বিশ্ব নিখিল - দেবাংশু সরকার || Biswa Nikhil - Debanshu Sarkar || Short Story || ছোটগল্প

    বিশ্ব নিখিল 

          দেবাংশু সরকার



      "শুধু বিঘা দুই, ছিল মোর ভুঁই,

       আর সবই গেছে ঋণে।

      বাবু বলিলেন ...।"



      আবৃত্তি করছে তেরো বছরের ছোট্ট মধু। বেশ মন দিয়ে শুনছে মেজো বাবু। আবৃত্তি করতে করতে আটকে যাচ্ছে মধু। বারে বারে ভুল হচ্ছে। মেজো বাবু নিজেই ধরিয়ে দিচ্ছে,



     "...বুঝেছো উপেন, এ জমি লইব কিনে..."



      আবার আবৃত্তি করতে শুরু করলো মধু। এক নিঃশ্বাসে আবৃত্তি করলো বড় কবিতাটা।



      আবৃত্তির শেষে খুব প্রশংসা করলো মেজ বাবু। বললো, "এত টুকু বয়সে এত বড় কবিতা আবৃত্তি করা চট্টিখানি কথা নয়। একটু আধটু ভুল হতেই পারে। আর কবিতাটাও দারুন। শুনলে মন ভরে যায়। অসাধারণ লিখেছেন আমাদের রবি ঠাকুর।"



        - "জ্যাঠা বাবু আমরা স্কুল থেকে দার্জিলিং যাচ্ছি।"



      - "বাঃ খুব ভালো। কবে যাচ্ছিস মধু।"



      -"পরশু।"



      - "রাম, তোরাও সঙ্গে যাচ্ছিস নাকি?" 



      - "রাম উত্তর দেয় - "না, কেবল মধু বন্ধুদের সঙ্গে, স্যারেদের সঙ্গে যাচ্ছে।"



      - "তোরাও এই সুযোগে ঘুরে আসতে পারতিস। আমি যদি আগে জানতাম, তোদের দুজনের হোটেল, ট্রেনের টিকিট সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতাম। সারা জীবনটাতো পার্টিকে দিলি। এবার নিজের বউয়ের দিকে একটু তাকা।"



      রথীন রায় চৌধুরি ওরফে মেজো বাবু। উচ্চ শিক্ষিত। গত পনেরো বছর ধরে স্থানীয় এম এল। বনেদি বংশে জন্ম তার। এক সময়ে জমিদারী ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের। ছোটো থেকে অভাব কাকে বলে সে দেখেনি। পড়াশোনা করেছে মন দিয়ে। স্কুল জীবনে বেশ ভালো ছাত্র ছিল। জমিদার পরিবারে জন্মালেও নাক উঁচু ভাব তার ছিল না। অত্যন্ত মিশুকে রথীন ছোট থেকেই এলাকার মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করত। রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই তার যথেষ্ট জন সংযোগ ছিল। গ্রাম্য জীবনে জমিদার বাড়ির প্রভাব এবং জন সংযোগের ক্ষমতা রথীনের রাজনৈতিক জীবনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। জমিদার বাড়ির ছেলে হলেও গ্রামের মানুষজন তাকে তাদের একজন ভাবতো। তার প্রভাব ভোট বাক্সেও পড়তো। যখনই রথীন ভোটে দাঁড়িয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছে। তার দেখাদেখি তার দাদা এবং অনান্য ভাইরা রাজনীতি আসে এবং সাফল্য লাভ করে। অবশ্য রথীন প্রথম থেকেই রাম, পলাশ, নীলদের মত পরিশ্রমী সাথীদের সঙ্গে পেয়েছে। রাম, পলাশ, নীলদের নিরলস পরিশ্রম রথীনের এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করেছে।



      দোষ গুন নিয়েই মানুষ। রথীনও তার 

ব্যতিক্রম নয়। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত বইছে বলেই হয়তো তবলা, সারেঙ্গী, ঘুঙুর এবং ডবল ডবলিউর প্রতি তার একটা আসক্তির কথা শোনা যেত। নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে এসবের মাধ্যমে নিজের মনকে রিচার্জ করতো সে। হাতে অগাধ টাকা, রথীন ভাবতো টাকা দিয়ে সব কিছু হাসিল করা যায়। প্রথম যৌবনে শীলাকে বেশ ভালো লাগে রথীনের। সে কথা ব্যক্ত করে শীলার কাছে। কিন্তু রথীনের চরিত্রে কিছু দোষ আছে বলে, শীলা সরাসরি না করে দেয়। হয়তো এই ধাক্কাটা রথীনের দরকার ছিল। এরপর সে নিজেকে শুধরে নেয়। ভুলে যায় শীলাকে। কিন্তু সত্যিই কি সে সব কিছু ভুলতে পেরেছে? ভুলতে পেরেছে সেই অপমান? হয়তো পারে নি! হয়তো অবচেতন মনে রয়ে গেছে সেই অপমান! এই অপমান চাবুক চালায় তার নীল রক্তে। কিন্তু তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে হজম করে নেয় সেই অপমান।



      দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বিশ্বাসী মাঝি রাম, নীল, পলাশদের সহায়তায় তরতরিয়ে এগিয়ে চলে তার রাজনীতির পালতোলা নৌকা। 



      এর মধ্যে রথীন বিয়ে করে সংসারী হয়। বিয়ে করে রাম, পলাশরাও। রাম বিয়ে করে ঘরে আনে তার বহু দিনের প্রেয়সী শীলাকে। শীলা অবশ্য রথীনের দেওয়া প্রস্তাবের কথা গোপন করে যায় রামের কাছে। রাম সব কিছু জেনেও না জানার ভান করে।



      সময় এগিয়ে চলে। সফল এম এল এ রথীন এখন স্বপ্ন দেখছে এম পি হওয়ার। তাহলে কে বিধানসভা উপ নির্বাচনে দাঁড়াবে? নীল নাকি রাম? ওপর মহলও দ্বিধায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী নীল এই সুযোগটা কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সে জানে এই বিষয়ে শেষ রায়টা রথীন দেবে। চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে নীল। বারে বারে সে রথীনকে মনে করাতে থাকে সেদিনের অপমানের কথা। শীলার ঔদ্ধত্বের কথা। রথীনের জমিদারী রক্ত ক্রমশ গরম হতে থাকে। প্রতিশোধের জন্য ছটফট করতে থাকে সে।



      রামের ছেলে মধু বেড়াতে গেছে। কয়েক দিন বাড়ি থাকবে না। অর্থাৎ একটু হলেও বাড়ি ফাঁকা থাকবে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। যা করার এর মধ্যে করতে হবে। চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে নীল। রথীনকেও সঙ্গে পেয়ে যায়।



      পরের দিন রাম, নীলকে ডেকে রথীন বললো, "তোদের দুজনকে কাল পার্টির হেড অফিসে যেতে হবে। জানিসতো এবার আমি লোকসভা ভোটে দাঁড়াবো। এম এল এ পোস্ট খালি হবে। সেই উপ নির্বাচনে কাকে দাঁড় করানো হবে সেটা নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি তোদের মত পার্টির অ্যাক্টিভ কর্মীদের মতামত নেবে, তাই ডেকে পাঠিয়েছে। লোকসভা ভোটের জন্য এখন পার্টি অফিসে সবাই খুব ব্যস্ত। তোদের দুপুরের পরে যেতে বলেছে। বেশি রাত হলে ওখানে থেকে যাবি। থাকার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কোনো অসুবিধা হবে না।



      পরের দিন তারা পার্টির হেড অফিসে হাজির হল। কথা বার্তা সারতে সারতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে গেল। আর ফেরার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে সেখানে থেকে গেল তারা। পুরানো আমলের তৈরি পার্টি অফিসের ছাদের কড়ি কাঠ গুনতে গুনতে রাত কেটে গেল রামের। কোনো এক অজানা আশঙ্কা যেন জড়িয়ে ধরে তাকে। নিজের অজান্তেই সে বারে বারে কেঁপে ওঠে।



      অন্যদিকে সেই রাত এক কাল রাত হয়ে নেমে এলো শীলার জীবনে। সেই রাতে তার সঙ্গে যা ঘটেছিল সেটাকে পাশবিক অত্যাচার বললে হয়তো পশুরা মানহানির মামলা করতে পারে। 



