উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -37


 



সেদিন রাত্রিযাপন যে কিভাবে করলাম তা প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল না। শত যন্ত্রণা দুঃখ ও নির্যাতনের পরে যে একটুখানি হাসির রেখা মুখে ফুটে উঠবে তা কল্পনা করিনি। দেবী আমাকে দিন কয়েক পরেই রেজেষ্টারী করে বিয়ে করবে। যদিও আমি বলেছিলাম তার বাবার আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে সে শোনেনি।


 আমি এই কারণে বলেছিলাম বা ইচ্ছে ছিল, যখন দেবীর জীবন তরণীর কর্ণধার হয়ে সেখানে যাবো তখন একেবারে সব বাধা বিঘ্নকে দূর করে ভবিষ্যৎ গার্হস্থ জীবনকে মধুময় করতে পিছনের কোন গ্লানি বা সাংসারিক চিন্তা রাখবো না। হয়তো এমনও হতে পারে দেবীর বাবা আমার পরিচয় জেনে ফেললে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিলে আমার স্বপ্নের গড়া স্বর্গ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বরং সেই দুর্নাম বা ওদের আভিাজত্যকে কোনরূপ নষ্ট করার আগেই সরে পড়া অনেক ভালো।


 আমার কথা শুনে দেবীদাস আমায় বলল, তার বাবা যদি আমাকে কোন প্রকারে অস্বীকার করেন তা মানবে না। প্রয়োজন হলে বাড়ী হতে বেরিয়ে গিয়ে আমাকে নিয়ে অন্যত্র সুখের নীড় বাঁধবে। তাতে যদি বাবা তাকে তাজ্য পুত্র বলে ঘোষণা করেন তাতে তার কোন আপত্তি থাকবে না। কারণ সে তার ভালবাসার পাত্রীকে কিছুতেই উপহাস্যস্পদ হতে দেবে না। ময়নার মা হারানোর দুঃখকে যখন রমা নিজের মাতৃস্নেহ দিয়ে ঘুচিয়ে দিয়েছে তখন রমার কৃতজ্ঞতা দেবীদাস কোন দিন ভুলতে পারবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। আমার কলঙ্কিত অতীত জীবনকে বার বার স্মরণ করিয়েও আমি তাকে এই পথ হতে বিচলিত করতে পারিনি। অবশ্য আমার অজ্ঞাতসারে আমার নারীমন কখন যে তার হৃদয়ের মধ্যে একটা স্থান করে নিয়েছে তা আমি জানি না। দেবী আমাকে কোন প্রকারে ত্যাগ করবে না শুনে আমার চক্ষু হতে কত বার আনন্দাশ্রু ঝরে পড়েছে। বিশেষ করে তার বাবার আগমনের কথা শুনে আমার মন অজ্ঞাত আশঙ্কায় ভরে উঠেছিল। বিয়ে আমাদের অতি শীঘ্র হবে। কিন্তু আমাদের পরিনয়ের শুভ রাত্রির


পূর্ব্বে শ্যামলীদির কারা মুক্তির বিশেষ প্রয়োজন তা না হলে এই শুভদিন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।


কিন্তু সে আশা পূর্ণ হয়নি। তার আগেই শ্যামলীদি কারামুক্তির পথ নিজেই খুঁজে পেয়েছিলো। অভিমানীনি কন্যা কোন প্রকারে তার বাবাকে কলঙ্কিত মুখখানি দেখাতে রাজী হয়নি। পিতা-মাতাকে নিজের মুখ দেখানোর আগেই সে কারাভ্যস্তরে আত্মহত্যা করেছিলো। নিজেদের পরামর্শ মতো আমরা সকলেই সেদিন শ্যামলীদির কারাকক্ষের কাছে উপস্থিত হয়েছিলাম। শ্যামলীদি কারাকক্ষ হতে মুক্ত বাতাসে আসবে। আমরা সকলে তাকে আনতে যাবো। অরূপবাবু বহু পরিশ্রম করে শ্যামলীদিকে জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। শ্যামলীদি পুনরায় আমাদের মাঝে উপস্থিত হবে শুনে মনটা আনন্দ বিহ্বল হয়ে উঠেছিলো।


আমরা সকলে কারকক্ষের কাছে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে আছি কখন শ্যামলীদি বেরিয়ে আসবে। অরূপবাবু উপস্থিত হয়ে শ্যামলীদির বেরিয়ে আসার দেরি দেখে জেলের মধ্যে প্রবেশ করে খোঁজ নিতে গেলেন। দেবীদাস ও সুভাষদা আলোচনায় মগ্ন। তারা সকলেই আগের মতো শ্যামলীদিকে আদর করবে। সে সুস্থ সমাজ জীবন থেকে অধঃপতিত হয়ে গেছে বলে ঘৃণা করবে না। আমার বারবার তখন মনের মধ্যে এই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। যারা পতিতা এবং ভ্রষ্টা, তারা যদি প্রত্যেকেই কখনও দরদী মনের স্নেহস্পর্শ লাভ করে, তাহলে সমাজ জীবনে তারাও আবার অন্যান্যদের মতো পিছনের কলঙ্কিত জীবনের ঘৃণা কাহিনী ভুলে গিয়ে সুস্থ সমাজ ও মধুর গার্হস্থ জীবন গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু কে তাদের সমবেদনা জানাবে।


হঠাৎ এক সময় অরূপবাবু শোকের ঝড় নিয় আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন। ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য্য হয়ে বললেন শ্যামলীদির বাবা। অরূপবাবু আপনি নীরব রইলেন কেন? তবে কি শ্যামলীর জামিন হবে না?


