Tuesday, February 28, 2023

ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ২০২৩ || February Sonkha 2023

 



যে মাতৃভাষার জন্য একসময় আন্দোলন গড়ে তুলতে পিছ পা হন নি, নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যারা নিজেদের জীবন বলিদান দিতেও পিছপা হয় নি, এই মাতৃভাষার জন্য আজ আমরা নিজের অস্তিত্বকে জানতে পারি, তাই তাদের বলিদান আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলা ভাষা আমার মা, আমার মাতৃভাষাতে আমার অস্তিত্ব নিহিত। তাই আপনাদের পাশে পেতে চাই, আন্দোলিত হোক ছন্দে ছন্দে আপনার লেখনী শক্তির আদলে।


     আমাদের ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন (ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা) তার ই একটি রূপক । লিখুন, লেখাকে ভালোবাসুন। পাঠক এর চরম সীমায় পৌছে যান।

                                          ধন্যবাদান্তে
              World Sahitya Adda সম্পাদকীয় বিভাগ

___________________________________________



___________________________________________

বি দ্র - সকল লেখকবৃন্দদের জানানো হচ্ছে আপনারা আপনার লেখার লিংক গুলো পাবেন পরপর। যারা  মোবাইল ফোন থেকে সাইট খুলছেন তারা এই পেজে নীচের দিকে View Web version নামে একটি অপশন আছে সেটি ক্লিক করুন তাহলে ডানদিকে সম্পূর্ণ লেখাগুলোর লিংক পেয়ে যাবেন। আর যারা কম্পিউটার ব্যবহার করছেন তারা সরাসরি ডানদিকে লেখাগুলোর লিংক পেয়ে যাবেন। 

বিদ্রোহী কবি নজরুল - সামসুজ জামান || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article Writing

           বিদ্রোহী কবি নজরুল

                  সামসুজ জামান


২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একবার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল জানতে যাওয়া হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? ৩০ দিনের উপর চালানো পরিসংখ্যানে দেখা যায় শ্রোতাদের মনোনীত শ্রেষ্ঠ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় তৃতীয় স্থানে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার কবি এবং অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

নজরুল ইসলামের জন্ম পশ্চিমবাংলার সংযুক্ত বর্ধমান জেলার আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রামে। বাংলা হিসেবে ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ , মঙ্গলবার আর ইংরেজি ২৪ শে মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মায়ের নাম জাহিদা খাতুন। বাবা ফকির আহমদ স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম এবং একটি মাজারের খাদেম ছিলেন। খুবই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ হয়েছিল মাদ্রাসায়। কষ্টের হাত ধরে জন্ম বলে তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়াঁ। আর খুব ছোটবেলায় বাবার মৃত্যু হয় বলে ছোটবেলা থেকেই অর্থের রোজগারের ব্যবস্থা তাকে করতে হয়েছে। তাই বেশি পড়াশোনা সম্ভব হয়নি। জীবিকার কারণে চায়ের দোকানে রুটির কারখানায় বা কারো বাড়ির খানসামা হিসেবে কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে। তবে নিজের লেখনী শক্তি থাকায় গ্রামবাংলায় ঘুরতে থাকা নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবিতা, নাটক, লেটোগান রচয়িতা করে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

একেবারে তরুণ বয়সে নজরুল যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা তাঁর ভিতরে ছিল তাই তিনি ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে করাচিতে গিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। সশস্ত্র আন্দোলন হবে এবং তার মধ্যে দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করতে হবে এটাই ছিল তাঁর মনের ভাবনা। সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈনিক হয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে ফেরার পর সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। এই সময় ‘ধুমকেতু-’র মত পত্রিকা জনসমাজে খুব সাড়া জাগিয়েছিল। তার “বিদ্রোহী” কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে।  'ভাঙার গান' ইত্যাদি রচনা একেবারে মানুষকে উত্তাল করে দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে সাহিত্য রচনা করা নজরুলের জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে ছিল। তিনি কখনো এই সাম্প্রদায়িকতাকে মেনে নেন নি। তার গানের ভাষা – “হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন / কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার” – অপূর্ব সুন্দর ভাবনার পরিচায়ক। তিনি অন্য কবিতায় বলেছেন- “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত- জালিয়াত খেলছো জুয়া”। আসলে তিনি ছিলেন মানবতার কবি। তাই জাত ধর্মের বন্ধনে তাঁকে কেউ কখনো বন্দী করে রাখতে পারেনি।

নজরুল তাঁর দেশপ্রেমমূলক লেখা লিখে ইংরেজ রাজশক্তির বিষ নজরে পড়েছিলেন। যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ নজরুলের লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে “বসন্ত” গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কে জোড়াসাঁকো ডেকে পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল, তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি”। তাঁর আরও বক্তব্য ছিল – “তাকে বোলো আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না ব’লে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকন্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই”। 

ইংরেজরা তো নানাভাবেই ভারতীয়দের, বিশেষ করে নজরুলের মত লেখনি ধারণ করে যারা দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলছে তাদেরকে নানাভাবেই ঘৃণা করতেন। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবার কথা সেদিন জেলখানার ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার অবাক হয়েছিলেন যে – “টেগোর ওই ‘প্রিজনার’-কে বই ডেডিকেট করেছেন”!! আর তারপর নজরুল সেই কথা শুনে “বসন্ত” বইখানা তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে, বুকে চেপে ধরেছিলেন আনন্দে, বিস্ময়ে, উত্তেজনায়! তিনি আসলে আজন্ম প্রতিবাদী তাই জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় বিভিন্নভাবে রাজবন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে নজরুল অনশন শুরু করেছিলেন। জেলের বাইরে সে খবর ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত মানুষ উত্তেজিত হয়েছিল প্রচন্ড পরিমাণে। রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাঁকে অনশন তুলে নিতে বলেছিলেন। শরৎচন্দ্র উত্তেজিত হয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অনুমতি পান নি। আর নজরুলের বন্ধু-বান্ধব বহু কবি-সাহিত্যিক সাধারণ মানুষ সকলেই নানাভাবে নজরুলের সমব্যথী হয়েছিলেন। অনশনে মরার মত হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল শরীর তা সত্ত্বেও তিনি জেদ ধরে বসে ছিলেন- তিনি খাবেন না। এরপর ৩৯ দিনে অনশন ভঙ্গ করানো হয় অনেক চেষ্টা চরিত্র করে। এভাবেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা নজরুলের একেবার মনোধর্মের মধ্যেই ছিল।

আমাদের দুর্ভাগ্য নজরুল সুস্থ অবস্থায় মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক, শিল্পী-জীবন পেয়েছিলেন। যার মধ্যে ৫০০ রচনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। এখানে ছিল ২৮৫ টি কবিতা, ১৫৭ টি গান, ৪৩ টি প্রবন্ধ ও ভাষণ, ১৪ টি গল্প, তিনটি ধারাবাহিক উপন্যাস। সুস্থ অবস্থায় নজরুলের প্রকাশিত গ্রন্থ ৪৯ টি। অসুস্থতার পরে তাঁর রচনাবলীর মধ্যে ৯৭৪ টি গান, ৬৫৩ টি কবিতা, ৭৬ টি প্রবন্ধ, ১৮ টি গল্প, ৯টি নাটক-নাটিকা, তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদিতে প্রকাশিত রচনা হিসেব করলে গান পাওয়া যাবে আড়াই হাজারেরও বেশি, কবিতা ৬৮টি-র বেশি, প্রবন্ধ আলোচনা একশোটির ও বেশি, গল্প ১৮ টি,  নাটক গীতি বিচিত্রা ইত্যাদি মিলিয়ে ২৫ টি আর উপন্যাস ৩ টি। এর বাইরে নজরুলের কত লেখা যে এখানে ওখানে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে তার হিসেব পাওয়া মুশকিল।

আমাদের দেশ বিভাগের পর নানাভাবে নজরুলকে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে চিরস্থায়ীভাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু মন থেকে তিনি সেদিকে সাড়া দেন নি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এবং আমাদের পক্ষে এটা খুব লজ্জ্বার কথা যে নজরুল যখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন আমাদের দেশের পক্ষ থেকে খুব উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে নজরুলের চিকিৎসার সুব্যবস্থার কথা ভেবে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে এই কবিকে বাংলাদেশের নেবার অনুমতি চেয়ে নেয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মে বাংলাদেশ বিমানে কবিকে সপরিবারে ঢাকা আনা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের একুশে পদকে ভূষিত করেন এবং তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু সে দেশেই তিনি ১৯৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৯ শে অগাস্ট সকাল দশটা দশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যথাযোগ্য ভাবেই বলেছিলেন – “তাঁর সক্রিয় জীবনে কবি যা লিখেছেন তা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে। তাঁর মৃত্যু ভারত ও বাংলাদেশকে রিক্ত করে দিয়েছে”। তাঁর স্বভাব ছিল সহজ, সরল। হৈ হৈ করে সকলকে নিয়ে আনন্দ-হাসি-গানের মধ্যে দিয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র কবি হিসেবে তাঁকে ধরে রাখা যায় না, তিনি বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, গল্পকার হিসেবেই সব সময় কাজের মধ্যে মানুষকে নিয়ে বেঁচে থাকতে এবং মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। একেবারে ছোট থেকে এত রকমের অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য, ঝড়-ঝঞ্ঝা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নজরুল কাটিয়েছেন যে তাঁর কবি-সাহিত্যিক হিসেবে এত বড় হওয়া অনেকের কাছেই খুব আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হয়। যত রকমের প্রতিকূল পরিবেশ অর্থাৎ বাধাবিঘ্ন তাঁকে চেপে ধরেছে, তিনি যেন ভিতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তত বেশি উচ্ছল হয়ে মানুষের মাঝে তাঁর সাহিত্য, গান, কবিতাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। জেলখানায় বন্দি থেকেও নজরুলকে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন রচনা থেকে দূরে সরানো যায় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি নজরুলকে ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। আজও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মত লেখনি দিয়ে তিনি নিজে সবার কাছে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে  বেঁচে আছেন। কবির  মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এই কবিকে সমাধিস্ত করা হলেও পরে তাঁর সমাধিস্থলের মাটি নিজের জন্মভূমি চুরুলিয়া তে এনে কবি পত্নী প্রমিলা ইসলামের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। চুরুলিয়ার সেই পবিত্র মাটিতে সেই সমাধির পাশে দাড়ালে আজও আমরা যেন শুনতে পাই তিনি বলছেন- “ মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু- মুসলমান/ মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ” কিংবা “রক্ত ঝরাতে পারিনা তো একা/ তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা”। মনে হয় তিনি যেন বলছেন তার চিরস্মরণীয় বাণী – “বিদ্রোহী রণক্লান্ত / আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না.........”!!!

মিথ্যে কথার শিল্পী - সৌরভ মুখার্জী || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article Writing

 

মিথ্যে কথার শিল্পী

  সৌরভ মুখার্জী 

 



আইফেল টাওয়ার কিনবেন? সস্তায় বিক্রি আছে!


