উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -12


 


আমি বাবার কাছে ফিরে যাবো। এই নরক যন্ত্রণার হাত হতে আমাকে মুক্ত হতে৷ ঐ লম্পটের পৈশাচিক লালসা আমাকে তিলে তিলে দগ্ধ করছে, আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবো না। কিন্তু গৃহ হতে বেরুবার পথ না পেয়ে দমাদম ধাক্কা মারতে শুরু করলাম। কোন ফল হলো না।


 মনে হয় আমার শব্দ শুনে সেই বর্ষীয়সী গৌরবর্ণা মহিলা চোখ রগড়াতে রগড়াতে আমার কাছে এসে রুদ্র মূর্ত্তি ধারণ করে দারুন বকাবকি শুরু করলো, কি ভেবেছিস ছুঁড়ি? কপাটে ধাক্কা মারছিস কেন? ভাবছিস বেরিয়ে চলে যাবি? খবরদার এ বাড়ীর এক পা যদি বাইরে রেখেছিস তাহলে পিঠে চাবুকের দাগ বসে যাবে। ও কথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠলাম। আমি কি ওর বাঁদী যে ওর কথাতে উঠতে বসতে হবে? 

তাই গলা হাঁকিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, আমি কি আপনার ক্রীতদাসী যে আপনার কথা শুনতে হবে?

 হ্যাঁলো ছুঁড়ি শুনতে হবে। তোর মুখ দেখতে রোন্টার কাছে ৮০ হাজার টাকায় কিনিনি।

কি বললেন রন্টুদা আমাকে বিক্রি করেছেন? 

ভালোই তো করেছে, বাড়ীতে না খেতে পেয়ে মরতে চলেছিলি। এখানে খাবি দাবি স্ফূর্তি করবি। শোন্ আর জ্বালাস না বাপু। আজকের মতো ঐ বেঞ্চিটাতে শুয়ে পড়, কাল থেকে সব ববস্থা হবে। 

সে চলে গেলো। ওর কাছে ও কথা শুনে রন্টুদার প্রতি ঘৃণায় আমার সর্ব শরীর বিষাক্ত হয়ে উঠলো। এক অজানা আশঙ্কায় আমি দেহে ও মনে সংকুচিত হয়ে গেলাম। রাগে অভিমানে ধীরে ধীরে আমার শরীরের শিরা উপশিরাগুলো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে থাকলো। রন্টুদা এত নীচ। এতোখানি বিশ্বাসঘাতক! সে আমাকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে এক লম্পটের হাতে! নিজের দুঃখে আক্ষেপে মনে হলো আত্মহত্যা করি। না-না এ আমি সহ্য করতে পারবো না। এর থেকে মৃত্যু অনেক ভালো। কিন্তু এই পথ তো আমি চাইনি? এভাবে নিজেকে আত্মবলি দিতে চাইনি? বিশ্বাস করে দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য রন্টুদার সাথে-না? তাকে দাদা বলতে ঘৃণা করি। সেই বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, তার শয়তানীর মুখোস আমি খুলে ফেলেছি। জানতে পারিনি তার হৃদয়ের অন্তরালে এতোখানি নোংরামী ছিলো। সে এতোখানি নীচ মনোবৃত্তি ব্যক্তি তা বুঝতে পারিনি।

সেই সময় মনে পড়লো পাড়ার ছেলে সমীরদার কথা। তিনি রন্টুদার অধঃপতন নিয়ে ঠিকই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বরং আমি রন্টুদার উপচিকীর্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তবে কি জানিস রমা, এই বর্তমান যুগে মানুষ বড় পাশবিক স্তরে নেমে গেছে। যদি ওকে বিশ্বাস করিস, তাহলে ওর সঙ্গে যেতে পারিস! কারণ প্রতিবেশী হয়েও কখন এই অসময়ে কোন সহযোগিতা করার মত আমাদের ক্ষমতা নেই। গিয়ে দেখ কি চাকুরী তোকে দিচ্ছে সে। 

সেদিন সমীরদার কথাকে অবজ্ঞা করে রন্টুদাকে আমার মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝছি ওসব তার অন্তঃসার শূন্য ও কৃত্রিম লোক হিতৈষীতা। ভাবছি তার এই বেইমানীর প্রতিশোধ কি করে নেব। সামান্য নারী হয়ে কুখ্যাত সমাজ বিরোধীর সর্বনাশা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো কি?

