বন্ধুত্বের বন্ধনই সম্প্রীতির বীজমন্ত্র - সামসুজ জামান || Article || Essay || প্রবন্ধ || নিবন্ধ

 বন্ধুত্বের বন্ধনই সম্প্রীতির বীজমন্ত্র

    সামসুজ জামান


বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে দুকথা বলতে গিয়ে হলপ করে যে কথাটা বলতে চাই তা হল মানুষে মানুষে আজ বন্ধুত্বের বন্ধনের বড় প্রয়োজন। “বন্ধু বিনে প্রাণ বাচে না...”। কিন্তু তা কি সত্যি নাকি? দেখা যাক -- । 

একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করছি। আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই থাকে আরেকটি পরিবার, যাদের বাড়িতে আম গাছে আম ফলে রয়েছে। ইতিপূর্বে দু-তিনদিন গাছের আম দিয়েছিলেন তারই সূত্র ধরে গতকাল যখন আমার স্ত্রী কিছু কলা দিতে গিয়েছিল তখন ঐ পরিবার আঁতকে উঠলেন। - না না না, আপনাদের দেওয়া ফল তো আমরা নিতে পারবো না। - কারণ কি? আসলে বাড়িতে বয়স্ক শাশুড়ি আছেন, আপনাদের ছোঁয়া নিলেই উনি খুব অসন্তুষ্ট হবেন। জিজ্ঞাসা করা হল আপনাদের ছোঁয়া মানে? আমরা মুসলিম বলে? খুব অকপটে স্বীকার করলেন ওই পক্ষ - হ্যাঁ। তারপরেও আমাদের পক্ষ থেকে বলা হল- আরে, এ তো ঘরে রান্নাকরা কোন জিনিষপত্র নয়, বাজারের কেনা ফল। এতে আবার আপত্তির কী আছে? গিন্নীর মাথায় কিছুতেই ঢুকলনা এই সাদা-মাটা ব্যাপারটা- বলল আচ্ছা, সামান্য এই ব্যপার নিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব কেন নষ্ট হবে? কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। এতদসত্ত্বেও উনি তীব্র আপত্তি করে বললেন- কিছুতেই আপনাদের দেওয়া জিনিস ঘরে ঢোকানই চলবে না। প্রবন্ধের শুরুতে কী বলেছিলাম? এখন তো দেখি উলটপুরাণ – প্রাণ থাকলেও বন্ধু বাচে না!

 আমার এই অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনার পর কবি লেখক পরমবন্ধু রাজারহাটের শংকর কুমার ঘোষ বললেন- ‘আমাদের ছোটবেলায় মুসলিম বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া নিয়ে পাড়ার লোক আপত্তি করেছিল এবং বলেছিল এই ছেলেটার জাত গেছে। কিন্তু সেই ছবি তো আমি জানতাম বহু আগেই মুছে গেছে। এখনো এই ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়? এ তো ভারি লজ্জার কথা এবং ব্যাপারটা শুনে যদিও আমি হিন্দু হিসেবে খুব লজ্জিত বোধ করছি কিন্তু তাই বলে আপনার-আমার বন্ধুত্ব যেন প্রাণ থাকতেও কোনদিন নষ্ট না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখব দুজনেই’! বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমাদের অটুট বন্ধুত্বের মাধ্যমে সৃষ্ট অনাবিল সম্প্রীতির বাতাবরণ অনেকের কাছেই ঈর্ষার বিষয়।

বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকায় আমাদের আদি নিবাস। পারিবারিক প্রয়োজনে, যখন শহরে থাকার মনস্থির করেছিলাম তখন এয়ারপোর্টের সামনেই ফ্যাট নিয়েছিলাম। যদিও দু'বছর আগে যখন ফ্ল্যাটের সন্ধান করা হচ্ছিল তখনই একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একটা ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ পছন্দ হয়ে যাওয়ার পরও ফ্লাটের মালিক হঠাৎই আমার পরিচয় পেয়ে বলেছিলেন – ‘আপনাকে তো ফ্ল্যাট দেওয়া যাবে না’। আমি বললাম – ‘কারণটা জানতে পারি’? উনি জানিয়েছিলেন –‘অসুবিধা আর কিছুই নয়, আসলে আমাদের বাড়িতে গোপাল প্রতিষ্ঠা করা আছে। আর বাড়িতে বয়স্কা মা আছেন। সুতরাং কিছুতেই দেওয়া সম্ভব নয়’। এরপর আমি পকেট থেকে যখন মোবাইল বের করে দুর্গাপূজা বিষয়ক একটা স্বরচিত কবিতা শুনিয়েছিলাম তখন হঠাৎই মত বদল হয়েছিল ভদ্রলোকের। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও দুর্গাপুজোর বিষয়ে আমার ভক্তি ও জ্ঞানের (যদিও দ্বিতীয়টি আমার অত্যন্ত নগন্য বলেই আমি মনে করি) পরিচয় পেয়ে উনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সেই ফ্ল্যাট দিতে চেয়ে ছিলেন। যদিও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই আমাকে নিরস্ত্র করেছিলেন ‘কি জানি আগামীকাল হয়তো এইরকমই অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক কারণে মতবিরোধ সৃষ্টি হবে আর ওই ফ্ল্যাট আমার বসবাসের জন্যে অনুপযুক্ত হয়ে যাবে’ – ব’লে।

আমাদের সকলের মনে থাকার মতই কথা বছর কয়েক আগে সনু নিগমের মতো এক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ্যেই আপত্তি জানিয়েছিলেন যে মসজিদ থেকে দেওয়া আযান উনি কোনমতে শুনতে রাজি নন। ওনার সেই স্বাধীনতাটুকু আছে। সেই তিনিই স্বার্থের খাতিরে যখন মুসলিম দেশে ব্যক্তিগত স্বার্থে থেকেছেন তখন তাঁর উল্টো সুর। আমরা গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যেই রোগীদের জন্য হিন্দু মুসলিম আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করতে দেখে আশ্চর্য হয়েছি কিভাবে মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব নষ্ট করে এই মহান দেশটার ঐতিহ্য নষ্ট করার চক্রান্ত চলছে। এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কতটা ক্ষুদ্র মানসিকতার অধিকারী আমরা। আসলেই আমরা দিনে দিনে এত অসহিষ্ণুতার শিকার হয়ে যাচ্ছি যার কারণে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন টিকিয়ে রাখার ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখি না, আমরা ভেবে দেখি না মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, কিংবা পূজা-অর্চনার মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ অথবা কীর্তন এর আওয়াজ শুনে যদি অন্য ধর্মের মানুষ একই রকম ভাবে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন এবং আপত্তি জানান তাহলে অবস্থাটা কিরকম সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছাতে পারে!

বন্ধুত্বের সম্পর্কের সুতো আলগা হলেই জেঁকে বসবে সাম্প্রদায়িকতা। শুধু দেশে নয় বিদেশেও চর্চিত হচ্ছে ভারতে প্রচারিত এই নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি। এবং এটিই আমাদের কাছে একান্ত লজ্বার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে আমরা খুব সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এর পক্ষ থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে সুপারিশ সম্পর্কে জেনেছি ১৪ টি দেশের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে সেই দেশগুলিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির পরিবেশ তৈরি হয়ে মানুষে মানুষে স্বাভাবিক বন্ধুতার নুব্জদশা ঘনীভূত হয়েছে। এই দেশগুলো হল - ভারতবর্ষ, মায়ানমার, চীন, ইরিত্রিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, রাশিয়া, সিরিয়া, ভিয়েতনাম ও নাইজেরিয়া। এ বিষয়ে ভেবে দেখা অথবা কোন উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করা বিশ্বের সামগ্রিক স্বার্থেরই জন্যে খুব জরুরী যাতে বিশ্ব-বন্ধুত্বের আবহাওয়াটা অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ্য হতে পারে।

