তুলি - অভিজিৎ দাস || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 তুলি

    অভিজিৎ দাস


 বাইরে সোনাঝরা নরম রোদ । মাঠের সবুজ ঘাসগালিচার ওপর যেন গুঁড়ো গুঁড়ো সোনা মুঠো ভরে ছড়িয়ে দিচ্ছে । ভাইয়ের হাত ধরে দৌড়ে বাগানে এল তুলি । এই সময়টা বাগানটা যেন আরও রঙিন হয়ে যায় । রং বেরঙয়ের প্রজাপতি দল বেঁধে গাছে গাছে উড়ে বেড়ায় । কোনোটা সাদা, কোনোটা হলুদ , কোনোটা নীল আর কালো , কোনওটার গায়ে আবার বিভিন্ন রঙ দিয়ে আঁকা । ভারী সুন্দর লাগে তুলির । শরৎ আসব আসব করছে । নীল আকাশে সাদা মেঘের দল পানসী ভাসিয়ে এক দিক থেকে আরেক দিকে চলেছে ।


        “ দেখ দিভাই, কি সুন্দর ওই প্রজাপতিটা !” – টিটু বলল ।


“ হ্যাঁ , নীল আর সাদা রঙের ওপর কালো গোল গোল ফুটকি । খুব সুন্দর । ”


ওহ , বলতে ভুলেই গেছিলাম । তুলির ভাইয়ের নাম টিটু । একমাথা ঝাঁকড়া চুল । টানা চোখদুটোতে স্বপ্ন ভরা ।


প্রতিদিন সকালে তুলি আর টিটু বাগানে চলে আসে । ওদের বাড়ির একপাশে লম্বা বাগান । সামনের দিকে সবুজ ঘাসের লন । সকালের দিকে একঝাঁক ছাতারে পাখি আসে । ওদের ক্যাঁচর-ম্যাচরে ঘুম ভেঙে যায় তুলির ।


         একটা সাদা-কালো প্রজাপতি বসেছে ওই টগর ফুলের ওপরে । তুলি একটু এগিয়ে যায় । ধুস্ ! দু পা এগোতেই টুক করে উড়ে যায় । বড্ড দুষ্টু প্রজাপতিটা । আর একটু এগোয় তুলি । টগরের পাশে একটা জবা গাছ । লাল টুকটুকে জবা ফুলে গাছ ভরে আছে । জবা গাছটায় ছোট্ট ছোট্ট দুটো প্রজাপতি উড়ছে । সাদা রঙের । আবার ডানার নিচের দিকে কমলাটে ছোপ আছে ।


  ‘ আরে ! এগুলো কী । ’- মনে মনে বলেই একটা পাতা তুলে ধরে তুলি । পাতার নিচের দিকে খুব ছোট্ট ছোট্ট দানা লেগে আছে । একসাথে অনেকগুলো । তুলি এগুলো ভাল করেই চেনে । ওই প্রজাপতি দুটোর ডিম । মা দেখিয়েছিল আগে । ভাইকেও দেখায় তুলি । কী সুন্দর লেগে আছে পাতার নিচে । যতই ঝাঁকাও, পড়বে না ।


       বেশ কিছুদিন কেটে গেল । তুলি রোজই একবার করে গিয়ে ডিমগুলো দেখে আসে । অবশ্য একা যায় না । টিটুও সঙ্গ নেয় । বাবা সবসময় বলে , ‘প্রকৃতি হল সবচেয়ে বড় বই । এখান থেকে যা শিখবে , কোনও বইতে পাবে না ’ । মাঝখানে


দুদিন বৃষ্টি হয়েছিল । তাই বাগানে যেতে দেয়নি মা । কিন্তু তুলির খুব ইচ্ছে করে বৃষ্টির পর বাগানে আসতে । বাচ্চা শামুকগুলো বেরোয় । তারপর কমলা রঙের ফড়িং ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় । কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ । কী আর করবে তুলি ! তাই আজ বাগানে এসেই ছুটে গেল জবা গাছটার দিকে । ডিমগুলো আর নেই । তার জায়গায় খুব ছোট ছোট সবুজ রঙের পোকা হয়েছে । দিব্বি পাতার মধ্যে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে ।