বিশ্বাস হল না তো? না হওয়ারই কথা, কারণ আমি ভিক্টর লাস্টিগ নই। ভিক্টর লাস্টিগ এই কথাটাকেই এমনভাবে বলতেন যে আপনারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হতেন। তিনি ছিলেন মিথ্যে কথার শিল্পী, যিনি জালিয়াতিকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।


 


আর হ্যাঁ, লোকজনকে টুপি পরিয়ে সত্যি সত্যিই তিনি ফ্রান্সের জাতীয় সম্পদ আইফেল টাওয়ারকে বেচে দিয়েছিলেন। তাও, একবার নয়, দু-দু'বার।


 


ভিক্টর লাস্টিগের (Victor Lustig) জন্ম হাঙ্গেরিতে। জীবনকাহিনী বিশদে বলছি না। তবে পড়াশোনায় তিনি ছিলেন তুখোড় আর স্কুলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছাত্র হিসেবে নাম করেছিলেন। পড়াশোনা প্যারিসে। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় চৌকস। সঙ্গে বেশভূষা আদবকায়দা সবেতেই চোখে পড়ার মত স্মার্ট। এগুলো সবই তাঁর জালিয়াতি শিল্পের অঙ্গ। উনিশ বছর বয়স থেকে জুয়া খেলায় জোচ্চুরি করে হাত পাকান। তারপর ফ্রান্স থেকে নিউ-ইয়র্ক যাওয়ার (ট্রান্স-আটলান্টিক লাইনার্স) জাহাজকে তাঁর শিল্পের প্রথম ক্যানভাস বানিয়ে নেন।


 


ফ্রান্স থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে এই জাহাজে যাতায়াত করত মূলতঃ উচ্চবিত্ত ফরাসি ও আমেরিকানরা। লাস্টিগ তাদের টার্গেট করতেন না। উচ্চবিত্তদের মধ্যেও একেবারে টপক্লাস বড়লোকেরা ছিল লাস্টিগের শিকার। তারা প্রায় মাসখানেকের ক্রূজ ভ্রমণে ধীরে ধীরে লাস্টিগের সঙ্গে পরিচিত হত। লাস্টিগও নিজেকে ওইরকমই এক টপক্লাস বড়লোক বলে পরিচয় দিতেন। বলতেন, তিনি হচ্ছেন একজন খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালক। ব্রডওয়ে প্রোডাকশনের মালিক। এই নামে আদৌ কোনো কোম্পানির অস্তিত্বই ছিল না। টপক্লাস বড়োলোকেরা ভাবতেন বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি? তখন ইন্টারনেটও ছিল না, আর একমাসের জার্নিতে জাহাজে ভাসতে ভাসতে লাস্টিগের কথা যাচাই করার কোনো উপায়ও ছিল না। কেউ আবার অজ্ঞতা ঢাকতে বলেই দিত, ওহো, আপনিই তবে ব্রডওয়ের মালিক? কি সৌভাগ্য, নাইস টু মিট ইউ।


 


মিট যতই নাইস হত, লাস্টিগ ততই ফেনিয়ে ফেনিয়ে তাঁর কোম্পানির সুখ্যাতি করে যেতেন। বলতেন, ব্রডওয়েতে ইনভেস্ট করার জন্য বড় বড় আমেরিকান ব্যবসায়ীরা তো মুখিয়ে আছে। প্রফিট ই প্রফিট! কিন্তু আমি চাই যারা একটু শিল্প-টিল্প বোঝে এমন ইনভেস্টর আমার কোম্পানিতে টাকা ঢালুক। এই ধরুন আপনার মত। এইভাবে চাগাতে চাগাতে এক্সট্রিম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে লাস্টিগ বলতেন, যাকগে! জাহাজ পোর্টে ভিড়লেই তো ইনভেস্টররা ছেঁকে ধরবে। তার আগে একটু রেস্ট নিয়ে নিই।


 


চাগা বড়লোকেরা ভাবনা-চিন্তা বন্ধ করে দৌড়ে গিয়ে কেবিন থেকে চেকবই এনে বলতেন, অ্যামাউন্টটা বলুন জাস্ট। কত ইনভেস্ট করতে পারি? লাস্টিগ তাও ইতস্তত করে বলতেন, এত বড় অংকের টাকা কি আপনি ইনভেস্ট করতে পারবেন? থাক, এখন কম করেই দিন। ধরুন এই হাজার দুয়েক ডলার। চাগা বড়লোক ব্যবসায়ী হইহই করে উঠতেন, বলেন কি মশাই, দু'হাজারে কীই বা হয়? আপনি এই পাঁচহাজারের চেকটা রাখুন। প্রফিট তো হবেই, ব্রডওয়ে বলে কথা!


 


আগেই বলেছি এই ব্রডওয়ে প্রোডাকশনের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আর জাহাজ পোর্টে আসার সঙ্গে সঙ্গে লাস্টিগ চেক নিয়ে হাওয়া। টাকা তুলে আবার ফিরতি জাহাজে চেপে বসতেন। নতুন শিকারের অপেক্ষায়। সেই চাগা ব্যবসায়ী আমেরিকা পৌঁছনোর কিছুদিন পর লাস্টিগের স্বরূপ বুঝতে পেরে মাথার চুল ছিঁড়তে আরম্ভ করতেন। ঘটনাটা যেহেতু ফ্রান্স ও আমেরিকার মাঝে হত, তাই দুদেশের পুলিশ একে অন্যের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকত। মাঝ থেকে ভিক্টর লাস্টিগ তাঁর ব্যবসা চালিয়ে যেতেন।


 


ব্যবসা ভালই চলছিল, বাধ সাধলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ট্রান্স আটলান্টিক লাইনার্স তাদের জাহাজ পরিষেবাই বন্ধ করে দিল। লাস্টিগ তখন জালিয়াতির অন্য ধান্ধায় প্যারিসে এসে থিতু হলেন।


 


১৯২৫ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে ফ্রান্স তখন অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছে। এদিকে কয়েক বছর আগে ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের দোহাই দিয়ে ঘটা করে আইফেল টাওয়ার বানানো তো হয়ে গেছে, এখন তাকে মেন্টেন করতে কালঘাম ছুটছে সরকারের। ওই লোহার দৈত্যকে রঙ করতেও যে বিপুল খরচ হয়, প্যারিস সিটি কাউন্সিলের কাছে সে এক বিশাল অংক। শুরুতে প্ল্যান ছিল আইফেল টাওয়ারকে জং থেকে বাঁচাতে প্রতি সাত বছর অন্তর অন্তর রঙ করতেই হবে। কিন্তু অর্থাভাবে রঙ না করায় আইফেল সেই জৌলুশ হারাতে লাগল। প্যারিসের জনগণ আর বিরোধী রাজনৈতিক দল উঠেপড়ে সরকারের পেছনে লাগল, কই হে! অত আড়ম্বর করে লোহার দৈত্য বানিয়ে তাকে কি এখন না খেতে দিয়ে মারবে?


 


এইসব নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি হল প্যারিসের সংবাদপত্রে। লাস্টিগের তা চোখে পড়ল, মনেও ধরল। তখন তিনি আইফেল টাওয়ারকেই বানিয়ে নিলেন নিজের জালিয়াতি শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্যানভাস।


 


জালিয়াতির প্রস্তুতি হিসাবে লাস্টিগ সরকারি স্ট্যাম্প পেপার, লেটারহেড, সিলমোহর সবকিছু নকল করলেন। তারপর প্যারিসের ভীষণ দামি একটি হোটেলে স্যুইট বুক করে এক গোপন মিটিং ডাকলেন। মিটিংয়ে আহ্বান করলেন ফ্রান্সের কিছু লোহা ব্যবসায়ীকে। নিজেকে ডাক ও টেলিগ্রাফ মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবে পরিচয় দিলেন। লাস্টিগ দুঃখের সঙ্গে বললেন যে আইফেল টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণ ফরাসি সরকারের পক্ষে খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। তাই সরকার এটিকে ভেঙ্গে লোহার দরে বিক্রি করে দেওয়ার প্ল্যান করছে। কিন্তু এই চুক্তি জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ ডেকে আনতে পারে বলে সরকার গোপনে কাজটা সেরে ফেলতে চাইছে। বিস্তারিত বিবরণ বাইরে কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। এই লোহার বিশাল দৈত্যকে কে ভাঙা লোহার দরে কিনবে তা ঠিক করার জন্যেই সরকার তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে। সৎ লোহা ব্যবসায়ী হিসাবে খ্যাতির কারণে লাস্টিগ তাঁদের নাম নির্বাচন করেছেন। তাঁর কথাবার্তা, আদবকায়দা, বিশেষ করে কাগজপত্রের নিখুঁত নকলের ফলে মিটিংয়ে উপস্থিত একজনও ভাবতে পারেনি লাস্টিগ একজন ঠগ। বরং তারাও লাস্টিগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল, ভেঙে ফেলাই উচিত। প্যারিসের অন্যান্য দুর্দান্ত গথিক সৌধগুলোর সঙ্গে আইফেল এক্কেবারে বেমানান। মাঠের মধ্যে দাঁড় করানো এক পেল্লাই লোহার টাওয়ার, না আছে ছিরি, না আছে ছাঁদ!


 


ব্যবসায়ীদের দলের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল কে আইফেল টাওয়ার ভাঙা লোহার দরে কিনবে। সকলে দরপত্র জমা দিল। সবটাই খুব গোপনে। কিছুদিন পর তাদের মধ্যে আঁদ্রে পোইসন (André Poisson) নামের এক উঠতি ব্যবসায়ী আলাদা করে লাস্টিগের সঙ্গে দেখা করল। বলল, স্যার, সরকারি কাজ। টেন্ডারটা প্লিজ পাইয়ে দিন। দরকারে আপনাকে যদি আলাদা করে কিছু দিতে হয় সে নাহয় আমি দেব।


 


লাস্টিগ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কী? আমার মত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীকে ঘুষ দিতে চাইছেন?


