উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -44

 



কয়েক সেকেন্ড সকলে নীরব থাকার পর দেখা গেল হেমন্তবাবুর চোখে জল এবং তার মনে এক দারুন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষ হয়ে গেলেন। তিনি রমা রমা বলে চিৎকার করতে করতে রমার রূমে প্রবেশ করে দেখলেন রুমখানি শূন্য। তন্ন তন্ন করে বাড়ীখানা খোঁজ করে কোন হদিশ পেলেন না। নিজের ভুলের জন্য বিবেকের দংশন জ্বালায় ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলেন। তবে কি রমা পালিয়েছে!


হেমন্তবাবু নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকলেন। তিনি বড় ভুল করলেন তার ভাগ্নের কথা শুনে। ভাগ্নে যে এক নম্বরের বদমায়েস তা বুঝতে পারলেন। কিন্তু গুনধর ভাগ্নে অতি চালাক মানুষ, তার কারণ সে যে পরিবারের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি করলো অবস্থা ভালো নয় দেখে কখন সে স্থান ত্যাগ করেছে তা কেউ বুঝতে পারলেন না।

এই সংসারে এমন ধরনের কিছু মানুষ থাকে, যারা পরিবারের মধ্যে এনে দেয় বৈশাখী ঝড়, রুদ্র তান্ডব, পারিবারিক বিপর্যয় এনে সাময়িকভাবে আনন্দ পেয়ে থাকে। হেমন্তবাবু তার অন্তরের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে সহ্য করতে না পেরে সুশীল বাবুর হাত দুটো ধরে অস্ফুষ্ট গলায় বললেন, আমি বড় অবিচার করে ফেললাম সুশীলবাবু। একজন কুলঙ্গার লম্পটের কথা শুনে আমার গৃহলক্ষীকে ত্যাগ করে ফেললাম। যেমন করে হোক আপনি বিভিন্ন প্রান্তে লোক পাঠিয়ে আমার বৌমাকে ফিরিয়ে আনুন। নইলে আমার হৃদয়কে আমি তৃপ্তি দিতে পারবো না। আমার সেই শিকারী জীবনের কথা আজও ভুলতে পারছি না। রমার বাবা যদি সেই স্থানে না উপস্থিত থাকতেন তাহলে

হিংস্র জন্তুর মারাত্মক আক্রমণে আমার জীবনদ্বীপ নিভে যেত। আমার রক্ষা কর্তা

সীতাংশু বাবু এখন পরলোকে। কিন্তু আমি তাঁর কাছে ঋণ গ্রস্ত হয়ে থাকবো না। বিলম্ব না করে রমাকে খোঁজ করে বের করতেই হবে। যেহেতু রমা তারই মেয়ে। দেবী সেই সময় বলে উঠলো রমা এ বাড়ীতে আর কোন দিনই ফিরে আসবে না। কারণ সে চায় না আমাদের সংসারের মধ্যে অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করতে।

হেমন্তবাবু বললেন, একটু ভুলের জন্য এইভাবে সে আমাকে মর্মে মর্মে দগ্ধ হতে হবে কোনদিন কল্পনা করিনি দেবী। ওকে খোঁজ করে বের করবার চেষ্টা করো। ভুল করেই ফেললাম, কিন্তু ভুল সংশোধনের এখনও তো পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি।

দেবী কোন কথা না বলে একটা চিঠি হেমন্ত বাবুর দিকে নিক্ষেপ করে বাড়ী হতে বেরিয়ে পড়লো।

হেমন্তবাবু চিঠিটা কুড়িয়ে বেদনাক্ত হৃদয় নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। শ্রীচরণেষু,

তুমি আমায় ক্ষমা করবে। আজ রাত্রে তোমাদের সকলকে ত্যাগ করে যে দিকে দুই চক্ষু যাবে সেই দিকে হাঁটতে শুরু করবো। আমি জানি আমাকে হারিয়ে তুমি অন্তরে অন্তরে দগ্ধ হবে। কি করবো বলো ভাগ্য বিড়ম্বিতাদের চোখের জল কোন মতে শুষ্ক হতে চায় না। তাদের আশা আকাঙ্খা শূন্যে সৌধ নির্মাণের মতো অলীক হয়ে যায়। এই দিনে যদি অপরাধ করে থাকি অবশ্যই ক্ষমা করবে। তোমাদের পিতা-পুত্রের তর্কাতর্কি যখন আমার কানে পৌঁছেছিলো তখন আমি এই পথ বেছে নিয়েছি। সুতরাং আমাকে বিদায় নিতে হলো। কেন আমার জন্য তিনি তার সংসার জীবনে অশান্তির প্লাবন ডেকে আনবেন। আমি চাই না বাবা বৃদ্ধ বয়সে শোকাতুর হয়ে নিজে কষ্ট পান। তোমার ঔরসজাত সন্তান আমার গর্ভ হতে ভূমিষ্ট হলে তাকে তোমার মতো গড়ে তুলবার চেষ্টা করবো।

