চারু লেন রহস্য - প্রতীক মন্ডল || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story
চারু লেন রহস্য
প্রতীক মন্ডল
(১)
"রাগ, ষড়রিপুর মধ্যে এমন এক রিপু যা খুবই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু, তার চেয়েও বড় রিপু হয়ে উঠতে পারত মানসিক বিকৃতি। বিকৃত মানব কখন যে কি দেখে, কি করে, কি বলে, কেউ জানে না যে। তাদেরকে বেঁধে রেখে দিলে সামাজিক চোখরাঙানি, ছেড়ে রাখলে মৃত্যুর হাতছানি। কিভাবে? একটু ভাবুন। ভাবলে দেখবেন যে, বিকৃত মনের মানুষের সঙ্গে আপনি নিজের অজান্তে যা যা দুর্ব্যবহার করেছেন সবই সে ফিরিয়ে দিতে চায়। সেটার জন্য একটা ছুরিই যথেষ্ট। সুতরাং, সময় থাকতে সাবধান হোন।"
প্রতিবেদনটা মন দিয়ে পড়লেও লেখার ভঙ্গিমাটা তার একদমই পছন্দ হয়নি। হতেও পারে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন অপমানজনক সুরে প্রতিবেদনটা লেখা! খবরের কাগজটা মুড়ে স্টেশন থেকে নামলেন প্রদ্যুৎ বাবু। শেষের অংশটুকুতে যা বলেছে তা খারাপ লাগলেও, কিছু জিনিস ঠিক। কারণ তার রাতে ঘুম ক'দিন ধরে হচ্ছেই না। মাথা ধরছে, মাথায় ভুলভাল চিন্তা আসছে, দুঃস্বপ্ন দেখছেন, আরো কত কি! কেন হচ্ছে, তা তিনি বুঝতেও পারছেন না। এবং সত্যি বলতে বাকিদের বুঝতে দিচ্ছেন না। আসলে তাঁর জীবনে একটা গোপন দুঃখ আছে, যেটাকে ব্যর্থতা বললেও ভুল হবে না। তাঁর কোন সন্তান নেই। সত্যি বলতে সেটার দায় তাঁরই। কিন্তু ব্যর্থতা সেটা নয়। তাঁর অক্ষমতা লুকিয়ে রেখেছেন সযত্নে। তাই অভিযোগের আঙুল শুক্লার দিকেই। সে জিনিসের প্রতিবাদ না করার ব্যর্থতা একটা ঘটনার পর থেকে তাকে যেন ভিতর থেকে ফালাফালা করে দেয়। সেই চিন্তাগুলোই সম্প্রতি তাঁকে পাগল করে দিচ্ছে। প্রেসে কাজ করছেন বছর দশেক হলো। নিখুঁতভাবে কাজ করা প্রদ্যুৎ বাবুর কাজেও ভুল হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।
-"চা লাগবে বাবু?"
-"এত সকালে চা! পাঁঠা নাকি!"
-"অন্য দিন তো খান আজ কি হলো?"
বলে গজগজ করতে করতে চলে গেল মাধব বেয়ারা। সত্যিই তো রোজ খান! আজ এত রেগে গেলেন কেন? অকারনে চিৎকার করলে শরীর খারাপ হতে পারে। নাহ ঠিক হচ্ছে না কাজটা। শান্ত থাকতে হবে তাঁকে।
তখন বাজে বিকেল চারটে। এবার কাজ গুছানো শুরু করলেন। আজ ইচ্ছে আছে একটু ভালো মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন। হলদিরাম থেকে ভুজিয়াও নেবেন। ভালো খেলে যদি মনটা একটু শান্ত হয়। এখন প্রেস প্রায় ফাঁকা। রাতের শিফটের লোক ঢোকার একটু দেরি আছে। বাথরুমে গেলেন। বের হয়ে আসার সময় নজরে পড়ল একটা হাতের ছাপ! বেশ অদ্ভুত! ভালো করে দেখলেন। তারপর নিজের হাতটা সেই হাতের ছাপের উপর বসিয়েই একটু চমকে গেলেন। এ যে অবিকল তার হাতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে! টেবিল থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আনার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন নেই! "নেই" কিভাবে সম্ভব এখানেই তো ছিল তাহলে!
" প্রদ্যুৎদা? কি করছো! এমা হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস কেন?" একটু হকচকিয়ে গিয়ে প্রদ্যুৎবাবু বললেন,"নানা ভুল করে নিয়ে চলে এসেছিলাম।"
এরপর দ্রুতপায়ে টেবিলে গিয়ে নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। শীত পড়ছে। একটু তাড়াতাড়ি আঁধার নামছে। তখন প্রদ্যুৎ বাবুর মনে হচ্ছিল এই সামনের জনসমুদ্র তার জন্য নয়। একটু অন্ধকারে মিশে গেলে তিনি হারিয়ে যাবেন। কেউ যখন নাগাল পাবে না, তখন এই আঁধার তার বন্ধু হবে। এসব ভাবতে ভাবতে একটা শর্টকাট ধরলেন।
আধো অন্ধকার। দুদিকের বাড়িগুলো যেন অতন্দ্র প্রহরী। সেই প্রহরীদের মাঝেও কি নিরাপদে থাকা যায়! এটার নাম চারুচন্দ্র লেন। বেশ কিছু বছর আগে এখানে নাকি দুজন পথচারীকে নিশংসভাবে খুন করেছিল কেউ। সে রহস্যের সমাধান হয়েছে কিনা জানা নেই। বাড়িগুলো থেকে টিমটিমে আলোগুলো রাস্তায় আসতে গিয়েও পারছে না যেন। বাড়ির ভিতরগুলো নিস্তব্ধ। দ্রুতপায়ে হেঁটে স্টেশনের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুদূর যেতেই থমকে দাঁড়ালেন। সামনে গলিটা যেখানে বাঁক নিচ্ছে সেই বাঁকের ডানদিক থেকেই যেন আওয়াজটা আসছে।
প্রদ্যুৎ বাবু লুকিয়ে পড়লেন। শরীরের রক্ত চলাচল যেন আরো বেড়ে গেছে। যে বাড়ির পাঁচিলে লুকিয়ে ছিলেন, সেখান থেকেই উঁকি মেরে দেখলেন। দেখে তাঁর হাড়হিম হয়ে গেল। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা একটি লোক। মুখে একটা অদ্ভুত মুখোশ। সেটা কি রংয়ের বোঝা যাচ্ছে না। তার হাতে বিশাল বড় ভোজালি। সেটা দিয়ে সমানে কুপিয়ে যাচ্ছে সামনের মৃতদেহটাকে। না! সেতো এখনো মরেনি! সে দুই হাত দিয়ে ঘষে ঘষে পালানোর চেষ্টা করছে! অবশেষে সেই অজানা মানুষটার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আর দেখতে পারলেন না প্রদ্যুৎবাবু। তাঁর হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু পালাতে না পারলে যে বিপদ! কোনরকমে যথাসম্ভব নিঃশব্দে পালাতে লাগলেন। পালানোর সময় বারকয়েক পিছনে দেখলেন। না কেউ আসছে না। অবশেষে এসে থামলেন অফিসের সামনে। সামনে সেই পরিচিত জনসমুদ্র। খুনিটা তাঁকে দেখেছে কিনা জানা নেই। তিনি ধীর পায়ে মিশে গেলেন এই জনসমুদ্রের কোলাহলে তাঁকে আর খুঁজে পাবে না সে।
পরদিন অফিস যাওয়ার অবস্থায় ছিলেন না। গোটা দিন ভেবে গেলেন সেই রাতের ঘটনাটা। সেদিন যা দেখলেন, তা কিভাবে সম্ভব? ওই রাস্তায় আরো অনেকে হাঁটাচলা করে, বাড়িতেও কত লোক থাকে; তাই বলে এত ঝুঁকি নিয়ে কেউ খুন করবে? ওই রাস্তায়! নানা!
মনে মনে আরও ভাবলেন,"আগে কোনদিন যাইনি ওই রাস্তায়। এত বড় বাড়ি সন্ধের সময় ওই রাস্তা ফাঁকা কেন থাকবে? নিদেনপক্ষে একটা সাইকেল বা কোন কুকুরও ছিল না। তবে! তবে কি ভুল দেখলাম? না না এ হতে পারে না। নাকি সত্যি! .... কদিন আগে এরকম একটা স্বপ্নও দেখেছিলাম। তবে সবই কি মনের ভুল?"
