অপরিচিত বিভূতিভূষন - হিমাদ্রি শেখর দাস || Oporichito Bibhutibhushan - Himadri Sekhar Das || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article

    অপরিচিত  বিভূতিভূষন

     হিমাদ্রি শেখর দাস 


বিভূতিভূষণ শৈশব থেকেই গ্রাম বাংলার সব শ্যামল প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে ভালোবেসে ছিলেন তার সাহিত্যের অন্যতম উপাদান প্রকৃতি প্রেম প্রকৃতি সম্বন্ধে তার একটা পূর্ণ আর সমগ্র অনুভূতি ভালো-মন্দ সুন্দর অসুন্দর আলো অন্ধকার রমণীয়তা ভীষনতা সবকিছু নিয়ে আমাদের মহীয়সী পৃথিবী আর ধরিত্রীমাতার কোলে যে গাছপালা বন অরণ্য নদ নদী পাহাড় পর্বত সমুদ্র আর বনবাসে মানুষ রয়েছে সেই সমস্তের প্রতি তার মনে এক সদা জাগ্রত অনুভূতি আর আনন্দ এক অপর প্রীতিপূর্ণ আর অনুভূতিপূর্ণ পাঠক অনুভব করে।

বিভূতিভূষণের অনেক উপন্যাস এবং গল্প সবাই পড়লেও কিছু কাহিনী আমরা জানিনা এই প্রবন্ধে বিভূতিভূষণের অজানা কিছু জানাবো 


 *সাধারণ জীবনরসিক* 

 

বিভূতিভূষণের ছোটগল্পের বিরাট অংশ জুড়েই রয়েছে বাংলাদেশের গ্রাম্য জনপদ আর বাঙালি ঘরোয়া জীবনের চিত্র। এই গ্রাম্য, অনাদৃত, অস্পৃশ্য, অনভিজাত ব্রাত্যজনেরা কোন সাজগোজ ছাড়া  ধূলিমলিন পায়ে উঠে এসেছেন তার গল্প- উপন্যাসে।  তাই তারা এত জীবন্ত, অকৃত্রিম, আন্তরিক। বিভূতিভূষণ তার গ্রামের লোকজনের সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে মিশতেন, তারাও কখনও বিভূতিভূষণকে পর মনে করেনি। জীবনরসিক বিভূতিভূষণকে পাওয়া যায় তার গল্পে। বিভূতিভূষণ মানুষকে ভালোবাসতেন। তার গ্রামের মানুষরা ছিলেন তার কাছে পরমাত্মীয়ের মতো। বিভূতিভূষণের দিনলিপির পতায় পাতায় ছড়ানো রয়েছে এই ভালোবাসার নিদর্শন-"অনেকদিন পরে গোপালনগরের হাটে গিয়েছি। সেই আশ্বিন মাসের পুজোর ছুটির পর আর আসিনি। সবাই ডাকে, সবাই বসতে বলে। মহেন্দ্র সেকরার দোকান থেকে আরম্ভ করে সবজির গোলা পর্যন্ত। হাটে কত ঘরামী ও চাষি জিজ্ঞেস করে করে এলেন বাবু? ওদের সকলকে যে কত ভালোবাসি, কত ভালোবাসি ওদের এই সরল আত্মীয়তাটুকু। ওদের মুখের মিষ্ট আলাপ। কাঁচিকাটা পুল পার হয়ে খানিকটা এসেই একটা লোকের সঙ্গে আলাপ হলো। তার বয়স ষাট-বাষট্টি হবে, রঙটা বেজায় কালো, হাতে একটা পোটলা কাঁধে ছাতি। আমি বললুম- কোথায় যাবে হে? সে বললে, আজ্ঞে দাদাবাবু, ষাঁড়াপোতা ঠাকুরতলা যাব। বাড়ি শান্তিপুর গোঁসাইপাড়া। লোকটা বললে, একটা বিড়ি খান দাদাবাবু। বেশ লোকটা ওরকম লোক আমার ভালো লাগে। এমন সব কথা বলে যা সাধারণত শুনিনে।" এককম অজস্র বর্ণনা তার দিনলিপির পাতায় পাওয়া পাওয়া যায় যেখান থেকে বোঝা যায় তিনি কতো সাধারন ছিলেন ।


