উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -36


 

দেখলাম শ্যামলীদির চোখ দুটো ধীরে ধীরে বাষ্পাকূল হয়ে উঠলো। ও ঠোঁট কাঁপতে শুরু করলো। সেও তো একদিন সুখী সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখছিলো। স্বামী সেবা করবে, গৃহবধূ হয়ে সংসারে দায় দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু তার জীবনে সমস্ত আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া পাওয়া হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেলো ।


 গভীর যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে শ্যামলীদি নিজের আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জলকে মুছবার চেষ্টা করলো। দেবীদাস তা লক্ষ্য করল ও এও বুঝতে পারলো শ্যামলী পদ্মার মতোই সমদুঃখিনী।

 দেবীদাস শ্যামলীকে নম্রকণ্ঠে বলল, আমি যে জন্যে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি, তা বলা হয় নি। তোমার সাথে আমার যে কি মধুর সম্পর্ক আছে তা হয়তো জানো না। তোমার মা আমাকে পুত্রের মতো দেখেন। তোমার দাদা সুভাষ আমার বন্ধু, সুতরাং তুমি আমার বোনের মতো কোন চিন্তার কারণ নেই, আমরা সকলে মিলে যত শীঘ্র পারি তোমাকে কারামুক্ত করবো। আমি আজই তোমার দাদার সাথে আলোচনা করবো। আজ আমরা বিদায় নিচ্ছি, পরে খুব শীঘ্রই তোমার কাছে আসছি।

 দেবীর মুখ থেকে এই কথা শুনে জেল কপাটের রেলিং ধরে স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্যামলীকে দেখে দেবীদাসের মনে হলো, তার ঘৃণ্য জীবনের আবর্জনার মধ্যেও পদ্মার মত একটি সুখী সংসার খোঁজ পাওয়ার জন্য মনে মনে কাতর আকুতি জানাচ্ছে।

 শ্যামলী যখন অতীতের ধঞ্জা বিধস্ত জীবনে দুঃখ ও বেদনার সাগরে হাবুডুব খাচ্ছিলো সে সময় দেবীদাস সেখানে উপস্থিত হতেই শ্যামলীদি কিছুটা শান্তির আশ্রয়

খুঁজে পেলো। শ্যামলীদির মুখপানে তাকিয়ে থেকে কখন যে বাইরে এসে উপস্থিত হলাম টের পেলাম না।

 পরদিন দেবীদাসের সাথে যখন কয়েক জন লোক বাড়ীতে প্রবেশ করলো, তখন মনে হলো ওদের সাথে আমার যেন না পরিচয় হয়। আমি জানতে পারলাম এরা কারা, বা কেন এখানে এসেছে এবং আমাকে শ্যামলীদির নিয়ে কথা জিজ্ঞেস করবেন এর কোন ব্যতিক্রম নেই। শ্যামলীদির বাবার চেহারা দেখে মনে হলো তিনি গম্ভীর, নিষ্ঠাবান আভিজাত হলেও তার দেহমন একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। হয়তো শ্যামলীদির চিন্তায় শরীরের ঐরূপ দুর্দশা। সমস্ত সুখ, উল্লাস ও জীবনের আমোদ-প্রমোদকে পরিত্যাগ করে শ্যামলীকে খুঁজে পাবার জন্য চাতক পাখীর মত পথ চেয়ে থাকেন। মনে হয় আমর কাছে শ্যামলীদির সংবাদ শুনে মনকে অনেকখানি সান্ত্বনা দেবেন।

 কোন সময় যে দেবী আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। ওর ডাক শুনে নিজের স্বম্বিৎকে ফিরে পেয়ে ওকে বললাম, আমার ঘৃণ্য অতীত ওদের সামনে উদ্ঘাটন করা কি আমার পক্ষে উচিত হবে ?

 দেবীদাস সাহস দিলো বলার জন্য। কারণ শ্যামলীকে যদি বাঁচাতে হয় তাহলে উকিল বঙ্কুবাবুর কাছে প্রকাশ করতেই হবে। তিনি শ্যামলীর গোপন সূত্র ধরে শ্যামলীর পক্ষে লড়াই করবেন। শ্যামলীকে বাঁচাতেই হবে, এ আমার কর্তব্য। তাই, একথা চিন্তা করে শ্যামলীদির পঙ্কিল জীবনের ইতিহাস একে একে প্রকাশ করলাম ওদের নিকট।

 বঙ্কুবাবু আমার কাছে শ্যামলীদির ঘৃণ্য, কদর্য ইতিহাস শুনে কিছুক্ষণ হেঁট মস্তকে থেকে ধীরে ধীরে মুখ তুলে বললেন, আমি তোমাকে কতকগুলো প্রশ্ন করবো, আশাকরি সঠিক উত্তর দিও।

 ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। তিনি বললেন, তোমার সাথে শ্যামলীর ঐ বস্তীতেই

 পরিচয় ? হ্যাঁ।

 তোমাকে সে বোনের মতো ভালোবাসতো?

 হ্যাঁ।

 তাহলে আদালতে সাক্ষী দিতে পারবে?

 হ্যাঁ।

 শ্যামলী যে রন্টুকে খুন করেনি একথা বলতে পারবে?

 হ্যাঁ বলতে পারবো।

 বন্ধুবাবু আমাকে বললেন, এই সাহসটুকু রেখ মা। আমার বিশ্বাস সে সাহস তোমার আছে। কারণ তোমার কাহিনী শুনে জানতে পারলাম শ্যামলী তোমাকে
গভীরভাবে ভালোবাসতো। আমার মনে হয় তোমার জন্যই শ্যামলীকে কারামুক্ত করতে পারবো।

বন্ধুবাবু শ্যামলীদির বাবার মুখ পানে তাকিয়ে বললেন, কোন চিন্তা করবেন না বিকাশবাবু। কোন কেসে হারিনি। এই কেসেও হারবো না। কিভাবে কেশ ফাইল করবো তার পরিকল্পনা অতি শীঘ্র করছি।

দেবীদাসের কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি তোমার মানবিকতার পরিচয় পেয়ে যারপর ন্যায় সন্তুষ্ট হয়েছি। পতিতাদের জন্য আমাদের সমাজ দায়ী। অনেকাংশে এর জন্য আমরা অপরাধী। আমাদের সমাজের নারী জাতি দারিদ্রের দুর্বিষহ জ্বালা উপেক্ষা করেও কোন মতেই তারা নারীত্বকে নিয়ে ছেলেখেলা করে না। নারীত্বের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস গৌরবজ্জ্বল। সমাজের কতিপয় স্বার্থান্ধ ও উৎশৃঙ্খল যুবক নারীদের অসহায়েত্বে ও দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাদের পাপ পথে পরিচালিত করে এবং নিজেদের লালসার ইন্ধন যোগায়।

দেবীদাস তুমি যা করছো তার জন্য বর্তমান সমাজে তুমি অভিনন্দন যোগ্য। আমি কথা দিচ্ছি শ্যামলী মাকে মুক্ত করবই। তোমার প্রতি প্রীতি হয়ে আমি আশীর্বাদ করছি, তুমি সুখী হও ও দীর্ঘজীবি হও।

বন্ধুবাবু আমার মস্তকের কেশ স্পর্শ করে বললেন, তোমারও জীবন মধুময় হোক মা। বিগত দিনের ঘৃণ্য কাহিনী তোমার মনকে যেন কখনো আবিষ্ট করতে না পারে।

বঙ্কুবাবুর কথা শেষ হতেই আমি ধৈর্য্য ধরতে না পেরে তাকে আমি ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানালাম তিনি পুনরায় বললেন, আমি তোমাকে কায়মনো বাক্যে বলছি তোমার জীবন মধুময় হবেই। আমার আশীর্বাদ বিফলে যাবে না মা। দেবীদাস যখন তোমাকে গ্রহণ করেছে তখন তুমি নিশ্চিন্ত আশ্রয় লাভ করেছো। আজ আসি মা। পরে আবার আসবো।

তারা উভয়েই প্রস্থান করলেন। তাদের পিছন পানে তাকিয়ে থাকলাম। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নিষ্প্রভ জ্যোতির ন্যায় চিক চিক করতে থাকল। এক সময় দেবীদাসের ডাকে আমার তন্দ্রা কাটলো।