      শ্লীলতাহানি ছাড়াও চোদ্দটা ছুরিকাঘাত নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা শীলার মৃত দেহটা পরের দিন সকালে রাম আবিষ্কার করে। নীল কিছু একটা চক্রান্ত করছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল রাম। কিন্তু সেটা যে এত বড়, এত মারাত্মক হতে পারে সেটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি! সেই সঙ্গে মেজো বাবুও যে এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে সেটাও তার বুদ্ধির অগম্য ছিল।



      শোকগ্রস্থ রাম নিজেকে সামলে নিয়ে থানায় যায়। সরাসরি নীল আর রথীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে। বিরোধীরা এই ইস্যুটাকে লুফে নিয়ে জোরদার প্রচার শুরু করেছে। শাসক দলের অন্তর্কলহকে সামনে আনতে চাইছে। এর মধ্যে মধু বাড়ি ফিরে এসেছে। তার দিকেও নজর দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে নীল, রথীন আত্মরক্ষার জন্য, দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য নতুন করে চক্রান্তের জাল বুনে যাচ্ছে। তারাও রটাতে শুরু করেছে যে রাম আসন্ন উপ নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।



      মাঝ রাতে দরজায় টোকা। ভেতরের ঘরে মধু ঘুমোচ্ছে। রাম দরজা খুলতেই হাত পড়লো রিভলভরের ট্রিগারে। ছুটলো গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়েও আর্তনাদ না করে চিৎকার করে রাম বললো, "মধু পালা। এরা আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না।" কথা শেষ হতেই রামের নিথর দেহটা ধড়াস করে মাটিতে পড়ে গেল।



      খিড়কির দরজা খুলে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলো মধু। মা, বাবা, বাড়ি, ঘর, জমি, জায়গা সব হারিয়ে সে প্রাণপণে ছুটে চলেছে কেবল প্রাণটুকু বাঁচানোর জন্য। প্রাণ ভয়ে ছুটে চলেছে মধু। কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে সে নিজেই জানে না। ছুটতে ছুটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। মাথায় চোট লাগে। অজ্ঞান হয়ে যায়।



      জ্ঞান ফিরলে মধু নিজেকে একটা ঘরে আবিষ্কার করে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন গেরুয়াধারী। গেরুয়াধারীদের দেখে মধুর মনে হচ্ছে তারা যেন কেউ মানুষ নন। একেক জন স্বর্গীয় দেবদূত। বিগলিত করুণা যেন চুঁইয়ে পড়ছে তাদের শরীর থেকে। খুব আপন মনে হচ্ছে তাদের। মনে হচ্ছে তাদের কাছে সব কথা খুলে বলা যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে মধু। সব কথা খুলে বলে তাদের।



      - "কে বলেছে তুমি সব কিছু হারিয়ে ফেলেছো? এই বিশ্ব নিখিল তোমার। একে গড়ে তোলো নতুন পৃথিবী হিসেবে। যেখানে হিংসা থাকবে না, দ্বেষ থাকবে না, অভাব থাকবে না, অনাহার থাকবে না। কে বলেছে তুমি নিঃস্ব হয়ে গেছ? তোমার মধ্যেই আছে সেই অমোঘ শক্তি। সেই শক্তিকে সঠিক কাজে লাগাও, সত্যের কাজে লাগাও, ধর্মের কাজে লাগাও। আমি মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছি তোমার মধ্যে আছে সেই ক্ষমতা, সেই দক্ষতা, সেই তেজস্বীতা, সেই বলিষ্ঠতা। হয়তো সর্ব শক্তিমানের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে তোমাকে নিয়ে। হয়তো তিনি চান না তোমাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে। হয়তো তিনি তোমাকে দেখতে চাইছেন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে। তোমাকে দিয়ে হয়তো তার বিশেষ কোনো কাজ করাতে চাইছেন। হয়তো সেই জন্যই তুমি ছুটতে ছুটতে ঠিক আশ্রমের সামনেই অজ্ঞান হয়ে গেলে। এখন তুমি ছোট। অনেক কিছুই বুঝতে পারবে না। তার জন্য ধৈর্য ধর। আশ্রমের শিক্ষায় নিজেকে তৈরী কর।"



      - "কিন্তু আমি যে আমার বাবা মাকে হারিয়ে ফেলেছি!"



