Tuesday, January 31, 2023

গ্রামীণ ডাক সেবক (GDS) নিয়োগ 2023 || WB GDS recruitment 2023 || Post office peon recruitment 2023 || https://indiapostgdsonline.in/




পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চাকরি প্রার্থীদের জন্য নতুন সুখবর আছে। আবার নিয়োগ হতে চলেছে গ্রামীণ ডাক সেবক তথা GDS পদে। বিজ্ঞপ্তি টি Indian post এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

সমগ্র দেশ জুড়ে এই নিয়োগ চলবে। এর মধ্যে আপনাকে পশ্চিমবঙ্গের সার্কেল সিলেক্ট করতে হবে।

চাকরি সংক্রান্ত সম্পূর্ণ বিবরণ নীচে দেওয়া হল-






মোট শূন্যপদ - 40889 টি ( সমগ্র দেশে)

 

 

কোন কোন পদে নিয়োগ করা হবে - 


(1) ব্র্যাঞ্চ পোষ্ট মাস্টার (BPM)


(2) অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যাঞ্চ পোষ্ট মাস্টার/ ডাক সেবক (ABPM) 



বেতন- 

(1) BPM - 12,000 টাকা/মাস


(2) ABPM - 10,000 টাকা/মাস



বয়সসীমা- ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে হবে। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন।




শিক্ষাগত যোগ্যতা - 


শুধু মাত্র মাধ্যমিক পাশ করে থাকলেই আপনি এখানে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।

 



বিশেষ যোগ্যতা -

আবেদনকারীকে অবশ্যই সাইকেল চালাতে জানতে হবে। এর সাথে চাকরিপ্রার্থীদের স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে, বুঝতে এবং লিখতে জানতে হবে।




নিয়োগ প্রক্রিয়া-


শুধু মাত্র মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেরিট লিস্ট তৈরি হবে। কোনোরকম লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ দিতে হবে না।




আবেদন প্রক্রিয়া -

 অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এ গিয়ে অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পাবেন। 



আবেদন ফি -


সাধারণ প্রার্থীদের জন্য 100 টাকা। সংরক্ষিত প্রার্থী এবং মহিলাদের কোনো আবেদন ফি লাগবে না।





গুরুত্বপূর্ণ তারিখ-


আবেদন শুরু - 27/01/2023

আবেদন শেষ- 16/02/2023




Official Website-


Click here 🔴





 

Monday, January 30, 2023

গনিত বিস্ময় - পুষ্প সাঁতরা || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article writing

 গনিত বিস্ময়

     পুষ্প সাঁতরা


গনিতে অসাধারণ প্রত্যুতপন্নমতিত্ব বিস্ময় ব্যক্তিত্ব শ্রীনিবাস রামানুজন! বিশ্বের অন্যতম সেরা গনিতজ্ঞ। স্বল্প আয়ুস্কালের মধ্যে তিনি এমন শীর্ষে পৌঁছেছিলেন যে, তাঁর সান্নিধ্যে বা গনিত ভাবনার সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন প্রত্যেকেই রামানুজের প্রতিভার উজ্জ্বলতায় সম্মোহিত হয়েছেন। দুশত এগার র ছাব্বিশে ডিসেম্বর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষনা করেন শ্রীনিবাস রামানুজনের জন্মদিনটি 'জাতীয় গনিত দিবস '- হিসাবে পালিত হবে।

রামানুজনের পিতৃনিবাস তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনম শহরে। বাবা কুপুস্বামী শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার ছিলেন এক কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, তাঁর ভক্তিমতী মা কোমলতাম্বল ছিলেন সু কন্ঠের অধিকারী ইরোড শহরের মামা বাড়িতে-- আঠারশ সাতাশি র বাইশে ডিসেম্বর রামানুজনের জন্ম। মা ছিলেন স্থানীয় জাগ্রত দেবী নামগিরির একান্ত ভক্ত। বাল্যে রামানুজনের খেলাধুলায় তেমন আগ্রহ ছিল না, তবে স্মৃতি শক্তি ছিল অসাধারণ! মায়ের কাছ থেকে আত্মস্থ করেছিলেন পুরাণের কথা, ভক্তি গীতি, রামায়ণ মহাভারত ও বিভিন্ন ধর্মের কাহিনি শুনতেও বড় ভালবাসতেন।

প্রাথমিকে শেষ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে রামানুজন ভর্তি হয় কুম্ভকোনম টাউন হাইস্কুলে, সেখানেই গনিতে তাঁর অসাধারণ মেধা ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় নবম শ্রেনীতে পড়ার সময় এসএল লোনির লেখা একটি ত্রিকোনমিতির বই পান। সামান্য সময়ের মধ্যে তত্ত্ব অনুধাবন সহ বইটিতে প্রদত্ত প্রতিটি সমস্যার সমাধান করে ফেলেন সহজেই। ঊনিশ শ তিন সালে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় গণিতে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য রামানুজন লাভ করেন-'রঙ্গনাথ রাও 'পুরষ্কার। ওই বছরই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি পান। পরের বছর কুম্ভকোনম সরকারী কলেজে এফ এ ভর্তি হন, তার আগেই তাঁর হাতে আসে জি এস কারের লেখা, 'এ সিনোপসিস অফ এলিমেন্টরি রেজাল্টস ইন পিওর ম্যাথমেটিক্স 'বই টি। সেই বইয়ে ছিল গণিতের বিভিন্ন শাখার সাড়ে চারহাজার সূত্র ও উপপাদ্য। রামানুজন সেগুলি প্রমাণ করার পর আবিষ্কার করতে থাকেন একের পর এক সূত্র ও উপপাদ্য। যা তিনি একটি খাতায় লিখে রাখেন, পরে সেটি রামানুজনের 'নোটবুক 'নামে খ্যাত হয়। কলেজে অঙ্কের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলেও ইংরাজিতে কম নম্বর পাওয়ায় এফ এ কোর্সে দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে পারেন নি, মনের দুঃখে কলেজ ছেড়ে দেন।

উনিশ ছ সালে মাদ্রাজের পাপাইয়াচ্চা কলেজে ফের এফ এ ভর্তি হন, সেখানেও একশ তে একশ পান, কিন্ত অন্য বিষয়ে পাশ নাম্বার ও তুলতে পারেন নি, ফলে এফ এ তকমা পাওয়া হয়নি, তবু তাঁর গনিত সাধনা থামেনি বরং বাড়তি গতি পায়। নতূন নতূন আবিষ্কারে স্ফীত হতে থাকে তাঁর নোটবুক।

রামানুজন ঊনিশ শ ন সালে বিয়ে করেন জানকী দেবীকে, এর মধ্যেই রামানুজনের গনিতের সমস্যা ও সমাধান ইন্ডিয়ান ম্যাথম্যটিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হলে তিনি উচ্চ প্রশংসিত হন। তাঁর প্রতিভার কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে পারিবারিক প্রয়োজনে তাঁকে মাদ্রাজ পোর্টট্রাষ্ট অফিসে কেরানির চাকরি নিতে হয়। তবে গবেষণা অব্যাহত ছিল। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সেও আয়ারের পরামর্শে রামানুজন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জি এইচ হার্ডি কে চিঠি লেখেন এবং সেই সঙ্গে পাঠান নিজের আবিষ্কৃত কিছু সূত্র ও উপপাদ্য, সেসব দেখে অধ্যাপক হার্ডি অভিভূত হন, তাঁর চেষ্টায় রামানুজন কেমব্রিজে যান।

সেখান তিনি আরও সৃজন শীল হয়ে ওঠেন। অধ্যাপক হার্ডির সহায়তায় রামানুজন লেখেন একের পর এক গবেষণার পত্র। ষোল সালে কেমব্রিজ থেকে বি এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সতর সালে লন্ডন ম্যাথম্যটিক্যাল সোসাইটির পদ লাভ করেন আঠার সালে নির্বাচিত হন কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য এবং প্রথম ভারতীয় হিসাবে ফেলো অফ ট্রিনিটি হন রামানুজন।

মানুষ হিসাবেও মহান, তাঁর ব্যক্তিত্ব আচরণ আন্তরিকতা সকলকেই মুগ্ধ করত, তিনি নিজের প্রতিভা সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন, ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাস 'যে সমীকরন ঈশ্বরের চিন্তাকে প্রকাশ করে না, তা আমার কাছে অর্থ হীন---- বলেছিলেন রামানুজন।

তিনি আরও বলতেন--'নামাক্কলের জাগ্রত দেবী স্বপ্নে তাঁকে সূত্র বলেদিতেন ' রামানুজনের কাজ ছড়িয়ে আছে তাঁর সাঁইত্রিশটি গবেষনামূলক প্রবন্ধ তিন হাজার দুশত চুয়ান্ন টি গানিতিক ফলে সমৃদ্ধ 'নোটবুক '।পাশাপাশি ইন্ডিয়ান ম্যাথম্যটিক্যাল সোসাইটির জার্নালে পাঠানো আঠান্নটি প্রশ্নে এবং গবেষক হিসাবে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমা দেওয়া তিনটি গবেষনা পত্রে।

রামানুজনের কাজ শুধু গনিত কে সমৃদ্ধ করেনি, গনিত কে ছাড়িয়ে বিজ্ঞানের অন্য শাখাতেও প্রয়োগ করাহচ্ছে। ঊনিশ শ সতের সালে লন্ডনে হঠাৎই অসুস্থ হয়েপড়েন, চিকিৎসা চললেও দ্রুত সেরে উঠবেন এই আশায় ভারতে আনা হয় রামানুজনকে, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ঊনিশ শ কুড়ি সালের ছাব্বিশে এপ্রিল এই মহান গনিতজ্ঞের মহাপ্রয়ান ঘটে মাদ্রাজের চেতপাটে। তখন তাঁর বয়স মাত্র তেত্রিশ। এই প্রজন্মেও যাঁরা গনিত সাধনায় মগ্ন শ্রীনিবাস রামানুজন তাঁদেরকেও প্রেরনা জুগিয়ে চলেছেন!


মনের আমি মনের তুমি - স্নেহাশিস মুখোপাধ‍্যায় || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article writing

 মনের আমি মনের তুমি 

           স্নেহাশিস মুখোপাধ‍্যায়



 


মন নিয়ে লিখতে বসে একটা সক্ষমতা এবং অসক্ষমতার প্রশ্ন খুব বড়ো হয়ে উঠছে। ‘দুই পাখি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ খাঁচার পাখি এবং বনের পাখির ভেতরে যে মিল এবং পার্থক্য তৈরি করে দেখিয়েছিলেন, তার শেষে অসামর্থ্যের প্রশ্নটি বড়ো হয়ে দ্যাখা দিলো। খাঁচার পাখি নিরিবিলিতে থাকে, কিন্তু তার ভেতরে বাইরের পৃথিবীর স্বপ্ন রয়েছে। বনের পাখি অনেক খোলামেলা এবং উদার হলেও এবং তার সঙ্গে আকর্ষণীয় হয়ে উঠলেও, খাঁচার পাখির পক্ষে সেই দামালপনার সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি দান করা মোটেই সম্ভব নয়। ফলে তার ভেতরে সুখ এবং দুঃখ দুই-ই সময়ে সময়ে মুহূর্ত তৈরি করে ফেলছে। আধুনিককালের মনস্বী মানুষেরা মানুষের মনোস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যে পর্যবেক্ষণগুলোকে সামনে রাখার চেষ্টা করেন, তার ভেতরে স্বপ্ন একটি অন্যতম বিষয়। ফ্রয়েড সাহেব তাঁর ‘স্টাডিস অন হিস্টিরিয়া’তে বাস্তব মানুষের জীবনে স্বপ্নের ধারণাকে ভ্রান্ত বলে ধরে নেননি। বরং তাকে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার ভেতর দিয়ে একটা রুপ দিতে চেয়েছেন। দুজন মানুষের মনের আলো-অন্ধকারের দিক যে আসলে সাফল্য এবং ব্যর্থতার দিক এবং তার বৈচিত্র্য, ফ্রয়েড বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগীর মানসিক অবস্থার রোগজনিত টানাপোড়েনের আলাদা আলাদা দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।


মন নিয়ে দু-কথা লেখা আর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলা খুব সমার্থক নয়। কিন্তু মনের সঙ্গে মনস্তত্ত্বের একটা মিল থাকে বলেই লেখাটা সাহস করে লিখছি। মন নিয়ে কথা উঠলেই, মনের স্থিরতা এবং অস্থিরতা নিয়ে কথা ওঠে। তখন সময় তুল্যমূল্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সকলই ক্ষণিক, খণ্ড, ছিন্ন’...। অর্থাৎ সমস্ত কিছুই একটা মেয়াদের ভেতরে আবদ্ধ হয়ে থাকে। সেইজন্য অনেক বিষয় নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও মেয়াদী। তাহলে চিরন্তন বলে কি কিছুই নেই? কিছু হয় না? এক্ষেত্রে খণ্ড এবং ছিন্ন হওয়ার নিমিত্তকালটিকেই চিরন্তন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ, এর ভেতরে ধারাবাহিকতার উপাদান রয়েছে। দেশ, কাল, ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারার মধ্যে এই চিন্তাটাই হয়তো একমাত্র সত্য। কিন্তু মানুষের মনের ধারার বয়স, মানে একক মানুষের ক্ষেত্রে সময় অনেক কম থাকার জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদী বিচ্ছিন্নতা যা দীর্ঘদিনের ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত, তাকে খুব বেশি ছুঁয়ে যায় না। একক মানুষের জীবন তো তাঁর মতোই হবে। ফলে, তাঁর মন এবং মনের গঠনের মেয়াদ আরো কম হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ এই মানুষটিও ইতিহাসের বিরাট ব্যাপ্তির একটা অংশ। এবং খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন। ফলে চিরন্তনের সেও একজন অংশীদারই হয়ে উঠছে। মানুষটি কিম্বা ব্যক্তিটির ভেতরে প্রত্যেকদিনের চিন্তার ঢেউ এবং শূন্যতা নিয়েই তাঁর নিজস্ব মনোজগৎ এবং মনোস্তত্ত্বের বোধটি তৈরি হয়ে চলেছে। এই মনোস্তত্ত্বকে একটি উন্নততর বিজ্ঞান বলেছিলেন মনোস্তত্ত্ববিদ নিৎসে। ফরাসী কবি বোদলেয়ারের কবিতায় খুব স্পষ্টভাবে ভালো এবং মন্দ চিন্তার মানুষের মন নিয়ে লেখা আছে, যা মানুষের ভেতরের অন্তর্গত ধারণা সম্পর্কে একটা রুপ তৈরি করতে কিম্বা বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। বুদ্ধধর্মের চর্চার ভেতরেও এই ‘পজিটিভ’ এবং ‘নেগেটিভ’ চিন্তার কথা বলা হয়ে থাকে। উপনিষদের অনেক শব্দই পরবর্তীকালে তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। কিম্বা সেই চর্চারও একটা ধারাবাহিক ইতিহাস তৈরি হয়ে উঠেছে। এই সামগ্রিকতা ব্যক্তির জীবন আর সামাজিক কিম্বা আরো বড়ো কোনো জীবনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অংশীদার হয়ে মানুষের মনের আকার এবং রুপকে একটা বিবর্তনের ভেতর নিয়ে চলেছে। একেও একধরণের যান্ত্রিক প্রক্রিয়াই বলা যায়। বিবেকানন্দ মানুষের জীবনে দুঃখের বোধ তৈরি হওয়ার কারণ হিসেবে জ্ঞান কিম্বা অনুসন্ধিৎসার অভাব বলেই আলোচনা করেছিলেন। এই আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বিবেকানন্দ খুব সাধারণ স্তরের মানুষের কথা বলেননি। ‘কুয়োর ব্যাঙ’ বলতে বিবেকানন্দ যা বুঝিয়েছিলেন, তাকে আজ হয়তো সর্বজনীন বলে দ্যাখাই যায়। কিন্তু একটা সময় এই কথাটিরও একটা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র ছিলো।


সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার কতোগুলো শর্ত থাকে। সাধারণ বলতে, সমস্ত মানুষের কথাই এখানে বলা হচ্ছে। বিজ্ঞান বলতে একটা সময় মানুষ বিশেষ জ্ঞানকেই বুঝতো। এখন বিজ্ঞান বলতে ব্যবহারিক জ্ঞানের দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি তৈরি হয়েছে। এখানে অবশ্য সাধারণ এবং অন্য স্তরের মানুষের ভেতরে একটা শ্রেণীবিভাগ করাই যায়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যে অর্থে একজন বিশেষ জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষ ছিলেন, সেই অর্থ ফলিত সত্যের আরো অনেক দূরবর্তী আলোর কথা ভাবতে পেরেছিলো। 


কিন্তু অন্য স্তরের মানুষরাও বিজ্ঞানের এই ব্যবহারিক জ্ঞানের উপযোগীতার বাইরে থাকা মানুষ নন। সাধারণ মানুষের প্রত্যেকদিনের দুঃখের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে অর্থের উপযোগীতার কথা মনে হয়। অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মানুষের চাহিদা প্রাথমিক শর্ত মিটিয়েও খানিকটা লোকাচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। হয়তো সেই অর্থে ততোটা লোকাচারও নয়। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার এই বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্যের বাইরে খুব কম মানুষ বাস করেন বলেই আমার ধারণা। ফলে উদ্দীপনার তারতম্যজনিত কারণে মানুষের মনে সুখ এবং দুঃখের জন্ম এবং লালনপ্রক্রিয়ার কাজে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে যেতে পারে।


 


একজন মানুষ অনেক কারণে দুঃখী হতে পারেন। সাধারণ স্তরের মানুষরা তাঁদের আর্থ-সামাজিক কারণেই সুখী কিম্বা দুঃখী হন। বিশেষ কোনো সিদ্ধান্তের সংশয়ের কারণেও তাঁদের মনে সুখ কিম্বা দুঃখের জন্ম হতে পারে। এবং কম-বেশি সমস্ত মানুষই এই সংশয়ের ভেতরে অবস্থান করেন। একটি পুজোর উৎসবে চাহিদা মতো পোশাক কিনতে না পারার জন্য মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হওয়াও কোনো আশ্চর্য ঘটনা নয়।ছোটোবেলায়, নিজেদের মনেও এমন দুঃখ কিম্বা সুখের বোধকে অনুভব করতে পারা যায়। রবীন্দ্রনাথ ‘কাঙালিনী’ কবিতায় ধনী এবং দরিদ্রের ভেতরে যে পার্থক্যটি শব্দের মধ্য দিয়ে এঁকেছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো যথেষ্ট পরিমানে থেকে গেছে। এখান থেকে মানুষের মনে সুখ কিম্বা দুঃখের একটা চিরজাগরুক ছবিও মনের ভেতরে থেকে যেতে পারে। ছোটোবেলায় ঘটে থাকা বিশেষ কোনো আদর কিম্বা অনাদরের ঘটনাও একজন মানুষের মনস্তত্ত্বের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে। যদিও সবটাই নির্ভর করে, মানুষটি তাঁর পরবর্তী জীবনে সেই বিষয় নিয়ে কি ভাবছেন, তার ওপরে। স্বাধীন-ব্যক্তিসত্তার যুগে, মনস্তত্ত্বের একটা বিরাট অবদানের কথা বহুলভাবেই স্বীকৃত হয়ে উঠেছে। এককভাবে একজন মানুষের জীবনের বৈশিষ্ট্য যে এক এবং একক নয়, অর্থাৎ সমভাববিশিষ্ট মানুষও যে পৃথিবীতে বাস করেন, তা অনেকেই জানেন। মানুষে মানুষে মিলমিশের সেটাও একটা কারণ হিসেবেই ধরা হয়। আবার অমিল কিম্বা সংঘাতের কারণ হিসেবেই সেটাই প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে। কথা শোনা এবং না শোনার পক্ষে এবং বিপরীতে মানুষ তার অবস্থান সম্পর্কে ঠিক কতোটা সচেতন, মনোস্তত্ত্ব তার ওপরেও খানিকটা নির্ভর করে।


 