 


পোইসন থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে, না স্যার। চটবেন না। বলতে চাইছি আপনি কত বড় পদে অধিষ্ঠিত, অথচ সরকারি নিয়মের গেরোয় তেমন বিলাসী জীবন যাপন করতে পারেন না! দেখে বড্ড খারাপ লাগে স্যার।


 


লাস্টিগ ধপ করে চেয়ারে বসে বললেন, সে তো বটেই, কপাল! শেষমেশ প্রারম্ভিক দাম বারো লক্ষ আর ঘুষ হিসাবে আরো সত্তর হাজার ফ্রাঙ্কে (সব মিলিয়ে আজকের দিনে প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ ভারতীয় টাকা) রফা হল। পোইসন ভাবলেন,জলের দরে আইফেল টাওয়ার কিনে নিয়েছি! লাস্টিগ বললেন, এই টাকার পাকা বিলটা ঠিক দু'দিন পর অফিস থেকে নিয়ে নেবেন। আর হ্যাঁ, ব্যাপারটা কিন্তু খুবই গোপনীয়।


 


পোইসন কান এঁটো করে হেসে বলল, সে আর বলতে স্যার? বউকেও বলব না। এই আপনি আর আমি, ব্যস।


 


পোইসন নগদ টাকা লাস্টিগের হাতে তুলে দিল। লাস্টিগও নকল সরকারি রশিদ লিখে দিলেন।


 


দুদিনের মধ্যে পোইসন মিস্ত্রি-মজুর আর লোহা কাটার বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি নিয়ে আইফেলের মাঠে উপস্থিত। শুধু পাকা বিলটা পেলেই হয়। সরকারি অফিসে গিয়ে খুব গোপনে তাদেরকে বিশদে বলার পর তারা তো আকাশ থেকে পড়ল। তারা বলল, আইফেল ভাঙা তো দূরের কথা একটু চটা উঠিয়ে দেখুন কি অবস্থা করি আপনার! পোইসন বুঝল সে ভীষণভাবে ঠকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটল সেই হোটেলে যেখানে লাস্টিগ ছিলেন। হোটেল জানালো তিনি তো দুদিন আগেই চেক-আউট করে চলে গেছেন।


 


লাস্টিগ তখন ফ্রান্সের সীমানা পেরিয়ে জন্মভূমি অস্ট্রিয়ায় গা-ঢাকা দিয়েছেন।


 


লাস্টিগ জানতেন পোইসন সব ধরে ফেললেও নিজের মান আর ব্যবসা বাঁচাতে পুলিশের কাছে যাবে না। ফরাসি লোকেদের ইগো মারাত্মক। জনগণ যখন জানতে পারবে পোইসন কত বড় ধোঁকা খেয়েছে, তারা তো তাকে নিয়ে মশকরা করবে। লাস্টিগের ধারণাই সঠিক ছিল। ফ্রান্সের কোনো সংবাদপত্রে এই খবর বেরোল না। লাস্টিগ তক্কে তক্কে ছিলেন, ব্যাপারটা থিতিয়ে যেতেই আবার সন্তর্পণে ফ্রান্সে ফিরে আসেন। তারপর আবারও একই পন্থায় আরেকদল ব্যবসায়ীর কাছে আইফেল বিক্রির কাজ শুরু করেন।


 


দ্বিতীয়বারে আর সবকিছু প্ল্যানমাফিক হল না। এবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন ফরাসি পুলিশের হাতে। কিন্তু লাস্টিগকে ধরা অত সহজও ছিল না। তিনি ফরাসি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসেন আমেরিকায়।


 


আমেরিকায় আগে থেকেই তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড, কাজেই রিস্ক না নিয়ে এবার তিনি ছোটোখাটো জালিয়াতিতে মন দেন। তিনি টম শ' নামে এক খ্যাতনামা রসায়নবিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাল ডলার বানাতে আরম্ভ করেন। 


 


এবারেও সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু গন্ডগোল পাকালো লাস্টিগের প্রেমিকা বিলি। জালিয়াতিতে পার্টনার হলেও রসায়নবিদের স্ত্রীর প্রতি লাস্টিগ একটু আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আর তাতেই বেজায় চটে গিয়ে বিলি পুলিশে ফোন করে সব ফাঁস করে দিল। লাস্টিগ জীবনে অজস্র মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, কিন্তু যাকে তিনি নিজে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন সেই বিলি শেষ পর্যন্ত তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিল।


 


দেখতে দেখতে ভিক্টর লাস্টিগের সমস্ত জালিয়াতি প্রমাণ সমেত ধরা পড়ে যায়। শুরু হয় বিচারের জন্য অপেক্ষা। কিন্তু বিচারের ঠিক দু'দিন আগে অসুস্থতার ভাণ করে নিউ ইয়র্কের সুরক্ষিত জেল থেকেও পালিয়ে যান। কিন্তু এবার আর শেষরক্ষা হল না। একমাসের মধ্যেই আবার ধরা পড়লেন এবং বিচারে তাঁর কুড়ি বছরের জেল হল। তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর।


 


জেলে থাকাকালীন নিজেই তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি বলে গেছেন। তাঁর মতে, ধৈর্য্যশীল শ্রোতা হতে হবে। মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস এসব নিয়ে মতভেদে যেতে নেই। সবেতেই তালে তাল মেলাতে হবে আর অপেক্ষা করতে হবে কখন উল্টোদিকের মানুষটা আপনাকে বিশ্বাস করে তার গোপন কথাগুলো নিজে থেকেই বলতে শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়ার আলকাট্রাজ দ্বীপে নির্বাসিত থাকাকালীন বারো বছরের মাথায় জেলেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে বলা হয় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধোঁকাবাজ!


 


সবই তো শুনলেন। এবার থেকে বাড়িতে ফেরিওয়ালা ভাঙা লোহার জিনিস কিনতে এলে তাঁকে যখন ভাঙা বালতি কি কলের মাথা বেচবেন, দেখবেন তো একটু হলেও নিজেকে ভিক্টর লাস্টিগ মনে হচ্ছে কিনা?


 


তথ্যসূত্র :


https://en.wikipedia.org/wiki/Victor_Lustig


https://www.toureiffel.paris/en


https://www.mirror.co.uk/news/world-news/super-scammer-who-sold-eiffel-24706498


https://www.smithsonianmag.com/history/man-who-sold-eiffel-tower-twice-180958370/


https://bonjourparis.com/history/how-a-con-man-sold-the-eiffel-tower/


https://www.britannica.com/topic/Eiffel-Tower-Paris-France



কোরিয়ান কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা - শংকর ব্রহ্ম || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article Writing

 কোরিয়ান কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা


শংকর ব্রহ্ম




              কোরিয়াকে 'সন্ন্যাসীর দেশ' বলা হয়ে থাকলেও, বর্তমানে কোরিয়ো কবিদের ভাষায় তাকে 'কবিতার দেশ' বলা হয়ে থাকে।

           প্রথমদিকে ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোরিয়ো কবিদের বিকাশ ঘটলেও, প্রথম বা দ্বিতীয় এবং একাদশ চান্দ্রমাসে লন্ঠন ও ফসল কাটার উৎসবকে কেন্দ্র করে কবিতা বিস্তার লাভ করেছে। কোরিয়ান ভাষার প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থটি কিউন ইয়ো (균여, 均 如) রচিত "দশটি ব্রত সমান্তভরের গান", এটি কবির মৃত্যুর এক শতাব্দী পরেও ১০৭৫ অবধি ছিল। কোরিয়ার প্রিয় কাব্য রীতি 'সিজো' প্রায়শই একাদশ শতাব্দীর সিওনবি বিদ্বানদের কাছে পাওয়া যায়, তবে এর শিকড়গুলিও এখনও পূর্বের রূপগুলির মতোই রয়েছে। 'সিজো' ঘরানার আদিতম রূপে বেঁচে থাকা কবিতাটি চতুর্থ শতাব্দীর। 

        'হায়াঙ্গা' কবিতা বলতে বোঝায় বহিরাগত কোরিয়ান কবিতা যা 'হানজা' ব্যবহার করে কোরিয়ান শব্দগুলি প্রতিলিপি করে (ইডু পদ্ধতির অনুরূপ, প্রতিলিপির হায়ঙ্গা স্টাইলকে বলা হয় (hyangch'al) এবং ইউনিফাইড সিলার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। এটি কবিতার প্রথম স্বতন্ত্র কোরিয়ান রূপগুলির মধ্যে একটি। গোরিও পিরিয়ডের সামগুক ইউসার ১৪ টি কবিতা রয়েছে যা আজ অবধি সংরক্ষণ করা হয়েছে। 

         

         'হায়াঙ্গা' বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক বিধি দ্বারা চিহ্নিত। কবিতাগুলি চার, আট বা দশ লাইনের সমন্বয়ে থাকতে পারে। দশ-লাইনের কবিতাগুলি সর্বাধিক বিকাশযুক্ত, যথাক্রমে চার, চার এবং দুটি লাইন সহ তিনটি বিভাগে কাঠামোযুক্ত। দশ লাইনের অনেকগুলি কবিতা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। শিলার পরিধি হাওয়ারং 'এর বিকাশ ও সমৃদ্ধির' ক্ষেত্রে এর ভূমিকা হায়াঙ্গা জেনার অনেক পণ্ডিতের আগ্রহের বিষয়। 

           গোরিও পিরিয়ড হানজার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার হয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। হাইয়াঙ্গা মূলত কোরিয়ান সাহিত্যের একটি রূপ এবং "গোরিও গান" হিসাবে অদৃশ্য হয়ে গেল (গোরিও গায়ো) আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ গোরিও গানগুলি মৌখিকভাবে গাওয়া হয়েছিল এবং অনেকগুলি জোসিয়ন আমলে বেঁচে ছিল, যখন তাদের কয়েকটি হ্যাঙ্গুল ব্যবহার করে লেখা হয়েছিল। গোরিও গানের কাব্যিক রূপটি পরিচিত হিসাবে রয়েছে। 


         কোরিয়ো যুগের (৯১৮ - ১৩৯২ খ্রীষ্টাব্দ) এমন প্রায় ষাটটি কবিতা পাওয়া গেছে। কিছুটা দীর্ঘ বলে, এইসব কবিতাকে 'ছাংগা' বলা হতো। এইসব কবিতার রচয়িতারা সকলেই সাধারণ লোক, এমন কি কেউ কেউ জনপদ বঁধু ( কিসেয়াং)। কবিতাগুলির কাব্যিক উৎকর্ষ যথেষ্ট এবং প্রেমের উৎকৃষ্ট প্রকাশ।

         সুতীব্র আবেগের বাধাহীন প্রকাশ সেইসব কবিতাগুলোয় সমুজ্জল অথচ তা কিন্তু অশালীন নয়।

           'গাসা' শ্লোকের একটি রূপ, যদিও এর সামগ্রীতে নৈতিক উপদেশের মতো পৃথক অনুভূতির প্রকাশের চেয়ে আরও বেশি কিছু অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গাসা শ্লোকের একটি সহজ রূপ, যার প্রতিটি তিন বা চারটি সিলেবলের দ্বিগুণ হয়। কেউ কেউ গাসাকে প্রবন্ধের রূপক বলে মনে করেন। গাসার সাধারণ থিমগুলি ছিল প্রকৃতি, ভদ্রলোকদের গুণাবলী বা পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে প্রেম। ফর্মটি প্রথম গোরিও আমলে আবির্ভূত হয়েছিল এবং জোসেওন রাজবংশের সময়ে এটি জনপ্রিয় ছিল। 

            এগুলি সাধারণত গাওয়া হত এবং ইয়াংবান মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর কবি 'জিয়ং চোলকে' রূপটি নিখুঁত রূপকার বলে গণ্য করা হয়, যার মধ্যে সমান্তরাল রেখার সমন্বয়ে প্রতিটি বিভক্ত হয়ে যায়। 


           'সিজো' একটি (traditional) ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান ভাষাগত কাব্যিক রূপ যা উত্থাপিত হয়েছিল (Koryǒ) কোরিও সময়কাল, সময়কালে পুষ্পিত (Chosǒn) কোসন রাজবংশ, এবং এখনও লেখা হয়। সাধারণ থিমগুলি অন্তর্ভুক্ত করে তবে নিম্নলিখিতগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় , প্রকৃতি , অতীতের নস্টালজিয়া , প্রেমের আগ্রহ , (historical) ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি , নৈতিক নির্দেশন। বেশিরভাগই লিখেছেন তখনকার শিক্ষিত জনগণ এবং শিক্ষিতরা উপভোগ করেছেন (ইয়াংবান ক্লাস) তবে এর ব্যতিক্রমও ছিল। 'কিসেনগস' নিম্নতম শ্রেণীর ছিল, তবুও তারা তৈরি করতে পারে এবং আবৃত্তি করতে পারে 'সিজো'। 


                'সিজো' হলো ছোট তিন লাইনের কবিতা। জাপানে যেমন হাইকু, কোরিয়াতে তেমনি 'সিজো'। সংক্ষিপ্ত, শাণিত। সহজ, কিন্তু ভারী সুন্দর। 


          অনেকে বলেন, কবিতার ফর্ম হিসেবে 'সিজো' নাকি 'হাইকু'-র চেয়েও প্রাচীন। হাইকুর মত সিজোরও আছে কিছু বজ্র-আঁটুনি নিয়মকানুন। একেকটা লাইনে থাকবে মাত্র চোদ্দ থেকে ষোলটা সিলেবল, বাংলায় যাকে বলে ‘দল’। তাই শিজোয় শব্দব্যবহার হতে হয় খুব সংযত, পরিমিত। 


     হাইকুর সঙ্গে তুলনা করলে অবশ্য বোঝা যায়, সিজোর এই লাইনের দৈর্ঘ্যও নেহাৎ কম নয় , কারণ হাইকুতে সাধারণতঃ প্রথম লাইনে পাঁচ, দ্বিতীয় লাইনে সাত আর শেষ লাইনে পাঁচ, এইভাবে সিলেবল-এর বিন্যাস হয়। মোট সতেরো। হাইকু তাই আরও ছোট্ট। এখানে একফাঁকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে মাৎসুয়ো বাশোর সেই বিখ্যাত হাইকুটিকে, ইংরেজি অনুবাদে যাকে লেখা হয় : “An ancient pond/ a frog jumps in/ the splash of water”, 

      রবীন্দ্রনাথ যার বাংলা অনুবাদ করেছিলেন 

‘পুরোনো পুকুর/ 

ব্যাঙের লাফ/ 

জলের শব্দ’। 

         ভাষান্তরের সময়ে ওই মাত্রা-সিলেবল এর চুলচেরা হিসেব মানেননি তিনি। সেটা সম্ভবও নয় কারণ দুটো ভাষার গঠনরীতি পুরো আলাদা। 


     কোরিয়ান 'সিজো' অমন সাতে-পাঁচের নিয়মে থাকে না, তার দৈর্ঘ্য আরেকটু লম্বা-- তিন লাইন মিলিয়ে চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশ সিলেবল। সেই জন্য হাইকুতে যেমন একটা লাইন শুধু একটাই দৃশ্য দেখায়, শিজোর একেকটা লাইনে ধরে যায় দুটো টুকরো ছবি। লাইনের মাঝখানে ছোট্ট একটা বিরতি পড়ে, যার দুপাশে থাকে সে দুটো বাক্যাংশ। 


গোলমেলে ঠেকছে কী? 

একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপার টা বোঝানো সহজ হয়ে উঠবে। শুরু করা যাক তবে। 


" দশটা বছর ব্যয় করে এই পর্ণকুটির তৈরি করা

আধখানা তার বাতাস থাকে, আধখানা তার চাঁদের বাড়ি

কোথায় তোমায় বসতে দেব? বরং তুমি বাইরে এসো।"


       সং সুন নামে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের এক কোরিয়ান কবির লেখা । রাজদরবারে কাজ করতেন আগে, পরে তিনি সব ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যান, লেখালিখি নিয়েই জীবন কাটান। এই কবিতাটার 'পিটার লি'-কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুুবাদ করা। এখানে যদি এক একটা লাইনকে দেখা যায় আলাদা করে, বোঝা যাবে প্রত্যেকটায় আসলে দুটো বাক্যাংশ আছে, দুটো ছবি। 

     প্রথম লাইনেই যেমন দুটো স্টেটমেন্ট, একটা বলছে দশ বছর পরিশ্রমের কথা, অন্যটা বলছে বাড়ির কথা। দ্বিতীয় লাইনে তো আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে লাইনটাও, বাড়িটারই মত... যার অর্ধেকটায় থাকে বাতাস, আর বাকি অর্ধেকটায় চাঁদ। শেষ লাইনেও অমন দু ভাগ, প্রথম অংশটা বলছে, 

  বাড়িতে ঢুকতে / বসতে দেবার জায়গা নেই (যেহেতু বাতাস ও চাঁদ আগেই সবটা দখল করে রেখেছে), আর শেষ টুকরোটা জানাচ্ছে, বাড়ির বাইরেই বরং অতিথিকে গ্রহণ করা হবে। 


   ছোট্ট একটা ছিমছাম কবিতা। তিন লাইনের জাফরির ফাঁক দিয়ে আসা একটুকরো গল্পের আভাস। সিজো আসলে এরকমই।

            'সিজো'-তে তিন লাইন মিলিয়ে মোট চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশটা সিলেবল থাকে। লাইন পিছু চোদ্দ থেকে ষোলটা। 


ইংরেজি অনুবাদের সময়ে সচরাচর সিলেবল-এর হিসেব একদমই মানা হয় না, এমনকি লাইনের হিসেবও নয়। বাংলায় সেটা করা বরং তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ। অনুবাদ করার সময়ে ষোল মাত্রার স্বরবৃত্তের ছাঁচ রাখার চেষ্টা করা ভাল , যাতে সিলেবল - এর হিসেবটা বজায় থাকে মোটামুটি (মানে ছেচল্লিশ সিলেবলের উর্ধ্বসীমাটা আরেকটু বাড়িয়ে আটচল্লিশ বানানো যায় আর কি!) আর ছন্দটাও খানিক ফিরিয়ে আনা যায়। যদিও কোরিয়ান 'সিজো'-তে সিলেবল বিন্যাসের হিসেবটা আরও জটিল, সেগুলো কয়েকটা শব্দবন্ধে ভাগ হয়ে এরকম দেখায়


১ম লাইন – ৩ -৪ -৪ – ৪ (বা ৩)

২য় লাইন - ৩ -৪ -৪ – ৪ (বা ৩)

৩য় লাইন -৩-৫-৪-৩ 


         এ তো গেল শিজোর শুষ্ক গঠনগত দিকটা - খাঁচার গড়ন, যন্ত্রপাতি আর কলকব্জা। 

         তার ভেতরের কবিতাটা কেমন হবে? নিয়ম আছে তারও। 

প্রথম লাইনে বিষয়টার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে, দ্বিতীয় লাইনে সেটাকেই দেখানো হবে সবিস্তারে। 

তৃতীয় লাইনে এসে কিন্তু একটু পালটে যাবে বিষয়মুখ, আসবে একটা ছোট্ট টুইস্ট (কিম্বা, ক্ষেত্রবিশেষে একখানা বড় ক্লাইম্যাক্স) মোটমাট প্রথম দু লাইনের থেকে একটু বদলে যাবে স্বর। 


       যেমন আগে দেওয়া কবিতাটায় প্রথম লাইনে এসেছে বাড়িটার উল্লেখ। দ্বিতীয় লাইনে তারই বিস্তারিত বর্ণনা। শেষ লাইনে কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত নতুন সুর এসে গেছে, একজন অতিথির কথা, একজন ‘তুমি’, যাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া যাচ্ছে না। এটাই সিজোর বৈশিষ্ট্য। একটা ছোট্ট মোচড় শেষে, একটা আলতো বিষয়ান্তর। 

ব্যস, 'সিজো' মানে এই-ই।

               শেষ লাইনে টুইস্টের কথা বললাম ঠিকই, 

কিন্তু সিজো সেই অর্থে ওপরচালাকি করা কবিতা নয় মোটেই। পাঠককে চমকে দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। সিজো আসলে খুব সরল, এবং গভীর। প্রাচ্যের দেশগুলোতে, 

তা চিন হোক জাপান হোক আর কোরিয়াই হোক, কবিতার মূলসুরটা তো খুব সহজ তারে বাঁধা থাকে। হয়তো প্রকৃতির বর্ণনা, হয়তো কবির সুখ বা দুঃখের একটুকরো ছবি, এইটুকুই। 

             শেষ লাইনে যেটা আসে সেটা ওই একই ছবিকেই হয়তো একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে নেওয়া হয়।


          আর হ্যাঁ, 'সিজো' কিন্তু গান হিসেবেও গাওয়া হত। সুর-টুর দিয়ে, বাঁশির সঙ্গে। অনেক সময়েই সেগুলো হত তাৎক্ষণিক, কোনও জলসায় বসে তখনই কথা বসিয়ে সুর দিয়ে গেয়ে ফেলা। সেকালে আমাদের দেশেও কবিয়ালরা যেমন করতেন। কাজেই কবিদের সিজো-নির্মাণের নিয়মকানুন, অক্ষর আর সিলেবল-এর বিন্যাস একদম ভালোভাবে রপ্ত থাকতে হত, যাতে যে চট করে কথা বসিয়ে ওই ফর্ম্যাটে যে কোনও বিষয়ের ওপর কবিতা কিংবা গান বেঁধে ফেলা যায়।

প্রথম সিজোর জনকের মর্যাদা দেওয়া হয় 'উ তাক' নামের এক কবিকে। মোটামুটি তেরোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি, এই তাঁর জীবনকাল।


           রুচিশীলতা, সরলতা, ঐতিহ্যপরায়ণতা, বাস্তব বোধ, প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির বিমূর্ত চিন্তাধারা

শুধু নয়, কবিদের তীব্র অনুভূতি প্রবণতা ও আন্তর অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ, এইসব কবিতাগুলিকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে পাঠকের কাছে।

          কবিদের জীবন-মুখিতা, জীবন পিপাসা, স্বতোৎসারিত সারল্য , অভিজ্ঞতার গুণগত উৎকর্ষতা , প্রকাশের সৎ সাহস শুধু কোরিয়ো কবিদের বৈশিষ্ট্য নয় , বরং সমগ্র কোরিয়ো জাতীর মানসিকতার দ্যোতক।

         কোরিয়ো কবিরা স্বদেশের সংস্কৃতির ধারক বাহক হলেও, চীনের কবিতার বিপুল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সেটাকে যথাযথ রূপে আত্বস্থ করে গ্রহণ করেছিলেন।

       কোরয়ো যুগের উচ্চমানের কাব্যিক ঐতিহ্যধারা পরবর্তী 'য়ি-যুগ'-এ আরও প্রবাহমান হয়ে ওঠে , বিশেষতঃ 'হ্বোয়াং-চিন-ই' - এর কবিতায়। সংদো-র এই বিখ্যাত কিসায়েং (জাপানী ভাষায় গেইসা) কোরিয়ার সর্বকালের

শ্রেষ্ট কবি। 

         হ্বোয়াং-চিন-ই-র কবিতায় নাটকীয়তা , প্রকৃতি-মুখিতা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা , সারল্য , বিশেষতঃ দ্ব্যর্থবোধকতা , এবং সেই সঙ্গে অনুভূতির তীব্রতা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কবিতার সংকেত-ধর্মিতা , যথার্থ শব্দ প্রয়োগের পটুত্ব , বিষয় বস্তুর সাবলীল ক্রমবিকাশ কোরিয়ো সাহিত্যে তাঁকে প্রথম সারীর কবি হিসাবে গণ্য করেছে।



হ্বোয়াং-চিন-ই(১৫০৬-১৫৪৪).

-----------------------------------------


স্রোতস্বিনী

----------------


পাহাড়ের কোল ঘেষে ছোটা

                                   সবুজ নীলাভ নদী তুমি

কোরো না গর্ব স্রোতের বেগের,

একবার সমুদ্রে পৌঁছালে 

                           ফিরে কি আর আসবে তুমি?

তার চেয়ে বরং এখন যখন

জ্যোৎস্নার প্লাবন ভরে তোলে পাহাড়গুলিকে,

এখানে একটু থেমে বিশ্রাম নিলে ক্ষতি কি বলো?


  

        'য়ি-যুগ'-এর আর একজন বিখ্যাত কবি চোং-চোল। তার কবিতায় অতীত জীবনের ব্যর্থতা,অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিতৃষ্ণা,সৌন্দর্য পিপাসা,প্রেম ও বিরহ বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে।



চোং-চোল(১৫৩৭-১৫৯৪).

------------------------------------


একাকী

-----------


ফুলেরগুচ্ছ কী অপূর্ব মনোরম

                      প্রজাপতিগুলি মিথুনাবদ্ধ ওড়ে,

প্রাণ প্রাচুর্যে সজীব গাছেরা দূরে

      ডাকছে কোকিল কোকিলাকে করুণ সুরে।

পাখি ও পশুরা কত আনন্দে ভালবেসে

              একত্রে থেকে এখানে সেখানে ঘোরে,

তবে আমি কেন বন্দীর মতো 

                            একা পড়ে থাকি নিজ ঘরে?



         তবে এ যুগের সর্বশ্রেষ্ট কবি হিসাবে যার নাম সবার মুখে মুখে, তিনি হলেন 'য়ুন-সোন-দো'। ছোট বড় নানান কবিতার মধ্যে তার মূল সুর- পল্রী প্রীতি,প্রকৃতি প্রেম, সঙ্গীত পিপাসা, সদা সতর্কতা অথচ বিশ্রাম প্রিয়তা তার কবিতায় বারবার ধ্বনিত হয়েছে।



য়ুন-সোন-দো(১৫৮৭-১৬৭১).

-----------------------------------------


প্রিয় সাথী

—--------------


নরম কাঠের জানলা দরজা বন্ধ রাখি

হিমেল বাতাস আসে ছুটে,

বাতিটা নেভাও রাত্রিও গভীর হলো বটে

এসো নীরবে বালিশে মাথা রাখি,

ঘুমিয়ে কাটাই নিশি রাতি।

সূর্য এসে আলোয় আকাশ না ভরে দিলে

তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না প্রিয় সাথী।



                     তাছাড়া এ যুগের অন্যান্য কবিদের মধ্যে রয়েছেন, 'সোঙ- সুন', 'কোন-হো-মুম', 'ইম-চে', 'কিম-হ্বোয়াং-উক', 'য়ি-ম্যোঙ-হান' প্রমুখও।

       এছাড়া অজ্ঞতনামা কবিদের কিছু লেখাও পাওয়া গেছে, যাদের লেখার ভাবঘনত্ব এবং বিষয়-বৈচিত্র মুগ্ধ করে। 'য়ি-যুগ'-এর সমাপ্তি কাল ১৯১০ সালে।


       এর পর থেকেই কোরিয়ো কবিতায় আধুনিক যুগের শুরু হয়। এ যুগের কবিরা জাতীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করে, পাশ্চাত্য ভাবধারাকে গ্রহণ করে নতুন সৃষ্টির প্রায়াসী হয়েছেন।


         বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রাথমিকভাবে আমেরিকার আধুনিক কবিরা, যেমন এজরা পাউন্ড এবং টি এস এলিয়টের অনুবাদগুলিতে ইমেজিস্ট এবং আধুনিক কাব্য পদ্ধতি প্রবর্তনের চেষ্টা ছিল। 

      প্রজাতন্ত্রের প্রথমদিকে (কোরিয়ান যুদ্ধের পরে ১৯৫৩ সালে শুরু হয়েছিল), দেশপ্রেমমূলক কাজগুলি খুব সফল হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকে লিরিক্যাল কবিতা প্রাধান্য পেয়েছিল। কবিতা একবিংশ শতাব্দীর কোরিয়ায় প্রকাশিত ও লেখনী রচনার সংখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই বেশ জনপ্রিয়। 


আধুনিক কোরিয়ার একটি কবিতা সংকলিত হচ্ছে। 

১০,৩০০ আসল কোরিয়ান কবিতার সংগ্রহ থাকছে তাতে।


      তারা পুরণো 'কাসা' ( আলোচনামূলক কাব্য), বা 'সিজো' (তিন পংক্তির অনধিক পঁয়তাল্লিশ অক্ষরের কবিতা) এই দুই কাব্যধারা পরিহার করে কবিরা কবিতার ছন্দ ও দৈর্ঘমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, এমন কি ছন্দ বর্জিত গদ্য কবিতাও অনায়াসে লিখেছেন অনেকে।


তাদের কবিতায় - প্রেম , বিরহ , বাৎসল্য , সৌন্দর্য , প্রীতি , ধর্মবোধর, প্রকৃতি প্রেম, দারিদ্র , হতাশা , সেই সঙ্গে জীবনের প্রতি গভীর মূল্যবোধ প্রভৃতি তাঁদের কবিতায় ছায়া ফেলেছে।


        এই মুহূর্তে যারা লিখছেন, তাদের মধ্যে -

'হান-য়োঙ-য়ুন' , 'য়ু-চি-হ্বোয়ান' , 'কিম-দোং-ম্যোঙ' ,

'য়াং-ম্যোঙ-মুন' , 'কিম-চুন-সু' , 'চো-চি-হুন' ,

'কিম-নাম-জো' প্রমুখ উল্লেখযোগ্য, যাদের লেখা মনে রেখাপাত করে।



হান-য়োঙ-য়ুন (১৮৬১-১৯৪৪ সাল).

------------------------------------------


উইলো চারা

-----------------


বুনেছি উইলো চারা একদা উঠোনে

                  ঘোড়াটাকে তার ডালে বাঁধব বলে,

বানালাম চাবুক উইলোর সরু ডালে

                    পলকে ঘোড়াটা দূরে ছুটবে বলে।

রুয়েছি উঠোনে একদা উইলো চারা

                    অশ্ব ছোটানো চাবুক বানাব বলে,

হায়, উইলোর অগন্য তরু শাখা

                হৃদয় বাঁধলো আমাকে মায়ার ছলে।



য়ু-চি-হ্বোয়ান (১৯০৮-৬৭ সাল).

---------------------------------------


ফুল বাগান

----------------


হেমন্ত এসেছে ফিরে পুনরায়

ছেলে মেয়েরা আমার কোথা থেকে যেন

কয়েকটা ফুলের বীজ নিলে এলো ঘরে।

সেগুলো সাজাচ্ছে তারা, গুনছে এক এক করে

গোলাপ, গাঁদা, দোপাটি আর মোরগঝুঁটি।


পড়া লেখা সেরে ঘুমোবার আগে

বিছানায় শুয়ে তারা ফুলের কথা ভাবে,

এগুলো বোনার জন্য যদি একটা বাগান থাকত?

কী যে মজা হতো!


রাত্রি গভীর হলে, মা যখন লেপটি টেনে 

তাদের শরীর ঢেকে দেয় গভীর যত্নে,

এই দরিদ্র ক্লান্ত ফুলগুলি ঘুমে ঢুলে পড়ে

প্রত্যেকেই এক একটা বিশাল ফুলের বাগান

বুকে জড়িয়ে।



সুহ্ জুং জু (১৯১৫ জন্ম - মৃত্যু জানা নেই) 

--------------------------------------------------


দ্বিপ্রহর

----------


স্তিমিত মৃত্যুর স্বাদ পাপড়িতে লেগে

দুই পাশে ফুটে থাকা লাল ফুল পথে,


সুদূর সর্পিল পথে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়

আফিংয়ের স্বপ্নে যেন এলানো শরীরে

ছুটে ছুটে চলে যায়, আমাকে পিছনে ডেকে ডেকে।


আর করপুটে ধরে রেখে অনুস্মরণ আমার

বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরা তীব্র গন্ধ নাকে,


নিস্তব্ধ তীব্র তাপে শুষ্ক শান্ত দুপুর রাতে

দগ্ধ করি, দগ্ধ হই দেহের কিনারে পরষ্পর।



কিম চুন সু (১৯২১.জন্ম - মৃত্যু জানা নেই )

----------------------------------------------------


ফুল

--------

যতক্ষণ নাম ধরে ডাকিনি তাকে

বস্তু ছিল, তার বেশী কিছু নয়।


যখনই ডেকেছি নাম ধরে

কাছে এসে 

হয়ে গেল ফুল।


এ-দেহের বর্ণবাস মিল রেখে তুমি

আমায় ডেকো না কোনো নামে

যেমন ডেকেছি ওই নামে

কাছাকাছি আসব তোমার 

তোমার আপন হয়ে যাব।


আমাদের সকলেই কিছু কিছু হবার বাসনা

আমরা যে সকলেই সকলের কাছে

হতে চাই অর্থময়, অবিস্মরণীয়।



                         কোরিয়োরা 'নৃত্য-গীত প্রিয় জাতি '। 

এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো কেরিয়াতেও প্রাচীনতম কবিতা সেই দেশের ধর্মমতের সঙ্গে সংপৃক্ত হয়ে পবিত্র

মন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছিল। 

             তবে কৃষি-জীবন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা লোক সাহিত্যও প্রাচীন কোরিযো সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ, এ কথাও অনস্বীকার্য। 

 কোরিয়ার জনগণ কোরিয়ান কবিতাকে শ্রেষ্ট শিল্পকলা

হিসাবে গণ্য করে থাকেন। তাই কোরিয়াকে 'কবিতার দেশ'

বলে সেখানকার কবিরা আখ্যা দিয়ে থাকেন, গর্বের সঙ্গে।



Photography - Sikha Sengupta


 










ছবি পরিচিতি 

1,2 নং বর্ধমান নবাবহাটের 108টি শিবমন্দির

3, 4,5 নং দরিয়াপুর ডোকরা গ্রামে ডোকরা শিল্প

5 নং গুসকরার কাছেই ওরগ্রাম ফরেষ্ট

6 নং দরিয়াপুর ডোকরা গ্রামে আমাদের মহিলাদের টিম।

(যদিও এটি মেয়েদের একদিনের বেড়ানোর কাহিনী, এর মধ্যে আমরা গিয়েছিলাম হস্তশিল্পের ডোকরা গ্রাম দরিয়াপুরে।)