অরূপবাবু অতি ধীর কণ্ঠে বললেন, শ্যামলীকে জামিন নেবার জন্য আর বেগ পেতে হবে না। সে আর ইহজগতে নেই। নিজে মুক্তি নিয়েছে সেই সঙ্গে আমাদিগকে মুক্তি দিয়ে গেছে। এই পত্রটা পড়লে বুঝতে পারবেন।


শ্যামলীর বাবা ব্যাকুল হয়ে পত্রটার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছোট্ট ছেলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমরা সকলে মুষড়ে পড়লাম প্রিয়জনের বিরহ বেদনায়। আমার বুক কঠিন পাষাণ হয়ে গেলো। দেবীদাস পত্রটা পড়ে গোপনে চোখের জল মুছে আমার হাতে পত্রটা তুলে দিলো। আমি বহু কষ্টে কোন প্রকারে চোখের জলকে সংযত করে পত্রটা পড়তে শুরু করলাম। শ্যামলীদি লিখেছে,


স্নেহের পদ্মা,




তোকেই এই শেষ পত্র লিখছি তুই আমার অন্তিম স্নেহ ভালবাসা গ্রহণ করিস। আমি তোদের কাছ হতে চিরবিদায় নিচ্ছি বলে আমাকে ক্ষমা করিস। আত্মহত্যা ছাড়া কোন উপায় ছিল নারে। তুই তো জানিস আমি এর আগে মৃত্যু বরণ করতে পারতাম, কিন্তু কেন করিনি তা তো জানিস। এবার আর ধৈর্য্য করতে পারলাম না এই কারণে, যখন শুনলাম আমাকে পুনরায় বাবার কাছে যেতে হবে। একদিন বলেছিলাম তোকে, আমার এই কলঙ্কিত মুখ কোন প্রকারে বাবাকে দেখাতে পারব না। কারণ দেবতুল্য পিতাকে অপমান করে এক লম্পটের সাথে বেরিয়ে গিয়ে নিজের জীবনকে কলঙ্কে পরিণত করেছি। সে পিতার কাছে কিভাবে দাঁড়াই বলতো? পারলাম নারে তোদের সাথে মিলেমিশে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে। যে দিন জানতে পেরেছিলাম দেবীদাস দাদার বন্ধু, সে আমাকে জেলে থাকতে দেবে না, সেদিনই আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে নিয়েছিলাম।


গতকাল যখন জেলের অধিকর্তা আমাকে বললেন, আমি মুক্ত বাতাসে যাবার পারমিশন পেয়েছি, ভাবলাম কেন আমার দ্বারমুক্ত করলেন। আমার যে বাইরে বেরুবার মতো কোন মানসিক অবস্থা নেই। তা হলে কেন আমাকে মুক্তির পথ দেখালেন।


আমার উপর অভিমান করিস না বোন। আমিও চেয়েছিলাম পাঁচ জন মেয়ের মতোই বাঁচতে, কিন্তু পারলাম না। বেশী কথা লেখার মানসিকতা নেই, পরপারের বাঁশী আমার কানে বাজছে, বলতে ইচ্ছে করছে, ‘মরনকে তুঁউহু মম শ্যাম সমান'।


শেষে লিখি যে, যদি কোন দিন বাবার সাথে দেখা হয়ে থাকে তাহলে বাবাকে বলিস, এই পাপীষ্ঠাকে যেন ক্ষমা করেন। আর তোরাও একটু কামনা করিস আমার আত্মা যেন একটুখানি শান্তি পায়।


                      শুভেচ্ছান্তে, 

                 হতভাগিনী শ্যামলীদি


চিঠিটা পড়ার পর দুই চক্ষুকে কোন প্রকারে সামলাতে পারিনি মাতৃহারা মেয়ের মতো কাঁদতে থাকলাম। বারবার বিরহ যন্ত্রণায় দারুনভাবে শোকাহত হয়ে বারংবার অভিযোগ ও ধিক্কার দিয়ে বলতে থাকলাম, কেন ভুল করলে শ্যামলীদি। তোমার পাপ, তোমার অজ্ঞাত ভুল-ত্রুটিকে তোমার বাবা মেনে নিতেন, তাহলে কেন আমাদের কাছে ফিরে এলে না? পথভ্রষ্টা নারী হলেও তুমি আবার নতুনভাবে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা শুরু করতে পারতে।