সেদিন ভয় টিভি আর খবরের কাগজ খুলে দেখলেন না। রাত বাড়তেই স্ত্রীকে বললেন,
-"শোনো না, ঘুমের ওষুধ আছে?"
সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে, "না!"
তবে আর কি? নটার দিকে বেরিয়ে পড়লেন। এক ডোজ খেলে কিচ্ছু হবেনা, তাই এক শিশি কিনলেন। বের হয়ে আসার সময় শুনতে পেলেন ওষুধের দোকানের লোকটা বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে," আজ নাইট ডিউটি! ওদিকে সাবধানে যেও। খুন-জখমের খবর আসছে ভয় লাগে বাপু।"
দোকানির বউ আশ্বাস দিয়ে বলল,"তুমি একদম চিন্তা কোরোনা, আমি সাবধানেই যাব। তুমি বাড়ির খেয়াল রেখো।"
প্রদ্যুৎ অস্ফুটে বলে উঠলেন, "কোথায়?"
সেটা শুনে ওই দোকানদার বলল, " ওই তো শিয়ালদা স্টেশনের কাছে কি একটা জায়গা আছে না! ওখানে!"
মাথাটা ভয়ংকর ধরেছে। দোকানদারের কথাটা শুনেই যেন বেড়ে গেছে। জোর পায় হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছেন। কখনো হোঁচট খাচ্ছেন, কখনো হালকা দৌড়চ্ছেন। তবু যেন থামতে নেই। এই রাস্তার আঁধার যেন কৃষ্ণ গহবরের মতন গভীর ও দীর্ঘ হয়েই চলেছে! হঠাৎ যেন ধাক্কা খেলেন ঝুলন্ত কিছুতে! উপরে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন। গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে রয়েছে একটা মৃতদেহ!
তারপর এটুকু মনে আছে, ঘরে এসে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন বা বলা যায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে লালবাজার সরগরম হওয়ার তখনও তিন চার দিন বাকি। তবে ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট এর অন্দরে একটা চাপা গুঞ্জন চলছিল। কারণ, চারুচন্দ্র লেনের নৃশংস কোনটা মোটেও স্বাভাবিক না। দুই বছর আগে একইভাবে দুটো খুন হয়েছিল পাশে লেখা ছিল,
"For Experimental Purpose Only"
তাই জন্য ওই গলির মুখে সিসিটিভি লাগানো হলো। অথচ একইভাবে খুনটা করল সিসিটিভির পিছনেই। এবারে কেসের দায়িত্ব পড়েছে সত্যজিৎ সান্যালের উপর। খুনের ধরন সবই জানা। তবে একটা কথা বুঝতে পারছেন না; এবারে এই লেখাটির পাশে, "Now I have witness" কথাটা বড় করে লেখা। আর সেটাই ভাবাচ্ছে সত্যকে। যদিও অনেকে আমল দিচ্ছেনা। সামনে ইলেকশনের চাপে সকলেই জেরবার। তাই এটাকে পলিটিকাল মার্ডার বলে চাপা দিতে পরামর্শ দিচ্ছে সবাই। না! সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ তা বারবার দেখছেন," No clue! কিন্তু .... এটা কে?"
দশ মিনিট পরেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন ডিপার্টমেন্ট থেকে।
(২)
আজ অফিসে এসেছেন প্রদ্যুৎবাবু। মনটা একটু হালকা লাগছে। সঙ্গে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে গালিও দিচ্ছেন। সেদিন রাতে ভয়ে, টেনসনে, একটা ঝুলন্ত নারকেল পাতা কে ডেডবডি ভেবেছেন! সকালে উঠে যখন দেখলেন চারপাশ নিস্তব্ধ, ফাঁকা রাস্তার দিকে ইলেকট্রিক তারে ঝুলতে থাকা পাতায় ধাক্কা খেয়েছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল নিজেকে একটা বড় থাপ্পড় মারেন। এবার একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে। এমন সময় এগিয়ে এলো পর্ণা। নতুন ঢুকেছে, প্রদ্যুৎ জেঠুকে বিশাল শ্রদ্ধা করে। এসে বলল,
পর্ণা: ঠিক আছ জেঠু?
প্রদ্যুৎ যেন আঁতকে উঠে বলল," হ্যাঁ, মানে ওই আর কি...."
-"শরীর ঠিক আছে তো? কদিন ধরে দেখছি তুমি কিরকম যেন হয়ে আছো!"
-"না রে মা, রাতে বেশ কিছুদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। দুঃস্বপ্ন দেখছি।"
-"বল কি? তারমানে খুব দুশ্চিন্তা করছো নিশ্চয়ই? তোমাদের সবার এই এক সমস্যা, কোন কারণ নেই, তবু চিন্তা করে যাচ্ছ।"
-" নাহ!সেটা নয়। ক'দিন ধরে ডেড বডি দেখছি, মার্ডার দেখছি; এখন স্বপ্ন দেখতেও ভয় লাগে। কি যে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিনা।"
-"শোনো শোনো, অত চিন্তা কোরোনা। .... কোথায় গেল? এইযে এই নম্বর আর ঠিকানাটা লিখে নাও, এর কাছে গিয়ে একটু চেক আপ করিয়ে এস।"
-"কোথায় এটা?"
-" চারুচন্দ্র লেনটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই ফার্স্ট বাড়িটা। আর হ্যাঁ, সম্ভব হলে ঘুরে মেইন রোড দিয়ে যেও। ওই রাস্তায় পরশু একটা মার্ডার হয়েছে রাত ১১ টার দিকে।"
কথাটা শুনে আঁতকে উঠলেন। তার মানে, সত্যি! সব সত্যি! মিথ্যে নয়!
আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলেন। দাঁড়িয়ে চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। অবশেষে হাঁটা দিলেন চারুচন্দ্র লেনের ভিতর দিয়েই। অনেক প্রশ্নের উত্তর তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ওই পথে গেলে সত্যি মিথ্যের মুখোশগুলো ধ্বসে কিনা দেখা যাক।
(৩)
সত্যজিতের ফোন বেজে উঠলো। কিন্তু সেসব ধরার সময় নেই। ফোনের পাশের বোতাম টিপে সেটাকে শান্ত করলেন। কারণ সে নিজে বেশ উত্তেজিত। Clue পেয়েছেন। বা বলা ভালো সাক্ষীকে পেয়েছেন। রাস্তায় পুলিশের লাগানো সিসিটিভিতে একটা বাড়ির পাশেই একটা লুকোনো লোকের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। তারপর ছুটে চলে আসেন এখানে। এখন যে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সেই বাড়ির আরেক সিসিটিভি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ পাওয়া গেছে। বাড়ির মালিক সুব্রত রাহার কথা জানতে পেরেছেন।
সুব্রত: কি বলবো স্যার, আমি তো এখানে থাকিইনা। বাবার আমলের বাড়ি। ভুবনেশ্বর থেকে এখানে আসি উইকেন্ডে। একচুয়ালি দেখুন না, সামনের চারটে বাড়িতে সেই আগুন লাগল না!
সত্যজিৎ: কবে?
সুব্রত: চার-পাঁচ বছর আগে। তারপর ওই বাড়িগুলোতে কেউ থাকেনা।
সত্যজিৎ এক পলকে দেখে নিল বাড়িগুলো। দূর থেকে এখনো কালো দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সুব্রত: ওই জন্য দেখলাম পাড়াটা এত নিস্তব্ধ, আর আমি থাকিও না এখানে তাই একটা সিসিটিভি লাগালাম।
সত্যজিৎ: Seriously?! আমি ফুটেজ গুলো দেখতে চাই
সুব্রত: হ্যাঁ চলুন।
সত্যজিৎ: আর হ্যাঁ, আমার যদি কোন সিসিটিভি ফুটেজ লাগে, সেটা নেওয়ার ব্যবস্থা আছে তো?
সুব্রত: হ্যাঁ আছে। আপনার যা যা লাগবে বলে দিন, আমি দশ মিনিটের মধ্যে দিয়ে দিতে পারব।
সত্যজিৎ বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে ফুটেজগুলো দেখলেন। ওই লোকটাকে সম্পূর্ণভাবে দেখা গেল।
সত্যজিৎ: মার্ডার টাইম যদি রাত এগারটা হয়, তাহলে এই লোকটা লুকোচ্ছে কেন? তাও আবার সন্ধে সাতটায়? কে এই লোকটা? ওই অন্ধকার গলিতে কেন এসেছিল! সেটার চেয়েও বড় প্রশ্ন ফরেনসিক এ মৃত্যুর সময় রাত এগারোটা কেন?
এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। লোকটা যে পাঁচিলের কাছে ছিল, সেখানে যাবেন, এমন সময় দেখলেন একটি লোক ধীর পায়ে উল্টোদিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সত্যজিৎ: এই কে আপনি? এদিকে আসুন, কোথায় যাচ্ছিলেন এদিকে?
প্রদ্যুৎ: আমার নাম প্রদ্যুৎ। ভুল করে এই গলিতে ঢুকে পড়েছি, যাবো গুড লাইফ ক্লিনিক এ। শর্টকাট ধরতে গিয়ে গুলিয়ে গেছে। আ - আ আমি এই প্রেস টায় কাজ করি।
সত্যজিৎ: এই রাস্তায় আগে আসেন নি?
প্রদ্যুৎ: না
সত্যজিৎ: Ok, যান।
প্রদ্যুৎ বাবু ফিরে চললেন। এই রাস্তায় আর ঢুকবেন না। তিনি যে পুলিশের খাতায় একটা বড়সড় উইটনেস, সেটা ভালই বুঝেছেন। কিন্তু, পুলিশের কাছে না যাওয়ার দুটি কারণ। প্রথমত, পুলিশকে বিশ্বাস করেন না তিনি। দ্বিতীয়তঃ, তিনি উইটনেস হিসেবে উপযুক্ত নন, কারণ কোনটা হ্যালুসিনেশন, আর কোনটা সত্যি, তিনি নিজেই জানেন না। এই অবস্থায় পুলিশ তাঁকে যদি খুনি ভেবে নেয়, তাহলে শেষ।
হাঁটতে হাঁটতে পৌছলেন গুড লাইফ ক্লিনিকে। ফোন করে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিতে হয়েছিল। ভিতরে ঢুকে দেখলেন বাইরে কেউ নেই। এমনকি কোন রিসেপশনিস্ট পর্যন্ত নেই! আশেপাশে বেশ নিস্তব্ধ। দরজায় নক করে বললেন,
প্রদ্যুৎ: আসতে পারি?
ডাক্তার: হ্যাঁ আসুন! .... বলুন কি সমস্যা?
প্রদ্যুৎ: সমস্যা বলতে অনেক কিছু....
সব শুনে ডাক্তার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল। বলল,
"আপনি কি রিসেন্টলি কোন ট্রমাটিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন বা কোন মার্ডারের উইটনেস হয়েছেন?"
শুনে চমকে উঠলেন প্রদ্যুৎ বাবু।
প্রদ্যুৎ: না, মানে কেন বলুন তো?
ডাক্তার: ও, তাহলে আপনি সেই উইটনেস নন। ও হ্যাঁ, আমি কিন্তু লালবাজারেও কাজ করি!
প্রদ্যুৎ: উইটনেস! কিসের?
ডাক্তার: ওই যে পরশু মার্ডার টা হলো না রাত ১১ টায়, ওটার নাকি একজন উইটনেস আছে পুলিশ তাকে খুঁজছে।
ডাক্তার কথাগুলো বলে চলল। প্রদ্যুৎ বাবু ঘেমে উঠলেন। বললেন,
প্রদ্যুৎ: আমি ওই রাস্তায় সন্ধে সাতটায় দাঁড়িয়ে একটা হ্যালুসিনেশন এর মত দেখেছি। মানে একটা মার্ডার এর হ্যালুসিনেশন .... যেমনটা বললাম আর কি। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো ডাক্তার বাবু? কিন্তু .... কিন্তু রাত এগারোটায় ওই রাস্তায় আমি ছিলাম না!
ডাক্তার: আঃ শান্ত হন তো মশাই। এই নিন এই জলটা খান, অ্যাংজাইটি কমে যাবে। আপনি এখানে এসেছেন, আর কেউ জানে?
প্রদ্যুৎ: না। যে নাম্বার দিয়েছে সেও জানে না যে আজ আসব। কেন?
ডাক্তার: আপনি মশাই প্রচুর প্রশ্ন করেন। মনে শান্তি নেই না আপনার? সবকিছুতেই এত কৌতুহল ভালো না।
কথাটা শুনে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারকে দেখতে যাবেন, কিন্তু সব অন্ধকার।
(৪)
তিনদিন পর ময়দানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন সত্যজিৎ ও তাঁর ছোট্ট টিম। সামনে একটা লাশ পড়ে। মুখটা দেখার জো নেই। নৃশংসভাবে ছাড়িয়ে নিয়েছে মুখের চামড়া। কিন্তু সত্যজিতের নজর পাশের লেখাটার দিকে। লেখা আছে, "Witness" কমা দিয়ে "Amen". কিন্তু এই চেহারা সত্যজিৎ ভালো মতনই চেনেন! কারণ, তার সন্দেহ ঠিক। পরদিন প্রেসে গিয়ে খোঁজ নিতে গেলেন। কিন্তু খোঁজ না পেয়ে, বাড়িতে কন্টাক্ট করলেন। জানা গেল বাড়ি ফেরেননি। তারপর আজ সকালে এই দৃশ্য।
সত্যজিৎ: ফরেনসিক রিপোর্ট আসতে কদিন লাগবে?
ফটোগ্রাফার গার্ল: হয়ত তিন থেকে চার দিন.
সত্যজিৎ: নানা, আমার কালই চাই
বলেই গাড়িতে উঠে একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন প্রেসের দিকে। কিছুক্ষণ পর প্রেসের ম্যানেজার ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললেন,
-"প্রদ্যুৎ এর সঙ্গে লাস্ট কার কার কথা হয়েছিল? তারা একটু আমার ঘরে এসো।"
এর কিছুক্ষণ পর এসে মাধব বেয়ারা বলল, "পর্নাদির সঙ্গে কথা হয়েছিল প্রদ্যুৎদার। তারপর সেদিনই তো দিদি ছুটি নিতে এল স্যারের কাছে!"
ম্যানেজার বলে উঠলো,"হ্যাঁ ওকে তিন-চারদিনের ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্তু কাল থেকে ওকে ও ফোনে পাচ্ছি না। এখন আপনার কাছে যা শুনছি, ভয় লাগছে।"
সত্যজিৎ বলল,' ওর একটা ছবি দিন।"এবার কনস্টেবলকে উদ্দেশ্য করে বললেন," ফোন করে খোঁজ নাও যে এর নামে কোন মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে কিনা!"
- ওকে স্যার।
কনস্টেবল বেরিয়ে গেল। সত্যজিৎ ধীর পায়ে বের হয়ে এলেন। কেসটা জটিল হয়ে উঠছে। মেয়েটাও গায়েব! কিন্তু, লোকটা শেষবার কোথায় গিয়েছিল? এসব ভাবতে ভাবতে সত্যজিৎ চারুচন্দ্র লেন ধরে হাঁটা শুরু করলেন। অনেকক্ষণ হাঁটার পর সামনে চোখে পড়ল ক্লিনিকটা। উপরে সযত্নে লেখা 'গুড লাইফ ক্লিনিক'। এই তো! এখানেই আসছিল প্রদ্যুৎ! মনে পড়েছে।
প্রথমে না নক করে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। পাশে রাখা মেয়েদের জুতোটা তিনি খেয়াল করলেন না। তখনই একটা ফোন এলো। সেটা রিসিভ করলেন,
" হ্যাঁ স্যার, আমি তো এখন চারু লেনে, ওই ময়দানের মার্ডারটার জন্য।"
-"ওই কেসটা একটা জুনিয়ারকে দিচ্ছি। কাল থেকে তুমি শংকরপুরে কাজ করবে। ওখানে কয়েকটা পলিটিকাল মার্ডার হয়েছে, তার স্পেশাল টিমে তুমি আছো। আজ এসে জুনিয়ারকে ব্রিফ করে দাও। "
সন্ধ্যেতে ব্রিফিং দিয়ে বের হয়ে এলেন সত্যজিৎ। বন্দুকটা সঙ্গেই আছে। একটা ক্যাব ধরে গলিটার মুখে নামলেন। একটা হ্যালোজেন জ্বলছে। সেই আলো ওই বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছচ্ছে না। সত্যজিতের দৃঢ় বিশ্বাস, ওই বাড়িতে কিছু একটা আছে। খুব গভীর রহস্য। হয়তো ওই বাড়িতেই লুকিয়ে আছে সব ধাঁধার সমাধান! এমনকি মৃত্যুর সময় নিয়ে যে ধন্ধ তৈরি হয়েছে সেটাও কি এখানেই সমাধান হবে! জানা নেই যে!
