রমেশের কৃপণতা - সামিমা ইয়াসমিন || Ramesher Kripanata - Samima yeasmin || Short story || ছোট গল্প || গল্প || অনুগল্প || Story || Bengali Story
রমেশের কৃপণতা
সামিমা ইয়াসমিন
এক গ্রামে রমেশ নামে এক কৃপণ ব্যক্তি ছিল। যে তার খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে আশাক- পোশাক পর্যন্ত সবকিছুতেই কৃপণতা দেখাত। সে এতটাই কিপটে ছিল যে একটি জামা সম্পূর্ণ চিটচিটে ময়লা না হওয়া অবধি পরিষ্কার করত না। সে মনে করত খুব ঘন ঘন জামা পরিষ্কার করলে সাবান বেশি নষ্ট হবে। আবার প্রায় একমাস পর যখন সে জামা পরিষ্কার করত তখন খুব ভালো করে পরিষ্কার হতো না কারণ সে তার স্ত্রীকে কম সাবান ব্যবহার করতে বলতো। তারপর যখন ভালো করে পরিষ্কার হতো না তখন আবার সে তার স্ত্রীকেই বকত। আর তার বেচারা স্ত্রীর প্রায় বিনা সাবানে কাপড় পরিষ্কার করে করে হাত ব্যথা।
একদিন পাশের গ্রামে মেলা বসেছে। আর এটা যখন রমেশ শুনে তার মাথায় বাজ পরার মত অবস্থা। তার দুটি সন্তান আছে , একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। সে আগে থেকেই ভেবে নিয়েছে বাড়ি গিয়ে কোনোমতেই স্ত্রী ও সন্তানদের বলবে না যে পাশের গ্রামে মেলা বসেছে।
বাড়ি গিয়ে দেখে তার স্ত্রী ও সন্তানরা সেজেগুজে বসে আছে। তার স্ত্রী রমেশকে বলে-
‘ পাশের বাড়ির কমলা এসেছিল। সে বলল পাশের গ্রামে মেলা বসেছে তাই তাড়াতাড়ি মেলা চলো আর দেরি করা যাবে না। ’
রমেশ তো কোনোমতেই যাবে না কারণ তার অনেক খরচ হয়ে যাবে তাই সে বিভিন্ন রকম বাহানা বানানো শুরু করে। কিন্তু তার স্ত্রী তাকে ভালোভাবেই চিনে এবং সে তার সন্তানদের শিখিয়ে দিয়েছে যখন তার বাবা মানবে না তারা যেন কান্না শুরু করে দেয়। যখন তাদের কান্না রমেশের দ্বারা আর থামানো যায় না তখন তাকে অবশেষে মানতেই হলো মেলা যাবার জন্য।
আর মেলা গিয়ে কিছু না খেয়ে কিছু না কিনে তো আসা যায় না। তাই রমেশ যখন দেখে তার স্ত্রী ও তার ছেলে-মেয়েরা খেলনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন সে কোনমতেই তাদের কাছে যায় না এবং সে লুকিয়ে যায় কিন্তু সে দেখে তার স্ত্রী ও সন্তানরা দোকান থেকে ঘুরে আসছে এবং তার ছেলে ও মেয়ের হাতে একটি করে খেলনা আছে। রমেশ তো অবাক হয়ে যায়। সে ভাবে তার স্ত্রী টাকা কোথা থেকে পেল কারণ সে তার স্ত্রীকে ফুটি করি দেয় না। তারপর তার স্ত্রীকে যখন সে জিজ্ঞেস করে-
‘ তুমি টাকা কোথায় পেলে ?’