 এখন কি করবো, এই রুদ্ধ গৃহে বন্দী হয়ে পুরুষের কামাদগ্ধ হওয়ার চেয়ে আমার মৃত্যু শ্রেয়। আমি জানি একবার যে বারবনিতা, চিরকালই সে বারবনিতা। বাবার কথা মনে পড়তেই আরো মুঝড়ে পড়লাম। ঠাকুর এখন কি করি , আমাকে পথ বলে দাও, এই পথ আমার নিকট অসহ্য হয়ে উঠবে। বিবেকের তীব্র দংশনের জ্বালায় আমি ক্ষত - বিক্ষত। তুমি আমার মৃত্যু দাও ঠাকুর। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। মানুষ চেনার মনস্তাপে বার বার দেওয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলাম। 

হঠাৎ কার স্নেহ স্পর্শে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম, আমার চেয়ে বয়সে হয়তো তিন চার বছরের বড় হবে, শ্যামল বর্ণের হলেও আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বুঝতে পারলাম দেহের কোথাও কোথাও যেন রূপলাবণ্যের ছাপ আঁকা। আয়ত নেত্র, মসৃণ গন্ড, সুতীক্ষ্ণ নাক, গ্রীবাটিও সুন্দর। তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হয়েছিলো কোন সৌন্দর্য্যে লোক হতে জ্যোতিময়ী রমনী আমাকে এ বিপদ হতে রক্ষা করতে এসেছেন।

 তিনি নম্রকণ্ঠে বললেন, তুমি যে স্বেচ্ছায় এখানে আসোনি তা বুঝতে পেরেছি তোমার কান্না শুনে। কোন মহাপুরুষের ইঙ্গিতে এই ফাঁদে পা দিয়েছো? 

কেঁদে উঠলাম তার কথা শুনে। মুখে কোন প্রকারে বাক্য বের হতে চাইলো না। ওর ধমকে অস্পষ্ট গলায় রন্টুদার ঘৃণ্য জীবনের ইতিহাস সংক্ষেপে বললাম।


তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এই ভাবেই আমাদের আসতে হয়রে, নইলে কেউ কি সাধ করে এই গরল পেয়ালা পান করতে চায়? নারীর দেহকে যারা ভোগ্য সামগ্রীর মতো মনে করে, যারা নারীত্বের চরম অবমাননা করে, তাদের সান্নিধ্যে কে আসতে। আমিও ঠিক তোর মতো এক পথভ্রষ্টা নারী। পুরুষের শাঠ্যের ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আমি এক গ্লানিময় জীবনে ফিরে এসেছি। তোকে তুই বলে ডাকার দুঃসাহসের জন্য আমাকে মার্জনা করিস। 

ঐ স্নেহময়ীর নারীর দুঃখ ভরা কথা শুনে বললাম, আপনি যখন আমাকে বোনের মতো মনেই করেছেন, তাহলে আমাকে এই অধঃপতিত ও কেদাক্ত জীবনের পঙ্কিলতার আবর্ত্ত থেকে মুক্ত করুন। আমার অন্তরে নারীত্বের শুভ্র শতদল বিকশিত করে তুলুন দিদি। 

তিনি আমার হাত দুটো ধরে অশ্রু ভরা নয়নে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কোন উপায় নেই রে বোন। একবার যে নারী সতীত্বকে ধূলায় লুণ্ঠিত করে এই পাপ পথের যাত্রী হয়েছে তাকে কোন মতেই মুক্তির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেওয়া হয় না। এখানে বাবু গুন্ডা নামে এক কুখ্যাত ব্যক্তির কাছে ‘ শংকর মাছের চাবুক ' আছে, যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে এই পিঠটা দেখলে বুঝতে পারবি। 

