ছোট গল্প - মর্যাদাহানি || লেখক - অমিত কুমার জানা || Short story - Marjadahani || Written by Amit kumar jana


 


মর্যাদাহানি

অমিত কুমার জানা 



সোমবার। প্রতিদিনের মতো আজও সৌভিক পৌনে দশটায় মেদিনীপুর স্টেশনে পুরুলিয়া-হাওড়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়লো। তিনি পাঁশকুড়ার একটা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।বিশেষ করে সোমবার অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ভিড় থাকে। সেপ্টেম্বর মাস,নদীকূল কাশ ফুলে ভরে উঠেছে। সৌভিক ছোট থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূজারী। সে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে জানালা দিয়ে নদীকূলের অপার সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করছিলেন। এতেও তাঁর মন ভরলো না। তিনি কাশফুলের সৌন্দর্যের ভিডিও রেকর্ডিং করতে লাগলেন। তিনি মোবাইলটা বুকপকেটে রেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে কিছুটা জলপান করলেন। ততক্ষণে ট্রেন খড়্গপুর ছাড়িয়ে বালিচকগামী হয়ে গেছে। 

ঠিক এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। টয়লেটের দিক থেকে বোরখা পরিহিতা এক মহিলা একজনকে চড় মারতে মারতে বলছেন, " মদ খেয়ে ট্রেনে চড়া অপরাধ আপনি জানেন না? এটা মাতলামি করার জায়গা?" সৌভিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ইনি তো রসুলপুরের একটা ব্যাঙ্কের কর্মী। রসুলপুর বালিচক এবং পাঁশকুড়ার মধ্যবর্তী স্টেশন। সৌভিকদের সাথে একই কম্পার্টমেন্টে মাঝে মধ্যেই উনার দেখা হয়। সৌভিক উনাকে 'স্যার' বলে ডাকলেন কিন্তু ততক্ষণে বেশ কয়েকজন অপরিচিত যাত্রী উক্ত ব্যাঙ্ক কর্মীর উপর চড়াও হয়েছেন। উনি চড় ঘুঁসি খেয়ে বেশ কুপোকাত হয়ে গেছেন। ট্রেন বালিচক স্টেশনে এসে থামলো। দুজন রেলপুলিশ ট্রেনে উঠে উনার সামনে গিয়ে বুঝতে পারলেন উনি মদ্য পান করেছেন। উনাকে তা জিজ্ঞেস করে রেলপুলিশ কোন সদুত্তর পেলেন না। কারণ মদের নেশায় এবং পাপলিকের প্রহারে তিনি একেবারে নাজেহাল। 

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো যে বোরখা পরিহিতা ঐ মহিলাকে ওখানে খুঁজে পাওয়া গেল না। আর তিনি রেলপুলিশের কাছে কোন অভিযোগ ও করেন নি। সৌভিক ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন ওভারব্রিজের ওপর হেঁটে যাচ্ছেন জনা তিনেক বোরখা পরিহিতা মহিলা। এই সময় ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে রসুলপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। ট্রেন রসুলপুরে থামলে ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে তাঁর দু একজন সহযাত্রী স্থানীয় চিকিৎসালয়ে ভর্তি করলেন। 


স্কুলে পোঁছে সৌভিক কিছুক্ষণ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এটেনডেন্স খাতাটা নিয়ে তিনি ক্সাসে যাচ্ছিলেন। দোতলায় ক্লাস নাইনের ভূগোলের ক্লাস । সৌভিক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রিসিভ করলেন। তারপর তাঁর নজরে এলো একটা ভিডিও। ট্রেনে আসার সময় ভিডিও রেকর্ডরটা চালু ছিল। তিনি ভিডিওটি দেখে অবাক হলেন। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ঐ বোরখা পরিহিতা মহিলা ইশারা করে ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে ডাকছেন। টয়লেটের সামনে যেতেই ঐ দুজনকে আর দেখা যায় নি। তারপর ঐ মহিলা চড় মারতে মারতে উনাকে টয়লেট থেকে বের করছেন। ভিডিওটা দেখে সৌভিকের কেমন যেন সন্দেহ হলো ঐ মহিলার উপর। মহিলাটি ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে টয়লেটের দিকে ডাকছিলেন কেন? আবার তিনিই বা উনাকে মারলেন কেন? ঐ ব্যক্তি কখন মদ্যপান করলেন? এইসব কথা ভাবছিলেন সৌভিক। এমন সময় তাঁর মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল সোজা গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে। তিনি নীচে নেমে এসে দেখলেন তাঁর মোবাইল ভেঙে একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। মনে মনে এটা ভেবে দুঃখিত হলেন যে তিনি ভিডিওটি রেল পুলিশকে দেখাতে পারলেন না। 


