এরা কারা - বিশ্বনাথ দাস || Era Kara - Biswanath Das || পর্ব - ১০ || part - 10 || Era Kara part 10 || Novel - Era Kara || Era Kara by Biswanath Das || উপন্যাস - এরা কারা


 


।। চার।।


স্বরুপ বাবু কনিকাদের বাড়ীতে বিদায় নিয়ে আপন বাড়ীর উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কনিকার চোখ জলে ভরে গেল। কি আশা নিয়ে সে এসেছিলো। তার মুখখানি দেখে তার হৃদয় ফেটে যাচ্ছিল। নিদারুন ব্যাথায় নিজেকে কাইল করার মতো ক্ষমতা নেই। প্রেমের অঙ্কুর জন্ম নিতে শুরু করেছিল অচিরেই বিনাশ হলো। কনিকা ভাবতে পারেনি এই ধরনের ঘটনা তার কর্ন গোচর হবে। কোন উপন্যাস বা গল্পে কদাচিৎ কোনদিন এই ঘটনা চোখে পড়েনি। কিন্তু এ যে কতখানি বাস্তবতা তা বুঝতে পারলে,। কনিকার মনে উদয় হলো ঈশ্বর এই ধরনের ঘটনা ঘটালেন কেন? কেন ঈশ্বর তার প্রতি বিরুপ হলেন। কেন অমাবস্যায় ঘিরে এলো তার জীবনের পট ভূমিকা। আশালতাদির ট্রাজিডি জীবনের সাথে তার জীবন মিলে গেল। অবশ্য কনিকার অঙ্কুর বিনাশ আর আশালতাদির ভালোবাসার নাটকে তৃতীয় অংকে কুয়াসায় ফিরে গেল। আশাদি চিরন্তনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। দুটি হৃদয় যেন একই বাঁধা হয়েছিল। বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছিল এদের প্রেম চিরন্তর শ্বাশত, কেউ ছিন্ন করতে পারবে না। কিন্তু ওর জীবন হতে চিরন্তন যে কপূরের মতো উবে যাবে কোন কল্পনা করতে পারেনি। চিরন্তনকে অনেক জায়গায় শহর, নগর, গ্রাম গঞ্জের, হাসপাতাল নাসিংহোম ইত্যাদি প্রচুর খোঁজা খুজি করেছিল ওর বন্ধু বান্ধবরা কোন হদিস পায়নি। আশালতাদিকে শুধু হতাশ আমন্ত্রনে জর্জরিত করছে। মাঝে মাঝে আশাদি চোখের জলে ভাসতে থাকে। তবে আশাদি প্রতিজ্ঞা করেছে চিরন্তনকে খোঁজ করে বের করবেই।


হঠাৎ আশালতাদির মোবাইলে রিং হতেই তার চমক ভাঙ্গলো রিসিভ করলো- আমি আশালতাদি বলছি, কনিকা বললো-


বলো।


-কনিকা, স্বরুপ আজকে তোদের বাড়ী গিয়েছিল?


-হ্যাঁ


- ঠিক আছে তোর সাথে পরে কথা বললো। আজ রাত্রে তোদের বাড়ী যাবো। ঠিক আছে। তবে মনে রাখবি তোকে একটা মারাত্মক সারপ্রাইজ দেবো। এখন রাখছি, প্রয়োজনে ফোন করবি। আমি এখন আমার চেম্বারে আছি। একটা গুরুত্ব পূর্ণ পেসেন্ট দেখছি। কনিকা ওকে বিরক্ত করলো না।


বিনামূল্যে চিকিৎসা, আশালতার চেম্বার। আশালতা পারটাইমে এই চেম্বারে সময় কাটিয়ে দেয়। সে কাজের মধ্যে থাকতে ভালো বাসে বিশেষ করে ভুলে থাকতে চায় তার দুঃখকে।


বিকেল বেলা, সন্ধ্যে প্রায় আগত, মনে হয় আজ তার পেমেন্ট আসবে না। কারন চারিদিকে মেঘটা ঘন কালো আকারে জমাট হয়েছে। মনে হচ্ছে একটু পরে বৃষ্টি নামতে পারে। হঠাৎ এক মহিলা আশালতার পাদুটো ধরে বললো, আমাকে বাঁচান মিসটার। আশালতা ততক্ষনাৎ ওর হাত দুটো ধরে বললো এত উতলা হবেন না। আপনি স্থির হয়ে বসুন আমি আপনার কথা শুনবো। মহিলা বললো। চোখ মুখ ঘামে ভর্তি। নিজের কাপড়ের খুঁট দিয়ে মুছে বললো- আমার খুব বিপদ বলুন, কোথা থেকে আপনি আসছেন? মহিলা দ্বীর কন্ঠে বললেন - আমার নাম ময়না বারুই বাড়ী আমার চেতলাপুর। দামোদর নদীর পাড়ে। আমার খুব বিপদ।