অন্তর্মনোজগতে যেকোনো চিন্তাই একটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ফুলের বাগান দেখে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিমোহিত হয়ে পড়ার ঘটনাকে মনোস্তত্ত্বের অংশ বলেই হয়তো এখন ধরে নেওয়া হবে। ফ্রয়েডও এই ধরণের একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেই সম্পর্কে এটাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, মনোস্তত্ত্ব একটি স্নায়বিক কর্মপদ্ধতিরই অংশবিশেষ। আমাদের ভাব, ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা প্রভৃতি মানবিক এবং অমানবিক কাজকর্মের সাথে স্নায়ু ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ঠিক এখান থেকেই জীবনে বেঁচে থাকার শুদ্ধতার বোধ কিভাবে পাল্টে যায়, সেটাও একটা আলোচনার বিষয়। যে স্নায়ু প্রাণের অন্যতম ধারক, সেই স্নায়ুই তো রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কিম্বা বলা যায় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যশালা থেকে অন্য ফলাফলও তৈরি হচ্ছে। একক মানুষের জীবনে মনোস্তত্ত্ব এই এতোগুলো কাজে অংশগ্রহণ করে না হয়তো, কিন্তু তাঁর সুখ এবং দুঃখের বোধের ওপরে একটা প্রভাব রেখে যায়। কিম্বা করে ওঠে, সেকথাও বলা যায়। কারণ, একক মানুষটির গুরুত্বের পরিমাপ সামাজিক হলেও, তার একটি ব্যক্তিগত সাপেক্ষও থেকে যায়। সামাজিকভাবে অনেক বেশি সচেতন মানুষের ভেতরে এর সূক্ষ্মতা কখনো কখনো ব্যাধিরও সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাধি বলতে সামান্য কিম্বা অনেকখানি অপ্রকৃতিস্হ অবস্থাকেই ধরে নেওয়া হয়। শারীরিক অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা একটা স্পষ্ট রুপ থাকে। কিন্তু মানসিক অবস্থাটির রুপ সবসময় আকার পেয়ে ওঠে না। এখানে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা কি বিশেষ কোনো মনোনিবেশের ফল হিসেবেও আসতে পারে? ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর রামকৃষ্ণ দেবের ভেতরে একটা মিল কি তবে খুব প্রকট? মোহিত এবং বিমোহিত হয়ে যাওয়ার মিল? রামকৃষ্ণদেব তাঁর কথামৃতের আলোচনাগল্পগুলোর ভেতরে একাধিক পৌরাণিক অবতারের কথা বলেছিলেন। এর থেকে খানিকটা বোঝা যায়, তাঁর ভেতরে একজন কল্পলোকের বাসিন্দাও বসবাস করতেন। মোহিত হয়ে পড়ার দৃশ্যকে অনেকেই উন্মাদের আচরণ বলে মনে করেছেন। খানিকটা অসংযত রুপের পরিচয় পাওয়াও গেছে। বিশেষ করে পঞ্চবটী বনের ভেতরে ঈশ্বর-আরাধনার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপকে তাঁর নিকট আত্মিয়েরা অনেকেই উন্মাদের আচরণ বলে মনে করেছিলেন। আমাদের ভারতীয় ধর্মের ভেতরে সমাধিস্থ হওয়ার অভ্যেসকে যতোটা স্নায়বিক প্রক্রিয়া বলা যায়, ততোটাই তা মনোস্তত্ত্ব হয়ে ওঠে কি না, জানা নেই। শূন্য অবস্থান কি মনোস্তত্ত্বের কোনো প্রক্রিয়ার ভেতরে পড়ে না? বলা খুব মুশকিল। তাহলে মানুষের ভেতরে নিশ্চেতন হয়ে পড়ার ভাবটিকেই বা কি বলে ব্যাখ্যা করবো? এক নয় অলসতা, এক নয় গভীর মনোযোগ, এক নয় স্বার্থপরতা, আর নাহলে কঠিন কোনো অসুখ বলেই ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই সব কটি ক্রিয়ার সঙ্গে মনোজগতের একটা বিরাট সম্পর্ক কি নেই? এমনকি, যাকে আমরা অবচেতন বলি, অনেক সময় ঘুমের ভেতরে স্বপ্নের মতো যা আমাদের আলোকিত কিম্বা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে তার ভেতরেও এই ধরণের নিশ্চেতনার ভাবটিকে কি মনোজগতেরই একটা অংশ বলে ধরে নেওয়া যাবে না? বারট্রাণ্ড রাসেলের দর্শন এবং চিকিৎসক এবং মনোস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণের সমীক্ষার ভেতরেও এই চেতনা এবং অচেতনার অবস্থা একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলো। এবং এক ধরণের অতিমনোনিবেশ যে ঈর্ষার জন্ম দেয়, সেকথা রাসেল উদাহরণ দিয়েও আলোচনা করেছিলেন। ফ্রয়েডের ক্ষেত্রে সেটা রোগজনিত নিশ্চেতনার কারণ হিসেবে আলোচ্য হয়েছে। কিন্তু ফ্রয়েড সাহেব নিজেও কি এই অতিমনোনিবেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হননি? মানে অন্যের অতিমনোনিবেশের কারণে? তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ও পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এও তো মানুষের অন্তর্মনোজগতের বিরাট একটি কার্যপ্রক্রিয়া। আপাতভাবে তা খুব সরল এবং শিশুসুলভ। কিন্তু সমুচিত বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণে, তাই-ই বিশেষ সমস্যার হয়ে ওঠে। একভাবে দেখতে গেলে এই অতিমনোনিবেশনও এক ধরণের রোগ। কখনো কখনো তার ভেতরে একটা প্রকট অভিপ্রায় তৈরি হয়ে থাকে। সেটা মানুষ হিসেবে মনের গঠনের দিক থেকে একজন ব্যক্তির মানসিকতা এবং ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে। জীবনের প্রতি মারাত্মক লিপ্সা কিম্বা বিশেষ কোনো অবদমন অথবা তার প্রক্রিয়াও বিরাটভাবে একটা জাতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিশ্বযুদ্ধ কিম্বা পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ইতিহাস এবং খানিকটা কাল্পনিক কাহিনীতেও এমন বিভিন্ন চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়, যাঁরা অনেকেই মানুষ হিসেবে খুব স্বাভাবিক ছিলেন না। ট্রয় যুদ্ধের নায়ক এগামেমননের মেয়ে ইলেকট্রার ভেতরে এক ধরণের বিশেষ জটিলতা পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেছিলেন, যা খানিকটা তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। ইলিয়াডে এগামেমনন এবং একিলিসের কথোপকথন থেকেও এগামেমননের মানসিকতার একটা পরিচয় আমরা পাই। অথচ দুজনেই বীর যোদ্ধা ছিলেন। গ্রীক বীর ঈদিপাস কিম্বা সুন্দরী নার্সিসাসের ভেতরেও প্রতিশোধমুখ এবং অবদমিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং এক ধরণের জীবনবিমুখতার ভাবনাচিন্তা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। মনোজগতে এর অনেক রকম প্রভাব থাকলেও, মনোস্তত্ত্ব এর একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে। সাধারণভাবে শারীরিক পীড়ায় আচ্ছন্ন না হলে, এর কোনোটিকেই রোগ বলে ধরা হয় না। অর্থাৎ, এক ধরণের ক্লান্তি ঘনিয়ে না উঠলে, তাকে রোগ বলা এবং তার চিকিৎসা করা সম্ভবপর নয়।


 


পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্য এবং মহাকাব্যের অংশ বিশেষেও মানুষের অন্তর্জগতের একটা রুপ পাঠক নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন। অবদমন এবং তার প্রক্রিয়া এই অন্তর্মনোজগতে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে বলেই ধারণা করা হয়। অনেক সময় একটা বিশেষ তত্ত্বকেও প্রায় না বুঝেও মানুষকে তার প্রভাবে প্রভাবিত করার খারাপ অভিপ্রায় থেকেও একটা প্রজাতির ক্ষতিসাধনের কাজ সঙ্ঘটিত হতে পারে। তবে, সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করেন, তা বোধহয় নয়। ব্যক্তিজীবনের ঠাট্টা, কিম্বা উপহাসের বোধ এক একজন মানুষের কাছে এক এক রকম মানে হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলা যায়, যে মানুষ ভীত কিম্বা অতিভীত, সেই মানুষের মনোজগতের ওপর বেশ কঠিন চাপ পড়ে। এই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা, যার ভেতরে থাকা এবং না থাকার মানে একই, অর্থাৎ, অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া, তা শিশু এবং কিশোরদের পরবর্তী জীবনে কঠিন এবং গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেরই মনে হয়েছে। যদিও তাও ব্যক্তি বিশেষের শারীরিক এবং মানসিক গঠনের ওপর নির্ভর করে। ছোটোবেলায় স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি, এক এবং একাধিক ছাত্র দু-এক ঘণ্টা ছাত্রসারিতে দাঁড়িয়ে থেকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলো ছাত্ররা যাতে বসে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হতো। শারীরিক শক্তি বা ক্ষমতা যে মানুষের মানসিক অবস্থার গঠনে খানিকটা প্রভাব ফেলে, একথা স্বীকার না করে উপায় নেই।


একজন প্রতিবন্ধী মানুষের মনের জগৎ আর সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের মনের জগতে একটা তফাৎ নিশ্চই তৈরি হয়। বিশ্ববন্দিতা হেলেন কেলার খুব কঠিন পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে এই বাধা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ধরণের সমস্যায় মানুষ যে রোজই যুদ্ধের পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে, তা আরো ঘনিষ্ঠভাবে বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে হেলেন কেলার নিজে জাপানের মানুষের কাছে গিয়ে সৌহার্দ্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতো বড়ো জাগতিক ভালবাসার এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের নায়িকা নিজে কিন্তু কঠিন কষ্টের মধ্যে থেকে অন্যতম মানুষ হয়েছিলেন, যা আমাদের সবার শিক্ষণীয়। এবং সেই কষ্টের বেশিরভাগটাই তাঁর শরীরজনিত। পাকস্থলী এবং মস্তিষ্কের রোগে হেলেন তাঁর নতুন জীবন পেলেন, একথা তাঁর আত্মজীবনীতে পড়ে, আপাতভাবে একটি কাব্য পড়ছি বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু সেই সঙ্কট একজন মানুষের জীবনহানির একটা প্রচ্ছন্ন রুপ ছিলো, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। হেলেন লিখেছিলেন, “Gradually I got used to the silence and darkness that surrounded me and forget that it has ever been different…” . দেহের এই কঠিন পীড়ার ভেতরে যে দমচাপা আর্তনাদ থাকে, তা একটা যুক্তক্ষয়ের স্মারক ছাড়া আর কীই বা হতে পারে? অন্য মানুষের ক্ষেত্রে মনের অবদমনই হয়তো শারীরিক পীড়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিম্বা সাংঘাতিক রুপের আকার নিতে পারে, যা একধরণের রুপক্ষয় বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু হেলেন কেলার এই সমস্ত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে একজন বিজয়িনী। হেলেন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর জীবনে শিক্ষক আসার আগেই জীবনের বেঁচে থাকার এই আলাদা সত্তা সম্পর্কে তিনি খানিকটা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুভূতির কোনো ভাষা তৈরি করা হেলেনের পক্ষে তখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ যেন গাছের ভাষা, কিম্বা পৃথিবীর যেকোনো প্রাণের অবদমনের ভাষা। যে ভাষা তৈরি হতে হতে হেলেনের চরিত্রে সামগ্রিক যে রুপ সৃষ্টি হয়ে চলছিলো, তা সম্পূর্ণ অন্য একটি ভাষার জঠর কিম্বা আশ্রয়স্থল। তাতে রাগ আছে, অভিমান আছে, দুষ্টুমি এবং আফশোস মিশ্রিত অনুভূতি আছে। হেলেনকে দেখভাল করা নার্সের সঙ্গে তার সময় কাটানোর অভিজ্ঞতার কাহিনী পড়তে পড়তে এই ধারণাটিই বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। রাসেলের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের ইচ্ছে অসীম নয়। কিন্তু ইচ্ছের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধারণাটিকে আমরা অসীম বলতে পারি। ভালোত্বের একটা ব্যক্তিগত মালিকানা বোধ কিম্বা সত্তা থাকে এবং রাসেলের লেখার বিশ্লেষণে পাই, যে সেটি সর্বজনীন হওয়াই উচিৎ। কিন্তু ফলিত জীবনে তা যে হয়ে ওঠে না, তাই বোধহয় দুঃখের আর একটি অন্যতম কারণ। কারণটি খুব জৈবিক, আগেই বলা হয়েছে। এর ভেতরে অর্থনীতির বণ্টন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু তা যে অনেকক্ষেত্রেই সাধারণের সীমার মধ্যে আসে না, তা সত্যি। জৈবিকভাবে তা যে মনের জগতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে তা আগেই বলা হয়েছে। এখানে ‘জৈবিক’ শব্দটি অনেক ব্যাপ্ত। কারণ খাদ্যের সঙ্গে তার ওতোপ্রতো সংযোগ রয়েছে। মানুষ খানিকটা ইচ্ছের অধীন হলেও, ইচ্ছে শব্দটিকে যদি আমি অবস্থা কিম্বা অনুভূতি বলেই ধরে নিই, তবে তারও তো একটা ঘর আছে, তাকেই কোথাও পুষ্ট হতে হয়। এখানে সাধ্যের ঘর খুব ছোটো হওয়ার জন্য ইচ্ছের আকার কম হয়, এমন কথাও কি খুব অনিশ্চিত? স্বাভাবিকভাবেই বারট্রাণ্ড রাসেলের আলোচনায় শিক্ষা অংশগ্রহণ করেছে। কারণ, আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষা একই সঙ্গে কাজ, রোজগার এবং অনুভূতি এই তিনটি প্রক্রিয়ারই সহায়ক। এবং সেক্ষেত্রে ইচ্ছে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করলেও অর্থনীতির বাধাকে অতিক্রম করা বিশেষ শ্রম এবং সময়সাধ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ একটা সময় বিলেতে গিয়েছিলেন (নোবেল পাওয়ার পর) এবং বিশ্বভারতীর জন্য কিছু অর্থসংগ্রহের তাগিদে আমেরিকার কথাও ভেবেছিলেন। শেষপর্যন্ত তাঁর ভেতরের আবেগ যথেষ্ট ভরসা পায়নি। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, শিক্ষার প্রসারও অনেক ক্ষেত্রে কিম্বা কিছু ক্ষেত্রে বা সাময়িক অথবা পাকাপাকিভাবে নিরুপায় হয়ে পড়ে। রাসেল শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় জানিয়েছেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর কোনো দেশ নেই। উন্নত মানুষের মনের গঠনে তা একটা গভীর প্রভাব বিস্তার করে। রাসেল শিক্ষাব্যবস্থায় চার্চের প্রভাব খানিকটা খর্ব করার কথা বলেছিলেন। এখানে অবধারিতভাবে সক্রেতিসের কথা উল্লেখ করতে হয়। যদিও সক্রেতিস এবং তাঁর অনুগামীদের আলোচনা কতোটা কাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম ছিলো, এই নিয়ে সেই সময়ে বোধহয় অনেকেই দ্বিধায় ছিলেন। তাঁরা নিজেরাও সেই দ্বিধা সমসাময়িককালে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সক্রেতিস এবং অ্যালসিবায়োডিসের কথোপকথনে ‘লজিক’ বলে যে বিষয়টিকে ধারণা করা হয়, তা আসলে দ্বিধারই এক সমন্বিত রুপ। যেহেতু সক্রেতিসের আলোচনায় দ্বিধা একটা অন্যতম বিষয় ছিলো। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে কিম্বা তার পরবর্তী ফল হিসেবে যে শব্দটি তৈরি হতে পারে, তার নাম দ্বন্দ্ব। সেটা কোথাও শ্রমের স্বপক্ষেই বোধহয় কথা বলে যাচ্ছিলো, যা সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক হয়ে উঠেছিলো। তবে, মানুষের ইচ্ছে যে কাজ করার আগের একটা প্রক্রিয়া, এটা রাসেলের আলোচনার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়। রাসেল এই ইচ্ছেকে স্বার্থপরতার বিপরীতে থাকা একটা উপাদান বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আধুনিককাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়, স্বার্থপরতাও এক ধরণের ইচ্ছেরই দাসত্ব করে। আরো সূক্ষ্ম এবং গভীরভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষের মন এবং মস্তিষ্কের এক বিশেষ ধরণের অলসতার নাম স্বার্থপরতা। যা শেষ পর্যন্ত ইচ্ছে হয়েই ওঠে। সাধারণভাবে উন্নত মানুষের জীবনেই এই উপাদানটি অত্যন্ত প্রকট। উন্নত মানুষের পৃথিবীতে স্বার্থপরতা একটি বিচিত্র আকার নিতে পারে।


যুদ্ধের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক একটা শরীরের রক্তচলাচলের মতো। পরিপূরক। অথবা বলা যায়, সমার্থক হয়ে ওঠার কাছাকাছি। যুদ্ধ মানুষের জীবনে একটা অবশম্ভাবী নৈকট্য। মানুষ এবং গণ্য প্রাণীরা প্রায় সবাই বেড়ে ওঠার সময় প্রায় কাছ থেকেই তাদের মা, বাবার শ্রমের জীবনের পরিচয় পেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে। তাদের জীবনে স্বার্থপরতা এবং পরার্থপরতার শিক্ষাও খানিকটা শৈশবমুখী। একে অপ্রাসঙ্গিক বলা যায়, কি যায় না, তাও নির্ভর করে ওই ধরণের আচরণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ কিম্বা প্রাণীটির আচরণের ওপর। সেই যুদ্ধ যখন বিরাটভাবে ঘনীভূত হতে শুরু করে, তখন বোঝা যায় যে, খুব সূক্ষ্ম এবং ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের নির্মাণকাজটি আগেই হয়ে গেছে। যুদ্ধ তারই অবধারিত ভবিষ্যৎ। ফলে এই সামগ্রিকতার ওপরে জাতিগতভাবেও একজন মানুষ আচরণ করতে পারেন।


 


মনোস্তত্ত্ব শব্দটি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, ‘পাগল’ কিম্বা ‘উন্মাদ’ শব্দটিকেও একটু নজরে রাখতে হয়। পাগলামি, কিম্বা অতিরিক্ত উন্মাদনাকেও একটি বিশেষ অবস্থাই বলা হয়। কোনো মানুষের অতিরিক্ত জাতিবিদ্বেষও মারাত্মক পাগলামো হয়ে উঠতে পারে। রাসেলের শিক্ষা নিয়ে আলোচনার ভেতরে সবচেয়ে বড়ো যে দ্বন্দ্ব খুঁজে পাই, তার নেপথ্যে সৎ এবং অসৎ হওয়ার ধারণা যে কাজ করে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সক্রেতিস কিম্বা যিশুর সঙ্গে সমসাময়িক প্রতিষ্ঠানের সংঘাত একটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো। মিলনোৎসবও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ একটি কাজের দ্বিমুখী প্রতিফলন, কিম্বা প্রভাবের কথা লিখতে চাইছি। কিন্তু এঁরা দুজনেই বেশ খানিকটা সংগঠকও ছিলেন। ফলে নিজেদের গোষ্ঠির ভেতরে তাঁরা সবসময় খুব নরম হয়ে থেকেছেন, এমন বোধহয় হয়নি। সক্রেতিস খানিকটা বন্ধুভাবাপন্ন হলেও, প্লেটো অনেকটাই কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। সুতরাং, প্রাতিষ্ঠানিকতার ভিত যতো শক্ত, তার ভেতরের ঘুণপোকারাও ততোটাই প্রবল, অন্যভাবে এ কথাটা বলাই যায়। প্লেটোর স্বপ্নের গণতন্ত্রে কবিদের প্রবেশ চিরস্থায়ি হওয়া উচিৎ নয়, এমন একটা ধারণাও তাঁর হয়েছিলো। কিন্তু অ্যারিষ্টটল তা মনে করেননি। তিনি অস্তিত্বের দিক থেকেও কবিসত্তা এবং অন্য মানুষের সত্তা যে আলাদা, সেটি বুঝতে এবং বোঝাতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, একটা ভারসাম্যের বোধ, যা গণতন্ত্রের মূল কথা হওয়া উচিৎ, তার কথা বলেছিলেন। প্লেটো নিজেও কবিতা লিখতেন। তবে কবিতায় উচ্চ আদর্শ থাকাই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক, এই কথা জানিয়ে তিনি সক্রেতিসের বিপরীত মতই পোষণ করে বসলেন। কবিতার যে একটা শিল্পগত দিকও থাকে, ভাব এবং কাজের ভেতরে একটা ফারাক যে থাকে, তাকে বেশ খানিকটা অস্বীকার করেছিলেন প্লেটো। প্লেটো কবি এবং কবিতাকে নতুন কোনো সম্ভাবনা বলে মনে করেননি। কিন্তু প্লেটোর চিন্তাও কি খুব নতুন ছিলো? কারণ, এ বিষয়ে আগেই সক্রেতিস ভাবনা-চিন্তা করে গেছেন। মানুষের মনোস্তত্ত্বের ভেতরেই অনুকরণ করার অভ্যেস নিহিত থাকে। তাহলে কবিই কেন দোষের ভাগী হবেন? প্লেটোর মারাত্মক সম্পৃক্ততাই হয়তো এই ধরণের বিদ্বেষের একটা কারণ বলে মনে হতে পারে। এটা অবশ্য জাতিগত আলোচনা বলে মনে হতে পারে। উদার মানুষের কাছে গোটা পৃথিবীই আত্মিয়। একথা তো আমাদের দেশের শাস্ত্রেই লেখা আছে। শব্দ সত্য কিন্তু তার মহিমা সবসময় প্রকট হয়ে ওঠে না। এর সঙ্গে কাছের কিম্বা দূরের সম্পৃক্ততা কতোটা সরল কিম্বা জটিল, তার ওপরে নির্ভর করেও একজন মানুষের মনের গঠন রুপ পেয়ে বড়ো হচ্ছে। সক্রেতিস এবং সমকালীন প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বের সঙ্গে ঈজিপ্টের একটি ছোটো প্রচলিত গল্পের সামান্য মিল পাই। রাজা অ্যাপোফিস আর সেকনেনারের সংঘাতের সঙ্গে সক্রেতিসের মিল এবং তফাতও অনেকখানি। এখানেও ঈশ্বরবাদ প্রকট এবং বিরাট। অন্যদিকে সক্রেতিস দরিদ্র। এবং তাঁকে খুব পরিহাস করেও সমকালে দ্যাখা হয়নি। সমকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে কোনো ভালো দিক খুঁজতে চাইলে, এই বিষয়টিকেই একমাত্র বলে ধরতে হবে। সেখানেও ধারণাটি অসীম। মানে অস্তিত্বহীন। ইনফিনিটি। তার মানে মানুষের মনের নিরন্তর দ্বন্দ্বেরও দুটো দিক আছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। ধন এবং দারিদ্র্য, যার ভেতরের কথা হলো পারগতা এবং অপারগতা। এইভাবে দেখলে আমাদের আবার সেই ধর্মের কাছেই ফিরে যেতে হয়। তখন সক্রেতিস আমাদের কাছে কতো মহান হয়ে ওঠেন। কারণ সক্রেতিস দ্বন্দ্বমূলক আকাঙখার ভেতর দিয়ে ইনফিনিটির তত্ত্বকে চিনিয়ে গেলেন। মুসোলিনি তাঁর ‘ডকট্রিণ অফ ফ্যাসিজিম’-এ লিখেছিলেন, Fascism wants man to be active and to engage inaction with all his energies; it wants him to be manfully aware of the difficulties besetting him and ready to face them. শ্রমের প্রাথমিক কথাই তিনি লিখেছিলেন। প্রায় সংবিধানের মতো করে একটা চিন্তার ভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন মুসোলিনি। জন্মগতভাবে একজন কাঠমিস্ত্রিরির সন্তান ছিলেন। ফলে ছোটোবয়স থেকেই তিনি শ্রমকে খুব কাছ থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু ‘অ্যাবসলিউট’ হওয়ার জন্য যে ধর্মীয় বোধ থাকার দরকার ছিলো, মুসোলিনি তা রপ্ত করে উঠতে পারেননি। হিটলারের সঙ্গে সম্পর্কে যথেষ্ট টানাপোড়েনও ছিলো। ‘higher personality becomes a nation’ এই ধারণাটি আর গোপন রইলো না। ফলে মুসোলিনিকে চেনা পর্যবেক্ষকদের কাছে খুব সহজ হয়ে উঠলো। কিন্তু শুধুমাত্র মুসোলিনি অথবা হিটলার নন, বিশ্বের যে কোনো প্রতিষ্ঠানই যখন সর্বাধিনায়ক হয়ে উঠতে গেছে, বিপদ এসেছে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা খুব সহজে চিহ্নিত করা গেছে। প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু মনের জগতে যখন বিচার করতে বসার ইচ্ছে কিম্বা অবকাশ তৈরি হয়, তখন বুঝতে পারি যে, অধিকার করার প্রবণতা খুব সাধারণ একটা প্রক্রিয়া এবং অভ্যেস। অথচ সেই প্রবণতা থেকেই পৃথিবীতে আজীবৎকাল জুড়ে যুদ্ধ হয়ে চলেছে।


 