 *ভ্রমন পিপাসু* 

বিভূতিভূষনের মধ্যে এক ভ্রমন পিপাসু মন বাস করতো।এই ভ্রমনপিপাসু মানসিকতা সম্ভবত তিনি তাঁব  বাবার মহানন্দের কাছে পেয়েছিলেন। এই আগ্রহে স্কুলের কাজ ছেড়ে গোরঙ্গনী  সভা'র ভ্রাম্যমান প্রচারকের কাজ নিয়েছিলেন। প্রচারকের কজে পূর্ববঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, আরাকান অঞ্চলে ১৯২২ সালের শেষ পর্যন্ত অনেক ভ্রমন করেন ট্রেনে, জলপথে  অধিকাংশ পথ  পায়ে হেঁটে।


 *প্রথম গল্পপ্রকাশ* 


বিএ পাশ করার পর বিভূতিভূষন প্রথম চাকরী পেয়েছিলেন হরিনাভীর স্কুলে। একদিন স্টাফরুমে অল্পবয়সী ছেলে এসে বলল- " চলুন আমরা দুজনে মিলে একটা বই  লিখি। " কমবয়সী ছেলের রসিকতা ভেবে গুরুত্ব দেননি, মনে মনে ভেবেছিলেন বই তো অনেক দূর কোনওদিন গল্প, প্রবন্ধ লেখার কথা আমার মনে 

আসেনি ।' পরের দিনস্কুলে গিয়ে দেখেন যেখানে সেখানে সাঁটা কাগজ -" শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে- শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে উপন্যাস।" ভাবলেন নিশ্চয়ই সেই পাকা  ছেলের কাজ, এমনকি সে উপন্যাসের নাম ও করে ফেলেছে- চঞ্চলা ।  সহকর্মী শিক্ষকগন পিঠ চাপছে বললেল,-" বাঃ, মশাই।  আপনি তো বেশ গোপন রসিক দেখছি। কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস? বিভূতিভূষন তাঁর বন্ধু ও ভ্রমনসঙ্গী যোগেন্দ্র নাথ সিংহ কে বলেছিলেন, উপন্যাস তো দূরের কথা,  তিনি আদৌ লেখক নন। বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ মিথ্যে।  সমস্যা হলো একথা তিনি কাউকে বলতে পারছেন না  । 

খুব রেগে ছেলেটির কলার চেপে বিভুতিভূষন জানতে চেয়েছিলেন। এসব রসিকতার কারণ কী? কোন প্রতিশোধ নেওয়ার  জন্য সে এ কাজ করলো। ছেলেটি উত্তেজিত না হয়ে বলেছিল,-- "ভেবেছিলাম দুজনে মিলে লিখে ফেলবো তাছাড়া  চঞ্চলা নামটাও তো মন্দ নয়।'


রাস্তায়, হাটে বাজারে, স্কুলে সকলের প্রশ্ন-- "কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস? '

রাগ করে কাগজ কলম নিয়ে বসে ছোটগল্প লিখলেন এবং ঠিকানা লেখা খামে স্ট্যাম্প সেঁটে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার এক মাসিক পত্রিকায়।  তিনদিন পর থেকে অপেক্ষার শুরু  ।  এই বুঝি ভাম ভর্তি  মনোনীত গল্প ফিরে এলো।  তিন সপ্তাহ বাদে খাম এসেছিলো। বিভূতিভূষন ডায়েরীতে লিখেছেন --" দুঃখ তো হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই আনন্দও হল যে  রোজকার দুশ্চিতা তো কাটল।  আমার মনের অবস্থা এমন হল যে কোন প্রিয়জন অসাধ্য রোগে মারা গিয়ে যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেল। বাড়ি ফিরে ছিনিয়ে নেয়।বাড়ি ফিরে খাম খুলে দেখেন, লেখা তো নেই। বদলে একটি চিঠি। সম্পাদক মশাই লিখেছেন, "আপনার রচনা মনোনীত হয়েছে, শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।"

পরবর্তী কালে বিভূতিভূষণ তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন, ছেলেটি বোধহয় ঈশ্বরের দূত হয়ে সে দিন তাঁর কাছে এসেছিল। ওই বিজ্ঞাপন কাণ্ডটি না ঘটলে তিনি কোনও দিন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না।

সেই ছোকরার আসল নাম ছিল যতীন্দ্রমোহন রায়। ১৩২৮, মাঘ মাসের 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প 'উপেক্ষিতা'। এই গল্পটি সেই বছর শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কারও ছিনিয়ে নেয়।