     মহিলাদের একদিনের শীতকালীন ভ্রমণে ডোকরার হস্তশিল্প গ্রাম দরিয়াপুরে যাওয়া।

                      __________

 অনেক দিনের পরিকল্পনা শেষে আমাদের 50 জনের মহিলাদের গ্রুপ, গত 19শে ডিসেম্বর 2021 একদিনের জন্যে সংসারের দায়দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দু'টো ট্রাভেলার গাড়িতে গ্রামের মুক্ত বাতাস নিতে। আমরা যাব বর্ধমানের নবাবহাটের 108 শিবমন্দির, দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পগ্রাম ও গুসকরার কাছে ওড়গ্রাম ফরেষ্ট। গড়িয়া, এসপ্লানেড শ্যামবাজার হয়ে গাড়িদুটি চিড়িয়া মোড় এলে আমরা ক'জন চটপট উঠে পড়লাম, এরপর দক্ষিনেশ্বর বালিঘাট থেকে মেয়েরা উঠে 50 জন পুর্ন হতেই গাড়ি হাইওয়ে দিয়ে হু হু করে ছুটতে লাগল। শীতে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে আরামদায়ক গাড়িতে চলল মেয়েদের হাসি গল্প গান। সবার টিফিন ভাগ করে খাওয়া হল।ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে এসে গেল বর্ধমানের নবাবহাট। হাইওয়ের পাশেই একশো আটটি শিবমন্দির। বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, আমরা শাল জড়িয়ে রাস্তার ওপারে ঝুপড়ি দোকানে মাটির খুরিতে দুধ চা খেয়ে এলাম। বেশ ভালো কোয়ালিটির স্বাদু চা। গাড়িতে চপ্পল রেখে,গেটের মুখে টেবিল পেতে বসা ভদ্রলোকের দেওয়া স্যনিটাইজার হাতে মেখে, মোজা পায়ে আমরা শান বাঁধানো 108 শিবমন্দির চত্বর পরিক্রমা করতে লাগলাম। প্রত্যেকটি মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে। কোন কোন মন্দিরে ধুপধুনা কাসর ঘন্টা সহযোগে পুজা হচ্ছে।আমাদের কিছু মহিলা পুজো দিলেন। বেশ অনেকটা জায়গা, গাছপালা গোলাপ বাগান, পুকুর নিয়ে বিস্তৃত এলাকা।চার পাশ দিয়ে 108 টি শিবমন্দির ঘিরে রয়েছে।এখানে খোদিত একটা ফলক থেকে জানা গেল 1788 সালে বর্ধমান রাজপরিবারের মহারানী বিষণকুমারী দ্বারা এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের আদলে তৈরি এই একশো আটটি শিবমন্দির যেন লকেটসহ একশো আটটি রুদ্রাক্ষ দিয়ে তৈরি মালা।1965 সালে আবার এটিকে ভালোভাবে সংস্কার করা হয়। হালকা মিঠে সকালের রোদে এত নানারঙের গোলাপ বাগান,শিবমন্দির পরিক্রমা একটা সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে।

 আমাদের ট্রাভেলার হাইওয়েতে গিয়ে স্পীড নিল।অল্প সময় পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম দরিয়াপুর ডোকরা শিল্প গ্রামে। ঢুকতেই বিশাল গেটের একপাশে পিতলের প্রমান মাপের ডোকরা শ্রমিক পরিবার,স্বামী,স্ত্রী বাচ্চা কোলে। অপর গেটে ডোকরার নানা কারুকার্য করা। ঢুকে ডানদিকে বেশ বড় তিনটি ব্রোঞ্জের মুর্তি। পাশের পাঁচিলে পিতলের ডোকরা সপরিবারে দুর্গামায়ের অসুর নিধন খোদাই করা।এমনকি  

অন্যান্য পাঁচিলেও বিভিন্ন পিতলের ডোকরা শিল্পের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ডান পাশে খড়ের ছাউনির নীচে বড় লম্বা জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে থেকে শিল্পী মহিলা পুরুষেরা চিমটার সাহায্যে তপ্ত লাল ধাতব পদার্থ বের করে অন্য একটি লোহার দন্ডের দ্বারা নানারকম আকার দিচ্ছে,দেখে চমৎকৃত হতে হয়। ঢুকেই ঘাসজমির মাঠ, তার মাঝে উচুঁ গোল সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা। চারদিকে চারটি প্রমান মাপের ডোকরা মানব মুর্তির স্তম্ভ ছাদ ধরে রেখেছে। এবার গেলাম সামনের বিল্ডিং এর নীচে বড় হলে। সেখানে মেঝেতে শিল্পী মহিলারা তাদের ডোকরা শিল্পদ্রব্য নিয়ে বসেছেন বিক্রির জন্য।সাধারন পোষাকের ঘরোয়া এই মহিলাদের হাতের কাজ দেখলে অবাক হতে হয়। ধাতুকে আগুনে গলিয়ে অপূর্ব শিল্পসুষমামন্ডিত নিখুঁত রূপ দিয়েছেন। বলা হয় উড়িষ্যার এক আদিবাসী গোষ্ঠী এখানে বসত করে তাদের এই ডোকরা শিল্পধারা বজায় রেখেছেন। এখানে যে মহিলা শিল্পীরা বিক্রি করছেন, তারা বাঙালি, সবার পদবী কর্মকার।কত রকমের যে শিল্পদ্রব্য দেখলাম,পেঁচা,গণেশ,শ্রমিক দম্পতি, হারের লকেট,দুর্গাপ্রতিমা,গরুর গাড়ি ইত্যাদি অনেক রকম। কয়েকটি পালিশ করা শিল্প নিদর্শন একেবারে সোনার মত দেখাচ্ছে।আমরা সবাই কিছু কিছু জিনিস কিনলাম।তারা অনেক কষ্ট করেই এই শিল্পধারা ধরে রেখেছেন। এই গ্রামে আমাদের মত ট্যুরিষ্টরা যা কেনেন এবং বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় বিক্রি করেই যে আয় হয় তাতে তাদের নিজেদের মোটামুটি চলে যায়।

 এখান থেকে কয়েক কিমি দুরে গুসকরার কাছে ওড়গ্রাম বনভুমির মধ্যে একমাত্র রিসর্টে আমরা দুপুর দুটোর সময় পৌঁছলাম লাঞ্চের জন্যে। একতলার বড় হলে বড় বড় টেবিল ঘিরে আমরা পঞ্চাশ জন একবারে বসে পড়লাম।আগে থেকে বলা ছিল তাই তারাও গরম ভাত,শুক্তো,সবজি দিয়ে মুগ ডাল, গরম বেগুনি,পাবদা মাছ,মাটন,চাটনি, পাঁপড়,নলেন গুড়ের রসগোল্লা পরিবেশন করলেন। খেয়ে দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আমরা সামনের লনে বিকেলের মিঠে রোদে বিশ্রাম নিলাম।ড্রাইভার ভাই দুজনের খাওয়া হয়ে গেলে বাসে করে বনের কাঁচা মাটির পথে বনভুমি দেখতে দেখতে চললাম। বনের মধ্যে সুর্য্য অস্ত যাচ্ছে। পাহাড়, সাগরের সুর্যাস্ত থেকে এ এক স্বতন্ত্র মায়ামোহময় দর্শন।কাঁচা মাটির সংকীর্ণ পথে বাস আর যাবে না। শুনেছিলাম বন শেষ হলে একটি পরিত্যক্ত এরোড্রম আছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে বিমান ওঠানামা করত।স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসা করতে বললো,"ওই হোথা,বন শেষ হলি চাতাল।" তা চাতালই বটে!পুরোন ইট সুরকির বাঁধানো অনেকটা প্রশস্ত জায়গা,দু'পাশে ফসল কেটে নেবার পর বিশাল মাঠ দিগন্তে মিশেছে। ড্রাইভাররা এসে তাড়া দিল। সন্ধ্যা নেমে আসছে।এই বিশাল অরন্য প্রান্তরে অন্ধকারে পথ হারালে সমূহ বিপদ। তাড়াতাড়ি আমরা সবাই বাসে উঠে বসলাম। এবার ফিরতে হবে। 'মন চল নিজ নিকেতনে'। বাস হাইওয়ে এসে স্পীড নিল। শক্তিগড়ে একবার থামলো।আমরা বাড়ির জন্যে ল্যাংচা ও ছানাপোড়া মিষ্টি কিনলাম।রাত্রি পৌনে ন'টা থেকে যার যার স্টপে নামা শুরু হল। বাড়ি ফিরে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সবার খোঁজ নেওয়া হল। রাত্রি দশটার মধ্যেই সবাই নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছে গেছে।এইভাবে শেষ হল আমাদের পঞ্চাশ জনের মহিলাদলের সফল একদিনের আনন্দময় ভ্রমণ।

               _____________



একসাথে,এক পথে - তাপস বাবু || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

একসাথে,এক পথে


   তাপস বাবু 






ঐ যে আর দুজন চলেছে মরুভূমির মাঝ দিয়ে। গন্তব্য হিঙলাজ মাতার মন্দির।একে একে সবাই মরে গেছে এ পথে। কিন্তু ওরা থেমে থাকে নি।ওরা চলেছে একেঅপরের শক্তিকে বড় নিয়ে,একে অপরের ভালোবাসাকে বহন করে,একে অপরের প্রতি টানকে নিয়ে।একে অপরের প্রতি বৈবাহিক সম্পর্ক কে আগলে।আসলে ওরা দম্পতি।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটু জল। কিন্তু জোটে নি।এই বিশাল মরুভূমিতে জলের সন্ধান যে মেলেনি। ওরা আর পাচ্ছে না।ঐ যে পড়ে গেল লোকটা।"জল রেবা জল"অস্ফুট স্বরে কাতর আবেদন লোকটার।রেবারো শরীরের শক্তি শেষ।তার মৃত্যুও আসন্ন ও অবধারিত।তার বুকোও ফেটে যাচ্ছে এক বিন্দু জলের আশায়। তবুও সে সেই অবস্থায় স্বামীর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে তার মুখের উপর ঝুঁকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।আর ঐ যে ওর কান্নার দুফোঁটা জল স্বামীর মুখে পড়েছে।শেষ মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য স্বামীকে নিজের কাছে আগলে রাখা পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগেতার দেওয়া দুফোঁটা জলের বিনিময়ে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কষ্টে পাশে দাঁড়ানো জীবনের অর্ধাঙ্গিনী রূপে ।ওই যে রেবা ঝুঁকে পড়লো স্বামীর মুখে।সে মারা গেল।আর ঐ যে রেবার স্বামী সেই দুফোঁটা কান্নার জলে রেবার মাথায় হাতটা রেখে চোখের পাতা বুঝলো।সেও মৃত। সুখী দম্পতির মতো মৃত্যু এক পথে ,একসাথে। কারুর মনে কারুর জন্য নেই দুঃখ বেঁচে থেকে।

কালো - শুভদীপ দাস || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

 কালো

শুভদীপ দাস


কিছুদিন আগে বিয়ের জন্য রিনা কে দেখতে এসেছিল ছেলেপক্ষ। এর আগে অনেক বারেই সম্বন্ধ এসেছিল তবে কোনো বারেই সেটা বিয়ে অবধি যেতে পারে নি!