ভেবেছিলাম, অনেক নির্যাতন, শাস্তি ও দুঃখ পাবার পর তোমার গৃহ নির্মল শুভ্র জ্যোৎস্না ধারায় প্লাবিত করে তুলবো। কিন্তু ভাগ্যে নেই তো তুমি কি করবে? তবে যার জন্য তোমাদের সকলকে ত্যাগ করতে হলো তাকে কোনদিন তোমাদের মাঝে আশ্রয় দিয়ো না। কারণ সে চরিত্রহীন মানুষ।

ময়নার দিকে একটু নজর রেখো। হতভাগীকে ত্যাগ করে কোন মতেই আসতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু বাবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা কানে পৌঁছুতেই আর থাকতে পারলাম না। সমস্ত মায়া কাটিয়ে, হৃদয়কে পাষাণ করে তোমাদের ছেড়ে চলে এলাম। জানি না এরপর কোথায় আশ্রয় পাবো। তবে এ কথা জেনে রাখার তোমার রমা আর পদ্মার জীবন বেছে নেবে না। তাতে যতই কষ্ট আসুক জীবনে পরে আমার প্রণাম নিও, ভালো থেকো।

                                           ইতি

                                   'হতভাগিনী

                                        রমা

রমার পত্রটা পড়ে হেমন্তবাবু ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করলেন। তিনি যে অপরাধ করলেন তার ক্ষমা নেই। ধীরে ধীরে তিনি আরো মলিন হয়ে গেলেন। আপন হতে তার অশ্রু ধারায় চোখটা দুটো বাষ্পাকুল হয়ে গেল। এখন কি করবেন তিনি।

হঠাৎ তিনি নিজের দুঃখ, যন্ত্রণাকে বক্ষে ধারণ করে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। তিনি সুশীলবাবুকে মেজাজি গলায় বললেন, সুশীলবাবু আর দেরী নয়, আপনি চারিদিকে লোক পাঠান রমা মা আমার বেশী দূর যেতে পারে নি। তন্ন তন্ন করে খোঁজ করুন। দেবীদাসকে সঙ্গে নিন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে রমাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত রতে হবে। থানা, হাসপাতাল, নার্সিংহোম এমন কি শহরের রাস্তাঘাট অলি- গলিতে লোক পাঠান। থানাতে খবর দিন যে হেমন্তবাবুর নির্দেশ যেমন করে হোক বৌমাকে খোঁজ করে বের করতেই হবে। আমি দেবীদাসের কাছে হারতে রাজী নই।

সুশীলবাবু তাই করবেন বলে বেরিয়ে পড়লেন। হেমন্তবাবু দেবীকে কাছে ডেকে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত বাবা। আমার হৃদয় খানখান হয়ে যাচ্ছে, তুমি চিন্তা করো না, আমার রমাকে আমি ফিরিয়ে আনবই। ভুল যখন করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমি করবো। তুমি দুঃখ করো না।

দেবীদাস উদাস হয়ে জানালার পানে তাকিয়ে থাকে শহরের বৈচিত্র্যময় আলো রশ্মির দিকে। বার বার রমার মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে তার বন্ধু সুমস্তর মুখখানি, ভেসে ওঠে রমার বাবার মৃত মুখখানি।

সে কোন মতে থাকতে পারল না। উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে বেরুতেই হেমন্তবাবু ওর হাতখানি ধরে বললেন, তুমি যেখানে যাবে আমিও তোমার সাথে যাবো বৌমাকে খোঁজ করতে।; উভয়েই গাড়ী বের করে রমার খোঁজে নিশুতি রাত্রে বেরিয়ে পড়লেন।

সুশীলবাবুও কম চেষ্টা করলেন না। থানা, নার্সিংহোম, আশ্রম, মন্দির, মসজিদ

এমনকি ফুটপাতেও খোঁজ করলেন, তথাপি রমার খোঁজ পেলেন না। তিনি মানসিক

ভাবে দগ্ধ হলেন। বিশ্রামের প্রয়োজন মনে করে সূর্য উদয়ের পূর্বে হেমন্তবাবুর বাড়ীতে