আধুনিক পৃথিবী শেষ হয়ে যাওয়ার পর, মানুষের মন অধিকার করে নিয়েছে এক বিশ্রী ধরণের শীতলতা। ব্যক্তিজীবনে একজন মানুষ নিজেই নিজের কাছে গুপ্তচর হয়ে ওঠেন। বার্তোলুসির ছবিতেও এই ভয়ঙ্কর শীতলতার গন্ধ পাই। একে একটু অন্য রকম ভাষায় নাগচক্র বলা যেতে পারে। বুদ্ধ নিজেও হীন ধর্মকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব দিতে চাননি। একমাত্র ব্যক্তির দর্শন ছাড়া, সামগ্রিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তারও আপত্তি ছিলো। এটি সম্ভবত তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন। অর্থাৎ এই দর্শনও পরম্পরার দাবী রাখে। রামকৃষ্ণ দেবও একই কথা স্বামীজিকে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাষ্টার’ গল্পের পোস্টমাষ্টার আর রতনমণির সম্পর্ক যে সামগ্রিক হয়ে উঠতে পারে না, এবং তার ভেতরে যে আবহমানকালের ব্যথা লুকিয়ে আছে, তা বুঝে ওঠার কাজটি শুরু হয়। অথচ জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই চক্রই কতো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আমাদের কালে বাংলা ভাষার অন্তত: দু-জন জীবিত কবির আধুনিকতম লেখার ভেতরে এই মনস্ত্বত্বের গ্রাসটি খুঁজে পাই। একে সামগ্রিক লেখকসত্তা ভেবে ভুল করলে সাহিত্যের পাঠক হওয়া অসম্ভব। 


 


একজন একক মানুষের বেড়ে ওঠার ভেতর দিয়ে রাজকীয় পৃথিবীকে সে অনুভব করতে পারছে, এর ভেতরে ক্লান্তিও আছে। আবার টানও আছে। সাপের জৈবিক ক্রিয়া আছে। ফ্রয়েড ‘প্যারানোইয়া’ বলতে যা বুঝিয়েছেন, ভারত এবং এশিয়ার ধর্মগুরুরাও প্রায় একই কথা বলেছিলেন। চ্যাপলিনের 'The great dictator' ছবিতে দুই রাষ্ট্রনায়ককে বাতুল বলেই দ্যাখানো হয়েছিলো। মানে একটা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু ফ্রয়েডের তত্ত্বটি ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। একই কারণ, অস্বাভাবিকতা। এবং সেই অস্বাভাবিকতার সঙ্গে থাকতে থাকতে মৃত্যুজনিত কোনো ভয় অন্য মানুষকেও গ্রাস করতে পারে, মানে তার পাশের মানুষকে। সেটা বোঝা অনেক সহজ হয়ে ওঠে। যেহেতু ঘর অনেক বেশি 'ক্লোজ'। সংকীর্ণও বলা যায়। আবার ঘর সোপানও। আবার একই সঙ্গে একটু একটু করে তা সহ্যের আয়ত্তের ভেতরেও চলে আসে। জাতিগত ক্ষেত্রে সেটাই একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে সন্দেহের বাতাবরণ থাকা এবং তৈরি হওয়ার কারণও থেকে যেতে পারে। আন্দামানের তিরন্দাজ- আদিবাসীরা ইতিহাসের বিচারে কি সত্যি সত্যিই তিরন্দাজ? কিন্তু স্থানিক বিচারে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছে এই সেন্টিনেলিজরাই তাঁদের খর্বকায় চেহারা নিয়েও অতিকায় হয়ে ওঠেন। একটা বিরাট সংঘাতের মুখে পড়ে জাতি কিম্বা সভ্যতা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব বিরল নয়। কিন্তু ব্যক্তিজীবনই বলি, আর সামগ্রিক জীবনই বলি, অপ্রকৃতিস্থতার একমাত্র কারণ অবদমন। তার সঙ্গে স্মৃতিজনিত সংঘাত একটা বড়ো উপাদান হয়ে উঠতে পারে। রোগ কিম্বা দুর্ঘটনা এক ধরণের অবদমনের প্রক্রিয়াই। দুর্ভিক্ষ, কিম্বা মহামারীজনিত কারণে খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের অভাব এক ধরণের অবদমন। মনের ভেতর ঘটে বলে অবদমন শব্দটি মনের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে অবদমনের পারস্পরিক এবং বিপরীতমুখী কার্যকলাপও লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। আবার ব্যক্তিজীবনে এর বিপরীত ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। নাহলে, মানুষ কি করে মহৎ শিক্ষা পেলেন? পরিবেশ থেকে কিছুটা শিখলেন, কিছুটা শিক্ষা এবং বাকিটা নিজের মানসিকতা তাঁকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। তাতে তিনি যে খুব সফল হলেন, এমন নয়। কিন্তু সফল শব্দটিও তো আপেক্ষিক।  



 


গল্পচ্ছলে লিখছি। সত্য ঘটনা। এক ভদ্রমহিলা রোগজনিত কারণে মস্তিষ্কের রোগে আচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁর বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপের ভেতরেও মন এবং শরীরের পাল্টে যাওয়া ক্রিয়াগুলোর ছাপ খুব স্পষ্ট ছিলো। বেশ কিছু সময় তিনি সুস্থ মানুষের মতো স্বাভাবিক থাকেন। কিছু সময় তিনি মারাত্মকভাবে পাল্টে যান। একদিক থেকে দেখলে, এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সেটা খুব মারাত্মক আকার নিতো। মানে স্বাভাবিকতার অনেক ওপরে সেই সূচকের মান ছিলো। তাঁকে যিনি দেখভাল করতেন, তিনি দু-একবার কঠিনভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক জোরও তুলনামূলকভাবে কম ছিলো। অথচ মধ্যবিত্ত সংসারে খুব কাছের মানুষকে দেখভাল করার জন্য সমসময় ভাড়া করা কিম্বা মাইনে দিয়ে রাখা লোকজন নিয়োগ করা খুব শক্ত হয়ে ওঠে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। তিনি মনের দিক থেকেও অত্যন্ত নম্র ছিলেন। রোগী স্বয়ং তাঁর মা। মেনিঞ্জাইটিস বা ওই ধরণের কোনো রোগ থেকে বিকারের জন্ম হয়েছিলো। তার ওপরে স্বাস্থ্য বেশ উন্নত মানের ছিলো। সংসারে অনেক সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তিনি শারীরিকভাবে বেশ শক্ত মানুষ ছিলেন। মেয়েটি একদিন সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়েছিলেন। মাথা ফেটে রক্তারক্তি অবস্থা। তাছাড়া মনের দিক থেকেও তিনি বেশ নম্র, সেকথা আগেই লিখেছি। উত্তর কোলকাতায় বসবাস করতেন। ইঞ্জেকশন দেখলে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, এতোটাই তাঁর স্নায়বিক দুর্বলতা ছিলো। তাঁর ওপরে এই রোগীণীটিকে দ্যাখার ভার দেওয়া হয়েছিলো। যদিও তিনি একজন সুস্থ এবং সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন বলেই হয়তো তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু একদিন এই ধরণের একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেলো। তারপর মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। রোগীণী ভদ্রমহিলারও বয়স একটু একটু করে বাড়ছে। কিন্তু ওই ধরণের ঘটনার কথা আর শোনা যায়নি। নতুন যাঁরা দেখভাল করতেন, তাঁরা মাঝে মাঝেই প্রখর হয়ে উঠতেন। আর তিনিও কখনো হেসে, কখনো মৃদু দুঃখ পেয়ে বসে থাকতেন। কাগজ পড়তেন। আতিথেয়তারও চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে একা একা বসে বসে কথা বলতেন, যাকে আমরা ভুল বকা বলি। নিজের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা। রোগিণী আমার দিদা। আর আমার মা ছিলেন সেই মেয়েটি। মায়ের মুখে যেভাবে কাহিনী শুনেছি, তাতে মনে হয়নি, কাহিনীটি খুব ভয়ংকর গোছের কিছু ছিলো। যদিও আমার মা খুব যন্ত্রণা পেয়েছিলেন। আমার ঠিক এই কারণেই দিদার ওপর বাড়তি সহানুভূতি ছিলো, এটা খুব সাধারণ একটা কথা। সবারই হবে। কিন্তু নিত্যকালীন যাঁরা, তারা তো দু-একদিনের মেহমান নন। ফলে মৃদু কথা কাটাকাটি চলতো। মানুষটি অন্ততঃ একজনকে মেনে চলতেন। নাহলে খুব সংঘাতের একটি সময়ের ভেতরে কোলকাতার বাড়িতে(মামার বাড়ি) তাঁর থেকে যাওয়ায় আরো বাড়তি সমস্যা ছিলো। অবশ্য মেনে চলার মতো মানুষটি সংঘাতের অনেক পরে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু অমন আচমকা আঘাত পাওয়ার পর অনেক সময়তেই, বহিরঙ্গে, মানুষটির ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে, কিম্বা আসতে পারে। মা শারীরিকভাবে আরো অনেকবার পীড়াচ্ছন্ন হয়েছেন। আমাদের যৌথ পরিবারের নিত্য সমস্যার ভেতর দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এতো শুদ্ধ প্রাণ তিনি কি করে ধরে রাখতেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। প্ল্যাটফর্মের ওপর কয়েকজন ছিন্তাইকারিণী তাঁকে ঘিরে তাঁর হাত থেকে গয়না কেড়ে নিতে চাইছে, আর তাঁর কোলে তখন একটা ছোটো বাচ্চা...সেই দৃশ্যের বর্ণনা করতে গিয়েও তাঁর ভেতরে কোনো প্রতিশোধের চিহ্ন দেখিনি। মনোস্তত্ত্বের কঠিন কঠিন পাঠ তাঁর আয়ত্তে ছিলো না। কিন্তু এতো ধৈর্য তিনি পেলেন কোত্থেকে? ওই সামান্য একটু ভেঙে পড়া, তারপর আবার রোজকার জীবনকে আঁকড়ে ধরে একজন মানুষ সত্যি সত্যিই নারী হয়ে উঠলেন। মানুষ হয়ে ওঠা কথাটা কিভাবে দেখবো, এটা আবার ভাবাতে শুরু করে। মানুষের মোটিভ কি হওয়া উচিৎ, এটাও আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করে। স্বার্থপর মানুষের কাছে অন্য সমস্ত মানুষ দোষী হয়ে ওঠেন। কিম্বা এভাবেই তাঁরা বাঁচতে শেখেন। এই শিক্ষা কিম্বা বোধ মানুষ খুব ছোটো গণ্ডি থেকে উপলব্ধি করতে পারে। নিজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বোধের একটা চূড়ান্ত রুপ সে চর্মচোখে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য কিম্বা দুর্ভাগ্য অর্জন করে। শেষ পর্যন্ত মানুষের সাফল্যই তাঁর বেঁচে থাকার উপায়। কিন্তু সাহিত্য অথবা মনোস্তত্ত্ব এর খানিকটা বিপরীতমুখী হয়ে মূল স্রোতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে সাহিত্য কিম্বা মনস্তত্ত্ব। সাহিত্যিক কিম্বা মনোস্তাত্ত্বিকেরও একটা নির্দিষ্ট গণ্ডী থাকে। সাহিত্য কিম্বা মনোস্তত্ত্ব জীবনের কথাই বলতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও সম্পূর্ণ জীবন হয়ে ওঠে না। ‘নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা’ বাজার মধ্য দিয়ে জীবন এবং বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপায়ের উপাদানগুলোরও আকার এবং ভাবনা চিন্তায় বিবর্তন দ্যাখা দেয়। ‘The interpretation of dreams’ অধ্যায়ে ফ্রয়েড একজন মানুষের আশেপাশে থাকা বিভিন্ন সম্পর্ক এবং সমকালীনতার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছে যে প্রতিফলিত হচ্ছে, একটি ট্রেন যা একইসঙ্গে সৃষ্টি এবং ধংসের কারণ, তার সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি হয়ে ওঠার কথা আমাদের জানায়। হাইনরিখের কবিতাতেও ট্রেনের কথা বলা আছে। হাইনরিখ জার্মানির কবি ছিলেন। হিটলারের জীবনেও ট্রেন একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর ট্রেন আপাতভাবে তো একটা সৃষ্টিরই প্রকাশ। কিন্তু দুর্গার মৃত্যু এবং ঘটনাচক্রে অপুর জীবন স্থান, কাল এবং পাত্র ভেদে পাল্টে যাওয়ার মুহূর্ত এবং বিভূতিভূষণের লেখায় নিশ্চিন্দিপুরের কুঠির প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে আসা ইতিহাসই যেন নাগচক্রের মতো মানুষের মন এবং মনোস্তত্ত্বকে ঘিরে ধরে। এই তার নিত্যকালের ছোটো এবং বড়ো গণ্ডির সীমার পটচিত্র এবং প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে।


 


 


 


প্রেম আর প্রেমের বাধাও এক ধরণের আনন্দ কিম্বা অবদমন। আবার চিরন্তন শান্তি বলেও তো একটা ধারণার কথা মানুষই তাঁর জীবদ্দশার ভেতরে অক্ষয় করে রাখতে চেয়েছে। সেখানে চলিষ্ঞু কিম্বা অবিচল থাকা কতোটা এক কিম্বা আলাদা, তার ভারসাম্যের একক কিম্বা সূচকের আকারে কতোটা তারতম্য ঘটবে তার ওপরে নির্ভর করে যা গড়ে ওঠে, তাকে খুব প্রবীণ এবং বিজ্ঞের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে ব্যক্তিকাল। কিন্তু ততোটা প্রবীণ এবং বিজ্ঞ নই। অসীমের ধারণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষ যে পরিসমাপ্তির কথা ভাবে, এবং ভেবে আপাত নিষ্কৃতি পায়, নিজের কাজের জগতে সেটা বোঝার সুযোগ হয়েছিলো। প্রেমের ক্ষেত্রে মানুষ বিপরীতমুখী ফলই আশা করে। মানে, প্রেম সম্পর্কে একটা সাংঘাতিক দ্বিচারিতায় আমরা প্রায় সবাই আচ্ছন্ন। প্রেমের শুধু উপযোগীতাই থাকবে, এটা ধরে নিয়েই আমরা একটা কাল্পনিক পৃথিবীর নির্মাণ করে যাই। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবো, সেখানেও লেনদেনটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই প্রক্রিয়াটি সর্বজনীন বললে ভুল বলা হয় না। অর্থাৎ, প্রায় সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সাধারণভাবে মনোস্তত্ত্ব শব্দটা নিয়ে ভাবলে তার ভেতরে একটা প্রকট যৌনতার কথা ভাবা আমাদের একটা অভ্যাস। সেটা অনেক ক্ষেত্রে সত্যিও। কিন্তু সেটাই অনেকটা ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক এবং জাতিগত অবস্থানের ক্ষেত্রেও একটা সাহায্যকারি বিষয় হয়ে ওঠে, সেদিকে খেয়াল না রাখলে যৌনতার আসল মানে অনেক নিঃস্পৃহ হয়ে পড়ে। প্রেম জীবনের জরাজীর্ণতার ওপর একটা প্রলেপ বলেও অনেক কাজের মানুষেরা মনে করতে পারেন। আমার ধারণা, এটি একটি প্রক্রিয়া। কারণ, প্রেম না থাকলে কোনো কাজই ভালোভাবে করা যায় না। অনীহাও তো দুঃখের অন্যতম কারণ! প্রেম আর রাজনীতি খুব সম্পৃক্ত হওয়া উচিৎ কি উচিৎ নয়, সেটা আর একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। প্রেমকে যেদিক দিয়েই ভাবি, তার একটা সামাজিক ভূমি থাকে। কল্পলোকের সুবিধার মাহাত্ম্য বোধহয় এখানেই। সেখানে জৈবিক প্রেমও জাগতিকতার বাইরের একটা অবস্থান বলে মনে হতে পারে। যেমন মীরার প্রেম। এই নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু ভগবানের প্রতি ভক্তের প্রেমে, একাকীত্বকে কি অবকাশ বলেও ধরে নেওয়া যায়? স্থিরভাবে বলা খুব মুশকিল। তবে প্রেম এবং বিচিত্র প্রেম যে, মানুষের স্বাধীনতার বোধের একটা সূচক, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ‘সুখের সন্ধানে’ বইটিতে রাসেল সাহেব জানিয়েছিলেন, ভালোবাসা যা দেওয়া হয়, তা থেকে নয়, যা পাওয়া যায় তা থেকেই নিরাপত্তার বোধ জন্ম নেয়। তাহলে বাকি কি থাকে? না, অপরাধবোধ। খুব সুস্থ প্রেমেও এই বোধের কাজ এবং পদ্ধতি অন্যরকম চেহারা নিতে পারে। মানুষের ভালোবাসা না পাওয়াই যে আত্মকেন্দ্রিকতার একটা অন্যতম কারণ, রাসেল সাহেব এই কথাটি মেনে নিলেও, তার কোনো সর্বজনীন সত্তা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়ে ওঠেনি। ফলে, মানুষ ভাববাদী হন। কারণ, তাই-ই তাঁকে কিম্বা তাঁদের সাময়িক শান্তি কিম্বা স্বস্তির ক্ষেত্রে সহায়ক। ঠিক সেই কারণেই আজকের পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম এবং ধর্মের দ্বিচারিতার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সবারই একটা ধারণা থাকলেও, ঈশ্বর নামক একজন অলৌকিক ব্যক্তি ঠিক এই কারণেই মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠেন। এক কথায় একজন ভালো মনোস্তত্ত্ববিদ কিম্বা মনের চিকিৎসক তাঁর রোগীকে সেই কাজটির ভেতরেই রাখার চেষ্টা করবেন, কিম্বা পরামর্শ দেবেন, যা তাঁকে মানসিকভাবে তৃপ্তি দেবে। এবং একই সঙ্গে অন্যের ক্ষেত্রেও তা পীড়াদায়ক হয়ে উঠবে না। সেটা ঈশ্বরের ভাবনা ছাড়াও অন্য কিছুও হতে পারে। মোট কথা, রোগী হলে, তাঁর সামাজিক কর্তব্য অনেকটাই কমে যায়।     


 


 


মনই তো সব কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক। স্নায়ুর একটি কাব্যিক উপমা কিম্বা অংশ হিসেবেই মনকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সুকুমার রায়ের ‘গোঁফচুরি’ ছড়াটিকে একটু অন্য রকম করে শেষে এও বলা যেতে পারে, মনের আমি, মনের তুমি, মন দিয়ে যায় চেনা।  






 


 


 


টি টোকেন: চা বাগানের বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা - অসিত কুমার পাল || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article writing

 টি টোকেন: চা বাগানের বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা 

          অসিত কুমার পাল



পলাশীর যুদ্ধের পরে একটু একটু করে গোটা ভারতের শাসন ক্ষমতা প্রথমে ব্রিটিশদের হাতে চলে গিয়েছিল । তারা স্থানীয় ভাবে প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নিজস্ব কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছিল , সেই সঙ্গে সারা ভারতে অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা ( বিভিন্ন মূল্যমানের কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রা ) চালু করেছিল ।


 বহুদিন আগেই চিনে দেশের অধিবাসীরা লক্ষ্য করেছিল চা নামক এক প্রকার গুল্ম জাতীয় গাছের পাতার নির্যাস থেকে তৈরি এক প্রকার সুস্বাদু পানীয় দেহের ক্লান্তি দুর করে । অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত চীন দেশের বাইরে পানীয় হিসাবে চায়ের ব্যবহার ততটা প্রচলিত ছিল না । ব্রিটিশরাই চীনের বাইরে চায়ের ব্যবহার ছড়িয়ে দিয়েছিল । তারা লক্ষ্য করেছিল ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল চা চাষের উপযোগী । তাদেরই চেষ্টায় বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং জলপাইগুড়ি জেলা , বর্তমান আসামের কিছু অঞ্চল ও বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে অসংখ্য চা বাগান ও চা প্রক্রিয়া করন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল ।


 সেই সব চা বাগানের বিভিন্ন ধরনের কাজ করার জন্য বর্তমান ঝাড়খণ্ড ছত্তিশগড় ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । প্রধানত এজেন্ট বা দালালদের মাধ্যমে আদিবাসী সম্প্রদায়ের দরিদ্র পরিবারগুলোকে নানা সুযোগ সুবিধার লোভ দেখিয়ে চা বাগানগুলোতে নিয়ে যাওয়া হত । কিন্তু নারী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও চা শ্রমিকরা ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হত । তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা হত , খাদ্যের চাহিদা মেটাতে নিম্ন মানের খাদ্য শস্য বিতরন করা হত , চিকিৎসার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না ।


 সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার ছিল পারিশ্রমিক বাবদ কখনো শ্রমিকদের হাতে নগদ টাকা দেওয়া হত না । পরিবর্তে তাদের হাতে টি টোকেন ( Tea Token) নামে কিছু ধাতব চাকতি ধরিয়ে দেওয়া হত যার বিনিমনে নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল । চা বাগান কর্তৃপক্ষের তরফে দাবী করা হত উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে তাদের হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ থাকে না বলেই তার বিকল্প হিসাবে ওইসব টোকেন দেওয়া হয়েছে । প্রয়োজনে টোকেন এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ পাওয়া যাবে । কার্যক্ষেত্রে ওই সব টোকেন নির্দিষ্ট চা বাগানের বাইরে কার্যকর ছিল না , ফলে কোন শ্রমিক নিজের প্রয়োজনে টোকেন ব্যবহার করতে পারত না , এমনকি সেটার সাহায্যে বাড়ী ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট কেনাও যেত না । অনেকে বলে থাকেন কোন শ্রমিক যাতে কাজ ছেড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে না পারে সেজন্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে নগদ অর্থের পরিবর্তে ওইসব টোকেন দেওয়া হত ।






জাপানি কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা - শংকর ব্রহ্ম || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article writing

 জাপানি কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

শংকর ব্রহ্ম




                   আমরা জানি, উদিয়মান সূর্যের দেশ, চেরী ফুলের দেশ হিসাবে বিখ্যাত জাপান।

অন্যদিকে জাপানকে 'হ্রষতম কবিতার দেশ।' বলা হয়ে থাকে।

                    জাপানি কবিতা অন্যান্য দেশের কবিতার মতো নয়। সে দেশের কবিতা অবিমিশ্র- কাব্যিক ও অকাব্যিক কোন বিবেচনা প্রসূত নয়। কবিতার আকৃতি এখানে মূলতঃ হ্রস্বতম। জাপানের হাইকু (Haiku) কবিতার কথা আমরা অনেকেই জানি।

             এদের কবিতা চীনের কবিতার কাছে ঋণী হলেও জাতীয় মানসিকতায় পরিস্রুত। জাপানী কবিতা চীনের মতোই সংযত ও সংহত। ফলে তাদের কবিতায় অনেক কিছুই অনুক্ত (না বলা থাকে)। এক ফুলের কলির বিকাশে, সমগ্র বসন্তকে ধরার চেষ্টা এখানে কবিতায়। সন্ধ্যা ঝরা পাতার দৃশ্য বর্ণনায় হেমন্তকে ধরার প্রচেষ্টা। ঘাসের উপরে শিশির ফোটার দৃশ্যে সমগ্র জীবনের অনিত্যকে ধরার চেষ্টা।

জাপানে কবিতা চর্চা সমাজের সকলেই করে।

কবি বলে আমাদের এখানকার মতো, ওখানে কোন রকম কোন আলাদা কবি সম্প্রদায় নেই। সকলেই মোটামুটি কবিতা লিখতে পারেন। অনুভূতির প্রাধান্য ও ছন্দের সারল্যই এর মূল কারণ।


          জাপানের বেশীর ভাগ কবিতাই 'তানকা' বা 'ওয়াকা'। পাঁচ পংক্তিতে ( ৫-৭-৫-৭-৭) মোট একত্রিশ মাত্রায় রচিত। তাছাড়া 'হাইকু' (৫-৭-৫) মোট সতেরো মাত্রা, লেখার চলও আছে। 


              জাপানের প্রাচীনতম কবিতা সংগ্রহ 'কোজিকি' (৭১২ খ্রীষ্টাব্দে সংকলিত)। এর আগেও কবিতা মৌখিক ভাবে প্রচলিত ছিল, তবে তা লিপির অভাবে তখন লিপিবদ্ধ হতে পারেনি।


                 ৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে সংগৃহীত 'মানয়োও শুউ' 

( দশ হাজার পত্র সংগ্রহ) পৃথিবীর অন্যতম কবিতা সংগ্রহ।

                

'তানকা' হলো জাপানি সংক্ষিপ্ত কবিতা। 


(তানকা কি?

