মাতৃত্ব সে কেবলই অন্তরের - সঞ্চারী ব‍্যা্যানাজ্জী || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 মাতৃত্ব সে কেবলই অন্তরের

      সঞ্চারী ব‍্যানাজ্জী



খবরের কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা "তিয়াশা" নামটা পড়ে বেশ প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ করলাম।কাগজে লেখা আছে " বিভাস চক্রবর্তী পরিচালিত বিধবা ছবির জন‍্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন তিয়াশা"।শুধু নামটাই লেখা পদবী ও ব‍্যাবহার করে না।বয়স মাত্র তেইশ।মাত্র পাঁচ বছরের কেরিয়ারেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নায়িকা বনে গেল।মা হিসাবে ওকে নিয়ে গর্ববোধ তো হবেই তাই না! লক্ষী বেঁচে থাকলে আরও খুশি হত।শুধু লক্ষী কেন হারাধনও কি কম খুশি হত!চেয়ারে বসে পেপার পড়তে পড়তে আজ বড্ড পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ছে।এই হয়েছে আমার এক ব‍্যামো বয়স বাড়তে না বাড়তেই স্মৃতিচারণায় মেতে উঠি যখন তখন।আর স্মৃতির ঝাঁপি তো আপনা আপনিই খুলে যায়।আরে শরীরের বয়স বেড়ে গেছে তো কি হয়েছে?কিন্তু মনের বয়স তো আর বাড়েনি আমি বাড়তেও দিইনি।ওই যে এখন কার একটা গান আছে না "দিল তো বাচ্ছা হ‍্যা জি"।ওইরকম কিছুটা।আমার বয়স একষট্টি কর্তার বয়স সত্তর।আর মেয়ের বয়স তো বললামই,সব মিলিয়ে আমরা বাড়িতে সাত জন সদস্য ।কে কে?ওই তো আমরা তিনজন আর চারজনের মধ্যে হল গিয়ে একজন ড্রাইভার রমেশ,রান্নার কাজ করা মেয়ে ইন্দু,ঘরদোর পরিস্কার করার মেয়ে বুলা আর মেয়ের ম‍্যানেজার অনুসূয়া।সবাই মিলে থাকি তাই আমরা সবাই এক পরিবার হলাম কিনা?আসলে এটা ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শিখেছি।আমাদের গ্রামের বাড়িতে যত কাজের লোক ছিলেন তাদেরকে মা কোনো দিনই বাইরের লোক বলে মনে করতেন না।মায়ের কাছে তারাও ছিলেন বাড়ির সদস্য।আজ অবশ‍্য ভীষন আমার সেই পুরনো গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা যেদিন গ্রামে গিয়ে খবর পেলাম লক্ষী আর হারাধনদা বেঁচে নেই।লক্ষী আমাদের বাড়িতে কাজ করত সেই ষোলো বছর বয়স থেকে।ওর বাবা ছিলেন না।মা প্রায়দিনই অসুস্থ থাকতেন।তাই সংসারের হাল ধরতে লক্ষী আমাদের বাড়ি কাজ করত।পড়াশোনাটা শিখে ওঠা হয়নি ওর।কিন্তু ও ছিল বুদ্ধিমতী,ভদ্র,মার্জিত স্বভাবের মেয়ে।পেটে যে বিদ‍্যা ছিল না সেটা কোনো দিন ওর কথায় বা আচরনে প্রকাশ পেত না।শেখার আগ্রহও ছিল খুব।আমিই ওকে হাতে ধরে ধরে সই করতে শিখিয়েছিলাম।আমার তখন কত বয়স হবে কুড়ি।কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছি। লক্ষীর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই আমার খুব ভাব ছিল।ওকে আমি বোনের মতোই দেখতাম।আর আমার মা তো ওকে চোখে হারাতেন বাবাও তাই।লক্ষী যখন কুড়িতে পা দিল ওর মা তখন ওর বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন।পাত্রও পেয়ে গেলেন বাপ,মা হারা হারাধন।চাষ বাষ করে।আমার মা ওখানে লক্ষীর বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না।উনি চেয়েছিলেন আরও কোনো সচ্ছল ছেলের হাতে ওকে তুলে দিতে।কিন্তু ওর মা জেদ ধরে বসলেন ওখানেই উনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান চোখ বোজানোর আগে।তারপর বিয়েটা হয়ে গেল।আমাদের বাড়ি থেকেই হল।বিদায়ের সময় মায়ের তখন সে কি কান্না আর লক্ষীও কেঁদে কেটে একশা করছিল।যাইহোক ও শশুর বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমারও বিয়ের তোড়জোড় লাগল।কলকাতার ছেলে সত‍্যজিৎ।আমার কোনো অপছন্দের কারন ছিল না কারন আমি চিরকাল কলকাতার ছেলেকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।কলকাতা শহরটাকে আমার ভালো লাগত।তা বলে এই না যে আমার জন্মভূমি আমার গ্রামকে আমি ভালোবাসি না।আমারও বিয়ে হয়ে গেল আমি কলকাতায় চলে এলাম।ওদিকে লক্ষীর সংসারও ভালোই চলছিল।কিন্তু হঠাৎ একদিনই হারাধনের চাষ বাষের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।ব‍্যাস তারপর থেকেই আর্থিক অনটন শুরু হল।আমার মা,বাবা জানতে পেরে লক্ষী আর হারাধনকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন।ওদিকে তখন লক্ষীর মাও মারা গেছেন।লক্ষী আবার আগের মতো কাজ করতে লাগল।আর হারাধনদা আমার বাবার সঙ্গে ব‍্যাবসা সামলাতেন।এদিকে আমার সংসারও দিব‍্যি চলছিল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমাদের সন্তান হচ্ছিল না।যখন প্রায় আমি মা হওয়ার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম ঠিক সেই সময় লক্ষীর কোল আলো করে এক ফুটফুটে কন‍্যাসন্তান এল।নাহ্ এর জন্য আমি কোনো দিন ওকে হিংসা করিনি।কেনই বা করব?ভগবানের যা ইচ্ছা আমি তাই মেনে নিয়েছি।ভগবান হয়তো চাননি আমি কোনো সন্তানের জননী হই বা আমারও কোল আলো করে কোনো সন্তান আসুক।ভগবানের যা ইচ্ছা হবে তাই তো সকলকে মেনে নিতেই হবে।কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারি ভগবান কেন এমনটি চেয়েছিলেন।


গ্রামে যতবার যেতাম ততবারই লক্ষীর ওই ফুটফুটে একরত্তি শিশুটাকে কোলে নিয়ে কত আদরই না করতাম।নিজের কোনো সন্তান ছিল না বলেই হয়তো আমার ওই বাচ্ছাটির প্রতি এত টান ছিল।সম্ভবত লক্ষীও এটা টের পেত তাই তো গ্রামে যখনই গিয়ে থাকতাম তখনই ও আমার কোলে ওর বাচ্ছা মেয়েটিকে দিয়ে বলত,"রিনা দিদি ওকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না।আমার কাছে থাকলে খুব দুষ্টুমি করে"।আমিও তখন সব কাজ ছেড়ে ওই বাচ্ছাটিকে ঘুম পাড়ানোর কাজে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়তাম।এরপর এল সেই ভয়ংকর দিন যেদিন গ্রামে গিয়ে শুনলাম লক্ষী আর হারাধনদা মারা গেছে।এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল ঘুরতে ফেরার সময় মর্মান্তিক বাস দূঘর্টনায় দুজনেই নিহত হয়।ওদের বাচ্ছা মেয়েটির বয়স তখন মাত্র তিন বছর।আমার মাতো দিশেহারা হয়ে গেলেন ওই বাচ্ছাটির কথা ভেবে।তিন বছরের একটা ছোট্ট মেয়েকে উনি যে কিভাবে মায়ের স্নেহ,ভালোবাসা ছাড়া মানুষ করবেন সেটাই ভেবে পেলেন না।প্রায়ই চোখের জল ফেলে বলতেন,"ভগবানের কি নিষ্ঠুর বিচার বল রিনা!বলি কি এমন পাপ, করেছিল আমার লক্ষী যে তাকে ওমন সাত তাড়াতাড়ি তুলে নিল।এখন এই বাচ্ছাটিকে নিয়ে কি করব আমি?হা ভগবান এর থেকে তুমি আমাকে তুলে নিলে পারতে"।আমারও বাচ্ছাটির প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গিয়েছিল।তাই একটু সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।লক্ষীর মেয়েকে আমি মানুষ করব। আমারও মা হওয়ার স্বপ্ন পূরন হবে।মাকে এই কথাটা জানাতে মা খুশি হয়েছিলেন বটে কিন্তু বেশ অবাক হয়ে জানতেও চেয়েছিলেন যে,"তোর যখন নিজের সন্তান হবে তখন কি করবি মা?যতই যাইহোক নিজের সন্তানের প্রতি যে মায়েদের আলাদা একটা টান থাকে"।আমি একটু হেসে বলেছিলাম,"মা আমার যে সন্তান হবে না সেটা তুমি না বুঝতে পারলেও আমি আর সত‍্যজিৎ এতদিনে বেশ বুঝে গেছি।তাই আমরা দুজনে মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তুমি আর আপত্তি করো না মা।আমি ওর মা হতে চাই"।এমন কথা শোনার পর আমার মা,বাবা কেউই আর কোনো আপত্তি করলেন না।ছোট্ট তিয়াশা চলে এল আমার সাথে কলকাতায়।এই তিয়াশা নামটা ওর নিজের মা লক্ষীরই দেওয়া।এখানে নিয়ে আসার পর ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিই।পড়াশোনায় ও বরাবরই ভীষণ ভালো ছিল।তবে পড়াশোনা ছাড়াও ওর আর একটা জিনিস শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল সেটা হল নাচ।নাচতে খুব ভালোবাসত মেয়েটা।সেইজন‍্য ওকে নাচের স্কুলেও ভর্তি করে দিলাম।ওয়েস্টার্ন ডান্স শিখতে লাগল।এইভাবে দেখতে দেখতে কখন যে ও বাচ্ছা থেকে কিশোরী হয়ে উঠল সেটাই টের পেলাম না।স্কুল পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হল।কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও ডান্স করত এমনকি অ‍্যাক্টিংও করত।ওর কলেজে অনুষ্ঠিত রোমিও জুলিয়েট নাটকে ও জুলিয়েটের চরিত্রে এত চমৎকার অভিনয় করেছিল যে কলেজের টিচার থেকে শুরু করে প্রফেসর সবাই ওর ভীষণ প্রশংসা করেছিলেন।কলেজের প্রফেসর বি.কে মুখাজ্জীর এক বন্ধুও ওই নাটকটি দেখতে এসেছিলেন।তিনি আবার সিরিয়াল বানাতেন অর্থাৎ ডিরেক্টর ছিলেন।আমার তিয়াশার অভিনয় ওনার এতটাই ভালো লাগে যে উনি ওনার আগামী সিরিয়ালের জন্য তিয়াশাকে নেওয়ার কথা ভেবে ফেলেন।এই কথাটা তিয়াশার কানে যেতেই ও লাফিয়ে উঠেছিল।আমি বেশ বুঝতে পারতাম ওর অ‍্যাক্টিংয়ের প্রতি একটা ভালোলাগা আছে।ও স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের কাছে পারমিশন চেয়েছিল যে ওই ডিরেক্টর ভদ্রলোককে হ‍্যাঁ বলবে কিনা?