গোটা বাড়িটা অন্ধকার। কেউ নেই। একটা জলের পাইপ ছিল, সেটা বেয়ে উঠে ঘরে গেলেন। অনেকক্ষণ খোঁজার পর, নিচের ঘরে স্টাডি টেবিল এর পাশে দাঁড়ালেন। সেটা যেন ছোটখাট একটা ল্যাব! কিন্তু একটা ছোট্ট ফাইলে চোখ আটকে গেল। তাতে বড় করে লেখা এক্সপেরিমেন্ট! না! ভুল জায়গায় আসেননি তিনি! পৃষ্ঠা উল্টাতেই কিছু ফটোগ্রাফ আর টাইপ করা লেখা!
"Unsuccessful! .... Semi Success! .... Success!"
Success এর পাশে লাস্ট মার্ডার হওয়া লোকটার ছবি।
ডাক্তার: গ্রিটিংস! .... না না! পিস্তলটা সাইডে রাখুন প্লিজ! ওটা ধরা যাবেনা না। হলে চিরদিনের মত ঘুম পাড়িয়ে দেবো। ভেরি গুড। তো, আপনি আমার খোঁজ পেলেন কিভাবে? আই মিন আমি তো কোন loose end রাখিনা!
সত্যজিৎ: ওটা তোমার ভাগ্য ডক্টর। তুমি এতটাও পাকা খেলোয়াড় নও।
ডাক্তার: আমি প্লেয়ার নই, সাইন্টিস্ট। বলতে পারো আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাইন্টিস্ট আন অফিশিয়ালি। অফিশিয়ালি তোমাদের ফরেনসিক ডক্টর। সিবিআই তো? না? ওকে ওকে, তারমানে চুনোপুঁটি। এক্ষুনি তো মরেই যাবে, তার চেয়ে কারনটা শুনেই মরো! তোমরা সারাক্ষণ যা অশান্তিতে থাকো, শান্তিতে মরার সৌভাগ্য তোমার হোক! একচুয়ালি, আমি এমন একটা সিরাম ইনভেন্ট করেছি, যেটা নরমাল টেম্পারেচার এ ডেড বডিকে সেম রাখবে। তাতে মার্ডারের টাইম কেউ জানতে পারবে না। এটার তো হিউম্যান ট্রায়াল' এর দরকার ছিল, তাই এই মেন্টাল হেলথ ক্লিনিক খুলে বসতে হলো। বছরে দুটো পেশেন্ট তো দরকার, তাই একেই কাজে লাগাতে হলো।
পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটা মেয়ে। সত্যজিৎ তাকে দেখে অস্ফুটে বলে উঠলেন, "পর্ণা!"
কথাটা বলে মেয়েটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাতেই সত্যজিৎ এক লাফে নিজের বন্দুক তুলে নিয়ে ডাক্তারের দিকে নিশানা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের বন্দুকও গর্জে উঠলো। গর্জে উঠলো সত্যজিতেরও বন্দুক। বীভৎস এক আওয়াজ।
পর্ণা দেখল দুটো লাশ মরার আগের অবস্থায় ছটফট করছে। কিন্তু ওর যে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। ফর্মুলাটা পাঠাতে হবে মেইল করে। সেটার জন্য অপেক্ষা করছে কত অজানা ক্লায়েন্ট। মরলে চলবে না, ধরা পড়াও চলবে না। তাকে তার ডাক্তারের জন্য বাঁচতে হবে। পুলিশ সব দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। পর্ণা ফাইলগুলো নিয়ে মিলিয়ে গেল একটা অজানা সুড়ঙ্গের অন্ধকারে।
(৫)
দরজা ভেঙ্গে পুলিশ ঢুকলো। সব জায়গায় আগুন লেগেছে। সব কনস্টেবলের সঙ্গে ঢুকলো চন্দ্রানী। সব দেখে দ্রুত নির্দেশ দিলো দমকল ডাকার। বাকিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু হঠাৎ দূর থেকে শুনতে পেল একটা গোঙানির আওয়াজ। ঘরের একদম কোনায় দেখতে পেল সত্যজিৎকে।
চন্দ্রানী হুঙ্কার দিয়ে বলল," Hurry up! Sir কে বাঁচাতে হবে।"
আগুন বেশি লাগেনি তাই অল্পক্ষণের চেষ্টায় সত্যজিৎকে বের করে আনা হলো। কিন্তু তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, "পর্ণা .... পর্ণা, ও- ওকে ধরো..." বলেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। চন্দ্রানী নির্দেশ দিল, "চারপাশটা সার্চ করো।সন্দেহজনক যাকে দেখবে তাকে অ্যারেস্ট করবে। আর কেউ একজন অ্যাম্বুলেন্সকে ডাকো" তারপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সত্যজিৎকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। চন্দ্রানীর নেতৃত্বে একটা ইনভেস্টিগেশন টিম গোটা বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে এখন। কারোর মনে কোন সন্দেহ নেই যে এটাই সেই চার লেনের খুনির ডেরা। কিন্তু সবকিছু ধোঁয়াশার মতন ঘুরছে চারপাশে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পাওয়া ব্রিফিংয়ের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। তবে কি সত্যজিৎ স্যার তথ্য লুকিয়ে ছিলেন! সৌভাগ্যবশত, এই লেনের থেকে কিছু দূরেই পুলিশ ভ্যান টহল দিচ্ছিল। তারা গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে আসে, আর খবর দেয় থানায়। চন্দ্রানী তখন ওই থানায় বসে ছিল তদন্তের ডিটেলস নিতে। চারু লেনের নাম শুনেই সে-ই নির্দেশ দেয় ফোর্স নিয়ে যাওয়ার। কারণ সত্যজিৎ স্যার কথা শেষ করেছিল এটা বলে যে, "আমি সন্ধ্যেতে ওই ক্লিনিক টায় যাব কয়েকটা ডাউটস আছে।" তারপর গলাটা একটু আস্তে করে বলেছিলেন, "তুমি বসকে বোলো না এসব নিয়ে। কিছু ইন্টারেস্টিং জানতে পারলে তোমায় জানিয়ে দেবো।"
তারপর এই অবস্থায এখন। খবরের চ্যানেলগুলোতে বড় করে খবরের রিপোর্টিং করা হচ্ছে। সকলের একটাই বক্তব্য, "সব জেনেও সিরিয়াল কিলিং এর খবর চেপে রাখলো পুলিশ। শহরবাসীর কি কোনো নিরাপত্তা নেই! সে উত্তর দেবে প্রশাসন।"
খবরের চ্যানেলটা বন্ধ করে দিয়ে চন্দ্রানী আপন মনেই ভাবতে ভাবতে বলল, "কেউ নেই পিছুটান নেই তাই কি এতটা ঝুঁকি নিতে গেলেন স্যার? নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য!" এরপর অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার কি মনে হয় ডক্টর আর কে ঘোষ এর সঙ্গে স্যারের কোন কানেকশন ছিল?" অনুপম একটু অবাক হয়ে বলে, "সেটা কে?" তারপর একটু ভেবে বলল, "ও আচ্ছা গুড লাইফ ক্লিনিক। লোকটা তো শুনেছি ফার্স্টে লালবাজার আর পরে সিবিআইতে কাজ করতো। কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়ে একেবারে বেপাত্তা! তারপর একেবারে এই সব মার্ডারের মাস্টারমাইন্ড।"
-"না এখনো শিওর না" বলে উঠল চন্দ্রানি।
- "সব ডকুমেন্টসগুলো একবার খুঁটিয়ে দেখতে হবে। মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি স্যারের জ্ঞান ফিরলে জেরা করতে হবে।"
-"তুমি কি ওনাকে সন্দেহ করছো? উনি প্রায় ন' বছর হল এই ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যুক্ত!" অনুপমের কথা শুনে চন্দ্রানী বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে, "তাতে কোন পাপ ধুয়ে যায় না অনুপম। উনি দোষী কিনা জানিনা, তবে এটা জানি যে একটা লার্জ টার টার্গেট এর পিছনে উনি একা গিয়েছিলেন। তার জন্য একটা ক্রিমিনাল মারা গেল। আর তারপর তো .... এই হ্যাঁ, পর্না কে?" "আমিতো জানি না। তুমি বলার পর অনেকেই খুঁজলো ডেটাবেসে। কিন্তু আমাদের ক্রিমিনাল রেকর্ডে এরকম কেউই নেই।" "কিন্তু স্যার সব জানে আমার বিশ্বাস স্যার মিথ্যে বলছে।" তারপর চন্দ্রানী আপন মনেই বলে উঠলো, "সত্যজিৎ তুমি মিথ্যাকে জয় করছ কেন তুমিই কি সত্যান্বেষীর বেশে ভন্ড কেউ?" অনুপম অবাক হয়ে বসে রইল। এখন তার মাথাও কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে মনে হয়।
তিন দিন পর জ্ঞান ফিরলো সত্যজিতের। কিন্তু খবর একদম ভালো না, অন্তত অনুপমের তাই মনে হল। কারণ সত্যজিতের গলায় এমন এক জায়গায় গুলি লেগেছে, যেখান থেকে সার্জারি করে গুলি বের করতে গেলে কথা হারানোর চান্স ছিল ৯৯%। দুর্ভাগ্যবশত সেটাই হয়েছে।
"এছাড়া ওনাকে বাঁচানো যেত না" বলে উঠলো ডাক্তার। চন্দ্রানী চেঁচিয়ে বলে, " হোয়াট রাবিশ!!! আপনারা কোনরকম ইনফর্ম না করেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?" এবার ডাক্তার শান্ত স্বরে বলল, "ম্যাডাম প্লিজ একটু আস্তে কথা বলুন। হসপিটালে এত জোরে কথা বলা যায় না। আর এটা নিয়ে আমরা আপনাদেরকে জানিয়েছিলাম। হয়ত আপনি কোনভাবে মিস করে গেছেন।" বলে ডাক্তার চলে যেতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চন্দ্রানী।
(৬)
এদিকে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। তাই কোন রহস্যের জট ছাড়াতে না পারার ব্যর্থতা বেশ চেপে ধরছে চন্দ্রানীকে। হয়তো তাকে নিয়ে সকলে ব্যঙ্গই করছে। এই মুহূর্তে নিজেকে অপয়া ও অপদার্থ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। তবে ধৈর্যের অবসান ঘটলো এক সপ্তাহ পরে।
আজ জেনারেল বেডে শুয়ে থাকা সত্যজিৎ স্যারকে দেখে ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অনুপম চন্দ্রানীদের মনের চামড়া বেশ শক্ত রাখতে হয়। পাশাপাশি আজকের কাজটাও বেশ কঠিন। চন্দ্রানী সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আজ জেরা করবে সত্যজিৎকে। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ অথবা না তে দেওয়া যাবে। এছাড়া লিখে বলার মতন কিছু হলে রাইটিং প্যাড এর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ডাক্তারও দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল। চন্দ্রানী সবে প্রশ্ন করতে যাবে, সত্যজিত হাতের ইশারায় ট্যাবটা চেয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পরে ফেরত দিলেন তাতে যা লেখা আছে তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, "আমি দোষী নয়। আমি একটু বেশি কৌতুহলী হয়ে পড়েছিলাম। তাই মরে না গেলেও শান্ত হয়ে গেছি।" চন্দ্রানী সত্যজিৎ এর দিকে তাকাতেই তাঁর বিমর্ষ চোখটা দেখতে পেল। কিন্তু চন্দ্রানির মনে কি চলছে সেটা অনুপম বুঝলো না।
চন্দ্রানী : আপনি ডক্টর আর.কে ঘোষ কে চিনতেন?
সত্যজিৎ ইশারায় ঘাড় নাড়ায়।
চন্দ্রানী : না? আচ্ছা। ওই ক্লিনিকের ডক্টর, যে আপনার গুলিতে মারা গেছে….. প্রদ্যুৎ বাবুর মার্ডার কেসের দায়িত্বে আপনি ছিলেন। রাইট?
সত্যজিৎ এবার ইতিবাচকভাবে ঘাড় নাড়ায়।
চন্দ্রানী : আমায় ব্রিফিং দেওয়ার সময় সব ইনফরমেশন আমায় দিয়েছিলেন?
-না!
তাহলে ডাক্তারের বাড়ি কেন গিয়েছিলেন? ওনাকে ট্যাবটা দাও।
চন্দ্রানির এক একটা প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবেই দিলেন। এবার শেষ প্রশ্ন।
চন্দ্রানী : এরকম টাইপের সিরাম! কিন্তু পর্না কে?....
শুনে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন সত্যজিৎ সান্যাল। তারপর ট্যাবে যা লিখলেন সেটাও অনুপম পড়ে শোনালো।
"ওই মেয়েটিই ওই রাতে ডাক্তারের সঙ্গে ছিল। তারপর ঘরে আগুন লাগার পর তিন-চারটে ফাইল নিয়ে পালায়। বেঁচে যাবো ভাবিনি। তারপর তোমরা এলে, তখন হিন্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তোমরা বোঝনি, ওকে খুঁজে বের করো না হলে কি হয়ে যাবে ঈশ্বর জানেন...."
লেখাটা পড়ে অনুপম চন্দ্রানির দিকে লক্ষ্য করল। তার মুখের কঠিন ভাবটা কেটে গেছে। চন্দ্রানির কর্মদক্ষতা নিয়ে তার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কেসটার শুরু থেকেই তার মধ্যে যে এগ্রেশনটা ছিল, তা আজ যেন স্তিমিত হয়েছে।
"থ্যাঙ্ক ইউ" বলে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল চন্দ্রানী।
সেই দিন সন্ধ্যেতেই একটা পুলিশের জিপ এগিয়ে চলল সেই চারুলেনের দিকে। চারজন কনস্টেবল গাড়ি থেকে নামতেই চন্দ্রানী নির্দেশ দিল, "উপর থেকে নীচ, প্রত্যেকটা ঘর, ছাদ, উঠোন, বাগান, বাড়ির পিছন, সবকিছু তল্লাশি করবে। তোমরা উপরটা দেখো, আমি আর অনুপম আপাতত নীচটা দেখছি।" কথা শেষ হতেই সবাই কাজে লেগে পড়লো। কিছুক্ষণ পর অনুপম প্রশ্ন করল,
-"আমরা কি খুঁজছি এখানে?
চন্দ্রানি অন্যমনস্ক ভাবে বলল,' ফার্স্ট লিড…. এখনো আমরা কিছু পাইনি যেটা দিয়ে ডক্টরের কোনো আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশনের লিংক পাওয়া যায়।
অনুপম : ধুস! আন্ডারওয়ার্ল্ডের ব্যাপারটা ঢপ লাগছে। আর ওই সিরাম, ওটা আদৌ সম্ভব!
চন্দ্রানী : ফরেনসিক রিপোর্ট এত মিথ্যে বলে না। তবে কি জানো অনুপম, ডাক্তার খুব চালাক লোক। ওই ল্যাবে ঠিক যা যা ডকুমেন্ট ছিল, তার কথাই সে স্যারকে বলে গেছে। এর বেশি কিছু বলেনি। অর্থাৎ....
অনুপম : অর্থাৎ কি?
চন্দ্রানী : অর্থাৎ এর পিছনে কোন বড় কারোর মাথা আছে, যে এই এক্সপেরিমেন্টাল মার্ডারগুলো করিয়েছে।
অনুপম : এক মিনিট, এক মিনিট। ইউ মিন মাস্টারমাইন্ড!.... হ্যাঁ, এভাবে তো ভেবে দেখিনি। ডাক্তার ওই সিরাম বানিয়ে কি করবে, যদি না বেচতেই পারে! কেউ তো ফান্ড দিত।
চন্দ্রানী : সেটাই এখন প্রশ্ন।
বলতে বলতে হোঁচট খেলো একটা জায়গায়। নিজেকে কোন রকমে সামলে নিল চন্দ্রানী। টর্চ মেরে দেখে বাঁকা হাসি হাসলো। তারপর বলল, "বডি টেনে আনার দাগ না? এটা মনে হচ্ছে কোন সুরঙ্গ। ঢাকনাটা খোলো লিডটা পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে।"
সকাল সকাল চা খেয়ে পুজো দিচ্ছিলেন প্রেসের ম্যানেজার সমীরণ বসাক। প্রণাম সেরে পিছনের তাকাতেই চন্দ্রানী বলল, "নমস্কার, ইন্সপেক্টর চন্দ্রানী সেন, লালবাজার। সকাল সকাল একটু বিরক্ত করতে এলাম।"
সমীরণ : হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। কিন্তু আমি তো যা বলার সব পুলিশকে বলে দিয়েছিলাম।
চন্দ্রানী : না, আমায় পর্ণার ঠিকানাটা দিন।
সমীরণ : পর্ণা! ওকে পাওয়া যায়নি? প্রদ্যুত চলে যাওয়ার পর ওর তো কোনো খবরই নেই।
চন্দ্রানী : নেই বলেই তো খোঁজ লাগাচ্ছি। She is a prime suspect of the whole scenario.