দেবীদাস আমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলল, কারণ আমার সাথে রেজেষ্টারী ম্যারেজ নিয়ে আলোচনা করবে। বঙ্কুবাবু আমাদের সম্পূর্ণ সহযোগীতা করবেন। তবে তারপূর্বে সুশীলবাবুর সাথে আলোচনা করতে হবে। আজকে সুশীল বাবু আসবেন। দেবীদাসের কাছে শুনেছি সুশীলবাবু দেবীর বাবার বিশ্বক্ত বন্ধু এবং শিল্পকার্য্যের পরিচালনার ভার তার উপর দিয়ে গেছেন। তিনি একজন বিশিষ্ট মানুষ, সৎ ও জানি না সেই পর উপকারী মানুষটির বিচারে আমার ভাগ্যে কি পরিবর্তন ঘটবে। পরোপকারী। জানি না আমি জয়ী হতে পারবো কিনা। শত চিন্তা ভাবনাকে মুক্তি দিয়ে বাড়ীর কাজে মনযোগ দিলাম।

 রাত্রে সুশীলবাবু কখন যে দেবীর বৈঠকখানায় হাজির হয়েছেন জানতে পারিনি। প্রয়োজনে দেবীকে ডাকার জন্য বৈঠকখানায় উপস্থিত হতে, উভয়ের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো । দুজনের আলোচনার মধ্যে আমার উপস্থিতি কোন কাম্য নহে শুধু আড়াল হতে সুশীলবাবুকে দর্শন করে তার উদ্দেশ্যে মনে মনে বললাম, আমাদের এই নবজীবনের প্রবেশের পথে তোমার বিচার যেন কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে। অন্তরযামী জানেন কি পঙ্কিল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আজ আমি সামাজিক মর্য্যাদা ও নারীত্বের গৌরব লাভ করতে চলেছি।

 হঠাৎ সুশীলবাবুর গম্ভীর কণ্ঠস্বর আমার কানের মধ্যে প্রবেশ করতেই আমার চমক ভাঙ্গলো। তিনি দেবীকে বলে চলেছেন, ছিঃ ছিঃ দেবী, এ অন্যায় আমি মেনে নিতে পারবো না। তুমি নিশ্চয় জানো আমি তোমার বাবার একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ও বিশিষ্ট বন্ধু। সেই বিশ্বাসের “রজ্জু বন্ধন” ছিন্ন করতে বলো না। এক বারবনিতাকে কি করে তোমার বধূ রূপে স্বীকৃতি দেবো।

 দেবী বলল, এই বারবনিতার সামাজিক পদস্খলেনর জন্য আমি দায়ী। আমার অমানবিক ও অবিবেচনা প্রসূত কাজের জন্য একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় জমিদারের পৌত্রী বাধ্য হয়ে পতিতা গ্রহণ করেছে। আমার অন্যায়ের জন্য জমিদার সীতাংশুশেখর বাবু জমিদারী ত্যাগ করে পথের ভিখারী হয়ে মহানগরীর ফুটপাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সুমন্তর খুনের ব্যাপারেও বর্ণণা করলো।

 দেবীদাসের কথা শুনে সুশীলবাবু বললেন, কি বললে! রমার বাবার নাম সীতাংশুশেখর সিংহ।

 হ্যাঁ।

 ওর দাদুর নাম জানো ? ব্রজকিশোর সিংহ।

 বাড়ী ?

 চন্ডীপুর।

 সুশীলবাবু একদৃষ্টে জানালা পানে তাকিয়ে থেকে কিসের চিন্তায় যেন মগ্ন হলেন। আমি ঐরূপ সুশীলবাবুর অবস্থা দেখে বা বাবার ও দাদুর নাম জিজ্ঞেস করতেই গভীর কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। মনে হলো দৌড়ে গিয়ে সুশীলবাবুকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করি তিনি কি আমার বাবা ও দাদুকে চিনতেন ? যদি চিনতেন তাহলে তাদের সঙ্গে সুশীলবাবুর সম্পর্ক কি। কিন্তু পারিনি, মনের কথা মনেই চাপা দিয়ে রাখলাম।
এক সময় সানন্দে সুশীলবাবু বিয়েতে সম্মতি দিলেন। আর এও বললেন বিয়ের দিন স্থির করে তাকে যেন জানান হয় । বিলম্ব না করে তিনি দরজার কাছে এগিয়ে এসে আমার সজল নয়ন পানে তাকিয়ে বললেন, তুমি সুখি হও মা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি তোমার জীবন এবার মধুময় হোক। একদিন সময় করে এসে তোমার সাথে গল্প করব। আজ সময় নেই।

বাধা দেব ভাবলাম কিন্তু পারলাম না। তিনি ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি গভীর দৃষ্টি নিয়ে তার পিছন পানে তাকিয়ে দরদর করে চোখের জল ফেলতে শুরু করলাম।


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024