নিবারণবাবু ও পিকনিক - অভীক মুখার্জী || Nibaronbabu o picnic - avik Mukherjee || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 নিবারণবাবু ও পিকনিক

                অভীক মুখার্জী




শীতকাল এলেই নিবারণবাবু একটু আতঙ্কে থাকেন এই বুঝি পিকনিকের প্ল্যান হল। কেন?  নিবারণবাবু কি পিকনিক পছ্ন্দ করেন না? নাকি উনি সোস্যালি অকওয়ার্ড? কোনোটাই নয়,উল্টে পিকনিকের হইচই নিবারণবাবু খুবই ভালোবাসেন।তাহলে আতঙ্কে ভোগেন কেন?কারণ আছে,একটা ঘটনা ঘটেছিল বছর দশেক আগে, আর তারপর থেকেই গুটিয়ে গেছেন নিবারণবাবু।কি ঘটনা?বলি শুনুন তাহলে।


নিবারণবাবুর একটা বন্ধুদের গ্রুপ আছে।সব একদম ছোটোবেলাকার বন্ধু,প্রায় প্রত্যেকেই একই স্কুলে পড়েছেন প্রায় বছর দশেক একসাথে।তারপর কলেজ জীবনে ছড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জায়গায়।পরবর্তীতে কর্মসূত্রে আরও দুরবর্তী জায়গায় এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে গেছেন অনেকে।কিন্তু বন্ধুত্বের সূত্র পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়নি।স্মার্টফোন আসার পর সোশ্যালমিডিয়ার দৌলতে অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আবারো যোগাযোগ হয়েছে।এই সব বন্ধুদের গ্রুপে সাধারণত কয়েকজন খুব এ্যাকটিভ থাকে। নিবারণবাবুদের গ্রুপে সুমিত সেইরকমই একজন।মূলত তার উদ্যোগেই ১৯৯৪ উচ্চমাধ্যমিক পাস ব্যাচের বন্ধুদের পিকনিক শুরু হয় ২০০৯ সালে। নিবারণবাবু তখন কর্মসূত্রে মুম্বইনিবাসী।সুমিতের কাছ থেকে জানতে পারতেন সেই সব পিকনিকের কথা আর ভাবতেন তিনিও কবে যোগ দেবেন সেই পিকনিকে। ২০১০ সালে যখন নিবারণবাবু কলকাতা ফিরলেন তখন সুমিত আবার কর্মসূত্রে গুয়াহাটিতে।সে কলকাতায় ব্যাক করার পর আবার পিকনিকের আয়োজন হল ২০১২ ডিসেম্বরে।নিবারণবাবুর আনন্দ তো আর ধরে না।কতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে।কয়েকজনের সঙ্গে ফেসবুক মারফত যোগাযোগ থাকলেও বেশিরভাগের নম্বরটাও নেই নিবারণবাবুর কাছে। তাদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় উত্তেজনায় ফুটছেন নিবারণবাবু। সুমিতের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন প্রায় জনা ত্রিশ কনফার্মড আসছে। এমন অনেকের নাম রয়েছে সেই লিস্টে যাদের সঙ্গে স্কুলের শেষ দিনের পর আর দেখাই হয়নি। পিকনিক ঠিক হওয়া ইস্তক নিবারণবাবুর মুখে খালি বন্ধুদের গল্প। প্রথম প্রথম বেশ মন দিয়ে শুনলেও ওঁর স্ত্রী শেষপর্যন্ত বিরক্ত হতেই লাগলেন। কিন্তু  নিবারণবাবুর কিছু এসে যায়না তাতে।তা সেই বন্ধুদের ভালো নামগুলো আসলে কী ছিল সেগুলো আর ওনার মনে নেই।লম্বু,মোটা,কালু,রাঘো,বোদো,কি আজব নাম সব! এই সব অদ্ভুত নামগুলো শুধু বন্ধুদের মধ্যেই নয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন শিক্ষকমহলেও ছড়িয়ে পড়েছিল।এখন পিকনিকের লিস্টে ভাল নামগুলো দেখে নিবারণবাবু তাঁদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলেন। 