সমীরণ : তাহলে ডক্টর!
চন্দ্রানী : সময় হলে সব জানতে পারবেন। আর এই পর্নার ব্যাপারটা কাউকে জানাবেন না। দিন, ওর ডিটেলসগুলো দিন।
সমীরণ : হ্যাঁ দিচ্ছি। কিন্তু যদি ক্রিমিনাল হয় তাহলে এগুলো ফেক হতে পারে। তার জন্য প্রেসের কোন দায় নেই কিন্তু।
রাস্তায় বের হয়ে চন্দ্রানি নির্দেশ দিল, "স্যারের কথা অনুযায়ী ও আরো কোম্পানিতে কাজ করতো। সেগুলোর খোঁজ নাও আর এই ঠিকানাটা ভেরিফাই করো।"
- আচ্ছা
(৭)
কিন্তু শহরের অন্য এক প্রান্তে কিছু একটা ঘটছে। খবরে চোখ রাখলে দেখা যায় সেই খুনের ঘটনাগুলো। ওই অঞ্চলের পুলিশের মতে সবই পলিটিক্যাল মার্ডার। কিন্তু মৃত লোকগুলির কোন পলিটিক্যাল কানেকশন নেই বললেই চলে। সবাই ছোট বড় ব্যবসা করে। সকলের মৃতদেহ ঘরের মধ্যেই পড়ে থাকে। গলায় দড়ির দাগ, বুকে ভোজালির দাগ। আর গোটা ঘর জুড়ে জিনিসপত্র এলোমেলো করা। কেউ যেন কিছু খুঁজছে। কি খুঁজছে? সেই প্রশ্ন সকলের মনে জ্বললেও, আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়ে না। কোনো অজানা অস্ত্র সমাজের শিরদাঁড়াকে চুপ করিয়ে রেখেছে। এমন শান্ত সকালে চন্দ্রানির টেবিলে একটা বাজ পড়লো। অনুপম উত্তেজিত হয়ে এসে বলল,
-পর্ণার বাড়ি পেয়ে গেছি।
চন্দ্রানী : এত ফাস্ট?
অনুপম : প্রেসের ঠিকানাই ওর রিয়েল এড্রেস। গিয়ে ভেরিফাই করে এসেছি। বাট .... বাট এরপর যা বলবো শুনলে মাথা ঘুরে যাবে।
চন্দ্রানী : কি?
অনুপম : পর্ণার প্রথম এমপ্লয়মেন্ট ওই প্রেসেই। এর আগে কোন কোম্পানিতে কাজই করেনি। স্টুডেন্ট ছিল আর একটু খারাপ দিকে চলে গেছিল।
চন্দ্রানী : খারাপ বলতে?
অনুপম : সেই ড্রাগ racket টা মনে আছে? সিগারেটের প্যাকেটে স্টুডেন্টদের মধ্যে ড্রাগ বিলি হতো, ওটার জন্য ধরা পড়েছিল।
চন্দ্রানী : ড্রাগ নেওয়া! নাকি distribution?
অনুপম : Distribution. কিন্তু কোন প্রপার এভিডেন্স ছিল না বলে তিন মাসের জেল খাটিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর চাকরির খোঁজ লাগাতে শুরু করে।
চন্দ্রানী : এটা কত বছর আগে হয়েছে?
অনুপম : এই ধরো চার পাঁচ বছর।
চন্দ্রানী : কিন্তু এইখানে তো গত বছরের ডেট লেখা আছে। এসবের মানে কি?
অনুপম : সেটা নিয়ে খবর নিতে হবে। .... হাসছো যে! আগে প্রমাণ গুলো জোগাড় হোক, তারপর তো অপরাধী এমনিই হাতের মুঠোতে চলে আসবে।
চন্দ্রানী : হ্যাঁ। আবছা সুতোর রং গুলো স্পষ্ট হচ্ছে। নাটকের শেষ অংক আসতে কিছুটা দেরি। তবে অন্তিম পদ আসন্ন। খুব তাড়াতাড়ি তাকে পেয়ে যাব।
অনুপম : হ্যাঁ, পেতে তো হবেই।
বলে তাকিয়ে রইল চন্দ্রানির দিকে। কিন্তু চন্দ্রানির চোখ তখন কাছের দেয়াল পেরিয়ে একটা ভিড়ের দিকে। ডিপার্টমেন্টের বাকি লোকরা দাঁড়িয়ে। একজন তার দিকে তাকাতেই চন্দ্রানির ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি খেলে গেল।
সিনিয়র ইন্সপেক্টর বিরুপাক্ষ বেশ সাহসী লোক বলেই পরিচিত। সেই ভিড়ের মধ্যমণিও বটে। তার বক্তব্য একটাই, "এটা একটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। অপরাধী ধরা পড়ে গেছে। এরপর আবার কিসের তদন্ত করছে? এদিকে অন্য কতগুলো কেস যে জমে আছে সেটা কেউ দেখছে না। এটা কোন ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট, নাকি মজা করার জায়গা? সেই কেসগুলোর ইনভেস্টিগেশন না শুরু করলে উপমহল থেকে চাপটা পড়বে আমাদের উপরেই। সেটায় কি কারুর কোন ভ্রুক্ষেপ আছে?"
ততক্ষণে গুঞ্জনটা থেমে গেছে।
চন্দ্রানী : তো তাতে আপনার সমস্যাটা কি হচ্ছে? নাকি আমার তদন্তে বাধা দিলে আপনার কোন লাভ আছে!
বিরুপাক্ষ : বসের কাছের লোক বলে সত্যজিৎ দার থেকে কেসটা পেয়ে গেলে। জীবনে আর বড় কেস পাবে না, তাই এটা নিয়েই রবারের মতন টেনে যাচ্ছ।
চন্দ্রানী : সেটা তো সময় বলবে। তবে আপনার কোন প্রবলেম হলে সেটা লিগালি ফাইট করার চেষ্টা করুন। এভাবে লোকজনকে উসকে কোন লাভ হবে না।
বিরুপাক্ষ : আমি কি করবো সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। যা ইচ্ছা কর। আশা করব ডিপার্টমেন্টের সময় ফালতু নষ্ট করছ না।
চন্দ্রানী : সেটাও সময় বলবে। জানি, আপনাকে কেসটা দেওয়া হয়নি বলে রেগে আছেন। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখি সত্যজিৎ স্যার কিন্তু আমাকেই বেছেছিলেন। বাকিটা আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে বুঝে নিন।
বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল চন্দ্রানী।
গাড়ি তখন শিয়ালদহ ব্রিজের উপরে চন্দ্রানী বলল,
-অনুপম খেলা জমে উঠেছে।
অনুপম : সব তো বুঝলাম, কিন্তু লোকাল থানার সাথে কাজ করে কি কোন লাভ হচ্ছে? ডিপার্টমেন্টকে অন্ধকারে রেখে কাজ করলে এরকম প্রবলেম হবেই।
চন্দ্রানী : করতে হচ্ছে। বুঝছো না? আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়া। সর্ষের মধ্যে ভূত তো আছেই! আমার কিছু প্রমাণ দরকার। না হলে চার্জশিট তো দূরের কথা, এরেস্ট ওয়ারেন্টও ইস্যু করাতে পারবো না।
বলতে বলতে গাড়ি এসে থামলো একটা দোতলা বাড়ির সামনে। পর্ণার বাড়ি। ওরা দুজন বাড়িতে ঢুকতেই এক মহিলা রে রে করে তেড়ে উঠে এগিয়ে এসে বললেন, "আপনারা এখানে কেন এসেছেন? আপনাদের জন্য ওরা এসে শাসিয়ে গেল। এদিকে মেয়েটার কোন পাত্তা নেই। ওকে খুঁজুন, তারপর বাকি কথা।" চন্দ্রানী বলল, "কে এসেছিল? আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছি। তবে একটাই রিকোয়েস্ট, পর্ণার ঘরটা একটু দেখতে চাই।"
কিছুক্ষণ পর হাজার চিৎকার ও কান্নাকাটির মধ্যে থেকে দুজন বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল। ফোনের ছবি দেখে জায়গার নাম উল্লেখ করে গাড়ি ঘোরানোর নির্দেশ দিল অনুপম। সন্ধে নামছে। কিন্তু, তদন্তের ভবিষ্যৎ এই শহুরে আলোর মতন উজ্জ্বল, নাকি চারুলেনের মতন ভয়ংকর অন্ধকার। সেটা অনুপম জানেনা। কিন্তু ভ্রুকুটিহীন নিশ্চিত চন্দ্রানির দৃষ্টি অন্য কথা বলছে।
(৮)
সকাল সকাল বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন সমীরণ বসাক। হঠাৎ চমকে উঠলেন।
সমীরণ : নমস্কার! এত সকালে? আমার এড্রেস কোথায় পেলেন? ও হ্যাঁ, থানায় তো সব দেওয়া আছে।
চন্দ্রানী : হুম, ঠিক ধরেছেন এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম meet করে যাই।
সমীরণ : সে ভালো করেছেন। কিন্তু পর্ণার কোনো খবর?
