উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -40


 


আমি আড়চোখে তাকিয়ে ওর মুখের ভাবকে লক্ষ্য করছিলাম । কিন্তু কেন এইভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । কোন অজুহাত দেখিয়ে বাহানা করে ওখান হতে সরে পড়লাম । বিকাশ ও দেবী কোন রূপ বাধা দিলো না । কিন্তু আমার মনের কৌতূহল রয়েই গেল । একটু পরে শুনলাম , সে বাড়ী গেছে । ওর বাবার শরীর খারাপের জন্য থাকতে পারেনি । ওর নাম জয়ন্ত তা পরিচয়ের সময় জেনেছিলাম । বিশেষ করে সে বিকাশের বাল্যবন্ধু বলেই এই বিয়েতে এসেছিলো নতুবা আসতো না । কারণ ওর বাবার শরীর অসুস্থ । বিকাশকে সে কথা বলে গেছে । কিছুক্ষণের মধ্যে ওর কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারবো কি ? কারণ তার চোখ কি চাইছিলো জানার কৌতুহল রয়ে গেল । বিকাশের বিয়েতে এসে মনটা অনেকখানি প্রফুল্লতায় ভরিয়ে তুলেছিলাম সত্যি তবে , জয়ন্তকে নিয়ে কেমন যেন একটা সমস্যা উদয় হলো । দেবীকে কোন কথা বলিনি । সব কথা চেপে রাখলাম । ধীরে ধীরে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো । বিকাশদের বিয়ে ব্যতীতে বৈদ্যুতিক আলোগুলো এক সময় জ্বলে উঠলো । মনে হলো আলোর শোভাতে একটা মোহময়ী রূপ চারিদিকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে । এমন ঝকঝকে বিভিন্ন আলোকসজ্জা কখনো দেখিয়ে দেবীর সাথে বাইরে এসে অনেকক্ষণ আলোর লুকোচুরি খেলা দেখেছি ময়নার নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছি । এক সময় আমাদের ডাক পড়লো । বিকাশ এবার রাজকুমারী আনতে যাবে । ভিনদেশে । বর বেশে আমার কাছে এসো । তার যাত্রা শুভ হোক প্রার্থনা করলাম ঈশ্বরের কাছে দেবী বিকাশের সাথে রওনা হলো । এতো বড় বাড়ীতে লোকগুলো কমে যেতে কোলাহলের মাত্রা বেশ কমলো । এক সময় মাসীমা আমায় ডাকলেন ও বললেন তিনি আমার সাথে গল্প করবেন । মাসীমাকে অনুসরণ করে তার শোবার ঘরে উপস্থিত হলাম । তিনি তার পাশে বসিয়ে বললেন , তোমার কথা বিকাশের কাছে শুনেছি । বিকাশ আমার পুত্র হলেও সে কোন কথা লুকায় না । কিছু মনে করো না মা , আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মা ও মেয়ের । বিকাশের কাছে তোমাদের পারিবারিক ঘটনা শুনে বড় দুঃখ পেয়েছি । তোমার বাবা দরিদ্র পীড়িত জীবনে বহু আশা আকাঙ্খা নিয়ে তোমার দাদাকে ডাক্তারী পড়াছিলেন , সে যদি ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো , তাহলে তোমাদের কোন ভাবনা চিন্তা থাকতো না । কিন্তু তোমাদের ভাগ্যের এমনি নিষ্ঠুর পরিহাস যে তোমাদের সব আশা আকাঙ্খা ধুলিসাৎ করে দিয়ে তোমার দাদার জীবনে করুণ ট্রাজেডি এনে ছিলো । যাক দুঃখ করে কি হবে । দেবীর কাছে নতুন জীবনে তুম সুখী হবে বলেই আশা রাখি । আচ্ছা মা , একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে ? তুমি কি অনেক পোকায় খাওয়া ফল ? ও কথা শুনে আমার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন হিমা হয়ে গেলো । এবার আমি সোজা হয়ে বসে থাকতে পারলাম না । আমার শরীরটা যেন ঘোর ঘোর করছে । আমার দম যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে আমি বমি করবো । পর পর দুই তিন বার হাই তুলে আর সামলাতে পারলাম না । প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাথরুমে গিয়ে