বিদ্রুপে - তুষার দেবনাথ || Bidrupe - Tushar Debnath || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

বিদ্রুপে                                   

   তুষার দেবনাথ 


   একটি ট্রেন এসেছিল প্লাটফর্মে, লোকজনের আনাগোনা একটু কম,শেষ ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে তার যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে,জ্যোৎস্না রাতের পর অষ্টমীর চাঁদ খানা ক্ষয়ে গেলেও তার আলোতে স্টেশনখানা এক অদ্ভুত অনুভূতিতে জড়িয়ে রয়েছে। স্টেশনখানা রে বড়ো খুব এমন নয়,

মাঝারি গোছের, তবে দিনমানে লোকজন চলাচল করলেও রাতের দিকে বেশ ফাঁকা ফাঁকা।

                 

                            বছর দশেকের একটা মেয়ে, এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল কিছুক্ষন ধরে, দেখে সাধারণ বাচ্চাদের মতো হলেও তার চাহনির মধ্যে দীর্ঘ 

প্রশান্তি, মেয়েটির সামনের কোঁকড়ানো চুল কপালের দুদিকে ঝুলে রয়েছে।সরু কপালের দুপাশ দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো চোখের ওপর এসে পড়ে।

     

                                শেষ ট্রেনটা যখন স্টেশনে পৌছালে,ট্রেন থেকে নামলো ঋত্বিক, পুরো নাম ঋত্বিক চক্রবর্তী।আজ অনেকদিন পর সে ট্রেনে ভ্রমণ করেছে,

সাধারণত নিজস্ব দুটো বিলাসবহুল গাড়িতেই সে কাজে যায়‌। তাছাড়া ছয়, সাতটা শখের বাইক তো পড়েই থাকে। আজ কী হঠাৎ মনে হলো ট্রেনে করে

রশ্মিতার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করলো।রশ্মিতা সদ্য কলেজে প্রবেশ করেছে, অবশ্য তার আগে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে তিনবছর, কিন্তু তার বরাবর ইচ্ছে শিক্ষিকা হবে, সমাজ সংস্কৃতি বাঁচাবে। রশ্মিতাকে বাড়িতে সবাই রাধিকা বলে ডাকে।তার সাথে ঋত্বিকের পরিচয় হয় কলেজেই, ঋত্বিক ওদের কলেজে কোনো একটা অনুষ্ঠানে গিয়েই,রশ্মিতাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু প্রথম দেখাতেই কিছু বলতে পারেনি,তারপর ফেসবুকে তার নাম খুঁজে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, অবশেষে সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব হয়, বন্ধুত্ব দৃঢ় হলে পৌছায় সম্পর্কে, অবশ্য রাধিকা মানে রশ্মিতা ঋত্বিককে প্রথমে ঠাট্টা করে ঋত্বিকদা বলেই ডাকতো।

                    

                                      "বাবু , দুটি টাকা দেন না, কিছু খাবো!",,,,,,,,

কথাটি শুনে চমকে ওঠে ঋত্বিক,তার পায়ের কাছে বসে একটা ১০ বছরের বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটির করুণ চোখে চিত্রিত এক দীর্ঘ ক্লান্তি। ঋত্বিক সাধারণত একটু কড়া ধাঁচের,সে মনে করে সমাজে মানুষ ইচ্ছা করেই ভিক্ষা করে কাজ করার বদলে।সে এরকম অনেকেই দেখেছে,তাই সে এইসব দান ধ্যানের ব্যপারে উদাসীন।

তাই সে মেয়েটিকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ট্রেন থেকে নামলো রশ্মিতা।সে তার ব্যাগ থেকে একপ্যাকেট বিস্কুট মেয়েটিকে খেতে দিল, তাতে ঋত্বিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই রশ্মিতার ইশারা ওর ইশারাকে গিলে নিয়ে ওকে শান্ত করে দিল। এদিক থেকে ঋত্বিক দুর্বল, আসলে তার সাধনার ফল তো,তাই। আসলে রশ্মিতার এই ভালোমানুষি গুলোই ঋত্বিককে বেশী আকর্ষণ করে,সে নিজে রুক্ষ মানুষ হলেও। আবার রশ্মিতাও জানে ঋত্বিকের এরকম হোওয়ার কারণ। আসলে যারা দরিদ্রতা স্পর্শ করে বড়ো হয়,যারা ছেলেমানুষি, খুনসুটি করার বয়সে দুবেলা অভুক্ত থেকেও বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাদের মনের বাইরে এক ঢাল তৈরী হয়ে যায়,যেই ঢাল তাদের মনের মধ্যে আর কষ্ট পৌঁছাতে দেয় না। কিন্তু ঝিনুকের শক্ত খোলশের মধ্যেই যে মুক্তোর সন্ধান মেলে, সেই মুক্তোটাই খুঁজে পেয়েছিল ঋত্বিকের মধ্যে।

                    ঋত্বিক এবার একটু শান্ত থাকে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।রশ্মিতাই কথা বলুক বরং মেয়েটির সঙ্গে।রশ্মিতা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো-"তোমার নাম কী,?"

মেয়েটি জবাব দেয় না, আবার রশ্মিতা জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি জবাব দেয়"অপরাজিতা"

মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রশ্মিতা।সে বুঝতেই পারছে মেয়েটি অনেক সময় ধরে ক্ষিদের জ্বালা সয়েছে, এবার যখন ভাগ্যবলে খাবার পেয়েছে তখন তা না খেয়ে কী অপেক্ষা করা যায়। মেয়েটি খাওয়া শেষ হলে রশ্মিতা তার জলের বোতলটা এগিয়ে দেয়, মেয়েটির দিকে, মেয়েটি ঢকঢক করে জল খায়,এক চরম প্রশান্তির ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটির চোখ যেন ঘুমে জড়িয়ে যায়।

রশ্মিতা এবার তাকে আবার প্রশ্ন করে-"তোমার বাবা মা কেও নেই"

মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নটি শুনে, তারপর জবাবে সে দুদিকে ঘাড় নেড়ে জানায় নেই।

রশ্মিতা বলে "আচ্ছা তুমি খাবার না পেলে কী করতে"

প্রশ্নটি যেন আচমকা ঝটকা দেয় ঋত্বিকের মনে।

বাচ্চাটি জবাব দেয় -"ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে মাকে বলতাম,মা আমার না খুব ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খেতে পাইনি মা, তারপর ওই স্টেশনের কল থেকে জল খেয়ে শুয়ে পড়তাম।"মেয়েটিকে আরো একপ্যাকেট বিস্কুট দিয়ে রশ্মিতা বলে কালকে সে তাকে নিতে আসবে,তার থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। মেয়েটি খুশিমনে বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিয়ে স্টেশনের ছাউনির তলায় শুতে যায়।

এরপর রশ্মিতা ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলে,"কী ঋত্বিক মশাই, বাড়ি যাবেন না এখানেই রাত কাটাবেন?"


       প্রশ্নটি শুনে ঋত্বিকের হুশ ফিরলে সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়‌, অন্ধকারে ঋত্বিকের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল খসে পড়ে অজান্তেই। মেয়েটির শেষের কথাগুলো যেন তার বড়োই চেনা, বড়োই চেনা।

তার বাবার মুখে সে শুনেছে,যখন তার বাবা খাবারের শেষটুকু ঋত্বিকের পাতে তুলে দিতেন, এবং ঋত্বিক তাকে খেতে বললে,তার বাবা হাসতেন,আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতেন ----

               " ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় 

                 পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি"‌।

Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024