এসে উপস্থিত হলেন ও সোফায় বসে তিনি চিন্তার রাজ্যে ডুব দিলেন। ভাবতে থাকলেন দুঃখিনী রমার কথা। ভাবতে থাকলেন তার পিতার কথা ঈশ্বরের কেমন বিচার। একজন জমিদার পুত্র হয়ে অনাহারে, অনিদ্রায় ফুটপাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করলেন। তার মেয়ে রমা এক জায়গায় আশ্রয় পেয়েও তাকে হারাতে হলো তার ভালোবাসার পাত্রকে। তবে কি সেই দুঃখিনী মামনিকে সারাজীবন কি দুঃখের সাগরে ভাসতে হবে। রমা মাকে কি ফিরিয়ে আনা যাবে না?

এমন সময় করালী হন্ত দন্ত হয়ে হয়ে ছুটে এসে সুশীল বাবুকে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে মেজবাবু । সুশীলবাবু ব্যাকুল স্বরে বললেন, কি হয়েছে করালী, এমন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে

এলে কেন ?

ময়নাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সেকি! প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। করালী তুমি নিবারণকে বলো গ্যারেজে গাড়ী রাখতে হবে না। আমাদের পুনরায় বেরিয়ে পড়তে হবে। বেরিয়ে পড়তে হবে ময়নার খোঁজে। বিপদের পর বিপদ। দুঃখের পর দুঃখ। দেবী ও হেমন্তবাবু সহ্য করতে পারবেন ? এই অসহনীয় জ্বালা উভয়ের অন্তরকে কুরে কুরে খেতে থাকবে। অসহ্য নিদারুনের কুঞ্ঝটিকায় পরিণত হবে তাদের মন ও অন্তর। ঠাকুর ওদের একটুখানি শান্তির বাতাস দিয়ে অশান্ত মনকে শান্ত কর।

সহসা ড্রাইভার ব্রেক করতেই সুশীল বাবুর চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। নিবারনের এক পরিচিত ড্রাইভার এসে বলল, গাড়ী সাইট করো নিবারণ দা। একটা বাচ্চা মেয়ে এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তাই পথ যাত্রীরা পথ অবরোধ করেছে। বাচ্চা মেয়ের কথা কানে যেতেই সুশীলবাবু বুকে কে যেন হাতুড়ীর ঘা মারলেন।

তৎক্ষণাৎ গাড়ী হতে নেমে সঠিক সংবাদ নেওয়ার জন্য যান জটের মধ্যে প্রবেশ করলেন। বাচ্চা মেয়েটিকে হাসপাতালে বা কোন নার্সিংহোমে নিয়ে গেছে। তবে মেয়েটি যেভাবে আহত হয়েছে মনে হয় -

সুশীলবাবু আর থাকতে পারলেন না। পাগলের মতো একে ওকে অর্থাৎ নানা জনকে জিজ্ঞস করাতে ও কোন খবর পেলেন না। তিনি কি করবেন এই মুহুর্তে। যদি ঐ মেয়েটি ময়না হয়ে থাকে তাহলে - সমস্ত কলকব্জাগুলো যেন বিকল হয়ে গেল। শরীরটা যেন থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। এমন সময় কানে ভেসে এলো মেয়েটিকে কনক নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। সুশীলবাবু বিলম্বনা করে কনক নার্সিংহোমে উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রওনা ঠিক সময়েই হয়েছিলো জয়ন্ত। কিন্তু পথমাঝে এই রকম বিপদের মাঝে পড়বে ভাবতে পারেনি। জয়ন্ত ও ওর বাবা কুশলবাবু গভীর চিন্তায় মগ্ন। বাচ্চা মেয়েটি কার। প্রভাতেই বেরিয়ে পড়েছিল। ওর সাথে কি গার্জেন ছিল না!

নানা চিন্তার মধ্যে এক সময় চারু নার্সিংহোমে হাজির হলো। রমাকে চারু নার্সিংহোমে ভর্তি করে নিজেকে শান্ত রাখতে পারেনি জয়ন্ত। কারণ গত রাত্রে তার গাড়ীতেই ধাক্কা হয়েছিল। ওকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় নার্সিংহোমে ভর্তি করেছিলো। অনেকটা বেলা হলো, মনে হয় রমা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024