 

দুদিন পর ছেলের মা ফোন করে জানায় এখন তারা তাদের ছেলের বিয়ে দিতে চাইছে না। 

প্রতিবারের মতো এবারেও সমন্ধ ভেঙ্গে গেল। 

আসলে রিনার গায়ের রং ঘনকালো আর কালো মেয়েদের জায়গা তো লেখকের লেখনীতেই, বাস্তব জগতে তারা সবদিন কোণাতেই পড়ে থাকে ।। 

           

             

বাড়ি বদল - সুমিত মুখার্জী || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

 বাড়ি বদল

          সুমিত মুখার্জী


আজ শিশিরের মন খুব খারাপ। শিশির রা আজ তাদের পুরনো বাড়িটা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। মাস খানেক আগে রাতে খাবার টেবিলে বাবা যখন বললেন, আগামী মাসে আমরা নতুন বাড়িতে উঠছি এবং এই বাড়িটা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, শিশির তখন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারেনি । কেউ যে এক বাড়ি বদলে অন্য বাড়ি যেতে পারে সেটা শিশির কখনোই কল্পনা ও করতে পারে না । শিশির ভেবে নিয়েছিল সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। তাই নিশ্চিত হবার সে নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটলো । একটু ব্যাথার মতো লাগলো তাই শিশির বুঝলো যে তারা সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছে।


বাবা অন্য জায়গায় বদলী হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই তাদেরকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হচ্ছে। এই বাড়ি টার জন্য শিশির মনে মনে অনেক কষ্ট পেতে লাগলো । হয়তো ছোটবেলা থেকেই শিশির এই বাড়িতেই বড় হয়েছে তাই তার খারাপ লাগাটাও বেশী। এখানকার পথ ঘাট, নদী নালা, এমনকি সব গাছ পালার নামও শিশির জানে। যেসব গাছপালার নাম শিশির জানেনা, সেসব গাছ পালার নতুন নাম শিশির নিজেই রেখেছে আজ বাড়ির কাঁঠাল গাছটাকে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে শিশিরের! গত পাঁচ বছরে সে গাছ টিকে নিজের সন্তানের মতোই আদর যত্নে বড় করেছে সে।


আজ সকালে মাকে নিয়ে শিশির যখন তার স্কুলে সব বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার জন্য ও টিসি আনার জন্য গিয়েছিল, তখন ক্লাসের সবাই শিশিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিল। হৈমন্তী ম্যাডাম যখন আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তখন দুই বছরের বাচ্ছাদের মতো করে কেঁদে দিয়েছিল শিশির। মনীষা যখন শিশিরের দিকে অপলক তাকিয়ে কাঁদছিল আর তার সাদা ইউনিফর্ম এর কোণা দিয়ে চোখের জল মুছছিল তখন তো পাগলের মতো মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে দিয়েছিল শিলির! মনীষাকে কতো পছন্দ করতো শিশির! অথচ কিছুই বলা হয়নি তাকে এটা ভাবতেই শিশিরের বুক ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।


গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে নতুন বাড়ির ঠিকানায়। রাস্তার পাশেই মনীষার বাড়ি, শিশির মনীষা কে একবার বলেও ছিল যে তারা বিকেল চারটায় বের হবে। শিশির তাই বারবার রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখছে কোথাও মনীষা তাকে বিদায় দিতে এসেছে কিনা। মনীষার জন্য একটা চিঠিও লিখেছিল শিশির অথচ চিঠিটা আর হাত বদল হল না। শিশির খুব সাবধানে তার চোখের কান্না আটকাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। হঠাৎ খেয়াল হল চোখের জলে বুক পকেটে রাখা চিঠিটা একদম ভিজে যাচ্ছে শিশিরের চোখের জলে তবুও শিশির চোখের জল কিছুতেই আটকাতে পারছেনা......।।

দরিদ্র্যতা - সৌমেন দেবনাথ || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

 দরিদ্র্যতা

সৌমেন দেবনাথ 


পল্লবের হাতের লেখা খুবই সুন্দর। লিখলে মনে হয় না হাতের লেখা, মনে হয় যেন কম্পিউটারে টাইপ করা। তবে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বলে বানান ভুল করে ফেলে। একারণে খসড়া করে নেয় আগে, দেখে দেখে লেখে। নির্ভুল লেখা আর চমৎকার লেখার কারণে প্রত্যেক দোকানদার তার হাত দিয়েই দোকানের নাম ঠিকানা লিখে নিয়েছেন। হাতে তার রংতুলি নাচে, আর শব্দের পর শব্দ বসে। লেখার নিচে ছোট্ট করে লিখে দেয়-পল্লব আর্ট।


কম্পিউটারেও দক্ষ পল্লব। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাদের কম থাকে, তারা আবার হাতের কাজে চৌকস হয়। কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে গান-বাজনা দেখা তার কাজ না। সে কম্পিউটারের সামনে বসে বসে কাজ শিখেছে। তার কম্পিউটার চালানো দেখলে কেউ বলবে না তার সার্টিফিকেট নেই। এডোবি ফটোশপের কাজ খুব ভালো জানে। দক্ষ দুটি হাতের অনেক মূল্য। সুরুচি কালার ওয়ার্ল্ডে কাজ পেলো সে। ফটোশপের কাজ।


সারাদিন কাজের চাপ। একের পর এক একেকজন আসেন, আর তাদের কাজ করে দেয় সে। বলা লাগে না, নিজের থেকেই চমৎকার করে কালার করে দেয় ব্যানারের লেখাতে। সরকারি লোক আসেন, সরকারি দলের লোক আসেন, বিরোধী দলের লোক আসেন, সমাজসেবী দলের লোক আসেন, বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা আসেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আসেন। নিজেকে সমাজের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলতে কত মানুষই তার কাছে এসেছেন ব্যানার বানাতে তার ইয়ত্তা নেই। কাজ জানা মানুষের কদর অনেক। সবার কাজ আপন মাধুরী মিশিয়ে করে দেয় সে, বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার শিকার হয়, তবুও বিরক্ত হয় না সে। মালিকের কাছেও একারণে পল্লবের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।


বাড়ি থেকে যখন পল্লব বের হয় যেদিকেই তাকায় সেদিকেই ব্যানার দেখে, পোস্টার দেখে আর ভাবে তার হাতের কাজ, তার হাতের ছোঁয়া, তার হাতের মমতা। সবার কাছেই পরিচিত সে, কেউ দেখলেই ডেকে কথা বলে। তার কাজের কারণে এলাকাতে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু তার ভেতর অন্য কষ্ট বিরাজ করে। মাসিক যে টাকা পায় সে, তাতে তার সংসার চলে না। মানুষের ভালোবাসায় তার হৃদয় ভরে, কিন্তু পকেট থাকে ফাঁকা, বাজারের প্যাকেট থাকে ফাঁকা। 


সারাজীবন দল, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির নামে ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট বানিয়েছে পল্লব। আজ তার নামেই সারা অঞ্চল ছেয়ে গিয়েছে পোস্টারে, ধরিয়ে দিন।

সহচরী - সঙ্ঘমিত্রা রায় || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

 সহচরী 

     সঙ্ঘমিত্রা রায় 

                                           এক  

    শ্বশুরবাড়ীতে এসেই মধুরিমা বুঝতে পারে তার পিসিশাশুড়ী বসুধার ভূমিকা এখানে কাজের লোকের মতো ! বসুধা সারাক্ষণ সবার ফাই -ফরমাশ খাটে মন জুগিয়ে চলে ।

       একুশ বছরে একবছরের মেয়ে বাসবীকে নিয়ে বিধবা হওয়া বসুধাকে যখন শশুর বাড়ীর লোকেরা তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন বাপের বাড়ীতে আসে বসুধা । বাবা তখন নেই তার মা বাসনা দেবীর সংসারে কোন আধিপত্য নেই সংসার তখন ভাইয়ের বৌদের দখলে । বড় বৌদি আল্পনা বলেছিলেন ,” দেখ ঠাকুরঝি তোমাদের দুজনকে রাখতে অনেক খরচ লাগবে ।তুমি তো কানাকড়িও নিয়ে আসনি ।তবে এখানে থাকতে হলে তোমাকে খেটে পুষিয়ে দিতে হবে নইলে তোমাকে রাখা সম্ভব নয় তুমি অন্য কোথাও চলে যাও !”

   “ না না বড় বৌদি বল আমাকে কি করতে হবে আমি করব ।তবু তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিও না।“

 “ বেশ আমি কাজের লোককে ছেড়ে দিচ্ছি তুমি এখন থেকে ঘরের সব কাজ করবে দুজন মানুষের খরচা নেহাত কম নয় ।“

 “ ঠিক আছে বৌদি আমি এখন থেকে ঘরের সব কাজ করব । “ 

   সেই থেকে বসুধা সংসারের সব কাজ করে আসছে । বসুধার বাবা অমিয় বসাকের ভালো ব্যবসা ছিল । তিনি খুব লোভী প্রকৃতির ছিলেন। চন্দননগরে উনার বড় বাড়ী আছে। বসুধার বড় দুইভাই অনিরুদ্ধ বড় আর অনির্বাণ ছোট। অনির্বাণ থেকে বসুধা প্রায় চোদ্দ বছরের ছোট। বলতে গেলে এতবছর পর বসুধার জন্ম তার ভাইরা ,বাবা কেউ ভালোভাবে নেয়নি । অমিয়বাবু বাসনা দেবীকে বলেছিলেন ,” এতদিন পর তোমার বাচ্চা হবে লোকে কি বলবে ! তুমি বাচ্চাটা নষ্ট করে দাও ।“

  “ লোকে যা বলার বলুক আমাদের মেয়ে নেই যদি এবার ঘরে লক্ষ্মী আসে ।“

   “ তোমাদের যত কথা মেয়েরা নাকি লক্ষ্মী ! ওকে বড় করে বিয়ে দিতে কত টাকা লাগবে ভেবে দেখেছ ।লক্ষ্মী চলে যাবে আসবে না ।বরং ছেলে বিয়ে দেওয়ার সময় অনেক কিছু নিয়ে আসবে ঘরে । কত লাভ হবে বলতো !”