সত‍্যজিৎ আর আমি প্রথমে একটু দোনোমনো করলেও পরে ওর মুখের দিকে চেয়ে রাজিই হয়েছিলাম।তারপর ওই সিরিয়ালের জন্য অডিশান দিল এবং প্রায় তিনশো জনের মধ্যে থেকে ওকেই ওরা মেন লিডের জন্য সিলেক্ট করল।ব‍্যাস তারপর থেকে একটু একটু করে ছোটপর্দা থেকে বড়োপর্দায় পা রাখল।ওর অভিনেত্রীর হওয়ার স্বপ্নও পূরন হয়ে গেল।পড়াশোনাটাও অবশ‍্য ছাড়িনি।ইংরেজিতে স্নাতক হয়েছে।আজকের অভিনেত্রী "তিয়াশাকে"সকলেই এক ডাকে চেনে।এর পিছনে আছে ওর কঠোর পরিশ্রম এবং অতি অবশ্যই অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা।রাস্তায় বেরোলে কেউ যখন আমাকে দেখে বলে ওঠে,"ওই দ‍্যাখ অভিনেত্রী তিয়াশার মা যাচ্ছে রিনা দিদি"।বিশ্বাস করুন তখন গর্বে মাথা উঁচু হয় আমার।চোখে জল চলে আসে ।এই যেমন এখন আসছে।মনে হয় আমি সফল হয়েছি।"পেটে না ধরলে নাকি মা হওয়া যায় না "এই যে ধারনাটা আমি ভেঙে ফেলার আপ্রান চেষ্টা করে গেছি সারা জীবন।আমার অন্তরের মাতৃত্ব দিয়েই আমার তিয়াশাকে আমি মানুষ করেছি।কখনও ওকে অবহেলা করিনি।সত‍্যজিৎও তিয়াশাকে খুব ভালোবাসে।আর আমাদের তিয়াশাও আমাদের ভীষণ ভালোবাসে।ও যে আমাদের সন্তান নয় এই কথাটা আমরা ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখিনি।ও সব জানে।ওর বেডরুমে ও লক্ষী আর হারাধনের একটা ছবি লাগিয়ে রেখেছে।রোজ সকালে উঠে প্রনাম করে তারপর বাড়ি থেকে বের হয়।ওর আসল পদবী হালদার আর সৌভাগ্যবশত আমাদেরও পদবী হালদার।ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি আমাদের নাম দিয়েই।আগে ও সারনেম সব জায়গায় লিখলেও এই অভিনয় জখতে আসার পর আর সারনেম ব‍্যাবহার করে না।বলে,"আমার তিয়াশা নামটাই যথেষ্ট মা এই তিয়াশা নামেই সবাই চেনে আমায়।শুধু শুধু পদবী জুড়ে আর নামটাকে বড়ো করার কোনো দরকার নেই "।সত‍্যি আজ আমার তিয়াশার অনেক নাম ডাক হয়েছে,ও আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে।আমারও কোথাও না কোথাও একটা দায়িত্ব শেষ।এবার বাকি আছে ওর বিয়ে দেওয়াটা।এই প্রসঙ্গে বলে রাখি মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে।ওর নতুন ছবি "বিধবার" ডিরেক্টর বিভাস চক্রবর্তীর সাথে মন দেওয়া নেওয়া কমপ্লিট।আমাকে জানিয়েছে সে কথা।আমি তো ওর সাথে সব সময় বন্ধুর মতো মিশেছি তাই ও মন খুলে আমার সাথে সব কথা শেয়ার করে।মেয়ে বলেছে এখনই বিয়ে করতে চায় না আরও কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়িতে বসবে।ওই যে!বাইরে গাড়ির আওয়াজ মেয়ে এসে গেছে।এবার আমাকেও উঠতে হবে।শেষে একটাই কথা বলব মমত্ব সব নারীর মধ্যেই লুকানো থাকে।ভগবান আমায় নিজের সন্তান বোধহয় এইজন‍্যই দেননি।আমার নিজের সন্তান থাকলে কি আমি এতটা আদর,যত্নে তিয়াশাকে বড়ো করতে পারতাম?জানি না।তবে সারা জীবন চেষ্টা করেছি একজন সত্যিকারের মা হওয়ার।জানি না কতটা পেরেছি!!



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024