-ঠিক যেন উত্তেজনাপূর্ণ, টি- টুয়েন্টি ম্যাচের মতো ।)  


      জাপানিরা মনের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশ করতেই বেশী পছন্দ করে। 'কথা কম কাজ বেশী'। এই নীতিতেই তারা বিশ্বাসী। মানে অল্প কথায় ভাবের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে চায় তারা তাদের গীতি-কাব্যে। তাই জাপানকে বলা হয়

'হ্রষতম কবিতার দেশ।'


তানকার ফর্মটি (৫-৭-৫-৭-৭) মূলত ওয়াকা (waka) ফর্ম থেকে এসেছে ৷ 

জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে তানকার ব্যবহার করত, সেই অনুযায়ী ধ্বনিবিন্যাসই শ্রেয়। 


জীবনের সুখ দু:খ, আশা-আকাঙ্খা, হতাশা, প্রতিবাদ, আনন্দ, উল্লাস, নৈতিক অবক্ষয়, সবগুলিই তানকার বিষয় হতে পারে অনায়াসে। 

তানকায় (৫-৭-৫) -কে জাপিনিরা upper phrase( (কামি নো কু)-য়ে বিষয়বস্তু। 

(৭-৭) -কে বলে lower phrase (শিমো নো কু)-য়ে সারমর্ম। 


প্রথম তিন লাইনে বা চরণে প্রকাশ পায় বিষয়বস্তু, ভাবমূর্তি, রূপ-প্রতিরূপ, প্রতিচ্ছায়া-প্রতিচ্ছবি বা কথামালা এবং পরের দুই লাইনে প্রকাশ পায় সারমর্ম।

তানকা বিষয়ের দিক থেকে জোর দেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঋতুবৈচিত্র, জীবনের আশা নিরাশা প্রভৃতিকে।  


তিন প্রজন্মের তিনটি 'তানকা'-র উদাহরণ -

--------------------------------------------------------------


১).


ক্লান্তি বিহীন

গাও হে কোকিল।

এক বছরে

দুবার কখনো কি

বসন্ত আসে বলো?


(ফুজিয়ানা নো ওকিকাজে -৯১০ সাল)


২).


বিবর্ণ ফুল

আনমন হৃদয়ে

জগৎ দেখে,

সুবিশাল আকাশে

বসন্ত আসে ছুটে।


(রাজকুমারী শিকুশি - ১২০১ সাল)


৩).


এপ্রিল দূরে

মে মাসে বৃক্ষশাখা

ফুল শয্যায়

দিশাহারা নয়নে

অপেক্ষায় থাকে যে।


( মায়েদা য়ুউগুরে - ১৯৫১ সাল)


              জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে ধ্বনিবিন্যাসে

তানকা লিখেছেন ঠিকই, তবে বর্ণবিন্যাসেও আজকাল তানকা ও হাইকু লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়। আমরা যেহেতু তানকা বা হাইকুকে গীতি-কাব্য হিসেবে ব্যবহার করি না, সেই কারণে বর্ণবিন্যাসে লেখা হাইকু বা তানকা বাংলায় চলে যায়। 


হাইকু (Haiku) হল ওয়াকা ফর্মের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্ম। 

হাইকুতে (৫-৭-৫) সতেরোটি ধ্বনি আর তানকাতে (৫-৭-৫-৭-৭) একত্রিশটি ধ্বনি (সিলেবল) থাকে। এগুলি মূলতঃ জাপানিদের আবেগপূর্ণ গীতি-কাব্য ।


তিন প্রজন্মের তিনটি 'হাইকু'-র উদাহরণ -

-------------------------------------------------------------


১).


মাঝ রাত্তির

সমুদ্রে জলরাশি

উত্তাল হলো।


(রানসেৎসু - ১৬৫৩ সাল)


২).


পাখা ওয়ালা

এক বোবা হাওয়া

অসহ্য তাপ।


(কাকো-১৭০০ সাল)


৩).


সহসা সূর্য

অচেনা ফুলদলে

কবিতা লেখে।


(বাশো - ১৮৯৪ সাল).


    জাপানিরা 'সেনরু' নামে এক পংক্তির কবিতা লিখেছেন বহু। সেগুলি জনসমাজে খুবই জনপ্রিয়। মানুষের মুখে মুখে ঘোরে, আমাদের দেশের বাংলার প্রবাদের মতো। তবে বেশীর ভাগ লেখকরই পরিচয় জানা যায় নি।


এখানে কয়েকটা জাপানি 'সেনরু'-র উদাহরণ দিলাম। 


পাঁচটি 'সেনরু'-র উদাহরণ -

------------------------------------------


১).


সোহাগ করলে মেয়েটার কথা বেড়ালের মতো হয়,না হলে মেঘ গর্জন।

- অজ্ঞাত।


২).


বাজিয়ে জাগায় বাপ, বাঁশিটি সদ্য কেনা শিশুর জন্য। -শোকি।


৩).


দুজনে বেরোবো, স্বামী কথা বলে আয়নার সাথে। 

-সেইকো।


৪).


মেয়ে দেখতে এসে, মাকে পছন্দ হল শেষে।

-অজ্ঞাত।


৫).

স্ত্রী রাতেই থিয়েটারে যায়,স্বামীকে নেয় না সঙ্গে। -হাম্পনসেন।


       জাপানের কবিতা মূলতঃ চিত্রকল্প প্রধান। জাপানের প্রাচীন যুগের প্রতিভাধর কবিরা হলেন - হিতোমারো, য়াকামোচি, ওকুরা প্রমুখ।



হিতোমারো (জন্ম-৬৮১ সালে -মৃত্যু সাল জানা যায়নি)

---------------------------------------------------------------------------


১).


প্রভাত-ঘুমের কেশ

আঁচড়াব না তো,

লেগে আছে

সুরূপ প্রিয়ের

বাহু-বালিশের পরশ।


২).


আকাশ সাগরে

ঢেউ-তোলা মেঘে

চাঁদের জাহাজ,

তারার অরণ্য দিয়ে

দাঁড় বেয়ে যায়।


য়াকামোচি (৭১৮-৭৮৫ সাল)

------------------------------


১).


সন্ধ্যা এলে

আগেই দুয়ার খুলে

প্রতীক্ষায় থাকি -

সে বলেছে আসবেই

স্বপ্নে দেখা দিতে।


২).


ছল করে বলেছি

'যাই তো দেখি

কি হাল হয়েছে

বাঁশের বেড়ার'

আসলে তোমার দেখা।


ওকুরা (৬৬০-৭৩৩ সাল)

-----------------------


দুর্গত

-----------


যদিও প্রবাদ -

এ আকাশ,পৃথিবী বিশাল,

আমি তো দেখেছি তারা

গুটিয়েছে আমার উপর।


যদিও প্রবাদ -

চন্দ্র- সূর্য দ্যুতিময় 

আমি তো দেখছি তারা

আমার উপর যেন কিরণ বিমুখ।


সব মানুষেরই কি এই দুর্ভোগ

নাকি আমর একার?

পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি মানুষের

ক্ষেতে খামারে করেছি

কঠোর শ্রম সকলের মতই।

তবু আমার পোষাক

মোটা পাটের সূতোর

পাতলা জ্যালজ্যালে ফতুয়া

কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলে

শতচ্ছিন্ন টুকরোয়

সমুদ্রের কর্কশ শ্যাওলা

এর চেয়েও ভাল।


আমার বাড়িটা চালাঘর

ছড়ানো খড়ের নীচে

নগ্ন শীতল মাটিতে

নীচু ছাদ অর্ধেক নেমেছে।

উপরে আসনে 

বাবা মা বসে গুটিশুটি

আর নীচে 

স্ত্রী ছেলে মেয়েরা

বসে আমার গা ঘেঁষে

নির্দয় কান্নায়।


ঘরের উনুনে

আগুন তোলে না ধোঁয়া

হাড়িতে একাকী

মাকড়সা জাল বুনে চলে।

আমরা ভুলেছি 

রান্না করাটাও

রাতের চড়াই হয়ে

ক্ষীণ কান্নায় ভাঙি।

তবুও এই শেষ নয়

দুর্দশার চূড়ান্ত পর্যায়ে।

লোককথা -

ছোটকে ছোট করতে গিয়ে

দরজায় লাঠি হাতে

ভীমমূর্তি রাজ-পেয়াদা

হাক পাড়ে

জাগো, খাজনা দাও।


এই কি তবে জীবন হবে

সাধ্যাতীত, আশাহীন

এই কি জগতের রীতি?


উপসংহার -


আমরা ভাবতে পারি কেউ

জীবন বেদনাময়

আমাদের ভাগ্য লজ্জাকর,

মানুষ তো পাখি নয়

যে উড়ে গিয়েও মুক্তি পাবে।


                      হেইয়ান যুগে (৯১৭ সাল - ১১৮৫ সালে) দেখা গেছে একটা আশ্চর্য ব্যাপার, পুরুষরা কাব্য রচনা করত চিনা ভাষায়, আর মহিলারা করত জাপানী ভাষায়।

                         ৯০৫ সালে 'ৎসুরায়াকি' সংকলিত 

'কোকিন শুউ' ( প্রাচীন ও আধুনিকদের একত্রিত কাব্য সংকলন)।

                 কামাকুরা (১১৮৫- ১৩৩৩ সালে) যুগের মাঝামাঝি থেকেই 'তানকা'র ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে।

                 মোরুমাচি(১৩৩৩-১৬০০ সালে) যুগে 'রেঙ্গা' বা যুক্ত কবিতার খুব প্রচলন হয়।রেঙ্গা মূলতঃ তানকা, প্রথম তিন পংক্তি একজনের বাকী দুটি অন্যের।

তোকুগাওয়া (১৬০০-১৮৬৮ সালে) যুগে কবিতার তেমন উন্নতি হয়নি। এ যুগের বৈশিষ্ট হলো, 'এদো' ও 'সেনরু'। দু'টিই হাইকু ধরণের কবিতা।

'এদো' সম্পূর্ণ ব্যাঙ্গাত্মক লেখা।

'সেনরু'- এ ফুটে ওঠে জীবনের অন্তর্দৃষ্টি। জাপানী সাহিত্যের মূল ধারা নয় বলে 'এদো' ও 'সেনরু'র অবক্ষয় ঘটে পরবর্তীকালে।

                                সম্রাট মেইজীর রাজত্বকালে মেইজী যুগে (১৮৬৮-১৯১২ সালে) দেশে বিরাট পরিবর্তন আসে, (রুদ্ধদ্বার খুলে গিয়ে) জাপানী কৃষ্টির পুরর্জীবন ঘটে, আধুনিকতাবাদের শুরু হয়।

ইউরোপীয় কাব্যানুবাদের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ কবিতা লেখার প্রচলন ঘটে। নাম হয় ' শিন তাই শি' অর্থাৎ 'নতুন বড় কবিতা'।

           বিভিন্ন মতবাদের মধ্য দিয়ে জাপানী কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। কাব্যিক উপমা, উৎপ্রেক্ষা পরিহার করে সহজ সরল গদ্য কবিতা লেখা শুরু হয়।

          বর্তমানে সেখানে এখন 'শোয়া' যুগ ( ১৯২৬- ২০২২ সাল) চলছে। ইয়োরোপীয় ডাডা-ইজম, চীন-রাশিয়ার সর্বহারাবাদ, ফরাসী দেশের বিপ্লববাদ, সুকুমার ও ধ্রুপদী সাহিত্যের মেলবন্ধনে নতুর ধারার লেখার লেখালেখি

চলছে এখন সেখানে। সেখানে এখন 'হাইকু' বা 'তানকা' লেখা হয় না বললেই চলে। 

          আর আমরা বাংলা ভাষায়, ওদের পরিত্যক্ত জিনিষ ('হাইকু' বা 'তানকা') নিয়ে গর্বের সঙ্গে চর্চা করে চলেছি। সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ ! 


       দীর্ঘ ষোল শতাব্দী ব্যাপী জাপানী কবিতার সংক্ষিপ্ত

ইতিহাস প্রায় এইরকম।




মতুয়া সম্প্রদায়: আরেকটি আত্মঘাতী হিন্দুদের দল - বরুণ মণ্ডল || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article writing

 মতুয়া সম্প্রদায়: আরেকটি আত্মঘাতী হিন্দুদের দল

বরুণ মণ্ডল



    হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের বিভেদের অন্ত নেই। শাক্ত, বৈষ্ণব তো ছিলই। এসেছে মতুয়া, জগৎবন্ধু, অনুকূল পন্থী, লোকনাথপন্থী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, রামকৃষ্ণ মিশন, আউল, বাউল, ফকির, কর্তাভজা বা সহজিয়াপন্থী ইত্যাদি অগুনতি ধর্মমত। কেউ কারো সমালোচনা করতে ছাড়েন না; যুক্তি দেন তারাই ঠিক, বাকিরা ভুল। আর সুবিধাবাদী হিন্দু বিরোধীরা ভদ্রলোকের মুখোশ পরে হিন্দু ধর্মের মধ্যে ডিভাইড এন্ড রুলস পলিসি চালানোর জন্য সাধারণ হিন্দু জনতাকে বোঝায় 'যত মত তত পথ'! ধর্মের এই ভুলভুলাইয়াতে সাধারণ হিন্দুরা আজ নাজেহাল।

    বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম সম্পর্কে অসচেতন। ফলে ধর্মের তত্ত্ব নিয়ে তাদেরকে 'হিপটোনাইজ' করা খুবই সহজ। এই কারণে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। দোষ ধর্মের নয়, এ দোষ অজ্ঞতার। যত মত তত পথের দোহাই দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মপথ বা ধর্মের শাখাগুলোকেও মহামূল্যবান মনে করে মুখ্য বা ধর্মের মাতৃস্বরূপ 'সনাতনধর্ম'কে হেলাফেলা করার চেষ্টা করে। একদল ধর্মের যত মত তত পথের ভুলভুলাইয়াতে পড়ে ধর্মকেই অসম্মান বা অমান্যতা করে। যেমন কিছু সাম্প্রদায়িক লোক মনে করে যে সনাতন ধর্ম একটি সাম্প্রদায়িক ধর্ম। কিন্তু এটি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং বিকৃত বুদ্ধিজাত অন্ধকারের প্রকাশ। আমরা যদি আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন ধর্মের যথার্থতা বিশ্লেষণ করি তখন দেখব যে এই ধর্ম পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ধর্ম, শুধু তাই নয় এই ধর্ম সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জীবের ধর্ম। হিন্দু ধর্মের মধ্যে এই বিভেদতার কোন স্থান নেই। যত মত তত পথের দিশা নেই। ধর্ম নিয়ে কোন সংশয় নেই। ধার্মিক, অধার্মিক, নাস্তিক সবার প্রশ্নের সব উত্তর যথেষ্ট ভাবে মজুত আছে।

     হিন্দু শাস্ত্রের বিশালতা এবং মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতার সংকীর্ণতা ধর্মের সংশয় সৃষ্টি করেছে। আপাত অর্থে বৈদিক রীতিনীতি গুলিকে ধর্মীয় কুসংস্কার মনে হলেও গবেষণা করে জানা যাচ্ছে সুগভীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যেমন,নিরামিষ ভক্ষণ ক্ষতিকর ঘোষণা করেও আজকের প্রতিটি গবেষণা প্রমাণ করছে নিরামিষ খাদ্যই অতি উত্তম। একাদশী উপবাস পালন ধর্মীয় কুসংস্কার মনে করলেও আজ প্রমাণিত উপবাস কতখানি স্বাস্থ্যসম্মত। গবেষণায় আজ প্রমাণিত যে গায়ত্রী মন্ত্রের ব্রহ্মমুহূর্তের নিয়মিত উচ্চারণ মস্তিষ্কের উর্বরতা ঘটাতে অদ্বিতীয়। ইত্যাদি কত কিছু।

   বর্তমানে কিছু জাত-পাত ভেদাভেদ করা মানুষ বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করেছে, মতুয়া সম্প্রদায়িত ব্রাহ্মণদের কথা শুনলে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে! ব্রাহ্মণদের জন্যই নাকি তাদের এত অধঃপতন! কিন্তু সঠিক আলোচনার প্রয়োজন এর জন্য আজকের এই আলোচনা।

   পৌরাণিক ইতিহাস জানাচ্ছে, ত্রেতা যুগে ক্ষত্রিয়দের হাতে শাসন ক্ষমতা ছিল, মহাভারতের সময়কালে যাদব ও ক্ষত্রিয়দের হাতে শাসন ক্ষমতা ছিল, এরপর দলিত, মৌর্য্য, বৌদ্ধদের হাতে শাসন ক্ষমতা ছিল, তারপরে ৬০০ বছর আরব লুটেরা মুসলিম বাদশাহদের হাতে ভারতের শাসন ক্ষমতা ছিল। তারপরে ৩০০ বছর ব্রিটিশদের হাতে শাসন ক্ষমতা ছিল, এরপর ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ৭৫ বছর ধরে আম্বেদকরের সংবিধানের হাতে ভারতের শাসন ক্ষমতা রয়েছে। এরপরও বলা হচ্ছে যে সমাজে সবচেয়ে বেশী অত্যাচার নাকি ব্রাহ্মনদের দ্বারা করা হয়েছে।

   বর্তমানে ব্রাহ্মনদের গালি দেওয়া, অপমান করা একটা ট্রাডিশনে পরিনত হয়েছে। কেউ কেউ ব্রাহ্মনদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তো কেউ আবার ব্রাহ্মনদের মন্দির থেকে বের করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে । কিছু তথাকথিত মানুষ বিশেষত মতুয়া সম্প্রদায়ের দলপতিগোসের ব্যক্তিরা আজও অভিযোগ করেন, ব্রাহ্মনদের কারনেই নাকি উনারা পিছিয়ে পড়া জাতিতে পরিনত হয়েছে। কেউ আবার বলেন সমাজে পিছিয়ে পড়ার মূলে ব্রাহ্মনরা দায়ী, দেশে অন্ধবিশ্বাসের মূলেও নাকি ব্রাহ্মনরা দায়ী। এমনকি কিছু উচ্চ শিক্ষিত ব্রাহ্মণের সন্তানও এই দাবিগুলিকে সমর্থন করে! কিন্তু এই দাবি কতটা সত্যি!

   বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিবিদ কৌটিল্য ব্রাহ্মণ সন্তান ছিলেন, যিনি মগধ রাজ্যকে সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছিল এবং জনহিতৈষী সরকার স্থাপনা করেছিলেন, ভারতের সীমানা ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন এবং কালজয়ী 'অর্থশাস্ত্র' রচনা করেছিল যেটা আজ সারা বিশ্ব পড়ছে ।

   আদি শঙ্করাচার্য যিনি সমস্ত হিন্দু সমাজকে এক সূত্রে বাঁধার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, যার ফল স্বরুপ চারধাম যাত্রা শুরু করেন, চারটি মঠ নির্মান করেন সেই আদি শংকরাচার্যও কিন্ত ব্রাহ্মন ছিলেন ।

   আজ কর্নাটকের যে লিঙ্গায়েতদের কংগ্রেস হিন্দুদের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে সেই লিঙ্গায়েতদের গুরু এবং লিঙ্গায়েতদের সংস্থাপক বাসব একজন ব্রাহ্মণ ।

    ভারতের সামাজিক ও বিচারগত উত্থান, ভিন্ন জাতির সমানতা, ছুত-অচ্ছুত ভেদভাবের বিরুদ্ধে সমাজকে এক করার জন্য ভক্তি আন্দোলন করার মূল পথপ্রদর্শক সন্ত রামানন্দ একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন । আজ দিল্লীর অক্ষরধাম মন্দিরে সব জাতির প্রবেশ অবাধ সেই মন্দির স্থাপনাকারী স্বামী নারায়ণ সম্প্রদায়ের ছিলেন, যার জনক ঘনশ্যাম পান্ডেও একজন ব্রাহ্মণ ছিল ।

আর্য সমাজ ও ব্রহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতীও ব্রাহ্মণ সন্তান ছিলেন ।

    সতীদাহ প্রথা থেকে সমাজকে মুক্তি দেওয়ার মূল কারিগর রাজা রামমোহন রায় একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।বিধবা বিবাহ আইন চালু করার মূল কারিগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

   ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের মহিমা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন 'রামচরিত মানস' এর রচয়িতা তুলসীদাসও একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

 বন্দেমাতরমের মত গান লিখে দেশপ্রেম জাগানো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

   নেহেরু সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পদত্যাগ করা এবং কাশ্মীরকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সেই জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

   হিন্দু সমাজের একতা এবং হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে তৈরী সংগঠন "রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের" প্রতিষ্ঠাতা ডঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

সঙ্ঘের দ্বিতীয় সর-সঙ্ঘচালক ডঃ গোলওয়ালকরও একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

  একাত্ম মানবতাবাদের জন্মদাতা পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ও একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

   ১৯৪৬ সালে "দ্যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং" থেকে হিন্দুদের রক্ষাকর্তা গোপাল মুখোপাধ্যায়ও একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ।

  এরপরও যদি কেউ মনে করেন ব্রাহ্মণরা শুধু মন্দিরে ঘন্টা বাজাতে এবং চাল ডাল কলা আয়ের জন্য শুধু পৌরহিত্বের কাজে লাগে তারা জেনে নিন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘোড়সওয়ার বীর যোদ্ধা যিনি ২০ বছরে কোনো যুদ্ধে হারেননি, যিনি মুসলিম শাসকদের আতঙ্কিত করে রেখেছিলেন সেই বাজীরাও বল্লাল একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন যাকে "বাজীরাও মস্তানী" ফিল্মে দেখে আপনারা হাততালি দিয়েছিলেন ।

   ব্রাহ্মণরা সমাজকে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করে গেছেন, ব্রাহ্মনরাই জাত পাতের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ব্রাহ্মনরাই সমাজের কুসংস্কারকে দূরে সরানোর জন্য প্রতিবাদ করে গেছেন তাই হিন্দুদের মধ্যে বিভেদের রাজনীতি ঢোকানোর জন্য ব্রাহ্মনদের গালি দেওয়া, অপমান করা বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র জাতিভেদ প্রথা নয়। সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করবার এক অবিসংবাদি কৌশল। চার ধরনের সৈন্য দ্বারা হিন্দু সমাজকে দূর্ভেদ্য চক্রব্যূহ রচনা করা হয়েছিল স্বয়ং বৈদিক ঋষিদের কর্তৃক। এই কর্মভেদ বা ক্ষমতা অনুসারে পদের বিভাগ প্রতিটি সফল কর্ম ক্ষেত্রে আজো দেখা যায়। যারা বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ছেন তারা বেশ ভালো রকম জানেন। সনাতন ধর্ম কৃষ্টি কালচার বিরোধী অপশক্তির অপপ্রচারে সেই প্রতিরক্ষার চক্রব্যূহের প্রধান ব্যূহ 'ব্রাহ্মণ' অংশকে চিহ্ন ভিন্ন করা হয়েছে। 

 মতুয়া সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মের প্রতিরক্ষার চক্রব্যূহের প্রধান অঙ্গ ব্রাহ্মণের উপর আঘাত হেনে ে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু গীতা অনুসারে ব্রাহ্মণ কোন জাত নয়। গুণের আধারে চতুরবর্ণ ভগবান স্বয়ং সৃষ্টি করেছেন। গীতার চতুর্থ অধ্যায় তেরো নম্বর শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন, "চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।/ তস্য কর্তারমপি মাং বৃদ্ধ্যকর্তারমপি মাং বৃদ্ধ্যকর্তারমপিব্যয়ম্।।" অর্থাৎ প্রকৃতির তিনটি গুন ও কর্ম অনুসারে আমি মানব সমাজে চারিতি বর্ণ বিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে। 

   ব্রাম্ভন-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য এবং শূদ্র এই বিভাজন নিয়ে আমাদের কত দুশ্চিন্তা। কত আন্দোলন চলছে। এই বর্ণভেদ সৃষ্টিকারী গীতা এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেও সমালোচনা করতে ছাড়ছিনা। অথচ শ্রীমদ্ভাগবতগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে, কৃষ্ণভক্ত বা বৈষ্ণব ব্রাহ্মণের থেকেও উত্তম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি যেমন সমাজের চার বর্ণের অতীত, তার ভক্তও তেমন এই বর্ণ বিভাগের অতীত; এমনকি তিনি জাতি কুলাদি বিচারেরও অতীত। তাহলে যারা বলছেন হিন্দু সমাজের বর্ণভেদ প্রথার জন্য হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন সম্প্রদায় তৈরি করার প্রয়োজন। (যে কারণে মতুয়া সম্প্রদায় আন্দোলন করছে) আসলে কি তারা হিন্দু ধর্মটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝেছেন? নাকি বিধর্মীদের চালাকিতে পড়ে আত্মহননের পথ অবলম্বন করেছেন!

