পরমবীর - দেবাংশু সরকার || Proambir - Debanshu Sarkar || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story
পরমবীর
দেবাংশু সরকার
আজ হনুমান জয়ন্তী। অর্থাৎ মহাবীর বজরঙবালী শ্রী হনুমানের জন্মোৎসব। এক সময়ে এই উৎসব হিন্দি বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে সারা ভারতেই উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। আমাদের রাজ্যেও এখন হনুমান জয়ন্তী ঘটা করে পালিত হয়। মন্দিরে মন্দিরে হনুমান চালিশা পাঠ হয়। বড় বড় শোভা যাত্রা বের হয়। বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে উৎসবে মেতে ওঠে।
বেশ ধুমধাম করে হনুমান জয়ন্তী পালিত হচ্ছে রাজুদের বাড়ি। রাজুর অর্থাৎ রাজেশ সিং। আমার বন্ধু। রাজুরা অবাঙালি হলেও, বহু বছর বাংলায় থাকার ফলে, বলতে গেলে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গেছে। রাজুর ঠাকুরদার বাবা কলকাতার বড় বাজারে কাজ করতে এসে কলকাতাতে বসবাস করতে শুরু করেন। বড় বাজারের কাছেই একটা ছোটো ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তারপর রাজুর ঠাকুরদা আমাদের পাড়ায় বাড়ি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কথাবার্তা, চাল চলনে বোঝা যাবে না রাজুরা অবাঙালি। এমন কি রাজু পড়াশোনাও করেছে বাংলা মিডিয়ামে।
রাজুদের বাড়িতে আজ আমরা কয়েকজন বন্ধু আমন্ত্রিত হয়েছি। একটা ঘরে বসে আমরা গল্প গুজব করছি, আর পুজো শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ পুজো শেষ হলেই প্লেট ভর্তি কেশর লাড্ডু, মালপোয়া আসবে আমাদের জন্য। যদিও এর মধ্যে কোল্ড-ড্রিঙ্ক এবং সন্দেশ উদরসাৎ হয়েছে। রাজুর দাদুও আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করছেন।
গল্প করতে করতে রাজুর দাদু বলতে থাকেন, "তোমরাতো জানো আমরা ইউ পির সাহজাহানপুরের মানুষ। ইউ পিতেও খুব আড়ম্বরের সঙ্গে হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়। আমাদের সাহজাহানপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। আট বছর আগে অর্থাৎ দুহাজার ষোলো সালে আমাদের সাহজাহানপুরে হনুমানজীর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ছেলে ছোকরা থেকে বৃদ্ধ সকলের মনে কি আনন্দ! কি উদ্দীপনা!"
কথাটা শুনে অবাক হয়ে আমি বললাম, "হনুমানজীর জন্মশত বার্ষিকী! ঠিক বুঝলাম না।"
দাদু হেসে বললেন, "তুমি অবাক হচ্ছোতো বেটা। অবাক হওয়ারই কথা। আমাদের সাহজাহানপুরে উনিশ ষোলো সালের একুশে নভেম্বর স্বয়ং হনুমানজী অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ত্রেতা যুগে হনুমানজী যেরকম বিক্রম দেখিয়েছিলেন, এই কলি যুগের হনুমানজীও একই রকম বিক্রম দেখিয়েছিলেন উনিশ আটচল্লিশ সালে কাশ্মীরের নওশেরায়। সেই হনুমানজী আমাদের দেশের গৌরব, আমাদের জাতির গৌরব।"
দাদুর কথা শুনে আমাদের কৌতুহল বেড়ে গেল। পুরো ঘটনাটা শোনার জন্য আমরা আগ্রহী হয়ে উঠলাম। দাদু বলতে শুরু করলেন সাহজাহানপুরের হনুমানজী অর্থাৎ যদুনাথ সিংয়ের বীরগাথা।
