উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -34
দশ
কিছুক্ষণ পর দেবীদাস ট্যাক্সি বের করল। আমি ট্যাক্সির মধ্যে ওর পাশে বসে বাবার চিন্তায় মগ্ন রইলাম। শেষ পর্যন্ত বাবার দেখা পাবো তো! জানি না কত কাল তাকে অনাহারে অনিদ্রায় কাটাতে হয়েছে। যে মানুষ দিনের পর দিন কাধে বন্দুক নিয়ে শিকার করেছেন, সে জমিদার। ধনী পুত্র দুঃখ যে কি বস্তু জানতেন না। দারিদ্র কোন দিন তাকে স্পর্শ করতে পারতো না, তিনি এক মুঠো অন্নের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়চ্ছেন। হায়রে বিধাতা কি নির্মম বিচার। শত কষ্ট, যন্ত্রণা, নির্যাতনের মধ্যে আমার মুখে হাসি ফোটানো ইঙ্গিত ছিল দেবীর
কাছে স্থান পাবো বলে কিন্তু বাবার অবস্থা উপলব্ধি করে দুঃখের বোঝা বেড়ে গেলো।
অব্যক্ত বেদনা যে কতখানি আমার অন্তঃস্থল হতে গোঙাতে থাকল, সে সময় এই
বেদনা আমার অন্তস্থলকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো কোন
শক্তিই ছিল না। হয়তো সে সময় কারো কাছে যদি একথা প্রকাশ করতাম তাহলে
নিশ্চয় সান্ত্বনার তীর হৃদয়ে প্রবেশ করিয়ে উদ্ভ্রান্ত চিত্তকে শান্ত করতাম। কিন্তু সে
সময় কোন প্রাণী আমার কাছে ছিল না। শুধু দেবী ছাড়া।
মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলেছি, মনে হয় আমার বাবা আর ইহ জগতে নেই। কে যেন কানের কাছে এসে বলে গেলো, ওরে হতভাগী মেয়ে, বাবাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে আজ আবার কি লালসায় তাকে ফিরিয়ে আনতে চলেছিস? ভয় নেই, তোর বাবা তোকে বিরক্ত করতে আসবে না। ফুটপাতে লোকের লাথি, গুঁতো পেয়ে জীবন তার অনেক আগে বেরিয়ে গেছে। সে শান্তি পেয়েছে। তার শরীরে এখন শান্তির বাতাস বইছে। উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠতেই দেবী গাড়ীটা ব্রেক করল ও তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো - পদ্মা এ ভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। নীচে নেমে এসো, এখানে গাড়ী দাঁড় করিয়ে ঐ ধর্মশালায় খোঁজ নিয়ে আসি। ওখানে অনেক দুঃস্থ পরিবারের লোকবাস করে।
কোন প্রকারে গাড়ী হতে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশী দূর যেতে হলো না, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটু দূরে মিউনিসিপ্যালিটির একটা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। দুটো লোক ট্রেচার করে একজন মৃত ভিখারীকে ফুটপাত হতে তুলে এনে ঐ গাড়ীতে চড়াচ্ছে। ভিখারীর মুখটা দেখেই আমার সমস্ত দেহ শিউরে উঠল। তিনি আমার বাবা ছাড়া কেউ নন। আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে বাবার দেহের উপর ঝাঁপয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমায় ক্ষমা করো বাবা। অনেক আশা নিয়ে তোমাকে খোঁজ করতে বেরিয়ে ছিলাম। কিন্তু ভাবিনি আজই তোমার অন্তিম যাত্রা দেখতে পাবো। জীবনে অনেক দুঃখ, কষ্ট সহ্য করেছো। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে হারাতে চাইনি বাবা। নিরুপায় হয়ে তোমার হাত ধরে তোমাকে পথ ধরিয়েছিলাম আমি বিশ্বম করতে পারছি না বাবা, এইভাবে তুমি চিরশান্তির রাজ্যে চলে যাবে। উচ্চস্বরে কাদতে থাকলাম।
উঃ ভগবান এই করুন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখবার জন্যই কি প্রস্তুত ছিলাম? বাবা তুমি সারা জীবন দুঃখের সাথে সংগ্রাম করেছো। কিন্তু সংগ্রামে জয়ী হতে পারলে না। তুমি তোমার সমস্ত মায়া মমতা ত্যাগ করে পরলোকে চলেছো।
বাবার বুকে আছড়ে পড়ে কেঁদে চলেছি। দেবীদাস এক সময় জোর পূর্ব্বক ট্যাক্সির ভেতরে বসিয়ে দিলো। তখনও আমি উদগ্রীব হয়ে সীটের উপর উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকলাম। কখন যে বাবার মৃত দেহকে ট্রেচার করে নামিয়ে ট্যাক্সির মধ্যে চড়ালো বুঝতে পারিনি। এক সময় দেবীদাস আমাকে জানালো আমরা শ্মশানে এসে উপস্থিত হয়েছি।
বাবার শেষ কৃত্য সমাপন করে বাড়ীতে এলাম, অনেক বেলা বয়ে গেছে। আহারে মন বসলো না। দেবীদাসের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে আমি যখন অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম, সেই সময় আমার গণ্ড দেশে অশ্রুবন্যা বইতে লাগলো। পর পর তিন দিন ঐভাবে কাটিয়ে ছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে অতীতের অনেক স্মৃতি আমার জীবনে ম্লান হয়ে এলো।
এই তো সংসারের নিয়ম। শোক দুঃখ চিরস্থায়ী নয়। তা যদি চিরস্থায়ী হতো। তাহলে এ জগতে মানুষের মনে এতো দ্রুত পরিবর্তন আসতো না। অবশ্য ভুল যে আমি কতখানি করেছি তা প্রকাশ করা যায় না। শত দুঃখ যন্ত্রণাকে চাপা দিয়ে দেবীর সংসারে প্রবেশ করে আনন্দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম সত্য, কিন্তু এত সহজে পতিতার ঘৃণ্য ও পাপ পঙ্কিল জীবনের আবর্ত হতে সমস্ত কলঙ্ক কালিমা মুছে ফেলে একটা অভিজাত পরিবারে আদরিনী বধূ হয়ে উঠবো সে কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
কেন, পতিতার দোষ কোথায়? পতিতানারী কি নতুন জীবন শুরু করতে, নতুন আশা আকাঙ্খায় ঘর বাঁধতে, বিগত দিনের ঘৃণ্য জীবন হতে নূতন জীবনের সূর্য উঠার স্বপ্ন দেখতে পারে না? জীবনের পথ চলতে অনেকেরই পদস্খলন হয়, কিন্তু সেই স্থলনই কি তার জীবনের পরিপূর্ণতা আনয়নের পথকে মসিলিপ্ত করে দেবে, কখনো না। নারী জীবনের সুপ্ত কামনা বাসনার বীজগুলি অনুকূল পরিবেশের রৌদ্র, জল ও বাতাসে নব জীবনের অঙ্কুরোদগম হয় না?
দেবীদাসের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে এসে আমার তমসাচ্ছন্ন জীবন রৌদ্র করোজ্বল এবং ভাস্কর হয়ে উঠলো। দেবীদাসের দ্যুতিহীন কুঞ্জটি দুটি বিহগের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠলো। আমি না ওর কত আপন গৃহিনী।
অবশ্য আমি যে তার নিজের গৃহিনী নই তা অকপটে স্বীকার করবো। দেবী আমাকে আদরী মাসীর কবল হতে মুক্ত করেছে। এমনকি তার ছন্নছাড়া জীবনের জীবন সাথীরূপে নির্বাচিত করার অভিলাষ প্রকাশ করেছে। অবশ্য প্রথম দর্শনেই দেবীদাসকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ও যেদিন ময়নার অসুখ সারাবার জন্য ময়নার কাছে প্রথম মা ডাক শুনেছিলাম সেদিন হৃদয়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো।
মা হারা ময়নার মুখ হতে সেদিন “মা” ডাক শুনে আমার অন্তরের বদ্ধ দরজায় মাতৃত্বের আবেদন জোর করে আঘাত দিয়েছিলো সেদিনই আমি আমার অজ্ঞাতসারে ময়নার মাতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলাম।
ও সব চিন্তায় যখন মগ্ন ছিলাম ময়নার ডাকে নিজেকে ফিরে পেলাম। মা আমায় হরলিক্স দেবে না?
