শুধু তোমাকেই ভালোবাসি - সংযুক্তা পাল || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

 শুধু তোমাকেই ভালোবাসি

       সংযুক্তা পাল




বরুণ বড্ড সুন্দর। বেশ অনেক মেয়েকে খেলিয়েছে সরি নাচিয়েছে। মানে এখনকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে লিখতে গেলে যা হয়! তো সেই বরুণ প্রেমে পড়ল কার! না ও পাড়ার মন্টির। মন্টি ওর বাবার শাড়ির ব্যবসাটাই ধরেছে। নিজস্ব দোকান। বি.এ পাশ। এই হল যোগ্যতা। আর রূপ। বলব কি! আপনারা শুনে আবার রে রে করে তেড়ে আসবেন না। কারণ সত্যি কথাই বলছি। তাকে আমি ব্যঙ্গ করতে বসিনি। তাকে লোকেরা যা বলে তাই বলছি। আর আমি যদি বলি তবে ও হল কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। শুধু পায়ে নয়, পুরো মুখশ্রী আলোকিত করে রেখেছে ওর হাসি আর টানা টানা দু'টো চোখ। খুব চঞ্চলা আর মিশুকে। ওর পিসিরা ওকে বড় ভালোবাসে। মা নেই বলেই হয়তো। এদিকে পিসিদের আবার দুধে আলতা রঙ। ও মেয়ের রঙ কালো, আবার স্থুলকায়। নিন্দুকেরা বলে কালো মোষ।

আমাদের নায়ক বরুণ আবার ইঞ্জিনিয়ারবাবু তায় রাজপুত্রের মত দেখতে। সকল সুন্দরীদের কাঁদিয়ে মন্টির প্রেমে কি করে ডুবে গেল এটা তারা কিছুতেই আবিষ্কার করতে পারল না। ওদিকে বরুণের মা-কাকিমা কেঁদেই অস্থির। তারা মন্টিকে কিছুতেই বাড়ির বৌ করবে না। 'কেন রে, দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? তুই ওকে নিয়ে কোথাও বেরোতে লজ্জা পাবি। লোকে হাসবে'। বরুণের এত কথায় বয়ে গেছে। জেদ ধরল মন্টি ছাড়া কাওকে নয় বিয়ে। ওকে কেও মেনে না নিলে আলাদা হয়ে যাবে! তবু ওই ভালো। খুব ভালো।


আসলে যা হয়েছে এতদিন সে তো লম্বা ইতিহাস। সুন্দরী মেয়েগুলোর সাথে ঘুরে, খেয়ে, শুয়ে বরুণ এ'টুকু বুঝেছে সব ক'টার রুপের দেমাক। একটা কেও সংসারী না। তা বলে কি সুন্দরী তন্বীরা সংসারী হয় না! নিশ্চয়ই হয়। উদাহরণ ওর মা-কাকিমা। ওরা রুপের আগুনে বাপ কাকাদের ঝলসে মারছে। আর ওর বাবা-কাকারা ভয়েই জুজু যদি সুন্দরী বৌ ছেড়ে চলে যায়! অতএব এরা যেমন করে সংসার করছে মেনে নাও, যেমন করে রান্না করছে মেনে নাও। কেও তো বলতে পারবে না বাচ্চারা পড়াশোনা শেখেনি বা বাড়ির ছেলেরা না খেয়ে অফিস গেছে। তবে কি! ব্যস, ওই জরু কা গোলাম হয়ে থাকতে হবে। এটা হল বরুণের দেখা দু'জন ঘরোয়া সুন্দরী মহিলা। বরুণ তাই ঘরোয়া, সুন্দরীকে আনতে পারবে না। মন্টি মন্টির বিজনেস দেখবে, ও ওর চাকরি। দিনশেষে ওরা ওদের বেডরুমে থাকবে। রুপ.....এতদিন তো ওই আগুন নিয়ে খেলল। এখন অরুচি।