উত্তর প্রদেশের সাহজাহানপুরের খাজুরি গ্রাম। চারিদিকে শষ্যক্ষেত, তার মাঝে কিছু মাটির বাড়ি। গ্রামের মানুষরা অধিকাংশই কৃষিজীবি। মহাজনের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে তারা চাষের কাজে নামে। শষ্যক্ষেতে জোয়ার, বাজরা, রাগী, বিভিন্ন প্রকার ডালশষ্য প্রভৃতি চাষ হয়। ফসল পাকলেই ফড়েরা গ্রামে হাজির হয়। অত্যন্ত কম দামে সেই ফসল কিনে নিয়ে যায়। কৃষকরা ফড়েদের কাছে স্বল্প মূল্যে সেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। গঞ্জে গিয়ে ন্যায্য দামে ফসল বিক্রি করার সুযোগ তাদের থাকে না। কারণ ফসল ফলতে শুরু করলেই মহাজনের লোকেরা এসে হাজির হয়, ধারের টাকা শোধ করার জন্য তাগাদা দিতে থাকে।
গ্রামের মধ্যে এক মাটির বাড়িতে বাস করেন বীরবল সিং রাঠোর। পেশায় কৃষিজীবি। স্ত্রী এবং আট সন্তান নিয়ে তার বেশ বড় সংসার। একার উপার্জনে বীরবলের পক্ষে সংসার সামলানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। সংসার সামলাতে তার ছেলেরাও ক্ষেতে নামেন, হাল ধরেন। তবে তার সেজ ছেলে যদুনাথ অন্যরকম। পড়াশোনা করতে তার একটুও ভালো লাগে না। চতুর্থ শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করে স্কুলের পাট চুকিয়ে যদুনাথ নেমে পড়েন কৃষিকার্যে। সারাদিন ক্ষেতে কাজ করার পর সন্ধ্যার সময়ে যদুনাথ চলে যান মঠে, হনুমান চালিশা শুনতে। হনুমান চালিশা শুনতে তার খুব ভাল লাগে, মোহিত হয়ে যদুনাথ হনুমান চালিশা শুনতে থাকেন। নানাজী ঠাকুরের সুরেলা কন্ঠের হনুমান চালিশা শুনে বিভোর হয়ে যান। কোথায় যেন হারিয়ে যান! মানস চক্ষে দেখতে পান, বীর হনুমান, বজ্রের ন্যায় অঙ্গ যার, তার কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। রণক্ষেত্রে বিপক্ষ শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দেন হনুমানজী। যদুনাথ ভাবেন তিনিও একদিন এরকম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করবেন, বিপক্ষকে ধরাসায়ী করবেন।
ক্ষেত থেকে ফেরার পথে কখনো কখনো যদুনাথ দাঁড়িয়ে পড়েন শের সিংয়ের আখড়ার সামনে। দেখতে থাকেন পালোয়ানদের কুস্তি। অবাক হয়ে দেখেন বিশালদেহী কুস্তিগীররা একে অপরকে অনায়াসে মাথার উপর তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলছে। যদুনাথ বোঝার চেষ্টা করেন তাদের দাঁও প্যাঁচগুলো। যদুনাথের লম্বা চওড়া সুঠাম চেহারা চোখে পড়ে শের সিংয়ের।
একদিন শের সিং যদুনাথকে ডেকে বলেন, "যদু তুই রোজ এখানে দাঁড়িয়ে কুস্তি দেখিস। তোর কুস্তি ভালো লাগে?"
- "হ্যাঁ, কুস্তি আমার খুব ভালো লাগে।"
- "শুধু কুস্তি দেখতে ভালো লাগে, নাকি কুস্তি করতে ইচ্ছা করে?"
- "কুস্তি দেখতেও ভালো লাগে। কুস্তি লড়তেও ইচ্ছা করে। কিন্তু আমিতো দাঁও প্যাঁচ জানিনা। কি করে কুস্তি লড়বো?"
- "যদি তোকে কুস্তির দাঁও প্যাঁচ শিখিয়ে দিই, তাহলে তুই ঐসব পালোয়ানদের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে পারবি?"
- "পারবো গুরুদেব, পারবো। এদের সবাইকে আমি একদিন হারিয়ে দেবো।"
- "তুই যখন আমাকে গুরুদেব বললি, তখন তোকে আমি কুস্তির সব রকম দাঁও প্যাঁচ শেখাবো। এই তল্লাটের সেরা পালোয়ান করে তুলবো।"
দুজনেই কথা রেখেছিলেন। শের সিং তার প্রিয় শিষ্য যদুনাথকে শেখাতে থাকেন কুস্তির যাবতীয় কলা কৌশল। দেখতে দেখতে যদুনাথ হয়ে উঠলেন এক কুশলী কুস্তিগীর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কেবল শক্তিই কুস্তির একমাত্র অস্ত্র নয়। ক্ষিপ্রতা এবং বুদ্ধিরও প্রয়োজন। প্রতিপক্ষের মানসিকতা, তার আক্রমণের ধরন বুঝে প্রতি আক্রমণ করলে সে সহজেই কাবু হবে। বেশ কিছু বড় মাপের কুস্তিগীরকে হারিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই যদুনাথের বেশ নাম ডাক হয়।
সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী, সুদর্শন যদুনাথ যে কেবল শের সিংয়ের নজরে পড়েন তাই নয়, খাজুরি গ্রামের তরুণীদেরও হৃদয় হরণ করে নেন তিনি। কাঁধে হাল নিয়ে যদুনাথ যখন ক্ষেতে যান বা ঘর্মাক্ত কলেবরে আখড়া থেকে ফেরেন, গ্রামের মেয়েরা কেউ স্নানের ঘাট থেকে, কেউ বা গাছের আড়াল থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যদুনাথের দিকে। কিন্তু 'হনুমান ভকৎ বাল ব্রহ্মচারী' যদুনাথের সেসব দিকে নজর নেই। হনুমান চালিশা আর কুস্তি তার জীবনের ব্রত। অন্যদিকে বীরবল সিং তার বড় দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌমা এনেছেন। ছেলেদের সংসারী করেছেন। সেইসঙ্গে ঘরে বেশ কিছু টাকা, সোনা চাঁদি এনেছেন। ভাবছেন এবার যদুনাথের বিয়ে দেবেন। ঘটক লাগিয়েছেন। সেও কয়েকটা অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ের সন্ধান এনেছে। কিন্তু বীরবল সিং যদুনাথকে কিছুতেই বিয়ের ব্যাপারে রাজি করাতে পারছেন না। বারে বারে বোঝাচ্ছেন। যদুনাথের মাও বোঝাচ্ছেন। দাদা বৌদিরাও বোঝাচ্ছেন। না, কেউ পারছেন না যদুনাথকে ব্রহ্মচর্য ত্যাগ করে, সংসারী হওয়ার জন্য রাজি করাতে।
অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে বীরবলের। বিয়ের ব্যাপারে যদুনাথের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ক্রমশ ঝগড়াতে পরিনত হয়। বিরক্ত হয়ে ঘর ছাড়েন যদুনাথ। কিন্তু যাবেন কোথায়? সারাদিন খাওয়া জোটেনি। অভুক্ত শরীর ক্রমশ ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে আসছে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে যদুনাথ হাজির হলেন আখড়ায়। সেখানে তার পুরানো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। সে কিছুদিন হলো সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেই বন্ধু যদুনাথকে পরামর্শ দেয় পল্টনে ভর্তি হতে। পল্টনে ভর্তি হলে যদুনাথ পাবেন ভরপেট খাবার। সেইসঙ্গে আরো বড় মাপের কুস্তিগীরদের সঙ্গে লড়াইয়ের সুযোগ। এক কথায় রাজি হয়ে যান যদুনাথ। ভালো খাবারের প্রলোভনতো আছেই, সেইসঙ্গে নিজের এলাকার কুস্তিগীরদের সঙ্গে মাসের পর মাস লড়তে লড়তে ব্যাপারটা ক্রমশ একঘেয়েমিতে দাঁড়িয়েছে। পল্টনে ঢুকলে আরও অনেক কুশলী কুস্তিগীরদের সঙ্গে লড়াইয়ের সুযোগটাও তাকে প্রলোভিত করে। পল্টনে ভর্তি হলেন যদুনাথ। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে চাকরি পেয়ে প্যারেড আর কুস্তি করে বেশ আনন্দেই দিন কাটতে থাকে যদুনাথের।
বিশ্ব জুড়ে বাজছে রণ দামামা। বাতাসে বারুদের গন্ধ। বোমা বন্দুকের আওয়াজে কেঁপে উঠছে সমগ্র বিশ্ব। পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কখনো এগিয়ে যাচ্ছে মিত্র শক্তি, কখনো আবার অক্ষ্যশক্তি। ঘনঘন পালা বদল ঘটছে যুদ্ধের। এশিয়া মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বযুদ্ধের আঁচ। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে কখনো মাথা তুলছে জাপান, কখনো আবার ইংল্যান্ড আমেরিকার যৌথ বাহিনী।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন যদুনাথ। যদুনাথের বন্দুকের নিখুঁত নিশানা, সেই সঙ্গে ধেয়ে আসা শত্রুদের কখনো মুষ্ঠাঘাতে, কখনো মল্লযুদ্ধ করে ধরাসায়ী করেছেন যদুনাথ। তার বিক্রমে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে শত্রু শিবিরে। যেন স্বয়ং বজরঙ বালী নেমে এসেছেন আরাকানের যুদ্ধে। যদুনাথের প্রবল প্রতাপ প্রশংসা কুড়িয়েছে ইংরেজ সেনাধক্ষদের থেকেও।
অবশেষে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হলো জাপান। দিকে দিকে স্তিমিত হয়ে আসতে লাগলো যুদ্ধের বাতাবরণ। বাতাস থেকে সরে গেলো বারুদের গন্ধ। থেমে গেলো গোলাগুলির শব্দ। শান্তি ফিরে এলো বিশ্বজুড়ে।
কয়েক বছর পর স্বাধীনতা লাভ করলো ভারত বর্ষ। অবসান হলো দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের। লাল কেল্লায় উঠলো তেরঙ্গা। বেজে উঠলো জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে এলো দেশ ভাগের জ্বালা এবং আরও কিছু জটিলতা। প্রায় পাঁচশো দেশীয় রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ এবং কাশ্মীর রাজি ছিল না ভারতভুক্ত হতে। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীনভাবে থাকতে চাইছিলেন। ভারত পাকিস্তান কোনো পক্ষেই যোগ দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু তার অগোচরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছিল। শুরু হলো অরাজকতা। পাকিস্তানের মদতে কিছু অনুপ্রবেশকারী হামলা শুরু করলো কাশ্মীরে। অত্যাচার, লুঠপাট, গনহত্যার মাধ্যমে অতিষ্ঠ করে তুললো কাশ্মীরের অধিবাসীদের। ক্রমশ শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো সশস্ত্র হিংস্র অনুপ্রবেশকারীরা। মহারাজ হরি সিং নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ভারতের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন এবং ভারতে অন্তর্ভুক্তি চুক্তিতে সাক্ষর করলেন। পরের দিনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো ভারত। শ্রীনগরে নামলো ভারতীয় সেনা।
পাকিস্তান একসঙ্গে অনেকগুলো ফ্রন্টে আক্রমণ করে। তার মধ্যে তাইন্দর ছিল নওশেরা সেক্টরের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট। পাকিস্তানের কাছে তাইন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ তাইন্দর দখল করতে পারলে শ্রীনগরের বিমান ঘাঁটি দখল নেওয়ার পথ সুগম হবে।
উনিশশো আটচল্লিশ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি শ্রীনগরে পৌঁছে ভারতের পঞ্চাশ নম্বর প্যারা ব্রিগেড নওশেরা আক্রমণ করে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এই লড়াইতে পাকিস্তানের সেনারা ব্যাপকভাবে হতাহত হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ছয় ফেব্রুয়ারি শত্রুরা শক্তি সঞ্চয় করে আবার তাইন্দর পাহাড়ের পিকেটে গুলি চালিয়ে আক্রমণ করে। গোটা শৃঙ্গ এবং আসে পাশের এলাকা গুলি এবং মর্টারের শব্দে কেঁপে ওঠে। অন্যদিকে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে শত্রুরা ভারতীয় পিকেটের দিকে এগোতে থাকে। ভোর বেলা পোষ্টটা দখলের জন্য মুহুর্মুহু আক্রমণ করতে থাকে।
দুই নম্বর পিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েক যদুনাথ সিং। তিনি অসাধারণ বীরত্ব এবং নেতৃত্বের প্রদর্শন করে, মাত্র নয়জনকে সঙ্গে নিয়ে, শত্রুদের বিরাট বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে পশ্চাদপসারন করাতে সক্ষম হন। কিন্তু দুরদর্শী এবং অভিজ্ঞ যদুনাথ বুঝতে পারেন যে পরবর্তী আক্রমণ কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাই তিনি বারে বারে আরো সেনা পাঠানোর জন্য হেড কোয়ার্টারে বার্তা পাঠাতে থাকেন। কিন্তু হেড কোয়ার্টার থেকে সেনা পাঠানোর কোনও আশা নেই দেখে তিনি পরবর্তী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হন।
হাতে সৈন্য সংখ্যা কম, অস্ত্র সংখ্যাও কম। এমনকি তার ব্রেন গানারও মারাত্মক ভাবে আহত, তার পক্ষে বন্দুক ধরা সম্ভব নয় দেখে যদুনাথ নিজের হাতে তুলে নেন ব্রেন গানটি এবং অপেক্ষা করতে থাকেন শত্রুদের পরবর্তী আক্রমণের জন্য।
আবার এগিয়ে আসছে শত্রুরা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে তারা। এক, দুই, তিন যদুনাথ গুনতে থাকেন শত্রুদের সংখ্যা। ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ছে! এত সংখ্যক শত্রুর মোকাবিলা কি করে করবেন তিনি? পরাজয় অবশ্যম্ভাবি।
এবারে সরাসরি পোষ্টের দেওয়ালে আক্রমণ করে বসে শত্রুরা। কিন্তু অসামান্য রণকুশলতা এবং বীরত্বের নমুনা রেখে, আবার নিশ্চিত পরাজয়কে জয়ে রূপান্তরিত করেন যদুনাথ সিং। কিন্তু এই লড়াইতে তার সমস্ত সেনা শহীদ হন।
একা আহত যদুনাথ তার পোষ্ট পাহারা দিতে থাকেন। তিনি জানেন শত্রুরা আবার আসবে এবং পোষ্ট দখলের মরিয়া চেষ্টা চালাবে। সীমিত পরিমাণ গোলা বারুদ নিয়ে তিনি পোষ্ট পাহারা দিতে থাকেন।
আবার! আবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে ওরা! যদুনাথ অপেক্ষা করতে থাকেন। শত্রুরা তার বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্রই গর্জে ওঠে তার বন্দুক। অসংখ্য শত্রুকে ধ্বংস করতে করতে এক সময়ে শেষ হয়ে যায় তার গোলা বারুদ। কিন্তু এখনও যে কয়েকজন শত্রু জীবিত আছে! তাদের শেষ করতে না পারলে এই পোষ্ট যে বেদখল হয়ে যাবে! এদিকে বন্দুকের গুলিও শেষ! এবার কি করবেন যদুনাথ? পোষ্ট বাঁচাতে মরিয়া যদুনাথ বন্দুকের মাথা থেকে বেয়নেট খুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুদের উপরে। শত্রুদের বন্দুক থেকে গুলি ছুটে আসতে থাকে তার দিকে। সে সবের পরোয়া না করে তিনি শত্রু নিধন করতে থাকেন। আচমকাই দুটো বুলেট তার মাথায় এবং বুকে বিঁধে যায়। শহীদ হন যদুনাথ। প্রাণ দিলেও তার পোষ্টকে বেদখল হতে দেননি ভারতের গর্ব যদুনাথ সিং। পরমবীর চক্র জয়ী, ভারত মাতার বীর সন্তান, অমর শহীদ যদুনাথ সিং।
দেখলাম কথা বলতে বলতে দাদুর দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রু। দুফোঁটা অশ্রু নাকি শ্রদ্ধার্ঘ?
Comments