পরদিনের ঘটনা। সৌভিক প্রতিদিনের মতো একই সময়ে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়লেন। ট্রেন খড়্গপুর স্টেশনগামী। এমন সময় ভিড়ের মাঝে এক যুবতী একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে কষিয়ে চড় মারলেন। যুবতী চেঁচিয়ে বলছেন, " ভিড়ের মাঝে মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া! অসভ্য কোথাকার।" সৌভিক তাকিয়ে দেখলেন ইনি তো রসুলপুরের একটা হাইস্কুলের শিক্ষক। বেশ ভদ্রলোক। উনি জোর গলায় বললেন যে উনি ঐ যুবতীকে স্পর্শ ও করেন নি। তবুও উনার কথা কেউ গ্ৰাহ্য করলেন না। সৌভিক উনাকে চেনেন।উনি মনতোষ স্যার। তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ স্যারের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ভিড় সরিয়ে উনাকে সিটে বসালেন। 

মনতোষ স্যার সৌভিককে বললেন যে উনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। হয়তো অন্য কেউ অসভ্য লোক এই কাজটা করেছেন,যার ফল ভুগতে হলো উনাকে। 

ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে খড়্গপুর স্টৈশনে এসে থামলো।

এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবক সৌভিক এবং মনতোষের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে স্টেশনে নেমে পড়লেন। সৌভিক উনার কাছে যেতে উদ্যত হচ্ছিলেন, কিন্তু উনি দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সাথে সাথে খড়্গপুর থেকে ট্রেন ছেড়ে দিল। 


স্কুলে পৌঁছে সৌভিকের মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তার এটা মনে হল যে পরপর দুই দিনের এই দুর্ঘটনা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না যে এই ঘটনাগুলো কেন ঘটছে। 


পরের সপ্তাহের সোমবার এর ঘটনা। পাঁশকুড়ায় ট্রেন থেকে নেমে সৌভিক শুনতে পেলেন যে আজ অন্য একটা কম্পার্টমেন্টে একজন স্কুল শিক্ষক বোরখা পরিহিতা এক মহিলার দ্বারা প্রহৃত হয়েছেন। ওই স্কুল শিক্ষকের নাম সঞ্জয় বেরা।সঞ্জয় বেরা নামটা শুনে সৌভিক চমকে উঠলেন।

উনি বালিচক হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।


পরদিনের ঘটনাটা সৌভিককে আরো বিব্রত করে তুললো। গতকাল ট্রেনে সঞ্জয় বেরা নামক স্কুলশিক্ষককে একজন বোরখা পরিহিতা মহিলা মারধর করেছিলেন। সেই মারধরের ভিডিও আজ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে কয়েক শত লাইক কমেন্ট পড়েছে। সৌভিক দেখলেন ভিডিওটি লাইক করেছে তারই এক পুলিশ বন্ধু কোতোয়ালি থানার এস.আই সমরেশ তিওয়ারি। সৌভিক তৎক্ষণাৎ সমরেশ তিওয়ারিকে ফোন করলেন। তারপর তিনি পার্সোনালি সমরেশ তার সঙ্গে দেখা করলেন। দেখা করে তিনি উনাকে বললেন যে ট্রেনে পরপর দুটো সোমবারে যে দুটো দুর্ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে তিনি কিছু বলতে চান। তিনি বললেন যে তিনি ওই ব্যাংক কর্মী এবং সঞ্জয় বেরাকে ভালোভাবে চেনেন। ওই দুইজন অতি পরিচিত এবং ভীষণ ভদ্রলোক। আজ পর্যন্ত উনারা কোন মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন নি। শুধু তাই নয় উনার আজ পর্যন্ত মদ্যপান ও করেন নি। সম্ভবত এটা ঐ বোরখাধারী মহিলার কাজ, হয়তো উনি বিগত কোন ঘটনার বদলা নিয়েছেন এইভাবে।