বিলম্ব না করে ব্লাউজটা খুলে আমাকে পিঠটা দেখালেন, দেখলাম অজস্র চাবুকের দাগ। তোর মতো অসহায় নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে বাবু গুন্ডা আমাকে অজস্র বেত্রাঘাত করেছে। জানিস ও মানুষ নয় জানোয়ার। তাই বলছি এখান হতে কোন প্রকারে মুক্তি পাবি না। বন্দী শালায় আবদ্ধ হয়ে চিরকাল অশান্তির আগুনের দগ্ধ হতে হবে। নারীদেহ লোভী হিংস্র মানুষের সে যুগ দৃষ্টি কোন মতেই এড়াতে পারবি না। এখানে পরুষের লীলা খেলা চাপল্য খেয়াল খুশীয় সবই নির্বিবাদে সহ্য করতে হবে। প্রতিবাদের কোন পথ নেই রে বোন। 

ওর কথা শুনে পনুরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার এই ধিকৃত জীবনের অভিশাপের জন্য ভগবানের নিকট অভিযোগ জানালাম। ঠাকুর এই পঙ্কিলময়, নর্দমার নরককুন্ডে কেন আমাকে নিক্ষেপ করলেন? আমি তো কোন অন্যায় করিনি যে, দন্ড স্বরূপ আমাকে এই আস্তাকুঁড়ে আশ্রয়। কান্না বাড়তে থাকলে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন সেই সুন্দরী নারী। ওরে পোড়া কপালী কেঁদে কেঁদে নিজেকে দূর্বল করিস না। শুধু তুই কেন, তোর মতো বহুনারীর জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ঐ শয়তানের দল। তাই বলছি প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা কর। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন পুনরায় বলতে পারিস, আমার কিসের অভাব ছিল? আমার দাদা একজন ডাক্তার, বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার। অঢেল সম্পত্তি আমাদের। তবুও ভাগ্যচক্রে ঐ শয়তানটার পাল্লায় পড়ে আমাকে বেশ্যা হতে হয়েছে। আমি কি এদের ষড়যন্ত্র ও ছদ্মবেশ জানতে পেরেছিলাম, আমার এই নারী দেহ নিয়ে ওরা ছিনিমিনি খেলা করবে এটা ভাবতে পারিনি বোন।

 ধীরে ধীরে ওর মুখখানি সিঁদুর রাঙ্গা হয়ে উঠলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস তার বুকটা যেন হাপরের মতো উঠানামা করতে লাগলো। তারই মধ্যে চাপা গলায় বললেন, “খবরদার কাঁদবি না, তোকে শক্ত হতে হবে, বুককে পাষাণের মতো করতে হবে। শুধু তুই কেন, বহু মেয়েরা এই পথে এসেছে। তাদের মধ্যে আমরা। প্রতিজ্ঞা কর এই ব্যভিচারী পুরুষদের মুখোস খুলে দিয়ে নারী অবমাননার চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করবি। 

কান্না থামিয়ে অতি ধীর কণ্ঠে বললাম, এতো আমি চাইনি দিদি। 

আমিও কি চেয়েছিলাম? বা অন্য মেয়েরা কি নিজেকে পাঁচের ভোগে লাগাতে চায়? এখানে যত মেয়ে আছে তাদের সকলকে তোর আমার মতো শয়তানদের ফাঁদে পড়ে আসতে হয়েছে। একবার যদি ওরা কোন প্রকারে এই দেহ বিক্রয়ের হাটে কোন নারীকে পণ্য সামগ্রীর মতো হাজির করতে পেরেছে, তাহলে আর রক্ষা নেই, মুক্তির পথ রুদ্ধ। সতীত্ব ও নারীত্ব কাঁচের জিনিষের মতো ভেঙ্গে পড়বে। অসহায় নারী করুন আর্তনাদ এই কুর্নিশ কঠোর শয়তানি কর্ণে প্রবেশ করে না। রাত অনেক হয়েছে, আমার কুঞ্জেই নিশিযাপন করবি চল।

 তিনি আমাকে ওঁর সুসজ্জিত কক্ষে নিয়ে গেলেন। বেদনার অশ্রুজলে আমি এই দয়াময়ী নারীর গৃহভ্যন্তরে বিনিদ্র রজনী যাপন করলাম।



                                 ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024