উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -33
ঐ ঘরের মধ্যে দিয়ে ল্যাবরেটার রুমের রাস্তা। সদর দরজায় না গিয়ে চৌবের নির্দেশ মতো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে জানালার কাচ ফাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে আলো জ্বলছে তবে জোরালো নয় অবশ্য ঐ আলোতে কাজ করতে কোনরূপ বাধা আসবে না। কলেজের নাড়ীনক্ষত্র দেবীর নখদর্পণে। সুতরাং E.C.G. মেসিন কোথায় কি অবস্থায় থাকে সব তার জানার মধ্যে।
ধীরে ধীরে মেসিনটার দিকে এগিয়ে চলল। হাতে উদ্যত রিভলবার। কোন জন প্রাণী নেই বলে মনে হলো, তাছাড়া এ সময়ে কারো থাকার কথা নয়। মেসিনটার কাছে পৌঁছে হাত দুটো প্রসারিত করেও মেসিনটা স্পর্শ করতে পারল না। কত বড় অন্যায় করতে চলেছে সে। একটা প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে হাজার হাজার ছাত্রদের অসুবিধার কারণ সৃষ্টি করছে। কিন্তু একটু পরেই বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে তার কার্য সাধনে উদ্যত হলো।
হঠাৎ কে যেন তাকে বলে উঠল, নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা কর বৎস। অকালে মরবার চেষ্টা করো না। দেশের কত মানুষ কত অন্যায় করছে, তুমিই বা করবে না। কেন ?
পারল না ধৈর্য্য ধরতে, দুই হাত প্রসারিত করে E.C.G. মেসিনকে নিয়ে অতি সতর্কে বাইরে বেরুতে গিয়ে উপস্থিত হলো সুমন্তর সামনে। মনে হয় পাশের রুমে কোন কাজে ব্যস্ত ছিলো। পরে কাজ শেষ করে কোন দরকারে ল্যাবরেটরি রুমে আসছিলো। সে কখনো কল্পনা করেনি সেই মুহুর্তে সুমন্ত তার সম্মুখে হাজির হবে। তাকে দেখে হকচকিয়ে গিয়ে বলল সুমন্ত। দেবীদাস তুমি! একি E.C.G. মেসিনটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
কোন কথা বলার অভিপ্রায় তার নেই। উদ্যত পিস্তল তখন সক্রিয় হতে চলেছে। বিশেষ করে তার হিংস্রতা আরোও বেড়ে গেলো তার সঙ্গে পুরাতন শত্রুতার কথাগুলো মনে উদয় হতে। কারণ তার প্রিয়তমা মুকুলকে তার কাছ হতে ছিনিয়ে নিয়েছে। এই সুযোগে ওকে দুনিয়া হতে বিদায় দেওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। আর একদিকে পথের কাঁটাকে সরিয়ে দেওয়া উচিৎ নতুবা মূর্খের কাজ হবে। উদ্যত পিস্তল ততক্ষণাৎ গর্জে উঠল। সুমন্ত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ততক্ষণাৎ ওখান হতে কেটে পড়ল দেবীদাস। তারপর- তারপর এক গরীবের সন্তান পৃথিবী হতে চির বিদায় গ্রহণ করল।
তখন একটিবার ভাবিনি পদ্মা, আমি কত বড় সর্বনাশ করেছিলাম। আমার অপরাধের মার্জনা হয় না। পদ্মা, আমি তোমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছি, তোমাদের যা সর্বনাশ করেছি, মর্মে মর্মে তা অনুভব করছি, সেইজন্য আমি তোমাদের কাছে শাস্তি চাইছি, আমাকে শাস্তি দাও পদ্মা, আমাকে শাস্তি দাও! দেবীদাস ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকল
থাকতে পারলাম না ওর কথা শুনে। ডুকরে ডুকরে আমিও কাঁদতে থাকলাম। দেবীদাস বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর পুনরায় বলতে শুরু করল। কিন্তু ঐ মহানুভব বন্ধুটি পুলিশের কাছে প্রকাশ করেনি আমি তাকে খুন করেছি। বরং সে পুলিশের কাছে প্রকাশ করেছিল ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় ।
সুমন্ত আমাকে ক্ষমা করলেও ভগবান কিন্তু শাস্তি দিতে ছাড়লেন না। আমার স্ত্রী আমাকে সন্দেহ করেছিল আমি খুনী। কারণ E.C.G. মেসিন নিয়ে সেদিন কোন প্রকারে আড্ডাতে পৌঁছুতে পারিনি। বাড়ীতে উঠতে গিয়ে চন্দ্রার কাছে ধরা পড়েছিলাম। তারপর পেপারে পরদিন সকালে বড় হরফে লেখা, “মেডিকেল কলেজের E.C.G. মেসিন যে ব্যক্তি অপহরণ করেছে, যদি কেউ তার সন্ধান দিয়ে থাকেন, তাহলে তাকে পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। এর সঙ্গে আরো ঘোষণা ছিল, মেডিকেল ছাত্র সুমন্তর হত্যাকারীকে যে ব্যক্তি ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”