   এ তো গেল শাস্ত্রীয় যুক্তি তক্কের কথা। স্বাধীনতার প্রাক্কালে যোগীন্দ্রনাথ মন্ডলের কাহিনী নিশ্চয়ই সবার জানা। স্বজাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং বিজাতির প্রতি মোহের ফলে কিভাবে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল। সে কাহিনীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাতে আলোচনা আর দীর্ঘ করছি না। বর্তমান রাজনীতিতেও মতুয়া সম্প্রদায় সেই যোগীন্দ্রনাথেরই পথ অবলম্বন করছেন। ইতিহাস থেকে তারা শিক্ষা নিচ্ছেন না। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মতুয়াদের মাখামাখি শুধু আজকের নয়। তারা বামপন্থীদের সঙ্গেও ছিল, তৃণমূলের সঙ্গেও আছে আবার বিজেপির সঙ্গে আছে। পাওনা গন্ডার রাজনীতি দূরদৃষ্টিতার পরিচয় নয়। অবশেষে অতি সংক্ষেপে বলি,যে রাজনীতি ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতি সর্বোপরি অস্তিত্বকে রক্ষার রসদ যোগায়, সেই রাজনীতিকে আদর্শ করে এগিয়ে যাওয়াই দূরদৃষ্টিতা।



জানুয়ারি সংখ্যা ২০২৩ || January Sonkha 2023 || Monthly Magazine || প্রথম পাতা - সূচিপত্র ও সম্পাদনা


 


পত্রিকা সম্পাদনা যে একটা সহজ কাজ নয়, তা প্রত্যেক সম্পাদক-ই জানেন। আসলে কবিত্ব শক্তি নিয়ে বাঁচতে চাই এমন মানুষদের পর্যবেক্ষণ করা কতটা কঠিন তা অনেক মানুষ জানেন। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডার মাসিক পত্রিকার জানুয়ারি সংখ্যা বের করার জন্য যে লেখা আহবান করা হয়েছিল। তারজন্য যথেষ্ট সাড়া আমি পেয়েছি। আমি যদিও আমার পত্রিকার কাজে সম্পূর্ণ একা। তবে আপনাদের মত লেখক সমাজ নিজের সৃষ্টি করলাম নিয়ে আমার পাশে থেকেছেন , এতে আমি খুশি। 

যাই হোক ইতিমধ্যে সম্পাদনার কাজ শেষ। পত্রিকা প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। আপনারা যাদের লেখা এখানে মনোনীত হয়েছে তাদের এবং বাকি লেখকদের যাদের লেখা মনোনীত হয়নি তাদেরকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা অবশ্যই পরবর্তীতে আমাদের পাশে থাকবেন। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই সকল বন্ধুদের। সকল পাঠকদের। সকল সাহিত্য পথিকদের। ভালো থাকুন সবসময়। লেখাই থাকুন। ভালোবাসা রইল।


বিঃদ্রঃ - নীচে দেওয়া সূচিপত্র টি ভালো করে পড়ুন। সকলেই নিজের নামে ক্লিক করুন। ওটাই আপনার লেখার লিংক।👇👇👇🙏

_________________________________________



__________________________________________
 
                    (সূচিপত্র)



বাংলায় কবিতা লিখছেন :






















___________________________________________

ইংরেজি কবিতা লিখছেন:




___________________________________________________



__________________________________________________

Photography:




__________________________________________________

গল্প লিখছেন: 







_________________________________________________

রম্যরচনা / মুক্তগদ্য লিখছেন: 


__________________________________________________



_______________________________________________

প্রবন্ধ/নিবন্ধ লিখেছেন:




_____________________________________________



কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড - শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় || রম্যরচনা/মুক্তগদ্য


কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড

    শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়


 


বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। আবার গাছ-গাছালি মোরাম বেছানো রাঙা পথ থাকলেও বিশ্বভারতীর সঙ্গেও ঠিক মেলে না। ওটা বড্ড বড় আর ছড়ানো। আবার যাদবপুরের মতোও বলা যায় না। কারণ বর্ধমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিল ঘেরা কোনও একটি নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস নেই। বিভিন্ন পড়াশুনোর বিভাগের একাধিক ইমারত, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বা সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, গবেষক ছাত্রদের আবাসন এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোলাপবাগের মনোরম পরিবেশে। বড় বড় পুকুর, দীঘি, পরিখা আর ছায়াতরু। পরিখাগুলোই কোনও কোনও দিকে গোলাপবাগের সীমানা। গোলাপবাগের সংলগ্ন তারাবাগে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের কোয়ার্টার আর ছাত্রী ও গবেষিকা ছাত্রীদের হোস্টেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর আবার প্রায় এক কিলোমিটার দূরের রাজবাটীতে। তারাবাগ থেকে রাজবাটী যাওয়ার পথে পড়ে কৃষ্ণসায়র পার্ক আর পর পর ছেলেদের হোস্টেলগুলো। ছাত্রীর সংখ্যা বেশি হলেও ছাত্রীনিবাসের চেয়ে ছাত্রাবাসের সংখ্যা বেশি। গোলাপবাগ থেকে সরাসরি তারাবাগ যাওয়ার রাস্তায় পড়ে কচুরিপানা ঢাকা একটা পরিখা, যা পেরোতে হয় একটা জেড আকৃতির কাঠের সাঁকো দিয়ে। সাঁকো দিয়ে অনেকে মিলে হুড়মুড় করে যাওয়া যাওয়া চলে না। দুপ্রান্তের দুখানা গেট এমন ভাবে খোলে যে একে একে লাইন দিয়ে গেট পেরোতে হয়।


        গোলাপবাগে কলা বিভাগের জন্য যে অট্টালিকা আছে, তার নাম ‘হিউম্যানিটিস বিল্ডিং’। তার দক্ষিণ দিকে, যেদিক দিয়ে ক্যান্টিন ও তারাবাগ যেতে হয়, সেদিকে রয়েছে অনেকগুলো বড় বড় বৃক্ষ। একটা ইঁট বাঁধানো রাস্তা সোজা গিয়ে সমকোণে বাঁক নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে গেছে, তারপর আবার বেঁকেছে সাঁকোটার দিকে। তবে সেই স্বল্প ব্যবহারে ঘাসচাপা রাস্তাটা দিয়ে কয়েকজন অধ্যাপকই কেবল যাওয়া আসা করতেন। আমরা ছাত্রছাত্রীরা সবাই ঐ এল-আকৃতির অফিশিয়াল রাস্তার বদলে একখানা পায়ে হাঁটা কোণাকুণি সংক্ষিপ্ত পথ ধরে ক্যান্টিন পর্যন্ত যেতাম। তারপর সাঁকোর রাস্তাটা একই। ঐ বিশাল গাছগুলোর নীচে আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে চলতে বেশ লাগত।


        সেই গাছগুলোর শাখায় শাখায় শাখামৃগ। গোটা তারাবাগের গাছগাছালিতেও ছিল বানর সাম্রাজ্য। আস্ত কিষ্কিন্ধ্যাই বলা যায়। তারা বড় কোনও অনর্থ বা খুনখারাপি ঘটিয়েছে বলে তখনও পর্যন্ত জানা ছিল না। তবে তাদের উৎপাতের সঙ্গে সহাবস্থান ছিল ছাত্রীনিবাসগুলোর আবাসিকদের রোজকার ব্যাপার। আমাদের নিবেদিতা হোস্টেলের পেছনের উইং-এর বেসিন চার-পাঁচবার ভাঙার পর আর নতুন করে লাগানোই হয়নি। সম্ভবত তাদের আক্রোশটা বেসিনের ওপর ছিল না। কৌতুহল ছিল দেওয়ালে লাগানো আয়নাটার প্রতি। এখন বেসিনে বসে তিনটে গোদা মিলে আয়নায় নিজেদের যমজ দেখার জন্য ঠেলাঠেলি করলে বেসিনের আর দোষ কী?


        হোস্টেলের সাধারণত বৈকালিক জলখাবার ছিল চার স্লাইস কাঁচা পাঁউরুটি, একটা সিঙাপুরি কলা আর খানিকটা গরম জল। গরম জল দিয়ে আমরা হরলিক্স, কমপ্ল্যান ইত্যাদি গুলে খেতাম। চা, কফি করতে হলে ঐ হাত-সওয়া গরম জলে কাজ হত না। প্লাগ পয়েন্টে কেরামতি করে কিছু কিছু মেয়ে ঘরের মধ্যে হীটারের ব্যবস্থা করেছিল। আমিও তেমন এক অস্থায়ী বন্দোবস্তে পুঁচকে একটা ইমার্শন হীটারে চা-কফি থেকে গার্গেলের গরম জল করে নিতাম।


        আমরা জানি বাঁদররা কলা পছন্দ করে। কিন্তু কোনও দিনই কলা ছিনতাই করার জন্য বানরসেনা হানা দেয়নি। কিন্তু মাসের শেষে ‘গ্র্যান্ড’-এর দিন কেক, পেস্ট্রি, মোগলাই এসবের আয়োজন হলেই মুখ বদলানোর জন্য তারা হাজির হত। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, ঘুননির বাটিও চেটেপুটে সাফ করে দিচ্ছে। অতঃপর লুণ্ঠিতদের সঙ্গে বাকি যারা আক্রান্ত হয়নি তারা খাবার ভাগাভাগি করে নিত দরজা এঁটে। এক-একটা খুপরি ঘরে সাত-আটজনের জমায়েত। মেস ম্যানেজাররাও বন্ধু সেবায় লেগে যেত।


ছেলেদের হোস্টেলে মেস ম্যানেজাররা নিজেদের জন্য যেমন ভালোমন্দ খাবার বেশি করে বরাদ্দ করে নিত, মেয়েদের হোস্টেলে তেমনটা হতে পারত না। সকলকে খাইয়ে যখন ম্যানেজাররা বড় ডাইনিং-এ খেতে বসত, তখন কচ্চিৎ-কদাচিৎ যদি বাড়তি মাছ জুটত তো কোনওদিন তরকারিটাও কম পড়ে যেত। তার ওপর ছিল বাঁদরের বাঁদরামি। তার ক্ষতিপূরণটাও সকলে ভাগযোগ করেই দিতাম। শুধু বাঁদর কেন, ঘরে খাবার নিয়ে যাওয়ার পথে কাকে পাত থেকে মাছ তুলে নিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। চোখের জল চেপে রেখে তখন ঘেন্নায় সমস্ত খাবারটাই ফেলে দিতে হত।


        একবার এক গ্র্যান্ডে আমি দুই হাতে দু’রকম সুখাদ্য নিয়ে এক মর্কটের মুখোমুখি। প্রায় কাবাডি খেলার মতো চুক্কি দিয়ে নিজের তিনতলার ঘরে ঢুকে যেই দরজা দিয়েছি, অমনি শুনি পরিত্রাহী চিৎকার। আমার রুমমেট ছিল না। আমি একটু আগুপিছু না ভেবে এগিয়ে যাওয়া বোকাহাবা বলেই কিনা কে জানে, মাঝে মাঝে এমন কিছু করে বসতাম, যা অন্য মেয়েরা সাহস করত না। চিৎকার শুনে নিজের ঘর থেকে বাইরে করিডোরে এসেই খবর পেলাম সুক্তিদের ঘরে হনুমান ঢুকেছে। গোটা তিনতলার সবকটি মেয়ে যে যার ঘরে ঢুকে খিল এঁটে চেঁচাচ্ছে। এমনকি করিডোরের দিকে জানলাও বন্ধ করে দিচ্ছে, যাতে দুর্বৃত্তরা হাত গলিয়ে কোনও অনিষ্ট করতে না পারে। আমি আমার ঘরের দরজার ল্যাচ্ টেনে চিৎকার ধ্বনি ধরে এগোলাম আক্রান্তদের ঘরের দিকে।


        কী সর্বনাশ! দরজা বন্ধ যে! জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম বজরংবলী কাউকে খিমচোচ্ছে বা মারছে কিনা। দরজাটা বন্ধ নয়, ভেজানো মাত্র। কব্জা আলগা হয়ে বাতাস বা তার ছেলের ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে। হনুমানটা তস্করবৃত্তি সেরে বেরোতে না পেরে টেবিলে বসেই ভোজ সারছে। আমি কপাট ঠেলে খুলে দিলাম। তবে ‘হ্যাট্‌ হ্যাট’ বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। হতচ্ছাড়া মুখপোড়া টিবিলে জুত করে বসে এক হাতে পেস্ট্রি আর এক হাতে রোল বাগিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। সে মাসে বেশি ছুটি ছিল বলে অনেকেই বাড়িতে কাটিয়েছে বেশির ভাগ দিন। মাসের শেষে ম্যানেজারদের হাতে ভালোই টাকা ছিল। তাই আয়োজনটাও মন্দ হয়নি। আহা! হনুমানটার কী বরাত সেদিন! সঙ্গীসাথী কেউ আসেনি ও ঘরে। একাই পাঁচজনের ভোগের দখল পেয়েছে।


ঘরের ভেতর পাঁচজন আমায় দেখে চেঁচানি কমিয়েছে, কিন্তু থামায়নি। তাদের আতঙ্কিত আর আমার আসহায় দৃষ্টির সামনে হনুটা কিছুক্ষণ পর পরিতৃপ্ত হয়ে এলোমেলো খাবার ছিটিয়ে উঠে বেরিয়ে এল। আমি সভয়ে ও সসম্ভ্রমে দরজা ছেড়ে দিয়ে তফাতে সরে গেলাম। পাথরের বজরংবলী হলে না হয় কথা ছিল। জীবন্ত হনুমানজীর প্রসাদ কে খাবে? কেকা ভাগ্যিস নিজের খাবারটা একটা থালায় রেখে আর একটা থালা চাপা দিয়ে রেখেছিল। সেটা বাঁচে গেছে। আমি আমারটাও সাবধানে এনে দিলাম। তারপর দুজনের খাবার ছয় ভাগ। সঙ্গে চা আর কফি মিলিয়ে চাফি।


 


        এমন লুটেরাদেরও ঘর সংসার থাকে। বাপেরা বাচ্চার খোঁজ না রাখলেও অঞ্জনি রুমারা তাদের সন্তানদের বুকে করে ঘোরে। বড় করে তোলে। আর তারপর তো সবাই রোজগেরে। গাছের কলা, কৎবেল, চালতা, আম, জাম, কাঁঠাল - যখন যেটা জোটে পেড়ে বা কেড়ে খেতে তো লাইসেন্স লাগে না, মেয়েদের হোস্টেলে ঢুকে হুজ্জোতি করলেও পুলিসে ধরে না, বা আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে বেসিন ভেঙে দিলে ফাইনও করা হয় না। সুতরাং বালী, সুগ্রীব, অঙ্গদরা যখন খুশি দোল খায়, যখন খুশি লুঠতরাজ চালায়।


        এমন বানর-রাজ্যে একবার এক মানুষই বাচ্চা চুরির অপবাদে গণ পিটুনি খায় আর কি। মানুষটা কোনও ষণ্ডাগুণ্ডা লোক নয়, কোনও দীর্ঘদেহী পেটানো চাহারার ছাত্রও নয়। এক নিরীহ পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি দৈর্ঘ্যর, উনত্রিশ ইঞ্চি ছাতির আর চৌঁত্রিশ কেজি ওজনের বছর একুশের একটি মেয়ে, যে তার হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্টের দিন পাঁচজন বাঁদর-বন্দীকে মুক্ত করেছিল।


        আমি ডিপার্টমেন্ট থেকে সচরাচর একাই ফিরতাম। বর্ষায় টানা বৃষ্টির পর সেদিন রোদ উঠেছিল; কিন্তু গাছের তলার পায়ে হাঁটা পথটা জলে কাদায় দারুণ পেছল। কেন যে আমাদের ইঁট বেছানো রাস্তাটার কথা খেয়াল থাকত না, কে জানে? আসলে অব্যবহারে ঘাস গজিয়ে ওটা চোখেই পড়ত না, মনেও থাকত না। জল কাদা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে হাঁটছি। এক জায়গায় কাদা ডিঙোতে গিয়ে দেখি একটা পুঁচকে বাঁদর ছানা কাদা মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। মুখ, হাত, পায়ের লালচে আভা কাদার মধ্যেও ফুটে আছে। ইস্‌! এক্কেবারে সদ্যোজাত। মা-টা কোথায়? বেচারার নিজে ওঠার ক্ষমতা হচ্ছে না। মা, বাবা, আত্মীয়-স্বজন কেউ এসে তুলেও নিয়ে যাচ্ছে না। কী করি? এই নির্বোধ আমি মানুষটা ভাবলাম, কাদা থেকে তুলে পুকুরের জলে সামান্য সাফ-সুতরো করি। তারপর কোনও গাছের তলায় বা হোস্টেলের ছাদে রেখে দেব। ওর মা না হোক, সমাজের কারও না কারও চোখ নিশ্চয়ই পড়বে।


        চিটচিটে কাদার মধ্যে এঁটে থাকা বাচ্চাটাকে বেশ কসরৎ করে তুললাম। কাঁধের ব্যাগ মাটিতে আছাড় খেলো। ছাতাখানা পড়ে ভূপতিত। ব্যাগটা ফের কাঁধে ফেলে বাচ্চা হাতে যখন হিউম্যানিটিস বিল্ডিং-এর কাছাকাছি পুকুর পাড়ের দিকে এগোচ্ছি, কানে ধুপ্‌ধাপ্‌ ঝুপ্‌ঝাপ্‌ আওয়াজ এল। সেই সাথে পাতার ঝর্‌ঝর্‌ খস্‌খস্‌। দশ-বারো সেকেন্ডে বুঝলাম শব্দটা আসছে মাথার ওপর থেকে। আরও বেশ কয়েক সেকেন্ড লাগল টের পেতে গাছের ডালে ডালে কিষ্কিন্ধ্যা-রাজ্যে শোরগোল পড়ে গেছে। মোটা বুদ্ধিতে আরও দেড় সেকেন্ড লাগল অনুমান করতে বাঁদর বাহিনী বাচ্চা চুরির অপরাধে আমার দিকেই ধেয়ে আসছে। তারপর আর সময়ের হিসাব মনে নেই। হাত থেকে কচি শিশুকে মাটিতে ফেলে দিয়েই দিকবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে কাদা হাতে, ব্যাগ কাঁধে দে চম্পট। আমার ছাতাখানা গাছতলায় ডিগবাজি খাচ্ছে। সেটা তুলতে আর সাহস হল না। ছুট-ছুট-ছুট।


সেদিন ইঁটের রাস্তাখানা খুঁজে পেয়েছিলাম। পথটা যদিও দীর্ঘ, কিন্তু শর্টকাটের মতো পেছল নয়। তারাবাগ যাওয়ার সাঁকোটার দুই মুখে সরু গেটের স্পীড ব্রেকার। ওদিক থেকে কয়েকজন আসছিল। তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। ওদের পেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অত সময় নেই। দমও নেই। দৌড়ে ক্যান্টিনে ঢুকে পড়লাম। কোনওদিন সঙ্গীসাথীর পরোয়া করিনি। সেদিন অন্য বিভাগের দুই ছাত্রী হিস্টেলে ফিরছে দেখে তাদের সঙ্গ নিলাম। ওরা আমার হোস্টেলের নয়। একজন সরোজিনী আর বাকি দুজন মীরাবাই ছাত্রীনিবাসের দিকে হাঁটা দিল। আমি ছুটলাম নিবেদিতার দিকে।


পরে সন্দেহ হত, সত্যিই কি আমাকে বাঁদরকূল তাড়া করেছিল, নাকি আমি খামোখা ভয় পেয়েছিলাম? কিন্তু তারপর থেকে গরমের ছুটি পড়া পর্যন্ত ঐ তল্লাটে বাঁদর হনুমান দেখলেই ছাতা দিয়ে, বলা বাহুল্য, নতুন কেনা ছাতা দিয়ে মুখ আড়াল করে চলতাম।


 

জীবন যেমন - আশীষ কুন্ডু || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

জীবন যেমন

আশীষ কুন্ডু



রূপক চাকরি নিয়ে চলে এসেছে আজমীর। 

নিরালা রাত- আকাশ কথা বলে মনের সাথে।

তৃষার কথা ভুলে যেতে চায় সে। পারছে না। জীবনের প্রথম ভালোবাসার এই পরিণতি হবে ভাবেনি সে। অনেক দিন পরে স্বস্তির বৃষ্টি হোলো