বমি করলাম । ছানার মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো । মাসীমা আমাকে অনুসরণ করে বাথরুমে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন , কোন ভয় নেই মা , এ অম্লের বমি নয় , তুমি মা হতে চলেছো । আমি শিউরে উঠলাম । চলো আমার সাথে তোমার দুর্ভাবনাকে কাটিয়ে দিই । কি করবো ভাবছি , মনে হচ্ছে এখন হতে ছুটে পালিয়ে যাই । কিন্তু এমন পিঞ্জরাবদ্ধ যে কোন উপায় নেই । লজ্জা , ঘৃণা , পরিত্যাগ করে তার সাথে পুনরায় শোবার ঘরে হাজির হলাম । আমাকে তক্তাপোশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন , তুমি ভয় পাচ্ছো আমি তোমার সব কিছু জানতে পেরেছি বলে ? তাহলে তুমি জেনে থেকো মা , তুমি যেমন অনেক পোকায় খাওয়া , আমিও তেমনি দুই পুরুষের দংশনে ক্ষত হয়েছি । তবে কি বলতো পারো আমি অশুচি নই ? বহু সংসারে তোমার মতো নারী বিদ্যমান । তারা বধূ হয়ে নির্বিঘ্নে স্বামী পুত্র নিয়ে সংসার করছে । হয়তো তাদের অতীত সবার কাছে গোপন রাখে । যেমন আমার কথা ধরো , আমিও একজন শয়তানের পাল্লায় পড়ে গর্ভে বাচ্চা এনে নিজেকে অপবিত্র করেছিলাম । মা , বাবা , সেই অপবিত্রকে ঢাকা দিয়ে টাকার জোরে এক সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলের সাথে বিয়ে দিলেন । একবার তলিয়ে দেখলেন না আমি কি । টাকার জোরে সব সব তলিয়ে গেলো । হয়তো তলিয়ে গেল সত্য , কিন্তু আমি যে অশুচি তা কোনদিনই অকপটে অস্বীকার করতে পারবো না । আজ একথা তোমাকেই প্রকাশ করলাম , কারণ যাতে তোমার মন একটু হালকা হয় । বিকাশের কাছে তোমার ইতিহাস শুনে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করেছিলো । সে তোমাকে এ বিয়েতে আনতে রাজী হয়নি । বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে তার মনকে দুর্নিবার করে ওকে সত্যের সন্ধান দিয়েছি । প্রয়োজন যদি হয় দেবীকেও বুঝিয়ে বলবো । নানা আলোচনা , সমালোচনায় আমার মনের উদ্বেগ পরিস্কার করে দিলেন । মাসীমার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম । সেদিন মাসীমার কথায় অনেকখানি শক্তি পেয়ে ছিলাম । আমাদের কলঙ্কিত জীবনে অনেক সময় উল্কার মতো ঝড় আসছে । মানিয়ে নিতে হবে সেই ভয়ঙ্করকে । কারণ আমি যে একজন বারবণিতা , তাই নয় কি ? বিকাশদের বাড়ী হতে আপন বাড়ীতে এসে মনটা ভারী চঞ্চল হয়ে উঠল । দেবী নিশ্চয়ই জানবে আমি মা হতে চলেছি । কিন্তু প্রথমতঃ আমি তাকে জানাব কি করে । একথা দেবীর কানে গেলে সে নিশ্চয় আনন্দিত হবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । তবু তাকে একথা বলতে পারলাম না । বার বার চেষ্টা করেও আমার মুখকে বন্ধ করে দিতে লাগলো । দেবীর পাশে শুয়ে আছি মনটা বড় উসখুস করছে । পাশে ময়না গভীর ঘুমে আছন্ন । দেবীর পরের পর নবকল্লোলের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে আর বালিশের উপর মুখ গুঁজে আমি আমার ভাবনার রাজ্যে ডুবে আছি । এক সময় দেবী পাশ ফিরে শুতেই আমার প্রতি চোখ রেখে বলল , রমা , এখনো ঘুমোও নি ? কথা না বলে ঘাড় নাড়লাম । আমি লক্ষ্য করছি বিকাশদের বাড়ী হতে এসে তুমি কেমন যেন হয়ে গেছো । মাসীমা কি কিছু বলেছেন ? না । 