ময়নাকে বুকে জড়িয়ে কয়েকবার চুমু খেয়ে বললাম, তোমার হরলিক্স খাবার সময় হয়েছে তা আমার মনেই ছিল না। চল তোমাকে হরলিক্স করে দিই।
ময়নাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেবীদাসের গাড়ীর শব্দ পেলাম। ময়নাকে কোলে নিয়ে দেবীদাসের আগমনের প্রতীক্ষায় থাকলাম।
দেবীদাস কাছে এসে ময়নার চিবুক ধরে বলল, আমার কোলে এসো মামনি।
সর্বদা কি মায়ের কোলে চড়ে থাকতে হয় ?
দেবীর কোলে ময়নাকে চড়িয়ে দুই গ্লাস হরলিক্স তৈরী করে ওদের দিলাম। ময়না হরলিক্স শেষ করে বাপির কোল থেকে নেমে এসে পুনরায় খেলাতে মন দিলো। ময়নার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে পর দেবী আমাকে কাছে টানলো।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, করো কি, এই প্রকাশ্যে দিবালোকে এভাবে কি প্রণয়িনীর নিকট প্রেম নিবেদন করে ?
কি বললে তুমি আমার প্রণয়িনী
তা নয়তো কি?
বুঝতে পেরেছি তোমার অভিমান কি। সত্যি আমার ভীষণ ভূল হয়েছে। তা ছাড়া কাজের চাপে একেবারে সময় করতে পারছি না। আমাকে এক মাস সময় দাও, সুশীলবাবু এলেই নির্বিঘ্নে রেজিষ্টারী করে শুভকার্য সমাধা করবো। আমার ভালবাসা কোনদিনই তাচ্ছিল্য ভেবো না। দেবী আর অমানুষ নয় পদ্মা।
না? নামে আর ডেকো না। পদ্মা আর বেঁচে নেই। পদ্ম হয়ে তোমার জীবন সরোবরে বিকশিত হয়ে থাকতে চাই না। পদ্মের পাপড়ি এখন শুকিয়ে গেছে। ঝরে পড়ে গেছে সে। ও নামে আর ডেকো না। আমি তোমার প্রিয়তমা রমা।
তোমাকে এবার রমা বলে ডাকবো। আর কখনো 'ঝরা পদ্ম পাপড়িকে কুড়িয়ে এনে মালা গেঁথে রাখবো না। তোমাকে রমা রুপেই আমার হৃদয় রাজ্যে অভিষিক্ত করবো।
চলো অনেক বেলা হয়ে গেছে, তোমার স্নানের ব্যবস্থা করি। স্নান ঘরে প্রবেশ করলাম। আমি এ বাড়ীতে আসার পর তার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমাকে যোগাড় দিতে হয়। বাড়ীর চাকর / চাকরাণী সব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। যতদিন দেবীর কাছে থাকবে। দেবতার মতো দেবীকে পূজা করবো। কারণ, তাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে মনে করেছি। তবে জানি না করে আমার সীমান্তে সিঁন্দুর দেবে।
নানা ছলা, কলা, হাসি ঠাট্টার মধ্যে দেবীর স্নান শেষ হলো। অতি যত্ন সহকারে ভোজনের পরিচর্যা করলাম প্রতিদিনের ন্যায়। তারপর বিশ্রামের ব্যবস্থা। রাত্রেও তার যাতে কোনরূপ কোন দিক দিয়ে অসুবিধা না হয় সে দিকেও সজাগ থাকি সর্ব৷৷ এইভাবে দিন অতিবাহিত হতে থাকে।
Comments