বিকেলের নির্লিপ্ত রোদ্দুরে মেখে নেওয়া রক্ত স্নান প্রতিটি দেহান্তর উদ্ভাসিত করে। বেঁকে বসা হৃদয় অঙ্কুর একটু বিশ্রামের আশা রাখে। নরম কোলে বালিশ খোঁজা পাঠক বর্গ -- একটা প্রেমের খোঁজ করে। কল্পনার দর্শনে আগন্তুক নারী ফিকে হাসি দিয়ে অল্প সময়ে আরাম দেয়। প্রাণ সখীর সম্ভাষণ কিছুটা স্বস্তি দেয়। আসলে বন্ধুহীন পাঠকের জীবনে একটা সঠিক প্রীতিপূর্ণ মানুষের আগমন ঘটুক -- এটাই সাহিত্যের চাওয়া পাওয়া।
Sunday, July 30, 2023
জুলাই সংখ্যা 2023 || সম্পাদকীয় || July Sonkha 2023
চিনের কবিতা - শংকর ব্রহ্ম || Chiner Kobita - Sankar Brhama || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article
চিনের কবিতা
শংকর ব্রহ্ম
চিনা সাহিত্যের প্রধান ঐতিহ্য তার সুদীর্ঘ কালের ব্যাপ্তি ও অভিজ্ঞতা, অভিন্নতা এবং যুক্তিগ্রাহ্যতা।
খ্রীষ্টপূর্ব ছয়শো বছর আগে চিনের যে কবিতা বা গদ্য সাহিত্য পাওয়া গেছে তা (প্রকাশের ভাষার ও ভঙ্গির ভিন্নতা ছাড়া) মূলতঃ অভিন্ন রয়ে গেছে আজও। ধ্বনির পরিবর্তে ভাবমূলক লিপি পদ্ধতি ও ব্যাকরণের সল্পতায় তা সম্ভব হয়েছে।
চিন যুগে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একতাবদ্ধ করার পর প্রকাশের একতার প্রচেষ্টা হান যুগে (২০৬ খ্রীস্ট পূর্ব- ২২০ খ্রীষ্টাব্দ) আরও দৃঢ়মূল হয়েছে। এই সময় তারা
বহির্জগত বিচ্যুত হওয়ায় সাহিত্যের স্থিতবস্থা থেকে গেছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তার কিছুটা পরিবর্তন হয়।
বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
প্রাচীন কনফুসীয় সাহিত্য এবং পাঁচ ও সাত
অক্ষরে লেখা 'শিহ্ কবিতা' (জাপানী হাইকু কবিতার মতো) এদের প্রাচীন সাহিত্যের সম্পদ।
প্রাচীনতম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত
চিনের কাব্য রচনা মূখ্যত রাজকর্মচারীর ব্যাপার ছিল, একমাত্র ব্যতিক্রম তাং যুগের শ্রেষ্ট এবং বিশ্বের অন্যতম কবি 'লি পো'।
কবি তু ফু এবং লি পো দুই বন্ধু ছিলেন।
লি পো (৭০৫- ৭৬২ খ্রীষ্টাব্দ)
------------------------------
টিয়া
----------
দল বেঁধে কুঞ্জবনে সুন্দরীরা রত্ন সাজে
মনে মনে ভাবে কত কি যে,
কুঠরীর গোপন খবরগুলি,
বলি বলি করেও বলে না,
আকুলি বিকলি করে মনে।
কিন্তু টিয়ার খাঁচা বড় বেশী কাছে এসে দেখে
কোন কথা বলার সাহস নেই বুকে।
স্তব্ধ রাতে
---------------
খাটের পায়ার কাছে কি এতো করছে চিক্ মিক্
এখনই কি তুষার পাত শুরু হয়ে গেল?
উঠে বসে দেখি তা আলোর ঝিক্ মিক্
চাঁদ এসে ঘরে ঢুকে আছে,
আবার শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবি
ঘরে একা প্রিয়া বসে আছে।
নানকিং পানশালা বিদায়
------------------------------
শিমূলের তুলো বয়ে আনা দমকা বাতাস
সহসা এ পানশালা মদির গন্ধে ভরে তোলে
উ-প্রদেশের তরুণী সুরা ঢেলে বিদায় জানাতে এসে
শহরের বন্ধুদের সাথে পানে পীড়াপীড়ি করে,
পেয়াল উজার করে তারা পান করছে যখন,
আমার বিদায় সম্ভাষণ,
আহা যাও পুবে ছোটা ওই নদীটিকে বলো,
বন্ধুর প্রেমের চেয়ে
আরও দূরে কখনও সে যেতে পারে কিনা?
সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ,মানবিকতা বোধ, যুক্তিবাদ ,ব্যক্তিগত অনুভূতির সহজ প্রকাশ,অতীন্দ্রিয়তার স্পর্শ চীনা কবিতার চিরন্তন বৈশিষ্ট।
বিখ্যাত চীনা সাহিত্যের সমালোচক
'লিউ হ্ সি এহ্'( ৪৬৫-৫২২ খ্রীষ্টাব্দ) বলেছেন,
" বৎসর ও মাস ছুটে চলে যায়, আত্মা চিরস্থায়ী নয়, শুধু লেখার মধ্য দিয়েই মানুষ তার খ্যাতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে এবং আপন কীর্তিগুলোকে ব্যাপ্তি দিতে পারে।"
তাই দেখা যায়, সরকারী আধিকারিক থেকে
সম্রাট , সম্রাট-প্রিয়া , প্রধান মন্ত্রী , সেনাপতি , রাজনীতিবিদ ,সন্ত ও সাধারণ নর-নারী সকলেই কবিতা লিখেছেন।
গ্রীক বা সংস্কৃত কাব্যে যেমন মহাকাব্য আছে চীনা কাব্যে সেরকম কিছু নেই।
শুধু পাওয়া যায় গীতি কবিতা। চীনা সাহিত্যে কাব্যের নায়ক নায়িকারা কোন দেব-দেবী নয়, মর্তের মানব-মানবী।
বিপুল চিনা সাহিত্য সম্ভারে, দেশপ্রেম থাকলেও যুদ্ধের প্রশস্তি বা যৌনতার কোন নাম গন্ধ নেই। বাস্তব জীবনের দুঃখ কষ্টের রূপয়ণ করেই তারা চরম আনন্দ পেয়েছেন।
চীনের আদিতম কাব্যগ্রন্থ কনফুসিয়াস ( তার চিনা নাম - কুং ফু ৎজু- জন্ম ৫৫১ খ্রী.পূঃ) সংকলিত 'শিহ্- চিং'।
তিন হাজার কবিতা থেকে নির্বাচন করে এই গ্রন্থে তিনশ' পাঁচটি (৩০৫) সুরানুক্রমিক সাজানো হয়েছে।
এর অধিকাংশই লোকগীতিন,বাকী অংশের নাম
কুয়ো পেং বা 'দেশের হালচাল'।
তাং যুগকে (৬১৮-৯০৭ খ্রীষ্টাব্দ) চীনা কবিতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ের বিখ্যাত কবিরা হলেন-লি পো (যাদুকর কবি নামে খ্যাত) , তু ফু ( ঋষি কবি নামে খ্যাত), পাই চু-য়ি মেং ,হাও জান প্রমুখ।
তু ফু (৭১২-৭৭০ খ্রীষ্টাব্দ)
------------------------------
রাতের ভাবনা,যুদ্ধ ও শান্তি
------------------------------
বাগান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢোকে জ্যোৎস্নায়
চাঁদের কিরণ নাচে পাগলের মতো,
বাইরে পড়ছে শিশির ,আকাশের তারাগুলি দেখে।
জোনাকিরা এধারে ওধারে ভেসে চলে যায়
নদীচরে জলচর পাখি ডাকে তার সঙ্গীনীকে।
আর আমি?
যুদ্ধ বিদীর্ণ পৃথিবীর কথা ভেবে
অশান্তিতে ঘুমাতে পারি না।
ফুলের দিকে তাকিয়ে
------------------------------
জীবনের চেয়ে ফুল বেশি ভালবাসি
ভেবো না ভুলেও,
কুসুম শুকিয়ে গেলে ভয়ে হীম হয়ে যাই,
চোখের পলকে আমিও জরাজীর্ণ হবো।
ফুলের পাপড়িগুলি কত না সহজে
শুকিয়ে ছড়ায় চারিদিকে,
আহা কুঁড়িগুলি আরও ধীরে বিকশিত হলে
কত না যে ভাল হতো বলো?
লি পো-র কবিতার 'যাদু বাস্তবতা' মায়াময় করে
তুলেছে তার কাব্যকে। হৃদয় নিঙড়ানো তার সব শব্দ ব্যবহার পাঠককে আকুল করে তুলেছে।
এর পাশাপাশি লোকায়ত সাহিত্য ধারাও অব্যাহত ছিল নিশ্চিৎ ভাবেই।
তাং যুগের শেষ দিকে কাব্যে বিষয়বস্তুর চেয়ে, ধ্বনি উৎকর্ষের প্রাধান্য দেখা দেয়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিদেশী সাহিত্যের প্রভাবে (বিশেষ করে অনুবাদ সাহিত্য পড়ার ফলে) তাদের ঐতিহ্যবাহী চিন্তাধারায় কিছুটা চিড় ধরে। তারা তখন নতুন কাব্য ধারার মধ্য দিয়ে আপন সত্তাকে খুঁজে পেতে চাইল।
আফিনসেবী দরিদ্র চীন দেশের উর্বর মাটিতে , মার্কসবাদ বীজ বপনের উর্বরক্ষেত্র খুঁজে পেল।
১৯১৯ সালের আন্দোলন মূলতঃ রাজনৈতিক হলেও, এর ফলে আধুনিক চিনা কবিতার জন্ম হলো।
ওয়েন ই-তো ,হ্ স্ উ , চিহ্-মো , কুয়ো-মো-জো প্রমুখ চীনা কবিরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের রোমান্টিকতার সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁরা ভাষার সৌকুমার্যের উপর জোর দিলেন।
সাম্প্রতিক কালে চিনা সাহিত্যের প্রেরণা রাজনৈতিক সাম্যবাদ প্রচারের ফলে ,কবিতা তার মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেকটা বিচ্যুত হয়ে প্রচার সাহিত্যে পরিণত হয়েছে।
মাও ৎসে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬ খ্রীঃ)
------------------------------
তিনটি কবিতা
--------------------
১).
গিরি চূড়াগুলি
দ্রুত অশ্বে, উদ্যত চাবুক,পৃষ্ঠাসন কখনও না ছেড়ে
পিছনে তাকতে ছিল ভয়,
কারণ আকাশ মাথার উপরে দু'হাতের সামন্য
তফাৎ।
২).
গিরি চূড়াগুলি
ঝাপিয়ে চূর্ণতাকামী সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ যেন তারা,
কিংবা পূর্ণ উল্লম্ফনের ছোটা
দশ সহস্রাশ্ব যেন,সংগ্রাম সাগরে।
৩).