আজ বিকেলে। মনটা আরো উদাস করে দিয়ে গেছে।

টুয়েলভে পড়ার সময়টা ভুলে থাকা দায়- অবসর সময়ে মনটা খোঁচায়। তৃষা --একদিন এসেছিল পাড়ায়। পূজোর ঠিক পরে। অনীকদের দোতলায় সেদিন আলোর মেলা। রূপক গেছিলো বিজয়া করতে অনীকের বাড়ি। অনীক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো," আমার মামাতো বোন তৃষা।" তৃষার দীঘল চোখে লেগে থাকা হাসি, কেমন একটা

ঘোর লাগা অনুভূতি যেন।

এরপরে শীতের ছুটিতে পিকনিকে দেখা। 

এরপরে সুনামী ভালোবাসার। গঙ্গার পাড়ে শেষ বিকেলের আলোয় সারাজীবন একসাথে চলার অঙ্গীকার।চাকরি পেতে দেরী হয়নি সদ্য ইনজিনিয়ারিং স্নাতক রূপকের। এরমধ্যে চুল পড়ে যেতে লাগলো রূপকের। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হোলো না। মাথা ফাঁকা হয়ে ভুরুর লোমও পড়ে গেলো। অটো ইমিউন ডিজিজ।অনেক চিকিৎসা হোলো,হোমিওপ্যাথি থেকে আ্যলোপাথি হয়ে আয়ুর্বেদে।সারেনি রোগটা। তৃষা জানালো ওর পক্ষে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। 

রূপকের দীর্ঘশ্বাস পড়লো। দূরে অজ্ঞাত কোথাও হয়তো ওর প্রকৃত ভালোবাসা অপেক্ষায় রয়েছে।

দূরে একটা তারা খসে পড়ে।

চারু লেন রহস্য - প্রতীক মন্ডল || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 চারু লেন রহস্য

প্রতীক মন্ডল


(১)


"রাগ, ষড়রিপুর মধ্যে এমন এক রিপু যা খুবই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু, তার চেয়েও বড় রিপু হয়ে উঠতে পারত মানসিক বিকৃতি। বিকৃত মানব কখন যে কি দেখে, কি করে, কি বলে, কেউ জানে না যে। তাদেরকে বেঁধে রেখে দিলে সামাজিক চোখরাঙানি, ছেড়ে রাখলে মৃত্যুর হাতছানি। কিভাবে? একটু ভাবুন। ভাবলে দেখবেন যে, বিকৃত মনের মানুষের সঙ্গে আপনি নিজের অজান্তে যা যা দুর্ব্যবহার করেছেন সবই সে ফিরিয়ে দিতে চায়। সেটার জন্য একটা ছুরিই যথেষ্ট। সুতরাং, সময় থাকতে সাবধান হোন।"


    প্রতিবেদনটা মন দিয়ে পড়লেও লেখার ভঙ্গিমাটা তার একদমই পছন্দ হয়নি। হতেও পারে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন অপমানজনক সুরে প্রতিবেদনটা লেখা! খবরের কাগজটা মুড়ে স্টেশন থেকে নামলেন প্রদ্যুৎ বাবু। শেষের অংশটুকুতে যা বলেছে তা খারাপ লাগলেও, কিছু জিনিস ঠিক। কারণ তার রাতে ঘুম ক'দিন ধরে হচ্ছেই না। মাথা ধরছে, মাথায় ভুলভাল চিন্তা আসছে, দুঃস্বপ্ন দেখছেন, আরো কত কি! কেন হচ্ছে, তা তিনি বুঝতেও পারছেন না। এবং সত্যি বলতে বাকিদের বুঝতে দিচ্ছেন না। আসলে তাঁর জীবনে একটা গোপন দুঃখ আছে, যেটাকে ব্যর্থতা বললেও ভুল হবে না। তাঁর কোন সন্তান নেই। সত্যি বলতে সেটার দায় তাঁরই। কিন্তু ব্যর্থতা সেটা নয়। তাঁর অক্ষমতা লুকিয়ে রেখেছেন সযত্নে। তাই অভিযোগের আঙুল শুক্লার দিকেই। সে জিনিসের প্রতিবাদ না করার ব্যর্থতা একটা ঘটনার পর থেকে তাকে যেন ভিতর থেকে ফালাফালা করে দেয়। সেই চিন্তাগুলোই সম্প্রতি তাঁকে পাগল করে দিচ্ছে। প্রেসে কাজ করছেন বছর দশেক হলো। নিখুঁতভাবে কাজ করা প্রদ্যুৎ বাবুর কাজেও ভুল হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।




-"চা লাগবে বাবু?"


-"এত সকালে চা! পাঁঠা নাকি!"


-"অন্য দিন তো খান আজ কি হলো?"




    বলে গজগজ করতে করতে চলে গেল মাধব বেয়ারা। সত্যিই তো রোজ খান! আজ এত রেগে গেলেন কেন? অকারনে চিৎকার করলে শরীর খারাপ হতে পারে। নাহ ঠিক হচ্ছে না কাজটা। শান্ত থাকতে হবে তাঁকে।


    তখন বাজে বিকেল চারটে। এবার কাজ গুছানো শুরু করলেন। আজ ইচ্ছে আছে একটু ভালো মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন। হলদিরাম থেকে ভুজিয়াও নেবেন। ভালো খেলে যদি মনটা একটু শান্ত হয়। এখন প্রেস প্রায় ফাঁকা। রাতের শিফটের লোক ঢোকার একটু দেরি আছে। বাথরুমে গেলেন। বের হয়ে আসার সময় নজরে পড়ল একটা হাতের ছাপ! বেশ অদ্ভুত! ভালো করে দেখলেন। তারপর নিজের হাতটা সেই হাতের ছাপের উপর বসিয়েই একটু চমকে গেলেন। এ যে অবিকল তার হাতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে! টেবিল থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আনার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন নেই! "নেই" কিভাবে সম্ভব এখানেই তো ছিল তাহলে!

" প্রদ্যুৎদা? কি করছো! এমা হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস কেন?" একটু হকচকিয়ে গিয়ে প্রদ্যুৎবাবু বললেন,"নানা ভুল করে নিয়ে চলে এসেছিলাম।"


এরপর দ্রুতপায়ে টেবিলে গিয়ে নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। শীত পড়ছে। একটু তাড়াতাড়ি আঁধার নামছে। তখন প্রদ্যুৎ বাবুর মনে হচ্ছিল এই সামনের জনসমুদ্র তার জন্য নয়। একটু অন্ধকারে মিশে গেলে তিনি হারিয়ে যাবেন। কেউ যখন নাগাল পাবে না, তখন এই আঁধার তার বন্ধু হবে। এসব ভাবতে ভাবতে একটা শর্টকাট ধরলেন।


    আধো অন্ধকার। দুদিকের বাড়িগুলো যেন অতন্দ্র প্রহরী। সেই প্রহরীদের মাঝেও কি নিরাপদে থাকা যায়! এটার নাম চারুচন্দ্র লেন। বেশ কিছু বছর আগে এখানে নাকি দুজন পথচারীকে নিশংসভাবে খুন করেছিল কেউ। সে রহস্যের সমাধান হয়েছে কিনা জানা নেই। বাড়িগুলো থেকে টিমটিমে আলোগুলো রাস্তায় আসতে গিয়েও পারছে না যেন। বাড়ির ভিতরগুলো নিস্তব্ধ। দ্রুতপায়ে হেঁটে স্টেশনের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুদূর যেতেই থমকে দাঁড়ালেন। সামনে গলিটা যেখানে বাঁক নিচ্ছে সেই বাঁকের ডানদিক থেকেই যেন আওয়াজটা আসছে।


    প্রদ্যুৎ বাবু লুকিয়ে পড়লেন। শরীরের রক্ত চলাচল যেন আরো বেড়ে গেছে। যে বাড়ির পাঁচিলে লুকিয়ে ছিলেন, সেখান থেকেই উঁকি মেরে দেখলেন। দেখে তাঁর হাড়হিম হয়ে গেল। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা একটি লোক। মুখে একটা অদ্ভুত মুখোশ। সেটা কি রংয়ের বোঝা যাচ্ছে না। তার হাতে বিশাল বড় ভোজালি। সেটা দিয়ে সমানে কুপিয়ে যাচ্ছে সামনের মৃতদেহটাকে। না! সেতো এখনো মরেনি! সে দুই হাত দিয়ে ঘষে ঘষে পালানোর চেষ্টা করছে! অবশেষে সেই অজানা মানুষটার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আর দেখতে পারলেন না প্রদ্যুৎবাবু। তাঁর হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু পালাতে না পারলে যে বিপদ! কোনরকমে যথাসম্ভব নিঃশব্দে পালাতে লাগলেন। পালানোর সময় বারকয়েক পিছনে দেখলেন। না কেউ আসছে না। অবশেষে এসে থামলেন অফিসের সামনে। সামনে সেই পরিচিত জনসমুদ্র। খুনিটা তাঁকে দেখেছে কিনা জানা নেই। তিনি ধীর পায়ে মিশে গেলেন এই জনসমুদ্রের কোলাহলে তাঁকে আর খুঁজে পাবে না সে।


    পরদিন অফিস যাওয়ার অবস্থায় ছিলেন না। গোটা দিন ভেবে গেলেন সেই রাতের ঘটনাটা। সেদিন যা দেখলেন, তা কিভাবে সম্ভব? ওই রাস্তায় আরো অনেকে হাঁটাচলা করে, বাড়িতেও কত লোক থাকে; তাই বলে এত ঝুঁকি নিয়ে কেউ খুন করবে? ওই রাস্তায়! নানা!


মনে মনে আরও ভাবলেন,"আগে কোনদিন যাইনি ওই রাস্তায়। এত বড় বাড়ি সন্ধের সময় ওই রাস্তা ফাঁকা কেন থাকবে? নিদেনপক্ষে একটা সাইকেল বা কোন কুকুরও ছিল না। তবে! তবে কি ভুল দেখলাম? না না এ হতে পারে না। নাকি সত্যি! .... কদিন আগে এরকম একটা স্বপ্নও দেখেছিলাম। তবে সবই কি মনের ভুল?"




    সেদিন ভয় টিভি আর খবরের কাগজ খুলে দেখলেন না। রাত বাড়তেই স্ত্রীকে বললেন,


-"শোনো না, ঘুমের ওষুধ আছে?"


    সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে, "না!"


তবে আর কি? নটার দিকে বেরিয়ে পড়লেন। এক ডোজ খেলে কিচ্ছু হবেনা, তাই এক শিশি কিনলেন। বের হয়ে আসার সময় শুনতে পেলেন ওষুধের দোকানের লোকটা বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে," আজ নাইট ডিউটি! ওদিকে সাবধানে যেও। খুন-জখমের খবর আসছে ভয় লাগে বাপু।"


দোকানির বউ আশ্বাস দিয়ে বলল,"তুমি একদম চিন্তা কোরোনা, আমি সাবধানেই যাব। তুমি বাড়ির খেয়াল রেখো।"


প্রদ্যুৎ অস্ফুটে বলে উঠলেন, "কোথায়?"

সেটা শুনে ওই দোকানদার বলল, " ওই তো শিয়ালদা স্টেশনের কাছে কি একটা জায়গা আছে না! ওখানে!"


    মাথাটা ভয়ংকর ধরেছে। দোকানদারের কথাটা শুনেই যেন বেড়ে গেছে। জোর পায় হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছেন। কখনো হোঁচট খাচ্ছেন, কখনো হালকা দৌড়চ্ছেন। তবু যেন থামতে নেই। এই রাস্তার আঁধার যেন কৃষ্ণ গহবরের মতন গভীর ও দীর্ঘ হয়েই চলেছে! হঠাৎ যেন ধাক্কা খেলেন ঝুলন্ত কিছুতে! উপরে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন। গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে রয়েছে একটা মৃতদেহ! 


    তারপর এটুকু মনে আছে, ঘরে এসে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন বা বলা যায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।


    এদিকে লালবাজার সরগরম হওয়ার তখনও তিন চার দিন বাকি। তবে ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট এর অন্দরে একটা চাপা গুঞ্জন চলছিল। কারণ, চারুচন্দ্র লেনের নৃশংস কোনটা মোটেও স্বাভাবিক না। দুই বছর আগে একইভাবে দুটো খুন হয়েছিল পাশে লেখা ছিল,


    "For Experimental Purpose Only"


    তাই জন্য ওই গলির মুখে সিসিটিভি লাগানো হলো। অথচ একইভাবে খুনটা করল সিসিটিভির পিছনেই। এবারে কেসের দায়িত্ব পড়েছে সত্যজিৎ সান্যালের উপর। খুনের ধরন সবই জানা। তবে একটা কথা বুঝতে পারছেন না; এবারে এই লেখাটির পাশে, "Now I have witness" কথাটা বড় করে লেখা। আর সেটাই ভাবাচ্ছে সত্যকে। যদিও অনেকে আমল দিচ্ছেনা। সামনে ইলেকশনের চাপে সকলেই জেরবার। তাই এটাকে পলিটিকাল মার্ডার বলে চাপা দিতে পরামর্শ দিচ্ছে সবাই। না! সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ তা বারবার দেখছেন," No clue! কিন্তু .... এটা কে?"

    দশ মিনিট পরেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন ডিপার্টমেন্ট থেকে।

 


                      (২)


    আজ অফিসে এসেছেন প্রদ্যুৎবাবু। মনটা একটু হালকা লাগছে। সঙ্গে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে গালিও দিচ্ছেন। সেদিন রাতে ভয়ে, টেনসনে, একটা ঝুলন্ত নারকেল পাতা কে ডেডবডি ভেবেছেন! সকালে উঠে যখন দেখলেন চারপাশ নিস্তব্ধ, ফাঁকা রাস্তার দিকে ইলেকট্রিক তারে ঝুলতে থাকা পাতায় ধাক্কা খেয়েছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল নিজেকে একটা বড় থাপ্পড় মারেন। এবার একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে। এমন সময় এগিয়ে এলো পর্ণা। নতুন ঢুকেছে, প্রদ্যুৎ জেঠুকে বিশাল শ্রদ্ধা করে। এসে বলল,


পর্ণা: ঠিক আছ জেঠু?


প্রদ্যুৎ যেন আঁতকে উঠে বলল," হ্যাঁ, মানে ওই আর কি...."


-"শরীর ঠিক আছে তো? কদিন ধরে দেখছি তুমি কিরকম যেন হয়ে আছো!"


-"না রে মা, রাতে বেশ কিছুদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। দুঃস্বপ্ন দেখছি।"


-"বল কি? তারমানে খুব দুশ্চিন্তা করছো নিশ্চয়ই? তোমাদের সবার এই এক সমস্যা, কোন কারণ নেই, তবু চিন্তা করে যাচ্ছ।"


-" নাহ!সেটা নয়। ক'দিন ধরে ডেড বডি দেখছি, মার্ডার দেখছি; এখন স্বপ্ন দেখতেও ভয় লাগে। কি যে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিনা।"


-"শোনো শোনো, অত চিন্তা কোরোনা। .... কোথায় গেল? এইযে এই নম্বর আর ঠিকানাটা লিখে নাও, এর কাছে গিয়ে একটু চেক আপ করিয়ে এস।"


-"কোথায় এটা?"


-" চারুচন্দ্র লেনটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই ফার্স্ট বাড়িটা। আর হ্যাঁ, সম্ভব হলে ঘুরে মেইন রোড দিয়ে যেও। ওই রাস্তায় পরশু একটা মার্ডার হয়েছে রাত ১১ টার দিকে।"


কথাটা শুনে আঁতকে উঠলেন। তার মানে, সত্যি! সব সত্যি! মিথ্যে নয়!

    আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলেন। দাঁড়িয়ে চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। অবশেষে হাঁটা দিলেন চারুচন্দ্র লেনের ভিতর দিয়েই। অনেক প্রশ্নের উত্তর তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ওই পথে গেলে সত্যি মিথ্যের মুখোশগুলো ধ্বসে কিনা দেখা যাক।


                         (৩)



    সত্যজিতের ফোন বেজে উঠলো। কিন্তু সেসব ধরার সময় নেই। ফোনের পাশের বোতাম টিপে সেটাকে শান্ত করলেন। কারণ সে নিজে বেশ উত্তেজিত। Clue পেয়েছেন। বা বলা ভালো সাক্ষীকে পেয়েছেন। রাস্তায় পুলিশের লাগানো সিসিটিভিতে একটা বাড়ির পাশেই একটা লুকোনো লোকের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। তারপর ছুটে চলে আসেন এখানে। এখন যে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সেই বাড়ির আরেক সিসিটিভি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ পাওয়া গেছে। বাড়ির মালিক সুব্রত রাহার কথা জানতে পেরেছেন।



সুব্রত: কি বলবো স্যার, আমি তো এখানে থাকিইনা। বাবার আমলের বাড়ি। ভুবনেশ্বর থেকে এখানে আসি উইকেন্ডে। একচুয়ালি দেখুন না, সামনের চারটে বাড়িতে সেই আগুন লাগল না!


সত্যজিৎ: কবে?


সুব্রত: চার-পাঁচ বছর আগে। তারপর ওই বাড়িগুলোতে কেউ থাকেনা।


    সত্যজিৎ এক পলকে দেখে নিল বাড়িগুলো। দূর থেকে এখনো কালো দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।


সুব্রত: ওই জন্য দেখলাম পাড়াটা এত নিস্তব্ধ, আর আমি থাকিও না এখানে তাই একটা সিসিটিভি লাগালাম।


সত্যজিৎ: Seriously?! আমি ফুটেজ গুলো দেখতে চাই


সুব্রত: হ্যাঁ চলুন।


সত্যজিৎ: আর হ্যাঁ, আমার যদি কোন সিসিটিভি ফুটেজ লাগে, সেটা নেওয়ার ব্যবস্থা আছে তো?


সুব্রত: হ্যাঁ আছে। আপনার যা যা লাগবে বলে দিন, আমি দশ মিনিটের মধ্যে দিয়ে দিতে পারব।


    সত্যজিৎ বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে ফুটেজগুলো দেখলেন। ওই লোকটাকে সম্পূর্ণভাবে দেখা গেল।


সত্যজিৎ: মার্ডার টাইম যদি রাত এগারটা হয়, তাহলে এই লোকটা লুকোচ্ছে কেন? তাও আবার সন্ধে সাতটায়? কে এই লোকটা? ওই অন্ধকার গলিতে কেন এসেছিল! সেটার চেয়েও বড় প্রশ্ন ফরেনসিক এ মৃত্যুর সময় রাত এগারোটা কেন?


    এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। লোকটা যে পাঁচিলের কাছে ছিল, সেখানে যাবেন, এমন সময় দেখলেন একটি লোক ধীর পায়ে উল্টোদিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।




সত্যজিৎ: এই কে আপনি? এদিকে আসুন, কোথায় যাচ্ছিলেন এদিকে?


প্রদ্যুৎ: আমার নাম প্রদ্যুৎ। ভুল করে এই গলিতে ঢুকে পড়েছি, যাবো গুড লাইফ ক্লিনিক এ। শর্টকাট ধরতে গিয়ে গুলিয়ে গেছে। আ - আ আমি এই প্রেস টায় কাজ করি।


সত্যজিৎ: এই রাস্তায় আগে আসেন নি?


প্রদ্যুৎ: না


সত্যজিৎ: Ok, যান।


    প্রদ্যুৎ বাবু ফিরে চললেন। এই রাস্তায় আর ঢুকবেন না। তিনি যে পুলিশের খাতায় একটা বড়সড় উইটনেস, সেটা ভালই বুঝেছেন। কিন্তু, পুলিশের কাছে না যাওয়ার দুটি কারণ। প্রথমত, পুলিশকে বিশ্বাস করেন না তিনি। দ্বিতীয়তঃ, তিনি উইটনেস হিসেবে উপযুক্ত নন, কারণ কোনটা হ্যালুসিনেশন, আর কোনটা সত্যি, তিনি নিজেই জানেন না। এই অবস্থায় পুলিশ তাঁকে যদি খুনি ভেবে নেয়, তাহলে শেষ।


    হাঁটতে হাঁটতে পৌছলেন গুড লাইফ ক্লিনিকে। ফোন করে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিতে হয়েছিল। ভিতরে ঢুকে দেখলেন বাইরে কেউ নেই। এমনকি কোন রিসেপশনিস্ট পর্যন্ত নেই! আশেপাশে বেশ নিস্তব্ধ। দরজায় নক করে বললেন,




প্রদ্যুৎ: আসতে পারি?


ডাক্তার: হ্যাঁ আসুন! .... বলুন কি সমস্যা?


প্রদ্যুৎ: সমস্যা বলতে অনেক কিছু....




সব শুনে ডাক্তার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল। বলল,


"আপনি কি রিসেন্টলি কোন ট্রমাটিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন বা কোন মার্ডারের উইটনেস হয়েছেন?"


শুনে চমকে উঠলেন প্রদ্যুৎ বাবু।


প্রদ্যুৎ: না, মানে কেন বলুন তো?


ডাক্তার: ও, তাহলে আপনি সেই উইটনেস নন। ও হ্যাঁ, আমি কিন্তু লালবাজারেও কাজ করি!


প্রদ্যুৎ: উইটনেস! কিসের?


ডাক্তার: ওই যে পরশু মার্ডার টা হলো না রাত ১১ টায়, ওটার নাকি একজন উইটনেস আছে পুলিশ তাকে খুঁজছে।


ডাক্তার কথাগুলো বলে চলল। প্রদ্যুৎ বাবু ঘেমে উঠলেন। বললেন,


প্রদ্যুৎ: আমি ওই রাস্তায় সন্ধে সাতটায় দাঁড়িয়ে একটা হ্যালুসিনেশন এর মত দেখেছি। মানে একটা মার্ডার এর হ্যালুসিনেশন .... যেমনটা বললাম আর কি। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো ডাক্তার বাবু? কিন্তু .... কিন্তু রাত এগারোটায় ওই রাস্তায় আমি ছিলাম না!


ডাক্তার: আঃ শান্ত হন তো মশাই। এই নিন এই জলটা খান, অ্যাংজাইটি কমে যাবে। আপনি এখানে এসেছেন, আর কেউ জানে?


প্রদ্যুৎ: না। যে নাম্বার দিয়েছে সেও জানে না যে আজ আসব। কেন?


