Tuesday, May 28, 2024

এরা কারা - বিশ্বনাথ দাস || Era Kara - Biswanath Das || পর্ব - ৮ || part - 8 || Era Kara part 8 || Novel - Era Kara || Era Kara by Biswanath Das || উপন্যাস - এরা কারা


 


গতস্য শোচনা নাস্তিঃ কিন্তু হিড়িম্ব মহারাজ কোন মতেই অসীম রায়ের অপমানের কথা ভুলতে পারলো না। সর্বদাই কানের মধ্যে বাজতে থাকলো। সর্বক্ষন মনে হচ্ছে বুকের বাম দিক টাতে একটা আলপিন যেন ফুটে আছে। একদিন ওর সাকরেদদের ডেকে পরিকল্পনা করলো, কি ভাবে নীলরতনকে ফাঁদে ফেলা যায়। একমাত্র পথ হলো স্কুলের হেডস্যারকে হাত করতে হবে। রাজনীতির প্রভাবে হেডস্যারকে সহজেই হাত করা সহজ হবে। তার চামচারা একমত। নেতাকে থাপ্পড় মারা মানে তাদের ও ল্যাজ কেটে দেওয়া। হঠাৎ হিড়িম্বর পোষাগুন্ডা গনশা এক সময় বলে উঠলো - টেন্সন নিওনা গুরু, তুমি বললে খালাস করে দেবো। হিড়িম্ব ও তার গোপাল বন্ধুরা মিলনদার দোকানে মাল ও কচি পাঁঠার মাংস খাচ্ছিল। হঠাৎ দাঁতের খাঁজে এক টুকরো হাড় আটকে যাওয়াতে মুখের ভেতরে পুরো কব্জিটা ঢুকিয়ে বের করতে করতে বললো


- পারবি খালাস করতে? গনশা বললো- পারবো গুরু পারবো, হুকুম করলে দেখবে কাজ হাসিল। হঠাৎ গনশা বিকট চিৎকার করে বললো, -এই জোগা, একটা ট্যাংরা নিয়ে আয় নেশাটা জমাতে হবে। এমন সময় হিড়িম্ব বললো- উঠে পড় গনশা, একটা নয়া চিজ খেয়ে আসি। বলা মাত্র ট্যাংরী না খেয়ে উঠে পড়লো। এবার আপনাদের কাছে দু লাইন বক্তব্য রাখছি, এই গনশা কে? কি তার পরিচয় যদি জানতে চান তাহলে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে। এ ছেলেটি শিক্ষিত, মেধাবী ছাত্র ছিলো, এবং ভালো ক্যারেটে ম্যান ও ছিলো। কে এবং কেন তার জীবন নষ্ট করলো। পড়তে থাকুন জানতে পারবেন। তবে হিড়িম্ব হাজরার চরিত্র কিছু জেনেছেন, এখানো অনেক বাকী। নেতা হওয়ার জন্য ওর পাওয়ার এতো বেশী যে ওর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারো ক্ষমতা নেই, তার কারণ পূর্বেই প্রকাশ করেছি। তবে কোন যুবতী ওকে চটিপেটা করেছিলো। ঐ যুবতী ছিলো এক জন নার্স নাম আশালতা। ওতেও ব্যাটার লজ্জা শরম নেই। কি ভাবছেন ঐ চটি পেটার গপ্পো শুনবেন নাকি? আমি বুঝতে পারছি আপনাদের মন উত্তলা ঠিক আছে ঐ গপ্পো, আপনাদের শোনাব একটু ধৈর্য্য ধরুন। আশালতা শুধু চটি পেটা করেনি, নানা উপহার ও দিয়েছিলো। তাহলে শুরু করি কেমন? ঠিক আশ্বিনের কাছাকাছি হবে। গৌরবাবু রিটার্ড হয়ে অচীন পুরেই ডেরা বাঁধলেন পাততাড়ি গুছিয়ে। বাংলা দেশের মানুষ হলেও তিনি ভালো ও খাঁটি মানুষ। অনেক পূর্বে এখানে এসে মাষ্টারী যোগাড় করেছিলেন। সেই প্রাইমারী স্কুলে খুবই কম বেতন ছিলো। তাই তাঁর কামনা বাসনা থাকলেও তিনি বিয়ে করতে পারেন নি। তার ভয় ছিলো সংসারী হলে ঐ পয়সাতে সংসার চালাতে পারবেন না। সেই জন্য তিনি চাপা বয়সেই বিয়ে করেছিলেন। বেশী বয়সেই তিনি জনক হলেন। একমাত্র মেয়ে কনিকাকে নিয়েই তার সংসার।- ভালো মন্দের মধ্য দিয়ে দিন কেটে যায়। কনিকা যৌবনে পা দেবার পর অনেকেই ওর সাথে প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিলো কিন্তু সকলকে ডিনাই করেছে। সে তার বাবার দীক্ষায় দিক্ষিত। কনিকা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। খুবই ভালো মেয়ে স্কুলে যখন পড়তো তখন পড়াছাড়া কিছু বুঝতো না বাবার বয়স হয়েছে, মা যামিনী দেবী, গৌর বাবুকে বিয়ে করে সুখীই হয়েছিলো কিন্তু কনিকা জন্ম নেবার কয়েক বৎসর পর তাঁকে এমন রোগে আক্রান্ত করলো যে কনিকার মাধ্যমিক পাশ করার পর ইহলোক ত্যাগ করলেন। কনিকা এবার একা সংসারের কাজ কর্ম বাগিয়ে পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো উচ্চমাধ্যমিকের পর আর কলেজে যাওয়া ইচ্ছে জাগেনি। কারন বাবার সেবা করার তার কর্তব্য।


হঠাৎ একদিন প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টার স্বরুপ বাবুর সাথে কনিকার সাক্ষাৎ হলো ঘটনা চক্রে। তবে স্বরুপ বাবুকে প্রায়ই দেখতো হাটে বাজারে। এমনকি পাড়াতেও, ভোটার কার্ড, রেশনকার্ড সংশোধন ইত্যাদি কাজে। হাটের মধ্যে সম্মুখে চোখাচুখি হবে ভাবতে পারেননি উভয়েই। দৃষ্টিটা এমন প্রতিফলিত হয়ে ছিল যেন উভয়েই শুভ দৃষ্টি হচ্ছে। একটু পরে উভয়েই পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছিল। স্বরুপ বাবু প্রথম কথা বলেছিলেন- আপনি গৌরবাবুর মেয়ে! কনিকা নম্র কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন- হ্যাঁ। কনিকা ওখানে আর দাঁড়ায় নি, সোজা বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল। দিন কয়েক পর ধুমকেতুর মত স্বরুপ বাবু কনিকাদের দরজায় সামনে উদয় হলেন। কনিকার চক্ষু চরক গাছ। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, আপনি! হ্যাঁ আমি। বিশেষ দরকারে আপনার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলাম। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে সাক্ষাৎ করবো নতুবা একশো মিটার রেসে এখান থেকে পালিয়ে যাবো। কনিকা চোখ দুটোকে গোল মার্বেল করে বললো, আমার অনুমতি, ঠিক বুঝলাম না।


বুঝলেন না এই তো? ঠিক আছে আমি আপনাকে সারাংশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার নাটকে আমি হলাম নায়ক, আর আপনি হলেন নায়িকা। নায়িকা যদি নায়ককে বিয়ে করতে রাজী না থাকে তাহলে নাটক লেখার সার্থকতা কোথায়। অর্থাৎ আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারছেন। কনিকা একটু অবাকই হলো, কারন স্বরুপ বাবু যে এই প্রস্তাব করবেন ভাবতেই পারে নি। যুবকটি বলেন কি! তার সাথে কোন আলাপ হলো না, প্রেম হলো না আলে, খালে, ডালে, পার্কে বসে দশ মিনিটের জন্য কোন দিনই প্রেম কাব্য রচনা হলো না, কোন প্রেমের ভাষাতে আলাপ হলো না, আপন গালে প্রেমের চুম্বন ও আঁকলো না আমি কে, কি আমার পরিচয় তাও জানলো না। তবুও বিয়ের কথা শুনে অন্তরটা যেন কল্ কল্ করে উঠলো। অবশ্য কনিকা ওর বাবার কথা ভেবে কোনদিন বিয়ের কথা ভাববার অবকাশ পাইনি। কারন তার বাবাকে কুহকে ফেলে কোন প্রকার বিয়ে করবে না। আর পরক্ষনেই ভাবতে থাকে বাবা চিরদিন বাঁচবে না। তাঁকে সংসারী হতে হবে। স্বরুপ বাবু মেধাবী ছেলে, ভদ্র ও নম্র ও চরিত্রের সার্টিফিকেট ও ভালো। ওর কথা শুনে প্রথমতঃ থতমত করছিলো, কিন্তু সেদিনের হাটের দৃশ্য মনে করতেই তার মনের মধ্যে প্রেমের বাসা বাঁধতে শুরু করেছিলো। প্রেম যে কি তা একটু একটু করে অনুভব করছে। কিন্তু- ওর সাথে আলাপ না হলেও স্বরুপ বাবুর চোদ্দ গোষ্টীর রামায়ন শুনিয়েছে কনিকার অত্যন্ত প্রিয় দিদি আশালতা। আশালতা দেবীর কাহিনী এখন বলবো না পরে জানতে পারবেন। যাইহোক স্বরুপের কন্ঠস্বরে কনিকার সম্বিৎ ফিরে এলো- কি ভাবছেন? তাহলে আমি বাড়ী ফিরে যাই?


-আমি কি তাই বললাম? কনিকা মৃদুস্বরে বললো।


- আপনি রাজী। কনিকা ঘাড় নাড়ে। স্বরুপ বাবু বললেন,


- আপনি আমার বায়োডাটা জানেন?


- কিছু কিছু জানি, আশাদির কাছে শুনেছি।


- তাহলে বাবার কাছে হাজির হই।


ভেতরে আসুন। পজেটিভ উত্তর পেয়ে স্বরুপ বাবুর মনে হলো দুইহাত তুলে চৈতন্য মহাপ্রভুর মতো নাচতে, কিন্তু পারলো না মাষ্টার মশায় হয়ে এতটা উৎফুল্ল হওয়া উচিত নয়। এবার আপনারা ভেবে দেখুন তো, মানুষের মনের আশা যদি পূর্ণ হবার সম্ভাবনা হয় তাহলে মানুষের হৃদয় আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠে। প্রেমানন্দে, অনেক খানি আত্মসুখী হয়ে থাকে। আর মনো বাসনা যদি পূর্ণ না হয় তাহলে ভেতর থেকে কান্নাকে ঠেলে নিয়ে আসে। চোখ ফেটে জল ঝরতে থাকে, হৃদয় একে বারে খন্ড বিখন্ড হযে যায়। স্বরুপবাবু জীবনে নিরানন্দের বন্যার স্রোতে হৃদয় একে বারে বারে ধসে পড়েছিলো। এই আঘাতে যে কত কঠিন তা স্বরুপবাবু অনুভব করেছিলেন। ঘটনা কি ঘটেছিল একটু পরেই বুঝতে পারবেন বা জানতে পারবেন। তবে একথা স্বীকার করেন তো? "বিধির লিখন কে করে খন্ডন"। কনিকা তার জেঠুর মেয়ে। আপন জেঠুর মেয়ে। কি ভাবছেন আমার প্রিয় পাঠক/পাঠিকা গন? ভাবছেন এ আবার কি রকম লেখা। কি করবেন আমি দুষ্টু লেখক, নায়ক/নায়িকার মিলন ঘটাতে আমার কলম বিরুদ্ধাচারণ করে এই তো বলবেন না মশায়, আমি তা চাই না, যেটা সত্য তা আমার কলম লিখে, সত্য পথে এগিয়ে যেতে আমার কলম পিছপা হবে না। এক অদ্ভুত সাহস নিয়ে কাগজের উপর লিখতে শুরু করে। আমার কলমকে বীর যোদ্ধা বললে ভুল হবে না, আমার কলমকে বন্দুকের গুলি বলতে পারেন, আমার কলমকে তীক্ষন তীর বললেও ভুল হবে না।


তাহলে শুনুন ব্যাপারটা কি দাঁড়িয়েছে। কনিকার মত পেয়ে স্বরুপ বাবু গৌরবাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে গৌর বাবুকে টুক করে প্রমান করে বললেন- আপনার কাছে এলাম স্যার। গৌরবাবু গুরু গম্ভীর লোক। প্রায় আশির কাছাকাছি বয়স। তরমুজের মতো মাথা। আধা কাঁচা ও পাকায় মাথা ভর্তি চুল। মধ্যিখানে পাক ধরেছে। নাকের ডগায় মোটা ফ্রেমের চশমা। গোঁফ খানিও মোটা। নজরুলের "সঞ্চিতা" পড়ছিলেন, স্বরুপ বাবু কণ্ঠস্বরে বই পাতা হতে চোখ সরিয়ে বললেন- কে? কোথা হতে আগমন। স্বরুপ বাবু নম্র কন্ঠে বললেন- পাশের গ্রাম ধরমপুর হতে। ঐ গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী করি। গৌরবাবু একটু ট্যারাচে চোখে বললেন- প্রাইমারী স্কুলে?


হ্যাঁ স্যার।


কোন সাবজ্যাকট নিয়ে অর্নাস করেছো?


-অংকে। ভালো, ভালো, বসো। কনিকা কে একটা চেয়ার আনার জন্য বললেন। কনিকা একটা হাতল ভাঙ্গা চেয়ার এনে স্বরুপ বাবুকে বসতে বললো। একটা প্রাইমারী স্কুলের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকের হাতল ভাঙ্গা চেয়ার! ও সব ভাবনা না ভেবে টুপ করে বসে পড়লেন। কিছুক্ষন নীরব। এমন সময় মুখ সরিয়ে বললেন, কি খাবে চা, না কফি? স্বরুপ বাবু আমতা আমতা করে বললেন,- আমার জন্য আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তবুও কনিকাকে কফি করতে বললেন। স্যার, আমি যে প্রস্তাব নিয়ে অপনার দরবারে এসেছি যদি বলার সুযোগ দিতেন তাহলে খুশী হতাম। তিনি বললেন- অবশ্যই বলো,


- আপনার মেয়ে কনিকাকে আমার ভারী পছন্দ। তাকে আমি বিবাহ করতে ইচ্ছুক, আপনার মতামত বলুন। গৌরবাবু বেশভারী গলায় বললেন, কনিকাকে পছন্দ হলো কি করে? তবে কি কনিকার সাথে প্রেম আদান প্রদান হয়েছে? হক্কচিয়ে স্বরুপ বাবু বললেন, না না ওসব কিছু নয়। আপনার মেয়েকে দেখে আমার ভারী পছন্দ হয়েছে। অবশ্য কনিকার সাথে কদাচিৎ কোন আলাপ, ও কোন কথাবার্তা হয়নি। একটু দুরে দাঁড়িয়ে ছিলো কনিকা। গৌরবাবু কনিকার পানে কর্কশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝতে পারলো বাবা ওকে দু-চার কথা জিজ্ঞেস করবে সুতরাং কনিকা হঠাৎ বলে উঠলো- না বাবা, এনার সাথে আমার আলাপ হয়নি, আর এই ব্যাপারে আলোচনা হয়নি। গৌর বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তোমার বাড়ী ও জন্ম স্থান কোথায়? সংক্ষেপে উত্তর, ঢাকা জেলায় কনকপুরে। জন্ম এই স্থানে কনকপুরের নাম শুনতেই গৌরবাবু চমকে উঠলেন। এবার বইটা বন্ধ করে গভীর ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,-


কতদিন দেশ ছাড়া হয়েছো.


তা জানি না।

তোমার বাবার নাম কি?


- আমার বাবার নাম কিশোরীলাল বসাক। হঠাৎ গৌর বাবুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে তোমার ঠাকুরদার নাম জানো? এলো,


প্রেমেন্দ্র বসাক। গৌরবাবু পুনরায় বললেন,


তোমার মায়ের নাম কি ললিতা বসাক! তার মার নাম শুনে স্বরুপ বাবু চমকে উঠলেন, গৌরবাবু কি করে জানলেন তার মার নাম ললিতা বসাক। তবুও কৌতুহল দৃষ্টি নিয়ে বললেন, -আপনি কি করে আমার মার নাম জানলেন? গৌরবাবু স্তব্দ হয়ে গেলেন। কনিকা, স্বরুপ গভীর ভাবে আশ্চর্য্য হলেন। বারংবার নিজেদের মনকে নাড়া দিতে থাকলো। গৌরবাবু কি করে জানতে পারলেন। হঠাৎ দেখা গেল গৌরবাবুর চোখ দিয়ে টপ্স্টপ্ করে জল বেরুতে থাকলো কনিকা ধীরে ধীরে গৌরবাবুর কাছে এগিয়ে এসে বললো- বাবা তোমার চোখে জল। গৌরবাবু চোখ দুটো মুছে বললেন,


এ দুঃখের চোখের জল নয় মা। এ আমার আনন্দাশ্রু। হঠাৎ মুড পালটে বাবা স্বরুপ এবার বলতো, তোমার মা বেঁচে আছেন? বললেন,


হ্যাঁ আছেন। বাবা নেই। কিন্তু আপনি স্বরুপের কথাকে লুফে নিয়ে বললেন, বলবো, সব বলবো নইলে যে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি কয়েক বছর ধরে এবার সেই যন্ত্রনা হতে নিস্কৃতি পাবো। আমি ভেবেছিলাম আমার পরিবারের লোক জন মারা গেছে, কেউ বেঁচে নেই। সেই ভয়ংকর রাত্রির কথা আজো মনে আছে। ঐ রাত্রির কথা কোন মতে ভুলতে পারিনি বাবা। দিনটা ছিল, হেমন্তের কোন এক রাত্রি। সবে মাত্র চাষীদের খামারে ধান উঠতে শুরু করেছে। প্রচন্ড ফসল ফলেছে মাঠে, সোনালী বর্নে মাঠ ভরে গেছে। চাষীদের মনে আনন্দের শেষ নেই। কি হিন্দু, কি মুসলিম। স্থানে স্থানে মৃদঙ্গের বাজনা বাজছে ঝুমুর, ভাটিয়ালী, ও গম্ভীরা গানের তালে তালে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা, খাটুনির পর সন্ধ্যের সময় গান/বাজনার আসর জমে উঠেছে। প্রতি মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার। কিছু লোক ভাঙ্গ, গাঁজা প্রভৃতি মাদকতায় ঝিমুচ্ছে। কেউ কেউ গানের সুরে সুর মিলিয়ে গান করার চেষ্টা করলে নেশার ঘোরে মানুষ গুলো নেতিয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আবার হেমন্তের মৃদু, মন্দা বাতাসে শীতের আমেজ উপভোগ করছে। গৌরবাবু আপন বারান্দায় বসে কয়েক জন ছাত্র/ছাত্রী কে পড়াছিলেন। পাশের ঘরে অর্থাৎ ত্রিশ/চল্লিশ মিটার দুরে লুডো খেলছিলো। তখন টি.ভি ছিলো না। কখনো কখনো ছোট ভাই কিশোরীলাল ছোটতেই ললিতাকে হারিয়ে বিকট শব্দ করে তাকে রাগন্ধিত করছে। এমন করে ঘন্টা খানেক কেটে যাবার পর শতশত মানুষের বিকট চিৎকার, পালাও পালাও রব। হিন্দু ভায়েরা পালিয়ে যাও। নইলে ওরা মেরে ফেলবে। 




পর্ব - ৭ || Part - 7



পর্ব - ৯ || Part - 9


Friday, May 3, 2024

এপ্রিল সংখ্যা ২০২৪ || April Sonkha 2024





সম্পাদকীয়:

নদীর বুকে নিজেকে জড়িয়ে নিন। বিকেলের পড়ন্ত রোদের বিকেলে দুদন্ড শান্তি নিন নদীর প্রান্তে। এ এক অমায়িক সুখ। হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার হোক‌। জানি সে প্রেম তাৎক্ষণিক। তবুও এই দুদন্ড শান্তি প্রত্যেক প্রহরের অক্লান্ত পরিশ্রম দূর করার এক নিবিড় প্রয়াস মাত্র।

পৃথিবীর বুক ফেটে বের হয়ে আসে লাভা, এই তপ্ত দুপুরের পরিশ্রম যেন ঐ গলিত লাভাকে স্পর্শ করেছে। তাই সুখের খোঁজে বের হোন। নদীর প্রান্তে শীতল বাতাস খুঁজে নিন। সঙ্গে নিন সাহিত্য চর্চার সমস্ত সামগ্রী। অন্তত নিজের মোবাইল সাথে রাখুন। প্রশান্তির আদলে শুরু করুন সাহিত্য চর্চা। লেখালেখির জগতে প্রবেশ করাতে শিখুন। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন আপনার সুদৃঢ় প্রয়াসকে অবশ্যই কুর্নিশ জানাবে। আসলে বিনামূল্যে সাহিত্য চর্চায় প্রশান্তি আনতে পারে একমাত্র ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন। তাই নিজের মোবাইল এর স্পর্শে ঘেঁটে ফেলুন আপনার প্রিয় লেখক এর লেখা গুলো। নদীর প্রান্তে শীতল বাতাসের প্রশান্তি আর সাহিত্য চর্চার প্রশান্তিকে করে ফেলুন এককার।

ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন সর্বদা সকলের পাশে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই সাহিত্যে থাকুন, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ ম্যাগাজিন পড়তে থাকুন।
     

                                ধন্যবাদান্তে
                           সম্পাদকীয় বিভাগ 


__________________________________________________


এপ্রিল সংখ্যার সূচীপত্র - 


অনুগল্প : 

১) দর্পনা গঙ্গোপাধ্যায় ২) প্রদীপ সেনগুপ্ত ৩) পার্থপ্রতিম দাস ৪) নীল মিত্র ৫) অভিষেক ঘোষ ৬) চন্দন মিত্র ৭) প্রহ্লাদ কুমার প্রভাস। 


কবিতা :

১) ইলা সূত্রধর ২) সুশান্ত সেন ৩)আনন্দ গোপাল গড়াই ৪) নাসির ওয়াদেন ৫) অনুপম বিশ্বাস ৬) মুহা আকমল হোসেন ৭) নীলমাধব প্রামানিক ৮) অমিত কুমার সাহা ৯) তপন মাইতি ১০) পূর্বিতা পুরকায়স্থ ১১) গোবিন্দ মোদক ১২) গৌতম ঘোষ দস্তিদার ১৩) সমর আচার্য্য।


গল্প :

১) সিদ্ধার্থ সিংহ ২) শাশ্বত বোস।


প্রবন্ধ :

১) তন্ময় কবিরাজ ২) শংকর ব্রহ্ম।


______________________________________



স্বর্ণমণি - সিদ্ধার্থ সিংহ || Sawarna moni - Sidhartha singha || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 স্বর্ণমণি

সিদ্ধার্থ সিংহ



বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখতেই সৌম্য বুঝতে পারল, স্বর্ণমণিকে কত লোক ভালবাসত। না হলে এইটুকু সময়ের মধ্যে এত লোক এসে জড়ো হয়! গোটা বাড়ি জুড়ে থিকথিক করছে লোক। তার মধ্যে আশপাশের মেয়ে-বউই বেশি। ও যে সবাইকে চেনে বা ওকেও যে সবাই চেনে, তা নয়। তবে স্বর্ণমণিকে নিশ্চয়ই এরা সবাই চেনে।


ও তখন মেজদির বাড়িতে রাখী পরতে গেছে। জামাইবাবুর আনা মটন বিরিয়ানি খেতে খেতেই শুনল মেজদির ফোনে রিং হচ্ছে। মেজদির কথা শুনেই বুঝতে পারল মাধুকাকা ফোন করেছে।

মা মারা যাওয়ার পর তাদের এই অকৃতদার কাকাই তাদের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে থাকেন। পঁচাত্তর পেরিয়ে গেলেও শরীর এখনও যথেষ্ট সুঠাম। কিন্তু তিনি ওখানে একা থাকবেন কী করে! রান্নাবান্না কে করে দেবে! তাই খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের সংসাররের যাবতীয় কাজকর্ম যে দু'হাতে একাই সামলাচ্ছে, সেই স্বর্ণমণিকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওখানে।

খুব ছোটবেলায় বাপ-মা মরা পলাশীর এই মেয়েটিকে তার বৌদি এত অত্যাচার করত যে, সে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতার ট্রেনে চেপে বসেছিল। সেই ট্রেনে ছিলেন সৌম্যর মা।

সে বহু যুগ আগের কথা। সৌম্য তখন ফাইভ কি সিক্সে পড়ে।

ওর মা উলটো দিকের সিটে মেয়েটিকে ও ভাবে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কোথায় যাবে?

ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়েটি কোনও রকমে বলেছিল, এই ট্রেনটা যেখানে যাবে সেখানে।

উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কোথায় থাকো?

ও বলেছিল, পলাশীতে।

--- তোমার নাম কি?

মেয়েটি বলেছিল, স্বর্ণ।

ওর মা জানতে চেয়েছিলেন, ওখানে কার কাছে যাবে?

মেয়েটির আমতা-আমতা করা দেখেই তিনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। দেখতে-শুনতে আদিবাসীদের মতো হলেও অল্প বয়স তো, চারিদিকে হাজার রকমের লোক ঘুরে বেড়ায়, কোথায় কখন কোন বিপদে পড়ে যাবে, তাই তাকে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের বলেছিলেন, এটা হচ্ছে তোদের একটা মণি। যেমন মাসিমণি, পিসিমণি, ঠিক তেমনি এটাও একটা মণি। তোরা ওকে মণি বলেই ডাকবি, বুঝেছিস?

কেউ কেউ মণি বললেও সৌম্য যেহেতু একটু পাকা ছিল, তাই মণি নয়, স্বর্ণকে স্বর্ণমণি বলেই ডাকত। আর স্বর্ণও তাদের এত ভালবেসে ফেলেছিল যে, আসার ক'দিন পর থেকেই তাদের সংসারটাকে নিজের সংসার মনে করেই দু'হাতে সামলাত। 


সৌম্যরা সব ক'টা ভাইবোনই পশুপাখি খুব ভালবাসে। তাদের কলকাতার বাড়িতে কুকুর, বিড়াল, টিয়াপাখি, কাকাতুয়া, খরগোশের পাশাপাশি সৌম্যর ভাই দর্শন একটা ছোট্ট বাঁদরের বাচ্চা পুষতে শুরু করেছিল। আদর করে নাম রেখেছিল র‍্যাঞ্চো।

দেখতে দেখতে তার বয়সও সাত-আট বছর হয়ে গেল। এত দিন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু কিছু দিন আগে তাদের এলাকায় যখন বনদফতর থেকে ঘনঘন হানা দিতে শুরু করল, যে দিন তাদের পাড়া থেকে একজনের পোষা বাজপাখিটাকে জোর করে নিয়ে গেল, তখন ভয় পেয়ে তার পর দিনই ভোররাতে একটা ছোট্ট ম্যাটাডর ভাড়া করে খাঁচাশুদ্ধু র‍্যাঞ্চোকে নিয়ে বারুইপুরের বাগানবাড়িতে রেখে এসেছিল দর্শন।

না, এ বাঁদর, মানে র‍্যাঞ্চো কলা খায় না। দই খায়। শশা খায়। লিচুর সময় লিচু, আঁশফল, সন্দেশ, কড়াইশুঁটি, পেয়ারা।

সে দিন নাকি ওকে কিছুতেই খাওয়ানো যায়নি। স্বর্ণকে মাধুকাকা বলেছিলেন, এই দুপুরবেলায় ও না খেয়ে থাকবে! যা, ওকে তা হলে দুটো রসগোল্লা খাইয়ে আয়।

র‍্যাঞ্চো যখন কলকাতায় ছিল, ছাড়াই থাকত। দর্শনের বুক জড়িয়ে কিংবা কাঁধে চড়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। শুধু সৌম্যদের বাড়ির লোকেরাই নয়, ওকে ভালবাসত পাড়ার প্রায় সকলেই।

দর্শনের খুব ন্যাওটা ছিল ও। খানিকক্ষণ না দেখলেই দর্শন যে যে জায়গায় আড্ডা দিত, হুটহাট করে সে সব জায়গায় চলে যেত। 

একদিন খুব ভোরবেলায় পাঁচিল টপকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

ওদের পাড়ায় ছিল মাদার ডেয়ারির একটি দোকান। যাঁরা দুধ দিতে আসতেন তাঁরা সবাই র‍্যাঞ্চোকে চিনতেন। কিন্তু সে দিন এসেছিলেন একদম নতুন একজন লোক। তিনি দুধের পাউচ ভর্তি ট্রে-টা মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘর্ষণের সেই বিচ্ছিরি আওয়াজ শুনে লোকটার দিকে তেড়ে গিয়েছিল র‍্যাঞ্চো।

বাঁদরটাকে ওই ভাবে তেড়ে আসতে দেখে লোকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যদি কামড়ে দেয়! তাই আগের দিন রাস্তার ধারে খুলে রাখা প্যান্ডেলের একটা বাঁশ তুলে সজোরে মেরেছিল বাঁদরটাকে। একটা নয়, পর পর বেশ কয়েক ঘা।

সেই যে লোকটা ওকে মারল, সে তো ওকে মেরে চলে গেল। আর তার পর থেকে কোনও লোক দেখলেই হল, তাকে কামড়ানোর জন্য তেড়ে যেতে লাগল। বাধা দিতে গিয়ে কামড় খেল দর্শনও। কামড়ে দিল বেশ কয়েক জন পথচলতি মানুষকেও।

বাঁদর পোষার জন্য তখন প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে দর্শনকে। পাশাপাশি দিতে হয়েছে তাদের যাবতীয় চিকিৎসার খরচ। তখনই ঠিক করা হয়, আবার কখন কাকে কামড়ে দেবে, তখন হয়তো শুধু ভর্তুকি দিলেই হবে না, এই নিয়ে থানা-পুলিশও হবে, তার চে' বরং ওর জন্য একটা খাঁচার ব্যবস্থা করি।

তখন ওদের মাথাটা কাজ করেনি, একবারও মনে হয়নি আর কিছু দিন পরে সে যখন আরও বড় হবে, তখন এই খাঁচাটা ওর তুলনায় ছোট হয়ে যাবে। তাই বারুইপুরে নিয়ে আসার পরে একটা পুরো ঘরের সমান খাঁচা বানানো হয় র‍্যাঞ্চোর জন্য। যাতে সে হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারে। তখনই ভাবনাচিন্তা করা হয়, খাঁচাটা যখন এত বড় করাই হচ্ছে, তখন একটা মেয়ে বাঁদর আনলে কেমন হয়!

তখনই ঠিক হয়, এখন যেখানে খাঁচাটা আছে সেখানেই বড় খাঁচাটা রাখা হবে। কিন্তু একবার বড় খাঁচাটা তৈরি হয়ে গেলে সেটাকে টেনেহিঁচড়ে ওখানে নিয়ে যাওয়াটা খুব মুশকিল হবে। তাই র‍্যাঞ্চোর খাঁচাটাকে একটু দূরে সরিয়ে সেখানেই পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা শুরু হয় বড় খাঁচাটি।

এত দিন যেখানে ছিল সেখান থেকে খাঁচাটি সরানোর জন্যই বুঝি সে খুব রেগে ছিল। তাই মাধুকাকা যখন বলল, যা, ওকে তা হলে দুটো রসগোল্লা খাইয়ে আয়।

সেটা খাওয়াতে গিয়েই এই বিপত্তি। স্বর্ণ যখন রসগোল্লা খাওয়ানোর জন্য খাঁচাটার সামনে গেল, দেখল, না-খাওয়ার জন্য খাঁচার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সে ছুটোছুটি করছে। মাঝেমাঝেই ওপরে উঠে রড ধরে বসে থাকছে। হাজার ডাকলেও নামছে না।

স্বর্ণ তখন ওকে খাওয়ানোর জন্য ঘুরে ঘুরে খাঁচার এ দিকে ও দিকে গিয়ে ওর মুখের সামনে রসগোল্লা ধরছে।

হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝট করে ওর হাতটা টেনে নিয়ে র‍্যাঞ্চো এমন মারণ কামড় কামড়ে ছিল যে, সেই যে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোনো শুরু হল, একটা গোটা কোলগেট পেস্ট দিয়েও সেই রক্ত বন্ধ করা গেল না। শেষে পাশের বাড়ির যে ভদ্রমহিলা সারা দিনে পঞ্চাশ বার পান সেজে খান, তাঁর কাছ থেকে একগাদা চুন এনে কোনও রকমে বন্ধ করা হয় রক্ত।

স্বর্ণকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, ও কিন্তু ডাক্তারকে একবারও বলেনি বাঁদর কামড়েছে। যাদের ভয়ে ওকে কলকাতা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, জানাজানি হলে যদি সেই বন দফতরের লোকেরা এসে ওকে নিয়ে যায়, তখন? তাই স্বর্ণ বলেছিল, বঁড়শি গেঁথে গেছে।

ডাক্তার সেই হিসেবেই ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। খাবার ট্যাবলেটও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁদর কামড়ালে যে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, ওকে তো সেটা দেওয়া হয়নি। রাত থেকেই শুরু হয়েছিল যন্ত্রণা। কাটা পাঁঠার মতো দপাদাপি করেছে সারা রাত।

স্বর্ণর অবস্থা বেগতিক দেখে দর্শনকে বারবার ফোন করেছিল মাধুকাকা। দর্শনকে না পেয়ে বাধ্য হয়েই ফোন করেছিল মেজদিকে।

আজ রাখিপূর্ণিমা। নিশ্চয় ওরা দু'ভাই তাদের মেজদির বাড়িতে প্রতিবারের মতো রাখী পরতে যাবে। ওখানে যাওয়া মাত্রই দর্শন যাতে খবরটা পায়, সে জন্যই উনি ফোন করেছিলেন।


ফোন রেখেই সৌম্যর দিকে তাকিয়ে মেজদি বলেছিলেন, স্বর্ণর অবস্থা খুব খারাপ রে। গোটা শরীর নাকি বেঁকে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওর চিৎকারে আশপাশের লোকজন সব জড়ো হয়ে গেছে। দর্শনকে ফোনে পাচ্ছে না। ও তো এইমাত্র রাখী পরে গেল। ফোন কর তো, ফোন কর, ফোন কর। এক্ষুনি ফোন কর।

সৌম্য যখন শুনল স্বর্ণমণির শরীর বেঁকে গেছে, তার মানে ওর ধনুষ্টংকার হয়েছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে না গেলে ওকে বাঁচানো মুশকিল। তাই খাওয়া থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দর্শনকে ফোন করল সৌম্য। কিন্তু ফোন বেজে গেল, বেজেই গেল। আবার। আবার। আবার। অনেক বার চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে ফোন করল মিঠুকে।

মিঠু দর্শনের ছেলে। সে বলল, হ্যাঁ, বাবাকে না পেয়ে দাদু আমাকে ফোন করেছিল। আমিও বাবাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু পাইনি। তাই আমি একটা বন্ধুর বাইকে করে এক্ষুনি বারুইপুরে যাচ্ছি।

সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা স্বর্ণর।। আর ভাবতে পারল না সৌম্য। সেই কোন ছোটবেলা থেকে সে তাদের সংসারটা সামলাচ্ছে। আজ তার এই অবস্থা! ফোন করল বড়দিকে--- শুনেছিস? স্বর্ণমণির কি হয়েছে?

--- কী হয়েছে?‍ দিদি জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, মাধুকাকা যা বলল, তাতে ও বাঁচবে কি না সন্দেহ আছে।

সৌম্যদের বাড়ির উলটো দিকেই থাকে সৌম্যর ছোটবোন। বারান্দার গ্রিলের ও পারে দেখতে পেয়ে তাকে বলল, স্বর্ণমণি বোধহয় আর বাঁচবে না রে!


খানিক পরেই ফোন করল মিঠুকে। তার বন্ধু এত জোরে বাইক চালিয়ে নিয়ে গেছে যে, পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই কসবা থেকে বারুইপুরে পৌঁছে গেছে।

সৌম্য জিজ্ঞেস করল, স্বর্ণমণি এখন কেমন আছে? মিঠু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নেই।

সৌম্য এই ভয়টাই পাচ্ছিল। ও যে কেন প্রথমেই ডাক্তারকে বলল না বাঁদর কামড়েছে, তা হলে তো ঠিকঠাক ইঞ্জেকশনটা পড়ত। এ ভাবে অঘোরে প্রাণ দিতে হত না। এই দুঃসংবাদ ও কাউকে বলবে কী করে! কিন্তু এ সংবাদ তো চেপে রাখারও নয়। জানাজানি হবেই। তাই মেজদিকে ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মেজদি, স্বর্ণ আর নেই রে...

--- কী বলছিস? আঁতকে উঠল মেজদি।


ফোন করল বড়দিকে। বড়দি স্তম্ভিত। সে কী রে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। এই তো শেতলা পুজোর সময় যখন বারুইপুর থেকে আসছি, জোর করে একগাদা গোটা ফল আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে দিল। বলল, নিয়া যান। পরে খাইতে পারবেন। এখানে তো খাওনের লোক নাই। পইরা থাইকা থাইকা নষ্ট হইব। তুই কখন খবর পেলি?

--- এই তো একটু আগে। মিঠু বলল।

--- আমি ভাবতে পারছি না রে, মেয়েটার কী হল!আমার হাত-পা কেমন কাঁপছে। এ কী খবর শোনালি তুই...


ফোন করল ছোটবোনকে। সে বলল, আমাদের তো ওখানে যাওয়া দরকার। কী করে যাই বল তো! বডি কি বাড়িতেই আছে, না হাসপাতালে?

--- আমি এখনও ঠিক পুরোটা জানি না।

--- না, ওখানে তো মাধুকাকা ছাড়া কেউ নেই। সবাই তো এ দিকেই থাকে। সবাই মিলে দল বেঁধে যেতে গেলে কখন গিয়ে পৌঁছব কোনও ঠিক নেই। এতটা পথ... যেতেও তো সময় লাগবে। তার চেয়ে বরং ওর বডিটা যদি এখানে আনা যায়, দ্যাখ না... তা হলে শেষ চোখের দেখাটা একবার দেখতে পাই।


বারুইপুরে দাহ করার জায়গা বলতে ওই একটাই। জোড়া মন্দির। তা হলে কি ও মাধুকাকাকে ফোন করে একবার বলবে, আমাদের ফ্যামিলির যারা মারা যায় তাদের সবাইকে তো কেওড়াতলাতেই দাহ করা হয়, ও তো আমাদের পরিবারেরই একজন। ওকে এখানে দাহ করলে হয় না?

কিন্তু না, বেশ কয়েক বার ফোন করেও মাধুকাকাকে না পেয়ে ও সোজা রওনা হয়ে গিয়েছিল বারুইপুরে। যে তাদের জন্য সারাটা জীবন দিয়েছে, শেষকৃত্যে তার পাশে না থাকলে হয়! লোকে কী বলবে!


বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখতেই সৌম্য বুঝতে পাড়ল, স্বর্ণমণিকে কত লোক ভালবাসত।

বাড়ির উঠোন জুড়ে এদিকে-সেদিকে জটলা। ওকে দেখেই সবাই সরে গিয়ে জায়গা ছেড়ে দিল।

ও ঘরে ঢুকেই একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দেখল, মাধুকাকা খাটের উপরে বসে আছেন। আর তার ঠিক উলটো দিকের সোফায় স্বর্ণমণি। ওকে দেখেই স্বর্ণ বলল, আপনে?

--- তুই?

--- এই তো ডাক্তার দেখাইয়া আইলাম।

--- ডাক্তার দেখিয়ে! বলেই, ওর মনে পড়ে গেল মিঠুই তো তাকে বলেছিল, ও নেই। তার মানে? তাই সৌম্য জিজ্ঞেস করল, মিঠু কোথায়?

মাধুকাকা বললেন, এই তো ছিল, এখানে তো টাওয়ার পাওয়া যায় না... ফোন করার জন্য মনে হয় বাইরে গেছে, দ্যাখ না... উঠোনে গিয়ে দ্যাখ, ওখানে আছে মনে হয়।

মাধুকাকা এই ভাবে কখনও ওর সঙ্গে কথা বলে না। তার মানে স্বর্ণমণিকে নিয়ে উনি খুব টেনশনে ছিলেন। সেই রেশ এখনও কাটেনি। তার ওপর কে যে রটিয়েছে, ও মারা গেছে... সেই নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে আছেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে সৌম্য দেখল, উঠোনের ও দিকে পায়চারি করতে করতে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে মিঠু। ও সঙ্গে সঙ্গে মিঠুর কাছে গিয়ে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল, তুই আমাকে কী বলেছিলি?

জেঠুর কথা বলার এই টোন সে চেনে। তাই ফোনের ও প্রান্তে যে আছে তাকে বলল, এই, একটু পরে ফোন করছি... বলেই লাইনটা কেটে দিয়ে জেঠুকে বলল, কী বলেছি?

--- তুই যে বললি স্বর্ণমণি নেই!

--- ছিল না তো... ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। আমি এসে দেখলাম নেই। তাই তুমি জিজ্ঞেস করতেই বললাম, নেই। কেন, কী হয়েছে?

--- ও তো ঠিকই আছে দেখছি।

--- হ্যাঁ, ডাক্তার দেখিয়ে এল তো...

--- না, মাধুকাকা যে মেজদিকে বলল, ওর শরীর বেঁকে গেছে!

--- তাই নাকি? বেঁকে গেছে বলেছে? তা হলে যাও দাদুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ঘরে আছে তো।

সৌম্যরও মনে হল এটা জিজ্ঞেস করা দরকার। তাই ঘরে গিয়ে মাধুকাকাকে ও জিজ্ঞেস করল, আপনি মেজদিকে ফোন করে বলেছিলেন ও বেঁকে গেছে... কোথায়? ও তো দিব্যি আছে।

--- বেঁকে গেছে? কে বলল? আমি তো ওকে বললাম পেকে গেছে। বাঁদরটা যেখানে কামড়েছিল সেই জায়গাটা পেকে গেছে।

তার মানে মেজদি 'পেকে'টাকে 'বেঁকে' শুনেছিল। আর বেঁকে গেছে শুনেই তার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই ধনুষ্টংকার হয়ে গেছে। আর ধনুষ্টংকার মানেই... তার ওপরে মিঠু যখন বলল নেই, তখন তার মনে হয়েছিল 'নেই' মানে, স্বর্ণ আর বেঁচে নেই। আর বেঁচে নেই ভেবেই, সে নিজেই সবাইকে ফোন করতে শুরু করেছিল।

সামান্য ভুল শোনা, আর সেই শোনার ত্তপরে ভিত্তি করে অনেক কিছু ভেবে নেওয়ার জন্যই এই বিপত্তি!

যাক বাবা, যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক, ও তো বেঁচে আছে, থুড়ি ভাল আছে, সেটাই অনেক। এ বার আবার তাকে একের পর এক ফোন করতে হবে। মেজদিকে, বড়দিকে এবং ছোটবোনকে। বলতে হবে। গুছিয়ে বলতে হবে। এমন ভাবে বলতে হবে, সেটা নিয়ে যাতে আর কোনও ভুল বোঝাবুঝি না হয়। কিন্তু কী বলবে সে! কী!


-----------------------------------


বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা - শাশ্বত বোস || Baishali parar protima ra - Saswata Bose || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা

     শাশ্বত বোস



মফস্বলের ঝিম ধরা বিকেলের চলন্তিকা রোদ, প্রিজম তর্জনীর বর্ণালী ছাড়িয়ে, রাহুরেখা বেয়ে তির্যক ভাবে আলো আঁধারির মায়াজাল বুনেছে পাড়াটায়| আদুর গায়ের ছায়া শরীর আর গলনাঙ্কে ফুটতে চাওয়া তেঁতুল বিচির আঠার রং, যেন কুলহারী বেদব্যাসের স্বমেহ পিন্ডদানের আবহে, খড় –মাটি-রোদ-বৃষ্টির গল্প বলে চলেছে নিরন্তর| গলিটার গা বেয়ে তখন উদলা কাঠামো, নিটোল স্তন আর উর্বীমুখি নিতম্বের সারি| এটা স্থানীয় “কুমোরপাড়া”| আশেপাশের প্রায় তিন চারটে ছোটোখাটো শহরের মাঝে, প্রান্তিক, ক্লেদাক্ত, কস্তুরীয়, ম্রিয়মান প্লবতার নামাবলী গায়ে জড়িয়ে, রক্তাভ ঈশানে, এখানে এক শ্রেণীর মনুষ্যসম জীব, খড়কুটো দিয়ে কাঠামো বাঁধে, সেই বৈরী নগ্নতার গায়ে মাটি চাপায়, বানায় “প্রতিমা”| শাড়ি-গহনা-ডাকের সাজের আড়ালে, নিজের শিল্পসত্তার ফ্যালাসিকে কবর দিয়ে, মূর্তি বিক্রির মৈত্রী চুক্তিতে সায় দিয়ে, দূরে দাঁড়িয়ে যন্ত্রনার সুরহারীর ছেঁড়া তারে, আগমনীর সুর তোলে, আর অনাড়ম্বর সম্যক দৃষ্টির স্থিতিস্থাপকতায় অনুভব করে, সেই প্রতিমার পৃথু দেহজুড়ে লেপন হতে চলেছে, নির্জিত প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনশ্বর অসিয়তনামা| আমাদের গল্পটা শুরু হয় এই পাড়াটারই কোনো এক মৃৎশিল্পীর গোলা থেকে| অশীতিপর ভূতবৈরল্য আকাশের শরীরের উপর দাঁড়িয়ে, স্বয়ম্বরী সন্তাপের মেটাফিজিক্যাল অঙ্ক কষে, ঠাকুর বানায় “মধু কুমোর”, প্রতিমার মুখ গড়ে, চোখ আঁকে নিজে হাতে| হতে পারে সেটা আগত আশ্বিনের আগের বর্ষার কোনো এক সর্বাশী বিকেল কিংবা ওই একই দিনের শুরুর বিবসন ভোরের কাল| সময়ের তফাৎ খোঁজা নিরর্থক| কারণ কাহিনীটার শুরু কিংবা শেষ, আবাহন কিংবা বিসর্জন, যাবতীয় গল্পগুলো সবই আবহমান|


“এবারে ওই দাঁবাল পার্টি এখনও এলুনি, মধুদা? বরাত দেবেনি এইবার?” একতাল এঁটেল মাটিকে দুহাতে চটকাতে চটকাতে, নিজের বুনো চট ধরা চুলগুলোকে চোখের উপর থেকে সরিয়ে প্রশ্ন করে “হাঁদুল”|


মধু কুমোর কথাগুলোয় বিশেষ আমল করে না| তাঁর ধ্রুপদী হাত তখন অস্তিত্ব-শুণ্যবাদের পদাবলী রচনায় ব্যস্ত পিশাচসজ্জার এই ঈশ্বরনগরীতে|


আগের কথার উত্তর না পেয়ে হাঁদুল আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে, “ও পাড়ার মাটি কবে লিবে বলবেক, আগে থেকে| আমি একবারেই যাবক, সবাইলে লিয়ে এসে দিবোক|”


মধু হালকা সুরেলা গলায় ফিনফিনে পর্দায় উত্তর দেয় এবার, “লাগিবে নি|"


কথাটা শুনে চমকে ওঠে হেঁদো, “লাগিবে নি কি গো?”


মধু কুমোর আবার হাতের ছাঁচগুলোতে মাটি মাখাতে ব্যস্ত| সবে ঠাকুরের খড় বাঁধা হয়েছে এবার| অন্যবার এতদিনে একমেটে হয়ে যায়| এবার বয়সের প্যাঁচটা বেশ একটু বাগিয়েই ধরেছে তাকে|


মুখ তুলে, ঘাড়খানা বামেতর বেঁকিয়ে, হাঁদুল মধুর দিকে ফিরে, ঝাঁঝালো হয়ে ওঠে, “লাগবেনি কি গো? ভীমরতি ধরসে নাকি? ছিষ্টি ছাড়া হইলা নাকি বুড়ো!”| মধু কথাটা শুনে ঋষভ ভঙ্গিতে তাকায় হেঁদোর দিকে| তার অমিত্রাক্ষর চোখ দুটো, নির্বাক শূণ্যতায় তাকায় হেঁদোর খোলা পিঠে| সেই নিস্পলক দৃষ্টির দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে না থেকে, হেঁদো আবার নিজের কাজ করতে থাকে| রিক্ত, বস্তুবাদী বিরক্তিতে এবার সে বলে ওঠে “তোমায় যে কয়েছিলাম, আমার মজুরী বাড়াইতে, কি হইলো?” এই পহায় আমি আর কাজ করবুনি, পত্যেকে বাড়ায়েছে একেনে|”


প্রতিমা তৈরীর কাজে এক বিশেষ শ্রেণীর জোগাড়ের লোকের দরকার হয়, সৃষ্টির আদিকাল থেকেই| গঙ্গা থেকে কাঠামো তুলে আনে, স্থানীয় হিন্দুস্তানী পট্টির ছেলেপুলেরা| সেই অস্থিসার কশেরুকার উপর, মাটির প্রলেপ মাখানো চলে| একমেটের জন্য ক্ষেতের আঠালো এঁটেল মাটির জোগান দেওয়া থেকে শুরু করে, সেই মাটি তুশ দিয়ে মেখে, মৃৎশিল্পীর হাতের কাছে ধরা কিংবা এঁটেল আর বালি মাটি মিশিয়ে মুখের ছাঁচে ফেলে, মুখ বানিয়ে দেওয়া, দোঁমেটের জন্য গঙ্গা থেকে বালি মাটি তুলে আনা, দোমেটের পর প্রতিমার গা ফাটলে, এঁটেল মাটিকে জল দিয়ে গলিয়ে পাতলা করে, ন্যাকড়া দিয়ে সেই ফাটলের গায়ে মেরে দেওয়া, এঁটেল মাটিতে মেশানোর জন্য দা দিয়ে পাট কুচিয়ে দেওয়া, এসবই এপাড়ায় বেশ অনেকবছর ধরে একসাথে বেশ কিছু গোলায়, অনুমেয় গুলজারী ধারায় করে আসছে এই হাঁদুল| এই করেই ওর পেট চলে| সারা বছর এই কুমোরপট্টির বিভিন্ন ঘরে, ওর দিন কাটে| কাজের পরিবর্তে মজুরী আর দুবেলা খাওয়া, এই হল ওর রোজনামচার ঋণাত্মক সোপান| রাতে মধুর সাথে সস্তার মদ আর নিকোটিনে চুবোনো নির্কষ সন্তুষ্টি, কাব্যিক গূঢ়তার দিগম্বরী স্পর্ধায় হাঁদুল ভাবতে শুরু করে, সেও “শিল্পী”| 


এই গলিটার শেষে, যেখানে অন্ধকার চুঁইয়ে নামছে, পোড়ো বাড়ির গায়ের, নোনা ধরা দেওয়ালের খসে পরা পলেস্তারার মতো, সেইখানটাতে শর্বরীর শরীর হাতড়ে পাওয়া যায়, কিছু নির্বস্ত্র শরীর| অবাধ পৃথু দেহ জুড়ে যেন তন্দ্রাতুর অশ্লীলতার ছাপ, চোখগুলো জুড়ে অমোঘ নেশা, আর কিছু সবুজ হলুদ শাড়ি-চুমকি-অভ্র| এই গলিতে ভদ্র লোক যায় না| শুধু এই রাস্তার শেষে কসাইয়ের দোকান, আর সেই দোকানের মতো এই গলিতেও দরজায় দরজায় মাংস বিক্রি হয় অবাধে| খদ্দের এসে হাত বাড়ায় বুক, পেটে, ঠোঁটে| দরদাম করে সবশেষে কিনে নিয়ে চলে যায়, এ ঘর থেকে ও ঘরে| পুরো খুললে পাঁচশো, আঁচল সরালে তিনশো, ঘন্টা প্রতি হরেক রকম রেট চলে এখানে| বলার অপেক্ষা রাখে না এটাই “বেশ্যা পাড়া”| পাশাপাশি দুটো পাড়া জুড়ে প্রতিমা আর পতিতা দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি| পাড়ার মোড়ের কালীমন্দিরটায়, অম্বুবাচিতে প্রতিমার মুখ ঢাকা হয়| পোয়াতি বর্ষার অবাধ ধারায় বেশ্যারাও রজঃস্বলা হয়| ভয়, লজ্জা আর প্রার্থনার ঐতিহাসিক সন্ত্রাস চলে এই কদিন| হেঁদো ও এই বেশ্যা পট্টির ফসল, তবু সেই প্রেষিত, কলুষ, ইমারতি জন্মস্রাবের স্মৃতিকে, নিজের একমাত্র পরিচয় না করে, বেশ্যা পাড়ার দালাল বৃত্তি ছেড়ে এই কুমোর পাড়ায় জোগাড়ের কাজ নিয়েছে হেঁদো| এই জন্যই হয়তো বৈবস্বত নগরে বোকা দের অনিবার্য্য জন্ম হয়, বুদ্ধি মত্তার ক্লীবতার স্বার্থে|


তবু হেঁদো দিনে একবার ছুতোনাতায় ঘুরে আসে ও পাড়া থেকে| পুরোনো আধভাঙা সব বাড়ি, অশুচি দেওয়াল ,বায়ুভুক উঠোন, যেন সারা শরীরে সেপ্টিসেমিক রক্ত আর কামব্যবসার ভেজা শীৎকারে ডুবে যাওয়া, অন্তঃসত্ত্বা অঘোরকামিনীর অনুসর্গ টেনে বাঁচতে চাওয়া, প্রসেনিয়ামের সজল এপিটোম| কোনটা একতলা, ব্রাত্যজনের দরজা ঠেলে, এঁটো উঠোনের আঁশটে গন্ধটা গায়ে মেখে, হয়তো বাঁ পাশে একটা লম্বচ্ছেদী সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়| ক্রাফ্টেড মেঘের গা থেকে চুঁইয়ে পরা নিমমাজনের এঁটো থুতুর মতো, মরা উপন্যাসিকের নালবেষ্টিত ঘরগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মৃত প্রিয়ম্বদার এরোটিক যৌনতার মহাকাব্য হয়ে| ঘরের এককোণে একটা তক্তপোষ, আরেক কোণে হয়ত একটা জল খাবার কুঁজো, সাথে উপুড় করা গ্লাস| ঘরের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে, পর্দা ঢাকা ঠাকুরের ছবি যেন লিপি ধর্মঘট টানে, পতিতার রোমান্টিক শ্রাবণী সঙ্গমে| এই ঘরেরই আরেক কোণে, নীরব চারুকলার সাক্ষী হয়ে ঝুলতে থাকা একটা মাদুর, পরকীয়ার তত্ত্ব বোনে| তার ঠিক পাশটাতেই, মেঝেতে ইট দিয়ে ঘেরা ছোট একটা জায়গার ভেতর, একটা নর্দমা, পাশে মগ আর বালতি| ওটাই গণিকার সঙ্গমের পর যোনিপথ সাফ করার জায়গা| বাড়িগুলোর সামনে মহাকাব্যিক দরজা কিংবা রোয়াকে শোভা পায় অপর্ণা, অর্চিতা, মৌসুমী, শোভনার দল| এইরকমই কোনো এক ঘরে জন্মেছিলো হেঁদো| আবঝা আবঝা এখনো মনে পড়ে তার| ঘরে লোক ঢুকিয়ে ওর মা ওকে বাইরে বার করে দিতো| ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ও শুনতে পেত মায়ের গোঙানি আর খদ্দেরের অবিরাম খিস্তিখেউড়| এক এক দিন অনেক রাতে ওকে কাছে টেনে নিতো ওর মা| আধো ঘুমের মাঝেও ও টের পেত ওর মায়ের নিঃশব্দ কান্নার উপস্থিতি| আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা পরিশ্রমী ঘাম, অভিশাপের চুমু ছুঁড়ে দিতো ওর কপালে| সময়ের স্রোতে বদ্ধ ডাস্টবিনে জমা প্লাস্টিক আর আবর্জনার মতো পচতে থাকে সে সব, হেঁদোর অন্তরালে| একদিন বাইরে থেকে খেলে ফিরে, হেঁদো দেখলো ওদের ঘরের সামনে অনেক ভিড়| ছোট্ট দু হাতে একে ওকে সরিয়ে, ঘরের ভেতর বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে, একটা সজোরে ঝটকা খেল হেঁদো| বিশাল চর্বির একটা থলি যেন ওকে চেপে ধরল সজোরে| গদার মতো দুটো হাত দিয়ে ওর ছোট্ট শরীরটা, নিজের পৃথুলা শরীরে চেপে ধরেছিলো “নমীমাসি”| হেঁদোর মা টা মরে গেলো, কোন কাস্টমার নাকি কাজ করার সময় বেশি চড়ে গিয়ে, গলা টিপে মেরে ফেলেছিলো ওর মাকে| তারপর থেকে নমীমাসির কাছেই থাকতো হেঁদো, পাড়ার মেয়েদের ফাইফরমাশ খাটতো| মাঝে মাঝে মাঝরাতে জোরালো হাসি কিংবা কান্নার শব্দে, ঘুম ভেঙে যেত ওর| তখন দেখতো ষণ্ডামার্কা একটা লোক, খদ্দের নিয়ে এসে ঢোকাচ্ছে অন্য মেয়েদের ঘরে| আগে এই লোকটাকে ও দেখেছিলো, ওর মায়ের ঘরে লোক নিয়ে আসতে| লোকটাকে আড়ালে খুব ভয় পেত হেঁদো| ওকে দেখলেই লোকটা যেন আরো ষণ্ডাপনা দেখাতো, চোখ পাকিয়ে তেড়ে আসতো মাঝে মাঝে,মারধরও করতো| একদিন আর থাকতে না পেরে, একটা আধলা তুলে লোকটাকে ছুঁড়ে মেরেছিল হেঁদো| পাশের ঘরের বিন্নি, হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে| মাথায় হাত বুলিয়ে, পাইরিয়ার ক্ষত চিহ্ন শোভিত দাঁত গুলোয় অষ্টকি হাসি তুলে বলে, "অমন করে না মানা, ওটা কে জানিস? তোর বাপ্"| তারপর থেকে একটা মনোক্রমী ভয়, মাথা থেকে নেমে, চোখ, নাক পেঁচিয়ে গলা টিপতে আসতো হেঁদোর| দেহজ পাপ, শুকিয়ে আসা আসঞ্জক আর ক্রমে বন্ধ হয়ে আসা নিঃশ্বাসের শ্রেণীবদ্ধ বিন্যাসে এক ঋণাত্মক উপলব্ধি জাগছিল তার ভেতর, এই অপার বিশ্বে সে অবাঞ্ছিত, তাঁকে কেউ চায় না| একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ও, আর ফেরেনি, গিয়ে জুটেছিল এ পাড়ার “মধু কুমোরে” র কাছে| বৌ, ছেলে মেয়ে নিয়ে মধুর তখন ভরা সংসার| সরকার থেকে পুরস্কারও জুটেছে তার শিল্পকর্মের জন্য| বড় বড় খবরের কাগজের লোক, তখন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে "মধুসূদন পাল শিল্পালয়" এর সামনে|