গিরি চূড়াগুলি
সুনীল ত্রিদিবভেদী,শীর্ষ বিন্ধু নয় অনুজ্জ্বল
আকাশ পড়ত বুঝি ভেঙে
এই স্তম্ভগুলির অভাবে।
অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী চীন অর্থাৎ তাইওয়ানের বর্তমানের কবিতা একটি অপূর্ব রূপ নিয়েছে। ১৯৪৯ সালের আগে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তাইওয়ান জাপানীদের দখলে ছিল।
জাপানী ভাষা ছাড়া অন্যকিছু ছাপা হতো না। এমনকি পান্ডুলিপি আকারেও কিছু পাওয়া যায়নি।
১৯৪৯ সালে মূল ভূখন্ডের সংস্কৃতি বহন করে কুড়ি লক্ষ চীনা সৈন্য তাইওয়ানে আসে।
মূল ভূখন্ড থেকে তাইওয়ান এক সংকীর্ণ উপসাগর দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তাই তাদের মানসিকতার বিচ্ছিন্নতাও হয়তো অতলান্তিক। তাইওয়ানের কবিরা একদিকে যেমন চিনের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভোলেনি , অন্যদিকে তেমনি বহির্জগতের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের ফলে নতুন ধ্যান ধারণা , আঙ্গিক গ্রহণ করে , অকল্পনীয় সৌন্দর্যময় কাব্য সৃষ্টি করেছে।
দুই ধারার কাব্য স্রোত স্ব স্ব বর্ণবৈশিষ্টে
অভিন্ন হলেও সতন্ত্র বৈচিত্র নিয়ে বয়ে চলেছে।
কোনদিন ওতপ্রতভাবে একধারা হবে কিনা
সে প্রশ্নের উত্তর আজও অমীমাংসীত।
কিছু তাইওনান কবিতা
------------------------
য়াং হুয়ান (১৯৩০-১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দ)
------------------------------
কবিতা
-------------
কবিতা অমর পুষ্প
জীবন মৃত্তিকায় উপ্ত হতে হয় তাকে,
কবিতা কাকলি ভরা পাখি
গীতিময় প্রাণবন্ত হৃদয়ে সবার।
মরি যে লজ্জায়
তুমি এলে যে কবিতা লিখি হৃদয়ে আমার,
তারা শুধু কালো অক্ষর
কবিতার বিবর্ণ নমুনা?
য়া হ্সুউয়ান (১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দ - মৃত্যু জানা নেই)
------------------------------
ঈশ্বর
----------
ঈশ্বর একা
চুপচাপ বসে গীর্জার জানলার নীচে,
কেননা বেদীটি থাকে
পুরহিতের জবর দখলে।
ফাং হ্সিন ( জন্ম - ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দ - মৃত্যু জানা নাই)
------------------------------
খোলা টেরিফোন বুথ
----------------------------
সঙ্গীহীন জনৈক যুবক
যুবতীর হাসি যেন একমুঠো চকচকে টাকা
মেঝেতে ছড়াল টুং টাং,
আমি নই খোলা টেলিফোন বুথ
আঃ নয় কখনোই -
এমন কি প্রত্যাশার মুদ্রাটিও তাতে
ফেলা যাবে না কখনও।
হ্সিউং হুং ( জন্ম- ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দ - মৃত্যু জানা নেই)
------------------------------
প্রতিশ্রুতি
---------------
একদিন তোমাকে তো আর আমি লিখব না চিঠি
তখন জানবে তুমি আমি আর নেই,
যখন অনেক দেরী হয়ে যাবে সখী
আমার দরজায় এসে যদি তুমি কর করাঘাত।
মরে গিয়েও প্রাণবন্ত থেকে যাব
শুধু প্রাণটুকু মিশে যাবে পঞ্চ উপাদানে,
স্রোতশীল নদীকে বলে যার আমার বেদনা
ঝিরি ঝিরি বাতাসকে বলে যাব
তোমাকে পাঠাতে সোহাগের কথা।
কাঁপা কাঁপা বাতাস এসে ছড়াবে আমার দীর্ঘশ্বাস
আগুনের শিখায় হবে বিচ্ছুরিত আমার কামনা
তুমি তুলে নেবে তাই ,পৃথিবীতে এ দেহের রক্ত
জন্ম দেবে অজস্র সুগন্ধী গোলাপ।
------------------------------
কবি ও অকবি - দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় || Kobi oo Okobi - Darpana Gangapadhyay || Short Story || ছোটগল্প
কবি ও অকবি
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
হিপ্রোটিজম বোঝো ? হিপ্রোটিজম করে করে মানুষকে কিভাবে মেরে ফেলা যায় । আজ তোমাদের তারই এক কাহিনী শোনাবো । বধির
করে দেওয়া যায় অনায়াসে।
পাড়ায় জগা আর সোমেন দুই ভাই খেলা করে। হাজার বন্ধু বান্ধব, জগা সবার সঙ্গে মেশে,
সোমেন সব সময় বন্ধুদের বলে ওর সাথে বেশি খেলার দরকার নেই ও ভালো ছেলে না।
নম্বর আমি ক্লাসে বেশি পাই সুতরাং আমি ভালো--- তোমরা আমার সঙ্গে মেশো আমার সঙ্গে খেলো ওর সাথে না, --- এভাবে বন্ধুদের থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে জগা ।
সব বন্ধুরাই জগাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা তামাশা করে সকলেই অ্যাভয়েড করে এভাবে জগা মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ।
বাড়িতেও সবাই জগা যেহেতু বড় ছেলে বাবা রিটায়ারের পর জগার ওপরই সব দায়িত্ব পড়ে।
ছোট বলে সোমেন গা বাঁচিয়ে বাড়ির বাইরে দূরে পড়াশোনার জন্য চলে যায়।
একদল টিউশনি এবং কোচিং এ পড়িয়ে বোনেদের পড়াশোনার দায়িত্ব বড় বোনের বিয়ের দায়িত্ব সব গ্রহণ করার পরেও নিজের লেখাপড়া পাশাপাশি চালিয়ে যায় ।
তার সঙ্গে নিজের লেখা লিখি ও চালিয়ে যায়। কলকাতার বিভিন্ন বড় বড় জায়গায় সে কবিতা পাঠে ডাক পায় ।
বড় বড় পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়।
এভাবে বেশ কিছু বছর চলে যাওয়ার পর সে এমএ পাস করে বিএড করে এবং চেষ্টা করে পিএইচডি করার
এসময় সে অনেক ইমপ্রুভ করে ফেলে নিজেকে কিন্তু ইহার ভাগ্য সহায় হয় না। কোন ভালো চাকরি জোটে না। সেই কোচিং এ পড়িয়েই বউ বাচ্চার দায়িত্ব পালন করতে হয়।
এভাবে তার ছেলেপুলেরাও বড় হয়ে যায় সে অনেক লেখালেখি করে যায় ,পত্রিকা চালিয়ে যায় ।
কিন্তু আর যোগাযোগ কারো সঙ্গে রাখতে পারে না ,অনেক চাপ থাকে তার সংসারের জোয়াল টানার।
রিটায়ারমেন্টের পর অসুস্থ হয়ে পড়ে মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে তার ফলে সে বাড়িতে বসে এবার লেখালেখি করার কথা ভাবছে যখন তখন এক অকবি তাকে বিভৎস ভাবে হিপ্রোটিজম করতে থাকে। প্রতিদিন সে তার কবিতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে এবং বলতে থাকে সে কবিতার হোল টাইমার সে বড়লোকের বকে যাওয়া ছেলে। বাবার পয়সায় বসে বসে খায় আর কবিতার দালালি করে। কিন্তু এই জগার পেছনে পড়ে যায়।
দিনের পর দিন সে প্রচার করতে থাকে যে সেই বিখ্যাত কবি তার ভীষণ নাম ডাক এবং সে খুব বড় বিখ্যাত কিন্তু তোমাকে কেউই চেনে না অথচ প্রতিদিন তাহলে বিখ্যাত কবি জগারবাড়ি কি করে ?