চাপা দীর্ঘশ্বাসে আমার বুকে যেন বিচ্ছেদের শত শত বান এসে বিদ্ধ করতে লাগলো। মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে থাকলাম। এক সময় শ্যামলীদির শবদেহ এক ট্রেচারে বহন করে সরকারী এ্যাম্বুলেন্সের কাছে নামালো। কোন প্রকারে ঢাকা খুলে সেই হাসিমাখা মুখখানি দেখে ওর উপর আছড়ে পড়লাম। বার বার ঐ এককথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল, আমিও তোমার মত পতিতা মেয়ে, আমার মতোই সুখের নীড় বাঁধতে পারতে। এছাড়া আরো অনেক কথা বলেছিলাম, তা মনে নেই।


জানি না ঐ দিন কতক্ষণ আমি শ্যামলীদির শবদেহের উপর আছড়ে পড়ে কান্নায় রত ছিলাম। শ্যামলীদির বাবা ও দাদার মুখপানে তাকাবার অবকাশ ছিল না। শ্যামলীদির এই শবযাত্রার মর্মন্তুদ দৃশ্য আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শ্যামলীদির বাবাকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। ওর দাদা কাদতে থাকলেন। এই দৃশ্য কতখানি যে কষ্টদায়ক সে দিন বুঝেছিলাম।


সেদিন ওখান হতে গভীর বেদনা বক্ষে নিয়ে দেবীদাসের বাড়ীতে ফিরে এলাম। বাড়ীতে এসেও আমি শোককে সহজে ভুলতে পারলাম না।


শ্যামলীদির মৃত্যুর পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। নিদারুন শোকাতুর মন নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম দিনগুলোকে। কোন প্রকারে নিজেকে শান্তিতে রাখতে পারছিলাম না। কারণ আমার মানসপটে শ্যামলীদির মুখচ্ছবি বারবার ভেসে উঠতো। বিশেষ করে ওর কথা গুলো যখন আমি স্মরণ করতাম তখন এক নিদারুন বিবেকের দংশন জ্বালা আমি দেহ মনে অনুভব করতাম।


শ্যামলীদির অভাব আমি জীবনে পূরণ করতে পারিনি, মানসিক মর্মজ্বালায় ক্ষত- বিক্ষত ও বিভ্রান্ত। সেদিন গায়ত্রীদি আমাকে চাপ দিয়ে ধরে বসলো শ্যামলীদি কি করে অন্ধকার জীবনে প্রবেশ করেছিল। যদিও বলার মত ক্ষমতা আমার ছিল না। বার বার তার কাতর প্রার্থনাকে পরিত্যাগ করতে পারিনি। বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে কাহিনী বলার সময় কতখানি যে চোখের জল পড়েছে তা জানি না।


গায়ত্রীদি ঘটনা শুনে শুধু ঠোঁটকে দাঁতে চেপে বলেছিলেন, শয়তানটাকে খুন করে কোন অন্যায় করেনি। কিন্তু হতভাগী কেন মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছিলো। হলই বা সে পাপিষ্ঠা। তবুও আমরা সকলেই তাকে মেনে নিতাম। গায়ত্রীদির সাথে তর্ক করার মত ক্ষমতা আমার ছিল না।


তবে শ্যামলী যে কথা পত্রে লিখেছে তা ঘুনাক্ষরে মিথ্যে নয়। গায়ত্রীদির সাথে আলোচনা করার পর তিনি প্রস্থান করলে পর দেবী এক সময় আমার মনকে সতেজ করার জন্য এক সুখের বার্তা এনে উপস্থিত হলো। দেবী কোর্টে আপিল করেছে রেজেষ্টারী ম্যারেজ নিয়ে। কিছু দিনের মধ্যে তারা সম্পূর্ণভাবে বিকশিত জীবন উপভোগ করবে। সেই সময় সুখের বার্তা আমার মোটেই ভালো লাগেনি। তবুও অতীতের কথা মনে পড়তেই দুই চোখ বয়ে জল পড়তে শুরু করল । অতীতের স্মৃতিকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তুললাম।


পতিতালয়ে দীর্ঘদিন ধরে জীবন যন্ত্রণায় কাতর হয়েছি, জীবন দেবতার নির্মম পরীক্ষায় অধৈর্য্য হয়ে বার বার নীরবে অভিযোগ জানিয়েছি, কিন্তু আজ দেবীর কথা শুনে আমার ঘৃণ্য ইতিহাসকে পিছনে ফেলে, শত গ্লানি যন্ত্রণাকে ত্যাগ করে ঊষর আকাশের নীচে দাঁড়াবার সুযোগ পেলাম। দেবী আমাকে কোন দিনই মিথ্যে বলে না। আমরা মাস খানেক পরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024