Tuesday, February 28, 2023

Photography - Sikha Sengupta


 










ছবি পরিচিতি 

1,2 নং বর্ধমান নবাবহাটের 108টি শিবমন্দির

3, 4,5 নং দরিয়াপুর ডোকরা গ্রামে ডোকরা শিল্প

5 নং গুসকরার কাছেই ওরগ্রাম ফরেষ্ট

6 নং দরিয়াপুর ডোকরা গ্রামে আমাদের মহিলাদের টিম।

(যদিও এটি মেয়েদের একদিনের বেড়ানোর কাহিনী, এর মধ্যে আমরা গিয়েছিলাম হস্তশিল্পের ডোকরা গ্রাম দরিয়াপুরে।)


     মহিলাদের একদিনের শীতকালীন ভ্রমণে ডোকরার হস্তশিল্প গ্রাম দরিয়াপুরে যাওয়া।

                      __________

 অনেক দিনের পরিকল্পনা শেষে আমাদের 50 জনের মহিলাদের গ্রুপ, গত 19শে ডিসেম্বর 2021 একদিনের জন্যে সংসারের দায়দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দু'টো ট্রাভেলার গাড়িতে গ্রামের মুক্ত বাতাস নিতে। আমরা যাব বর্ধমানের নবাবহাটের 108 শিবমন্দির, দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পগ্রাম ও গুসকরার কাছে ওড়গ্রাম ফরেষ্ট। গড়িয়া, এসপ্লানেড শ্যামবাজার হয়ে গাড়িদুটি চিড়িয়া মোড় এলে আমরা ক'জন চটপট উঠে পড়লাম, এরপর দক্ষিনেশ্বর বালিঘাট থেকে মেয়েরা উঠে 50 জন পুর্ন হতেই গাড়ি হাইওয়ে দিয়ে হু হু করে ছুটতে লাগল। শীতে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে আরামদায়ক গাড়িতে চলল মেয়েদের হাসি গল্প গান। সবার টিফিন ভাগ করে খাওয়া হল।ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে এসে গেল বর্ধমানের নবাবহাট। হাইওয়ের পাশেই একশো আটটি শিবমন্দির। বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, আমরা শাল জড়িয়ে রাস্তার ওপারে ঝুপড়ি দোকানে মাটির খুরিতে দুধ চা খেয়ে এলাম। বেশ ভালো কোয়ালিটির স্বাদু চা। গাড়িতে চপ্পল রেখে,গেটের মুখে টেবিল পেতে বসা ভদ্রলোকের দেওয়া স্যনিটাইজার হাতে মেখে, মোজা পায়ে আমরা শান বাঁধানো 108 শিবমন্দির চত্বর পরিক্রমা করতে লাগলাম। প্রত্যেকটি মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে। কোন কোন মন্দিরে ধুপধুনা কাসর ঘন্টা সহযোগে পুজা হচ্ছে।আমাদের কিছু মহিলা পুজো দিলেন। বেশ অনেকটা জায়গা, গাছপালা গোলাপ বাগান, পুকুর নিয়ে বিস্তৃত এলাকা।চার পাশ দিয়ে 108 টি শিবমন্দির ঘিরে রয়েছে।এখানে খোদিত একটা ফলক থেকে জানা গেল 1788 সালে বর্ধমান রাজপরিবারের মহারানী বিষণকুমারী দ্বারা এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের আদলে তৈরি এই একশো আটটি শিবমন্দির যেন লকেটসহ একশো আটটি রুদ্রাক্ষ দিয়ে তৈরি মালা।1965 সালে আবার এটিকে ভালোভাবে সংস্কার করা হয়। হালকা মিঠে সকালের রোদে এত নানারঙের গোলাপ বাগান,শিবমন্দির পরিক্রমা একটা সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে।

 আমাদের ট্রাভেলার হাইওয়েতে গিয়ে স্পীড নিল।অল্প সময় পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম দরিয়াপুর ডোকরা শিল্প গ্রামে। ঢুকতেই বিশাল গেটের একপাশে পিতলের প্রমান মাপের ডোকরা শ্রমিক পরিবার,স্বামী,স্ত্রী বাচ্চা কোলে। অপর গেটে ডোকরার নানা কারুকার্য করা। ঢুকে ডানদিকে বেশ বড় তিনটি ব্রোঞ্জের মুর্তি। পাশের পাঁচিলে পিতলের ডোকরা সপরিবারে দুর্গামায়ের অসুর নিধন খোদাই করা।এমনকি  

অন্যান্য পাঁচিলেও বিভিন্ন পিতলের ডোকরা শিল্পের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ডান পাশে খড়ের ছাউনির নীচে বড় লম্বা জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে থেকে শিল্পী মহিলা পুরুষেরা চিমটার সাহায্যে তপ্ত লাল ধাতব পদার্থ বের করে অন্য একটি লোহার দন্ডের দ্বারা নানারকম আকার দিচ্ছে,দেখে চমৎকৃত হতে হয়। ঢুকেই ঘাসজমির মাঠ, তার মাঝে উচুঁ গোল সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা। চারদিকে চারটি প্রমান মাপের ডোকরা মানব মুর্তির স্তম্ভ ছাদ ধরে রেখেছে। এবার গেলাম সামনের বিল্ডিং এর নীচে বড় হলে। সেখানে মেঝেতে শিল্পী মহিলারা তাদের ডোকরা শিল্পদ্রব্য নিয়ে বসেছেন বিক্রির জন্য।সাধারন পোষাকের ঘরোয়া এই মহিলাদের হাতের কাজ দেখলে অবাক হতে হয়। ধাতুকে আগুনে গলিয়ে অপূর্ব শিল্পসুষমামন্ডিত নিখুঁত রূপ দিয়েছেন। বলা হয় উড়িষ্যার এক আদিবাসী গোষ্ঠী এখানে বসত করে তাদের এই ডোকরা শিল্পধারা বজায় রেখেছেন। এখানে যে মহিলা শিল্পীরা বিক্রি করছেন, তারা বাঙালি, সবার পদবী কর্মকার।কত রকমের যে শিল্পদ্রব্য দেখলাম,পেঁচা,গণেশ,শ্রমিক দম্পতি, হারের লকেট,দুর্গাপ্রতিমা,গরুর গাড়ি ইত্যাদি অনেক রকম। কয়েকটি পালিশ করা শিল্প নিদর্শন একেবারে সোনার মত দেখাচ্ছে।আমরা সবাই কিছু কিছু জিনিস কিনলাম।তারা অনেক কষ্ট করেই এই শিল্পধারা ধরে রেখেছেন। এই গ্রামে আমাদের মত ট্যুরিষ্টরা যা কেনেন এবং বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় বিক্রি করেই যে আয় হয় তাতে তাদের নিজেদের মোটামুটি চলে যায়।

 এখান থেকে কয়েক কিমি দুরে গুসকরার কাছে ওড়গ্রাম বনভুমির মধ্যে একমাত্র রিসর্টে আমরা দুপুর দুটোর সময় পৌঁছলাম লাঞ্চের জন্যে। একতলার বড় হলে বড় বড় টেবিল ঘিরে আমরা পঞ্চাশ জন একবারে বসে পড়লাম।আগে থেকে বলা ছিল তাই তারাও গরম ভাত,শুক্তো,সবজি দিয়ে মুগ ডাল, গরম বেগুনি,পাবদা মাছ,মাটন,চাটনি, পাঁপড়,নলেন গুড়ের রসগোল্লা পরিবেশন করলেন। খেয়ে দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আমরা সামনের লনে বিকেলের মিঠে রোদে বিশ্রাম নিলাম।ড্রাইভার ভাই দুজনের খাওয়া হয়ে গেলে বাসে করে বনের কাঁচা মাটির পথে বনভুমি দেখতে দেখতে চললাম। বনের মধ্যে সুর্য্য অস্ত যাচ্ছে। পাহাড়, সাগরের সুর্যাস্ত থেকে এ এক স্বতন্ত্র মায়ামোহময় দর্শন।কাঁচা মাটির সংকীর্ণ পথে বাস আর যাবে না। শুনেছিলাম বন শেষ হলে একটি পরিত্যক্ত এরোড্রম আছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে বিমান ওঠানামা করত।স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসা করতে বললো,"ওই হোথা,বন শেষ হলি চাতাল।" তা চাতালই বটে!পুরোন ইট সুরকির বাঁধানো অনেকটা প্রশস্ত জায়গা,দু'পাশে ফসল কেটে নেবার পর বিশাল মাঠ দিগন্তে মিশেছে। ড্রাইভাররা এসে তাড়া দিল। সন্ধ্যা নেমে আসছে।এই বিশাল অরন্য প্রান্তরে অন্ধকারে পথ হারালে সমূহ বিপদ। তাড়াতাড়ি আমরা সবাই বাসে উঠে বসলাম। এবার ফিরতে হবে। 'মন চল নিজ নিকেতনে'। বাস হাইওয়ে এসে স্পীড নিল। শক্তিগড়ে একবার থামলো।আমরা বাড়ির জন্যে ল্যাংচা ও ছানাপোড়া মিষ্টি কিনলাম।রাত্রি পৌনে ন'টা থেকে যার যার স্টপে নামা শুরু হল। বাড়ি ফিরে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সবার খোঁজ নেওয়া হল। রাত্রি দশটার মধ্যেই সবাই নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছে গেছে।এইভাবে শেষ হল আমাদের পঞ্চাশ জনের মহিলাদলের সফল একদিনের আনন্দময় ভ্রমণ।

               _____________



No comments: