উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -41


 


এগারো


পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেবীকে প্রাতঃরাশ করিয়ে স্নানে রত হলাম। দেবী আপন বাড়ীতে কর্তব্যে হাজিরা দিতে গেলো। ময়নাকে ঘুম হতে উঠিয়ে ওকে সাজিয়ে গুছিয়ে অর্থাৎ নিত্যকার পদ্ধতি অনুযায়ী স্কুলে পাঠিয়ে দিলাম বানীদার সাথে। আজ মঙ্গ লবার।

মঙ্গলাচন্ডীর মন্দিরে গিয়ে পূজো দিয়ে বাড়ী গেট খুলতেই নজরে পড়লো, একজন লোক বারান্দায় পায়চারি করছেন। পরিধানে দামী পাঞ্জাবী ও সাদা ধবধবে পায়জামা। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, মুখে ধূমপানের পাইপ। তার সুঠাম দেহ। আমার অনুমান, দেবীদাসের বাবা ছাড়া অন্য কেউ নন। অনুমানের সত্যতা যাচাই করবো কি করে ?

দ্বিতীয়তঃ ভদ্রলোককে দেখে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেছে। কি করে তাকে সম্বোধন করবো। তারপর প্রথম সাক্ষাতেই যদি টালবাহানা হয়ে যায় তাহলে আর বলার নেই। উপায় হলো, বাড়ী হতে করালীদা আমাকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বলল, দিদিমরি ছোট বাবুর বাবা এসেছেন।

ইনি দেবীর বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর মশাই। মিনিট খানেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শ্বশুর মশাইকে নিরীক্ষণ করতে থাকলাম। তার মুখখানি গাম্ভীর্য পূর্ণ। জানি না তার কাছে কি ব্যবহার পাবো। যদি আমাকে না মেনে নেন বা আমার পরিচয় বাড়ী প্রবেশ করার আগে পেয়েছেন, তাহলে কি হবে আমার?
মনে জোর না আনতে পারলেও মনকে শক্ত করতেই হবে। ভাগ্যে যা হবার তা হবে। যদি অদৃষ্টে আমার বিপর্যয় থাকে কেউ খন্ডন করতে পারবে না। কোন প্রকারে দুরু দুরু বুক নিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে প্রণাম করে বললাম, বাবা, কখন এলেন ?

তিনি প্রথমতঃ হকচকিয়ে গেলেন, পরে আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললেন, বাঃ বাঃ সেই চোখ, সেই নাক, মুখ, তোমার মধ্যে যেন আমার স্বর্গতা বৌমা চন্দ্রাকে দেখতে পাচ্ছি। সুশীলবাবুর পত্রে চন্দ্রার মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম। বড় অভিমানিনী ছিল মা চন্দ্রা, নইলে কেন অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

শ্বশুর মশায়ের চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তিনি দেবীর নিয়ে প্রসঙ্গ তুললেন। দেবীকে নিয়ে প্রসঙ্গ তুললেন।

দেবীকে নিয়ে এক দারুন স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু সব আশা আকাঙ্খা বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। যখন শুনলাম দেবী ভালো হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিয়েছে, তখন আর থাকতে পারলাম না। পাগল ছেলেকে দেখতে ইচ্ছে করলা। আর ইচ্ছে করলো তোমাকে দেখতে। দেবীকে সৎ পথে তুমিই এনেছো মা। তবে তোমার পরিচয় এখনো পাইনি।

আমি বললাম, বাবা আপনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, সারা পথ যানবাহনে এসেছেন, চলুন বিশ্রাম নেবেন তারপর সব কথা শোনাব।

হ্যাঁ মা, সত্যিই আমি ক্লান্ত। চলো কিছু খেয়ে বিশ্রাম করবো। বাবাকে যত্ন সহকারে খাইয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করলাম। আমার আয়োজন, পরিবেশনে অত্যন্ত প্রশংসা করে বললেন, অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে আহার করলাম মা। তোমার মতই চন্দ্রা বৌমা যত্ন সহকারে সেবা-শুশ্রূষা করতো।

স্থির করলাম, চন্দ্রাদি বাবাকে কিভাবে সেবা শুশ্রূষা করতো তা আমার গৃহস্থালীর কর্মের মধ্যে শিখে নিতে হবে। বাবাকে সুখী করার জন্য আমার চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবেনা না। যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

বাবা পাশের রুমে বিশ্রাম করছেন। আমি যত্ন সহকারে বাবার জন্য নানাবিধ রুচিসম্পন্ন খাবার তৈরীতে মনোনিবেশ করলাম। মনটা আমার রান্নার দিকেই পড়েছিলো। অতীত বা ভবিষ্যতের দিকে কোন খেয়ালই ছিলো না। এক সময় দেবী রান্না ঘরে প্রবেশ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আজ তোমার আশাপূর্ণ হলো রমা। এই দেখো রেজেষ্টারী ম্যারেজের দলিল। অরূপবাবু আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই আনন্দ সংবাদ যেন খুব শীঘ্র তোমাকে জানাতে পারি। এবার নিশ্চয় তোমার মানসিক চিন্তার অবসান হলো।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললাম, বাবা এসেছেন খবর পেয়েছো? দেবী ভীত হয়ে বলল, কখন এসেছেন? বাবার শরীর ভালো আছে তো?