      - "না, তাঁরা হারিয়ে যায় নি। তাঁরা আছেন।হয়তো এই ধরাধামে নেই। অন্যত্র আছেন। তুমি তাদের দেখতে পাচ্ছো না। কিন্তু তাঁরা সব সময়ে তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। সব কিছু এখন বুঝতে পারবে না। বড় হও সব বুঝবে।"



      আশ্রমের শিক্ষায়, আশ্রমের আদর্শে বড় হতে থাকে মধু। শিক্ষার বাইরেও অনেক কিছু সে জানতে চায়।



      - "গুরুদেব এর নাম আশ্রম কেন?"



      - "কারন আমরা বৈদিক আশ্রমিক আদর্শে জীবন যাপন করি তাই এর নাম আশ্রম। আর মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবে আমরা তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ। একাকি আমরা কিছুই করতে পারি না। সেইজন্য প্রয়োজন একতা এবং সংহতি। সেইজন্য আমাদের আশ্রমের নামের সঙ্গে 'সংঘ' শব্দটা যুক্ত। যেদিন আমরা সমস্ত মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারবো, সেদিন পৃথিবীর রূপ পাল্টে যাবে।"



      বড় হতে থাকে মধু। বুঝে নিতে থাকে তার দায়িত্ব। এতদিনে সে আত্মস্থ করেছে চার দেওয়ালে ঘেরা কংক্রিটের মেঝে, কংক্রিটের ছাদ তার জন্য নয়। সবুজ পৃথিবীটা তার ঘর। নীল আকাশ তার ছাদ।



      ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে তরুণ সন্ন্যাসী মধুর নাম। যেখানে বিপর্যয় সেখানেই হাজির মধু। সঙ্গে পৃথিবীকে নতুন করে গড়ে তোলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আরো কিছু তরুণ। এরা ধর্মযোগী নয় কর্মযোগী। গীতা পাঠের থেকে ফুটবল খেলা এদের কাছে বেশি গুরুত্বের। মানুষের মন থেকে লোভ, হিংসা, দ্বেষকে সরিয়ে দেওয়াই এদের লক্ষ্য।



      ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গেছে সুন্দর বন। লোনা জলে ভরে গেছে চরাচর। খাবার নেই, পানীয় জল নেই। পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে স্থানীয় চাষাবাদ। অসহনীয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে প্রান্তিক মানুষগুলো। ঘরে ঘরে হাহাকার, মৃত্যু যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা দেখে শুনে চুপ করে থাকতে পারে না মধুর দল। তারা পৌছে গেছে সেখানে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুন্দরবন এলাকায়। সংগ্রহ করে আনা ত্রাণ সামগ্রী পৌছে দিচ্ছে ঘরে ঘরে। অসুস্থ মানুষদের তুলে নিয়ে আসছে সদর হাসপাতালে। তাদের সুস্থ করিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভেঙে পড়া ঘরগুলো নিজের হাতে মেরামত করছে তরুণ সন্ন্যাসীর দল। যথেষ্ট কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের। দিনে দুবেলা তারা যা খাচ্ছে সেটা প্রায় অখাদ্যের পর্যায়ে পড়ে। রাতে যেখানে শুতে হচ্ছে, গোয়াল ঘর সেই স্থানের থেকে কোনো অংশে খারাপ নয়! মুখ বুজে সেই সব কষ্ট সহ্য করছে তারা। তার পরেও এক অনাবিল হাসির রেখা ফুটে রয়েছে তাদের মুখে।



      অবশেষে লোনা জল নামলো। ঘরে ফিরলো প্রান্তিক মানুষগুলো। তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তরুণ সন্ন্যাসীদের প্রতি। কাজ শেষে মধুরাও তৈরি হচ্ছে আশ্রমে ফেরার জন্য। গ্রামবাসীরা দল বেঁধে এসেছে তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কি বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না।



      মধু গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বললো, "কাল সকালে আমরা চলে যাব। আমাদের এখন অনেক কাজ।"



      মধুর দল কালই চলে যাবে শুনে অনেকের চোখে জল এসে গেল। সজল চোখের নীরব ভাষা পড়তে মধুর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না। গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে সে বললো,



      - "বুঝতে পারছি তোমরা কি বলতে চাইছো। তোমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছোতো। কিন্তু কৃতজ্ঞতা লাভের জন্য আমরা এতদুরে আসিনি। এত পরিশ্রম করিনি। আমার একটা কথা যদি তোমরা রাখো তাহলেই আমরা খুশী হব।"



      - "কি কথা ঠাকুর?" হাজার কন্ঠ থেকে প্রশ্ন ভেসে এলো।"



      - "কথা দাও এবার থেকে তোমরা নিজেরা নিজেদের দেখবে।"



      - "হ্যাঁ ঠাকুর দেখবো। তোমার কথা আমার কাছে আদেশ। সেই আদেশ আমরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবো।"



      - "নিজেদের বলতে তোমরা কাদের বোঝো?"