 *মায়ের খোজেঁ* 


চার পাঁচ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় আসেন। দরিদ্র ব্রাহ্মন বাবার সামর্থ্য নেই ভালো ভাড়া বাড়িতে থাকার।  বাধ্য হয়ে শিশুপুত্রকে নিয়ে নিষিদ্ধ পাড়ায় বস্তিতে ঘর ভাড়া

নিয়েছিলেন। সে ঘরের পাশেই এক মহিলা প্রায়ই ছোট্ট বিভূতিকে ডেকে গল্প করতেন। কখনও টফি দিয়ে আদর করে গালও টিপে দিতেন। মা-ছাড়া বাড়িতে খুব তাড়াতাড়ি শিশু বিভূতি মহিলার স্নেহের কাঙাল হয়ে উঠল। একদিন সন্ধেবেলা জেদ ধরল, ঘরে যাবে

না, তার কাছেই রাতটা থাকবে। মহিলা যত বোঝান, বিভূতি নাছোড়।

মধ্যবয়সে মেসে থাকার সময় একদিন

বিভূতির মনে পড়ল ওই মহিলার কথা। ঠিক করলেন সেই পুরনো পাড়ায় মহিলাকে খুঁজতে যাবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

সেখানে গিয়ে তিনি যত বলেন খুঁজতে এসেছেন সেই মহিলাকে, এ ছাড়া আর অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই, অল্পবয়সি যুবতী মেয়েরা শুনতে নারাজ। একসঙ্গে চার- পাঁচ জন মেয়ে নাকি তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকলেরই আবদার তাঁকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার।

শেষে ছুটে, দৌড়ে, পালিয়ে কোনও ক্রমে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন  বিভূতিভূষণ।


 *মেসবাড়ি ও নীরদ চন্দ্র* 

১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে বিভূতিভূষণ আবার কলকাতায় ফিরে এসে ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটে তাঁর পুরোনো মেসবাড়ি প্যারাডাইস লজে থাকতে শুরু করলেন। এখানে থাকতে এসে সহ-মেসবাসী হিসেবে পেয়ে গেলেন তাঁর সহপাঠী নীরোদচন্দ্র চৌধুরিকে। 

চাকরিটি ছেড়ে দেওয়ার  পেছনে একটা রোম্যান্টিক ঘটনা ছিল। ওই সময় তিনি স্কুলের কাছে একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। তাঁদের একটি বিবাহযোগ্যা তরুণী কন্যা ছিল। সে আড়ালে-আভাসে বিভূতিভূষণকে খেয়াল রাখত।

বিভূতি স্কুলে চলে গেলে প্রায়শই মেয়েটি এসে তাঁর এলোমেলো ঘর সুন্দর করে  গুছিয়ে দিত। বিভূতিভূষণ সে সব বুঝতে পারতেন। কিন্তু কিছু বলতেন না। কারণ, মেয়েটিকে  

তিনি পছন্দ করতেন।  প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কখনওই তাঁর মন-মেজাজ ভাল থাকত না। ঠিক তখনই না চাওয়াতেই এত আদর যত্ন। 

মেয়েটি নিজেকে 'আমি আপনার দাসী' সম্বোধন করে বেশ কয়েকটি চিঠিও

লিখেছিল তাঁকে। সে-চিঠি নীরদচন্দ্র দেখে বলেছিলেন, "এমন পবিত্র পত্র তিনি দেখেননি আগে।"

কিন্তু হঠাৎই বিভূতিভূষণ ওই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। কারণ ওই মেয়েটির উপর তিনি যতই মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন ততই বুঝতে পারছিলেন,  মেয়েটি তাঁদের সমগোত্রীয় নয়। তাই কোনও সম্পর্ক হলে তাঁর পরিবার খুশি হবে না। আশেপাশের মানুষজন  অনেক কথা বলবে।

সবকিছু ভেবে তিনি কাউকে না জানিয়ে প্রায় লুকিয়েই কলকাতায় চলে আসেন। ফিরে এসে স্কুলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। 


 *পথের পাঁচালী* 


প্রকাশের জন্য  ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসেই ‘পথের পাঁচালি’র পাণ্ডুলিপি বিচিত্রার দপ্তরে পাঠালেন বিভূতিভূষণ। সে পাণ্ডুলিপি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হল। বিচিত্রার পাতায় ‘পথের পাঁচালি’ জুলাই, ১৯২৮ থেকে সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ অব্দি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘পথের পাঁচালি’কে পাঠকদের একটা বড় অংশ সাদরে গ্রহণ করেছিল, তবু, বিচিত্রায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের পরেও কোন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক বই হিসেবে ‘পথের পাঁচালি’ ছাপতে রাজি হচ্ছিলেন না। সম্ভবত  নতুন লেখকের প্রথম উপন্যাস ছাপার ব্যাপারে তাঁদের জড়তা ছিল। এই সময় নীরোদচন্দ্র সজনীকান্ত দাসের সঙ্গে বিভূতিভূষণের আলাপ করিয়ে দেন। সজনীকান্ত তাঁর নতুন প্রকাশনা রঞ্জন প্রকাশালয় থেকে ১৯২৯ সালের ২রা অক্টোবর ‘পথের পাঁচালি’ প্রকাশ করেন। দিনটি ছিল মহালয়া। সঙ্গত ভাবেই বিভূতিভূষণ পিতৃতর্পণ হিসেবে তাঁর বাবার স্মৃতিতে উৎসর্গ করেন ‘পথের পাঁচালি’। সজনীকান্ত-র স্ত্রী সুধারাণীর একটি লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, ‘পথের পাঁচালি’র প্রথম সংস্করণের জন্য সজনীকান্ত বিভূতিভূষণকে তিনশ টাকা সম্মান-দক্ষিণা দিয়েছিলেন। 


 *পাঁচালি-র দুর্গা* 


পাঁচশো পাতার 'পথের পাঁচালী' শেষ করে ছাপার আগে  পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে  গিয়ে আশীর্বাদ নেবেন বলে,


 সেরেস্তা থেকে ছুটি নিয়ে ভাগলপুরে হয়ে কলকাতা যাবেন। বিকেলে একা একাই ভাগলপুরের জনবিরল রাস্তায়  দেখলেন সেই নির্জন পথে দাঁড়িয়ে একটি আট-দশ বছরের মেয়ে তাঁর দিকে  তাকিয়ে। বিভূতিভূষণও দেখছেন কিশোরী কন্যাটিকে।বন্ধু যোগেন্দ্রনাথ সিংহকে পরে বলেছিলেন, "মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, চোখে উদ্দেশহীন চাহনি, অথচ মুখে দুষ্টুমির চিহ্ন। মনে হয় স্কুল থেকে পালিয়েছে, নয়তো বাড়ি থেকে মেরে তাড়িয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু দুষ্টুমির মতলব আঁটছে।” তাঁর মনে হয়েছিল ওই কিশোরী কন্যার  দু'চোখের ভেতর এক ব্যথাভরা জগৎ লুকিয়ে।  রবিঠাকুরের কাছে না গিয়ে সে দিনই ফিরে এসেছিলেন জমিদারির সেরেস্তায়। মনে হয়েছিল, এই মেয়েটিকে তিনি যদি তাঁর উপন্যাসে ঠাঁই না দেন, সে লেখা হবে ব্যর্থ এবং নিষ্প্রাণ। পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেললেন।


ডায়েরিতে তাঁর বর্ণনা পাওয়া যায়- "মেয়েটিকে নিয়ে নতুন করে আবার লিখতে বসলাম। সেই মেয়েটিই পথের পাঁচালি-র দুর্গা।”




 *ভালোবাসা* 


ইছামতী নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে বোন জাহ্নবীর মৃত্যু হল। আকস্মিক এই ঘটনায় বিভূতি ভেঙ্গে পড়লেন ।

তার দু'দিন পর একটি অল্পবয়সি মেয়ে এল বিভূতির কাছে অটোগ্রাফ চাইতে।

মেয়েটিকে খুব ভাল লেগে গেল তাঁর। ধীরে, ধীরে দুই অসমবয়সির বন্ধুত্বও বেশ গাঢ় হল। এক বছরের মাথায় দু'জনে বিয়ে করলেন।

পরবর্তী কালে বিভূতিভূষণ কল্যাণী দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "এখন মনে হচ্চে হয়তো অনেক জন্মের বন্ধন ছিল তোমার সঙ্গে- নয় তো এমন হয়ে কেন? কল্যাণী, তুমি আমার অনেক দিনে পরিচিতা, এ বার এত দেরীতে দেখা কেন জানি নে, আরও কিছুকাল আগে দেখা হলে ভাল হতো।"


 *অচেনা লেখক* 


কলেজ স্ট্রিটে এক প্রকাশনা দফতরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।

আড্ডায় তাঁর সমসাময়িক অনেক  সাহিত্যিকও ছিলেন , সেখানে উত্তরবঙ্গ  থেকে দু'জন কম বয়সী ছেলে এলো হন্তদন্ত হয়ে। তারা  জনৈক সাহিত্যিককে ধরলেন। উত্তরবঙ্গে সাহিত্যসভায়  

সাহিত্যিককে সভায় সভাপতি করতে  চায়। কিন্তু লেখকমহাশয় যাওয়ার জন্য নানারকম শর্ত আরোপ করছেন।

শুনে ছেলে দু'টির কাঁচুমাচু দশা।

তারা বারবার বলছে, তিনি না গেলে  তাঁদের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। সেকথা  বিবেচনা করেও যদি একটি বারের জন্য তিনি যান।

কিন্তু সাহিত্যিক তাঁর শর্তে অনড়। শেষে তা ছেলে দুটি নিরুপায় হয়ে ফিরতে যাবে জন হঠাৎ পিছন থেকে বিভূতিভূষণ তাঁদের ডাক দিয়ে বললেন, তিনি গেলে কি তাদের  কাজ হবে?  শুধুমাত্র একটা দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট হলেই চলবে।

তাদের কাছে বিভূতিভূষণের চেহারাটি একেবারে অচেনা। তাই প্রস্তাব শুনে অতি  সাধারণ পোশাক পরা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তাদের থতমত অবস্থা।

ইনি আবার কে?

তাঁদের কিন্তু-কিন্তু ভাব দেখে বিভূতিভূষণ বললেন, "আমার একটা বই আছে। হয়তো শুনে থাকবে, 'পথের পাঁচালী'।" শুনে ছেলে দুটির চোখ বিস্ফারিত। তারা  বললো "আপনি বিভূতিভূষণ।"

উনাকে প্রণাম করে আড়ালে গিয়ে তারা পর বললো, উনি রাজি না হয়ে ভালই হয়েছে।  আপনাকে পাওয়া গেল!

বিভূতিভূষণের এই বলার মধ্যে ছেলে দুটির প্রতি যেমন তাঁর মায়া ধরা পড়ে, প্রন তেমন কোথাও বোধ হয় একস্থান থেকে স্থানান্তরে উড়তে থাকা ডানাও ছায়া ফেলে পর যায় !


 **মনভোলা উদাসীন*  


নিজেকে ভাবতেন তলস্তয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর নায়ক বেজুকভ। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাইরে নরম-কোমল মানুষট কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ কঠোর ছিলেন। প্রয়োজনে খুব কাছের মানুষদের  আশ্চর্য ভাবে ভুলে যেতেন।

অনেক দিনের বন্ধু বিভূতিভূষণ সম্পর্কে এমনই ধারণা ছিল নীরদ চন্দ্র চৌধুরী-র।

স্বাধীনতার  তিন বছর  আগের কথা।  সেই সময় কলকাতায় মাঝেমধ্যেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে।

একবার রাস্তায় দাঙ্গার মধ্যে পড়ে বিভূতিভূষণ একটি বালির বস্তার পেছনে  লুকিয়ে পড়লেন। প্রচন্ড  ভয়ে  বস্তার পিছন থেকে কেবলই বন্ধু নীরদচন্দ্রকে বলছিলেন, "আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, ট্রামে তুলে দিয়ো।"  কিন্তু যে মুহূর্তে ট্রাম এসেছিল  নীরদচন্দ্র দেখলেন, তাঁকে রাস্তায় প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে বিভূতিভূষণ ট্রামে উঠে, চলে গেলেন। ভুলেই গেলেন বন্ধু নীরদ চন্দ্র রয়েছেন,  একবার পেছন ফিরেও তাকালেন না।



তথ্য ঋণ -

১. অচেনা বিভূতি -আনন্দবাজার পত্রিকা (২০১৬)

 ২.  বিভূতিভূষণ  -সম্পাদনা,  মিনাল আলী মিয়া

৩. উইকিপিডিয়া

৪. পথের পাঁচালী ৯০( আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৬)




Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024