উৎপাদিকা - তপন তরফদার || Utpadika - Tapan tarafder || Novel || উপন্যাস || উপন্যাসিকা || Bengali Novel

  উৎপাদিকা

তপন  তরফদার

 


  পৃথিবী তার জন্ম লগ্ন থেকেই উৎপাদিকা হয়ে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির অমোঘ বিরূপ রূপ কে মোকাবিলা করতে শক্তি জোগায়। এই জগত পরির্বতনশীল গতিশীল হলেও  মূল শিকড় কিন্তু অপরিবর্তনীয়। অতীত থেকে আজও পর্যন্ত একই নিয়ম নীতি পথ ও কার্যক্রমের গতি একইভাবে দৃঢ়তার সাাথে অপ্রতিরূদ্ধ বলেই এই পৃথিবীতে জল ও স্থলের পরিমাণ বা পৃথিবীর গতিবেগ কক্ষপথ থেকে কমবেশি আজও হয়নি। জীবন ও  জীবনের দৃশ্য পট পরিবর্তনশীল হলেও তা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। মানুষ সর্বদাই তার জীবনদর্শনের সততা, সাধনা ও সুন্দরতার শিকড়ের সাথে নাম বদলে গেলেও শিকড় কিন্তু বদলায় না। উৎপাদিকারাই  পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলে এবং চালিকা শক্তি হয়ে থাকে।


         গ্রামের  নাম ছিল ইচ্ছাপূরণ। এখানকার গ্রামের আরাধ্য দেবতা তার ভক্তদের মন্স্কামনা পূরণ করে। সেই  গ্রামের নাম এখন মুখে মুখে ইছাপুর হয়ে গেছে।  এখন এই গ্রাম বেশ কয়েকবার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছে এক অদ্ভুত কারণে। এই গ্রামের অনেক মানুষের মধ্যে এক উদ্ভট আচরণ দেখা যায়। এদের আত্মহত্যার প্রবণতা খুব বেশি। গোটা দুনিয়ায় এক বছরে যত মানুষ আত্মহত্যা করে  তার সংখ্যা আট লাখ। ভারতে এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো মানুষ আত্মহত্যা করে। ভারতে প্রতি ঘন্টায় পনেরো জন আত্মহত্যা করে। সারা বিশ্বে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে এক জন আত্মহত্যা করে। ইছাপুরে ফাঁসিতলা বলে একটা অঞ্চলেরই নামাঙ্কিত করা হয়েছে, কবে থেকে কেউ খোঁজ রাখেনা। ওখানকার কয়েকটি  বেলগাছ থেকে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে অনেকে। কারন অনুসন্ধান করে অনেকেই বলে, তাদের ইচ্ছাপূরণ হয়নি বলে আত্মহত্যা করে এই বেলগাছে, কারণ  তাদের ইচ্ছাপূরণ হবেই আসছে জন্মে এই আশায়।  


      পাখিরাও আত্মহত্যা করে। আসাম প্রদেশের হাফলং থেকে আট কিলোমিটার দূরে জাটিঙ্গা গ্রামের প্রায় দেড় কিলোমিটার জায়গায় বহু বছর ধরে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সূর্যাস্তর সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা  দলবদ্ধ হয়ে পূর্ণ গতিতে পাগলের মতো উড়তে উড়তে বাড়ি, গাছপালায় ধুপধাপ আছেড়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। রিসার্চ চলছে এই আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে। মানুষ আত্মহত্যা কেন করে, সঠিক কারণ এখনো কেউ জানেনা। প্রাথমিক  কারণ সবাই  জানে হতাশা এবং আবেগ যা মানব মনে নিত্য জোয়ার ভাঁটা খেলায়। ভবিষ্যত প্রজন্মকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার করবেই বলে লাখ লাখ টাকা  খরচা করে রাজস্থানের কোটা আবাসিক টিউটরিয়াল হোমে  ভর্তি করে দেয়। ভাগ্যের কি পরিহাস ওখানেই হীনন্মন্যতায় ভুগে বেশ কিছু ছাত্র আত্মহত্যা করছে। ২০২৩ সালের আগষ্টের মধ্যেই ২৩ জন উচ্চাভিলাষী হতাশায় আত্মহত্যা করেছে। এখন গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও মাঝে মাঝেই শিরোনামে চলে আসে এই ইছাপুর। কেউনা কেউ আত্মহত্যা করেছে। এই গ্রামে শারদীয়া দুর্গাপুজোর থেকে দেবী গন্ধেশ্বরী পুজো মহা ধুমধামে করা হয়। ভবেশ অনেক দিন বাদে নিজের গ্রামে  আসছে। ভাবতে থাকে, ভেবে কুল পায় না কেন গ্রামের লোকজন আত্মহত্যা করে।


                (২)


        এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে প্রাচীন বট গাছের তলার রাস্তা ধরে এগিয়ে  চলছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পিছলিয়ে পড়া সূর্যের আলো মাথায় মেখে, গ্রামের সারদা বালিকা বিদ্যালয় কে পাশে রেখে গন্ধেশ্বরী পুকুরের পাড় ঘেঁষে আড় করে পাতা ইটের রাস্তা পেরিয়ে ভবেশ ঢুকে পরে বাবাজি তলায়। বাবাজি তলার পাশেই ‘বন্ধু সঙ্ঘ’র ঘর। সঙ্ঘের অনেক উন্নতি হয়েছে। পাকা বাড়ি হয়েছে। দোতলা হয়েছে। প্লাস্টিক ইমালশনের রকমারি রং দিয়ে সুন্দর করে রং করা হয়েছে। বাড়ির মাথায় স্টিলের পাত দিয়ে  ‘বন্ধু সঙ্ঘ ‘র নাম লেখা হয়েছে। ক্লাব ঘরটা অনেকদিন ধরেই দোতলা করার ইচ্ছা থাকলেও তা করা যায় নি, কারণ  গন্ধেশ্বরীর মন্দির একতলা। মন্দিরের চূড়ার থেকে উঁচু কোন বাড়ি গ্রামে থাকবেনা। এই বিধান কবে কে চালু করেছিল কেউ জানে না। তবে এই বিধান অমান্য করার চেষ্টা কেউ করেনি। গ্রামের ষোলআনা কমিটি আছে। এই কমিটির উপর কেউ কথা বলার সাহস রাখে না।


               ষোলআনা কমিটি আর যাই করুক গ্রামের এক অখণ্ডতা নিজেদের ভাব ধারার সংস্কৃতি কে অটুট রেখেছে। কাজের জন্য বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাতায়াত করে জানতে পেরেছে এই গ্রামের অনেক নিয়ম আধুনিক সমাজের সঙ্গে  খাপ খায়না। তাও ষোলআনা কমিটির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনা। নব্য যুবকেরা বুদ্ধি খাটিয়ে যুক্তি করে গন্ধেশ্বরী মন্দির কে প্রথমে সংস্কার করে। মন্দিরের চূড়া তিনতলা ছাড়িয়ে আকাশে ফুঁড়ে দেয়। এত উঁচু মন্দিরের চূড়া  ইছাপুরের গর্ব হয়ে উঠলো। আশেপাশের গঞ্জের লোকজন ইছাপুর গ্রাম কে  ধন্য ধন্য করতে লাগলো। ষোলআনা কমিটির তদারকি আরো বেড়ে যায়। জোরদার হয় মন্দির কমিটি, বিভিন্ন উৎসবের অনুষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওদিকে ষোলআনা কমিটি  আরো অনুশাসনের নিয়ম চালু করে অপ্রিয় হওয়ার বদলে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মান্যতা বেড়ে যায়। এরপর ক্লাবের ঘর দোতলা করা হয়। ওই গন্ধেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন জমি এখন মাঠ হয়েছে। লোকজনের মুখে মুখে বাবাজি তলার মাঠ নামে পরিচিত হয়ে যায়। গ্রামের যা কিছু উৎসব-অনুষ্ঠান এই মাঠেই হয়। ষোলআনা কমিটির দাপটে মাঠে স্থায়ী দোকান ঘর করার সাহস কেউ দেখায়না। উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য অস্থায়ী দোকান-পাট বসে এবং সঠিক সময়ে দোকানিরা তাদের দোকান তুলে নেয়। বিভিন্ন গঞ্জের হোমড়া চোমড়ারা এখানকার ষোলআনা কমিটির পরামর্শ নিতে আসে। গ্রামের সুনাম অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই ষোলো আনা কমিটি। তাই সাজানো গোছানো আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ নিজস্ব দপ্তরও আছে।


            (৩)


         ভবেশের মনে এই গন্ধেশ্বরী  দেবীর বিভিন্ন গল্পকথন  মনে পড়ে যায়। দেবীর রূপ সৌন্দর্যের কথা শুনে দেবী উপাসনায় ব্রতী হন গন্ধাসুর, যার কথা ভবপুরানে আছে। গন্ধাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী বর দিতে আসলে গন্ধাসুর দেবীর সুললিত সুন্দর যৌবনবতীর রূপ মাধুর্য্যে  বিমোহিত হয়ে মতিভ্রম হয়ে যায়।  গন্ধাসুর দেবীকে অপ্রস্তুত করে বলে বসে, দেবী তুমি  যখন আমার ইচ্ছে অনুযায়ী বর দেবে, আমাকে বর দাও আমিই তোমার বর হবো। দেবী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, কোন ভক্ত এরকম বর চাইতে পারে। ভক্তকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে, দেবী যুদ্ধ করে তাকে পরাস্ত করেব নিজের আসন পুনরায় প্রতিষ্ঠান করেন। সেই সময়েই  দেবীর পরিচিতি হয়ে যায়  “গন্ধেশ্বরী দেবী”। এই বিষয়ে  আবার  অন্য মতের লোকজন মনে করে, গন্ধবনিকরা এক কাল্পনিক দূর্গার পুজো করেন  যার নাম  দেন গন্ধেশ্বরী।  এই  ঠাকুরের বাম পা সিংহের  উপর ও ডান পা মহিষের উপর রাখা আছে। এই গ্রামে নিজস্ব উৎসবের রীতি আছে যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। কালীপুজোয় মাগুর মাছের ঝোল রেধেঁ  ভোগ দেয়ার রীতি আছে।