অবশেষে এসেই গেল সেই বহুপ্রতিক্ষিত দিন।রবিবার সকালে যেখানে নিবারণবাবু নটার আগে বিছানা ছাড়েননা , সেদিন সকাল সাতটায় চানটান করে এক্কেবারে রেডি।তর সইছেনা তাঁর আর। উত্তরপাড়ায় এক বন্ধুর কাকার একটা বাড়ি আছে অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়ার,সেই বাড়িতেই হবে গেটটুগেদার।আর এক বন্ধু যাকে গুন্ডা বলে ডাকতেন সকলে, তার এখন ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা। সেই কস্ট টু কস্টএ খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আর এক বন্ধু “কাগা”, যে এখন নামকরা শিশুচিকিৎসক, সে ভেনুর ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছে।বাকি সকলের কান্ট্রিবিউশন ধরা হয়েছে পার হেড ৩০০ টাকা করে।সকালে জলখাবার দিয়ে শুরু, দুপুরে লাঞ্চ আর বিকেলে চা এর সঙ্গে স্ন্যাকস। নিবারণবাবু অবশ্য মেনুর থেকেও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় বেশি খুশী।সকাল দশটায় সবার একসঙ্গে মিট করার কথা।জায়গাটাও নিবারণবাবুর বাড়ি থেকে মেরেকেটে পনেরো মিনিট। তবু নিবারণবাবু সকাল নটার সময়েই বেরিয়ে পড়েন।না না, নিবারণবাবুতো নন, বেরোলো তো নিবু । নিবারণবাবুকে তাঁর বন্ধুরা তো ওই নামেই ডাকত। খালি সেদিনের সেই রোগা প্যাংলা নিবু,যার মাথায় ছিল ঢেউখেলানো ঘন চুল,সময়ের অভিঘাতে সে এখন রীতিমত মোটাসোটা এক মধ্যবয়স্ক মানুষ, মাথার চুল পাতলা হতে হতে টাক দেখা দিয়েছে পরিষ্কার।নিবু সাইকেল ছাড়া এক পা বেরোত না, আর এই নিবারণবাবু রিকশা আর গাড়িতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।নিবুর সাইকেলটা তাই অযত্নে আজো পড়ে আছে সিঁড়ির তলায়।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিবারণবাবু একটা রিকশা নিয়েই নিলেন।প্রথমে ভেবেছিলেন হেঁটেই চলে যাবেন। কিন্তু তারপর আবার ভাবলেন হাঁটতে সময় লেগে যাবে বেশী। উত্তরপাড়ায় ঢোকার মুখেই সেই “ঢাকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”।স্কুল জীবনের সেই ছোট্ট দোকানটা এখন বিরাট বড় হয়ে গেছে।নিবারণবাবুর মনে পড়ে যায় নিবু এখান থেকে কত সিঙারা আর পান্তুয়া খেয়েছে তার দৈনিক হাতখরচার ২টাকা দিয়ে।নিজেকে সামলাতে পারেন না নিবারণবাবু। ঢুকেই পড়েন দোকানে।ঝাঁ চকচকে শোকেসে রকমারি মিষ্টি সাজানো থাকলেও অর্ডার দিলেন সেই সিঙারা আর পান্তুয়া।বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এক প্লেট মুসেলি খাইয়ে দিয়েছেন স্ত্রী,কিন্তু আজকের দিনটাতো একটু অন্যরকম। ছোটবেলার সেই সিঙারা পান্তুয়ার স্বাদ না পেলেও নিবারণবাবুর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।

মিষ্টির দোকান থেকে পিকনিকের ভেনু কাছেই। যত কাছাকাছি পৌঁছন, নিবারণবাবুর উত্তেজনার পারদ ততই বাড়তে থাকে।ইতিউতি দেখতে থাকেন,যদি কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।ঠিক তখনই চোখে পড়ে এক ভদ্রলোক, বেশ লম্বা,এক মাথা কাঁচা পাকা চুল,তাঁর দিকে একই ভাবে দেখছেন উল্টোদিকের পানের দোকান থেকে।খুব চেনা চেনা মনে হয় ভদ্রলোককে। চকিতে সব কিছু মনে পড়ে যায়।

“আরে লম্বু না ?চিনতে পারছিস?”নিবারণবাবু প্রায় চিৎকার করে ওঠেন। ‘নিবু মনে হচ্ছে। আরে। কত মুটিয়েছিস রে!’ সেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন নিবারণবাবুকে।ঠিক সেই সময় একটা বাইক এসে দাঁড়ায় তাঁদের ঠিক পাশে। বাইকারোহী হেলমেট খুলে কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরে দুজনকেই।নিবারণবাবু এই বন্ধুর নামটা কিছুতেই মনে করতে পারেন না, অয়ন না সায়ন?যে হবে হোক, আজ সবাই শুধু বন্ধু, নামটা বড় কথা নয়।লম্বু পানওলাকে অর্ডার দেয়, ‘তিনটে গোল্ডফ্লেক’। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না বাকি দুজন সিগারেট খায় কিনা। তিন বন্ধু সিগারেট ধরিয়ে পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই শুরু করে দেয় গল্প।বহুদিনের বহু গল্প যে জমা হয়ে রয়েছে।দেখতে দেখতে আরো দু তিন জন এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। নিবারণবাবু যথারীতি নামগুলো কিছুতেই মনে করতে পারছেন না, না চেহারাগুলো মেলাতে পারছেন ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে। গল্প করতে করতেই সবাই পৌঁছুলেন সেই বাড়িটায়।ভেতরেও অনেকে এসে গেছে ততক্ষণে।নিবারণবাবুদের ঢুকতে দেখে সবাই হই হই করে ওঠে।

‘আরে নতুন লোক এসেছে রে।কিরে ব্যাটা নিবু? যা মোটা হয়েছিস চিনতেই পারা যাচ্ছে না।’কেউ একজন নিবারণবাবুর পিঠে একটা বিশাল থাপ্পড় কষিয়ে বলে।পেছন ফিরে নিবারণবাবু নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেন না। এক সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড নিরুপম ওরফে মামা। সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত পাশাপাশি বসা, টিফিন শেয়ার, একসঙ্গে নীলডাউন, কত শত স্মৃতিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় নিবারণবাবুর। “কেমন আছিস মামা?” নিবারণবাবু জড়িয়ে ধরেন বন্ধুকে।আর একজন কেউ বলে ওঠে “শালা আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? ব্যাস তারপর যেটা হল সেটা আমেরিকান ফুটবলে যে হাডল হয় তার দেশি ভার্সন।এরই মাঝে কেউ একজন চিৎকার করে “থ্রি চিয়ার্স ফর নাইনটিফোর ব্যাচ।” বাকি সবাই ধুয়ো ধরে “ হিপ হিপ হুররে”। ঠিক কুড়ি বছর আগে যেমন হত।

প্রাতমিক পুনর্পরিচয়ের পালা সাঙ্গ করে সবার এবার  মনে পড়ে জলখাবারের কথা। আবার যেন স্কুলের দিনগুলো ফিরে আসে।লম্বু মামার প্লেট থেকে দুটো লুচি তুলে নিতে নিতে বলে “ তোর না পেটে গন্ডগোল? আবার লুচি খাচ্ছিস তার পরেও।” স্কুলের টিফিনের লুচি তুলে নেওয়া নিয়ে লম্বু আর মামার মারামারি ছিল নিত্যকার ঘটনা।এখন অবশ্য সে সব কিছুই হলো না।উল্টে মামা লম্বুর পাতে খানিকটা তরকারি তুলে দিয়ে বলল “গেল গেল, আরও গেল, এ্যাতো গিলিস তবু তোর গায়ে মাংস লাগে না কেন বলত?” ওদিকে দিবাকর মানে ব্যাঙ মুখে দুটো রসগোল্লা ঠুসে চোখ বুজে যেন জাবর কাটছে। নিবারণবাবুর মনে পড়ে এই ব্যাঙ মাঝে মাঝেই টিফিনের দরবেশ চুরি করত ঠিক এই ভাবেই।সময় বোধহয় সব কিছুকে চেঞ্জ করে দেয় না।

জলখাবারের লুচি আলুরদম মিষ্টি শেষ হতে নাহতেই সুমিত এককোণে রাখা একটা বড় ব্যাগ থেকে বের করে ফেলল দুটো বড় বোতল,একটা হুইস্কি অন্যটা ভদকা।তাদের বন্ধু শিবাশিষ এখন এক বিদেশি মদ কোম্পানির বড়কর্তা।সেই স্পনসর করেছে এই পানীয়।ব্যাস শুরু হয়ে যায় নরক গুলজার। নিবারণবাবুও বাদ জাননা ।বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় স্ত্রী যদিও পইপই করে মদ্যপানে না করেছিলেন, কিন্তু নিবারণবাবু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না।বন্ধুদের সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করতে করতে উড়ে যেতে লাগল গ্লাসের পর গ্লাস।পাল্লা দিয়ে উড়তে থাকল ভেজ আর চিকেন পকড়ার প্লেট।দেখতে দেখতে দু বোতল শেষ।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ হলে হবে কী করে? নিমেষে হাতে হাতে বেশ মোটা চাঁদা উঠে যায়।মানস বাইকের পেছনে শান্তনুকে বসিয়ে ছুট লাগায় বটব্যালের দোকানের দিকে।দোকান বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে।

এদিকে হুইস্কি আর ভদকার মিক্সচার খেয়ে নিবারণবাবু সামান্য, না না, বেশ একটু বেসামাল হয়ে পড়েছেন।কখনো মনটা ফুরফুরে লাগছে তো কখনো চাপা দুঃখগুলো গুড়গুড়িয়ে উঠছে।পাশে বসা মামার সঙ্গে সে সব কথাই চলছে।মামার অবস্থাও খুব একটা স্বাভাবিক নয়।সেও কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে।নিবারণবাবু অনেক দুঃখ নিয়ে তাঁকে বলতে গেলেন “ দ্যাখ মামা, যত দিন যাচ্ছে তত ফুলে যাচ্ছি।কোথায় মাথায় চিরুনি চলত না ! এখন দ্যাখ, টাক চকচক করছে, ছোটবেলাটাই ভালো ছিল রে , এত চিন্তা ছিল না”।ব্যাস, শোনা মাত্র মামা যেন ফেটেই পড়ে “আব্বে নিবু, তোর বুদ্ধিটা কি এখনো হাঁটুতেই আছে?এখন কি খারাপ আছিস শুনি? মদ গিলছিস, হুল্লোড় করছিস,আর কি চাই?আমায় দেখ, এমএসসি ফার্স্টক্লাস পেয়ে এখন লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। কিন্তু তোফা আছি।কম্প্রোমাইস গুরু, পুরো লাইফটাই কম্প্রোমাইস”।পাস্ থেকে ব্যাঙ ফুট কাটে “তা যাই বল ভাই, মাল খাবার ব্যাপারে কিন্তু কোন কম্প্রোমাইস নয়।” এইরকম টুকরোটকরা কথাবার্তা চলতেই থাকে। মানস ফিরে এসেছে ততক্ষণে, সঙ্গে এক ক্রেট বিয়ার। আসতে না আসতে সেগুলোও শেষ।

নিবারণবাবু পুরো আউট ততক্ষণে।একে তো এত বছর বাদে বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে দেখা, তারওপর হুইস্কি, ভদকা আর বিয়ার এর বিচিত্র ককটেল।কী বলছেন কী করছেন কোনও কিছুর ওপরেই নিবারণবাবুর আর কোনো কন্ট্রোল নেই।অন্যান্যদের অনেকের অবস্থাও প্রায় একই রকম।খালি জনা পাঁচেক যারা জলবিহার করেনি তারাই সোবার আছে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে হুড়হুড় করে।দুপুরের লাঞ্চও রেডি ইতিমধ্যে। যারা স্বাভাবিক আছে তারা প্রায় ধরাধরি করে বাকি বন্ধুদের বসিয়ে দেয় খেতে।দুপুরের লাঞ্চের মেনুটাও বেশ জমকালো।পোলাও, তোপসে ফ্রাই, মাটন কষা, চাটনি, পাঁপড় আর রাজভোগ।যে টেবিলে সুশোভন মানে মোটা বসেছে তাকে ঘিরে বন্ধুদের একটা জটলা তৈরি হয়।শোনা যায় ক্লাস ১২ এ পড়ার সময় মোটা কোনো এক বন্ধুর দিদির বিয়ের নেমন্তন্নে ২১টা ফিশ ফ্রাই, এক বালতি মাটন আর ৫০টা রসগোল্লা খেয়েছিল।এত বছর পরেও সুশোভন সেই একই রকম আছে।তার বিশাল বপু বিশালতর হয়েছে।কিছুদিন আগে এক বৃষ্টির রাতে রেনকোট পরে অন্ধকার রাস্তায় বাইক চেপে আসার সময় রাস্তার ধারে কয়েকজন মহিলা তাকে নাকি অটো ভেবে ভুল করেছিল।সেটা আবার তার নিজের মুখ থেকেই শোনা।এক পেট মদ খাওয়ার পরও সুশোভন নিজের ফর্ম বজায় রাখছিল লাঞ্চের টেবিলে।সেই সুশোভনের পাশে বসে নিবারণবাবু সঙ্গ দোষে বা গুণে যাই হোকনা কেন, স্বাভাবিক দিনের প্রায় দ্বিগুণ খেয়ে ফেললেন।খেয়ে তো ফেললেন, কিন্তু উঠতে আর পারেন না।এঁটো হাতেই গুম মেরে বসে রইলেন।দেখতে দেখতে থুতনিটা প্রায় বুকে ঠেকে গেল।মাঝে হালকা করে একটু নাক ডাকার শব্দও শোনা গেল যেন।তখন বাকি বন্ধুরা খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত ছিল বলে বিশেষ নজর দিল না কেউ।

সবার যখন খাওয়া শেষ হল তখন বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।টানা গল্প করতে করতে বন্ধুরাও যেন একটু হাঁপিয়ে গেছে,বিশেষ করে হেভি লাঞ্চের পরে।সুমিত হটাৎ হাঁক পাড়ে “ওরে কেউ একটু মিউজিক চালা কেউ, নাচ না হলে পিকনিক হয় নাকি?” কেউ একটা হিন্দি গান চালিয়ে দিল মোবাইলে। শুরু হল নাচ। চটকা ভেঙ্গে নিবারণবাবুও সোজা নাচতে শুরু করেন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, নিবারণবাবু নাচছেন। জীবনে নিবারণবাবু কোনওদিন নাচেন নি, এমনকি পুজোর ভাসানেও নয়। কিন্তু এখন জনা পনেরো বন্ধু মিলে এক অদ্ভুত নাচ জুড়লেন যেটাকে নাচ না বলে আবোলতাবোল লাফালাফি বলাই ভালো।এই যে নিবারণবাবু , ১০ মিনিট হাঁটতেও যাঁর প্রবল অনীহা, সেই তিনিও প্রায় আধঘণ্টা টানা নেচে নিলেন মানে লম্ফঝম্প করলেন। হচ্ছিল সবই, হটাৎ কী হল, নিবারণবাবু নাচ থামিয়ে গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে পাশে বসা মামাকে বললেন, “শোন আমি এখন আসি বুঝলি, নেশাটা একটু বেশী হয়ে গেছে, এরপর বাড়ি পৌঁছনো মুশকিল হয়ে যাবে”। ‘দাঁড়া, সুমিতকে বলছি একটা রিকশা ডেকে দিতে’, মামা বলে। “না না কোনো দরকার নেই, নিবারণ এইটুকু মাল খেয়ে টাল খায় না”, বলে নিবারণবাবু সোজা দরজার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু কি হল? এত কল এলো কোথা থেকে? সকালবেলা তো ছিলনা। আরে দূর, এটা তো বাথরুমের দরজা, ভুল শুধরে নিবারণবাবু ঠিক দরজা খুঁজে বাইরে এলেন। ভাগ্য ভালো, একটা রিক্সা যেন তাঁর জন্যই ওয়েট করছিল।

বাড়ির দরজায় নেমে গম্ভীরভাবে বেল দিতে গেলেন নিবারণবাবু।কিন্তু কী মুশকিল, নাগাল পাচ্ছেননা কেন? এই কয়েক ঘণ্টায় দরজাটা উঁচু হয়ে গেল নাকি? আজব ব্যাপার তো? ওই যা:, দরজাটা আবার খুলেও যাচ্ছে নিজে থেকে। তিনি তো বেল দেননি।একজন বয়স্ক মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে। নাঃ, নেশাটা একটু বেশি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। “ সরি, ভুল বাড়িতে এসে গেছি’, বলে নিবারণবাবু পিছন ফিরে চলে যেতে চান।কিন্তু সেই বয়স্ক মানুষটি খপ করে তাঁর জামা ধরে ভিতরে টেনে নেন,“ঘরে ঢোক ড্রাঙ্কার্ড কোথাকার, বউমা, মাতালটাকে ভেতরে নিয়ে যাও”। ভদ্রলোকের গলার সঙ্গে বাবার গলার খুব মিল পান নিবারণবাবু।উনি আরও কি সব বললেন গন্ধ নিয়ে, কিন্তু নিবারণবাবু ভালো করে বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বয়স্ক মানুষের কথার উত্তর না দেওয়াটা অশোভন, আন্দাজেই নিজের হাতঘড়িটা একটু শুঁকে গম্ভীরভাবে নিবারণবাবু বলেন “সরি স্যার, আপনি ভুল বলছেন, এটায় কোনো গন্ধ নেই”। এটুকু বলে নিবারণবাবু আর পারলেননা, ধপ করে বসে পড়লেন সিঁড়ির তলায়।আউট হয়ে যাবার আগে খালি কানে এল তাঁর ক্লাস টু তে পড়া মেয়ের গলা “ বাবা বড়দের কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছে, কী মজা, কী মজা”!

তারপর যা হল সেটা অন্য গল্প। নিবারণবাবু সেই থেকে পিকনিক একটু এড়িয়ে চলেন। কে জানে আবার কী হয় ।



Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024