আসলে মন্টিকে দেখে বরুণ হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর যে ওর কোনো চাহিদা নেই। ও ওর মা কাকিমাকে দেখেছে শুধু এই চাই, সেই চাই বলতে। শুধু গয়না আর শাড়ির পাহাড় করেছে লোককে দেখাবে বলে।(এই রে এবার আমায় সবাই জিগাবে, ও আবার কি কথা! শাড়ি তো মেয়েদের জাতীয় পোশাক। মেয়েরা চাইবে না তো কি ছেলেরা চাইবে! আর চাওয়ার কী আছে। তারা রান্না করে, বাচ্চা মানুষ করে। এসব তাদের হক। সে তো নিশ্চয়ই। তবে 'যা কিছু প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাই লোভ'। এই রে। পাটকেল ছুড়বেন না। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, আমি না। তবে আমি মন্টির গুণগান গাইতে বসিনি। ও ওরকমই। ঘুরতে খেতে ভালোবাসে। আপনি ওকে ছেড়া,ফাটা জামা পরিয়ে রাখুন, অপমান করুন। কিচ্ছুটি বলবে না। কিন্তু বেচারীর ঘোরার আর খাওয়ার খুব শখ। ভোজনরসিক যাকে বলে। বরুণ সে'বার মন্টি আর ওর বান্ধবীকে ফলো করে আসতে আসতে নিজে কানে শুনেছে। ব্যস, সেই থেকে শয়নে- স্বপনে মন্টি)


ওদিকে ওর মা-কাকিমা কোনো ভাবেই বরুণকে মন্টির থেকে দূরে আনতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিল। অবশেষে মন্টির বাড়িতে বরুণদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব গেল।


এইসব কথা শুনে কত সুন্দরীরা ঠাকুরের কাছে মন্টির মত হওয়ার জন্য মানত করল তার ঠিক নেই। যদিও শোনা কথা। আমি বাবা কিছু জানি না। কালোরা সুন্দর হয়, ফর্সারাও সুন্দর হয়।কেও অসুন্দর হয় না,কুৎসিত মানুষের মন। আমাকে কিল ঘুষি দিতে আসবেন না। আমি মন্টির গল্প বলতে এসেছি। কালো ফর্সা রোগা মোটা ইত্যাদি বৈষম্যমুলক আলোচনা করতে আসিনি। আমি নিজেও গমরঙা। কেও ভুল করেও ফর্সা বলবে না। যাইহোক তালে-গোলে, গোলে-মালে মন্টি সান্যাল বাড়ির বৌ। শুধু বৌ নয়, একেবারে বিজনেস ওম্যান। বরুণ ওকে অফিস যাওয়ার সময় দোকানে পৌঁছে দেয়। আবার ফিরে রাতে আনতে যায়। মন্টি বাপেরবাড়িতেও কিছুটা সময় কাটাতে পারে। বরুণ আসলে ভালো করেই জানে মন্টিকে ওদের বাড়িতে কেও দেখতে পারে না। ওকে একা পেলে ওর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। তাই ওর এই ব্যবস্থা। বৌকে আগলে রাখে।

এমন ভালোবাসা দেখে লোকে জ্বলবে না তাতো হয় না। কিন্তু বরুণ জানে ও তো আর জরু কা গুলাম হবে না। কারণ মন্টি সেই ধরনের নয়।এরপর দু'জনে লন্ডনে হনিমুন করে আসে। কিছু লোক একেবারে জ্বলে পুড়ে ছাই। এদিকে হিংসুটেদের দলে নাম লিখিয়েছে মন্টির দুই পিসিও। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর কাছে চক্ষুশূল হবে এ তো খুব স্বাভাবিক কথা। কিন্তু তা বলে বাপেরবাড়ির মানুষগুলোর কাছেও। নিন্দুকেরা বলে ও মেয়েই দোষী। আর আমি ওর জন্য সহানুভূতিশীল কারণ ও আমার গল্পের নায়িকা, কর্ণধার গল্পের। অতএব আমার ভাষায় 'হতভাগী'। বরুণ ভাবতো ও ওর বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে মন্টিকে সরিয়ে এনে ওকে ভালো রাখতে পারছে। আদতেই তা নয়। মন্টি ধীরে ধীরে ওর বাবার পরিবর্তন টের পেতে লাগল। বুঝতে পারল ওর বাবা তার ব্যবসা দুই অবিবাহিত বোনকে লিখে দিতে চায়। যেখানে মা হারা ভাইঝিকে তারা মানুষ করেছে, নিজেরা বিয়ে পর্যন্ত করেনি সেখানে তাদের এ হক'টুকু কিছুই না। আর তারা যদি দয়া করে মন্টিকে কিছু দেয় সেটা ওর ভাগ্য। মন্টি তো ওর বরের সাথে সুখেই আছে। আর অত বড়লোক শ্বশুরবাড়ি! এখানে দোকানে এসে রোজ রোজ বসতে হবে না। হায় রে ভাগ্য। বাবা এ'টুকু জানতে চাইল না মন্টির কী ইচ্ছে! ওনার মুখে এক কথা, 'তুই সুখেই আছিস। কিন্তু এ বয়সে তোর পিসিদের আর বিয়ে হবে কি না সন্দেহ'। মন্টি একদিন বরুণকে সব খুলে বলে। বরুণ বেশ অবাক হয়। এরপর মাস তিনেকের মধ্যেই বরুণ মন্টিকে নিয়ে পুনেতে চলে যায়। মন্টি এখানেও ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিল কিন্তু ও টের পায় ও সন্তানসম্ভবা। দেখতে দেখতে তিনমাস কেটে যায়। বরুণ কাওকেই কিছু জানাতে বারণ করে। বরুণের বাড়ি আর মন্টির বাড়ি দু'তরফকেই। বরুণ জানে কেও ওদের ওয়েল উইশার নয়। মন্টির ওপর এত বিদ্বেষ কেন এদের ও বুঝে পায় না। বরুণ সত্যিটা বোঝে। মন্টিকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মন্টির সহজ মাথায় ঢুকলে তো! তবে ও এ'টুকু জানে বরুণ ওকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে।এ তো ওর মৃত মায়ের আশীর্বাদ।তবু মাতৃত্বের সময়টা এমন একটা সময় মন অনেক দুর্বল থাকে। স্বামী ছাড়াও বয়োঃজ্যেষ্ঠ কারো সান্নিধ্য পেতে মন চায়। আর সেই দুর্বলতার সুযোগ নেয় ওর শাশুড়ি। ফোন করে মন্টি ওর শাশুড়িকে। মন্টির শাশুড়ি ফোনের মধ্যেই সুন্দর অভিনয় দিয়ে ওর মন জিতে নেয়। মন্টি ওনাকে আসার জন্য অনুরোধ করে। মন্টির শাশুড়ি এই সুযোগটাই খুঁজছিল। ছেলে যেতে বলে না, বৌ ওদের সংসারে যেতে বলছে। এবার সুদে-আসলে হতচ্ছাড়ীটার ঋণ শোধ করব। কিসের নাতি, কিসের নাতনী! শোনা যায় মুখপুড়ীটার বাপেরঘর থেকেও কেও পোছে না। শুধু আমার ছেলেটাকে বশ করে রেখেছে। ফোন ছেড়ে দিয়েই বরুণের মা দেওরকে টিকিটের ব্যবস্থা করতে বলে দেয়। সঙ্গে তিনি দোসর হিসেবে নিয়ে যাবেন দেওরের মেয়েকেও।


মন্টি বরুণকে বলে ওর মা আসবে।বরুণ তাতে খুব রেগে যায়। ও সোজা বলে দেয় বাচ্চাটার ভবিষ্যত যদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই দায় তবে মন্টির। কারণ বরুণ ওর মায়ের পরিবর্তনের কথা ভাবতেই পারে না। এ অবিশ্বাস্য। মন্টি আশ্বস্ত করে। মানুষের পরিবর্তন হতে কতক্ষণ এও বলে। বরুণ তখন আসল সত্যি বলে। বিয়ের পর বরুণের সামনেই ওর মা রাগের মাথায় মন্টির মৃত্যু কামনা করেছে। মন্টি অন্যদিকে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে পাখিরা তখন গোধূলীর আলোতে বাসায় ফিরতে ব্যস্ত। বড্ড তারা ওদের।

মন্টির শাশুড়ি আর ননদ এসে পৌঁছে যায় পুনেতে। ওদের ব্যবহারে মন্টির মনে হয় ওদের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নিয়তি অন্য কিছু হিসেব করেছিল। বরুণের সাথে মন্টির সুখী দাম্পত্য ওদের চক্ষুশূল ছিল। ধীরে ধীরে মন্টির খাবারে বরুণের মা বিষপ্রয়োগ করতে থাকে। আর একটু একটু করে মন্টি অসুস্থ হতে থাকে। ডাক্তারের কাছে চেকাপে গেলে ডাক্তার মন্টির ওয়েট না বাড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। শেষে আট মাসে বাচ্চাটার আর পালস রেট খুঁজে পাওয়া যায় না। মন্টিও মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেট কেটে মৃত বাচ্চা বের করতে হয়। ডাক্তাররা মন্টিকে বাঁচালেও চিরতরে ওর মাতৃত্ব হারানোর কথা জানিয়ে দেয়। মন্টি বা বরুণ কেও কিছু বুঝতেই পারে না। ওদিকে শাশুড়ি ননদ তাদের কার্যসিদ্ধি করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আর্জি পেশ করে। মন্টি খুব আফসোস করে বলে, 'বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারলাম না। তবে তোমাদের মাঝে মাঝে আসার অনুরোধ রইল'।

এরপরের গল্প কি হতে পারে! বরুণ আর মন্টির মধ্যে কি ভাঙন ধরেছে? নাকি ওরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে অসময়ে একে অন্যের হাত শক্ত করে ধরে আছে? আচ্ছা দুটি মানুষ যারা বাইরে থেকে দেখতে বেমানান হলেও মনের দিক থেকে বড্ড মানানসই তারা মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারলে অন্যদের এত ফাটে কেন?


না, বরুণ মন্টির হাত ছাড়েনি। সেই কথাটা তো বলিনি। মন্টির লাস্ট চেকআপের সময় ডক্টর বলেছিল, স্লো পয়েজনিংএর আশঙ্কার কথা। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। প্রথম দিকে ডক্টর ধরতে না পারলেও পরে পেরেছিল। এর জন্য মন্টির শাশুড়ি কোন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করেছিল, তার কম্পোজিশন কি, কোথা থেকে তিনি পেয়েছিলেন এরকম ওষুধ অত ডিটেল দিলাম না। শুধু মন্টির মন থেকে কারো প্রতি বিশ্বাস ব্যাপারটা চলে গিয়েছিল। বরুণের কথা আলাদা। ভালোবাসার মানুষ সাচ্চা হলে সব বাধা পেরোনো যায়। মন্টির পুনরায় মা না হতে পারার কথাটা বরুণ ছড়িয়ে দিয়েছিল ওর মা-বোন আর ওর বাড়ির লোকের মধ্যে। ওর মা-বোন কলকাতায় ফিরে যেতেই বরুণ আর মন্টি উড়ে গেল এক নতুন দেশে। যে দেশের ঠিকানা কেও কখনো জানবে না, ওরা জানতে দেবে না কাওকে। আর রাজপুত্র নয়তো রাজকন্যা ঠিক আসবে আবার, তার সময় মতো। বরুণ মন্টিকে ভালোবাসে এটাই দিনশেষে সত্যি কথা আর শেষ ।



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024