          ভবেশ বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামে এসেছে। নবমীর দিন দেবীকে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়। দেবীকে বাবাজিতলার মাঠে রেখে শুরু হয় এক অন্য ধরনের উৎসব। এই উৎসবের শেকড় কোথা থেকে এসেছে তার  অনুমান করতে পেরেছে ভবেশ কলকাতায় এসে। কলকাতায় বিভিন্ন উৎসবে সঙের ব্যাপক প্রচলন ছিল এখনো কিছু  জায়গায় চল আছে। “সঙ সাজা” বিষয়টি আদতে  বিভিন্ন পেশার নানা ধরনের মানুষের পোশাক পরে গান গেয়ে ছড়া কেটে ব্যক্তিগত ও সাময়িক সমাজের জীবনকে পরিহাসের মোড়কে মানুষের কাছে তুলে ধরা। মানুষের মনে ভরপুর তির্যকদৃষ্টি, রঙ্গ-ব্যঙ্গ্যের  মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করা। আনন্দের যোগান দেওয়া। সঙ সেজে সমাজের বিভিন্ন মানুষের অনুকরণ করে অভিনব কায়দায় সাধারণের মন জয় করা।


        “হাতুড়ে ডাক্তার”, “পশারহীন উকিল”, “আধুনিক যুবক”, “মোহন্ত আর তার বৌ” সহ বিভিন্ন মুখরোচক বিষয়। উত্তর কলকাতার বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট থেকে শুরু হতো  কাঁসারি পাড়ার সঙ। বিশেষ ধরনের ঘোড়ার গাড়ি যাকে বলা হত “কাটরা গাড়ি”। এই গাড়িতে চড়ে পথে পথে ঘুরতো সঙ সাজা মানুষেরা। কুক কোম্পানির মোষে টানা ছাউনি বিহীন গাড়িতে চরে সঙরা পথে নামতো।  প্রায় এক মাইল দীর্ঘ সঙের মিছিলে থাকতো নাচ, গান, হাসির অভিনয় সঙ্গে মজাদার ছড়া।


      কলকাতার ওই সঙ দেখার জন্য অনেক মানুষের ভীড় হতো। চিৎপুর রোড, কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের রাস্তার ধারের ঘরের মালিকরা বাড়ির বারান্দা, রোয়াক ভাড়া দিয়ে ভালোই উপার্জন করতো। জেলেপাড়ার সঙ ছিল বেশ জনপ্রিয়। এরা বেশ কিছুদিন আগে থাকতেই পালা ও গান লিখে সুর দিয়ে নিয়মিত মহলা চলতো। জেলে পাড়ার সঙের উদোক্তারা নিজেরা ছড়া ছাপাতেো না। অথচ এদের ছড়া,গান পুস্তিকা আকারে ছাপিয়ে ব্যবসা করে নিত কয়েকজন। এই পুস্তিকায় পাঁজির মতো কিছু  বিঞ্জাপন ও দেওয়া হত। এর থেকেই বোঝা যায় সঙের গান কত জনপ্রিয় ছিল। সরস্বতী পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় সঙরা অন্যয়কারী, ক্ষমতাপ্রাপ্তদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতো। বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে নিজস্ব ভাবনায় ব্যজ্ঞাতক ভঙ্গিতে,গানে, ছড়ায় এক লৌকিক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সাধারণ মানুষরা। এই সঙের মাধ্যমে মাথা উঁচু  করে বলতো, “আমরা সবাই শিবের চেলা(আমরা) ভূত গাজনের সঙ/ বছর ভরে তা ধেই তা ধেই নাচছি জবর জং,/  (মোদের) এক চোখেতে মায়ার কান্না, এক চোখেতে হাসি। (আমরা) ঝগড়া ঝাঁটি কুৎসা হুজুগ স্বার্থ ভালোবাসি।” সঙের মাধ্যমে সর্বগ্রাসি বিদ্রুপের কৌতুকের আবরণে প্রকাশ করা হত। আধুনিক পরিভাষায়, “কেস দেবেন না প্লীজ।“ সেই সঙের উত্তর সূরি “ছদ্মবেশ ধারণ” গোদা বাংলায় “যেমন খুশি সাজ।“ ইচ্ছাপূরণ করতে গ্রামের অনেকেই  ছদ্মবেশ ধরে ঘোরাফেরা করে। কেউ জেলে সাজে কেউবা ব্যারিস্টারের পোশাক পরে, যেমন ইচ্ছে সাজো সাজে। অতি শান্ত ভদ্র পৌঢ় কে দেখা যেতে পারে মদ খেয়ে মাতলামি করছে। ভবেশ এই গ্রাম থেকে কলকাতার ঠন ঠনিয়া কালিবাড়ি কাছে রাজেন্দ্র দেব রোডে গন্ধবণিক সমাজের  বিদ্যাসাগর ছাত্রাবাস থেকে প্রথমে দুবছর কলেজে পড়ার পর ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে  ডাক্তার হলেও নিজের গ্রামকে ভুলতে পারেনা।


      (৪)


            গ্রামের শিকড়ের টান ভুলতে পারে না কিন্তু নিজের ব্যস্ততার জন্য গ্রামে আসার সময় পায়না। ভবেশ এখন কলকাতার নামকরা ডাক্তার। ডাক্তারি পড়ার সময় এক খৃষ্টান নার্স রচনা বিশ্বাসের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা হয়, তাকে বিয়েও করে। ষোলআনা কমিটি এই বিয়েকে ভালো চোখে দেখেনা। ভবেশ বউকে নিয়ে গ্রামে ঢুকতে পারবেনা। পারমিশন নেই। ভবেশের মা যদিও প্রথমে এই বিয়েতে আপত্তি করেছিল কিন্তু ছেলের একগুঁয়ে জেদ দেখে নিমরাজি হন। ছেলের বউকে এই গ্রামে  ঢোকার অনুমতি না দেওয়ার জন্য ষোলো আনা কমিটির কোন দোষ দেয়না। ঠিক কাজ করেছে বলে মেনে নেন। মায়ের শরীর খারাপ  শুনেই ভবেশ জোর করে মা কে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল। মা নিজের শরীরের প্রতি কোনো যত্ন,সঠিক সময়ে নিজের  খাবারটাও খেতেন না। ফলাফল রক্তাপ্লতা, প্রেশার, ইত্যাদি রোগ বাসা বাঁধে। কলকাতায় এসে ছেলের  সঠিক ওষুধ ও ছেলের বউয়ের সঠিক তত্বাবধানে সবরোগ দুরে পালিয়ে যায়। কলকাতায় এসে ছেলের বউয়ের সঙ্গে মিশে বুঝতে পারে  ছেলে কেন একেই বিয়ে করার জন্য গোঁ ধরেছিল। গায়ের রঙ সোনার মতো নয়, কিন্তু  মনটা খাঁটি সোনার। ভবেশের বৌ রচনা, ভবেশের মায়ের মন জয় করে নেয়। রচনা বিশ্বাস যে  ক্রিস্টান তা ওর চলাফেরায় আচার ব্যবহারে কিছুই বোঝা যায়না। কেউ  বলবেনা  ও বাঙালি ঘরের বৌ নয়। নিয়ম করে সিঁথিতে হালকা সিঁদুর লাগায়। হাতে অবশ্য শাঁখা পড়েনা। শুধু রবিবার ওই মাদার মেরির সামনে একটা মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে দুমিনিটের মতো চোখবুঁজে প্রার্থনা করে। কি প্রার্থনা করে মা বুঝতে পারে না,তবে এটা বুঝে গেছেন লক্ষীমন্ত বৌ। রবিবারের ওই মোমবাতি জ্বালান ছাড়া অন্য কিছুই পার্থক্য খুঁজে পায়না। হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান আছে। মন প্রাণ দিয়ে সেবা করে যায় রোগিদের। লেডি নাইটিঙ্গলের নতুন সংস্করণ এই রচনা। পানপাতার মত মুখ। চোখ টানা টানা, টিকালো নাক  ঠোঁট মুখে একটা হাসি সর্বদাই লেগে আছে। হাসলে মুখে এক সুন্দর টোল পড়ে। গায়ের রং ফর্সা নয়,তবে শ্রীময়ী সেবার প্রতিমুর্তি এই রচনা। হাসপাতালের সব ডাক্তার কর্মীদের কাছে প্রিয়। রচনা কে সবাই বলে এখানকার নাইটেঙ্গেল রচনা।


       ভবেশ সাদামাটা পোশাক পরেই গ্রামে এসেছে। হাতে ডাক্তারি ব্যাগ নেই। কনো টেনশন নেই যাকে বলা হয় ঝাড়া হাত পা। ছোটবেলার অনেক কথা স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে। আগের থেকে গ্রামের লোক সংখ্যা বেড়েছে। সঙের বদলে ছদ্মবেশ ধরে উৎসাহী মানুষেরা। আবার  ছদ্মবেশের ধরন ও অনেক উন্নত হয়েছে, জমকালো হয়েছে। ছেলেবেলায় দেখতো ভিখারি, পাগল, বামুন ঠাকুর, সন্ন্যাসী এইসব। ভবেশ দেখছে মাঠে সান্টাক্লজ ঘুরছে। একটা ছদ্মবেশ এখনো ভালই চল আছে, যাদের গলায় একটু গান খেলে তারা বাউল হয় বা কীর্তনীয়া হয়। এখন আবার কেউ কেউ হিন্দি সিনেমার নায়ক হয়ে ঘুরছে। একজন মিঠুন হয়ে মিঠুনের গলা ও ভঙ্গি  নকল করে বলছে, “মারবো এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে।“ তবে বতর্মানে ওই –“বউ গেলে বৌ পাওয়া যাবে, মা গেলে মা পাওয়া যায়না” লোকজন শুনছে আর প্রাণ খুলে হাসছে। ভবেশ নিজেকে ভুলে ছদ্মবেশীদের লক্ষ করছে। মুখে এক প্রশান্তির ছাপ। এখানে রুগিদের ভিড় নেই। ডাক্তারবাবুকে রোগিদের আকুতি শুনতে হচ্ছে না। সবাই আকুতি মিনতি নিবেদন করছে ওদের ইস্ট দেবতাকে। প্রতিমা কে প্রণাম করছে। মেলার ভীড়ে মিশে গিয়ে সবাই গুঞ্জন তুলছে। ছদ্মবেশীরা বেশি বেশি করে প্রার্থনা করছে নিজেদের ইচ্ছাপূরণের জন্য। মাটির উঁচু বেদির ওপর বসানো হয়েছে প্রতিমাকে।


          (৫)


      ভবেশ প্রতিমাকে নিরীক্ষণ করছে। দেবীর প্রশান্ত মুখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ এক মুখ খোঁচা খোঁচা  দাড়ি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল গায়ে রংচটা ছেঁড়া ময়লা জামা, মালকোঁচা করে ধুতি পরা একজনের আর্বিভাব। সে তার ধুসর চোখটা গোল গোল করে নাড়িয়ে  ভবেশের কাছে সরাসরি আবদার করে বলে, কিরে ভবেশ একটা সিগারেট হবে। ভবেশ বলে না সিগারেট নেই। সে বলে, তাহলে একটা বিড়িদে।   


---আমি তো এখন বিড়ি সিগারেট খাইনা।   


 -তাহলে দশটা টাকা দে একটা চা খাই অনেকক্ষণ কিছু  খাইনি। কেমন কেমন করছে। ভবেশের কেমন কেমন কথাটা মনে পড়ে যায়। ক্লাসে মতি দেবনাথ নামের  সহপাঠী এই কথাটাই বলতো, ওই “কেমন কেমন করছে।“ কেমন কেমন করছে বলে অনেক আজগুবি কথা বলতো আজগুবি কান্ড করতো। মাঝে মাঝে মতিভ্রম হয়ে যেত, স্কুলে আসতো না। আবার কিছুদিন বাদে স্কুলে আসতো ক্লাসের সবাই সুযোগ পেলেই ওকে খ্যাপাতো। মাঝে মাঝে খ্যেপে যেত আমাদের আনন্দ হতো। আবার কখনো দার্শনিকের মত সব উড়িয়ে দিয়ে বলে উঠতো, জানি জানি তোরা আমায় পাগল মনে করছিস। আমার নাম মতি আমার মতিগতি ঠিক নেই। আমাকে ক্ষ্যাপা ভাবছিস তোরা।


         ভবেশ  মানিব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে দিতে  যাবে  সেই  সময়েই, সস্তা রংচঙে সিন্থেটিকস কাপড় পরা এক বউ যার কাঁখে বছর খানেক ছেলে, ভবেশের হাত থেকে নোটটা কেড়ে নিয়ে মতিকে বলে, আবার তুমি....। ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে রাখলো বউটা। কোন কথা নয়। চোখের ঝিলিকে অনেক কথাই বুঝিয়ে দিল। যুবতীর সিঁথিতে সিঁদুর চকচক করছে। কপালে কোন টিপ নেই। চোখে কোন  কাজল নেই। তবে এই চোখে কাজলের প্রয়োজন নেই। ঘন কালো চোখ দুটো যেন কেউ এঁকে দিয়েছে। মুখের গড়ন প্রতিমার মত। ফর্সা রং তামাটে হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবতীর যৌবন ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ভবেশের চোখ চলে যায় যুবতীর শরীরের উপর। যুবতী বুঝতে পেরে সবুজ রঙের শাড়ির আঁচল টেনে ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করে। কোলের ছেলেটা কেঁদে ওঠে, মনে হয় খিদে পেয়েছে অনেকক্ষণ খাইনি। যুবতী এবার গম্ভীর স্বরে ভবেশ কে বলে, ওকে এইভাবে টাকা দেবেননা। সংসারে থাকতে হলে উপার্জন করতে হয় এই বোধটা ওর ভেতর আনতে হবে। যুবতীকে ভবেশের ভালো লাগে। ভবেশ যুবতীকে বলে তোমার ছেলেটার খিদে পেয়েছে, চলো ওই দোকান থেকে একটু দুধ আর পাউরুটি কিনে দিই । ভবেশ চায়ের দোকানদারকে বলে গরম দুধ আর পাউরুটি দিতে। যুবতী আপত্তি করেনা। যত্ন করে বাচ্চাকে খাওয়ায়। ভবেশের মনে উথালপাতাল ভাবনা তোলপাড় করতে থাকে। যার কিছুই নেই অথচ সব আছে। ফুটফুটে এক সন্তান আছে। ভবেশের সব আছে কিন্তু সন্তান হয়েও টেঁকেনি। আর সন্তানের জন্ম দিতে পারবেনা। রচনার গর্ভকোষ আর সন্তান ধারণ করতে পারবেনা। সন্তান না থাকার যন্ত্রণা কুরে কুরে খায় ভবেশদের। যুবতীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে সুখ-দুঃখের কথা বলতে লাগে ভবেশ। যুবতীকে থোক টাকার লোভ  দেখিয়ে  বাচ্চাটাকে যদি কব্জা করা যায়। ভবেশ বলে, যদি কিছু মনে নকরো তাহলে একটা  কথা বলবো। যুবতীর চোখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে। মুখে  বলে বলুন।


 - কাল বিকাল বেলায় তোমাদের বাড়ি যাব। যুবতী উদাসীন হয়ে বলে কেন আমাদের বাড়ি কেন।   


- না কিছু কথা আছে তোমাকে বলবো। তোমার নাম কি? 


 - বেলা।


- আমি খারাপ মানুষ নই। আমি একজন ডাক্তার। অনেককেই আমি সাহায্য করি। মতি আমার ছোটবেলার বন্ধু । ওকে সাহায্য করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। বেলা একটা এঁটো হাসি হেসে বলে, আসবেন।


            (৬)


         পরের দিনেই  ভবেশ বাচ্চাটার জন্য জামা প্যান্ট, বাচ্চার মা বেলার জন্য তাতেঁর শাড়ি,  মতির   জন্য ধুতি,পাঞ্জাবি এবং এক বড়ো বাক্স ভর্তি সন্দেশ নিয়ে বিকেল বেলায় হাজির হয় মতির বাড়িতে। রাংচিতার বেড়া দেওয়া মাটির একচালা এক কামরা ঘর। ঘরের দাওয়া গোবর জল দিয়ে নিকানো। একটা লাউ গাছে নারকেল দড়ি দিয়ে টেনে ঘরের ছাউনিতে তোলা হয়েছে। এধার ওধার অযত্নে বেড়ে ওঠা কয়েকটা নয়নতারা ফুল গাছ। কঞ্চির গেটে হাত দিয়ে  ভবেশ বলে, মতি বাড়ি আছিস। কোন সাড়া শব্দ নেই। বাচ্চাটা দাওয়ায় ঘুমিয়ে আছে। পড়ন্ত বিকেলের রোদ শিশুর মুখে1 স্বর্গীয় আলোর আলপনা চারধারে। হঠাৎ দেখে বেলা পরনের সায়াটাকে উঁচু করে বুক পর্যন্ত টেনে দ্রুত দাওয়ার মাটির সিঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। ভবশের চোখে বেলার অর্ধ নগ্ন শরীর মনের মণিকোঠায় ভাসতে থাকে। ভবেশ ভয় পেয়ে যায়। কোনো ফাঁদে জড়িয়ে পরলাম কি? মেয়েটার শ্লীলতা হানি করেছি বলে ঘোঁট পাকাবেনাতো।


       একটু  সময় পার করে  বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় খেজুরের চাটাইটা পেতে দেয়। বেলার পরনে এখন একটা জংলা ডুরে শাড়ি। ব্লাউজ পরেনি। শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বেলার গলায় অন্তরঙ্গতার সুর। ভবেশের মাথায় অনেক ধরনের ভাবনা কিলবিল্ করে ওঠে। হয় ওর গর্ভ ভাড়া নিয়ে বা বাচ্চাটাকে যে করেই হোক দত্তক নিতে হবে। রচনাকে  পাগল হওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য সংসারে একটা বাচ্চা অবশ্যই দরকার। হতাশা ওকে চেপে ধরছে। দু দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বেলার সঙ্গে ভবেশের হাসিমুখেই  কথোপকথন চলছে। ভবেশ বেলাকে উদ্দেশ্যে করে বলে, আমি তোমার সঙ্গে গোপনে কিছু কথা বলতে এসেছিলাম।


                হঠাৎই মঞ্চে মতির প্রবেশ। সন্দেশের বাক্সটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে বলে কতদিন সন্দেশ খাইনি। কেমন কেমন করে। মন কেমন কেমন করে। বেলা মতির হাত থেকে বাক্সটা কেড়ে নিয়ে বাক্স খুলে একটা সন্দেশ ওর হাতে দিয়ে বলে মাঠ থেকে ঘুরে আসো। মতি সন্দেশ পেয়ে বলে, সবাইকে দেখাবো দেখ মতি কেমন কেমন সন্দেশ খায়, বলতে বলতে চু কিৎ কিৎ খেলার মতো দৌড়ে চলে গেল। বেলা এবার ভবেশকে বলে, বলুন আপনি কি বলতে চান। গ্রামের লোকের কাছে শুনেছি আপনি একজন নামকরা বাচ্চাদের  ডাক্তার। ভবেশ বলে, মন দিয়ে শোনো, আমাদের মহাভারত কাব্যের শুরুতেই এক তাৎপর্যপূর্ন ঘটনা আছে ওই বংশ রক্ষা নিয়ে। তুমি কি জানো। বেলা মাথা নাড়ায়। ওর মাথা নাড়ানো দেখে বোঝা যায় না ও জানে কি জানে না। ভবেশ বলে ঠিক আছে তুমি যদি একটু চেষ্টা করো, রাজি হও আমাদের অসুখ সেরে যাবে। চিরতরে সেরে যাবে।


 - আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। ভবেশ বলে, হ্যাঁ সহজে বোঝা যাবে না বিষয়টা জটিল। কিন্তু আবার সরলভাবে ভাবলে বিষয়টা খুবই সহজ। আমাদের কোনো বাচ্চা নেই, আমি একটা বাচ্চা চাই।


 - ছিঃ ছিঃ একি কথা বলছেন আপনাকে ভালো লোক বলেই কথা বলেছিলাম। মতির বন্ধু  বলে বাড়িতে আসলেও আপত্তি করিনি। আপনি এত নীচ বুঝতে পারিনি। জিভকেটে ভবেশ সঙ্গে  সঙ্গে বলে ওঠে,  না না তুমি আমাকে ভুল বুঝনা এখন এই বিজ্ঞানের যুগে আমরা জানি অনেক মেয়ের গর্ভে বাচ্চা ঠিকমতো জন্মায় না। উৎপাদিকা, সহজ কথায় যাকে বলা হয় জন্মদাত্রী, মা, হতে পারেনা। তোমার শরীর স্বাস্থ্য ভালো। আমি চাই তোমার পেটে আমার একটা বাচ্চা হবে। তুমি বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করো সেখানেও তো তুমি খাটা-খাটনি করছো সংসার পালন করার জন্য। তারা টাকা দিচ্ছে। আমি যে প্রস্তাবটা দিচ্ছি  সেটাও এক ধরনের কাজ ভাবলেই কোনো হীনমন্যতা হবে না, গন্ডোগোল হবেনা। অনেক মানুষের অনেক কিছু থাকেনা। আমরা রক্ত দিয়ে রোগিকে বাঁচাই অপরের রক্ত নিয়ে। এটা কি অন্যায়?


- না। আমি জানি দরকারে অন্যের রক্ত নিয়ে বাঁচতে হয়।


- সেই রকমই তোমার গর্ভে যদি একটা সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়ে একটা সংসারকে বাঁচাও। তোমাদের এমন ব্যবস্থা করে দেবো সারা জীবন তোমাদের কোন অসুবিধে হবে না। কয়েকটি ডাক্তারি পরীক্ষা করে তোমার গর্ভে সন্তান বড় হবে। সন্তান প্রসব হলেই তোমার কাজ শেষ। কেউ জানতে পারবেনা। তুমি আমাদের নতুন জীবন দান করতে পারো। মানুষ মরে গিয়ে নিজের চোখ দান করে অন্ধকে পৃথিবীর আলো দেখাচ্ছে। আর তুমি আমাদের জন্য একটু কিছু  কর।  বেলা দুহাত জড়ো করে বলে, ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি। ভেবে দেখি। ভবেশের মুখে বিজয়ীর হাসি। ভবেশে কিছু বলার আগেই বেলা ঠোঁটে আঙ্গুল লাগিয়ে চুপ করতে বলে। কিন্তু যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। মতি কখন যে কঞ্চির গেটে দাঁড়িয়ে আছে কেউ লক্ষ করেনি। ভবেশ মতির কাছে গিয়ে আদর করে মতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, চলিরে। কাল আবার আসবো। মতির চোখটা ধুসর থেকে গনগনে লাল চোখ হয়ে জ্বলতে থাকে।


           (৭)


               বেলা নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে। বারে বারে মনে ভেসে ওঠে সারা জীবনের জন্য এই দুঃসহ অবস্থার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে। অন্য মনে নিজেকেই তিরস্কার করে বেলা। বাঁকা পথে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পাঁকে ডুবে যাওয়া ঠিক হবেনা। এক মানসিক চিন্তায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মাঝরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে উচ্চ স্বরে অন্ধকারে চোখ জ্বেলে এক পেঁচা খুঁজে চলেছে তার  সঙ্গিনীকে।  ডাক ছেড়ে তার অবস্থান জানাচ্ছে। বেলার ঘুম আসেনা। নানান ভাবনা মনে দাগ কাটতে লাগে। এপাশ-ওপাশ করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। এক সময় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘটি থেকে জল ঢকঢক করে গলায় ঢালে। পিপাসা মেটায়।


         বেলা  দেখে মতি নির্বিকার ভাবে শুয়ে রয়েছে। হাঁটু জোড়ায় মাথা ঞ গর্ভস্থ শিশুর মতো1 বেলা বালিশে মাথা ঠেকায়। এক ক্লান্তি গ্রাস করে, নিদ্রা মগ্ন হয়ে যায়। মতি কিন্তু  ঘুমায়নি। ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে শুয়েছিল। মতি দরজার হুড়কো খুলে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। শেষ রাতের ভোরের হিমেল হাওয়া চোখে মুখে ঝাপটা দেয়। নাম না জানা অচেনা জংলি ফুলের গন্ধ  মতির মাথায় ধাক্কা মারে। কেমন কেমন লাগে। আওয়াজ আসে গাবগাছের কাকের বাসা থেকেই। আবার ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। জীবজগতের এক বিচিত্র চিত্র কোকিল কাকের বাসায় ডিম  পাড়ে। মতি ভবেশের কথা শুনেছে। যতখানি শুনেছে তাতেই বুঝতে পেরেছে, বেলা রাজি ওর  বাচ্চা ধারন করতে। এদের অনেক অনেক টাকা আছে। ক্ষমতা আছে, প্রতিপত্তি আছে। এরা দুর্বল মানুষদের দুরমুশ করেই আনন্দ পায়। এর আগেও বেলার দিকে হায়নাদের নজর পড়লেও বেলা তখন ওদেরকে আমল দিতনা। এখন বেলা বদলে গেছে। আর নিজকে এই দুঃসহ পরিবেশ থেকে মুক্তি চায়। মতি বুঝতে পারে যে কোনো সময়ে বেলা ওকে ছেড়ে, ওদের বাচ্চাকে ছেড়েও পালাতে পারে। মানুষের মন সব সময় কেমন কেমন করে।


     মতি বুঝতে পেরেছে, বেলা ক্লান্ত হয়ে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আলুথালু  হয়ে শুয়ে। দেহের কাপড় এলোমেলো। খোলা দরজা দিয়ে আঁধার ভেদ করে এক ক্ষীণ আলোর প্রলেপ বেলার সারা শরীরে। শরীর কেমন কেমন করে হাতছানি দিয়ে কাছে টানছে। মতি ঝাঁপিয়ে পরে বেলার শরীরের উপর। বেলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এক ঝটকায় মতিকে দুরে ঠেলে দেয়। মতি দাঁতকিড়মিড় করে বলে শালী কেমন কেমন খানকি হতে সাধ জেগেছে। আমাকে কেমন কেমন ঘেন্না করছে। তোর রোগ আমি সারিয়ে দিচ্ছি। তেলচিটে বালিশটা বেলার মুখে চেপে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে। বেলা আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজকে বাঁচাতে। আসুরিক শক্তির কাছে অসহায় বেলাকে দমবন্ধ হয়ে মরতে হয়।


      পাখিদের কলতান শোনা যাচ্ছে। অহনার আলো কালো আকাশে  ফুটতে শুরু  করেছে। মতি মনে মনে ঠিক করেছিল নিজে ফাঁসিতলার বেল গাছেই ঝুলবে। আলো ফুটে উঠছে। মতি দড়িটা ঘর আড়ায় বেধেঁ গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লো। বেল গাছে ঝোলেনা, এই জন্মেই যখন কিছু  হলোনা, আসছে জন্মতে বিশ্বাস করেইনা।


           (৮)


       বাচ্চাটার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। মৃত মায়ের স্তনের বোঁটা চুসে কিছুই না পেয়ে কাঁদছে। কচি কচি হাত নাক মুখে বুলিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছেনা, মা কেন উঠেছেনা। ক্ষেন্তীপিসি রাস্তা থেকেই কান্নার আওয়াজ শুনে বলতে থাকে, ওরে মুখপুড়ি বেলা, বাচ্চাটাকে খাওয়া। দুধের শিশুর যত্ন যখন করবিনা তখন পেঠে ধরেছিলিস কেন। ক্ষেন্তি পিসি নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী বলে যায় জন্মদিয়ে উৎপাদিকা হওয়া সহজ নয়। কোনো সাড়াশব্দ  না পেয়ে পিসি জানলা দিয়ে  সব দেখে চিৎকার করতে থাকে ওরে মতি তুই ও আমার বরের মতো গলায় দড়ি দিয়ে মরলি।


        ইচ্ছাপুর গ্রামের জবর খবর। একই দিনে দুজনের মৃত্যু । ষোলো আনা কমিটির মাতব্বরদের চিন্তা বাচ্চাটার কি হবে। ওদের কানে খবরটা পৌঁছে গেছে  ভবেশের ছেলেপিলে নেই এবং হবেও না। ওদের কে দত্তক দেওয়া হবে। যদি একটা মোটা অঙ্কের টাকা ষোলো আনা কমিটির তহবিলে জমা দেয়। ষোলো আনা কমিটিই ভবেশের উৎপাদিকা হবে।





Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024