      - "আমাদের বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, গাঁয়ের লোক।"



      - "ভিন গাঁয়ের লোক কেন তোমাদের নিজেদের লোক নয়? ভিন জেলার লোক কেন তোমাদের নিজেদের লোক নয়? ভিন রাজ্যের লোক কেন তোমাদের নিজেদের লোক নয়? এবার থেকে সবাইকে নিয়ে ভাবতে থাকো।"



      - তাই ভাব ঠাকুর। এবার থেকে সবাইকে নিয়ে ভাববো। সবাইকে নিয়ে বাঁচবো।"



      - "এখানে আমরা মাত্র বারোজন এসেছি। যদি আমাদের সঙ্গে পাঁচশো জন লোক থাকতো তাহলে কত সুবিধা হত! তোমরা আরো তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে পারতে। অনেক কম মানুষ মারা যেত। তাই বলছি দুর দুরান্তরে যদি কখনো কোনো বিপদ বিপর্যয় ঘটে, তোমরা তোমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেতো?"



      - "দেবো ঠাকুর দেবো। না হলে যে আমরা নিজেদের মানুষ বলে ভাবতে পারবো না।"



      মধু জানে আজ এরা যা বলছে, কাল সব ভুলে যাবে। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডির মধ্যে আটকে যাবে। কিন্তু তাই বলে হতাশ হলে চলবে না। বারে বারে ঘা দিয়ে ঘুমন্ত অচৈতন্য মানুষদের জাগাতে হবে। তাদের চেতনা ফেরাতে হবে। তারজন্য ধৈর্য ধরতে হবে। একটা ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে কঠোর থেকে কঠোরতম প্ররিশ্রম করতে হবে। সাধনা করতে হবে। 



      মধু এর আগে উত্তর বঙ্গে মানুষের হিতার্থে কাজ করে এসেছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মত আদিবাসী অধ্যুষিত অনুন্নত জেলাগুলোতেও মানুষের জন্য কাজ করে মানুষের মন জয় করেছে। তাদের হৃদয়ে নিজের একটা ছাপ রেখে এসেছে। এবার সে জিতে নিল দক্ষিণ বঙ্গের প্রান্তিক মানুষদের মন। এখন সে ভাবছে সত্যিই এই পৃথিবী তার ঘর। অজস্র তারা খচিত নীল আকাশ তার ছাদ। আজ সে এখানে। হয়তো কাল অন্য কোথাও যেতে হবে। যেতে হবে কোনো পথে, প্রান্তরে, গুহায়, কন্দরে। ছুটে চলেছে সে। বিরামহীন ছুটে চলেছে। নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার আনন্দে সে ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে সে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। 



      রাতের দিকে মধু ফোন করে আশ্রমের অধ্যক্ষ তথা তার গুরুদেবকে,



      - "গুরুদেব, আমাদের এখানের কাজ আপাতত শেষ। কাল ফিরছি। দেড় হাজার মানুষকে আমরা উদ্ধার করেছি। ঘরে ফিরিয়েছি।"



      - " মাত্র দেড় হাজার মানুষকে উদ্ধার করলে হবে না মধু। দেড়শো কোটি অসহায় ডুবন্ত মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের যে টেনে তুলতে হবে। মহা সংগ্রামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর। ওঠো, জাগো।"



      হ্যাঁ, বেশ ভোরেই উঠে পড়েছে মধু। উদিত সূর্যের প্রথম কিরণের চোখে চোখ রেখে আজ আবার সে আবৃত্তি করছে,



      "...মনে ভাবিলাম, 

        মরে ভগবান রাখিবে না মোহ গর্তে।

        তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল,

        দুবিঘার পরিবর্তে...।"



      না, আজ আর তার কোনো ভুল হচ্ছে না।



                 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024