এরপর সমরেশ তিওয়ারি সৌভিকের কথার গুরুত্ব অনুভব করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিলেন। যে এই ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তাকে উনি মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি তাকে বললেন, " আমি ইউটিউবের একটা চ্যানেল থেকে বলছি, ঐ ভিডিওটি থেকে আপনি অনেক টাকা রোজগার করতে পারবেন। আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।" 

সমরেশ মোবাইল নাম্বার পেয়ে গেলেন। তারপর ঐ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন যে উনার নাম সুতনু। সুতনু এই ভিডিওটি নিয়েছে তার মাসির ছেলের কাছ থেকে। তার মাসির ছেলের আপত্তি সত্ত্বেও গোপনে সুতনু এই ভিডিওটি নিয়ে নেয় এবং ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে। 


এরপর সমরেশ আইনি ভয় দেখিয়ে সুতনুকে তার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য করেন। সুতনু যখন জানতে পারে যে সমরেশ একজন পুলিশ অফিসার তখন সে সব কথা গড় গড় করে বলে ফেলে। সমরেশ সুতনু দেওয়া জবানবন্দি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং করে ফেলেন। 

সুতোর দেওয়া জবানবন্দিটা ছিল এইরকম:


আজ থেকে ছয়-সাত মাস আগে মার্চ মাসের ঘটনা। সুতনুর মাসি মেসোমশাই এবং তার মাসতুতো ভাই পুরুলিয়া -হাওড়া এক্সপ্রেসে হাওড়া যাচ্ছিলেন। সুতনু মাসির নাম কল্পনা নায়েক। তার মেসোমশাই ভরপুর মদ্যপান করে ট্রেনে চড়ে ছিলেন। তিনি এতটাই মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিলেন। 

সিটে বসে থাকা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি দুর্ব্যবহার শুরু করেছিলেন। একজন তরুণী তার ব্যবহারে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন। ওই কম্পার্টমেন্টে বসে থাকা অনেকেই নির্বাক দর্শক হয়ে সেই ঘটনা দেখছিলেন। সেই সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওই ব্যাংক কর্মী এবং সঞ্জয় বেরা নামক স্কুল টিচার এর তীব্র প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। ক্রমশ উনাদের সাথে সুতনুর মেসোমশাইয়ের প্রবল বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। তখন কেউ কেউ বলেন যে ঐ মাতালটাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিন। অসভ্য,অভদ্র কোথাকার! তা সত্ত্বেও ওর মেসোমশাই অভদ্রতা করেই যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ ব্যাঙ্ককর্মী এবং সঞ্জয় স্যার ওর মেসোমশাইয়ের কলার ধরে চড় লাগিয়ে দেন। এতে সুতনুর মাসিমাও সঞ্জয় স্যার এবং ব্যাঙ্ককর্মীকে চড় লাগিয়ে দেন। আসলে সুতনুর মেসোমশাই যতই খারাপ মানুষ হোক না কেন মাসিমা উনাকে খুব সম্মান করতেন, ভালবাসতেন। 

তারপর বালিচক স্টেশনে রেলপুলিশ সুতনুর মেসোমশাইকে কড়া ভাষায় গালিগালাজ করেন,কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে ছেড়ে দেন। তখনই সুতনুর মাসিমা প্রতিজ্ঞা করছিলেন যে যাদের জন্য তার পতির এতটা মর্যাদাহানি তাদের তিনি ছাড়বেন না। এর প্রতিশোধ তিনি নেবেন। 

এরপর সুতনুর মাসিমা বোরখা পরে নিজেকে আড়াল রেখে ব্যাগে জলের বোতলে মদ রেখে পুরুলিয়া-হাওয়া এক্সপ্রেসে উঠতেন। তারপর যেদিন সুযোগ এল সেদিন ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে টয়লেটে ডেকে বোতলের মদ উনার মুখে ঢেলে দিলেন। পরের সোমবার তিনি বোতলের মদ সঞ্জয় স্যারের গায়ে ঢেলে দিলেন। এইদিন তাঁর ছেলেও সেখানে উপস্থিত ছিল। যখন ভিড়ের মাঝে অনেকে সঞ্জয় স্যারের উপর চড়াও হলেন তখন উনার ছেলে সেই দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে ফেলে। সব ঠিক ছিল কিন্তু সুতনু মাসির বাড়ি গিয়েই ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে।


সব শুনে সমরেশ মহিলা পুলিশ নিয়ে চলে এলেন কল্পনা নায়েকের বাড়ি। কল্পনা নায়েককে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে গেলেন।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024