এক সংকটজনক মুহূর্তে কবি নজরুল রচনা করেছিলেন-“ হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার”। কিন্তু আজকের এই কঠিন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও সেই কথা আমাদের বারবার ভেবে দেখার সময় এসেছে নাকি? কবি নজরুলের সেই সন্দেহ, শঙ্কা এখনো একইভাবে বর্তমান থেকে যাবে এ তো ভারী আশ্চর্য কথা! আমরা পৃথিবীতে এত অগ্রবর্তী হয়েছি বলে আস্ফালন করি। বিজয় গর্বের এই আস্ফালন দেখে বারবারই লজ্জা হয় যে আসলে আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি? সম্প্রীতির বাণী ছড়াতে যাওয়া নজরুল হিন্দু মেয়েকে ঘরণী করেছিলেন কিন্তু তাঁকে এই ঘটনা কোনদিনই স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। মুসলিমরা তাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন কাফের হিসেবে। আর অনেক হিন্দুও তাকে কোনকালেই আপন করে নিতে পারেননি। এই যন্ত্রণা আর বঞ্চনার কাহিনী বন্ধুপ্রিয় নজরুল কে কুরে কুরে খেয়েছিল। 

 সুতরাং এই সম্প্রীতির বিরুদ্ধে আপস কোন ভাবে চলতে পারে না। করোনার সংকটজনক অবস্থায় সমস্ত বিশ্ব একাত্মতার বন্ধনে মিলেমিশে লড়াই করে দেখেছি আমরা কিছুটা অন্ততঃ রুখে দাঁড়াতে পারি ভেদাভেদ ভুলে সকলে একাত্ম হলে। কিন্তু সেই অবস্থায় যদি ধর্মের কারনে, রাজনীতির কারণে আমরা পারস্পরিক বিরোধ কে তীব্র করে তুলে ধরি, তাহলে সেই ইতিহাস যেমন লজ্জার একই সাথে সাথে জাতি ধ্বংসের জন্য, বিশ্ব ধ্বংশের জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষ কখনো মানুষকে এগিয়ে দিতে পারে না।

কোন অশুভ শক্তি বিভিন্ন কারণে মানুষকে বোকা বানানোর, ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেই যাবেন, কিন্তু আমরা সাদামাটা মানুষের দল সেই ধোঁকাতে বিপর্যস্ত হয়ে সম্প্রীতির এই বাণী প্রচারে কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবো? সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে সারা দেশ আমাদের পশ্চিমবঙ্গ বাসীদের উপর কৃতজ্ঞ হয়েছে এক বিশেষ দলের দুর্দান্ত জয়ের কারণে নয়, কৃতজ্ঞ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অটুট সম্প্রীতির কারণে, মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের কারণে। আশ্চর্য এটাই আমাদের বিশেষত্ব। হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান কোন মানুষই এখানে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সামান্যতম উস্কানিকেও মনের কোনেও ঠাঁই দেননি। এই মনোভাবকে একেবারে অন্তর থেকে প্রণাম জানাই আমরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা। 

আর সেখানেই এবার জোরাল প্রশ্ন – কেন তবে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়াছুঁয়ি বর্জন করে এখনো রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাগ্রস্থ হব? এখনও কি সময় আসেনি আমাদের সহানুভূতি নিয়ে সেই ভাবনাটা গুরুত্বপূর্ণভাবে ভেবে দেখার? গান-কবিতা আমরা শুনব আর পড়ব শুধু শোনা আর পড়ার জন্যেই? তার বাস্তব উপযোগিতা থাকবে না? আজকেও আমাদের মনে পড়বেনা সেই গান- “মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে।/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু”? আবার মনে পড়ছে কবি নজরুলের কথা – “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান / মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ”। কবির সেই অবিস্মরনীয় বাণী কি ব্যর্থ হয়ে মাথা কুটবে? আর মাত্র কিছু-দিন আগে অন্য লোকে পাড়ি দেওয়া প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষকে লোক দেখানি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁর কবিতার কথা – “ আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি”-র কোন মর্যাদাই থাকবে না আমাদের কাছে! তাই কখনও হয়? আমরা আশাবাদী। মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব অটুট থাকুক। আমরা সুদিনের অপেক্ষায়। একটা ফুটন্ত সকাল দেখব বলে আমরা উন্মুখ হয়ে আছি। 

         ------------------



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024