এখনো জগা একটি পত্রিকা চালায় এবং বেশ কিছু ভূমিকা লেখা ,পুস্তক সমালোচনা করা, প্রুফ দেখা ,নিজস্ব কাব্যগ্রন্থ লেখা চালিয়ে যায়।
এই অকবি তার কিছু দালাল
দিয়ে সে নিজেকে বড় প্রমাণ করার চেষ্টা করে ,তারাও তার আশেপাশে ঘোরে এবং বলে হ্যাঁ উনি বড় কবি উনি খেতে পারেন না ও কষ্টে থাকেন আসলে সব মিথ্যে ! ভাওতাবাজি।
দূরের লোকজন এসব কায়দা কানুন বুঝতে পারেনা তারা ভাবে হয়তো ছেলেটি খুব অভাবী
কেন অভাব ?
একটা সুস্থ সবল ছেলে কেন কিছু কাজ করতে পারে না ? যা থেকে তার পয়সা রোজগার হয় এবং নিজের সংসার টা চালাতে পারে। আসলে না, সে নিজেই গলাবাজি করে চিৎকার করে সবার সামনে,--- আমি বড় কবি ,আমি বড় কবি, বলে চিৎকার করে এবং বিখ্যাত, বিখ্যাত ,বলে চিৎকার করে--- জ্ঞানী গুণী এবং চেনা পরিচিত মানুষেরা ওর চিৎকারে চুপ হয়ে যায় ,মনে মনে সব বুঝলেও প্রকাশ্যে সেটা বলেনা ,কিন্তু অজ্ঞানী মানুষেরা ওকেই বড় করে তোলে ,দিনের পর দিন চলতে থাকে এইরকম অত্যাচার জগার ওপর ,---ফলে জগা বধির হয়ে যায়।
জগার লেখা কবিতার কোন সমালোচনা হয় না ,কেউ পড়ে না ,কেউ পাঠ করে না ,কোন আলোচনা হয় না।
এদিকে অকবি নিজের মনের কথা বানিয়ে গুছিয়ে সাজিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে পয়সা দিয়ে অন্য বাচিক শিল্পী দিয়েও তা বলাতে থাকে--- ফলে ক্রমশ বিখ্যাত হয়ে উঠতে থাকে ।
এভাবে কত কত সত্য রহস্য চাপা পড়ে যায় কে জানে।।
পুতুলের অন্নপ্রাশন - সান্ত্বনা ব্যানার্জী || Putuler Onnoprasan - Santwana Banerjee || Short Story || ছোটগল্প|
পুতুলের অন্নপ্রাশন
সান্ত্বনা ব্যানার্জী
"আরে অনু দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এসো
এসো, হারিয়ে যাবে কিন্তু!" বলতে বলতে ওর হাতটা ধরে হাঁটতে থাকে তপতী। এই প্রথম কলকাতায় দুর্গাঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে অনু
বন্ধুদের সঙ্গে। ওরে বাপরে!কি সুন্দর!!! যেমন
প্যান্ডেল, তেমন লাইট, তেমন থিম! আলোয় আলোয় একেবারে ইন্দ্রপুরী। তার ওপর কি নেই!
নানা রকমের খাবারের স্টল, সেরামিকের বাসন,
ঘর সাজানোর রকমারি শোপিস, পোশাক , সাজের জিনিস কত কি!গ্রামেই জন্ম কর্ম, শহরের সঙ্গে এভাবে মেশার সুযোগ এই প্রথম।
তাই যা দেখে তাই দেখেই অবাক হয়ে হাঁ করে
দাঁড়িয়ে পড়ে অনু।
ছেলের চাকরির সূত্রে মাস ছয়েক কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে এসেছে,আর পার্কে
হাঁটতে গিয়ে কয়েকজন বন্ধু পেয়েছে। নিজের
ভাগ্যকে কুর্নিশ জানায় অনু। ওর মত সাধারণ
গ্রামের মেয়েকে ওরা খুব অল্প দিনেই বড়ো আপন করে নিয়েছে। সামান্য একটু খালি গলায় গান যে ওদের এত ভালো লাগবে কে জানতো!ওদের আগ্রহেই পার্কে, কারও না কারও বাড়ীতে গান,কবিতার আসর বসে যায়। তপতী, সুমনা তো ওকে ছাড়া কোথাও যায় না। ওদের দৌলতে বেশ কয়েকটা ভালো সিনেমা, থিয়েটার, দেখে ফেলেছে অনু। এই দলে ক ' দিন
পর যুক্ত হলো পর্না। ভারি সুন্দর দেখতে। খোদ
কলকাতায় জন্ম, পড়াশোনা, গ্রাম দেখেনি সে ভাবে। কথাবার্তা সাজসজ্জা সব কিছুই কেতাদুরস্ত, একেবারেই অন্যরকম। কনভেন্টে
পড়া মেয়ে, বিলেত ফেরত হাজব্যান্ড, কথার মধ্যে বেশির ভাগই ইংরেজী শব্দ। কিন্তু আশ্চর্য
বন্ধুত্ব হতে একটুও সময় লাগলো না। খুব হাসিখুশি সহজ সরল। আর একটা অভিনব
অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়ে গেলো, পুতুলের অন্নপ্রাশন। অবাক হয়ে যায় অনু। তপতী হেসে
বলে," আরে পর্নার এক মেয়ে আর একটি পুতুল
ছেলে। তাকে উপলক্ষ্য করে একটু গেট টুগেদার
এই আর কি"।
অন্নপ্রাশন বাড়ীতে এসে তো অবাক! এলাহি আয়োজন। সঙ্গে সত্য নারায়ণ পুজো। পুজোর পর মানব শিশুর মতোই ধুতি, পাঞ্জাবী,
মালা চন্দন টোপর পরে সুসজ্জিত পুতুল ছেলের
অন্নপ্রাশন হলো মহা সমারোহে। আসন পেতে ,পঞ্চব্যঞ্জন কাঁসার থালা বাটিতে সাজিয়ে,
ছেলেকে বসিয়ে , ধান দূর্বা উলু শঙ্খধ্বনি সহযোগে আশীর্বাদ, পুতুল পুত্র কোলে নিয়ে স্বামী স্ত্রীর আনন্দে মাখা রাঙা মুখ, ফটো তোলা,
কিছুই বাদ গেলনা!তার পর রীতিমত ক্যাটারার
দিয়ে ভোজবাড়ীর মতোই খাওয়া দাওয়া!