আশালতা শান্ত স্বরে বললো, এবার বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি। ময়না নীরব থাকে। তার মুখ ফুটতে চাইছে না পুনরায় বললো আশালতা, কি হেলি মুখকে গাম আঁঠা চিটিয়ে রাখেেলন কেন? ময়না ধমক পেয়ে মৃদু স্বরে বললো-


-আমার মনে হচ্ছে আমি মা হতে চলেছি। আশালতা অবাক চোখে বললো,


- হোয়াট! একি বলছেন আপনি, আপনার তো বিধবার বেশ।


সে জন্য আমার আরো ভয়।


- আপনার এতো সাহস হলো কি করে?


- বিশ্বাস করুন আমি মোটেই রাজী ছিলাম না। আমার সাথে প্রতারনা করা হয়েছে। ডীও ম্যাশাই চায়। কা


-ঠিক আছে, আমার কাছে সেই প্রতারনার কথা বা ঘটনা প্রকাশ করুন। যদি আপনি নির্দোষী হন তাহলে আমি আপনাকে বাঁচাবই। ময়না দ্বিতীয় উক্তি না করে ততার ঘটনা ঘটে যাওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করলো।


দামোদর নদীর তীরে বিশাল মাথা উঁচু করে পরপর কয়েকটা চিমনি দাঁড়িয়ে আছে। ওর ভেতর দিয়ে গল গল করে গাঢ় আলকাতরার মতো কালো ধোঁয়া সর্বদাই বেরুচ্ছে। ঐ কারখানার বিশাল নাম। হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মস্থানের খ্যাতনামা জায়গা। কারখানার শ্রমিকরা, উচ্চপদস্থের, নিম্নপদের অফিসার ছাড়া ঠিকাদার কর্মী খুব সুখী। কারখানার মাইনেতে সুন্দর ভাবে তাদের দিন কেটে যায়। এই কারখানার ছয় নাম্বার মেসিনের হেড মিস্ত্রী হলো গজানন মোড়ল। নাম করা মিস্ত্রী। হঠাৎ তার কালাজ্বর হওয়াতে তাকে মৃত্যুবরন করতে হলো। কেউ ভাবতে পারেন নি গজানন মিস্ত্রীকে অকালে চলে যেতে হবে। কিন্তু বিধাতার লেখা কেউ খন্ডন করতে পারে না। একটি সাত বৎসরের সন্তান, চার বৎসরের কন্যাকে রেখে গেলেন। পত্নী ময়না ভাবতে পারে নি তাদের সকল কে অথৈই জলে ভাসিয়ে পর পারে রাস্তা ধরে নেবে। সংসার অভাবে ঘনিয়ে এলো। জমানো টাকা দিয়ে গজানন বাবু শ্রাদ্ধাদি কাজ সম্পন্ন হলো ঠিক কথা, কিন্তু অভাব ঘরের মধ্যে বাসা বাঁধলো। অনটন আর অনটন। প্রায় দিন ছেলে মেয়েদুটোর মুখে এক মুঠো অন্ন তুলে দিতে পারতো না। একদিন গজানন বাবুর ছেলে চয়ন ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পারুল মাসীর দোকান হতে পাউরুটি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। পারুল মাসী ওকে মারতে শুরু করে। সেই সময় ঐ দোকানে ঐ অঞ্চলের একজন নামী নেতা, হিড়িম্বর পরম বন্ধু অর্থাৎ এক ডালের দুটি ফুল তারা। অনেকেই প্রত্যক্ষদর্শী হিড়িম্ব হাজরার অনুগতির মিছিলে তিনি হাঁটেন। প্রতিটি পদক্ষেপ সীমা নির্ধারক ছিলেন। কারখানার ইউনিয়নের একজন সদস্য ছিল। পারুল মাসী কে ধমকে দিলো- কি করছো পারুল, একটা পাউরুটির জন্য ছেলেটাকে মারছো কেন? এই নাও তোমার পাউরুটির দাম। ঢল ঢলে পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে পারুল মাসীর হাতে দিল। পারুল মাসী ছোঁ মেরে পাঁচটাকার নোটটা হাতে নিয়ে দু টাকা কেটে ডমনা ঘোষের হাতে তিন টাকা ফেরত দিল। এখানে খেলা শেষ নয়। ডমনা, ছেলেটাকে বললো, চুরি করতে কে বলেছে? জানো এর ফল কি? তোমার নাম কি, তোমার বাড়ী কোথায়? ছেলেটি উত্তর দিল ওর নাম চয়ন, এই পাড়াতেই থাকে। ডমনা বললো- তাহলে চুরি করলে কেন? ছেলেটি বললো, - আজবধি দুদিন পেটে দানা পানি পড়ে নি, খুব খিদে পেয়েছিল তাই ঐ মাসীর কাছে একটা পাউরুটি চেয়েছিলাম। বলেছিলাম পরে পয়সা দোব। আমার কথা শুনলো না বলে চুরি করতে বাধ্য হলাম। ডমনা বললো,


তোমার বাবা কি করেন?


বাবা তিন মাস আগে মারা গেছেন, ঐ কারখানাতে কাজ করতো।


তোমার বাবার নাম কি?


গজানন মোড়ল।


-তুমি গজানন মোড়লের ছেলে! তুমি হয়তো জানোনা, তোমার বাবা আমাদের পাশের ডিপামেন্টে কাজ করতো। তোমার বাবা একজন নাম করা মিস্ত্রী ছিল। তোমাদের বাড়ীতে কে কে আছে? শয়তান, বলুন আর চরিত্রহীন বলুন কোন কিছুর গন্ধ পেতে চাইছেন গন্যমান্য ভদ্রলোক শ্রীমান ডমনা ঘোষ। এদের চরিত্র বিশ্লেষন করা যায় না। পাতার পর পাতা এদের চরিত্র এর ব্যাখা করা যায়। বাড়ীতে কেকে আছে বললে না। চয়ন নম্র কণ্ঠে বললো, মা, আমি আর আমার ছোট বোন দীপালি, ডমনা বললো,- চল তোমাদের বাড়ীতে যাই। তোমার মা কেমন আছে খবর নিয়ে আসি। ডমনা ওদের বাড়ীর দিকে রওনা হোক চয়নের সাথে। ডমনাবাবু হলেন সমাজ সেবক, উপকারী বন্ধু, দেখা যাক এই পরিবারে প্রবেশ করে তিনি কি উপকার টি করছেন। ডমনা কোনদিন গজানন মোড়লের বাড়ী আসে নি। তাই ময়না কে কোন দিন চোখে দেখে নি। ময়না একজন পূর্ন যুবতী মেয়ে। এক পলক দেখেই ওর ভেতরটা যেন শির শির করে উঠলো। মেয়েটার যেমন শরীরের বাঁধন, যেন পান পাতার মত মুখ, পটলচেরা চোখ, গায়ের রং দুধে আলতায় মিশ্রন। বিশেষ করে ঐ যে ঠোঁটের নীচে একটা কালো তিল ওটাতে তার মুখের ফেস একে বারে লাবন্যময়ী। যে কোন পুরুষের মন হরন হতে বেশী সেময় লাগবে না। ময়নার মুখ পানে কতক্ষন যে তাকিয়ে ছিল ডমনা তা জানে না, চয়নের ডাকে তার তন্দ্রা কেটে গিয়ে লজ্জায় পড়লো। চয়ন বললো- জেঠু চা খাবে? ভমনা বললো,


- না চয়ন আজ চা খাবো না। তোমাদের একটা হিল্লে না করা পর্যন্ত্য তোমাদের


বাড়ীতে কিছু খাবো না। চয়ন ওর মাকে বললো, মা জেঠু চা খাবে না। ময়নার পানে তাকিয়ে বললে, তুমি চয়নের মা?