ডাক্তার: আপনি মশাই প্রচুর প্রশ্ন করেন। মনে শান্তি নেই না আপনার? সবকিছুতেই এত কৌতুহল ভালো না।


    কথাটা শুনে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারকে দেখতে যাবেন, কিন্তু সব অন্ধকার।



                     (৪)


    তিনদিন পর ময়দানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন সত্যজিৎ ও তাঁর ছোট্ট টিম। সামনে একটা লাশ পড়ে। মুখটা দেখার জো নেই। নৃশংসভাবে ছাড়িয়ে নিয়েছে মুখের চামড়া। কিন্তু সত্যজিতের নজর পাশের লেখাটার দিকে। লেখা আছে, "Witness" কমা দিয়ে "Amen". কিন্তু এই চেহারা সত্যজিৎ ভালো মতনই চেনেন! কারণ, তার সন্দেহ ঠিক। পরদিন প্রেসে গিয়ে খোঁজ নিতে গেলেন। কিন্তু খোঁজ না পেয়ে, বাড়িতে কন্টাক্ট করলেন। জানা গেল বাড়ি ফেরেননি। তারপর আজ সকালে এই দৃশ্য।


সত্যজিৎ: ফরেনসিক রিপোর্ট আসতে কদিন লাগবে?


ফটোগ্রাফার গার্ল: হয়ত তিন থেকে চার দিন.


সত্যজিৎ: নানা, আমার কালই চাই


    বলেই গাড়িতে উঠে একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন প্রেসের দিকে। কিছুক্ষণ পর প্রেসের ম্যানেজার ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললেন,


-"প্রদ্যুৎ এর সঙ্গে লাস্ট কার কার কথা হয়েছিল? তারা একটু আমার ঘরে এসো।"


    এর কিছুক্ষণ পর এসে মাধব বেয়ারা বলল, "পর্নাদির সঙ্গে কথা হয়েছিল প্রদ্যুৎদার। তারপর সেদিনই তো দিদি ছুটি নিতে এল স্যারের কাছে!"


ম্যানেজার বলে উঠলো,"হ্যাঁ ওকে তিন-চারদিনের ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্তু কাল থেকে ওকে ও ফোনে পাচ্ছি না। এখন আপনার কাছে যা শুনছি, ভয় লাগছে।"


সত্যজিৎ বলল,' ওর একটা ছবি দিন।"এবার কনস্টেবলকে উদ্দেশ্য করে বললেন," ফোন করে খোঁজ নাও যে এর নামে কোন মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে কিনা!"


- ওকে স্যার।




    কনস্টেবল বেরিয়ে গেল। সত্যজিৎ ধীর পায়ে বের হয়ে এলেন। কেসটা জটিল হয়ে উঠছে। মেয়েটাও গায়েব! কিন্তু, লোকটা শেষবার কোথায় গিয়েছিল? এসব ভাবতে ভাবতে সত্যজিৎ চারুচন্দ্র লেন ধরে হাঁটা শুরু করলেন। অনেকক্ষণ হাঁটার পর সামনে চোখে পড়ল ক্লিনিকটা। উপরে সযত্নে লেখা 'গুড লাইফ ক্লিনিক'। এই তো! এখানেই আসছিল প্রদ্যুৎ! মনে পড়েছে।

প্রথমে না নক করে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। পাশে রাখা মেয়েদের জুতোটা তিনি খেয়াল করলেন না। তখনই একটা ফোন এলো। সেটা রিসিভ করলেন,


" হ্যাঁ স্যার, আমি তো এখন চারু লেনে, ওই ময়দানের মার্ডারটার জন্য।"


-"ওই কেসটা একটা জুনিয়ারকে দিচ্ছি। কাল থেকে তুমি শংকরপুরে কাজ করবে। ওখানে কয়েকটা পলিটিকাল মার্ডার হয়েছে, তার স্পেশাল টিমে তুমি আছো। আজ এসে জুনিয়ারকে ব্রিফ করে দাও। "



সন্ধ্যেতে ব্রিফিং দিয়ে বের হয়ে এলেন সত্যজিৎ। বন্দুকটা সঙ্গেই আছে। একটা ক্যাব ধরে গলিটার মুখে নামলেন। একটা হ্যালোজেন জ্বলছে। সেই আলো ওই বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছচ্ছে না। সত্যজিতের দৃঢ় বিশ্বাস, ওই বাড়িতে কিছু একটা আছে। খুব গভীর রহস্য। হয়তো ওই বাড়িতেই লুকিয়ে আছে সব ধাঁধার সমাধান! এমনকি মৃত্যুর সময় নিয়ে যে ধন্ধ তৈরি হয়েছে সেটাও কি এখানেই সমাধান হবে! জানা নেই যে!


    গোটা বাড়িটা অন্ধকার। কেউ নেই। একটা জলের পাইপ ছিল, সেটা বেয়ে উঠে ঘরে গেলেন। অনেকক্ষণ খোঁজার পর, নিচের ঘরে স্টাডি টেবিল এর পাশে দাঁড়ালেন। সেটা যেন ছোটখাট একটা ল্যাব! কিন্তু একটা ছোট্ট ফাইলে চোখ আটকে গেল। তাতে বড় করে লেখা এক্সপেরিমেন্ট! না! ভুল জায়গায় আসেননি তিনি! পৃষ্ঠা উল্টাতেই কিছু ফটোগ্রাফ আর টাইপ করা লেখা!

"Unsuccessful! .... Semi Success! .... Success!"


    Success এর পাশে লাস্ট মার্ডার হওয়া লোকটার ছবি।




ডাক্তার: গ্রিটিংস! .... না না! পিস্তলটা সাইডে রাখুন প্লিজ! ওটা ধরা যাবেনা না। হলে চিরদিনের মত ঘুম পাড়িয়ে দেবো। ভেরি গুড। তো, আপনি আমার খোঁজ পেলেন কিভাবে? আই মিন আমি তো কোন loose end রাখিনা!


সত্যজিৎ: ওটা তোমার ভাগ্য ডক্টর। তুমি এতটাও পাকা খেলোয়াড় নও।


ডাক্তার: আমি প্লেয়ার নই, সাইন্টিস্ট। বলতে পারো আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাইন্টিস্ট আন অফিশিয়ালি। অফিশিয়ালি তোমাদের ফরেনসিক ডক্টর। সিবিআই তো? না? ওকে ওকে, তারমানে চুনোপুঁটি। এক্ষুনি তো মরেই যাবে, তার চেয়ে কারনটা শুনেই মরো! তোমরা সারাক্ষণ যা অশান্তিতে থাকো, শান্তিতে মরার সৌভাগ্য তোমার হোক! একচুয়ালি, আমি এমন একটা সিরাম ইনভেন্ট করেছি, যেটা নরমাল টেম্পারেচার এ ডেড বডিকে সেম রাখবে। তাতে মার্ডারের টাইম কেউ জানতে পারবে না। এটার তো হিউম্যান ট্রায়াল' এর দরকার ছিল, তাই এই মেন্টাল হেলথ ক্লিনিক খুলে বসতে হলো। বছরে দুটো পেশেন্ট তো দরকার, তাই একেই কাজে লাগাতে হলো।




    পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটা মেয়ে। সত্যজিৎ তাকে দেখে অস্ফুটে বলে উঠলেন, "পর্ণা!"


    কথাটা বলে মেয়েটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাতেই সত্যজিৎ এক লাফে নিজের বন্দুক তুলে নিয়ে ডাক্তারের দিকে নিশানা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের বন্দুকও গর্জে উঠলো। গর্জে উঠলো সত্যজিতেরও বন্দুক। বীভৎস এক আওয়াজ।


    পর্ণা দেখল দুটো লাশ মরার আগের অবস্থায় ছটফট করছে। কিন্তু ওর যে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। ফর্মুলাটা পাঠাতে হবে মেইল করে। সেটার জন্য অপেক্ষা করছে কত অজানা ক্লায়েন্ট। মরলে চলবে না, ধরা পড়াও চলবে না। তাকে তার ডাক্তারের জন্য বাঁচতে হবে। পুলিশ সব দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। পর্ণা ফাইলগুলো নিয়ে মিলিয়ে গেল একটা অজানা সুড়ঙ্গের অন্ধকারে।


            (৫)


দরজা ভেঙ্গে পুলিশ ঢুকলো। সব জায়গায় আগুন লেগেছে। সব কনস্টেবলের সঙ্গে ঢুকলো চন্দ্রানী। সব দেখে দ্রুত নির্দেশ দিলো দমকল ডাকার। বাকিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু হঠাৎ দূর থেকে শুনতে পেল একটা গোঙানির আওয়াজ। ঘরের একদম কোনায় দেখতে পেল সত্যজিৎকে।


চন্দ্রানী হুঙ্কার দিয়ে বলল," Hurry up! Sir কে বাঁচাতে হবে।"




আগুন বেশি লাগেনি তাই অল্পক্ষণের চেষ্টায় সত্যজিৎকে বের করে আনা হলো। কিন্তু তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, "পর্ণা .... পর্ণা, ও- ওকে ধরো..." বলেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। চন্দ্রানী নির্দেশ দিল, "চারপাশটা সার্চ করো।সন্দেহজনক যাকে দেখবে তাকে অ্যারেস্ট করবে। আর কেউ একজন অ্যাম্বুলেন্সকে ডাকো" তারপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সত্যজিৎকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। চন্দ্রানীর নেতৃত্বে একটা ইনভেস্টিগেশন টিম গোটা বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে এখন। কারোর মনে কোন সন্দেহ নেই যে এটাই সেই চার লেনের খুনির ডেরা। কিন্তু সবকিছু ধোঁয়াশার মতন ঘুরছে চারপাশে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পাওয়া ব্রিফিংয়ের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। তবে কি সত্যজিৎ স্যার তথ্য লুকিয়ে ছিলেন! সৌভাগ্যবশত, এই লেনের থেকে কিছু দূরেই পুলিশ ভ্যান টহল দিচ্ছিল। তারা গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে আসে, আর খবর দেয় থানায়। চন্দ্রানী তখন ওই থানায় বসে ছিল তদন্তের ডিটেলস নিতে। চারু লেনের নাম শুনেই সে-ই নির্দেশ দেয় ফোর্স নিয়ে যাওয়ার। কারণ সত্যজিৎ স্যার কথা শেষ করেছিল এটা বলে যে, "আমি সন্ধ্যেতে ওই ক্লিনিক টায় যাব কয়েকটা ডাউটস আছে।" তারপর গলাটা একটু আস্তে করে বলেছিলেন, "তুমি বসকে বোলো না এসব নিয়ে। কিছু ইন্টারেস্টিং জানতে পারলে তোমায় জানিয়ে দেবো।"


    তারপর এই অবস্থায এখন। খবরের চ্যানেলগুলোতে বড় করে খবরের রিপোর্টিং করা হচ্ছে। সকলের একটাই বক্তব্য, "সব জেনেও সিরিয়াল কিলিং এর খবর চেপে রাখলো পুলিশ। শহরবাসীর কি কোনো নিরাপত্তা নেই! সে উত্তর দেবে প্রশাসন।"


    খবরের চ্যানেলটা বন্ধ করে দিয়ে চন্দ্রানী আপন মনেই ভাবতে ভাবতে বলল, "কেউ নেই পিছুটান নেই তাই কি এতটা ঝুঁকি নিতে গেলেন স্যার? নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য!" এরপর অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার কি মনে হয় ডক্টর আর কে ঘোষ এর সঙ্গে স্যারের কোন কানেকশন ছিল?" অনুপম একটু অবাক হয়ে বলে, "সেটা কে?" তারপর একটু ভেবে বলল, "ও আচ্ছা গুড লাইফ ক্লিনিক। লোকটা তো শুনেছি ফার্স্টে লালবাজার আর পরে সিবিআইতে কাজ করতো। কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়ে একেবারে বেপাত্তা! তারপর একেবারে এই সব মার্ডারের মাস্টারমাইন্ড।" 

-"না এখনো শিওর না" বলে উঠল চন্দ্রানি।

- "সব ডকুমেন্টসগুলো একবার খুঁটিয়ে দেখতে হবে। মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি স্যারের জ্ঞান ফিরলে জেরা করতে হবে।" 

-"তুমি কি ওনাকে সন্দেহ করছো? উনি প্রায় ন' বছর হল এই ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যুক্ত!" অনুপমের কথা শুনে চন্দ্রানী বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে, "তাতে কোন পাপ ধুয়ে যায় না অনুপম। উনি দোষী কিনা জানিনা, তবে এটা জানি যে একটা লার্জ টার টার্গেট এর পিছনে উনি একা গিয়েছিলেন। তার জন্য একটা ক্রিমিনাল মারা গেল। আর তারপর তো .... এই হ্যাঁ, পর্না কে?" "আমিতো জানি না। তুমি বলার পর অনেকেই খুঁজলো ডেটাবেসে। কিন্তু আমাদের ক্রিমিনাল রেকর্ডে এরকম কেউই নেই।" "কিন্তু স্যার সব জানে আমার বিশ্বাস স্যার মিথ্যে বলছে।" তারপর চন্দ্রানী আপন মনেই বলে উঠলো, "সত্যজিৎ তুমি মিথ্যাকে জয় করছ কেন তুমিই কি সত্যান্বেষীর বেশে ভন্ড কেউ?" অনুপম অবাক হয়ে বসে রইল। এখন তার মাথাও কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে মনে হয়।


    তিন দিন পর জ্ঞান ফিরলো সত্যজিতের। কিন্তু খবর একদম ভালো না, অন্তত অনুপমের তাই মনে হল। কারণ সত্যজিতের গলায় এমন এক জায়গায় গুলি লেগেছে, যেখান থেকে সার্জারি করে গুলি বের করতে গেলে কথা হারানোর চান্স ছিল ৯৯%। দুর্ভাগ্যবশত সেটাই হয়েছে।


     "এছাড়া ওনাকে বাঁচানো যেত না" বলে উঠলো ডাক্তার। চন্দ্রানী চেঁচিয়ে বলে, " হোয়াট রাবিশ!!! আপনারা কোনরকম ইনফর্ম না করেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?" এবার ডাক্তার শান্ত স্বরে বলল, "ম্যাডাম প্লিজ একটু আস্তে কথা বলুন। হসপিটালে এত জোরে কথা বলা যায় না। আর এটা নিয়ে আমরা আপনাদেরকে জানিয়েছিলাম। হয়ত আপনি কোনভাবে মিস করে গেছেন।" বলে ডাক্তার চলে যেতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চন্দ্রানী।


(৬)


     এদিকে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। তাই কোন রহস্যের জট ছাড়াতে না পারার ব্যর্থতা বেশ চেপে ধরছে চন্দ্রানীকে। হয়তো তাকে নিয়ে সকলে ব্যঙ্গই করছে। এই মুহূর্তে নিজেকে অপয়া ও অপদার্থ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। তবে ধৈর্যের অবসান ঘটলো এক সপ্তাহ পরে।


     আজ জেনারেল বেডে শুয়ে থাকা সত্যজিৎ স্যারকে দেখে ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অনুপম চন্দ্রানীদের মনের চামড়া বেশ শক্ত রাখতে হয়। পাশাপাশি আজকের কাজটাও বেশ কঠিন। চন্দ্রানী সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আজ জেরা করবে সত্যজিৎকে। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ অথবা না তে দেওয়া যাবে। এছাড়া লিখে বলার মতন কিছু হলে রাইটিং প্যাড এর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ডাক্তারও দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল। চন্দ্রানী সবে প্রশ্ন করতে যাবে, সত্যজিত হাতের ইশারায় ট্যাবটা চেয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পরে ফেরত দিলেন তাতে যা লেখা আছে তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, "আমি দোষী নয়। আমি একটু বেশি কৌতুহলী হয়ে পড়েছিলাম। তাই মরে না গেলেও শান্ত হয়ে গেছি।" চন্দ্রানী সত্যজিৎ এর দিকে তাকাতেই তাঁর বিমর্ষ চোখটা দেখতে পেল। কিন্তু চন্দ্রানির মনে কি চলছে সেটা অনুপম বুঝলো না। 


চন্দ্রানী : আপনি ডক্টর আর.কে ঘোষ কে চিনতেন?


    সত্যজিৎ ইশারায় ঘাড় নাড়ায়।


চন্দ্রানী : না? আচ্ছা। ওই ক্লিনিকের ডক্টর, যে আপনার গুলিতে মারা গেছে….. প্রদ্যুৎ বাবুর মার্ডার কেসের দায়িত্বে আপনি ছিলেন। রাইট?



সত্যজিৎ এবার ইতিবাচকভাবে ঘাড় নাড়ায়।


চন্দ্রানী : আমায় ব্রিফিং দেওয়ার সময় সব ইনফরমেশন আমায় দিয়েছিলেন?

-না!


তাহলে ডাক্তারের বাড়ি কেন গিয়েছিলেন? ওনাকে ট্যাবটা দাও।

    চন্দ্রানির এক একটা প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবেই দিলেন। এবার শেষ প্রশ্ন।

চন্দ্রানী : এরকম টাইপের সিরাম! কিন্তু পর্না কে?....

    শুনে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন সত্যজিৎ সান্যাল। তারপর ট্যাবে যা লিখলেন সেটাও অনুপম পড়ে শোনালো।


    "ওই মেয়েটিই ওই রাতে ডাক্তারের সঙ্গে ছিল। তারপর ঘরে আগুন লাগার পর তিন-চারটে ফাইল নিয়ে পালায়। বেঁচে যাবো ভাবিনি। তারপর তোমরা এলে, তখন হিন্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তোমরা বোঝনি, ওকে খুঁজে বের করো না হলে কি হয়ে যাবে ঈশ্বর জানেন...."


    লেখাটা পড়ে অনুপম চন্দ্রানির দিকে লক্ষ্য করল। তার মুখের কঠিন ভাবটা কেটে গেছে। চন্দ্রানির কর্মদক্ষতা নিয়ে তার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কেসটার শুরু থেকেই তার মধ্যে যে এগ্রেশনটা ছিল, তা আজ যেন স্তিমিত হয়েছে।


    "থ্যাঙ্ক ইউ" বলে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল চন্দ্রানী।


    সেই দিন সন্ধ্যেতেই একটা পুলিশের জিপ এগিয়ে চলল সেই চারুলেনের দিকে। চারজন কনস্টেবল গাড়ি থেকে নামতেই চন্দ্রানী নির্দেশ দিল, "উপর থেকে নীচ, প্রত্যেকটা ঘর, ছাদ, উঠোন, বাগান, বাড়ির পিছন, সবকিছু তল্লাশি করবে। তোমরা উপরটা দেখো, আমি আর অনুপম আপাতত নীচটা দেখছি।" কথা শেষ হতেই সবাই কাজে লেগে পড়লো। কিছুক্ষণ পর অনুপম প্রশ্ন করল,


-"আমরা কি খুঁজছি এখানে?


চন্দ্রানি অন্যমনস্ক ভাবে বলল,' ফার্স্ট লিড…. এখনো আমরা কিছু পাইনি যেটা দিয়ে ডক্টরের কোনো আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশনের লিংক পাওয়া যায়।


অনুপম : ধুস! আন্ডারওয়ার্ল্ডের ব্যাপারটা ঢপ লাগছে। আর ওই সিরাম, ওটা আদৌ সম্ভব!


চন্দ্রানী : ফরেনসিক রিপোর্ট এত মিথ্যে বলে না। তবে কি জানো অনুপম, ডাক্তার খুব চালাক লোক। ওই ল্যাবে ঠিক যা যা ডকুমেন্ট ছিল, তার কথাই সে স্যারকে বলে গেছে। এর বেশি কিছু বলেনি। অর্থাৎ....


অনুপম : অর্থাৎ কি?


চন্দ্রানী : অর্থাৎ এর পিছনে কোন বড় কারোর মাথা আছে, যে এই এক্সপেরিমেন্টাল মার্ডারগুলো করিয়েছে।


অনুপম : এক মিনিট, এক মিনিট। ইউ মিন মাস্টারমাইন্ড!.... হ্যাঁ, এভাবে তো ভেবে দেখিনি। ডাক্তার ওই সিরাম বানিয়ে কি করবে, যদি না বেচতেই পারে! কেউ তো ফান্ড দিত।


চন্দ্রানী : সেটাই এখন প্রশ্ন।


    বলতে বলতে হোঁচট খেলো একটা জায়গায়। নিজেকে কোন রকমে সামলে নিল চন্দ্রানী। টর্চ মেরে দেখে বাঁকা হাসি হাসলো। তারপর বলল, "বডি টেনে আনার দাগ না? এটা মনে হচ্ছে কোন সুরঙ্গ। ঢাকনাটা খোলো লিডটা পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে।"


    সকাল সকাল চা খেয়ে পুজো দিচ্ছিলেন প্রেসের ম্যানেজার সমীরণ বসাক। প্রণাম সেরে পিছনের তাকাতেই চন্দ্রানী বলল, "নমস্কার, ইন্সপেক্টর চন্দ্রানী সেন, লালবাজার। সকাল সকাল একটু বিরক্ত করতে এলাম।"


সমীরণ : হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। কিন্তু আমি তো যা বলার সব পুলিশকে বলে দিয়েছিলাম।


চন্দ্রানী : না, আমায় পর্ণার ঠিকানাটা দিন। 


সমীরণ : পর্ণা! ওকে পাওয়া যায়নি? প্রদ্যুত চলে যাওয়ার পর ওর তো কোনো খবরই নেই।


চন্দ্রানী : নেই বলেই তো খোঁজ লাগাচ্ছি। She is a prime suspect of the whole scenario.


সমীরণ : তাহলে ডক্টর!


চন্দ্রানী : সময় হলে সব জানতে পারবেন। আর এই পর্নার ব্যাপারটা কাউকে জানাবেন না। দিন, ওর ডিটেলসগুলো দিন।


সমীরণ : হ্যাঁ দিচ্ছি। কিন্তু যদি ক্রিমিনাল হয় তাহলে এগুলো ফেক হতে পারে। তার জন্য প্রেসের কোন দায় নেই কিন্তু।




    রাস্তায় বের হয়ে চন্দ্রানি নির্দেশ দিল, "স্যারের কথা অনুযায়ী ও আরো কোম্পানিতে কাজ করতো। সেগুলোর খোঁজ নাও আর এই ঠিকানাটা ভেরিফাই করো।"


- আচ্ছা



(৭)



    কিন্তু শহরের অন্য এক প্রান্তে কিছু একটা ঘটছে। খবরে চোখ রাখলে দেখা যায় সেই খুনের ঘটনাগুলো। ওই অঞ্চলের পুলিশের মতে সবই পলিটিক্যাল মার্ডার। কিন্তু মৃত লোকগুলির কোন পলিটিক্যাল কানেকশন নেই বললেই চলে। সবাই ছোট বড় ব্যবসা করে। সকলের মৃতদেহ ঘরের মধ্যেই পড়ে থাকে। গলায় দড়ির দাগ, বুকে ভোজালির দাগ। আর গোটা ঘর জুড়ে জিনিসপত্র এলোমেলো করা। কেউ যেন কিছু খুঁজছে। কি খুঁজছে? সেই প্রশ্ন সকলের মনে জ্বললেও, আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়ে না। কোনো অজানা অস্ত্র সমাজের শিরদাঁড়াকে চুপ করিয়ে রেখেছে। এমন শান্ত সকালে চন্দ্রানির টেবিলে একটা বাজ পড়লো। অনুপম উত্তেজিত হয়ে এসে বলল,




-পর্ণার বাড়ি পেয়ে গেছি।


চন্দ্রানী : এত ফাস্ট?


অনুপম : প্রেসের ঠিকানাই ওর রিয়েল এড্রেস। গিয়ে ভেরিফাই করে এসেছি। বাট .... বাট এরপর যা বলবো শুনলে মাথা ঘুরে যাবে। 


চন্দ্রানী : কি?


অনুপম : পর্ণার প্রথম এমপ্লয়মেন্ট ওই প্রেসেই। এর আগে কোন কোম্পানিতে কাজই করেনি। স্টুডেন্ট ছিল আর একটু খারাপ দিকে চলে গেছিল।


চন্দ্রানী : খারাপ বলতে?


অনুপম : সেই ড্রাগ racket টা মনে আছে? সিগারেটের প্যাকেটে স্টুডেন্টদের মধ্যে ড্রাগ বিলি হতো, ওটার জন্য ধরা পড়েছিল।


চন্দ্রানী : ড্রাগ নেওয়া! নাকি distribution?


অনুপম : Distribution. কিন্তু কোন প্রপার এভিডেন্স ছিল না বলে তিন মাসের জেল খাটিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর চাকরির খোঁজ লাগাতে শুরু করে।


চন্দ্রানী : এটা কত বছর আগে হয়েছে?


অনুপম : এই ধরো চার পাঁচ বছর।


চন্দ্রানী : কিন্তু এইখানে তো গত বছরের ডেট লেখা আছে। এসবের মানে কি?


অনুপম : সেটা নিয়ে খবর নিতে হবে। .... হাসছো যে! আগে প্রমাণ গুলো জোগাড় হোক, তারপর তো অপরাধী এমনিই হাতের মুঠোতে চলে আসবে।


চন্দ্রানী : হ্যাঁ। আবছা সুতোর রং গুলো স্পষ্ট হচ্ছে। নাটকের শেষ অংক আসতে কিছুটা দেরি। তবে অন্তিম পদ আসন্ন। খুব তাড়াতাড়ি তাকে পেয়ে যাব।


অনুপম : হ্যাঁ, পেতে তো হবেই।




    বলে তাকিয়ে রইল চন্দ্রানির দিকে। কিন্তু চন্দ্রানির চোখ তখন কাছের দেয়াল পেরিয়ে একটা ভিড়ের দিকে। ডিপার্টমেন্টের বাকি লোকরা দাঁড়িয়ে। একজন তার দিকে তাকাতেই চন্দ্রানির ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি খেলে গেল।


    সিনিয়র ইন্সপেক্টর বিরুপাক্ষ বেশ সাহসী লোক বলেই পরিচিত। সেই ভিড়ের মধ্যমণিও বটে। তার বক্তব্য একটাই, "এটা একটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। অপরাধী ধরা পড়ে গেছে। এরপর আবার কিসের তদন্ত করছে? এদিকে অন্য কতগুলো কেস যে জমে আছে সেটা কেউ দেখছে না। এটা কোন ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট, নাকি মজা করার জায়গা? সেই কেসগুলোর ইনভেস্টিগেশন না শুরু করলে উপমহল থেকে চাপটা পড়বে আমাদের উপরেই। সেটায় কি কারুর কোন ভ্রুক্ষেপ আছে?"


    ততক্ষণে গুঞ্জনটা থেমে গেছে।


চন্দ্রানী : তো তাতে আপনার সমস্যাটা কি হচ্ছে? নাকি আমার তদন্তে বাধা দিলে আপনার কোন লাভ আছে!


বিরুপাক্ষ : বসের কাছের লোক বলে সত্যজিৎ দার থেকে কেসটা পেয়ে গেলে। জীবনে আর বড় কেস পাবে না, তাই এটা নিয়েই রবারের মতন টেনে যাচ্ছ।


চন্দ্রানী : সেটা তো সময় বলবে। তবে আপনার কোন প্রবলেম হলে সেটা লিগালি ফাইট করার চেষ্টা করুন। এভাবে লোকজনকে উসকে কোন লাভ হবে না।


বিরুপাক্ষ : আমি কি করবো সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। যা ইচ্ছা কর। আশা করব ডিপার্টমেন্টের সময় ফালতু নষ্ট করছ না।


চন্দ্রানী : সেটাও সময় বলবে। জানি, আপনাকে কেসটা দেওয়া হয়নি বলে রেগে আছেন। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখি সত্যজিৎ স্যার কিন্তু আমাকেই বেছেছিলেন। বাকিটা আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে বুঝে নিন।




    বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল চন্দ্রানী। 


    গাড়ি তখন শিয়ালদহ ব্রিজের উপরে চন্দ্রানী বলল,


-অনুপম খেলা জমে উঠেছে।


অনুপম : সব তো বুঝলাম, কিন্তু লোকাল থানার সাথে কাজ করে কি কোন লাভ হচ্ছে? ডিপার্টমেন্টকে অন্ধকারে রেখে কাজ করলে এরকম প্রবলেম হবেই।


চন্দ্রানী : করতে হচ্ছে। বুঝছো না? আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়া। সর্ষের মধ্যে ভূত তো আছেই! আমার কিছু প্রমাণ দরকার। না হলে চার্জশিট তো দূরের কথা, এরেস্ট ওয়ারেন্টও ইস্যু করাতে পারবো না।




    বলতে বলতে গাড়ি এসে থামলো একটা দোতলা বাড়ির সামনে। পর্ণার বাড়ি। ওরা দুজন বাড়িতে ঢুকতেই এক মহিলা রে রে করে তেড়ে উঠে এগিয়ে এসে বললেন, "আপনারা এখানে কেন এসেছেন? আপনাদের জন্য ওরা এসে শাসিয়ে গেল। এদিকে মেয়েটার কোন পাত্তা নেই। ওকে খুঁজুন, তারপর বাকি কথা।" চন্দ্রানী বলল, "কে এসেছিল? আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছি। তবে একটাই রিকোয়েস্ট, পর্ণার ঘরটা একটু দেখতে চাই।"




    কিছুক্ষণ পর হাজার চিৎকার ও কান্নাকাটির মধ্যে থেকে দুজন বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল। ফোনের ছবি দেখে জায়গার নাম উল্লেখ করে গাড়ি ঘোরানোর নির্দেশ দিল অনুপম। সন্ধে নামছে। কিন্তু, তদন্তের ভবিষ্যৎ এই শহুরে আলোর মতন উজ্জ্বল, নাকি চারুলেনের মতন ভয়ংকর অন্ধকার। সেটা অনুপম জানেনা। কিন্তু ভ্রুকুটিহীন নিশ্চিত চন্দ্রানির দৃষ্টি অন্য কথা বলছে।


(৮)


    সকাল সকাল বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন সমীরণ বসাক। হঠাৎ চমকে উঠলেন।




সমীরণ : নমস্কার! এত সকালে? আমার এড্রেস কোথায় পেলেন? ও হ্যাঁ, থানায় তো সব দেওয়া আছে।


চন্দ্রানী : হুম, ঠিক ধরেছেন এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম meet করে যাই।


সমীরণ : সে ভালো করেছেন। কিন্তু পর্ণার কোনো খবর?


চন্দ্রানী : না। তবে একটা এরিয়া আন্দাজ করা গেছে। বাট কোন কনফার্ম খবর নেই। সে খবর সময় মতন পেয়ে যাবেন। তবে একটা কৌতুহল ছিল বলেই এলাম। আপনার বাড়ি থেকে প্রেসটা কাছেই। পর্ণা, প্রদ্যুৎ আপনার অফিসের লোক।উমম....


সমীরণ : আমার সন্দেহ করছেন নাকি?


চন্দ্রানী : না। কিসের সন্দেহ! আপনি কত বছর জয়েন করেছেন প্রেসে?


সমীরণ : প্রায় ১৫ বছর। কিন্তু আমি পর্ণার সঙ্গে কোনো ভাবেই যুক্ত নই।


চন্দ্রানী : সেটা আমি বলিনি। এটুকুই জানার ছিল। Thank you.


সমীরণ : ম্যাডাম .... আমার প্রাণের কোন ভয় নেই তো?


চন্দ্রানী : না, সে নিয়ে ভাববেন না। শুধু সতর্ক থাকবেন। কোন সন্দেহজনক কিছু দেখলে আমায় জানাবেন।




    এরপর এক সপ্তাহ পুরোপুরি চুপচাপ। কোন বিশেষ কিছু ঘটল না। মাঝেমধ্যে একটা দুটো ফোন করছে, আবার কোথায় যেন বের হয়ে যাচ্ছে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলছে,


"সুতোগুলো জুড়ে একটা সাদা পর্দা বানানো হয়ে গেছে, এবার পাখি নিজেই নিজের শিকার করবে। .... ও হ্যাঁ, একটা খবর রিপোর্ট করে এসো। ইন্সপেক্টর চন্দ্রানী রায়ের বাড়িতে এই কেস রিলেটেড ডকুমেন্ট আর কয়েকটা নীল ফাইল চুরি গেছে।"


অনুপম : আচ্ছা .... কিন্তু....


চন্দ্রানী : একটু জোরে বোলো, আজ সবাই আছে, সুবিধা হবে। আর সাসপেক্ট হয়ত কোন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মেয়ে।




    অনুপম গিয়ে দেখল বিরুপাক্ষ স্যার বসে আছে।


বিরুপাক্ষ : ফোন চুরি গেছে, ইমিডিয়েটলি খুঁজে বের করতে হবে। ডালহৌসি বাসস্ট্যান্ডেই চুরি হয়েছে। এ কি তুমি? কি খবর! তোমার কি চুরি গেল?


অনুপম : আমার নয় চন্দ্রাণী ম্যাডামের বাড়িতে কেস রিলেটেড কিছু ডকুমেন্ট মিসিং। সেটারই কমপ্লেন লিখব। সাসপেক্ট নাকি একটা মেয়ে!


বিরুপাক্ষ : I see... 




    এরপর গোটা ডিপার্টমেন্টে খবরটা আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ঝামেলা বাড়াল পরদিনের খবরের কাগজ। ছোট করে হলেও একটা নিউজ ছাপা হয়েছে এই নিয়ে। এত খবর থাকতে এই খবর ঠিক ছেপে গেল, তাও আবার চন্দ্রানির নাম সহ। অবশ্য সেটা হয়েছে চন্দ্রানীর পরিবারের লোকদের জন্যই। পাড়ায় চুরির খবর পেলে সকলেই হইহল্লা করে এই শহর কলকাতায়। লোকাল থানায় ফরমালিটি মেনে কেস করা হয়েছে, যার দরুন একটা নিউজ পেপারে খবর ছাপিয়ে দিয়েছে। এসব দেখে অনুপম প্রমাদ গুনল। একেই কেস ডকুমেন্ট বাড়িতে রাখার নিয়ম নেই, তার উপর ডিপার্টমেন্টের সবাই ক্ষেপে আছে। এবার চন্দ্রানির চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়তে বাধ্য। ওই তো হেডের ঘরে গেছিল চন্দ্রানি, নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছে। ঘরে ঢুকতে চন্দ্রানী বলল, "জাল গোটানোর সময় এসেছে। এই কল রেকর্ড গুলো ব্যাক ট্রেস করানোর ব্যবস্থা কর। .... চিন্তা নেই,আমার চাকরি যাবে না।"


অনুপম : কার কল রেকর্ড?


    মৃদু হেসে বলল, "দেখো শক খেয়ো না। অনেক কষ্টে প্রচুর লোক লাগিয়ে এই একটা খবর জানতে পেরেছি। এটা না জানলে কেসটাতে এগোতে পারতাম না।"


    অনুপম কেবিন থেকে বের হয়ে নিচে যাচ্ছিল। যেতে যেতে লক্ষ্য করল বিরুপক্ষকে। সে গম্ভীরভাবে হেডের ঘরে ঢুকছে। চন্দ্রানীকে নিয়ে কোন স্টেপ নেওয়া হয়নি দেখে রেগে গেছে সম্ভবত। অবশ্য সেটা জানার কথা নয়। নাকি .... ভাবতে পারল না সে কারণ ফোনটা বেজে উঠেছে। ফোন রিসিভ করতেই,   


    


 সমীরণ : চন্দ্রানী ম্যাডামকে ফোনে পেলাম না। তাই আপনাকে কল করলাম। কাল রাতে পর্ণা এসে আমায় শাসিয়ে গেছে। Please help me!


 অনুপম : okay okay! উত্তেজিত হবেন না আমি লোকাল থানাতে কল করে সব ব্যবস্থা করছি।


 


    এ ঠিক ৩৬ ঘণ্টা পরে একটা বস্তি সংলগ্ন এলাকায় হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে গেল। রাত এগারটা বাজে। সেই নাম না জানা বস্তির মধ্যেই কোন এক গলিতে নিস্তব্ধতার ভিড়। অস্তমিত সূর্যের মতন একটা টিমটিমে আলো। সেই আলো-আঁধারিতে একটা মেয়েকে দেখা যায়। সর্বাঙ্গ কালো পোশাকে ঢাকা। খুব সন্তর্পনে হেঁটে চলেছে। একটা দোকানের পিছনে দাঁড়ালো। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। ওই তো সে! ফোনের এসএমএস-এ টাইপ করলো, "আমি ফাইল এনেছি। আমার টাকার সুটকেস রেডি তো?" এসএমএসের উত্তর এলো, "হ্যাঁ তৈরি। হাফ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি কই?


        এরপর মেয়েটি ফোনের ফ্ল্যাশ চালিয়ে সিগন্যাল দিল। সিগন্যাল দিতেই একটা ছায়া মানব বের হয়ে এলো। তার হাতে ব্যাগটা তুলে দিল মেয়েটি। কিন্তু মেয়েটি কোন সুটকেস পেল না। তার কপালে বন্দুক ঠেকানো লোকটা পরিচিত কন্ঠে বলে উঠলো, "স্যার ঠিকই বলেছিল, তোর কচ্ছপের প্রাণ। সেদিন পেটে গুলি খেয়ে পড়ে রইলি, তারপর ম্যানহোলে ফেলে দিলাম। তারপরও বেঁচে গেলি কীভাবে!" 


            কোন উত্তর এলো না। "তোর মনের জোর আছে বলতে হবে। কিন্তু আজ পালাতে পারবি না। কবর খুঁড়ে রেখে এসেছি।" বলে কপালে ঠেকানো বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে, এমন সময় একটা পরিচিত শব্দে চমকে উঠলো। চারপাশে চোখ মেলে দেখল অনেকগুলো বন্দুকের নল তার দিকেই তাগ করা রয়েছে। ভয়ে শিউরে উঠল বিরুপাক্ষ। কারণ সামনের মহিলার মুখের কালো চাদর সরে গেছে। তার ডিপার্টমেন্টের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চন্দ্রানী দাঁড়িয়ে রয়েছে। 


(৯)




চন্দ্রানী : নমস্কার একটা happy news দিতে এলাম।


সমীরণ : Good morning, কি নিউজ?


চন্দ্রানী : বসুন সব বলছি। একচুয়ালি চারু লেনের খুনের পিছনে একটা বিশাল বড় gang কাজ করছিল।


সমীরণ : Gang? কেন? মানে এই কটা খুনের পিছনে একটা gang?


চন্দ্রানী : ইয়েস, কিন্তু প্রবলেমটা কি জানেন তো? ওই gang এর যাকে অ্যারেস্ট করেছি, সে বারবার আপনার নাম করছে। 


সমীরণ ঢোঁক গিলে বলল, "কি বলছেন কি? এর মধ্যে আমার নাম কেন আসবে!"


চন্দ্রানী : আসবে! আসবে! কিভাবে এলো বলি, কিছু ভুল হয়ে গেলে শুধরে দেবেন। ডক্টর আর.কে. ঘোষ, সিবিআই থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল ভুলভাল কিছু এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। সে খবর আপনার প্রেসেই ছাপা হলো। যথারীতি আপনার নজরে পড়ল সেটা। আপনি কন্টাক্ট করলেন। প্রথম দেখাতেই সে বলল, সে এমন একটা সিরাম বানাতে চায় যেটা মার্ডারের পর ইনজেক্ট করলে মার্ডারের সময়টা জানাই যাবে না। এরপর সম্পূর্ণ কথা শুনে আপনি ভাবলেন, এ বদ্ধ পাগল। আর সে যদিও বা বানাতে পারে, সেটাও অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে আপনার মাথায় একটা দারুন প্ল্যান খেলে গেল। বেশ কয়েকবার কথা বলে আপনি ফাইনালি কনভিন্স করলেন যে, serum বানানোর জন্য সব ফান্ডিং আপনি দেবেন এবং তাতে যতদিন সময় লাগে লাগুক। Problem নেই। তবে নেক্সট এক বছরের মধ্যে একটা টেস্ট স্যাম্পেল তৈরি করতে হবে, যেটা নিয়ে আপনি আপনার কার্যসিদ্ধি করবেন।


সমীরণ : গল্পটা বেশ ভালো ফেঁদেছেন দেখছি! কিন্তু এসব ধোপে টিকবে না।


চন্দ্রানী : টিকবে টিকবে, দাঁড়ান বলতে দিন। আর বেশি বাকি নেই। এবার প্রবলেমটা হয়ে গেল অন্য জায়গায়। আপনি যাকে পাগল সায়েন্টিস্ট ভাবছিলেন, সে নিজের মতন কাজ করে চলল। হঠাৎ করে একটা মার্ডারের খবর পেলেন। ততদিনে পুলিশ মহলে আপনি বন্ধুও জুটিয়ে ফেলেছেন। তাদের থেকে শুনে আপনি বুঝলেন যে কিছু একটা গন্ডগোল চলছে। তাই পর্ণাকে কাজে লাগালেন। তাকে বানাতে চাইলেন ডাক্তারের সহকারী, যে কিনা আপনাকে এনে দেবে ডাক্তারের গোপন তথ্য। কিন্তু বাধ সাধলো সেই ডাক্তার। যে একটা মিথ্যের জাল বুনে আপনাকেও ভুল বোঝাচ্ছিল। Maybe সে আপনাকে বলেছিল পর্ণা তার লোক। তার নির্দেশেই পর্ণা আপনার কোম্পানিতে জয়েন করেছে। অবশ্য এটা সম্পূর্ণ আমার আন্দাজ।


সমীরণ : আপনি তো আন্দাজ করে একটা গল্প বানিয়ে ফেলেছেন দেখছি।


চন্দ্রানী : কোনোটা যে মিথ্যে নয়, সেটা আপনার কম্পমান গলা থেকেই বোঝা যাচ্ছে মিস্টার বসাক! আর ওই সোফার নিচের বন্দুকটা ভুলেও ধরার চেষ্টা করবেন না, বাইরে armed guard রয়েছে।


সমীরণ : এভাবে আমায় ফাঁসাতে পারেন না আপনি।


চন্দ্রানী : আপনি ফেঁসে গেছেন মিস্টার বসাক! বাকিটা শুনবেন না?


সমীরণ : না শুনতে চাই না।


চন্দ্রানী : এরপর আপনার সঙ্গে ডাক্তারের গন্ডগোল শুরু হলো। কিন্তু ডাক্তার জানতো না আপনি ঠিক কে? আপনি যে কলকাতায় আফিম পাচারের অন্যতম মাথা ছিলেন এক দশক আগে, সেটা সে জানতো না। কে জানতো জানেন? আপনার পেট ডগ বিরুপাক্ষ। সে জেরায় সব স্বীকার করেছে। আপনার downfall এর সময় থেকে শুরু করে আজকের সব ঘটনা স্বীকার করেছে। সেই জন্যই তো ওইরকম এক অদ্ভুত 'মৃত্যু সময়হীন serum' এর গুজব ছড়িয়ে মার্কেটে আসতে চেয়েছিলেন। কী, ভুল বললাম?




সমীরণ চুপ করে বসে থাকে।




চন্দ্রানী : আপনি ঠিক দুটো জায়গায় ভুল করেছিলেন। প্রথম ভুলটা অবশ্যই অনুপমকে কল করে পর্ণার হুমকির কথা বলা। কি panicked হয়ে গিয়েছিলেন নাকি? এবং দ্বিতীয় ভুলটা পর্ণার ডকুমেন্টগুলো জাল করা। অন্তত একটু খোঁজখবর নিয়ে জাল করলে ধরা পড়তেন না। এবং থ্যাংকস টু পর্ণা। ও নিজে আমার জন্য রেখে গিয়েছিল ওর ফোন আর এই মহামূল্য ফর্মুলার ফাইলটা। ডাক্তারের বাড়ির নিচে একটা বেসমেন্ট আছে জানতেন না, না?




    এখনো চুপ করে বসে আছে সমীরণ। হাত দুটো মুখের কাছে ধরে বসে আছে। চন্দ্রানি বলে চললো, "ফোনের সমস্ত চ্যাট এবং কিছু নোটস আপনার বিরুদ্ধে যাবে তাই আপনি সারেন্ডার করুন।"


    একজন কনস্টেবল তার থেকে এগিয়ে গেল। তার গায়ে হাত দিতেই টের পেল সমীরণের দেহ নিথর হয়ে গেছে। চন্দ্রানি ছুটে গেল। অনুপম সব দেখে শুনে বলল, "আংটির মধ্যে এই pouch এ বিষ ছিল। সুইসাইড করেছে। হয়তো আরো অনেক ইনফরমেশন জানতো। হয়তো ওই যে বিজনেসম্যান গুলো মার্ডার হচ্ছিল, ওদের কেসটা এ সলভ করতে পারত।"


চন্দ্রানী : ওটা ওর rival gang এর কাজ। ওই নীল ফাইল গুলোকে সরাতে হবে। Otherwise আরো ক্রাইম হবে। ডাক্তার, সমীরণ, পর্ণা সবই নিমিত্ত মাত্র।


অনুপম : But বিরুপাক্ষই যদি পর্ণাকে মারে, তাহলে সমীরণকে ভুল ইনফরমেশন দিলো কেন?


চন্দ্রানী : ভুল ইনফরমেশন দেয়নি। আমার পাতা ফাঁদটা কাজে লাগতো না যদি না পর্ণার ফোনটা পেতাম তুমি, আমি। ফাইনাল কনফার্মেশন পায় আমার থেকে। পর্ণার হাইট যে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, সেটা ওর সিভিতেই আছে। তাই বিরুপাক্ষর জন্য ফাঁদ পাতলাম পর্ণার ফোন ইউজ করে। তাতেই এত কিছু।




    এরপর চন্দ্রানী একটা অদ্ভুত কাজ করলো। সুটকেসে থাকা নীল ফাইলগুলো নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। ধোঁয়া উড়ছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই অদ্ভুত জিনিসের ফর্মুলাগুলো। তবে এটার পরেও কী থামবে সবকিছু? কেউ জানে না। তবে অনুপমের মনে হলো পর্ণা ও ডাক্তার, সঙ্গে প্রদ্যুৎ বাবু, এরা কেউই ওই মৃত্যু পথের যাত্রী হতো না। লোভ! লোভ সব শেষ করে দেয়। এবং জন্ম দেয় আর এক লোভের। সমীরণের মৃত্যু কার লোভ বাড়িয়ে দেবে, কাকে বানাবে দ্বিতীয় সমীরণ, কে জানে।