হ্যাঁ বাবার শরীর ভালো আছে। তিনি এখন বিশ্রাম করছেন। বাবার আগমন বার্তা শুনে দেবী বেশ চিন্তামগ্ন হলো। ওর ঐ রূপ অবস্থা দেখে বললাম, বাবার আগমন বার্তা শুনে তুমি মুষড়ে পড়লে কেন?

দেবী নম্রকণ্ঠে বলল, বাবার সম্মুখে কি করে দাঁড়াবো তাই ভাবছি।

ওসব চিন্তা মনে না এনে বাবার কাছে যাও, বাবার ভালো মন্দের খবর নাও। তাছাড়া সুশীলবাবু তোমায় নিয়ে সমস্ত বিষয় আলোচনা করেছেন, সেই জন্য ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। দেবী কথা না বাড়িয়ে তার বিশ্রাম ঘরে প্রবেশ করলো। আমি পুনরায় কাজে মন দিলাম।

দুপুর বেলা, রান্নার কাজ শেষ করে ওদের সকলের খাবার ব্যবস্থা করলাম। তিনি বিচক্ষণ ও ধনী ব্যক্তি তবু তিনি ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে রাজী হলেন না। বাবার কথা মত তকতকে মেঝের উপর আসন পেতে খাবার ব্যবস্থা করলাম। ভয়ে ভয়ে খাবার পরিবেশন করতে শুরু করেছি, সে সময় আমার বক্তীর কথা মনে উদয় হতে চক্ষু ছেপে জল আসতে শুরু করলো। কি অদৃষ্ট আমার, আজ যেভাবে আমার শ্বশুর মশাইকে সেবা শুশ্রূষা করছি, সেদিন যদি আমার জন্মদাতা পিতাকে সেবা শুশ্রূষা করতে পারতাম, তাহলে আজ ওকথা মনে উদয় হয়ে মনকে পীড়া দিতো না। বাবাকে আশ্রয় দিয়ে একদিনও মনের মতো সেবা যত্ন করতে পারিনি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে ছিলাম। কিন্তু কেন তার প্রত্যুত্তরে মনের নিকট কোন জবাব দিহি করতে পারিনি। শুধু মনের জ্বালা ও বেদনাকে চেপে রেখেছিলাম।

বাবার আহার করা দেখে বেশ ভালো লাগলো। তিনি এই বয়সে বেশ সুন্দরভাবে আহার করে থাকেন তাতে আশ্চর্য হবার কথা দেখলাম। দই এর প্রতি বাবার ভীষণ আগ্রহ এবং ওটা তার রুচিসম্মত খাদ্য বলে মনে হলো। তাই দই এর মাত্রা বেশী দিলাম। তিনি বাধা দিলন না। বললেন, এই দই কেনা দই বলে মনে হচ্ছে না বৌমা?

বললাম, আমি তৈরী করেছি।

বাঃ বড় তৃপ্তি পেলাম তোমার তৈরী দই খেয়ে।

আমার প্রশংসা শুনে দেবী বঙ্কিম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওদের খাওয়া শেষ হলে পর, বাবাকে বিশ্রাম করার ব্যবস্থা করলাম। অর্থাৎ যাতে সব দিক দিয়ে তাকে তৃপ্তি করতে পারি তারই চেষ্টা আমার প্রবল । সারাদিন কোন প্রকারে কাটলো।

রাত্রে আমাদের উভয়ের ডাক পড়লো। আমি ও দেবী হাজির হয়ে নত মুখে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকাতে বাবা পাশে বসতে বললেন। অন্তরে আমার দুঃশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনা ছিলো না। বিশেষ করে তার স্নেহ আদর আমার মালিন্যকে দূর করে দিয়েছিলো। বুকে সাহস নিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। দেবী একটু দূরে বসলো নত মুখে।

একটু পর তিনি বললেন, দেবী তোমার পরিবর্তনে অনেক খুশী হয়েচি। সুশীলবাবুর পত্রে তোমার সৎ মনোবৃত্তি বা সৎ পথে চলার জন্য আমি কতখানি যে মানসিক শান্তি লাভ করেছি তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবে না। তোমাকে কতখানি ভালোবাসতাম তা হয়তো জানো। কিন্তু এতদিন তার বিনিময়ে কি দিয়েছো? শুধু ঘাত, প্রতিঘাত ও মানসিক অশান্তি। তোমার ভুলের জন্য বৌমাকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। বলতে পারো, সেকি এমন অপরাধ করেছিলো?

দেবী নিরুত্তর। তিনি বলে চলেছেন, তোমার জন্য মা হারা ময়না ফুলের শুষ্ক কুড়ির মতো ম্লান হয়ে যাচ্ছিলো। যাক ঈশ্বরের কৃপায় আমার মা রমাকে পেয়ে সেই ফুলের কুড়ি বিকশিত হবার অনুকূল পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। অতীতকে ভুলে এ বছর নব প্রভাতে সূর্যালোকে নিজেকে যেমন উদ্ভাসিত করেছো, সুতরাং সেই আলো অম্লান রাখার চেষ্টা করবে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024