চন্দ্রানী : না। তবে একটা এরিয়া আন্দাজ করা গেছে। বাট কোন কনফার্ম খবর নেই। সে খবর সময় মতন পেয়ে যাবেন। তবে একটা কৌতুহল ছিল বলেই এলাম। আপনার বাড়ি থেকে প্রেসটা কাছেই। পর্ণা, প্রদ্যুৎ আপনার অফিসের লোক।উমম....
সমীরণ : আমার সন্দেহ করছেন নাকি?
চন্দ্রানী : না। কিসের সন্দেহ! আপনি কত বছর জয়েন করেছেন প্রেসে?
সমীরণ : প্রায় ১৫ বছর। কিন্তু আমি পর্ণার সঙ্গে কোনো ভাবেই যুক্ত নই।
চন্দ্রানী : সেটা আমি বলিনি। এটুকুই জানার ছিল। Thank you.
সমীরণ : ম্যাডাম .... আমার প্রাণের কোন ভয় নেই তো?
চন্দ্রানী : না, সে নিয়ে ভাববেন না। শুধু সতর্ক থাকবেন। কোন সন্দেহজনক কিছু দেখলে আমায় জানাবেন।
এরপর এক সপ্তাহ পুরোপুরি চুপচাপ। কোন বিশেষ কিছু ঘটল না। মাঝেমধ্যে একটা দুটো ফোন করছে, আবার কোথায় যেন বের হয়ে যাচ্ছে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলছে,
"সুতোগুলো জুড়ে একটা সাদা পর্দা বানানো হয়ে গেছে, এবার পাখি নিজেই নিজের শিকার করবে। .... ও হ্যাঁ, একটা খবর রিপোর্ট করে এসো। ইন্সপেক্টর চন্দ্রানী রায়ের বাড়িতে এই কেস রিলেটেড ডকুমেন্ট আর কয়েকটা নীল ফাইল চুরি গেছে।"
অনুপম : আচ্ছা .... কিন্তু....
চন্দ্রানী : একটু জোরে বোলো, আজ সবাই আছে, সুবিধা হবে। আর সাসপেক্ট হয়ত কোন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মেয়ে।
অনুপম গিয়ে দেখল বিরুপাক্ষ স্যার বসে আছে।
বিরুপাক্ষ : ফোন চুরি গেছে, ইমিডিয়েটলি খুঁজে বের করতে হবে। ডালহৌসি বাসস্ট্যান্ডেই চুরি হয়েছে। এ কি তুমি? কি খবর! তোমার কি চুরি গেল?
অনুপম : আমার নয় চন্দ্রাণী ম্যাডামের বাড়িতে কেস রিলেটেড কিছু ডকুমেন্ট মিসিং। সেটারই কমপ্লেন লিখব। সাসপেক্ট নাকি একটা মেয়ে!
বিরুপাক্ষ : I see...
এরপর গোটা ডিপার্টমেন্টে খবরটা আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ঝামেলা বাড়াল পরদিনের খবরের কাগজ। ছোট করে হলেও একটা নিউজ ছাপা হয়েছে এই নিয়ে। এত খবর থাকতে এই খবর ঠিক ছেপে গেল, তাও আবার চন্দ্রানির নাম সহ। অবশ্য সেটা হয়েছে চন্দ্রানীর পরিবারের লোকদের জন্যই। পাড়ায় চুরির খবর পেলে সকলেই হইহল্লা করে এই শহর কলকাতায়। লোকাল থানায় ফরমালিটি মেনে কেস করা হয়েছে, যার দরুন একটা নিউজ পেপারে খবর ছাপিয়ে দিয়েছে। এসব দেখে অনুপম প্রমাদ গুনল। একেই কেস ডকুমেন্ট বাড়িতে রাখার নিয়ম নেই, তার উপর ডিপার্টমেন্টের সবাই ক্ষেপে আছে। এবার চন্দ্রানির চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়তে বাধ্য। ওই তো হেডের ঘরে গেছিল চন্দ্রানি, নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছে। ঘরে ঢুকতে চন্দ্রানী বলল, "জাল গোটানোর সময় এসেছে। এই কল রেকর্ড গুলো ব্যাক ট্রেস করানোর ব্যবস্থা কর। .... চিন্তা নেই,আমার চাকরি যাবে না।"
অনুপম : কার কল রেকর্ড?
মৃদু হেসে বলল, "দেখো শক খেয়ো না। অনেক কষ্টে প্রচুর লোক লাগিয়ে এই একটা খবর জানতে পেরেছি। এটা না জানলে কেসটাতে এগোতে পারতাম না।"
অনুপম কেবিন থেকে বের হয়ে নিচে যাচ্ছিল। যেতে যেতে লক্ষ্য করল বিরুপক্ষকে। সে গম্ভীরভাবে হেডের ঘরে ঢুকছে। চন্দ্রানীকে নিয়ে কোন স্টেপ নেওয়া হয়নি দেখে রেগে গেছে সম্ভবত। অবশ্য সেটা জানার কথা নয়। নাকি .... ভাবতে পারল না সে কারণ ফোনটা বেজে উঠেছে। ফোন রিসিভ করতেই,
সমীরণ : চন্দ্রানী ম্যাডামকে ফোনে পেলাম না। তাই আপনাকে কল করলাম। কাল রাতে পর্ণা এসে আমায় শাসিয়ে গেছে। Please help me!
অনুপম : okay okay! উত্তেজিত হবেন না আমি লোকাল থানাতে কল করে সব ব্যবস্থা করছি।
এ ঠিক ৩৬ ঘণ্টা পরে একটা বস্তি সংলগ্ন এলাকায় হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে গেল। রাত এগারটা বাজে। সেই নাম না জানা বস্তির মধ্যেই কোন এক গলিতে নিস্তব্ধতার ভিড়। অস্তমিত সূর্যের মতন একটা টিমটিমে আলো। সেই আলো-আঁধারিতে একটা মেয়েকে দেখা যায়। সর্বাঙ্গ কালো পোশাকে ঢাকা। খুব সন্তর্পনে হেঁটে চলেছে। একটা দোকানের পিছনে দাঁড়ালো। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। ওই তো সে! ফোনের এসএমএস-এ টাইপ করলো, "আমি ফাইল এনেছি। আমার টাকার সুটকেস রেডি তো?" এসএমএসের উত্তর এলো, "হ্যাঁ তৈরি। হাফ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি কই?
এরপর মেয়েটি ফোনের ফ্ল্যাশ চালিয়ে সিগন্যাল দিল। সিগন্যাল দিতেই একটা ছায়া মানব বের হয়ে এলো। তার হাতে ব্যাগটা তুলে দিল মেয়েটি। কিন্তু মেয়েটি কোন সুটকেস পেল না। তার কপালে বন্দুক ঠেকানো লোকটা পরিচিত কন্ঠে বলে উঠলো, "স্যার ঠিকই বলেছিল, তোর কচ্ছপের প্রাণ। সেদিন পেটে গুলি খেয়ে পড়ে রইলি, তারপর ম্যানহোলে ফেলে দিলাম। তারপরও বেঁচে গেলি কীভাবে!"
কোন উত্তর এলো না। "তোর মনের জোর আছে বলতে হবে। কিন্তু আজ পালাতে পারবি না। কবর খুঁড়ে রেখে এসেছি।" বলে কপালে ঠেকানো বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে, এমন সময় একটা পরিচিত শব্দে চমকে উঠলো। চারপাশে চোখ মেলে দেখল অনেকগুলো বন্দুকের নল তার দিকেই তাগ করা রয়েছে। ভয়ে শিউরে উঠল বিরুপাক্ষ। কারণ সামনের মহিলার মুখের কালো চাদর সরে গেছে। তার ডিপার্টমেন্টের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চন্দ্রানী দাঁড়িয়ে রয়েছে।
(৯)
চন্দ্রানী : নমস্কার একটা happy news দিতে এলাম।
সমীরণ : Good morning, কি নিউজ?
