ছোট গল্প - অবশেষ সূর্যোদয় || লেখক - রানা জামান || Short story - Obosese Suryaudai || Written by Rana Zaman


 


অবশেষ সূর্যোদয়

রানা জামান




অপেক্ষার উত্তাপে আমন্ত্রিত অতিথিদের মেজাজ এখনো তপ্ত হয়নি তেমন। দুপুর দুটো বাজলেও বরপক্ষ এখনো আসেনি। পুরুষদের ক্ষিধেয় পেট চো চো করলেও উচ্ছল মেয়েদের দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। ওরা কণেকে ঘিরে ঠাট্টা-তামাশায় মজে আছে। হাসি তামাশায় ক্ষুধা এড়ানো গেলেও তৃষ্ণা এড়ানো যায় না; বরঞ্চ গলা শুকিয়ে যায়। দু'জন তরুণী নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পানি আনতে যাচ্ছে খাবারের কোণায়। 

কণেপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথিদের কতক খাবার টেবিলে বসে গল্প করছে, কতক এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করছে, কেউবা দূরে গিয়ে ধূমপান করছে। তাঁবুর বাহির থেকে দুজন যুবক ওদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। 

এক যুবক জিজ্ঞেস করলো, বাহ! খুব সুন্দর তো! খিদা লাগছে?

একটা মেয়ে জবাব দিলো, পানি আনতে যাচ্ছি। 

অপর যুবক বললো, তোমরা কষ্ট করে এদিকে আসলা কেনো! আমদের বললেই পানি আইনা দিতাম!

অপর তরুণী বললো, আপনাদের চিনি না, জানি না! আপনাদের পানি আনতে বলবো কেনো? 

তরুণী দু'জন যুবকদ্বয়কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। যুবক দুটো উড়ো চুমু ছুড়ে দিলো ওদের দিকে। তরুণী দু'জন দুই বোতল পানি সংগ্রহ করে অন্যদিক দিকে চলে গেলো কণের কাছে। মিনিট দশেক পরে আরো দুই তরুণী ঐপথে পানি আনতে গেলে সেই যুবক দুটো ওদের পথ আটকে বিভিন্ন ধরনের ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগলো। এক সময় যুবক দুটো ওদের ঝাপটে ধরে চুমু খেতে চাইলো। 

অদূরে দাঁড়িয়ে জনি প্রথম থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলো। জনি প্রতিবেশি হিসেবে কণেপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথি। সে এগিয়ে গেলো ওদিকে। পরপর দুটো ঘুষি মেরে দুষ্টু যুবক দুটোকে মাটিতে ফেলে দিলো। শুরু হলো হৈচৈ। হৈচৈ শুনে অতিথিরা এদিকে দৌড়ে এলো। ঘটনা শুনে যুবকদের জিজ্ঞেস করায় ওরা জানালো যে ওরা আমন্ত্রিত অতিথি না। কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে ওরা এভাবেই ঢুকে খেয়ে থাকে। যুবক দু'জনকে বের করে দেয়া হলো বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে। 

দুষ্টু যুবক দুটো পুলিশের সোর্স। আমাদের সমাজে পুলিশের সোর্স পুলিশের সমান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। এরা এলাকার ভালো মন্দ সকল তথ্য পুলিশকে দিয়ে থাকে। পুলিশের ভালো মন্দ সকল কাজে এরা সহায়তা করে থাকে এবং কম বা বেশি ভাগও পেয়ে থাকে। এই দুই যুবকের নাম ধরা যাক রুবেল ও মিশা। 

রুবেল ও মিশা ধুপধাপ হেঁটে চলে এলো থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার খাসকামরায় ঢুকে অলীক কান্না শুরু করে দিলো। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হায়দার কারণ জিজ্ঞেস করলে রুবেল বললো, বড় অপমান হইছি আইজকা স্যার!

সাথে সাথে মিশা বললো, জিন্দেগিতে এতোবড় অপমান হই নাই স্যার!

ওসি হায়দার মোবাইল ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ওদের জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে? আগে ঘটনা ক! পরে কান্দিস!

রুবেল মেয়েদের উত্যক্ত করার ঘটনা বাদ দিয়ে বললে ওসি হায়দার বললেন, দাওয়াত না পায়া বিয়া খাওয়া কবে বাদ দিবি তোরা?

মিশা বললো, একটা বিয়াতে কত মানুষ খায়! আমরা দুইজন খাইলে কি কম পড়ে?

এখন কী চাস তোরা?

আমগো সাথে ফোর্স দ্যান! ঐ বান্দির পুতরে ধইরা লইয়া আসি!

ঠিকাছে। ২০/২৫ জন সিপাই নিয়া যা। সাথে এসআই প্রতুল যাবে। ওকে আমি বইলা দিচ্ছি। 

পঁচিশ জনের একটি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান থেকে জনি এবং ওর বড় ভাই রকিবকে তুলে নিয়ে এলো ওরা। 

থানায় এনেই জনিকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকলো রুবেল ও মিশা। থানার ভেতরে টানা আড়াই ঘণ্টা চললো জনির উপর অকথ্য পুলিশি নির্যাতন। এক পর্যায়ে জনির শরীর খারাপ হতে শুরু করলে সে এক গ্লাস পানি পান করতে চাইলো, পানি, পানি, পানি!