পাতাটার গায়ে এক টুকরো লাল সেলোটেপ লাগিয়ে দিল তুলি । যাতে করে একবার দেখলেই চেনা যায় । সবই ঠিকঠাক চলছিল । গন্ডগোল বাঁধল অন্য জায়গায় । পড়তে বসে খালি ওই ডিমগুলোর কথা মনে পড়ে । কেমন হয়েছে ডিমগুলো , ফুটবে কখন , বাচ্চাগুলো কেমন দেখতে হবে ......এইসব । যথারীতি নামতা বলতে গেলে ভুল হয় । ইংরেজি বানান লিখতে গেলে অ্যালফাবেট বাদ চলে যায় । অথচ তুলি সব পারে । এইতো কাল সন্ধ্যেবেলা মা পড়াতে বসে ধাঁই করে পিঠে একটা বসিয়ে দিল । কারণ ? তুলি গুণ অঙ্ক করার সময় সাত দুগুনে চৌদ্দ র বদলে ষোল লিখে ফেলেছিল ।


      কিছুদিন কাটল এভাবে । তারপর একদিন তুলি আবার বাগানে গেল । কোথায় ডিম ! ছোট ছোট সবুজ রঙের শুঁয়োপোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে । আর পাতার ধারগুলো কুরে কুরে খাচ্ছে । শুঁয়োপোকাগুলোর গায়ে রোঁয়া কম । দেখলেই বোঝা যায় নরম তুলতুলে । ফিসফিস করে ওদের সাথে কথা বলে তুলি । বলে, ‘এখন পেট পুরে পাতা খেয়ে নাও । প্রজাপতি হলে উড়তে শক্তি লাগবে ।’


 সেদিনের মতো ঘরে চলে আসে তুলি । কয়েকদিন পর আবার গেল ।


         তুলিদের বাড়িটা অনেক বড় । বাড়ির পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে পিচের রাস্তা চলে গেছে । তার ওপাশে সরস্বতী নদী । নদীর ধার বরাবর সবুজ ঘাসের পাড় । পাড় ধরে হাঁটলে সারাটা রাস্তা শিরশিরে বাতাস । মাঝেমধ্যে একআধটা কৃষ্ঞচূড়া গাছ । পাতার ফাঁকে আগমনী শরতের নীল আকাশ কাঁপে । নদীতে জল তেমন থাকে না । তবে বর্ষায় দুকূল কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায় । নদী ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে একটা ব্রিজ । ওর ওপর দিয়ে চলে গেছে দিল্লী রোড ।


        এবার তুলি একটা পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে এসেছে । এই কদিনে একটু বড় হয়েছে শুঁয়োপোকাগুলো । এখন এক একজন আলাদা আলাদা পাতা খাচ্ছে । পাতা ধরে একটু ঝাঁকুনি দিতেই টপাটপ বাক্সের মধ্যে পড়ে গেল শুঁয়োপোকাগুলো । তুলি গুনল । মোট পাঁচটা । তারপর বেশ কিছু পাতা ছিঁড়ে বাক্সে ফেলে দিল । মনে মনে ঠিক করল , বাক্সটাকে মায়ের আড়ালে ঘরে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে । এই ভেবে যেই না পেছন ঘুরেছে তুলি , সাক্ষাৎ মূর্তিমান দাঁড়িয়ে । টিটু যে নিঃশব্দে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে , টের পায়নি । উফ্ , এই ছেলেকে না দেখিয়ে কিছু করার উপায় নেই । না হলেই মা র কানে তুলে দেবে ।


    আকাশে তখন পালতোলা মেঘের নৌকো । তুলি শুঁয়োপোকাগুলো নিয়ে ঘরে চলে এল । বইয়ের কাবার্ডের একেবারে নিচের ড্রয়ারটায় বাক্সটা ঢুকিয়ে দিল । ব্যস্ । আর মায়ের চোখ পড়বে না ।