‘ আমার বাবা যখন বেড়াতে এসেছিল তখন রনি ও ছুটকিকে হাতে পয়সা দিয়ে গিয়েছিল। ’
তারপর সামনে জিলিপির দোকান দেখতে পেয়ে ছুটকি সেখানে ছুটে যায় এবং একটি জিলিপি হাতে তুলে নেয়।
উপায় না দেখতে পেয়ে রমেশ শুধু একটাই জিলিপির দাম দিল আর কিনল না।
‘ আজকে অনেক খরচ হয়ে গেল। ’
- এই কথাটি বলে তাড়াতাড়ি করে তাদেরকে নিয়ে মেলা থেকে প্রস্থান নিল।
সকালবেলায় রমেশ চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়েছে। সেখানে অনেক লোকজন বসে আছে এবং তারা গল্প-গুজব করছে। রমেশকে দেখে একজন বলে উঠল -
‘ কিরে তোর জামাটা দেখছি ময়লা ময়লা লাগছেে ? ’
কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠল এবং রমেশ লজ্জায় পড়ে গেল। আর একজন বলে উঠল-
‘ এবার মাটি দিয়ে পরিষ্কার করবি তাহলে দেখবি একটাও পয়সা খরচ হবে না। ’
আবার সবাই হেসে উঠল। আর গ্রামের লোকেরা রমেশকে ভালোভাবেই চিনে সে কতটা কৃপণ ব্যক্তি। তারপর রমেশ চা চাইল কিন্তু তাকে চা দিল না। কারণ সে কয়েকবার চা ধারে খেয়েছে এবং সেটার পয়সা এখনো মেটাইনি।
‘ আমি ঠিক দিয়ে দেবো। এই তো কালকেই দিয়ে দিচ্ছি। ’
এটা শুনে চাওয়ালা বলে-
‘ তুই কালকে কালকে করে কত কাল পার করেছিস। আমাকে আগে ধার মেটাবি তবে চা দেবো। ’
রমেশ চলে যাওয়ার পর চায়ের দোকানে বসে থাকা এক ব্যক্তি বলে -
‘ শুনেছি তারা নাকি দু মাসে একবার মাছ ভাত খায়। সে তো উৎসবের দিনেও তার স্ত্রীকে ভালো একটা শাড়ি কিনে দেয় না , এতটাই কিপটে। ’ আর একজন বলে উঠল -
‘ তার মুদিখানা দোকানে ভালোই বিক্রি হয় এবং জিনিসপত্রের অনেক দাম নেই। কি জানি অত টাকা বাঁচিয়ে কি হবে ? মনে হয় যখন মরবে টাকাগুলো সঙ্গে করে নিয়ে কবরে যাবে। ’
এবং তারা সবাই রমেশকে নিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু করে দিলো। ’
একদিন রমেশের বাড়িতে নিমন্ত্রণ এল জন্মদিনের পার্টির। রমেশ মনে মনে ভালো খাওয়া- দাওয়ার জন্য খুশি তো হচ্ছেই তার ওপরে কি গিফট দিবে তা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়েছে। আর সে তো কোনোমতেই টাকা দিয়ে কোনো জিনিস কিনবে না। কারণ সে তার নিজের ছেলে-মেয়েকে কোনো জিনিস কিনে দিতে নাকচ করে। কিন্তু মনে মনে ভালো খাবার দাবারের কথা নিয়ে লোভ সামলাতে পারেনা তাই সে মনে মনে ঠিক করল ছুটকির মেলা থেকে নেওয়া পুরনো খেলনাটি তাকে দেবে। তাই সে তার স্ত্রীকে ডাকে -
‘ ছুটকির খেলনাটি দাও তো ! ’
তার স্ত্রী বলে -
‘ কেনা ছাড়া উপাই নেই। ছুটকি খেলনা ভেঙে দিয়েছে। ’
এটা শুনে রমেশ পুরো বাড়িতে হই হট্টগোল শুরু করে দিল এবং তার স্ত্রীকে বকতে শুরু করে দিল।
‘ টাকা নষ্ট করে খেলনা কেন কিনে দিয়েছিলে ? ওই টাকাতে একদিন মাছ কেনা হতো। এবার পার্টি তে কি নিয়ে যাবো ? ’
তার স্ত্রী রাগ তাঁর কমানোর জন্য জল নিয়ে এলো।অনেকক্ষণ পর রমেশের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো সে ভাবল -
‘ ওই ভাঙ্গা খেলনাটিকে একটা বড় প্যাকেটের মধ্যে প্যাক করবো তাহলে দেখে বড় গিফট মনে হবে এবং ভেতরে কী আছে তা কেউ দেখতে পাবে না। ’
সন্ধ্যার পর বেরোলো ছুটকি ও রনিকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে গিয়ে রমেশ বন্ধুদের বেশি বেশি করে তার গিফটি দেখায়। তা দেখে একজন বলে -
‘ কি আছে ?’