রকিবকে ধরে রেখেছিলো দুই সিপাই। ওর অনুনয়-বিনয় কান্না কারো মনে কোনো রকম রেখাপাত করলো না। জনির কাতর কণ্ঠে পানি চাওয়া শুনে রকিব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমার ভাইটারে আর মাইরেন না পুলিশ ভাইরা। জনি ভুল করছে। ওর পক্ষে আমি মাফ চাইতাছি। রুবেল মিশা ওরে মাফ কইরা দেও। 

রকিবের কথা শুনে মিশা খলনায়কের মতো হাসতে থাকলো। আর রুবেল জনির পেটে কষে একটা লাথি মারলো। সাথে সাথে জনির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। 

এক সিপাই জনির বুকে বুট জুতা রেখে জনির মুখে থুতু ছিটিয়ে বললো, পানির বদ্লে থুতু খা!

ঐ থানা হাজতে জনির মৃত্যু হলো। পুলিশ রকিবকে মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ভয় দেখিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই জনির লাশটা নিতে বাধ্য করলো। ছোট ভাই-এর লাশ দাফন করার পরে পাড়ার লোকদের পরামর্শে থানায় পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগে মামলা করতে এলে পুলিশ মামলা না নিয়ে উল্টো ওকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলো থানা থেকে। তখন রকিব আদালতে চলে গেলো মামলা দায়ের করতে। আদালতের নির্দেশে থানা মামলা নিয়ে কবর থেকে জনির লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হলো। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে থাকলো যে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে এলে এক পর্যায়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় জনি। তদন্ত শেষে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যু হয়নি মর্মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেবার পরে রকিবের পক্ষে নারাজি দিলে অধিকতী তদন্তের জন্য মামলা সিআইডি-তে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হলো। 

শুরু হলো পুলিশের পক্ষে বিভিন্নভাবে রকিবকে হুমকি দেয়া। পুলিশের সাথে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য রকিবকে কখনো প্রলোভন কখনো বা হুমকি দিতে থাকলো পুলিশের পক্ষে ঐ দুটো সোর্স ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বিশেষ করে সরকারপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এতেও না টললে রকিবকে গুম ও হত্যার হুমকি দেখাতে থাকলো। রকিবের মাকেও সরাসরি বাসায় গিয়ে কখনো বা মোবাইল ফোনে হুমকি দেখানো হতে থাকলো এইভাবে যে এক ছেলে মারা গেছে, তুমি কি আরেক ছেলেকে হারাতে চাও? সময়টা তখন ২০১৪ খৃষ্টাব্দ।

একদিন রকিবকে মা বললেন, কিরে রকিব, তোকে এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে কেনো?

রকিব শুকনো কণ্ঠে বললো, পুলিশ বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেবার জন্য।

মা বললেন, আমাকেও হুমকি দিতাছে রকিব।

কী বলছো তুমি মা!

বাসায় আসছিলো। বলছে, একটা ছেলে মরছে, মামলা না তুলে নিলে তোকেও মেরে ফেলবে, অথবা গুম করে ফেলবে।

রকিব মার কাঁধে হাত রেখে বললো, আমি মামলা তুলে নিবো না মা। তুমি মামার কাছে চলে যাও। মামল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে আসার দরকার নাই। 

শুরু হলো মামলার তারিখ পড়া। আসামি পক্ষের আবেদন করলেই বিজ্ঞ আদালত পরবর্তী তারিখ দিয়ে দেন। বাদিপক্ষ সাক্ষী হাজির করলে আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী অসুস্থ, এই অজুহাতে মামলার পরবর্তী তারিখ পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে রকিবের উকিল মামলা চালাতে অনীহা প্রকাশ করেন। রকিব বিরক্ত হন না। তিনি প্রতিটি তারিখেই আদালতে গিয়ে হাজির দিতে থাকেন, এডভোকেটের ফি দিতে থাকেন। এভাবে দুই বছর অতিক্রান্ত হবার পরে একদিন মামলা আপোষে মীমাংসা করার জন্য কুড়ি লক্ষ টাকা প্রদানের প্রস্তাব এলো পুলিশের পক্ষ থেকে। 

রকিব বলেন, আমার আদরের ছোট ভাইকে খুন করা হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। টাকা দিয়ে কী করবো!

রকিব আপোষ করেন না। ভাইয়ের হত্যাকারীদের সাথে কোনো আপোষ নয়। বিচারের দাবিতে রকিব থাকেন অটল। 

মামলার তারিখ পিছায়, খরচ বাড়তে থাকে, একের পর এক তারিখ পড়ে। এরই মধ্যে আসামী পক্ষ মামলা স্থগিতের আদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। মামলার দুই আসামি প্রথম থেকেই পলাতক; যদিও ওদের থানায়, কখনো পুলিশ লাইনে দেখা যায়। আরেক আসামী জামিনে মুক্তি পেয়ে মামলার প্রাক্তন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে থানায় বসে রকিবকে দেখিয়ে দুপুরের খাবার খায়, চা পান করে, সিগারেট ফুঁকে। 


ভাই হত্যার বিচারের দাবিতে দায়ের করা মামলায় আদালত শুনানি ও অন্যান্য কাজে গত সাড়ে ছয় বছরে রকিবকে চারশ বার আদালতে আসতে হয়েছে। রকিব একটা শুনানির তারিখও অনুপস্থিত থাকেন নি। 

দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর অসংখ্য হুমকি, ভীতি, আপোষের প্রস্তাব, বিরামহীন আদালত শুনানির পর জনি হত্যার বিচার হয়। 

জনি হত্যায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি দুজনকে সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত। 

রায় ঘোষণার সময় জনির মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কান্না থামিয়ে বিজ্ঞ বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্তান হত্যার পরে বিচার পেয়ে কী হবে জজ স্যার? পুলিশের দ্বারা এমন ঘটনা যেনো আর না ঘটে তা নিশ্চিত করেন!


পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) ২০১৩ আইনে এই মামলার বিচার নিষ্পত্তি করা হয়।

(একটি সত্য ঘটনার অনুলিখন এই গল্প)

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024