- হ্যাঁ, আমি হতভাগী সেই মা, যে মা দুটো ছেলে মেয়ের মুখে এক মুঠো অন্ন তুলো দিতে পারে না। তাদের মুখপানে তাকাতে পারা যায় না। তবে আপনি কি ভমনদা? ডমনা ব্যাকুল স্বরে বললো,


- হ্যাঁ আমি ডমনাদা। গজানন ভালো মিস্ত্রি ছিলো। কিন্তু ঈশ্বর এতো তাড়াতাড়ি ওকে সংসার থেকে বিদায় করবেন কেউ ভাবতে পারিনি। তবে ময়না একটা কথা মনে রাখবে, মানুষ কখনো চিরস্থায়ী নয়, তবে অকালে চলে গেলে বুকে বড় আঘাত হানে। তবে ভয় পেওনা, আমি তো মার পাশে আছি, থাকবো। জানি না আমার নিয়ে গজাননের কাছে আমার বর্ননা শুনে থাকবে। তবুও বলছি আমি কারখানার একজন নামী নেতা। ময়না ওর কথাকে কেড়ে নিয়ে বললো, -আমি রাজুদার কাছে শুনেছি আপনার কথা। যদি কোন প্রকারে একটা যে কোন কাজ করে দিতেন তাহলে দুটো বাচ্চার মুখে কিছু আহারের ব্যবস্থা করতে পারতাম। আপনি কি একটা দুস্থ পরিবারকে মৃত্যুর কবল হতে বাঁচাতে পারেন না? একটা ঝঞ্ঝা বিদ্ধস্ত দরিদ্র পরিবারকে অন্ধকারাছন্ন হতে আলোতে আনতে পারবেন না। ওকথা শুনে ডমনার কুন্ড যেন ধীরে ধীরে উৎতপ্ত হতে থাকলো। এইতো সুযোগ ময়নাকে- না থাক এতো তাড়াতাড়ি করে মনকে উতলা করা উচিত হবে না। ধীরে ধীরে ময়নাকে নিজের করে নিতে হবে। ডমনা ঐসব নানা কেত্তনের কথা চিন্তা করে তেপান্তরের মাঠে হাজির হয়েছিলো। ময়নার ডাকে নিজের তন্দ্রাকে কাটিয়ে তুললো- আপনি কাজের ব্যাপারে চিন্তা করছেন?


- তুমি ঠিক কথা বলছো। তোমার এই দারিদ্র পরিবারটিকে আর্থিক অন্বেষণের কোন পথ খোলা নেই আমি বুঝতে পারছি। আমি আরো অনুভব করছি তুমি তোমার জীবনে পঙ্কিলতার আর্বতে ঘুর পাক খাচ্ছে। তুমি তো জানো ময়না এই বর্তমান যুগে মানুষ বড় জঘন্য হয়ে গেছে। সর্বত্র বিষাক্ত নিঃশ্বাস সমাজে রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে। সাবাস ডমনা ঘোষ সাবাস। এই সুন্দর ডাইলগ কি করে মুখ থেকে বের হলো এটাই আমাদের ভাবিয়ে তুললো। আচ্ছা দেখা যাক কত ভালো কাজ করছেন আমাদের ডমনা ঘোষ। তবে একটা কথা বলে রাখছি, ভূতের মুখে রাম নাম। ময়নাকে গভীর আশ্বাস দিয়ে বললো- তুমি চিন্তা করোনা ময়না আমি কথা দিচ্ছি কোন না কোন ব্যবস্থা করবই। এতো দিন পার্টী করছি তোমার একটা কাজ করতে পারবো না? আজ আর এখানে থাকার সময় হচ্ছে না। আমাকে ডিউটি যেতে হবে। এক কাজ করো, ভমনা ঘোষ কামিজের পকেট থেকে কড় কড়ে দশটার নোট কুড়িটা ময়নার হাতে দিয়ে বললো, - এই টাকা গুলো রাখ, তোমার ছেলে মেয়েদের মুখপানে তাকিয়ে দিলাম। ময়নাকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও নিতে হলো। ময়না জানে, এই ধুরন্ধর পৃথিবীতে এমন একটা মানুষ পাবেন না যে বিনা স্বার্থে মানুষের কাজ করে। ময়না কথাখানি মন্দ বলে নি। যুগ অনুপাতে কথাখানি যথেষ্ট সত্যতা আছে। ভমনা এক সময় বললো, তাহলে আজ বিদায় নি। পরে সময় সুযোগ পেলে আসবো। তবে যাবার সময় একটা কথা বলে যাই, বিপদে তোমার পাশে আছি। ডমনাবাবু প্রস্থান করলেন।'

_____________________________________


পর্ব - ৯ পড়তে -

click here 🔴

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024