এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী - শ্রাবনী আচার্য্য || Ek obishashyo kahini - Sharabani acharya || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

     এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী 

                       শ্রাবনী আচার্য্য


সাল টা ছিল ২০১৬।আমি হরিয়ানায় বি.এড এ পাঠরত ছিলাম।পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেই শুনলাম বাবা মা আমাকে না জানিয়েই পুরী বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।শুনে খুব খুশিই হলাম,কারণ আমি ভূগোলের ছাত্রী,বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।তার ওপর বেড়ানোটা যদি পরিবারের সাথে হয়,তাহলে তো একদম সোনায় সোহাগা।যাইহোক,যথারীতি লক্ষী পুজোর পরের দিন আমরা পুরী যাওয়ার জন্য রওনা হলাম।বাসে উঠেই দেখি প্রায়৬০জন মতো রয়েছেন।সবাই বাবার পরিচিত,কেনকি বাবা ডাক্তার।তাই বাবার খাতিরে,ওনার মেয়ে এবং স্ত্রী হিসেবে আমার আর মায়ের সাথেও ওনাদের আলাপ হয়ে গেল।রাত ১০ তার সময় বাস ছাড়লো রামনগর থেকে।

পরেরদিন ভোরবেলা আমরা নন্দনকানন এ পৌঁছলাম এবং ওখানে চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখলাম।বিকেলে আমরা পুরী পৌঁছলাম।যেহেতু আমরা ট্রাভেলার দের সাথে গেছি তাই পুরীতে থাকার জন্য আমাদের ২দিন বরাদ্দ ছিল।তারপর কোনারকের সূর্য মন্দির,খন্ড গিরি,ধবলগিরি,ভুবনেশ্বর এর লিঙ্গেস্বর মন্দির -এসব ঘোরার পর এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা।৬দিন পর আমরা যখন ওড়িশা দিয়ে বাড়ি ফিরছি তখন বিকেল ৫টা বাজে।ওই রাস্তায় নাকি তারিনী মায়ের মন্দির পড়ে।বাসের সবাই বলছিলেন তারিনী মা নাকি খুব জাগ্রত,ওখানে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরবেন।অগত্যা বাসের ড্রাইভার কাকু ওই মন্দিরের পাশে গাড়ি দাঁড় করালেন।আমরা সবাই নেমে একে একে মন্দিরের দিকে রওনা দিচ্ছি।মন্দিরে ঢোকার মুখেই কয়েকজন ১৫-১৬বছরের ছেলে পুজোর ডালা সাজিয়ে বিক্রি করছে।একটা লাল ওড়না,একটা গোটা নারকেল,আর কিছু ফুল,বেলপাতা ও সিঁদুর ছিল ওই ডালা গুলোতে।যথারীতি আমরা একটা ডালা কিনে পুজো দেয়ার জন্য মন্দিরের মধ্যে ঢুকলাম।মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখি,মন্দিরটা বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে।একটা ঘরের মাঝে তারিনী মায়ের মূর্তি রয়েছে,আর মায়ের চারদিকে প্রায় ১০ইঞ্চি দূরত্বে গোল করে পুরোহিতরা বসে রয়েছেন।আমরা একজন পুরোহিত কে পুজোর ডালা ধরিয়ে দিতেই উনি লাল ওড়নাটা নারকেল এর গায়ে বেঁধে দিলেন,তারপর নারকেল টাকে ফাটিয়ে তার জল টা তারিনী মায়ের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন,আর ফুল বেলপাতা ও ওড়না জড়ানো নারকেল এর টুকরো মায়ের কাছে নিবেদন করলেন মায়ের দিকে ছুড়ে ছুঁড়ে।এরকম পুজো দেখে খুব অদ্ভুত লাগলো আমার।৫মিনিটের মধ্যে পুজোও শেষ হয়ে গেল।তারপর মন্দিরের ভেতরটা আর একটু ভালো করে ঘুরে নিয়ে, মাকে প্রণাম করে বাইরে বেরিয়ে এলাম।মন্দিরের বাইরে এসে দেখি ফুলের ডালা বিক্রেতা ছেলেটার সাথে আমাদের বাসের ড্রাইভার কাকুর কোনও কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে,আর একটু এগিয়ে  এসে শুনলাম যে-বাসের ড্রাইভার কাকুএকজন মুসলিম ধর্মের মানুষ। তাই ওকে পূজার জন্য ডালা নিতে বললে কাকুটি রেগে ওর পরিচয় দিয়ে বলেন-আমি তো মুসলিম, কি করে তোমাদের মন্দিরে পূজো দেব?তুমি ডালা রেখে দাও ভাই, আমি পূজো দেব না।আমরা কিছু না বলেই চলে এলাম এবং যথারীতি বাসে উঠে নিজেদের জায়গায় গিয়ে  বসলাম।সবাই  না এলে তো বাস ছাড়বে না,তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম চিপস খেতে খেতে।২০-২৫মিনিটের মধ্যে সবাই  বাসের মধ্যে চলে ও এলেন।এবার বাস ছাড়ার পালা,আর কোথাও নামবার নেই, সোজা বাড়ি যাব। হালকা ঠান্ডাও পড়ছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো।আমরা সবাই এসে গেছি,ড্রাইভার কাকুও এসে গেছেন, কিন্ত বাস ছাড়ছে না কেন?সবাই পেছনের সিট থেকে বলছেন-কি হল গাড়ী ছাড়ুন,সবাই এসে গেছে তো,আর কেউ বাকি নেই তো।কিন্ত গাড়ি ছাড়ছে না দেখে বাবা উঠে গেলেন ড্রাইভার কাকুর কাছে। কি হয়েছে, গাড়ি ছাড়ছেন না কেন জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার কাকু বাবাকে বললেন- জঙ্গল এলাকা,জায়গাটা ভাল নয়,আমি তো আপনাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইছি।কিন্ত বাস টা যে কেন স্টার্ট নিচ্ছে না বুঝতে পারছি না।এটা শুনেই তো আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়ল।এই অচেনা অজানা জায়গায় কী এই বাসের মধ্যেই সারারাত থাকতে হবে নাকি?বাসটা আর খারাপ হওয়ার জায়গা পেলো না?এই জঙ্গলের মধ্যেই তাকে খারাপ হতে হলো?এখন কি হবে?আমরা বাড়ি যাব  কি করে?ধারে কাছে কোনও দোকান ও নেই যে কোনো মেকানিক কে ডেকে গাড়িটা সারিযে নেওয়া যায়।বাসের মধ্যে অনেক বয়স্ক মানুষ ও ছিলেন, তারা প্রায় হই হটোগোল ফেলে দিলেন চারদিকে।আবার কিছু কুসংস্কার মাখা কথাও শোনা গেল,যেমন-কেউ হয়তো অপবিত্র ছিল?বা কেউ কোনও  দোষ ত্রুটি করে ফেলেছে?তাই তারিনী মা রেগে গিয়ে গাড়ি খারাপ করে দিয়েছেন। এইসব শুনে আমার প্রথমে হাসিই পাচ্ছিল। তারপর এই হাসিটাই মিলিয়ে  গেল যখন ব্যাপার টা আরও গুরুতর হয়ে উঠল। ড্রাইভার কাকু তখন পাশেই একটা ছেলেকে ডেকে বললেন-পাশাপাশি কোন মেকানিক আছে কিনা খবর দিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারবে?আমরা খুব বিপদে পড়েছি।তখন ছেলেটি বলল আছেন একজন,১০-১৫মিনিট লাগবে,আমি ডেকে নিয়ে আসছি।যথারীতি ২০মিনিট বাদে একজন মেকানিক কাকু এলেন। উনি অনেকক্ষন দেখার পর বললেন-কই বাসে তো আমি কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না,বাস স্টার্ট নিচ্ছে না কেন?স্টার্ট না নেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। উনি প্রায় ৩০মিনিট ধরে চেষ্টা করলন,কিন্ত কোনও ফল পাওয়া গেল না।তখন ওই মেকানিক কাকু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, দাঁড়ান আমি আমার মালিক কে ডাকছি,যদি পারেন তো উনিই পারবেন,তা না হলে আর কিছু করার নেই। উনি ওনার মালিক কে ফোন করার প্রায় ২৫মিনিট পর ওনার মালিক এলেন।উনিও প্রায় ৩০মিনিট ধরে চেষ্টা করলেন, বললেন- না,বাসে কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না।বাস স্টার্ট নিচ্ছে না কেন  বুঝে উঠতে পারছি না।তারপর উনি হঠাৎই বললেন ড্রাইভার কাকুকে- যে আপনাদের কোনও ভুল ত্রুটি হয় নি তো?সবাই মায়ের পূজো দিয়েছিলেন?মা কিন্ত খুব জাগ্রত, রেগে গেলে কাউকে ছাড়েন  না।আমি তো খুব অবাক হয়ে গেলাম ওনার কথা শুনে,ভাবলাম ড্রাইভার কাকু তো পুজো দেয়নি,তাই কি মা রেগে গেছেন?তখন দেখি হঠাৎ করে ড্রাইভার কাকুর চোখে জল,উনি বলেন আমি মুসলিম, তাই আমি ফুলের ডালা কিনে মায়ের পুজো দিতে চাইনি।তাই কি মা আমার ওপর রাগ করলেন?তখন মালিক মেকানিক কাকু বললেন- আমাদের তারিনী মা,সবার মা।উনি জাতপাত মানেন না,সবাই ওনার  সন্তান। আপনি শিগগির  যান,স্নান করে ফুলের ডালা নিয়ে মায়ের পুজো দিয়ে আসুন।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।অগত্যা  ড্রাইভার কাকু ছুটে গিয়ে পাশেই একটা নদীতে ডুব দিয়ে একটা ফুলের ডালা কিনে মন্দিরে ঢোকার ৫মিনিটের  মধ্যেই মালিক মেকানিক কাকু গাড়ি স্টার্ট দিতেই, বাস সঙ্গে সঙ্গেই স্টার্ট নিল।তখন বাসের সবাই অবাক। আমার তো গায়ে প্রায় কাঁটা দিয়ে উঠল।তারপর যথারীতি আমরা তারিনী মা কে স্মরণ করে ৭'৩০মিনিটে বাসে রওনা দিলাম। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমি জীবনে ভুলতে পারবো না।আমরা অনেকে বিশ্বাস ই করি না ভগবান আছেন বলে।কিন্ত সেদিন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম যে-না,ভগবান আছেন ই।আর যে জাতপাত নিয়ে সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে এত ভেদাভেদ, তারিনী মা আমাদের চোখের সামনে থেকে সেই ভেদাভেদ দূর করে দিলেন।তিনি জানালেন যে- "সবাই এক,সবার রক্ত এক,সবার একটাই পরিচয়-সবাই মানুষ। "


Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024