      তুলি রোজই রাতে শোওয়ার সময় একবার করে ওগুলোকে দেখে আর বাগান থেকে পাতা এনে খেতে দেয় । কিন্তু চিন্তার বিষয় হল , যেমন খাচ্ছে শুঁয়োপোকাগুলো , ঠিক সেই পরিমাণ পটি ও করছে । এই ক’দিনে বাক্সটা নোংরা করে ফেলেছে । তবুও কিছু করার নেই । মা জেনে গেলেই মুশকিল ।


  সেদিন ছিল রবিবার । আগের দিন বাক্সটা দেখা হয়নি । শুতে গিয়ে তুলির হঠাৎ খেয়াল হল । বাক্সের ঢাকনা খুলতেই চোখদুটো আনন্দে ভরে উঠল । শুঁয়োপোকাগুলো আরও বড় হয়েছে । গায়ে বাদামী রঙের বুটি বুটি দাগ এসেছে । রোঁয়াগুলো আরও বড় ও ঘন হয়েছে ।


‘এই তো ! প্রজাপতি হওয়ার দিকে এগোচ্ছে ।’ – তুলির মন আনন্দে নেচে উঠল ।


বেশ কিছুদিন কেটে গেল । এখন শুঁয়োপোকাগুলো নড়াচড়া কম করে । আগের তুলনায় মোটা হয়েছে ।


একদিন তুলি দেখতে পেল, শুঁয়োপোকাগুলো আর নড়ছে না । বরং চারপাশে সবুজ রঙের মসৃণ আস্তরণে ঢেকে স্থির হয়ে গেছে ।


‘এগুলো কি রে দিদি ?’ – টিটু জিজ্ঞেস করে বসল ।


‘এগুলোকে বলে গুটি । এখান থেকেই প্রজাপতি বেরোবে কদিন পর ।’


আরও দু সপ্তাহ মতো চলে গেল । একদিন দুপুরবেলা তুলি পুতুল নিয়ে খেলছিল । হঠাৎই ড্রয়ারের মধ্যে কিছু একটা নড়াচড়ার শব্দ পেল । তাড়াতাড়ি উঠে ড্রয়ারটা টানতেই ...... আরে বাঃ! সাদা ধবধবে তিনটে প্রজাপতি ! ...... আর ঐ যে আরেকটা বেরিয়েছে । হলুদের ওপর কমলা কালো র বুটি দেওয়া।


পুতুল ফেলে আনন্দে নাচতে নাচতে ভাইকে ডাকতে চলে গেল তুলি । দুজনে মিলে সারাটা দুপুর দেখল প্রজাপতিগুলোকে । রাত্রে খেতে বসে মা কে সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল তুলি । তবে মায়ের মুডটা সেদিন ভালই ছিল । তাই সব শুনে শুধু বলল, প্রজাপতিগুলোকে ছেড়ে দিতে । নাহলে ওদের কষ্ট হবে ।


নাঃ ! শুধু মায়ের মুড ভাল বললে হবে না । সেদিন তুলি সাতটা বড় বড় ভাগ অঙ্ক একেবারে ঠিক করেছিল । সেটাও ভাবতে হবে ।


          সকাল হল । সূর্যদেব হাসি হাসি মুখে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন । তুলি আজ একটু তাড়তাড়িই উঠে পড়েছে । মাথার কাছের জানালাটা দিয়ে কাঁচা সোনার মতো রোদ এসে পড়েছে । তুলি আগে বাক্সটা খুলল । সবকটা প্রজাপতি বেশ বড় হয়ে গেছে । বাক্সটা নিয়ে জানালার ধারে এনে রাখল । একে একে বেরোতে লাগল প্রজাপতিগুলো । একটা , দুটো করে মোট পাঁচটা । ওদের ডানার লাল, হলুদ, কালো, বাদামী রঙের ডিজাইনগুলো যেন সূর্যের আলোয় আরও বেশী করে উজ্জ্বল লাগছে । ওরা যেন আজ নতুন আনন্দে নেচে নেচে চলেছে । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুলি ।


     টিটু পাশ থেকে বলল, ‘দেখ্ দিদি, ওই প্রজাপতিটা কী সুন্দর !’


- হ্যাঁ , ওই কমলা কালো টাই সবচেয়ে সুন্দর !


 


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024