বাড়ী ফিরে কি এক ঘোরের মধ্যে থাকে অনু। একটা পুতুল নিয়ে ওদের এই আনন্দ
আয়োজনে তো কোনো খামতি নেই! এমন কি আনন্দ খুশী তে ওরা যে ভরপুর হয়েছিল সে তো
মিথ্যে নয়! পুতুল সন্তান নিয়ে যদি ওরা এত আনন্দ পায় তবে মানব সন্তান নিয়ে তো আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে!
হঠাৎই অনুর চোখ আলোয় ঝলমল করে ওঠে! চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত মাসে
ছেলে বৌমার সঙ্গে দেখে আসা অনাথ আশ্রমটি।
ছোটো ছোটো মলিন মুখের শিশু গুলি যেন চেয়ে
আছে স্থির চোখে অনুর দিকে! তাড়াতাড়ি সেলাই মেশিনটা টেনে নিয়ে জড়ো করে রাখা ছিট গুলো নিয়ে বসে পড়ে অনু। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে বৌমা রূপসা,"কি হলো মা, এখন আবার সেলাই মেশিন নিয়ে বসলে যে!"ছোট ছোট জামা প্যান্ট তৈরী করার জন্য কাঁচি নিয়ে ছিট কাটতে কাটতে বলে অনু,"আজ একবার আমায় বাজার নিয়ে যাবি তো রূপসা, অনেক জামা, প্যান্ট, বিস্কুট লজেন্স, মিষ্টি কিনতে হবে, অনেক...!"
বিশ্ব নিখিল - দেবাংশু সরকার || Biswa Nikhil - Debanshu Sarkar || Short Story || ছোটগল্প
বিশ্ব নিখিল
দেবাংশু সরকার
"শুধু বিঘা দুই, ছিল মোর ভুঁই,
আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন ...।"
আবৃত্তি করছে তেরো বছরের ছোট্ট মধু। বেশ মন দিয়ে শুনছে মেজো বাবু। আবৃত্তি করতে করতে আটকে যাচ্ছে মধু। বারে বারে ভুল হচ্ছে। মেজো বাবু নিজেই ধরিয়ে দিচ্ছে,
"...বুঝেছো উপেন, এ জমি লইব কিনে..."
আবার আবৃত্তি করতে শুরু করলো মধু। এক নিঃশ্বাসে আবৃত্তি করলো বড় কবিতাটা।
আবৃত্তির শেষে খুব প্রশংসা করলো মেজ বাবু। বললো, "এত টুকু বয়সে এত বড় কবিতা আবৃত্তি করা চট্টিখানি কথা নয়। একটু আধটু ভুল হতেই পারে। আর কবিতাটাও দারুন। শুনলে মন ভরে যায়। অসাধারণ লিখেছেন আমাদের রবি ঠাকুর।"
- "জ্যাঠা বাবু আমরা স্কুল থেকে দার্জিলিং যাচ্ছি।"
- "বাঃ খুব ভালো। কবে যাচ্ছিস মধু।"
-"পরশু।"
- "রাম, তোরাও সঙ্গে যাচ্ছিস নাকি?"