রমেশ বলে - ‘ 500 টাকায় কিনেছি দারুন খেলনা আছে। ’
তার এই কথা শুনে সবাই অবাক হয় কারণ তারা ভালো করেই জানে যে ব্যক্তি তার নিজের সন্তানদের কিছু কিনে দিতে কৃপণতা দেখায়। সে আবার পরের ছেলেকে 500 টাকা দামের খেলনা কিনে দেবে এবং সবাই গিফটির দিকে তাক নজরে থাকে।
কেক কাটার পর সবাই খাওয়া দাওয়া শুরু করে। রমেশ পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে এবং তিনটে মিষ্টি ভরে নেয়। আর এই কাণ্ডটি করতে একজন দেখে নেয় এবং চিৎকার করে বলে -
‘ মিষ্টির চোর ! ’
রমেশ তখন তাড়াতাড়ি করে প্যাকেটটি পকেটে ভরে নেয় এবং লজ্জা পেয়ে সে বলে -
‘ যে জীবনে কোনদিন মিষ্টি খায়নি সে এই কাজটি করবে। ’
এটি বলে সে নিজেকে বাচায়।
খাওয়া-দাওয়ার পর সে সেখানে আর এক মিনিটও থাকবে না কারণ এবার সব গিফট খুলবে। রমেশ তাড়াতাড়ি করে ছুটকি ও রনিকে নিয়ে বেরোয় কিন্তু তাকে সবাই আটকে নেন।
‘ অত তাড়া কিসের , আরেকটু থাম একসঙ্গে তো সবাই বাড়ি যাব। ’
তাকে বাধ্য হয়ে থামতে হয় । সবশেষে যখন তার গিফটি খোলা হয় তাতে দেখে ভাঙ্গা খেলনা রাখা সেটা দেখে সবাই হাসতে শুরু করে। যার জন্মদিন পালন হচ্ছিল তার নাম রকি। সে খেলনাটি ডাস্টবিনে ফেলে দেয় এবং তার একটি নতুন খেলনা ছুটকিকে দেয় । কারণ রকি জানত খেলনাটি ছুটকির ছিল । সে খেলনাটি নিয়ে তাকে খেলতে অনেকবার দেখেছিল । যাইহোক অনেক রাত হওয়ার ফলে সব লোকজন নিজের নিজের বাড়ি প্রস্থান নিল।
রমেশ একদিন দোকান যাবার পথে রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের পেছনে একটি কালো রংয়ের ব্যাগ কুড়িয়ে পায়। সে ব্যাগটি না খুলেই সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে চলে আসে কিন্তু ব্যাগটিতে তালা মারা ছিল তাই রমেশ চেষ্টা করেও ব্যাগটি খুলতে পারল না । সে ভাবে ব্যাগটিতে হয়তো অনেক টাকা ভরা আছে এবং সে তার স্ত্রীকে দেখায় কিন্তু তার স্ত্রী তাকে বলে -
‘ রাস্তায় পড়ে পাওয়া জিনিস ভালো নয়। সবথেকে ভালো হবে তুমি এটা পুলিশকে দিয়ে দাও ।’
কিন্তু সে ব্যাগটিকে কাউকে ছুঁতে দিবেনা , পুলিশকে দেওয়া তো দূরের কথা।
এই ব্যাগটির জন্য কয়েকদিন সে দোকানে যায় না সেটা চুরি হয়ে যাবে বলে। সে সবসময় সেটিকে তার কাছে রাখে , সেটিকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।
সে ভাবে ব্যাগটি একদিন কামারের কাছে নিয়ে যাবে তালা ভাঙার জন্য কিন্তু সে এই ভয়ে নিয়ে যায় না যে কামার হয়ত সব টাকা গুলো দেখে নেবে এবং তাকেও কিছু ভাগ দিতে হবে। তাই সে ঠিক করে এখন সে এটি লুকিয়ে রাখবে । পরে তখন ঠিক সময় হলে এটি খুলবে। ততক্ষণে এটা যার ব্যাগ সে তখন খোঁজার হাল ছেড়ে দেবে।
অনেকদিন ধরে বাড়িতে থাকার ফলে তার দোকানের গ্ৰাহকগুলো চলে যায়। আর তাদের বাড়িতে যদি কেউ কোনো কিছু নেওয়ার জন্য আসে কিংবা কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য আসে রমেশ তাকে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। তার ওই গুপ্তধন দেখে নেবে এই ভয়ে। আর সে যখন ঘুমায় তখন নিজেকে ব্যাগটির সঙ্গে দড়িতে বেঁধে ঘুমায়। যাতে করে চোর যদি চুরি করতে আসে সেটা নিয়ে যেতে পারবে না।
অবশেষে সে ব্যাগটি খোলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটি হাতুড়ি নিয়ে আসে। হাতুড়িতে করে বার বার আঘাত করার ফলে তালাটি খুলে যায়। খোলার পর সে তার মাথায় হাত দেয় কারণ তাতে পুরনো জামা কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এটার জন্য সে তার দোকান পর্যন্ত যায়নি। সে ভাবে যদি সে এটা আগে কামারের কাছে খুলে নিত তাহলে হয়তো খোলার জন্য যত টাকা লাগত তার থেকেও বেশি দোকান না যাওয়ার ফলে তার অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে এবং তার দো
কান আর ভালো ভাবে চলেও না।
এদিকে তার এই কৃপণতার কারণেই তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।
Comments