জলাতঙ্ক - সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় || Jolatanko - Sushil Bandopadhyay || রম্যরচনা || Ramayarochona
জলাতঙ্ক
সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্ৰীষ্মকাল এলেই মনে পড়ে যায় কলতলার ঝগড়া কাকে বলে।এখনকার মানুষ সেই দৃশ্য চিন্তাও করতে পারবে না।বিশ শতকের শেষ দশকে তখনো শহরাঞ্চলেও ঘরে ঘরে জলের সংযোগ ছিলো না,রাস্তার টাইম কলই একমাত্র ভরসা।গ্ৰীষ্ম শুরু হতে না হতেই জলের জন্য হাহাকার।রাস্তার কলগুলো ভোর থেকে কিরকম ফ্যাকাশে মেরে পড়ে থাকতো,যেন কিচ্ছুটি জানে না,অথচ একটু পরে এই নির্জীব বস্তুটিই কিরকম বিপ্লব ঘটাবে।তার উপর একটা কাক বসে আবার 'কা কা' করে যেন তার সাময়িক নিঃস্বতাকেই প্রকাশ করে যাচ্ছে।কলের সামনে নানা রঙের নানা সাইজের জল সংগ্ৰহের পাত্র লাইন দিয়ে নামানো।বালতি,হাড়ি,কলসী,জারিকেন,বোতল,মগ কিছু বাকি নেই।এগুলো সিম্বলিক।কাছাকাছি কোনো মানুষজন নেই, কিন্তু এগুলো তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে।কে কোথা থেকে নজর রাখছে বোঝার উপায় নেই।লাইন একটু এদিক হওয়ার জো নেই,কুরুক্ষেত্র লেগে যাবে।কেউ হয়তো হাঁড়ি কড়াই কিছু খুঁজে পায়নি তো একটা আধেলা ইট দিয়ে রেখেছে, তার আইডিন্টিটি নিয়ে পরে অবশ্যই বচসা হবে।আপাততঃ সবাই ঘরে ঘরে আসন্ন লড়াই এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।মহিলারা ওড়না খুলে নাইটির উপর কোমরে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে,ছেলেরা লুঙ্গি দু ভাঁজ করে গামছা দিয়ে শক্ত করে কোমরে বেঁধে নিয়েছে।শাড়ি ধুতি,জামা প্যান্ট এখানে চলবে না।ড্রেস কোড আছে।লড়াই এর ড্রেস।
কলগুলোও তেমনি, এক বারে গলগল করে জল আসে না,প্রথমে ঘড়ঘড়ার নলে তামাক ফিরছে সেরকম আওয়াজ হয়,সেই শব্দ শুনে সবাই ছুটে এসে নিজের নিজের লাইন সামলায়।তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কলগুলো উপস্থিত সকলকে টেনশনে ফেলে দিয়ে হাপানি রুগীর মতো আওয়াজ করে,আদৌ আসবে না কি আওয়াজটাই সার বোঝা যায় ন। এরপর অতিরিক্ত ভোজ খাওয়া মানুষের মতো কলগুলি কিছুক্ষণ বমির মতো ঘোলা জল ফেলে।পরিষ্কার হতে একটু সময় লাগে।ততক্ষণে মানুষ অধৈর্য হয়ে ওঠে,লাইনের প্রথম মানুষটির উপর চাপ বাড়ে।তারপর যেই না জলের রঙ একটু সাদা হয়েছে হাঁড়ি কড়াই জেগে ওঠে।বোঝা যায় পাড়াতে জল এসেছে।কলতলা বাঙময় হয়ে ওঠে।মানুষ তো চুপচাপ থাকতে পারে না।পাড়ার সব খবর এখানেই পাওয়া যায়।ভালো খবর, মন্দ খবর,গোপন খবর,চাপা খবর, হাঁড়ির খবর,নাড়ির খবর সব।ভালো কথায় সাজানো নিন্দে,তীর্যক কথায় সাজানো প্রশংসা এগুলোও।
কেউ কেউ লাইনের বাড়তি সুবিধা নেওয়ার তালে থাকে।বরাদ্দ পাত্রগুলি তো ভর্তি করলোই,তার উপর ভালো মন্দ কিছু বলতে বলতে একটা বরাদ্দের অতিরিক্ত বোতল ভর্তি করে নিলো,কথার মারপ্যাঁচে কেউ খেয়াল করলো না ।যদি ত্যাঁদোড় ধরণের কারো চোখে পড়লো তো সেই চালাকি বের করে ছাড়ল।কারো হয়তো জায়গাগুলি আয়তনে ছোট,সে তখন বরাদ্দ জল অশুল করতে ঘরের কাঁচের গ্লাস থেকে শুরু করে চামচটি পর্যন্ত নিয়ে আসতে ছাড়ে না।কলতলার বচসা শুরু হতে দেরি লাগে না।একটু ছুতো পেলেই হলো।আর যদি পুরোনো কোনো রাগ থাকে তবে তো কথাই নেই।চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ছেড়ে দেয়।বাড়ির সবার উদ্দেশ্যে গালমন্দ দেওয়া শেষ হয়ে গেলে মামা বাড়ি,বাপের বাড়ির লোকজনদের নাম ধরে ধরে গাল দেয়।কার কদ্দুর পড়াশোনা,কার কত আর্থিক ক্ষমতা,কার কত লোকবল সব হিসেব বেরিয়ে আসে।পাড়ার কিছু কুচুটে লোক থাকে,এসময় পরস্পরকে লাগিয়ে দিয়ে তারা গোপনে নখ বাজিয়ে আনন্দ নেয়।কলতলা থেকেই আমরা তখন শুনতাম নাকি মাস্তান তৈরি হয়,তথাকথিত দাদা তৈরি হয় বা খান্ডারনি দাপুটে মহিলার সৃষ্টি হয়।সে যাই হোক,শেষ পর্যন্ত ভাবতে গেলে যা কিছু ঘটে সব তো জলকে কেন্দ্র করেই।আর কিছু না,মানুষ সারাদিনের খাবার জলটুকু সংগ্ৰহ করতে চায়।তাই কখনো কখনো মনে হয় জল তুমি শুধু "জীবন" নও,"মৃত্যু"ও।
কী জন্য রয়েছ সিন্ধু,তৃণশস্যহীন-
অর্ধেক জগৎ জুড়ি নাচ নিশিদিন।
Comments