- "রাম উত্তর দেয় - "না, কেবল মধু বন্ধুদের সঙ্গে, স্যারেদের সঙ্গে যাচ্ছে।"
- "তোরাও এই সুযোগে ঘুরে আসতে পারতিস। আমি যদি আগে জানতাম, তোদের দুজনের হোটেল, ট্রেনের টিকিট সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতাম। সারা জীবনটাতো পার্টিকে দিলি। এবার নিজের বউয়ের দিকে একটু তাকা।"
রথীন রায় চৌধুরি ওরফে মেজো বাবু। উচ্চ শিক্ষিত। গত পনেরো বছর ধরে স্থানীয় এম এল। বনেদি বংশে জন্ম তার। এক সময়ে জমিদারী ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের। ছোটো থেকে অভাব কাকে বলে সে দেখেনি। পড়াশোনা করেছে মন দিয়ে। স্কুল জীবনে বেশ ভালো ছাত্র ছিল। জমিদার পরিবারে জন্মালেও নাক উঁচু ভাব তার ছিল না। অত্যন্ত মিশুকে রথীন ছোট থেকেই এলাকার মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করত। রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই তার যথেষ্ট জন সংযোগ ছিল। গ্রাম্য জীবনে জমিদার বাড়ির প্রভাব এবং জন সংযোগের ক্ষমতা রথীনের রাজনৈতিক জীবনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। জমিদার বাড়ির ছেলে হলেও গ্রামের মানুষজন তাকে তাদের একজন ভাবতো। তার প্রভাব ভোট বাক্সেও পড়তো। যখনই রথীন ভোটে দাঁড়িয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছে। তার দেখাদেখি তার দাদা এবং অনান্য ভাইরা রাজনীতি আসে এবং সাফল্য লাভ করে। অবশ্য রথীন প্রথম থেকেই রাম, পলাশ, নীলদের মত পরিশ্রমী সাথীদের সঙ্গে পেয়েছে। রাম, পলাশ, নীলদের নিরলস পরিশ্রম রথীনের এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করেছে।
দোষ গুন নিয়েই মানুষ। রথীনও তার
ব্যতিক্রম নয়। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত বইছে বলেই হয়তো তবলা, সারেঙ্গী, ঘুঙুর এবং ডবল ডবলিউর প্রতি তার একটা আসক্তির কথা শোনা যেত। নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে এসবের মাধ্যমে নিজের মনকে রিচার্জ করতো সে। হাতে অগাধ টাকা, রথীন ভাবতো টাকা দিয়ে সব কিছু হাসিল করা যায়। প্রথম যৌবনে শীলাকে বেশ ভালো লাগে রথীনের। সে কথা ব্যক্ত করে শীলার কাছে। কিন্তু রথীনের চরিত্রে কিছু দোষ আছে বলে, শীলা সরাসরি না করে দেয়। হয়তো এই ধাক্কাটা রথীনের দরকার ছিল। এরপর সে নিজেকে শুধরে নেয়। ভুলে যায় শীলাকে। কিন্তু সত্যিই কি সে সব কিছু ভুলতে পেরেছে? ভুলতে পেরেছে সেই অপমান? হয়তো পারে নি! হয়তো অবচেতন মনে রয়ে গেছে সেই অপমান! এই অপমান চাবুক চালায় তার নীল রক্তে। কিন্তু তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে হজম করে নেয় সেই অপমান।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বিশ্বাসী মাঝি রাম, নীল, পলাশদের সহায়তায় তরতরিয়ে এগিয়ে চলে তার রাজনীতির পালতোলা নৌকা।
এর মধ্যে রথীন বিয়ে করে সংসারী হয়। বিয়ে করে রাম, পলাশরাও। রাম বিয়ে করে ঘরে আনে তার বহু দিনের প্রেয়সী শীলাকে। শীলা অবশ্য রথীনের দেওয়া প্রস্তাবের কথা গোপন করে যায় রামের কাছে। রাম সব কিছু জেনেও না জানার ভান করে।
সময় এগিয়ে চলে। সফল এম এল এ রথীন এখন স্বপ্ন দেখছে এম পি হওয়ার। তাহলে কে বিধানসভা উপ নির্বাচনে দাঁড়াবে? নীল নাকি রাম? ওপর মহলও দ্বিধায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী নীল এই সুযোগটা কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সে জানে এই বিষয়ে শেষ রায়টা রথীন দেবে। চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে নীল। বারে বারে সে রথীনকে মনে করাতে থাকে সেদিনের অপমানের কথা। শীলার ঔদ্ধত্বের কথা। রথীনের জমিদারী রক্ত ক্রমশ গরম হতে থাকে। প্রতিশোধের জন্য ছটফট করতে থাকে সে।
রামের ছেলে মধু বেড়াতে গেছে। কয়েক দিন বাড়ি থাকবে না। অর্থাৎ একটু হলেও বাড়ি ফাঁকা থাকবে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। যা করার এর মধ্যে করতে হবে। চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে নীল। রথীনকেও সঙ্গে পেয়ে যায়।
পরের দিন রাম, নীলকে ডেকে রথীন বললো, "তোদের দুজনকে কাল পার্টির হেড অফিসে যেতে হবে। জানিসতো এবার আমি লোকসভা ভোটে দাঁড়াবো। এম এল এ পোস্ট খালি হবে। সেই উপ নির্বাচনে কাকে দাঁড় করানো হবে সেটা নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি তোদের মত পার্টির অ্যাক্টিভ কর্মীদের মতামত নেবে, তাই ডেকে পাঠিয়েছে। লোকসভা ভোটের জন্য এখন পার্টি অফিসে সবাই খুব ব্যস্ত। তোদের দুপুরের পরে যেতে বলেছে। বেশি রাত হলে ওখানে থেকে যাবি। থাকার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কোনো অসুবিধা হবে না।
পরের দিন তারা পার্টির হেড অফিসে হাজির হল। কথা বার্তা সারতে সারতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে গেল। আর ফেরার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে সেখানে থেকে গেল তারা। পুরানো আমলের তৈরি পার্টি অফিসের ছাদের কড়ি কাঠ গুনতে গুনতে রাত কেটে গেল রামের। কোনো এক অজানা আশঙ্কা যেন জড়িয়ে ধরে তাকে। নিজের অজান্তেই সে বারে বারে কেঁপে ওঠে।
অন্যদিকে সেই রাত এক কাল রাত হয়ে নেমে এলো শীলার জীবনে। সেই রাতে তার সঙ্গে যা ঘটেছিল সেটাকে পাশবিক অত্যাচার বললে হয়তো পশুরা মানহানির মামলা করতে পারে।
