ছোট গল্প - জোনাকি ও দীর্ঘশ্বাস || লেখক - রোকেয়া ইসলাম || Short story - Jonaki oo Dirghaswas || Written by Rokeya Islam


 

জোনাকি ও দীর্ঘশ্বাস 

রোকেয়া ইসলাম 




বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে তিন বছরের ছেলে হাত বাড়িয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়ালো। তখন সন্ধ্যা রাতের দুয়ারে জোরেশোরে  কড়া নাড়ছে। অন্য বেবিট্যাক্সি থেকে মামা ও দেবর তড়িঘড়ি করে নামলো। জোনাকির স্বামী আহাদ বেবিট্যাক্সি ভাড়া মেটাতে না মেটাতেই দরজা খুলে দিলো আহাদের চেয়ে একটু বয়েসী এক ভদ্রলোক। তার নাম আবদুল মতিন । 

জোনাকি আকাশ ছোঁয়া খুশি আর নব অঙ্কুরিত আনন্দের ডালি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। আজ থেকে এই বাড়িটা ওদের নিজেদের। কোনো ভাড়া নেই, ভাগ নেই, ভাড়া দেবার তাগাদা নেই,ভাড়াটিয়া নামক "উঠুলি" পরিচয় নেই, ওরাই মালিক। অপার আনন্দে আপ্লুত জোনাকি। 

সবাই ড্রয়িং রুমে বসে। মাঝারি ধরণের চাকুরিজীবীর ড্রইং রুম বলতে যা বোঝায় তেমনি এটা। পাঁচজনের বসার মতো ব্যাবস্থা। তবে মতিন সাহেব   ভাড়ায় বেশ কয়েকটি ফোল্ডিং চেয়ার এনে রেখেছেন। 

জোনাকি জানে ওরা ভেতরের ঘরে থাকবে। বারান্দা ধরে ভেতরের ঘরে চলে যাওয়া যায়। 

এই রুমটি বেশ বড়সড়। বসা বা শোয়ার মত কোন ফার্নিচার নেই। 

ধোয়ামোছা রুমটায় আহাদ সকালেই লেপ-তোশক চাদর-বালিশ-পাটি কিনে রেখে গিয়েছিল। 

দেবর আর ছোটমামা মিলে বিছানা বিছিয়ে দেয় পাটপাট করে। বাইরে থেকে ব্যাগ সুটকেস টেনে নিয়ে আসে। 

মোটামুটি রাত্রিযাপনের স্বাস্থ্যকর  সুব্যাবস্থা হয়ে যায়। 

পাশের ঘর থেকে ভারি ভারি কথা টাকা পয়সার আদান প্রদান সিগনেচার,  সবশেষে চা মিষ্টির শব্দ ভেসে আসে। প্রত্যেকটা শব্দকে হীরেমানিক্যের মত করে সংগ্রহ করে জোনাকি। 

দুপক্ষের লোকজন চলে গেলেও ছোটমামা আর দেবর রইলো ওদের সাথে। 

আহাদ ঘরে ঢুকে সবকিছু সুন্দর ও ঝামেলা মুক্তভাবে সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে,  নিজেও বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে।

এই ফাঁকে জোনাকি ছেলের কাপড়চোপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে নিজেও সুস্থির হয়ে নেয়। 

জোনাকিকে বাথরুম থেকে বেরুতে দেখেই ওঠে পড়ে আহাদ। দেবরকে নিয়ে রাতের খাবার কিনতে বের হয়ে দরজা অবধি পৌঁছাতেই মতিন সাহেব ও তার স্ত্রী লিপি খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। 

জোনাকির সাথে লিপির পরিচয় করিয়ে দেয় মতিন সাহেব । জোনাকি লিপির রুপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঝকঝকে গায়ের রