টিউশন - পায়েল বিশ্বাস || Tution - Payel Biswas || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

    টিউশন

      পায়েল বিশ্বাস 



" অজয়, আরে ওই অজয়।"

নিজের নাম শুনে চমকে পিছন ফিরে দেখে তন্ময়। 

"কি হয়েছে? ডাকছিস কেন?"

"শোন না, একটা টিউশন আছে। করবি?"

এবার অজয়ের পাংশুমুখে হাজার বাতির আলো জ্বলে উঠল। এম.এ. পাশ করে দুই বছর যাবত চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে জুতোর শুকতলা খুইয়ে ফেললেও এখনো সে বেকার। বাবার সামান্য চাকরির টাকায় বাপ বেটার চললেও ওরও হাত খরচ আছে কিছু। আর কত কালই বা সে বাবার হোটেলে খাবে! এখন তো সব খরচ তারই করা উচিত। তাই যতদিন না চাকরি পায় ততদিন এই টিউশনি করে কিছু টাকা বাবার হাতে দিলে অজয়ের শান্তি। মা তো সেই ছোট্ট থাকতেই মারা গেছিলেন। অজয় মানুষ তার দিদি বিজয়ার হাতে। দিদি না, বিজয়া হল অজয়ের যশোদা মা। যতদিন অজয়ের কাছে ছিল তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখত। বিজয়ার বিয়ের পর থেকে তাই অজয় প্রতি মূহুর্তে দিদির অভাব বুঝতে পারে।



" হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই করব। কোথায় পড়াতে যেতে হবে জলদি বল।"



" আরে ওই তো ইস্ট পার্কের একদম শেষে পাঁচিল ঘেরা যে বাড়িটা আছে, ওখানে যেতে হবে। "



" তুই কি ইয়ার্কি মারছিস? ওই বাড়িটায় তো কেউ থাকে না। " এবার অজয় একটু রেগে গিয়ে বলল।



" থাকত না। কিন্তু এখন এক মহিলা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে ওখানে থাকছে। ছেলেটির কিছু সমস্যা আছে তাই সে স্কুলে যায় না। কিন্তু প্রতিটি ক্লাসের পড়া সে বাড়ির শিক্ষকের কাছে পড়ে নেয়। এই ছেলেটিকেই তোকে ক্লাস টুয়ের সিলেবাস অনুযায়ী পড়াতে হবে। সপ্তাহে চারদিন পড়াবি। তিন হাজার টাকা দেবে।"



তিন হাজার দেবে শুনে অজয় সানন্দে রাজি হয়ে গেল৷ 



তন্ময়ের কথামত অজয় ইস্ট পার্কের শেষ প্রান্তের পাঁচিল ঘেরা বাড়িটায় আসল সেদিন বিকেলেই। জায়গাটি বেশ নির্জন। এখানে এসে অজয়ের মনে হল ও যেন কোনো একটা মনুষ্য বর্জিত দ্বীপে এসে গেছে। কেউ কোথাও নেই শুধু ও একা এক জীবন্ত প্রাণী। কোনো পাখির হাঁকডাকও কানে এল না। পাঁচিল লাগোয়া গেট খুলে বাড়ির চৌহিদ্দির মধ্যে প্রবেশ করল অজয়। একরাশ আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে বাড়িটার সামনের বারান্দায় উঠল সে। দরজায় ঠকঠক করল। তিন বছর আগে যখন দত্ত কাকুরা এখানে থাকতেন তখন এই বাড়ির বাগান রকমারি ফুলে ফলে ভরে থাকত। পাড়ার বাচ্চাদের অবাধ প্রবেশ ছিল এখানে। যদিও গলির একদম শেষ প্রান্তে বলে তেমন কেউ আসত না। তবে ঋতু অনুযায়ী সব ফল পাকুড় সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন দত্ত কাকুরা। মহামারীতে পর পর স্বামী স্ত্রী মারা যেতে এই বাড়িটি পরিত্যক্ত একাকী হয়ে গেল। সুন্দর বাগান আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। দত্ত কাকুরা নিঃসন্তান ছিলেন বলেই জানত অজয়। তাহলে এখন যারা এখানে বাস করে তারা দত্ত কাকুদের কে হয় কে জানে! 



কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলে তাকে দেখে অজয় স্তম্ভিত হয়ে গেল। এক মূর্তিমতী বিষাদ প্রতিমা যেন দাঁড়িয়ে। অজয়ের থেকে বড়োই হবে! বিষন্ন মুখ হলেও হালকা হলুদ শাড়িতে তার বেশ মমতাময়ী লাগছে। মহিলাটিকে দেখে অজয়ের নিজের দিদির কথা মনে পড়ল। অজয়ের দিদির মুখশ্রীও এই রকম স্নেহময়। মহিলাটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অজয়ের দিকে তাকালে অজয় তার আগমনের হেতু জানাল। ভদ্রমহিলা তখন একটু হেসে তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা নিজের নাম রিটা সেন থমাস বলল। ওরা আগে ইতালিতে থাকত। সেখানে তার স্বামীর মৃত্যুর পর এখানে এসেছে। দত্তকাকু সম্পর্কে রিটার মামা হয়। মামা মামীর মৃত্যুর পর পুরো সম্পত্তি এখন রিটার। 



এই সময় হঠাৎ পাশের ঘরের দরজার দিকে নজর গেল অজয়ের। একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে অজয়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটির নীল চোখের দিকে তাকিয়ে অজয়ের কেমন যেন অস্বস্তি হল। তাও সে একটু হেসে বাচ্চাটিকে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করল।  



" আমার নাম রবার্ট। আমায় তুমি রবি বলে ডেকো। তুমি কি আমার নতুন স্যার?"



রবির আধো আধো কথা অজয়ের খুব ভালো লাগলো। সে রিটার দিকে সম্মতির জন্য তাকালো। রিটা স্মিত হেসে রবিকে বলল," হ্যাঁ। উনি তোমায় সোমবার থেকে পড়াতে আসবেন। "



রবি প্রথম প্রথম খুব আড়ষ্ট হয়ে থাকতো। ধীরে ধীরে অজয়ের সাথে সে সহজ হয়ে গেল। তবে পড়ার থেকে ঘরের চার দেওয়ালের বাইরের জগত নিয়ে রবির খুব আগ্রহ। প্রায়ই অজয়ের কাছে বায়না করে অজয়ের বাড়ির কথা, পাড়া, বন্ধুবান্ধবদের কথা জানতে চায়। আসলে খাঁচার পাখি তো, তাই মুক্ত পরিবেশকে রবি অজয়ের চোখ দিয়ে কল্পনা করতে চায়। 



অজয় বেশ মন দিয়েই রবিকে পড়ায়। অবশ্য বইয়ের চেয়ে রিটার দিকেই তার মনোযোগ বেশি । রিটার হাঁটাচলা কথা বলার ভঙ্গিতে অজয় তার দিদিকেই যেন ফিরে পায়। তাই সে রিটাকে দিদি বলেই ডাকে। তবে কয়েকটা ব্যাপার অজয়ের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। রবিদের বাড়িতে ঢুকলে অজয়ের কেমন গা ছমছম করে। সব সময় ওর মনে হয় কেউ যেন ওর উপর নজর রাখছে। মাঝে মাঝে হুট করে এক ছায়াকে সরে যেতেও দেখে সে। এছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, রবিকে পড়ানোর সময় মাঝে মাঝে অজয় শুনতে পায় রিটা কারোর সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। একদিন তো রবিকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল," তোমাদের বাড়িতে কি কেউ এসেছেন যার সাথে তোমার মা কথা বলছে?"



" না,না, স্যার। মা তো বাবার সাথে কথা বলছে।"



" বাবা!! তোমার বাবা তো মারা গেছেন। তাহলে? "



" মা মনে করে বাবা মরে গিয়েও এখনো আমাদের সাথেই আছে। " পাংশুমুখে রবি বলে।



অজয় বুঝল স্বামীকে এখনো রিটা খুব ভালোবাসে তাই তাকে কল্পনা করে তার সাথে কথা বলে। অজয়ের মন বিষাদের মেঘে ঢেকে গেল। অজয় ভাবল, সেও তো অনেক সময় মনে মনে দিদির সাথে কথা বলে। 



একদিন রিটার কথা ভাবতে ভাবতে যখন সে ওদের বাড়ি গেল তখন দেখল রিটা বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। 



" ভালোই হল স্যার। আমি একটু বাজারে যাচ্ছি। আপনি রবিকে পড়ান। আপনার যাওয়ার আগেই আমি চলে আসব।"



ঘাড় নেড়ে ঘরে ঢুকে অজয় দেখল রবি মুখ কালো করে বসে আছে।



" আরে মন খারাপের কি আছে? আমি তো আছি। তাছাড়া মা তো কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসবে।" 



" মা, একাই গেল। আমায় নিয়ে গেল না।" গাল ফুলিয়ে রবি বলল।



" তুমি গিয়ে কি করবে? বাজার খুব নোংরা জায়গা।" অজয় রবিকে বোঝাল।



" মা, আমায় কোথাও নিয়ে যায় না। এমনকি এই ঘর থেকে বাগানে অবধি যেতে দেয় না।"



" সেকি! কেন?" এবার একটু অবাক হল অজয়।



" জানি না। ও স্যার তুমি আমায় একটু ঘুরতে নিয়ে যাবে? আমার এই ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকতে ভালো লাগে না।" রবি কাতর দৃষ্টিতে অজয়ের দিকে তাকাল । 



 রবির কথা শুনে অজয় অবাক হয়ে বলল," ঠিক আছে। আমি রিটাদিকে বলব তোমায় একটু পার্কে নিয়ে যাবে।"



" মা কোনো দিনই আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে না। তুমি আমায় নিয়ে চলো।"



রবিকে না বোঝাতে পেরে শেষে অজয় নিমরাজি হল। 



রবির পড়া শেষ হওয়ার আগেই রিটা বাজার করে ফিরে এল। বাড়ি ফেরার সময় অজয় আস্তে করে রিটাকে বাইরে বাগানের দিকে আসতে বলল। রিটা একটু অবাক হলেও অজয়ের পিছু পিছু বাগানে এল।



 শুক্লপক্ষ শুরু হয়েছে। বাগানে হালকা চাঁদের আলোয় এক আলো আঁধারির রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রিটা এই কয়দিনেই বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে বিভিন্ন ফুল ফলের গাছ লাগিয়েছে। বাগানের ঠিক মাঝখানে আবার একটা দোলনাও বসিয়েছে। বাগানের চারপাশে পাঁচিল ঘেঁষে বড় বড় গাছগুলো এমন ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে যে বাইরে থেকে এখানকার অস্তিত্ব সমন্ধে কেউ অবগত হতে পারে না। এখন সবে সন্ধ্যা সাতটা। অথচ মনে হচ্ছে যে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁয়েছে। 



রিটা আর অজয় দোলনায় বসল। অজয় রবির মন খারাপের কথা সব খুলে বলল।



রিটা নত মস্তকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে তারপর মুখ তুলে অজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল," রবি ঠিকই বলেছে। আমি কোনো দিন ওকে বাইরে যেতে দেব না যত দিন না ও বড়ো হয়।"



" কেন?" অবাক হয়ে অজয় প্রশ্ন করল। 



" আমি জানি না কেন আজ আপনাকে আমার কষ্টের কথা, মনের কথা বলতে ইচ্ছা করছে। "



অজয় রিটার চোখে চোখ রেখে বলল," আপনি আমায় বিশ্বাস করে সব বলতে পারেন। " 



" সব বলব। কিন্তু কথা দাও ভাই, তুমি কাউকে বলবে না। " বলে রিটা অজয়ের হাত চেপে ধরল। 


রিটার মুখে ভাই ডাক শুনে অজয়ের মনটা খুশিতে ভরে গেল 



" রবির বাবাকে খুন করা হয়েছিল। কে বা কারা, কেন করেছিল, জানি না। আমাদেরও কয়েকবার খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল। তাই আমি ইতালি থেকে এখানে পালিয়ে আসি মামা মামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। যদি আমাদের খবর খুনীরা পেয়ে যায় তাই আমি পারতপক্ষে বেরোই না। রবিকেও তাই ঘরেই আগলে রাখি পাছে ওরা রবির অস্তিত্ব জেনে যায়৷ রবি বাচ্চা মানুষ, মানুষ চেনে না। বাইরে বেরোলে যদি ওরা ওকে অপহরণ করে, তাই আমি ওকে বেরোতে দিই না। মায়ের মন তো। তাই সর্বদা ভয়ে থাকি। রবি ছাড়া তো কেউ নেই আমার।"



" কে বলেছে কেউ নেই! আমি তো আছি, আপনার ভাই।" অজয় আবেগের সাথে বলল। 



রিটা অজয়ের কথা শুনে স্মিত হাসল।


এখন প্রায়ই নিজের দিদি বিজয়াকে স্বপ্নে দেখে অজয়। আগে দেখত না তেমন। যবে থেকে রিটাকে দেখেছে, সেইদিন থেকেই অজয় দিদিকে প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখে। কিন্তু দিদির মুখটা যে বড়ো বিষন্ন! অনেক সময় স্বপ্ন আর বাস্তবতা এমনভাবে মিলেমিশে যায় যেন অজয়ের মনে হয় এই তো দিদি তার পাশেই বসে আছে।



ইদানীং রবি বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অজয়কে পাগল করে তুলছে । পড়ায় আর তার মন নেই। সব সময় জানালা দিয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে৷ এদিকে অজয়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। দিনে দিনে কেমন যেন দূর্বল হয়ে পড়ছে।



একদিন অজয় পড়াতে গেছে। দরজায় কড়াঘাত করতে যাবে, তখন শুনতে পেল রিটা রবিকে বলছে," একদম অজয়কে নিয়ে বাইরে যাবি না। আর এই ভুল করিস না। আমি পালাতে পালাতে ক্লান্ত। নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা কর। সঠিক সময় আসুক তখনই না হয় যা ইচ্ছা তাই করিস।"



"এসব কি বলছে রিটা! কি করতে চায় রবি ওকে নিয়ে!" অজয় হতবাক হয়ে যখন ভাবল ঠিক তখনই রিটা দরজা খুলে বাইরে এসে অজয়কে দেখে এক গাল হেসে বলল," প্লিজ একটু রবিকে সামলাও ভাই। ঘরে একদম তেল নেই। তাই আমি একটু বাজার যাচ্ছি।" 



দিদির কথা কি ভাই ফেলতে পারে! অগত্যা ভাগ্নেকে সামলাতে মামা নিজেকে প্রস্তুত করল।




" কি হল, মন খারাপ আবার?"



জানালার দিকে মুখ করে রবি বলল," আমায় আজ দরজার ছিটকানিটা খুলে দিতেই হবে। আমি বাগানে যাব।" 



" একদম না। মার বারণ আছে।"



" প্লিজ স্যার। আমায় আজ বাইরে যেতেই হবে। ওই আকাশের গোল চাঁদ যে আমায় ডাকছে। "



" মানে?" অবাক হল অজয়।



" জানেন স্যার আমি না একটা ম্যাজিক জানি। আপনি চলুন আমার সাথে বাগানে। ওখানে দেখাব।"



" কেন? এখানে দেখা। " 



" এখানে হবে না স্যার। বাগানেই হবে যে ম্যাজিকটা৷ তাড়াতাড়ি চলুন। মা আসার আগেই।"



কিছুটা কৌতূহলে আর কিছুটা রবির জোরাজোরিতে, অজয় রবিকে নিয়ে বাগানে এল। সারা বাগান আসন্ন পূর্ণিমার রূপালি আলোতে তখন প্লাবিত হচ্ছে। নিস্তব্ধ নিঝুমতা চারিদিকে বিরাজমান। যদিও সবে শীতকালের শুরু, তবুও এর মধ্যেই একটা হালকা কুয়াশা বাড়িসহ বাগানটাকে যেন এক অস্পষ্ট ধোঁয়াটে আবরণে ঢেকে রেখেছে। রবি এক মনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে রবির ছোট্ট শরীরটা কাঁপতে লাগলো আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে নাকি ছোট্ট বাচ্চাটার! অজয় ছুটে রবির কাছে যাওয়ার আগেই সে মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগলো।  



" কি হয়েছে রবি? কি কষ্ট হচ্ছে?" রবির কাছে গিয়ে অজয় চমকে গেল। এক অজানা আশংকায় অজয়ের মেরুদণ্ড দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেল। এটা কি করে সম্ভব! 



রবি চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুখ হাঁ করে আছে। ওর ছোট্ট ছোট্ট দন্তরাশির মধ্যে শ্ব দন্ত দুটি অস্বাভাবিক বড় ও সূচালো হয়ে উঠেছে। সেগুলো চাঁদের আলোয় ছুরির ফলার মত চকচক করছে। রবি অজয়ের দিকে তাকালো। প্রচন্ড আতংকে অজয় ছিটকে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। রবির চোখে মণি বলে কিছু নেই, পুরো কালো চোখদুটো। রবির শিশুসুলভ শরীরটার এক অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হল। সারা শরীর পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে নেকড়ের রূপ নিল। এক জান্তব গন্ধ বাতাসে ভর করে অজয়ের শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে চাইল৷ অজয় এসব দেখে তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলল। ওর মনে হতে লাগলো ও যা দেখছে তা সবই ওর কল্পনা। বাস্তবে এরকম হতেই পারে না। নেকড়ে -মানবরূপী রবি এবার অজয়ের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল। চরম আতংকে অজয় পিছাতে লাগলো।  



" কেন ওকে এখানে নিয়ে এলে?" 



রিটার গলার স্বরে বামদিকে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টায় অজয় রিটার কাছে দৌড়ে গেল।



" ভয় নেই। আমি তো আছি, তোমার দিদি।" বলে রিটা অজয়কে নিজের পিছনে আড়াল করল। অজয় তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। 



" রবি, আমি তোর মা। আমি বলছি তুই আর এগোবি না।"



রবি মুখ দিয়ে একটা জান্তব শব্দ বার করে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল। 



" রবি, একই ভুল বার বার করিস না। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা কর। এখনো সময় হয়নি তোর শিকারের।"



এসব রিটা কি বলছে, কিসের শিকার? 



" এসো অজয়, আমার কাছে এসো৷ আমার কাছে থাকলে রবি কিছু করতে পারবে না।" 



কিন্তু রবি তার মায়ের কথা শুনল না। এক পা এক পা করে এগোতে লাগলো। অজয়ের পুরো শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে গেল। এমন সময় একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী রিটার চারদিকে পাক খেতে লাগলো। ধীরে ধীরে সেটি পুঞ্জীভূত হয়ে একটি পুরুষের রূপ পরিগ্রহণ করলে রিটা তার দিকে তাকিয়ে বলল , " দেখো, তোমার ছেলের কান্ড। অবশ্য ওর দোষ নেই। বাচ্চা মানুষ, বায়না তো করবেই। আমি তো বার বার এই বোকা অজয়কে বারণ করেছিলাম রবিকে ঘরের বাইরে না আনতে। তোমার মৃত্যুর পর আর রবির পরিচয় জানাজানির আশংকায় আমি ওকে নিয়ে এখানে পালিয়ে আসি। চেষ্টা করে গেছি যাতে রবি ঘরের বাইরে না বেরোয়, চাঁদ না দেখে। প্রতি পূর্ণিমায় আমার ডাইনীবিদ্যার জোরে একটা না একটা শিকার রবির জন্য ঠিক এনে দিতাম। আবার ঘরে বসে মূর্খ হলেও তো চলবে না। তাই অজয়কে রেখেছিলাম ওকে পড়ানোর জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সব ভেস্তে গেল।"



তারপর রিটা অজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, " তোমায় নিয়ে আমার অনেক আশা ছিল। মৃত্যুর পর আমার স্বামীর শরীর নষ্ট হয়ে গেছিল বলে তার আত্মাকে পুনরায় তার শরীরে স্থাপন করতে পারিনি। তাই ইচ্ছা ছিল তোমার শরীরে তাকে পুনঃস্থাপিত করার। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যাতে আগামী অমাবস্যায় পুরোপুরিই আমার স্বামী তোমার শরীরের দখল নিতে পারে। কিন্তু তুমি আমার সব আশায় জল ঢেলে দিলে। নাও, এখন মরো।"


তারপর রবির দিকে তাকিয়ে বলল," একসাথে সব মাংস খাস না। কিছু ফ্রিজে রেখে দেব৷ এক সপ্তাহ ধরে খাবি। "


অজয় এবার করুণ চোখে রিটার দিকে তাকিয়ে বলল," আপনাকে আমি নিজের দিদি বলে মনে করতাম। কিন্তু সেই আপনি আমায় নিয়ে এত নৃশংস পরিকল্পনা করেছিলেন? কি করে পারলেন আপনি?"


রিটা মুখটা বিকৃত করে বলল," দিদি? আমি কেন তোর মড়া দিদি হতে যাব? তোদের মতো বোকারাই তো আমার ছেলের খাবার।" রবির দিকে তাকিয়ে রিটা তাকে তাড়া দিয়ে বলল," নে, আর দেরি করিস না। বুদ্ধুটাকে শেষ কর এবার।"


রবি এবার অজয়ের টুঁটি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। কিন্তু অজয় অবধি পৌঁছাতে পারল না। তার আগেই কিসের এক আঘাতে ছিটকে পড়ে গেল। রিটা অবাক হয়ে অজয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা হালকা সাদাটে কুয়াশার আবরণ অজয়কে ঘিরে পাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি গাঢ় হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। দুই হাত দিয়ে সে অজয়কে আড়াল করে রইল।


" দিদি" বিস্মিত অজয়ের মুখ দিয়ে এই শব্দ বেরিয়ে এল।


" আমি তোকে অনেকবার সাবধান করেছিলাম ভাই।" নারীমূর্তিটি অজয়ে দিকে ফিরে বলল।


" তোর কথা বড্ড মনে পড়ত। তাই... "


" সবাই আপন হয় না ভাই।"


" দিদি ভাইয়ের কথা শেষ হয়েছে? এবার পেত্নী দিদি সরে যা তো। আমার ছেলের খুব খিদে পেয়েছে। " রিটা বিরক্ত হয়ে বলল। 


বিজয়া কিছু না বলে অজয়কে ফিসফিস করে বলল," ভাই তুই পালা। আমি এদের ঠেকিয়ে রাখছি।" 


" তুই একটা সাধারণ পেত্নী হয়ে আমাদের ঠেকাবি? তোর এত ক্ষমতা? মানুষ হোক বা পেত্নী কেউ আমার ছেলে আর তার খাবারের মাঝে এলে, তাকে আমি নিশ্চিহ্ন করে দেব।" বলে পালাতে উদ্যত অজয়ের দিকে এগিয়ে গেল রিটা। 


" খবরদার!" বিজয়া হুঙ্কার দিয়ে উঠে রিটার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে এক আছাড় মারল। তারপর অজয়কে বলল," পালা শিগগির।"


অজয় প্রাণের ভয়ে দৌড় লাগালো। বাগানের আগাছা অজয়ের পায়ে জড়িয়ে গতি রোধ করতে চাইল। কিন্তু অজয়কে থামলে চলবে না। কোনোমতে রিটাদের বাড়ির চৌহিদ্দী পেরিয়ে অন্ধকার নির্জন গলির মধ্য দিয়ে ঊর্ধশ্বাসে ছুটলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অজয় জানে না আজ ওর বাড়িও নিরাপদ কিনা এই রক্তপিশাচদের হাত থেকে। বিজয়া কি পারবে ওকে রক্ষা করতে? বিজয়া একা আর ওরা তিনজন। বাড়ির কাছাকাছি এসে কি মনে হতে একবার পিছন ফিরল অজয়, দেখল একটা কালো ধোঁয়া তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। প্রচন্ড আতংকে অজয় দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। কালো ধোঁয়া অজয়ের কাছে এগিয়ে এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় অজয় দেখল কালো ধোঁয়ার মাঝে তীব্র জিঘাংসায় ভরা রিটার স্বামীর মুখ। রিটার স্বামী হাত বাড়িয়ে যেই অজয়কে ধরতে যাবে তখনই অজয়ের বাবা দরজা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকেই সাথে সাথে অজয় দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। 


বাবার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ধীরে ধীরে সব ঘটনা অজয় খুলে বলল। বিজয়ার কথা শুনে ওর বাবার দুই চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো।  


" মেয়েটা তোকে আজও আগলে রেখেছে। মরার পরও তোর টানে রক্ষা করতে ছুটে এসেছে।"


বাবার কথায় অজয় বলল," হ্যাঁ বাবা। মৃত্যুই সব শেষ নয়। আমি বৃথাই কষ্ট পেতাম দিদি নেই বলে। হানিমুনে যাওয়ার পথে জামাইবাবুর সাথে দিদি যখন ট্রেন দূর্ঘটনায় মারা গেল, তখন বিশ্বাস করো বাবা, আমার মন বলত দিদি মরে গেলেও আমায় ছেড়ে যেতে পারে না। "


" তোর এই বিশ্বাসই ওকে বিপদে তোর কাছে পরপার থেকে টেনে এনেছে। " 


" বিপদ এখনো কাটেনি বাবা। আমাকে শিগগিরই লোকজন নিয়ে রিটাদের বাড়ি যেতে হবে। "


" খবরদার না। আজ রাতে বাড়ি থেকে বেরোবি না তুই। যা করার কাল হবে। আজ সারারাত আমরা ঠাকুরের সামনে গীতা পাঠ করব।"


সারারাত অজয় আর বাবা দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না। পুরো রাত তাদের বাড়িকে ঘিরে যেন ঝড় বয়ে গেল আর তার সাথে কারো অপার্থিব গর্জন। কোনো অপশক্তি যেন প্রাণপণে ওদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে কিন্তু বার বার কিছুতে বাধা পাচ্ছে। সারারাত তান্ডব চলার পর ভোরের দিকে সব স্তিমিত হয়ে গেলে অজয় আর তার বাবা গীতা পাঠ বন্ধ করল। প্রচন্ড ক্লান্তিতে দুজনে ঠাকুরঘরেই শুয়ে পড়ল। দুই চোখের পাতা এক করার সময় অজয়ের মনে হল বিজয়া যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে," চিন্তা নেই ভাই। আমি তো আছি।" 


হঠাৎ দরজা ধাক্কার শব্দে অজয় চোখ খুলে দেখল ঘরে সূর্যের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। 


"এই অজয়, দরজা খোল।"


তন্ময়ের গলার শব্দ পেয়ে দরজা খুলল অজয়। 


" আরে, নটা বাজতে যায় এখনো ঘুমাচ্ছিস! আর এদিকে কত কান্ড হয়ে গেছে। "


" কি হয়েছে? "


" রিটাদের যে দুধ দেয় সে সকালে এসে আমায় বলল রিটাদের বাড়ি ভেঙে পড়েছে আর ওরাও বেপাত্তা। আমি যাচ্ছি ওখানে। তুইও চল।" 


তন্ময়ের কথায় অজয় বুঝল গত রাতে অজয়কে মারায় ব্যর্থ হওয়ায় এবং ধরা পড়ার ভয়ে রিটারা সব পালিয়েছে। 


" নে, তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে। তুই যাবি না আমার সাথে?"


অজয় একবার ভাবল রিটাদের আসল রূপের কথা তন্ময়কে বলে দেয়। কিন্তু সেটা তন্ময় কেন কেউই বিশ্বাস করবে না। আর ওখানে গিয়েও এখন লাভ নেই। তাই সে অজয়কে জানিয়ে দিল সে যেতে পারবে না কারণ ওকে এখন ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। 


তন্ময়ের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে অজয় মনে মনে স্থির করল এবার একটা পাকা বন্দোবস্ত করতে হবে, একটা ভালো চাকরি করতেই হবে। তার বাবা, দিদির স্বপ্ন পুরণ তাকে করতেই হবে। আর তার চিন্তা কিসের! বিজয়ার স্নেহ আর আশীর্বাদ তো তার সাথেই আছে।





Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024