শ্লীলতাহানি ছাড়াও চোদ্দটা ছুরিকাঘাত নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা শীলার মৃত দেহটা পরের দিন সকালে রাম আবিষ্কার করে। নীল কিছু একটা চক্রান্ত করছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল রাম। কিন্তু সেটা যে এত বড়, এত মারাত্মক হতে পারে সেটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি! সেই সঙ্গে মেজো বাবুও যে এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে সেটাও তার বুদ্ধির অগম্য ছিল।
শোকগ্রস্থ রাম নিজেকে সামলে নিয়ে থানায় যায়। সরাসরি নীল আর রথীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে। বিরোধীরা এই ইস্যুটাকে লুফে নিয়ে জোরদার প্রচার শুরু করেছে। শাসক দলের অন্তর্কলহকে সামনে আনতে চাইছে। এর মধ্যে মধু বাড়ি ফিরে এসেছে। তার দিকেও নজর দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে নীল, রথীন আত্মরক্ষার জন্য, দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য নতুন করে চক্রান্তের জাল বুনে যাচ্ছে। তারাও রটাতে শুরু করেছে যে রাম আসন্ন উপ নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
মাঝ রাতে দরজায় টোকা। ভেতরের ঘরে মধু ঘুমোচ্ছে। রাম দরজা খুলতেই হাত পড়লো রিভলভরের ট্রিগারে। ছুটলো গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়েও আর্তনাদ না করে চিৎকার করে রাম বললো, "মধু পালা। এরা আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না।" কথা শেষ হতেই রামের নিথর দেহটা ধড়াস করে মাটিতে পড়ে গেল।
খিড়কির দরজা খুলে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলো মধু। মা, বাবা, বাড়ি, ঘর, জমি, জায়গা সব হারিয়ে সে প্রাণপণে ছুটে চলেছে কেবল প্রাণটুকু বাঁচানোর জন্য। প্রাণ ভয়ে ছুটে চলেছে মধু। কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে সে নিজেই জানে না। ছুটতে ছুটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। মাথায় চোট লাগে। অজ্ঞান হয়ে যায়।
জ্ঞান ফিরলে মধু নিজেকে একটা ঘরে আবিষ্কার করে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন গেরুয়াধারী। গেরুয়াধারীদের দেখে মধুর মনে হচ্ছে তারা যেন কেউ মানুষ নন। একেক জন স্বর্গীয় দেবদূত। বিগলিত করুণা যেন চুঁইয়ে পড়ছে তাদের শরীর থেকে। খুব আপন মনে হচ্ছে তাদের। মনে হচ্ছে তাদের কাছে সব কথা খুলে বলা যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে মধু। সব কথা খুলে বলে তাদের।
- "কে বলেছে তুমি সব কিছু হারিয়ে ফেলেছো? এই বিশ্ব নিখিল তোমার। একে গড়ে তোলো নতুন পৃথিবী হিসেবে। যেখানে হিংসা থাকবে না, দ্বেষ থাকবে না, অভাব থাকবে না, অনাহার থাকবে না। কে বলেছে তুমি নিঃস্ব হয়ে গেছ? তোমার মধ্যেই আছে সেই অমোঘ শক্তি। সেই শক্তিকে সঠিক কাজে লাগাও, সত্যের কাজে লাগাও, ধর্মের কাজে লাগাও। আমি মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছি তোমার মধ্যে আছে সেই ক্ষমতা, সেই দক্ষতা, সেই তেজস্বীতা, সেই বলিষ্ঠতা। হয়তো সর্ব শক্তিমানের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে তোমাকে নিয়ে। হয়তো তিনি চান না তোমাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে। হয়তো তিনি তোমাকে দেখতে চাইছেন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে। তোমাকে দিয়ে হয়তো তার বিশেষ কোনো কাজ করাতে চাইছেন। হয়তো সেই জন্যই তুমি ছুটতে ছুটতে ঠিক আশ্রমের সামনেই অজ্ঞান হয়ে গেলে। এখন তুমি ছোট। অনেক কিছুই বুঝতে পারবে না। তার জন্য ধৈর্য ধর। আশ্রমের শিক্ষায় নিজেকে তৈরী কর।"
- "কিন্তু আমি যে আমার বাবা মাকে হারিয়ে ফেলেছি!"
- "না, তাঁরা হারিয়ে যায় নি। তাঁরা আছেন।হয়তো এই ধরাধামে নেই। অন্যত্র আছেন। তুমি তাদের দেখতে পাচ্ছো না। কিন্তু তাঁরা সব সময়ে তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। সব কিছু এখন বুঝতে পারবে না। বড় হও সব বুঝবে।"
আশ্রমের শিক্ষায়, আশ্রমের আদর্শে বড় হতে থাকে মধু। শিক্ষার বাইরেও অনেক কিছু সে জানতে চায়।
- "গুরুদেব এর নাম আশ্রম কেন?"
- "কারন আমরা বৈদিক আশ্রমিক আদর্শে জীবন যাপন করি তাই এর নাম আশ্রম। আর মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবে আমরা তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ। একাকি আমরা কিছুই করতে পারি না। সেইজন্য প্রয়োজন একতা এবং সংহতি। সেইজন্য আমাদের আশ্রমের নামের সঙ্গে 'সংঘ' শব্দটা যুক্ত। যেদিন আমরা সমস্ত মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারবো, সেদিন পৃথিবীর রূপ পাল্টে যাবে।"
বড় হতে থাকে মধু। বুঝে নিতে থাকে তার দায়িত্ব। এতদিনে সে আত্মস্থ করেছে চার দেওয়ালে ঘেরা কংক্রিটের মেঝে, কংক্রিটের ছাদ তার জন্য নয়। সবুজ পৃথিবীটা তার ঘর। নীল আকাশ তার ছাদ।
ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে তরুণ সন্ন্যাসী মধুর নাম। যেখানে বিপর্যয় সেখানেই হাজির মধু। সঙ্গে পৃথিবীকে নতুন করে গড়ে তোলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আরো কিছু তরুণ। এরা ধর্মযোগী নয় কর্মযোগী। গীতা পাঠের থেকে ফুটবল খেলা এদের কাছে বেশি গুরুত্বের। মানুষের মন থেকে লোভ, হিংসা, দ্বেষকে সরিয়ে দেওয়াই এদের লক্ষ্য।