তাহলে এমন চিন্তান্বিত কেন ? কোন কথা না বলে দেবীর লোমশ বুকে হাত বুলোতে থাকলাম । কি করে ওকথা বলবো জানি না পুরুষেণ মন , হয়তো এই অবস্থায় তার মনে অনেক অশুভ চিন্তা ভাবনা এবং অমুলক সন্দেহ দেখা দিতেও পারে এই জন্যই আমার ভয় । অবশ্য আমার এই আসন্ন মাতৃত্বের জন্য দেবীদাস সন্দিগ্ধ হয়ে আমার উপর রূঢ় আচরণ করবে কথা আমার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করলো । দেবীর ডাকে আমার চিন্তার জালে ছেদ পড়লো । চিন্তা কিসের বলতো ? না , মানে - কি হয়েছে বলো না ? বলবো , রাগ করবে না তো ? বলেই দেখো না । তখন দেবীর লোমশ বুকের মধ্যে আমার হাত । আমি মা হতে চলেছি । রমা । আমাকে বুকে চেপে ধরলো । এই সংবাদ জানাবার জন্য এতো লজ্জা , তো ভয় ? এই সংবাদে আমি কি দুঃখিত হবো ভেবেছো ? আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম রমা । আর একথা মনে রাখতে যদি পুত্র লাভ করি নাম রাখবো বাপ্পা । আর মেয়ে হলে তুমিই ঠিক করবে সে নাম । দেবীর বুকে মুখ লুকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজে অনেকখানি শান্তি পেলাম । ভয় , ডর আমার কেটে যাচ্ছে বটে কিন্তু শেষ পরীক্ষা এখনও হয়নি । দেবীর বুক হতে মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম , বাবা কবে আসবেন । দেবীদাস স্বত্বঃস্পর্শভাবে বলল , সত্যি ও কথা বলতে ভুলে গেছি । বাবা আগামী সপ্তাহের মধ্যে আসবেন । সুশীলবাবুকে পত্র দিয়ে জানিয়েছেন এবং একথাও জানিয়েছেন আমি ব্যবসা বাণিজ্য ঠিক মতো তদারক করছি বলে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন । তোমার বাবা যদি আমাকে মেনে না নেন তাহলে কোথায় স্থান পাবো ? সে চিন্তা কোনদিন করবে না । মনে রাখবে সুশীলবাবু যখন তোমাকে মেনে নিয়েছেন বাবার দিক দিয়ে কোন বাধা বিঘ্ন আসবে না । সুশীলবাবু চিন্তা করেই আমাদের বিয়েতে মত দিয়েছেন । তিনি যখন বাবার বিশ্বস্ত বন্ধু সুতরাং ঐ চিন্তায় নিজেকে দূর্বল করে হেয়প্রতিপন্ন করো না । আরেকটা সুখবর আমাদের রেজেষ্টারী হচ্ছে আগামী পরশু দিন । সুশীলবাবু ও হাজির থাকছেন । দেবীদাসের কথা শুনে আর মনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা না রেখে নিদ্রায় মগ্ন হলাম । সেই নিদ্রায় এক দারুন স্বপ্ন দেখেছিলাম । আমার কোলে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার ন্যায় এক সন্তান আসছে । স্বপ্নে আমি ও দেবী আদরে , চুম্বনে নবজাত শিশুকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি । দেবী সন্তান লাভ করেছে বলে প্রচুর টাকা খরচা করছে । তিন দিন গরীব দুঃখীদের দান করছেন দেবীর বাবা । মহা আনন্দ সমারোহে ভরিয়ে তুলছেন রায় বাড়ীকে । এছাড়া আরো কত কি উৎসব । এ যেন এলাহি ব্যাপার । ঐ স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক সময় ঘুম ভেঙ্গে গেলো দেবীর হাত আমার দেহের উপর পড়তে । কোথায় আমার নবজাত শিশু আর কোথায় বা সেই এলাহি ব্যাপার । তবে কি এই স্বপ্ন আমার জীবনে একেবারে ব্যর্থ হবে ? যদি সেই স্বপ্ন ব্যথ হয় তবে বারে বারে আমার মনকে কেন আশা আকাঙ্খায় ভরিয়ে দেয় । আমার স্বপ্ন কি বাস্তবে রূপয়িত হবে না ? জীবন তরী কি মাঝদরিয়ায় ডুবে যাবে ? চিরকালই কি নৈরাশ্য ও ব্যর্থতার অন্ধকারে ডুবে থাকবো ? এই অন্ধকারের বুক ভেদ করে নতুন আকাশে সোনালী সূর্য কি উঠবে ? জানি না এরপর ভাগ্যে কি আছে ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024