“মধু খুড়োটার কিছু ভীমরতি হইছেক, দুগ্গা ঠাকুর গড়তে মাগীবাড়ির মাটি লাগব নি?”, জৈবিকতার শ্রাবণী মেঘের জংঘা বেয়ে নেমে আসা, একটা ধ্রুপদী নৈরাশ্য গ্রাস করে হেঁদোকে| তবে বছর কয়েক আগে, নিজের স্ত্রীর অকালমৃত্যুর পর থেকে, সত্যিই বদলে গিয়েছে মধু| জীবনের সব উচ্ছাস কেড়ে নিয়েছে, পৈশাচিক সন্তাপের দহন| সে এখন কাঁপা কাঁপা হাতে ঠাকুর গড়ে না, যেন দার্শনিক অঙ্ক কষে লিখে রাখে দপ্তরী ঔপন্যাসিকার শেষটুকু| ছেলেটাকে আর্ট কলেজে পড়িয়েছিলো, অল্প বয়সে বাপের মদের নেশা গিলে খেয়েছে ছেলেটাকেও| সে এখন দুগ্গার বাঁ পাশে লক্ষ্মী আর ডান পাশে সরস্বতী গড়ে, পৃথিবীর অভিকর্ষকে অগ্রাহ্য করতে চায়| সত্যি পাগলামো আর খামখেয়ালিপনা এদের রক্তে|


তবু আজও, এই মাঝ বয়সে পৌঁছেও দিনে একবার না একবার ও পাড়া থেকে ঘুরে আসে হেঁদো| বয়ঃসন্ধির কোনো এক নান্দনিক বিকেলের, অস্থির মেঘের তছরূপী ছায়াপথ বেয়ে, প্রেম এসেছিলো ওর জীবনে| যদিও এ পাড়ায় প্রেম আসে না, খোলা পথে আসতে গিয়ে, কুলোটা দময়ন্তীদের লাল ব্লাউজের ফাঁকে খাঁড়া আপিনে অদুগ্ধতার আশ্লেষে ধাক্কা খেয়ে পালিয়ে যায় চোরাপথে| তবুও হেঁদোর এই মাধুর্য্যহীন, অমানুষের জীবনে, ভালো লাগা এসেছিলো, এই বেবশ্যা পাড়াতেই, নিয়মমাফিক দেহস্রাবের বীর্যে পোয়াতি হওয়া, শুঁয়োপোকার মতো|   


কদিন ধরেই হেঁদো এ পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছে, চার নম্বর বাড়ির দরজার সামনে একটা ফর্সা পানা নতুন মেয়ে, গায়ে ব্লাউজ আর সেমিজ চড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে| কিন্তু মেয়েটা আর চার পাঁচটা মেয়ের চাইতে কোথায় যেন আলাদা| ঋতিচূর্ণতার ত্রাসে নত সূর্য্যাস্তের মতো অসম্ভব শান্ত দুটো চোখ, এক ঢাল আলু থালু চুল, তাতে রঙিন ফিতে দেয় না, কিন্তু চুলে একটা অদ্ভুত জেল্লা আছে| মেয়েটার মুখটা কি অসম্ভব মায়াময়| এ মুখ হেঁদো আগে কোথাও দেখেছে, হয়তো মধুর গড়া লক্ষ্মীঠাকুরের মতনই মুখের গড়ন| তাই মেয়েটাকে হেঁদোর এতো চেনা লাগে| মেয়েটা একএকদিন এক এক রঙের ব্লাউজ আর সেমিজ পরে| এখনকার মেয়েগুলোর মত জিন্স আর টপ ও পরে না, আবার নিজে থেকে কাউকে ডাকেও না| রাস্তা দিয়ে লোক গেলে "এই যে হিরো শোনো, যাবে?” বলে সিটি মারে না| এমনকি পড়তি গতরের মাগীদের মত হাত ধরে টানাটানিও করে না, চুল্লুর পাউচটা কেটে মুখে পুরে, দরজার সামনের রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে সিগারেটে অঙ্গার আত্তীকরণের ধোঁয়া তুলে, জটলাও করে না| খদ্দের এসে সামনে দাঁড়ালে, চুপচাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে| হাতে করে টাকাটা এনে মাসির হাতে দিয়ে দেয়| পাড়াটাকে ভালো করেই চেনে হেঁদো, এই বাড়িটাতেই ওরা থাকতো| এদিকটা এখন অনেক বদলে গেছে, পুরোনো অনেক লাইন বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটও উঠেছে| এলাকায় যারা পোড় খাওয়া ক্রিমিনাল, পলিটিকাল লিডারদের ডান হাত, বাঁ হাত, বেনামে তারা ফ্ল্যাটগুলোকে কিনে ধান্দা চালাচ্ছে| তবু এই দরজাটা হেঁদোর ভীষণ চেনা, এই জায়গাটাতেই ওর মা দাঁড়াতো| হাঁ করে মেয়েটাকে দেখতে থাকে হেঁদো| এ দৃষ্টিতে কামরসের দেহি উপসর্গ নেই, বরং মেয়েটির এই অমলিন সুন্দর দেহাবয়ব, এই বৃষ্টিমেদুর অন্ধকারে, প্লেটোনিক উষ্ণতায়, হেঁদোর শরীরে এঁকে দিতে চায় সমাবেশী মনন-শূলানির পদাবলী| মেয়েটাও নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে হেঁদোকে| হঠাৎ বাঁ পাশে একটা ছোট্ট ধাক্কা খায় হেঁদো, সাথে হাতের চুরির ঠুনঠুন শব্দ শুনতে পায়| চোখ ফিরিয়ে সে দেখে, নধর শরীর দুলিয়ে, সারা গায়ে মূর্ছনার হিল্লোল তুলে, হেঁটে যায় পাড়ার ঝুম্পা বৌদি| ভদ্র কাপড়ের আঁচলটা আলতো করে গুটিয়ে কাঁধে জড়ো করা| ঠোঁটের কামিনীঘন কামুক লাল রং, চোখের উরোগামী উনুন আঁচ আর সুডৌল আপিনের সমকোণের আবেদন, হেঁদোর শরীর অববাহিকায় ঢেউ তোলে, ওর মনে অজ্ঞেয় কাম জাগে|


 


মিসেস দুলারী ব্যানার্জী, আসলে দুলারী পাসোয়ান, এ পাড়ায় সবাই চেনে ঝুম্পা বৌদি নামে| সেই কোন কালে বিহারি জুট মিলের লেবারের ঘর ছেড়ে, মেয়ে কোলে করে, জুটমিলেরই কেরানী “নিমুবাবু”র হাত ধরে, এ পাড়ার কোণের ঘরটাতে এসে উঠেছিল| তাঁর স্বামী পালিয়েছিলো এক ছিনালের সাথে| মরদবিহীন যুবতী শরীর, সাথে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের অভাব, সব থেকে বেশি দুলারীর উঠতি যৌবনের অতলস্পর্শী কস্তুরী, উন্নিদ্র পৃথিবীর যে কোনো পিপাসী পুরুষমন, হয়তো নিমেষে এই নষ্ট শরীরী গুহ্যতায় মজে যেতে বাধ্য|


বিগত যৌবনা বারবনিতার মতো পাংশু, পলেস্তরা খসা, লাইনবাড়িগুলোর কোণের একটা ঘরে, মা মেয়েতে থাকতো দুলারী| জুটমিল বন্ধ হওয়াতে নিমু বাবু, বাইরে সেলস এর চাকরি নিলেন| প্রথম দিকে, ন মাসে-ছ মাসে বাড়ি এলেও, ইদানিং এ বাড়িতে তাকে আর কেউ দেখতে পায় না| যদিও মাসের মাঝখানে, অনলাইনে দুলারীর একাউন্ট এ টাকা এসে যায় ঠিকই| হয়তো বা সে মৃত মাছের, আঁশ না ছাড়ানো, চৈতন্যবাদী টগরবোষ্টমী আর অক্ষৌহিনী নীল শৃগালের, কোমল স্বরযন্ত্রের সান্দ্র মেদুরতায় বোনা, নির্মোক এক প্রায়শ্চিত্তের আখ্যান| দুলারীর মেয়ে “পিউ”, ভালো নাম “অস্মিতা ব্যানার্জী”| নিমুবাবুর পদবীটাই মেয়ের স্কুল কলেজে ব্যবহার করেছে দুলারী, নরম তরুনাস্থি কিংবা অস্থিসন্ধি আড়াল করার জন্য, সাদা চামড়ার একটা পিতৃপরিচয় এর লোভে| বয়সের নরম সমানুপাত বেয়ে, যৌবন খেলা শুরু করেছে পিউ এর শরীর জুড়ে, ঠিক যেন যৌবনের দুলারী| অস্থিসার সেই লাইনবাড়ির, অর্ধেকের বেশিটাই আজ আর নেই, ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে| ছোট খুপরির মতো নিরক্ষীয় প্রকোষ্ঠগুলোর অধিকাংশটাই, বেনামে কিনে নিয়েছে পলিটিক্যাল পার্টির লিডার কিংবা তাঁদের চেলাচামুন্ডারা| সেগুলোতে এখন দিনে রাতে, দিব্যি শরীর ব্যবসা চলে| একটা ফ্ল্যাট ঝুম্পারাও পেয়েছে| সবটাই অবশ্য লোকাল M.L.A “টেঁপা দা” আর তার রাইট হ্যান্ড “মদনা”র কল্যাণে| ঝুম্পা বৌদিতে মজে না, এমন মরদ এখনও জন্মায়নি এই দেবীপুরে| পিউ এর এখন ক্লাস টুয়েলভ, কমার্স নিয়ে পড়ছে এখানকার মালতী হাইস্কুলে| সকাল বিকেল শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়ার পথে, তার শরীরটা হাঁ করে গেলে মোড়ের মাথার মদনারা| পিউ এর সেটা বেশ লাগে, সাধ হয় কিশোরী দেহের খোলস ছেড়ে আদিম, অসভ্য এক নারী হতে| মদনা দা যদি হাতটা ধরে, একবার ওর বাইকে তুলে নেয়, বেশ হয়| ওর সব বন্ধু, কল্পনা, মৌসুমী, স্বেতা, সোমা, সবাই তো মদনাদার সাথে খেপে খেপে ঘুরেছে|


এইজায়গাটাতে থাকতে আর মন চায় না ঝুম্পার| মেয়েটা বড় হচ্ছে, নতুন করে আবার ঘর পাততে ইচ্ছে হয় ওর| পিউ কে ছেড়ে ঝুম্পার হাত ধরবে না মদনা কিংবা কেউটে| হাজারহোক এরা এন্টি সোশ্যাল, এই বয়সে নতুন করে অনিশ্চিত জীবনের দগদগে পোড়া ঘা চায় না দুলারী| পিছনের জীবনের ঝলসানো কালবেলা, এখনও ওর স্মৃতিতে টাটকা| পিউকে একাউন্টেন্সি পড়াতে, একটা বছর চব্বিশের ছেলে আসে ওদের ফ্ল্যাটে| ফর্সা, সুন্দরপানা চেহারা, নাম “সুমন”| কয়েকদিন হলো ছেলেটা MBA পাস করে ক্যাম্পাসিংয়ে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে| সেদিন সন্ধ্যেবেলা পিউ বাড়ি ছিল না, হাতকাটা শিফন নাইটিটা পরে জলখাবার দিতে যাবার ছুতোয়, সুমনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল দুলারী| ঊষর কবিতায়, শব্দপোকার আখরে ফুঁটে থাকা, প্রান্তিক যতিচিহ্নের তীব্র আশ্লেষে, নিজের ঈষৎ চর্বিল শরীর, গতযৌবনা আপীন কিংবা মাংসল সুউচ্চ নিতম্ব, সমন্বয়ী বর্ষামঙ্গলে ভেজা দেহানলের উত্তাপটুকু, পুরো চেপে ধরেছিলো ওর গায়ে| হাইবারনেশনের পাঁচিল টপকে সুমনের শ্বাস প্রশ্বাস কি একটুও গভীর হয়নি? ফেনিল সাগরের জৈবিক নিয়মানুবর্তীতায় কি উদ্যাপিত হয়নি ওর পৌরুষ?


 


মধু কুমোর ঠাকুর গড়ে, একমেটে শেষ করে দোমেটে করার প্রস্তুতি নেয়| ফাঁকে অসুর আর দেবীমুখ তৈরী করে পাশাপাশি নির্বাণি ছাঁচে, দপ্তরী হিসেবী আঙ্গুল চালায় প্রতিমার কটিদেশ, নিতম্ব কিংবা বক্ষদেশ জুড়ে| স্থূল থেকে স্থূলতর হয় দেবীকুলের বক্ষ বিভাজিকা, মধুর নিপুণ হাতের টানে| নাগাড়ে বালি মাটি আর এঁটেল মাটি মিশিয়ে চটকে দেয় হেঁদো| দুপুরে খেতে বসে, খাওয়ায় মন থাকে না মধুর| পোষা বেড়ালটা এসে, পাতে মুখ দেয়| পাতটুকু চেটেপুটে শেষ করে গিয়ে, শুয়ে পড়ে প্রতিমার কাঠামোর নীচে| মধুর মন পরে থাকে ঠাকুরে, এখনও কত কাজ বাকি! ঠাকুর গড়া, ঠিক জীবন গড়ার মতো| দুপুরে মনে হয় সামনের রাতটাই বুঝি শেষ| তারপর পোয়াতি যামিনীর জঠর চিরে, প্রত্যয়ী ভোর হয়| আবারও একটা দিনের শুরু| সিংহের কেশর, মহিষাসুরের পেশী, দেবীর স্তন, সব মিলেমিশে জমা হয় বৈতরণীর কূলে|


সেদিন সন্ধ্যে থেকে মদটা একটু বেশি খাচ্ছিলো মধু| হেঁদোটা বার বার বলছিলো, "আরে খেওনি মধুদা, রাত জাগতি হবেক, কাল তো মহালয়া, ঠাকুরের চোখ দেবেনি?” মধু কান দেয়নি ওসবে| ও জানে শুধু আজকের রাতটা, ব্যস তার পরেই গভীর ঘুমের ঘোরে, শস্যের মঞ্জুরি বেয়ে ঢুকে পরবে, আবেগ পোকার ডানা| আর কোনো নির্জিত যন্ত্রনা কিংবা পাতাবাহার পারবে না মধুর রাতের ঘুম ভাঙাতে| ভোর রাতে চোখ আঁকবে মধু, দেবীর ত্রিনয়ন, ঈষৎ অনল আভার সাথে কৌমুদী আবেশ মাখানো থাকবে সেই চোখে| মধু পাল রাষ্ট্রের সম্মান পেয়েছিল দেবীর চোখ এঁকে| সেই চোখ আবার আঁকতে হবে তাকে| আশাবরী রাগে খাম্বাজ মিশে যাবে| তারপর আহিরভৈরবীতে অনুষ্টুপ ছন্দে বিষণ্ণ ভোর, মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ এনে দেবে| টলতে টলতে, নিজের গোলায় ঢুকে যায় মধু| বাইরের চৌকিতে আজ আধজাগা থাকবে হেঁদো| হাতের তুলিটা রঙের তুবড়িতে ডুবিয়ে গভীর শ্বাস নেয় মধু| এবার সেই অমৃতক্ষণের প্রতিক্ষা| আজ বিকেল থেকেই লাইনের ওপারের মুসলমান পাড়ায় ঝামেলা বেঁধেছে| দফায় দফায় লোকাল থানা থেকে ভ্যান দৌড়োচ্ছে সেদিকে| রাত বাড়লে গন্ডগোল বাড়তে পারে| অমাবস্যার গুমোট অন্ধকারে, বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নরম আলোয়, বৃষ্টি ভেজা আধপোড়া রাস্তার ম্যানহোলে, দৌর্মনস্যতার জালবুনে নিঃসাড় গলনাঙ্কে, সাবধানী কান পাতে হেঁদো| মাথার কাছে রেডিওটা আঁকড়ে নেয়| আর কিছুক্ষন, মধু ঠাকুরের চোখ দেবে মহালয়ার ভোরে| মৃদঙ্গ ভৈরবী রাগে, উদাত্ত কণ্ঠে চন্ডীপাঠের আবহে, পাড়াটার অসাড় দেহে জেগে উঠবে, অনুচিন্তক মননশীলতা|


 


খুব ভোরবেলা, চারমাত্রিক নির্লিপ্ত বাতাসে, ভগ্নাংকের পূর্ণজন্মে, ঘুম ভাঙে পাশাপাশি দুটো পাড়ার| দূরের একান্নবর্তী কোঠাগুলোর রংচটা দেওয়ালে, এসে ধাক্কা খায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের "নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমৌ নমঃ", সাথে ত্রিদিবি সংলাপে, কারুবাসনার ছবি আঁকে, ইসলামী অনিন্দ্য আজান| রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে, দিনের শুরুয়াতি পাখির আলাপে| কুমারপাড়ায় মধু কুমোরের গোলার সামনে, ভিড়টা জমাট বাঁধে| বাইরের খাটিয়ায় তখন গোলাপের জীবাশ্মের মতো পরে আছে হেঁদোর থ্যাঁতলানো দেহটা| প্রচন্ড আক্রোশে গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ বসিয়েছে যেন কারা! গোলার দরজাটা সজোরে ভেঙে দিয়ে গেছে কেউ| ভিতরের প্রায় সম্পূর্ণতার কোঠায় পৌঁছানো মূর্তিগুলো, আসুরিক উন্মাদনায় দুরমুশ করেছে| পাশবিক যৌন উল্লাসে, প্রতিমার পরণের কাপড় করেছে ছিন্নভিন্ন| বিবস্ত্র, বিকৃত মুখ মূর্তিগুলো যেন নির্লিপ্ত দেহভৃত অবয়ব, ভগ্ন বাহুদ্বয় সম্মুখে বিস্তৃত করে, নিজেদের বিপন্নতার কথা ব্যক্ত করে চলেছে নিরন্তর| একটু দূরে মাটিতে উপুড় হয়ে পরে রয়েছে মধুর নিথর দেহ| মাথার পিছনে গভীর আঘাতের চিহ্ন| প্লাজমিক শোণিতধারা ক্ষীণ রাস্তা বেয়ে, গিয়ে মিশেছে দূরে উল্টানো রঙের বাটিতে, যেন রক্ত আর রঙের অব্যয় হোলিখেলা| ঠিক পাশটাতে পরে আছে, একটি দেবীমূর্তির খন্ড মস্তক দেশ| দেখে বোঝা যায়, কাল সারারাত ধরে এই নির্দিষ্ট মূর্তিটির মুখাবয়ব, রঙের পরতে, নিপুণ তুলির চক্ষুদানে, পরিপূর্ণ করেছে মধু| তার ঠিক পাশটাতে পড়ে রয়েছে, একটি অষ্টাদশী কিশোরীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি| হয়তো বা শিল্পী মনের, নৈসর্গিক সংবেদ আর কুদরতী অতীন্দ্রিয় প্রবৃদ্ধতায়, একেই ফুটিয়ে তুলছিল মধু| গোলার সামনে জটলা থেকে কেউ আর ভিতরে ঢোকার সাহস করে না| শুধু ভেসে আসে ফিসফাস শব্দ "ওই ও পাড়ার মালগুলারই কীর্তি, ক্ষারটো এইভাবে মিটাইলেক! আশেপাশের গোলাগুলার দরজা গুলান খুলতে পারেকলাই, মধুদার গোলার দরজাটো দরমা বেড়ার, কতবার কয়েছিলুম সারাইতে, সারাইলেনি| এবার লাও|


-ওই ছবিটা কার গো? আহা কি সুন্দরপনা মুখখানা!


-আরে ওইটাই ত মধুদার সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা গো, ওর শোকেই তো মধুদার এমন পাগলপানা দশা!”


বেলা গাঢ় হতে একটা পুলিশভ্যান ঢোকে পাড়াটায়| তবে সকলের প্রত্যাশামতো, সেটা মধুর গোলার সামনে না থেমে, সোজা চলে যায় গলির শেষপ্রান্তে, ৪ নম্বর লাইনবাড়িতে| বাড়ির সামনে তখন মেয়েদের ভিড়| স্থূল চর্বির বাতুলতায়, শরীরে দোল তুলে, পৃথুলা “মাসী” এগিয়ে এসে থানার আইসি কে নিয়ে যায় কোণের ঘরে| সে ঘরে তখন রক্তারক্তি কান্ড! কাল রাতে এ পাড়ার দালাল, “বিষ্টু”, দুটো ষণ্ডা মার্কা লোককে, জোর করে ঢুকিয়েছিল পাড়ার নতুন, সেই সুন্দর মুখের মেয়েটির ঘরে| মেয়েটি নরম গলায় আপত্তি করেছিল, কেউ শোনেনি| রাত বাড়লে লোকদুটো মদের ঘোরে চড়াও হয় মেয়েটির উপর, জোর করে যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করতে চায়| মেয়েটি সহ্য করে প্রথমে, এ লাইনে এটাই তো তাদের জৈবিক নিয়ম| এইরকম প্রতিরাতের শেষেই তো, প্রেমহীন অভাবী ভোরে তারা গান গেয়ে ওঠে, ঠিক যেন আলোর নীড়ে শিস দেওয়া হামিং বার্ড| কিন্তু কালরাতে অত্যাচার চরমে উঠেছিল, আঁচড়ানো কামড়ানোর সাথে চলে বিবস্ত্র করে মারধর| একটা লোক তো ধারালো ছুরি বার করে, মেয়েটার শরীরটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছিল| আর চুপ থাকেনি মেয়েটা, হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বসিয়ে দেয় একটার গলায়, অন্যটা দ্বিগুণ হিংস্রতায় এগিয়ে এলে সজোরে ছুরিটা বসিয়ে দেয় তার শিশ্নাগ্রে| ফিনকি দেওয়া রক্ত ছিটকে এসে লাগে মেয়েটির সীমন্তপথে| গ্রহণের জোয়ার ভাঁটায়, রোহিণী ভাদ্রপদদের বুক শুকিয়ে, কোমল বিটপীসম শরীরটায় যেন দৈবী রজঃসঞ্চার হয়|


লেডি কনস্টেবলরা, মেয়েটির দুহাতে হাতকড়া পরিয়ে, ধীরে ধীরে প্রিজন ভ্যানে তোলে| মেয়েটির মুখ জুড়ে, তখনও নির্বিকার মৃতবৎসা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে রয়েছে, শুকনো রক্তের দাগ| ভ্যানটা কুমোর পাড়া হয়ে, মধুর গোলার সামনে দিয়ে, মিলিয়ে যায় গলির শুরুর চোরাপথে|


ভিড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা, ঝুম্পা বৌদির দিকে, চোখ যায়নি কারও| আলুথালু চুল, গায়ে নাইটির উপর ওড়না জড়ানো চোখে, ভীত মাতৃত্বের স্বতঃপ্রবৃত্ত সন্তাপ| সকালে মেয়ে পিউয়ের ঘরে, টেবিলের উপর রাখা, চিঠিতে লেখা ছিল "মা আমরা চললাম, তুমি ভালো থেকো| আমি আর সুমন ভালো থাকবো, আমাদের খোঁজ করো না|"


বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালীর, চিকুরী শরীর জুড়ে তখন, অনসূয়া ঢাকের শব্দ|   







আল মাহমুদ - শংকর ব্রহ্ম || Aal mahamud - Sankarbrahama || প্রবন্ধ || Article || নিবন্ধ

আল মাহমুদ 


(আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি)


শংকর ব্রহ্ম




                         আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ই জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তাঁর দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা; যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন।


                          বাবা মীর আবদুর রব। মা রওশন আরা মীর। রব ও রওশন পরস্পর চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন। মীর আবদুর রব সংগীত-অনুরাগী ছিলেন। পিতামহ মীর আবদুল ওহাব ছিলেন কবি। জারি গান লিখতেন। আরবি-ফার্সি ভাষায় সুণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃত ভাষাও জানতেন। আবদুল ওহাব স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা ও কেরানির চাকরি করতেন।


                           ১৯৪২ সালে দাদি বেগম হাসিনা বানু মীরের কাছে বর্ণপাঠ দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। তাঁর কাছ থেকেই বিশাল বৈচিত্র্যময় আকাশের বিস্তার অবলোকনের প্রথম পাঠ গ্রহণ। ওই সময়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ধর্মীয় শিক্ষা। ১৯৪৩-৪৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম.ই স্কুলে ২য় থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ১৯৪৮ সালে ৬ষ্ঠ জর্জ হাইস্কুলে পড়েছেন ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত। ৮ম শ্রেণিতে পড়েছেন কুমিল্লার দাউদকান্দির জগতপুরে সাধনা হাইস্কুলে। তারপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।


                             ১৯৫৪ সালে কবি আল মাহমুদ দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৭-৬২ সালে তিনি ড্রেজার ডিভিশনে গেজ রিডার পদে এবং লাইফবয় সাবানের সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৬৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রুফ রিডার পদে যোগ দেন। পরে তাঁকে জুনিয়র সাব এডিটর এবং মফস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে ইত্তেফাক প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে আর্ট প্রেসে প্রকাশনা তদারকির কাজ করেন এবং চট্টগ্রামের প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা 'বইঘর'-এর প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে পুনরায় ইত্তেফাক চালু হলে তিনি সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইত্তেফাক কার্যালয় গুড়িয়ে দিলে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের জুনিয়র স্টাফ অফিসার পদে যোগ দেন। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাসদ-এর মুখপত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালের মার্চে কারাবরণ করেন। প্রায় এক বছর কারাভোগের পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালে মুক্তি পান। কারামুক্তির কয়েকদিন পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করেন। কারাবাসের সময়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পঠন-পাঠনের ফলে তাঁর চিন্তাজগতে পরিবর্তন ঘটে। নাস্তিকতার পথ থেকে আস্তিকতার দিকে ফিরে আসেন। ১৯৯৩ সালের ১০ই জুলাই তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ওই বছরই তিনি দৈনিক সংগ্রাম-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় প্রত্যাবর্তন করেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক কর্ণফুলি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।


                 আল মাহমুদের প্রথম প্রকাশিত রচনা ছিল একটি ছোটগল্প। তারপর ভাষা-আন্দোলন কমিটির একটি লিফলেটে ৪ পংক্তির কবিতা ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে তাঁর ১৮ বছর বয়স থেকে ঢাকা ও কলকাতার স্বনামধন্য পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ুখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়।


                           আল মাহমুদ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু।


আল মাহমুদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাকিস্তান-আন্দোলন, ভারত উপমহাদেশের বিভাজন এবং নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাষা-আন্দোলনের প্রবল প্রবাহের সময়ে শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করেছেন। নতুন দেশের জন্য অফুরন্ত আশা আর আশাভঙ্গের দারুণ হতাশার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। শৈশবে পারিবারিক ইসলামি ঐতিহ্যে লালিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাগরিক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আবহ, বিশেষ করে, লালমোহন পাঠাগার কেন্দ্রিক বামচিন্তাধারা ও বৈপ্লবিক চেতনা এবং জগতপুরের স্কুলজীবনে নির্মল প্রকৃতির প্রভাব তাঁর কল্পনা ভুবনে সৃজনশীলতার বীজ বপন করে। যৌবনের শুরুতে দেখেছেন স্বাধিকারের স্বপ্ন-ঘেরা এটি জাতির প্রস্তুতিকাল।


 আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাটের দশকেই কবি স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন।


                        সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে মাহমুদ ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র/পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলা পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।


                   ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন একজন। লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল), কালের কলস (১৯৬৬ সাল), সোনালী কাবিন (১৯৭৩সাল), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য গল্প ও উপন্যাসের জন্যও খ্যতি অর্জন করেছিলেন।


                   আল মাহমুদ ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪ সাল) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।


সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে সমাজতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে আস্থাশীল ছিলেন। ৪০ বছরের কাছাকাছি বয়সে তাঁর কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রকাশিত সরকারবিরোধী একমাত্র পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর সম্পাদক হন তিনি ।


                  ১৯৭১ সালে তিনি ভারত গমন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধের পরে দৈনিক গণকণ্ঠ নামক পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।


                  ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক পদ থেকে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।


                        ১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬ সাল), সোনালি কাবিন (১৯৭৩ সাল), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬ সাল) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল।


                           তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।


                        ১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম 'সোনালি কাবিন'। ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধ তার কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'কবি ও কোলাহল'। কোনও কোনও তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বাসগ্রস্ততার কারণে তার বেশকিছু কবিতা লোকায়তিক সাহিত্যদর্শন দৃষ্টান্তবাদ দ্বারা অগ্রহণযোগ্য। তবে একথাও সত্য, কবিতায় দর্শন থাকে, কিন্তু দর্শন দ্বারা কবিতা নিয়ন্ত্রিত নয়, কবিতা আবেগের কারবার। 


                     তিনি নিউমোনিয়া সহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ঢাকায় ধানমণ্ডির ইবনে সিনা হাসপাতা‌লে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। 



(তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ)



লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল), 


কালের কলস (১৯৬৬ সাল), 


সোনালী কাবিন (১৯৭৩ সাল), 


মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬ সাল), 


অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০ সাল), 


বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫ সাল), 


আরব্য রজনীর রাজহাঁস (১৯৮৭ সাল), 


প্রহরান্তে পাশফেরা (১৯৮৮ সাল), 


একচক্ষু হরিণ (১৯৮৯ সাল), 


মিথ্যাবাদী রাখাল, (১৯৯৩ সাল), 


আমি দূরগামী (১৯৯৪ সাল), 


হৃদয়পুর (১৯৯৫ সাল), 


দোয়েল ও দয়িতা, (১৯৯৬ সাল), 


দ্বিতীয় ভাঙন (২০০০ সাল), 


নদীর ভিতরে নদী (২০০১ সাল), 


উড়ালকাব্য (২০০৩ সাল), 


না কোনো শূন্যতা মানি না (২০০৪ সাল), 


বিরামপুরের যাত্রী (২০০৫ সাল), 


তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী (২০০৫ সাল), 


তুমিই তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল (২০০৭ সাল), 


সেলাই করা মুখ (২০০৮ সাল), 


পিপাসার বালুচরে (২০০৮ সাল), 


প্রেমপত্র পল্লবে (২০০৯ সাল), 


তোমার রক্তে তোমার গন্ধে (২০১১ সাল), 


পাখির কথায় পাখা মেললাম (২০১২ সাল),


তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫ সাল)


ইতিহাস দেখো বাঁক ঘুরে গেছে ফের ইতিহাসে (২০২০ সাল); 


মহাকাব্য'- এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না (২০২০ সাল); 


ত্রিশেরা


প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা


প্রেমের কবিতা সমগ্র


প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা


কবিতাসমগ্র


কবিতাসমগ্র-২


Selected Poems - Al Mahmud (১৯৮১ সাল)



(শিশু-কিশোর সাহিত্য [ছড়া/কবিতা])



পাখির কাছে ফুলের কাছে (১৯৮০ সাল), 


একটি পাখি লেজ ঝোলা (২০০০ সাল), মোল্লাবাড়ীর ছড়া (২০০৫ সাল), 


ফড়িং ধরার গল্প (২০১১ সাল), 


নেবু ফুলের গন্ধে (২০২০ সাল), 


আমার নামে ডাকছে পাখি (২০২০ সাল); 



(ছোটগল্প)



পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫ সাল), 


সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮২ সাল), গন্ধবণিক (১৯৮৮ সাল), 


ময়ূরীর মুখ (১৯৯৪ সাল), 


নদীর সতীন (২০০৪ সাল), 


ছোট-বড় (২০০৫ সাল), 


চারপাতার প্রেম (২০০৯ সাল), 


সপ্তর্ষী (২০১৪ সাল), 


জলবেশ্যা ও তাহারা (২০১৫ সাল), 


প্রিয় পঞ্চমী (২০১৬ সাল)


আল মাহমুদের গল্প


গল্পসমগ্র


প্রেমের গল্প



(উপন্যাস)



ডাহুক (১৯৯২ সাল), 


কাবিলের বোন (১৯৯৩ সাল), 


উপমহাদেশ (১৯৯৩ সাল), 


কবি ও কোলাহল (১৯৯৩ সাল), 


পুরুষ সুন্দর (১৯৯৪ সাল), 


নিশিন্দা নারী (১৯৯৫ সাল), 


আগুনের মেয়ে (১৯৯৫ সাল), 


যে পারো ভুলিয়ে দাও (১৯৯৫ সাল), 


পুত্র (২০০০ সাল), 


চেহারার চতুরঙ্গ (২০০১ সাল), 


কলঙ্কিনী জ্যোতির্বলয় (২০০৩ সাল), 


ধীরে খাও অজগরী (২০০৪ সাল), 


যে যুদ্ধে কেউ জেতেনি (২০০৬ সাল), 


তুহিন তামান্না উপাখ্যান (২০০৭ সাল), 


তুষের আগুন (২০০৮ সাল), 


জীবন যখন বাঁক ঘোরে (২০১৮ সাল), 


সহোদরা (২০২০ সাল), 


রাগিনী (২০২০ সাল)


কাবিলের বোন (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস)


উপন্যাস সমগ্র-১


উপন্যাস সমগ্র-২


উপন্যাস সমগ্র-৩



(কিশোর গল্প-উপন্যাস)



মরু মুষিকের উপত্যকা (১৯৯৫ সাল);


আরব্য রজনীর রাজহাঁস


বখতিয়ারের ঘোড়া


অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না


একটি পাখি লেজ ঝোলা


পাখির কাছে ফুলের কাছে


কিশোর সমগ্র


ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা)



 (আত্মজীবনী)



যেভাবে বেড়ে উঠি (১৯৯৭ সাল), 


বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ (২০০৭ সাল)


কবির আত্নবিশ্বাস



(প্রবন্ধ)



 দিনযাপন (১৯৯০ সাল), 


কবির আত্মবিশ্বাস (১৯৯১ সাল), 


নারী নিগ্রহ (১৯৯৭ সাল), 


কবিতার জন্য বহুদূর (১৯৯৭ সাল), 


কবিতার জন্য সাত সমুদ্র (১৯৯৯ সাল), 


কবির সৃজন বেদনা (২০০৫ সাল), 


সময়ের সাক্ষী (২০০৫ সাল), 


মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) (১৯৮৯ সাল), 


দশ দিগন্তে উড়াল (২০০৯ সাল), 


কবির কররেখা (২০০৯ সাল), 


বারো মাস তেরো পার্বন (২০০৮ সাল), 


কবির মুখ (২০১৫ সাল)



 (সম্পাদনা)



কাফেলা (১৯৫৫-৫৬ সাল), 


দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-৭৫ সাল), 


আহত কোকিল (১৯৭৭ সাল), 


শিল্পকলা (১৯৮০ সাল), 


আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা (১৯৮৩ সাল), 


দৈনিক কর্ণফুলী (১৯৯৫-২০০৪ সাল), 


সঙ্গীত সিরিজ-১ (গুল মোহাম্মদ খানা, কানাইলাল শীল, ফুলঝুরি খান), 


লোক লোকান্তর (১৯৬৩ সাল)



                           আল মাহমুদ ১৯৮০ সালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় কবিতা সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় নাগরিক ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া প্রায় ৭ দশক ধরে তিনি সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি বিষয়ক সভা-সমিতি-সেমিনারে নিয়মিতভাবে যোগদান করে বক্তৃতা ও মতামত প্রকাশ করে জাতীয় ভাবধারা ও অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন।


                            ১৯৭৮ সালে কবি আল মাহমুদ তৃতীয় বিশ্বগ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। আশির দশকে ভারতের ভূপালে এশীয় কবিতা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি একাধিকবার ভারতের দিল্লি এবং কলকাতার আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে ওল্ডহ্যাম সিটিতে একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৫ সালে PEN International-এর বাংলাদেশের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর রচনা ইংরেজি, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।



 (তাঁর পুরস্কার ও সম্মাননা)



 ১). 'বাংলা একাডেমি' পুরস্কার (১৯৬৮ সাল), 


২). 'জয়বাংলা সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৭২ সাল), ৩). 'হুমায়ুন কবির স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৭৪ সাল), ৪). 'জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৭৪ সাল), 


৫). 'সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য' স্বর্ণপদক (১৯৭৬ সাল), 


৬) 'বাংলাদেশ লেখক সংঘ' পুরস্কার (১৯৮০ সাল), 


৭). 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ' পুরস্কার (১৯৮১ সাল), 


৮). 'শিশু একাডেমি' (অগ্রণী ব্যাংক) পুরস্কার (১৯৮১ সাল), 


৯). 'আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৮৩ সাল), 


১০). 'অলক্ত সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৮৩ সাল), 


১১). 'কাফেলা সাহিত্য' পুরস্কার (কলকাতা, ১৯৮৪), 


১২). 'হুমায়ুন কাদির স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৮৪ সাল), 


১৩). 'একুশে পদক' (১৯৮৬ সাল), 


১৪). 'ফিলিপ্স সাহিত্য' পুরস্কার (১৯৮৭ সাল), ১৫). 'নাসিরউদ্দিন' স্বর্ণপদক (১৯৯০ সাল), 


১৬). 'ফররুখ স্মৃতি' পুরস্কার (১৯৯৫ সাল), 


১৭). 'মুক্তিযুদ্ধ পদক' (১৯৯৭ সাল), 


১৮). BJWA of America (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯৮ সাল), 


১৯). 'কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য' পুরস্কার (২০০২ সাল), 


২০). 'অগ্রদূত গুণীজন' পুরস্কার (২০০২ সাল), ২১). 'নতুনগতি সাহিত্য' পুরস্কার (কলকাতা, ২০০৩ সাল), 


২২). 'জাতীয় মঙ্গলপদক' (২০০৩ সাল), 


২৩). 'ঢাকা পোস্ট' স্বর্ণপদক (২০০৪ সাল), 


২৪)


 'শিশু একাডেমি' পুরস্কার (২০০৫ সাল) 


প্রভৃতি।



                           তাঁর সমালোচনা অনেকেই সমালোচনা করেন যে, আল মাহমুদ ১৯৯০’র দশকে ইসলামী ধর্মীয় বোধের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার কবিতায় ইসলামী চেতনার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। যদিও তিনি বিভিন্ন সময় তা অস্বীকার করেছেন।



(আল মাহমুদকে নিয়ে গবেষণা)



কবি খোরশেদ মুকুল আল মাহমুদকে নিয়ে লিখেছেন গবেষণামূলক গ্রন্থ 'দ্রোহের কবি আল মাহমুদ'।



কমরুদ্দিন আহমেদ প্রকাশ করেছেন গবে

ষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আল মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী’।



ড. ফজলুল হক তুহিন; আল মাহমুদের কবিতা : বিষয় ও শিল্পরূপ, মাওলা বাদ্রার্স , ঢাকা।



---------------------------------------------------------------------------------------------


[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত। সূত্র - অন্তর্জাল ]






কুমুদ কথায় অজয় - তন্ময় কবিরাজ || Kumud Kothay Ajay - Tanmay Kabiraj || প্রবন্ধ || Article || নিবন্ধ

 কুমুদ কথায় অজয়

        তন্ময় কবিরাজ



"ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বলো কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কি চলার শেষ ও নদীরে..."হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী গানের কথাই মনে এলো কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের সঙ্গে অজয় নদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। কারন কবি কুমুদ রঞ্জনের জীবনে মিশে গেছে অজয়ের স্রোত। রূপসী বাংলার মাধুর্য্য খুঁজতে গিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ পেয়েছিলেন গাঙ্গুর- বেহুলা, জীবন সংগ্রামের ইতিকথার জীবন্ত দলিল হয়ে রয়েছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা, বা কখনও তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কাছে নদী কেবল চলমান স্রোতের গতিধারা নয়,তিনি অজয়ের মধ্যেই গ্রামীণ জীবনের উঠানামার গল্প রচনা করেছেন। অজয় কবি কুমুদ রঞ্জনের সুখের কাব্যিক মেটাফরে সীমাবন্ধ থাকেনি, বরং পথচলতি জীবনের সাক্ষ্য বহন করা বন্ধু। তাই হাজার বিপত্তি কাটিয়ে তিনি বলেন,"অভয় মাগি মনের কথা বলতে পারি কি/উজানি আর অজয় আমার প্রাণের সামগ্রী।"কবিতায় আমার শব্দের অর্থ শুধু ব্যক্তি কবিই নন, বরং তার সঙ্গে জড়িত নদী তীরবর্তী জীবন। নদীর বাধা থাকলেও নদী মাত্রিক বাংলাদেশে নদীকে ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। আয়ারল্যান্ডের "রাইডার্স টু দ্যা সী" নাটকে মরিয়া নদীতে তাঁর সব সন্তানদের তিনি হারিয়েছেন, আবার নদীই তাঁর জীবিকার উৎস। নিয়তির এই দেওয়া নেওয়ার মধ্যেই এক স্বতন্ত্র জীবন বয়ে চলে যাকে যুক্তি বুদ্ধিতে সবসময় গ্রহণ করা অসম্ভব। কবি কুমুদ রঞ্জন তাঁর প্রিয় অজয়ের উদ্দেশ্যে লিখছেন,"অজয় আমার ভাঙবে গৃহ, হয়তো দুদিন বই/তবু তাহার প্রীতির বাঁধন টুটতে পারি কই?/সে তো কেবল নদ নহেক, নয়ক সে জল/সে তরল গীতগোবিন্দ চৈতন্যমঙ্গল।"অজয়ের বানের ভাঙন আসবেই। জীবনের দুর্দশার কাছে মানুষের কি করার আছে? নিয়তির কাছে সব সঁপে দিলেই সবাইকে ভালবাসা যায়। কারন কবি জানেন,এই অজয়ের তীরে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, আবার এই অজয়ের কৃপায় "বনকে করে শ্যামল এবং মনকে করে সমৃদ্ধি।"কবি অজয়ের তীরে যেমন গ্রাম্য জীবনকে উপভোগ করেছেন, তেমনই অজয়ের ধারে তিনি খুজেঁ বেড়িয়েছেন ইতিহাসের গলিপথ। অজয় যেনো কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের বারানসির গঙ্গা , যার তীরে কাশী বিশ্বনাথ থেকে মনিকর্নিকার চির আগুনে মিশে গেছে পুরাণের সঙ্গে বিশ্বাস যা আজও প্রবাহমান। অজয়ই হয়ে উঠেছে কবির কাব্য প্রেরণা, মঙ্গল বৈষ্ণব কাব্যের আঁতুড়ঘর।তিনি তাঁর "লোচনদাস" কবিতায় লিখেছিলেন,"অজয়ের তীরে রহিতেন কবি পর্ণকুটিরবাসী/লোষ্ট্র সমান দূরে কত ত্যক্ত বিভর রাশি।"শুধু অজয়কে ভালোবেসে তিনি তাঁর কবিতায় ছন্দে এনেছেন পরিবর্তন, উপমা হয়েছে সহজ সরল, আরোও শ্রুতিমধুর। বক্তব্যের বিষয়কে কবি একই রেখে দিয়েছেন, শুধু পরিবেশনে এনেছেন নতুনত্ব। তাই কুমুদ রঞ্জনের কবিতায় ক্লান্তি নেই। বরং নতুনের স্বাদে আরোও কিছুটা সময় অজয়ে ডুবে থাকা যায় অরূপ রতনের আশায়। "আমাদের সঙ্গী" কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"অজয়ের ভাঙনেতে করে বাড়ি ভঙ্গ/তবু নিতি নিতি হেরি নব নব রঙ্গ।"কবিতায় উঠে এসেছে কবির নিজের কথা। নদীর সঙ্গে লড়াই করার ইতি বৃত্তান্ত।' আমার বাড়ি "কবিতায় সেই কথাই প্রতিফলিত হয়েছে,"বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদীর বাঁকে/জল সেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।"আবার কখনও ভাঙনের গল্প ভুলে কবি হারিয়ে যায় হারান দিনের নস্টালজিয়াতে। অজয় নদের অ্যালবামে সযত্নে লালিত শৈশবের ফেলে আসা দিনলিপি। তাই "বকুল তরু "কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"পাঁচশো বছর হেতাই ছিল প্রাচীণ বকুলগাছ/অজয় নদের ভাঙনেতে পড়লে ভেঙ্গে যায়।"শৈশব যেমন অজয়কে দেখেছে, তেমনই অজয়ও আসতে আসতে মুছে দিচ্ছে ছেলেবেলার সব স্মৃতি।অভিমান যন্ত্রণার মধ্যে নদী বড়োই নীরব। দুজন দুজনের সমান্তরালে হেঁটে গেলেও কেউ কারো খবর রাখে না। তবু জীবন আর নদীর নিবিড় সম্পর্কের যে দর্শন রচিত হয় তার টানেই সভ্যতার ভীত গড়ে উঠে এই নদের তীরে।বড়ো বিচিত্র। বড়ো মোহময় নিজেকে জানা, নিজেকে চেনা।যাকে দেখে অভিমান বাসা বাঁধে, আবার তার জীর্ণ রুগ্ন অবস্থায় মন খারাপ করে।" শীতের অজয়' কবিতায় কবি সমব্যাথী হয়েছেন কারন শুকনো অজয়ের আজ জলধারা স্থিমিত। তাঁর কল্পনায় অজয় তো শিশু যার বিকাশে দরকার মায়ের স্নেহ ভালবাসার পরশ। অনাহারে জীর্ণ অজয়কে দেখে কবির হৃদয় আন্দোলিত হয় কারন অজয় তাঁর প্রানের প্রতিবেশী।কবি স্বার্থপর নয়।প্রতিবেশীর কষ্টে তাঁর মন কাঁদে।তিনি লেখেন,"সিকতায় লীন শীর্ণ সলিল ধারা/আজ জননীর স্নেহ হতে যেন হারা।"কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক মনে করেন,তিনি তাঁর ভাবনায় সুখী।তিনি তো কবি। আর চিন্তা মননের পথেই তো একজন কবি হেঁটে বেড়ান, আনন্দ উপভোগ করেন যা পরবর্তীকালে পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।" কবিতার সুখ "কবিতায় তাই কুমুদ রঞ্জন স্বীকার করেন,"কবিতা লিখিয়া পাইনি অর্থ, পাইনি নি কোনো খ্যাতি ভাই/হয়েছি স্বপ্ন বিলাসী অলস অনিযোগ দিবারাতি তাই।"কবি প্রাসঙ্গিক দ্বন্দ্ব বা বিষয়কে তুলেছেন - খ্যাতি বনাম সুখ।তিনি অর্থের মধ্যে জীবনকে দেখতে পাননি। নীরব বস্তুতে পরখ করেছেন প্রাণের স্পন্দন, যেখানে চলে হৃদয়ের দেওয়া নেওয়া। কবি কুমুদ রঞ্জনের সৃষ্টিতে রয়েছে সংশয়।তিনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর কবিতা পাঠযোগ্য। "কবিমানস" কবিতায় তিনি প্রশ্ন তোলেন,"বন্ধুরা কন আমার কবিতা কেহই পড়ে না শুনি/পড়িবার মত কি আছে তাহাতে কেন পড়িবেন শুনি।"টু বি আর নোট টু বি এর শ্বাশত দ্বন্দ্বের প্রতিমূর্তি তিনি।মনের ভেতরে অবিরাম কনফ্লিক্ট এর গতিতে সৃষ্টি হয় একের পর এক অনবদ্য সব কবিতা। থেমে যাওয়া নয়, প্রতিদিন জীবনকে শুধরে নিয়ে এগিয়ে যাবার কথাই বলতে ভালোবাসেন কবি কুমুদ রঞ্জন। কবি দেখেছেন, নদীকে ঘিরে রাজনীতি,সামাজিক শোষণ। বন্যার কবলে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান যখন শাসকের রাজধর্ম তখন সেই শাসকই তার প্রজাকে অনুগত ভৃতে পরিনত করে, যাতে সে তার মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। বারবার বন্যা হয়েছে। অতি বৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক। দরকার নদী সংস্কার।কবি বলছেন,"বন্যা হয়েছে হয়েছে এবং প্রতিকার নাই যবে।"বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা কবি তাই নিজেই বলে দিচ্ছেন,"ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে বন্যা ব্রিগেড গড়িতে হবে।"কারন কবি মনে করেন, গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামই সভ্যতার সোপান। শাসককে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।"পল্লী হতেছে অবাসযোগ্য রুক্ষ হে ভগবান/শহর বাঁচুক সঙ্গে তাহার পল্লীকে বাঁচাইও/.. রিলিফ আসিছে ভিক্ষা আলিছে কম্বল পিছু পিছু।"বন্যতে জীবন দুর্বিষহ, গৃহহীন, ভেসে গেছে বসতবাড়ি। "অজয়ের প্রতি" কবিতায় কবি প্রতিবাদ করেন তাঁর প্রিয় অজয়ের বিরূদ্ধে,"তোমার এ বারি নয় তো অজয় - এ বারি গরল ভরা/তোমার স্নেহের কনা নাই এতে এ শুধু বিষের ছড়া।"কবি বিশ্বাস করতে পারছেন না ভালবাসা এতো নির্মম।প্রেম যেমন গড়তে জানে তেমনই ভাঙতেও জানে। শূন্যতায় যে যাত্রার শুরু শূন্যতাতেই তার ইতি। দর্শন সরণে এ পদার্থবিদ্যা বড্ড জটিল অথচ মৌলিক। তাই আক্ষেপের মধ্যেও ত্যাগের বার্তা লুকিয়ে,"কতো বার বাড়ী ভাঙ্গিলে তুমি হে - গড়ি বা আমি কত/বিপদ যে তোমার দুর্দমনীয় - বড়োই অসংগত।"কবি কুমুদ রঞ্জনের কবিতায় তাই পল্লীজীবনের সাহিত্য ভাবনায় যেমন প্রাণের বাংলার প্রতি তাঁর স্নেহ ভালবাসাকে উজার করে দিয়েছেন আবার কখনও সমাজজীবনে তিনিই রচনা করেছেন ব্যঙ্গ কাব্য।রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যের স্বাদে ফিরে যান সাবেক বাংলার তুলসিমঞ্চ, সন্ধ্যা প্রদীপ,মঙ্গল শঙ্খর ইতিহাসে। তবে এতো কথা,এতো গল্পের আড়ালে বয়ে গেছে অজয়, এ যেন ব্রিটিশ কবি ওয়ার্দওয়ার্থের টেমসের রূপকথা। কবি কুমুদ রঞ্জনের আর অজয় সমার্থক। অজয়ের পাড়েই বসেই তার জেগে উঠে বাঙালি সত্তা। তিনি লেখেন,"আমরা বাঙালি হয়তো বা বটি দুষি/মোদের নিন্দাকে যার যত খুশী।"অজয়কেই তিনি তাঁর সব অব্যাক্ত ব্যাক্ত করেছেন। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কাছে অজয়ই সেই ক্ষুধিত পাষাণ বা জসীমউদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ যা আজও প্রবাহের স্রোতে কথা বলে যায়।




বিষয়: রূপসী বাংলার জসীমউদ্দীন


ভালবাসা অন্ধ? এ প্রশ্নের উত্তর কি হবে তা আমার জানা নেই। তবে গ্রামবাংলাকে ভালোবেসে কবি জসীমউদ্দীন যে আবেগ উজাড় করে দিয়েছেন তাতে তিনি সত্যিই অন্ধ।তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত গ্রাম্য জীবনের জটিলতা, আর্থ সামাজিক অস্থিরতা কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় নেই।তিনি রূপসী বাংলার কাছে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে। বাংলার প্রতি তাঁর ভালবাসাই প্রধান হয়ে উঠেছে। তাঁর বর্ণনায় আড়ালে উঁকি দিয়েছে কিছু সাময়িক অস্থিরতা। কখনও কবিতায় শোনা যায়, লালনের মত বৈরাগী জীবনের কথা।কবি বাংলার অলিগলি হেঁটে গেছেন শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করবেন বলে। "মুসাফির "কবিতায় কবি জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন,"চলে মুসাফির গাহি/এ জীবন ব্যাথা আছে শুধু, ব্যাথার দোসর নাহি/... হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেউ নাই শুনিবার।"কাব্যিক অলঙ্কারে আলিটারেশন,কখনও অ্যন্টিথেসিসে মিশে গেছে "আছে - নাহি"শব্দের রসায়ন,

প্রকট হয়েছে দর্শন - সমস্যাময় জীবনে সমাধান নেই, কথা আছে অথচ কথা বলার বা শোনার মত মানুষ নেই। সৌন্দর্যে ডুবে থাকা কবি জসীমউদ্দীনের এইরূপ হৃদয় যন্ত্রণা হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত। সৌন্দর্য বোধ কবির চিন্তনে ভাবনার জন্ম দেয়। ব্যক্তি জসীমউদ্দীন থেকে তিনি হয়ে উঠেন দার্শনিক যার স্বাদ তখন সর্বজনীন। বাংলার মেয়েদের তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন, বর্ণনা করেছেন সহজ ভাষায়। যৌনতার প্রলেপ নেই, রয়েছে তাকিয়ে থাকার আনন্দ।তিনি তাঁর সৃষ্টিতে পাঠকের মনে উত্তেজনার বীজ বপন করেননি, বরং ভালোবাসার সহজপাঠ রচনা করেছেন। ব্রিটিশ কবি ওয়াডসওয়ার্থ যেমন প্রকৃতিকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান লুসিতে বা নির্জন উপত্যকায় গান গাওয়া মেয়েটির মধ্যে, কবি জসীমউদ্দীনও মনে করতেন, বাংলার মেয়েরাই অপরূপ বাংলার মানবিক প্রতিমূর্তি। কল্যানী কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়াছ জোছনায়/রাঙা অনুরাগ ছরায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়।"অপূর্ব শব্দের বাহারি যুগলবন্দিতে কবি মেয়েদের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। কখনও তিনি বলেছেন,"পড়শীরা কয় মেয়ে তো নয়, হলদে পাখির ছা /ডানা পালিয়ে যেতে ছেড়ে তাদের গাঁ।"মেয়েদের বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি মনখোলা, নিখুঁত।"ও গাঁর মেয়ে আসছিল নূপুর পরা পায়ে।"কবি কোনো পাউডার বিউটির কথা বলেননি। বরং বিভূতিভূষনের ভানুমতির মত নারী মিশে গেছে প্রকৃতির চেনা সোহাগে,যার ভালোবাসো অমলিন।কবি লিখছেন,"লাল মোরগের পাখার মত উড়ে তাহার শাড়ি।"অন্যদিকে গ্রাম্য জীবনের বিবাদও ধরা দিয়েছে তাঁর লেখায় মাঝেমধ্যে।"এ গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও গাঁর লোকের সনে/কাইজা ফ্যাসাদে করেছে যা জানেই জনে জনে।"বাংলার মেঠো আলপথে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। চলার পথে যখন যা দেখেছেন তখন তাই সংগ্রহ করে রেখেছেন মনের গোপন ঘরে। কারন তারাই কবির নীরব সময়ের আশীর্বাদ, কাব্যিকতার রসদ। চেনা জীবনকে আরোও সহজ সরস করে তুলতে তিনি তাঁর ছন্দ বর্ণনার রীতি ভেঙেছেন।পারিবারিক জীবনের মধ্যেও দেখেছেন শামুকের পায়ের অপূর্ব আলপনা।কবি লিখেছিলেন,"আমার বাড়ি ডালিম গাছে/ডালিম ফুলের হাসি/কাজলা দীঘির কালো জলে/হাঁসগুলো যায় ভাসি।"প্রকৃতির অলঙ্কারে সেজেছে মানুষ। মানুষ আর প্রকৃতি সব দ্বন্দ্ব ভুলে আনন্দের সংহতি রচনা করেছে। কাজল জলে হাঁসগুলো যখন ভেসে তখন কবি নস্টালজিক। অনেকেরই আবার কবি ইয়েটসের দ্যা উইল্ড সোয়ান অ্যাট কুলি কবিতার কথা মনে যায়।কবি জসীমউদ্দীন তো জীবনানন্দের রূপসী বাংলার প্রতিবেশী। জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে জীবনানন্দ আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন, কবিতায় এসেছিল চলমান জীবনের সব কথা,কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতা রয়ে গেছে হারানো সুরেই, ফার ফ্রম দ্যা মাডিং ক্রাউড।তাই জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়লে গ্রের এলিজির মত আমরাও হতভাগ্য গ্রাম্য জীবনের প্রতি সমব্যাথী হয়ে যাই।বনলতা সেন যদি জীবনানন্দকে শান্তি দিয়ে থাকে, তবে বাংলার অপার্থিব সৌন্দর্য কবি জসীমউদ্দীনকেও সেই শান্তি উপহার দিয়েছিল। কবি জন কিটসের টু ওয়ান হু হাস বিন লং ইন সিটি পেন্ট কবিতার আবেগ এসে ধরা দেয় জসীমউদ্দীনের ভালোবাসায়। তাঁর "নিমন্ত্রণ"এ সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না।"তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোটো গাঁয়।"


বাংলার প্রতি জসীমউদ্দীনের ছিল অহংকার।তিনি লিখেছিলেন,"চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।"প্রাক ব্রিটিশ রোমান্টিক কবিদের মত তিনি প্রকৃতির মধ্যে জীবনকে বোঝার চেস্টা করেছেন। কখনও মিশে গেছেন,তো কখনও আবার স্বতন্ত্র জীবনের সন্ধানে অন্যভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছেন।"চৈত্র গেলো ভীষণ খরায়, বোশেখে রোদ ফাটে।"মৌলিক ভাষার বানান তিনি ব্যবহার করেছেন। পাশপাশি, প্রকৃতির খামখেয়ালী চরিত্রেও তিনি সজাগ।"এই এক গাঁও মধ্যে ধু ধূ মাঠ/ধান কাউর লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।"ইতিহাসের মুখবন্ধে লেখা থাকবে এ কথা কারন সভ্যতা তখনও গ্রামীণ জীবনে অগ্রসর হতে পারেনি। চারদিকে মাঠ মাঝখানে গ্রাম। প্রকৃতির উদার যাতায়াতে নেই আধুনিকতার অনুপ্রবেশ।কবি প্রকৃতির অনাবিল সুখকে বিলিয়ে দিয়েছেন চেনা জীবনের স্রোতে।তিনি লিখেছিলেন,"কচি ধানের তুলতে চারা হয়তো কোনো চাষী/মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।"সুখের চাহিদাতে প্রকৃতির হাতছানি।কবি বাংলার জীবন প্রকৃতির মধ্যে সুর খুঁজেছেন। গান তাঁর অন্যতম ভালো লাগা। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে জারি গান, মুর্শিদা গান।তিনি মানুষ হিসাবে প্রগতিশীল। অস্থির সময় তিনি দেখেছেন।তবু পল্লীবাংলাকে ভালবেসে সব ভুলে শান্তি পেয়েছেন। নজরুলের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন,রবীন্দ্রনাথের কাব্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা তো পল্লীজীবনের অ্যালবাম। নন্দলাল বসু বলেছিলেন, শিল্পবোধ তৈরি করতে হলে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আরোও নিবিড় করতে হবে, তেমনি পল্লীবাংলার ইতিহাসের খোঁজ নিতে হলে আগামীতে চলে আসতে হবে জসীমউদ্দীনের কবিতার মিউজিয়ামে। সাবেক বাংলাই তো তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়।