পুলিশ সন্দেহবশতঃ - গ্রেফতার করে আমাকে মৃত্যুপথযাত্রী সুমন্তর নিকট হাসপাতালে হাজির করল। কিন্তু সুমন্ত আমাকে দেখে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করল সে তার হত্যাকারীকে চেনে না। পুলিশ কাল বিলম্ব না করে আমাকে বেকসুর মুক্তি দিল। সুমন্তর মহানুভবতায় আমি সে যাত্রা রক্ষা পেলাম সত্য, কিন্তু বাড়ীতে এসে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলো সুমন্ত রেহাই দিলেও ভগবান আমাকে সহজে রেহাই দেবে না।
বাড়ীতে স্ত্রীর আত্মহত্যা দেখে আমি গভীরভাবে বিচলিত হয়ে পড়লাম। তার আত্মহত্যার একমাত্র কারণ, আমার স্ত্রী ধারণা করে নিয়েছিল সুমন্তর হত্যাকারী আমি। সেইজন্য আমার ভবিষ্যৎ শাস্তি ও অপমানের দূর্বিসহ বেদনা সহ্য করতে পারবে না বলেই আত্মহত্যা ছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না।
দেবী কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর বলল, আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। বিশষ করে মুকুলের কথায় আরো অতীষ্ট হয়ে উঠলাম। সুমন্ত তাকে সংক্ষেপে বলে গেছে মৃত্যুর পূর্বে দেবী যেন এবার প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। সে জন্য ওকে ক্ষমা করে চললাম।
মুকুল দাঁত চেপে বলেছিল, সুমন্তদার হত্যাকারী তার পরিচিত। ইচ্ছে করলে সে যে কোন সময় আসামীকে যোগ্য শাস্তি দেবার মত ক্ষমতা রাখতো। তবে সুমন্তর কথামত সে কাজ করে চলেছে। দেবীদাসের সন্দেহ থাকলেও মুকুল ও সুমন্তের মধ্যে ভাই বোনের স্নেহ মধুর সম্পর্ক ছিল।
ও কথা শুনে আমি নিজেকে আরো জর্জরিত করেছিলাম। আমি অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরা ছিলাম পদ্মা। তুমি ই পাপিষ্ঠ, অপরাধী মানুষটাকে ক্ষমা না করে এই শয়তান। দেবীদাসকে খুন করে তোমার দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নাও। দেবীদাস দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বালকের মতো কাঁদতে থাকল। এরপর...
এরপর নিজেকে সংযত করতে না পেরে বহুকষ্টে চোখের জল মুছে, ব্যথিত বুকে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগে এই কথা বারংবার মনের দুয়ারে আঘাত করল, অতীতকে ভুলবার চেষ্টা করছিস পদ্মা? দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ কি নিবি না? না? অনিবচনিয় মানসিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। নিষ্পাপ ময়নার মুখখানি স্মরণ করে আমার প্রতিহিংসার আগুন নিভে গেল।
সংযমের বল্লাকে দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরে দেবীদাসের দৃষ্টির বাইরে চলে আসতেই বাবার কথা আমার মনকে তীব্র ভাবে নাড়া দিল। বাবাকে শহরময় খোঁজ করে বের করতে হবে। বাবাকে বাঁচাতেই হবে। এই অভিশপ্ত শহরে আর থাকব না। বাবার সাথে গ্রামেই ফির যাবো। অপেক্ষা না করে অনেকদূর এগিয়ে এসেছি, এমন সময় দেবীদাসের। ডাকে কোন সাড়া না দিয়ে এগিয়ে চলেছি, দেবীদাস দৌড়ে এসে আমার পথ আগলে বলল, তুমি যেও না পদ্মা, আমাকে শাস্তি না দিয়ে তুমি যেতে পারো না। আমি অনেক অপরাধের অপরাধী। আমাকে কি নতুন করে বিশ্বাস করতে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত হতে রক্ষে করে অপার মাতৃ স্নেহ দিয়ে মা হারার বেদনাকে মন থেকে মুছে দিয়েছো, তখন এই সময় ময়নাকে ছেড়ে যেও না। উভয়ের প্রচেষ্টায় বাবাকে এই মহানগরীর ভিড়ের মধ্য হতেও যেকোন উপায়ে খোঁজ করে বের করবই।
তার মুখ দিয়ে একথা শুনে তার মলিন মুখ পানে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে দেবীদাসের বুকে আছড়ে পড়লাম। দাদার হত্যাকারী জেনেও ওর বুকে মুখ রেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। দেবীদাসের চোখ ফেটে জল বেরুতে থাকল।
কান্না ভেজা গলায় বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি পদ্মা। এ ভালোবাসা ক্ষণভঙ্গ র নয় মনে রাখবে। এই ভালোবাসা চিরন্তন ও শাশ্বত। তুমি আবার অন্ধকার জীবনকে এবার আলো দেখাবে। জীবনের সংকট ও দুর্যোগ মুহুর্তে তুমি দান করবে আমার মনে শক্তিশালী প্রেম। ধীরে ধীরে ওর বুক হতে মাথা তুলে ওকে প্রণাম করলাম। এরপর দেবীদাস ও আমি বাবার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।
Comments