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গেছে সুন্দর বন। লোনা জলে ভরে গেছে চরাচর। খাবার নেই, পানীয় জল নেই। পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে স্থানীয় চাষাবাদ। অসহনীয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে প্রান্তিক মানুষগুলো। ঘরে ঘরে হাহাকার, মৃত্যু যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা দেখে শুনে চুপ করে থাকতে পারে না মধুর দল। তারা পৌছে গেছে সেখানে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুন্দরবন এলাকায়। সংগ্রহ করে আনা ত্রাণ সামগ্রী পৌছে দিচ্ছে ঘরে ঘরে। অসুস্থ মানুষদের তুলে নিয়ে আসছে সদর হাসপাতালে। তাদের সুস্থ করিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভেঙে পড়া ঘরগুলো নিজের হাতে মেরামত করছে তরুণ সন্ন্যাসীর দল। যথেষ্ট কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের। দিনে দুবেলা তারা যা খাচ্ছে সেটা প্রায় অখাদ্যের পর্যায়ে পড়ে। রাতে যেখানে শুতে হচ্ছে, গোয়াল ঘর সেই স্থানের থেকে কোনো অংশে খারাপ নয়! মুখ বুজে সেই সব কষ্ট সহ্য করছে তারা। তার পরেও এক অনাবিল হাসির রেখা ফুটে রয়েছে তাদের মুখে।
অবশেষে লোনা জল নামলো। ঘরে ফিরলো প্রান্তিক মানুষগুলো। তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তরুণ সন্ন্যাসীদের প্রতি। কাজ শেষে মধুরাও তৈরি হচ্ছে আশ্রমে ফেরার জন্য। গ্রামবাসীরা দল বেঁধে এসেছে তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কি বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না।
মধু গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বললো, "কাল সকালে আমরা চলে যাব। আমাদের এখন অনেক কাজ।"
মধুর দল কালই চলে যাবে শুনে অনেকের চোখে জল এসে গেল। সজল চোখের নীরব ভাষা পড়তে মধুর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না। গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে সে বললো,
- "বুঝতে পারছি তোমরা কি বলতে চাইছো। তোমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছোতো। কিন্তু কৃতজ্ঞতা লাভের জন্য আমরা এতদুরে আসিনি। এত পরিশ্রম করিনি। আমার একটা কথা যদি তোমরা রাখো তাহলেই আমরা খুশী হব।"
- "কি কথা ঠাকুর?" হাজার কন্ঠ থেকে প্রশ্ন ভেসে এলো।"
- "কথা দাও এবার থেকে তোমরা নিজেরা নিজেদের দেখবে।"
- "হ্যাঁ ঠাকুর দেখবো। তোমার কথা আমার কাছে আদেশ। সেই আদেশ আমরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবো।"
- "নিজেদের বলতে তোমরা কাদের বোঝো?"
- "আমাদের বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, গাঁয়ের লোক।"
- "ভিন গাঁয়ের লোক কেন তোমাদের নিজেদের লোক নয়? ভিন জেলার লোক কেন তোমাদের নিজেদের লোক নয়? ভিন রাজ্যের লোক কেন তোমাদের নিজেদের লোক নয়? এবার থেকে সবাইকে নিয়ে ভাবতে থাকো।"
- তাই ভাব ঠাকুর। এবার থেকে সবাইকে নিয়ে ভাববো। সবাইকে নিয়ে বাঁচবো।"
- "এখানে আমরা মাত্র বারোজন এসেছি। যদি আমাদের সঙ্গে পাঁচশো জন লোক থাকতো তাহলে কত সুবিধা হত! তোমরা আরো তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে পারতে। অনেক কম মানুষ মারা যেত। তাই বলছি দুর দুরান্তরে যদি কখনো কোনো বিপদ বিপর্যয় ঘটে, তোমরা তোমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেতো?"
- "দেবো ঠাকুর দেবো। না হলে যে আমরা নিজেদের মানুষ বলে ভাবতে পারবো না।"
মধু জানে আজ এরা যা বলছে, কাল সব ভুলে যাবে। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডির মধ্যে আটকে যাবে। কিন্তু তাই বলে হতাশ হলে চলবে না। বারে বারে ঘা দিয়ে ঘুমন্ত অচৈতন্য মানুষদের জাগাতে হবে। তাদের চেতনা ফেরাতে হবে। তারজন্য ধৈর্য ধরতে হবে। একটা ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে কঠোর থেকে কঠোরতম প্ররিশ্রম করতে হবে। সাধনা করতে হবে।
মধু এর আগে উত্তর বঙ্গে মানুষের হিতার্থে কাজ করে এসেছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মত আদিবাসী অধ্যুষিত অনুন্নত জেলাগুলোতেও মানুষের জন্য কাজ করে মানুষের মন জয় করেছে। তাদের হৃদয়ে নিজের একটা ছাপ রেখে এসেছে। এবার সে জিতে নিল দক্ষিণ বঙ্গের প্রান্তিক মানুষদের মন। এখন সে ভাবছে সত্যিই এই পৃথিবী তার ঘর। অজস্র তারা খচিত নীল আকাশ তার ছাদ। আজ সে এখানে। হয়তো কাল অন্য কোথাও যেতে হবে। যেতে হবে কোনো পথে, প্রান্তরে, গুহায়, কন্দরে। ছুটে চলেছে সে। বিরামহীন ছুটে চলেছে। নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার আনন্দে সে ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে সে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
রাতের দিকে মধু ফোন করে আশ্রমের অধ্যক্ষ তথা তার গুরুদেবকে,
- "গুরুদেব, আমাদের এখানের কাজ আপাতত শেষ। কাল ফিরছি। দেড় হাজার মানুষকে আমরা উদ্ধার করেছি। ঘরে ফিরিয়েছি।"
- " মাত্র দেড় হাজার মানুষকে উদ্ধার করলে হবে না মধু। দেড়শো কোটি অসহায় ডুবন্ত মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের যে টেনে তুলতে হবে। মহা সংগ্রামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর। ওঠো, জাগো।"
হ্যাঁ, বেশ ভোরেই উঠে পড়েছে মধু। উদিত সূর্যের প্রথম কিরণের চোখে চোখ রেখে আজ আবার সে আবৃত্তি করছে,
"...মনে ভাবিলাম,
মরে ভগবান রাখিবে না মোহ গর্তে।
তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল,
দুবিঘার পরিবর্তে...।"
না, আজ আর তার কোনো ভুল হচ্ছে না।