চন্দ্রানী : বসুন সব বলছি। একচুয়ালি চারু লেনের খুনের পিছনে একটা বিশাল বড় gang কাজ করছিল।
সমীরণ : Gang? কেন? মানে এই কটা খুনের পিছনে একটা gang?
চন্দ্রানী : ইয়েস, কিন্তু প্রবলেমটা কি জানেন তো? ওই gang এর যাকে অ্যারেস্ট করেছি, সে বারবার আপনার নাম করছে।
সমীরণ ঢোঁক গিলে বলল, "কি বলছেন কি? এর মধ্যে আমার নাম কেন আসবে!"
চন্দ্রানী : আসবে! আসবে! কিভাবে এলো বলি, কিছু ভুল হয়ে গেলে শুধরে দেবেন। ডক্টর আর.কে. ঘোষ, সিবিআই থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল ভুলভাল কিছু এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। সে খবর আপনার প্রেসেই ছাপা হলো। যথারীতি আপনার নজরে পড়ল সেটা। আপনি কন্টাক্ট করলেন। প্রথম দেখাতেই সে বলল, সে এমন একটা সিরাম বানাতে চায় যেটা মার্ডারের পর ইনজেক্ট করলে মার্ডারের সময়টা জানাই যাবে না। এরপর সম্পূর্ণ কথা শুনে আপনি ভাবলেন, এ বদ্ধ পাগল। আর সে যদিও বা বানাতে পারে, সেটাও অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে আপনার মাথায় একটা দারুন প্ল্যান খেলে গেল। বেশ কয়েকবার কথা বলে আপনি ফাইনালি কনভিন্স করলেন যে, serum বানানোর জন্য সব ফান্ডিং আপনি দেবেন এবং তাতে যতদিন সময় লাগে লাগুক। Problem নেই। তবে নেক্সট এক বছরের মধ্যে একটা টেস্ট স্যাম্পেল তৈরি করতে হবে, যেটা নিয়ে আপনি আপনার কার্যসিদ্ধি করবেন।
সমীরণ : গল্পটা বেশ ভালো ফেঁদেছেন দেখছি! কিন্তু এসব ধোপে টিকবে না।
চন্দ্রানী : টিকবে টিকবে, দাঁড়ান বলতে দিন। আর বেশি বাকি নেই। এবার প্রবলেমটা হয়ে গেল অন্য জায়গায়। আপনি যাকে পাগল সায়েন্টিস্ট ভাবছিলেন, সে নিজের মতন কাজ করে চলল। হঠাৎ করে একটা মার্ডারের খবর পেলেন। ততদিনে পুলিশ মহলে আপনি বন্ধুও জুটিয়ে ফেলেছেন। তাদের থেকে শুনে আপনি বুঝলেন যে কিছু একটা গন্ডগোল চলছে। তাই পর্ণাকে কাজে লাগালেন। তাকে বানাতে চাইলেন ডাক্তারের সহকারী, যে কিনা আপনাকে এনে দেবে ডাক্তারের গোপন তথ্য। কিন্তু বাধ সাধলো সেই ডাক্তার। যে একটা মিথ্যের জাল বুনে আপনাকেও ভুল বোঝাচ্ছিল। Maybe সে আপনাকে বলেছিল পর্ণা তার লোক। তার নির্দেশেই পর্ণা আপনার কোম্পানিতে জয়েন করেছে। অবশ্য এটা সম্পূর্ণ আমার আন্দাজ।
সমীরণ : আপনি তো আন্দাজ করে একটা গল্প বানিয়ে ফেলেছেন দেখছি।
চন্দ্রানী : কোনোটা যে মিথ্যে নয়, সেটা আপনার কম্পমান গলা থেকেই বোঝা যাচ্ছে মিস্টার বসাক! আর ওই সোফার নিচের বন্দুকটা ভুলেও ধরার চেষ্টা করবেন না, বাইরে armed guard রয়েছে।
সমীরণ : এভাবে আমায় ফাঁসাতে পারেন না আপনি।
চন্দ্রানী : আপনি ফেঁসে গেছেন মিস্টার বসাক! বাকিটা শুনবেন না?
সমীরণ : না শুনতে চাই না।
চন্দ্রানী : এরপর আপনার সঙ্গে ডাক্তারের গন্ডগোল শুরু হলো। কিন্তু ডাক্তার জানতো না আপনি ঠিক কে? আপনি যে কলকাতায় আফিম পাচারের অন্যতম মাথা ছিলেন এক দশক আগে, সেটা সে জানতো না। কে জানতো জানেন? আপনার পেট ডগ বিরুপাক্ষ। সে জেরায় সব স্বীকার করেছে। আপনার downfall এর সময় থেকে শুরু করে আজকের সব ঘটনা স্বীকার করেছে। সেই জন্যই তো ওইরকম এক অদ্ভুত 'মৃত্যু সময়হীন serum' এর গুজব ছড়িয়ে মার্কেটে আসতে চেয়েছিলেন। কী, ভুল বললাম?
সমীরণ চুপ করে বসে থাকে।
চন্দ্রানী : আপনি ঠিক দুটো জায়গায় ভুল করেছিলেন। প্রথম ভুলটা অবশ্যই অনুপমকে কল করে পর্ণার হুমকির কথা বলা। কি panicked হয়ে গিয়েছিলেন নাকি? এবং দ্বিতীয় ভুলটা পর্ণার ডকুমেন্টগুলো জাল করা। অন্তত একটু খোঁজখবর নিয়ে জাল করলে ধরা পড়তেন না। এবং থ্যাংকস টু পর্ণা। ও নিজে আমার জন্য রেখে গিয়েছিল ওর ফোন আর এই মহামূল্য ফর্মুলার ফাইলটা। ডাক্তারের বাড়ির নিচে একটা বেসমেন্ট আছে জানতেন না, না?
এখনো চুপ করে বসে আছে সমীরণ। হাত দুটো মুখের কাছে ধরে বসে আছে। চন্দ্রানি বলে চললো, "ফোনের সমস্ত চ্যাট এবং কিছু নোটস আপনার বিরুদ্ধে যাবে তাই আপনি সারেন্ডার করুন।"
একজন কনস্টেবল তার থেকে এগিয়ে গেল। তার গায়ে হাত দিতেই টের পেল সমীরণের দেহ নিথর হয়ে গেছে। চন্দ্রানি ছুটে গেল। অনুপম সব দেখে শুনে বলল, "আংটির মধ্যে এই pouch এ বিষ ছিল। সুইসাইড করেছে। হয়তো আরো অনেক ইনফরমেশন জানতো। হয়তো ওই যে বিজনেসম্যান গুলো মার্ডার হচ্ছিল, ওদের কেসটা এ সলভ করতে পারত।"
চন্দ্রানী : ওটা ওর rival gang এর কাজ। ওই নীল ফাইল গুলোকে সরাতে হবে। Otherwise আরো ক্রাইম হবে। ডাক্তার, সমীরণ, পর্ণা সবই নিমিত্ত মাত্র।
অনুপম : But বিরুপাক্ষই যদি পর্ণাকে মারে, তাহলে সমীরণকে ভুল ইনফরমেশন দিলো কেন?
চন্দ্রানী : ভুল ইনফরমেশন দেয়নি। আমার পাতা ফাঁদটা কাজে লাগতো না যদি না পর্ণার ফোনটা পেতাম তুমি, আমি। ফাইনাল কনফার্মেশন পায় আমার থেকে। পর্ণার হাইট যে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, সেটা ওর সিভিতেই আছে। তাই বিরুপাক্ষর জন্য ফাঁদ পাতলাম পর্ণার ফোন ইউজ করে। তাতেই এত কিছু।
এরপর চন্দ্রানী একটা অদ্ভুত কাজ করলো। সুটকেসে থাকা নীল ফাইলগুলো নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। ধোঁয়া উড়ছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই অদ্ভুত জিনিসের ফর্মুলাগুলো। তবে এটার পরেও কী থামবে সবকিছু? কেউ জানে না। তবে অনুপমের মনে হলো পর্ণা ও ডাক্তার, সঙ্গে প্রদ্যুৎ বাবু, এরা কেউই ওই মৃত্যু পথের যাত্রী হতো না। লোভ! লোভ সব শেষ করে দেয়। এবং জন্ম দেয় আর এক লোভের। সমীরণের মৃত্যু কার লোভ বাড়িয়ে দেবে, কাকে বানাবে দ্বিতীয় সমীরণ, কে জানে।
Comments