 “ বেশ তাহলে বাচ্চাটা নষ্ট করার দরকার নেই যদি আরেকটা ছেলে হয় তাহলে আমাদেরই লাভ হবে ।“

 “ ঠিক আছে তাহলে থাক ।“

    কিন্তু ছেলে হয়নি হয়েছিল মেয়ে । এমনিতে মেয়েরা বাপ সোহাগী হলেও বসুধা বাপের আদর ভালোবাসা খুব একটা পায়নি ।বসাক বাড়ীতে ছেলেদের মূল্য বেশী । বসুধা যা আদর ভালোবাসা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে । এরজন্য বাসনা দেবীকে কথা শুনাতেন অমিয়বাবু। বলতেন , “একে বেশী লাই দিয়ে মাথায় তুলো না ।ঘরের কাজকর্ম শেখাও যত তাড়াতাড়ি পারি বিয়ে দিয়ে দেব ।“ 

“ একটু লেখাপড়া না করলে ওর জন্য কি ভালো বর পাওয়া যাবে ।“

 “ সরকারী স্কুলে যতটুকু হয় হবে ।“

   বসুধার দুই ভাই ভালো স্কুলে পড়েছে আর বসুধা সরকারী স্কুলে ক্লাস নাইন অবধি পড়াশোনা কড়েছে। অবশ্য সে পড়াশোনায় ততটা ভালো ছিল না ।তবে বাসনা দেবী তাকে ঘরের কাজ আর খুব সুন্দর সেলাই শিখিয়েছিলেন ।বসুধার হাতের কাজ খুব সুন্দর । বাড়ি থেকে খুব একটা বের হত না । অবসর সময়ে বাড়ীতে বসে নানা ধরনের সেলাই করত। বসুধার সতেরো বছর বয়সের সময় অমিয়বাবু মারা যান। দুই ভাইয়েরই তখন বিয়ে হয়ে গেছে । অনিরুদ্ধ বাবার ব্যবসা দেখছে তার স্ত্রী আল্পনা চাকরী করে ।অনির্বাণ চাকরী করে তার অফিস কলিগ সুচাতাকে বিয়ে করেছে । সবাই নিজের মতো করে আছে ওদের বাড়িতে অবাঞ্ছিত দুটি মানুষ বসুধা আর বাসনা দেবী । কোনরকমে বাড়ীর এককোনে পড়ে আছে দুজনে । সংসারের সব কাজ তারাই করে। বাসনা দেবীর অনুরোধে ভাইয়েরা বসুধাকে আঠারো বছর বয়সে চল্লিশ বছরের একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় ।লোকটার কোন আয় ছিল না তার উপর অসুস্থ ছিল , ভাইদের সংসারে থাকত । স্বামীর রোজগার না থাকায় বসুধা সারাদিন সংসারের সব কাজ করত । এভাবেই বসুধার মেয়ে হয় আর মেয়ের একবছরের সময় ওর বর মারা যায় তারপর থেকে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে কাজের লোকের মতোই আছে বসুধা । 


                                        দুই

      কেটে গেছে অনেক বছর ।বাসবী এখন কলেজে পড়ে , বাসনা দেবী এখন আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না সারাক্ষণ বসেই থাকেন। অনিরুদ্ধবাবুর ছেলে আকাশের বউ হয়ে মধুরিমা বসাক বাড়ীতে এসেছে । তার বাপের বাড়ি বহরমপুরে ।আকাশ ভালো সরকারী চাকরী করে মধুরিমা বাংলায় এম , এ চাকরী পায়নি তবে তার বুটীক খুলার ইচ্ছে অনেকদিনের । সেও ভালো সেলাই জানে । বুটীক নিয়ে কোর্স করেছিল তারপরই ভালো পাত্র পেয়ে ওকে বিয়ে দিয়ে দেন তার বাবা –মা। কথা হল চাকরী যদি না পায় বিয়ের পর বুটীক খুলবে সে ।এতে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কোন অমত নেই।

     মধুরিমা বুটীক খুলার প্লেন করছে মনে মনে কিন্তু একা একা তো আর বুটীক খুলা যায় না । চন্দননগরে সে তেমন কাউকে চেনে না ।

  দুপুরবেলা বাড়ীতে বাসনা দেবী , বসুধা আর মধুরিমা থাকেন । মধুরিমা তার ঘরে একাই বন্ধুদের সঙ্গে ফোন কথা বলে, চ্যাট করে । বাসনাদেবী , বসুধা এদিকে আসেন না পাছে তার ছেলে বৌমারা রাগ করে ।

   কিন্তু মধুরিমার এভাবে থাকতে ভালো লাগে না । সে বরাবরই মিশুকে আগে সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকত । মনে মনে ভাবল ঠাম্মী , পিসি এদিকে না আসলেও আমি তো তাদের কাছে যেতে পারি ,গল্প করতে পারি ।

   বসাক বাড়িটা বেশ বড় । রান্নাঘরের পাশে একটা ঘরে বাসনাদেবী, বসুধা ,বাসবী থাকেন । মধুরিমা ওদের ঘরে গেল তাকে দেখে চমকে উঠলেন দুজনে । সব কাজ শেষ করে দুজনে বসে কথা বলছিলেন ।

   “ তুমি এখানে কেন এলে নাতবৌ ?”

   “ কেন ঠাম্মী আমি তোমাদের কাছে আসতে পারি না ।“

  “ তুমি চলে যাও মধুরিমা আর এসো না দাদা বৌদি জানতে পারলে রাগ করবে ।“ 

  “ কেউ রাগ করবে না ।আমি তোমাদের সঙ্গে গল্প করব , আমাকে কি তোমরা তাড়িয়ে দেবে ।“ 

 “ না রে বোন তাড়িয়ে দেব কেন ! তুমি আমাদের ঘরে এসেছ নাতবৌ আমাদের সৌভাগ্য ।বস চা খাবে বসুধা চা করে নিয়ে আয় ।“

  “ খাব পিসিমনি তুমি নিয়ে আস । “

   বসুধা চলে যায় ।বাসনা দেবী নানা গল্প করতে থাকেন ।মধুরিমা দেখতে থাকে এদের ঘরে কি সুন্দর সুন্দর হাতের কাজ । টেবিলে, চেয়ারে, দেওয়ালে , বিছানায় যাই পাতা আছে সবকিছু কারো সুন্দর হাতের কাজ ।আরও ফেলে দেওয়া জিনিষ দিয়ে ছোট ছোট জিনিষ বানিয়ে রাখা ।

  “ঠাম্মী এসব কে বানিয়েছে ?”

   “ বসুধা বানিয়েছে। ও বেশ ভালো সেলাই জানে ।বিয়ের আগে খুব করত এখন সংসারের সব কাজ করে সময় পায় না ।তবুও নেশা ছাড়তে পারেনি ।যখন সময় পায় একটু আধটু সেলাই করে ।তা এসব করতে টাকাও লাগে কোথায় পাবে বেচারি টাকা !দুটো মানুষ ভাইয়ের সংসারে পড়ে আছে । এখন ওর একটাই চিন্তা কিভাবে বাসবীকে পাত্রস্থ করবে।“

    বসুধা চা নিয়ে এল । বাসনা দেবীকে বলল ,” মা তুমি ওর সঙ্গে আমাদের কষ্টের কথা বলছ কেন । ওদের জগত আর আমাদের জগত আলাদা !“

  মধুরিমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হেসে বলল ,” এভাবে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না পিসিমনি । কি সুন্দর তোমার হাতের কাজ তুমি চাইলে এসব দিয়ে অনেক দূর এগোতে পার । তোমার সব সমস্যার সমাধান হতে পারে !”

 “ কি বলছ তুমি আমার সমস্যার কক্ষনো হবে না !”

 “ হবে তার আগে বল তুমি আমার সহচরী হবে কিনা !”

 “ আমি তোমার সহচরী কি করে হব তোমার আমার বয়সের কত ফারাক!”

 “ তা হোক আমি তোমাকে আমার সহচরী মেনে নিলাম ঠাম্মী তুমি সাক্ষী থেকো । আমি সহচরীকে নিয়ে একটা বুটীক খুলতে চাই ।“

   “ তোমার বুটীকে আমি কি করতে পারি বল !”

 “ যার এতো সুন্দর হাতের কাজ তাকে নিয়ে বুটীক শুরু করলে বুটীকের নাম অনেক দূর ছড়িয়ে যাবে এটা আমার বিশ্বাস !” 

 “ আমিও চেয়েছিলাম সেলাই নিয়ে জীবনে কিছু করব আমি তো আর লেখাপড়া বেশী করিনি । কিন্তু কিছুই হল না জীবনে ।“ 

  “ এখন হবে আমরা দুজনে মিলে একটা বুটীক খুলি দেখি কি হয় !” 

  “ কিন্তু দাদা বৌদিরা হয়তো আমার তোমার সঙ্গে কাজ করাটা মেনে নেবে না ।“

  “ ওসব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও ওরা যখন বাড়ীতে থাকে না তখন তুমি কাজ করবে।“ 

  “ যা বসুধা নাতবৌ যখন সুযোগ করে দিচ্ছে তাহলে লেগে পড় দুপুরে তো এমনিই বসে থাকিস ।“

“ ঠাম্মী তুমি আমাদের আশীর্বাদ কর যাতে আমরা সফল হতে পারি ।“

“ তোরা দুই সহচরী সফল হবি ।আমি প্রাণভরে তোদের আশীর্বাদ করছি।“

    সেই শুরু ।মধুরিমা বু্টীকের নাম রাখে” সহচরী” বুটিক । ওদের বাড়ীর নিচতলায় দুটো ঘর খালি ছিল । মধুরিমা সবার অনুমতি নিয়ে সেখানেই বুটীক শুরু করেছে । বসুধার হাতের কাথা সেলাই , নানা রকম এমব্রয়ডারি সেইসঙ্গে মধুরিমার চেষ্টায় সহচরী বুটিকের শাড়ী , কুর্তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেশ নামডাক করে ফেলে । মধুরিমা প্রচারের জন্য ফেসবুকে পেজ খুলেছে এতে ওদের অনলাইনে বিক্রি ভালোই হচ্ছে । বাসবীও সময় পেলে ওদের বুটীকে এসে সাহায্য করে । মাকে দেখে ,মধুরিমাকে দেখে ওর খুব আগ্রহ বেড়েছে । ওর সঙ্গের কয়েকটা মেয়ে এসে সহচরী বুটিকে কাজ করছে ।

   দেখতে দেখতে চার বছর চলে গেল । সহচরী বুটীকের অনেক নামডাক হয়েছে । বাসবী এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে । মধুরিমা বুটীকের লাভের দুভাগ করে একভাগ বসুধাকে দেয় ।তা নিজেই ব্যাঙ্কে রেখে আসে বাসবীকে সঙ্গে নিয়ে । বাসনাদেবী ,বসুধা , বাসবী খুব খুশী মধুরিমার এই সাহায্যের জন্য । কিন্তু বসুধা এখনও আড়ালেই থেকে গেছে বাড়ীর কেউ জানে না বসুধার কাজের কথা , রোজগারের কথা। তবে আকাশকে বলেছে মধুরিমা । যারা ওখানে কাজ করতে আসে তাদের কাছে বসুধার একটাই শর্ত তার নাম যেন তার ভাই ,ভাইয়ের বউরা জানতে না পারে । ওরা তাদের কথা রেখেছে ।  

     সারা রাজ্যে অনেকগুলো বুটীক মিলে একটা প্রতিযোগিতা হয়েছে তাতে ’ সহচরী’ বুটীক প্রথম পুরস্কার পেয়েছে । দুলক্ষ টাকা আর মানপত্র , কাপ পাবে তারা । সবাই খুব খুশী । পুরস্কার প্রদান সভায় বসুধা ,বাসনাদেবী ,বাসবীকে নিয়ে গেছে মধুরিমা । বাড়ির কারো বারণ সে শুনেনি । পুরস্কার নেবার জন্য যখন মধুরিমাকে মঞ্চে ডাকা হয় তখন সে বসুধাকে টেনে নিয়ে যায় মঞ্চে । বাড়ীর সবাই কানাঘুষো করে বলতে থাকেন “ এটা মধুরিমার একটু বেশী বাড়াবাড়ি !”

  কিন্তু মধুরিমা মঞ্চে উঠে বসুধার কাজ করার ভিডিও দেখায় সবাইকে । আগেই সে সবকিছু ভিডিও করে রেখেছিল । সবাই অবাক বসুধার কাজ দেখে । পুরস্কার নেওয়ার সময় মধুরিমা বলল,” বুটীকটা আমরা দুই সহচরীর তাই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য আমরা দুজনেই ।“

   বিচারক হেসে দুজনের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন ।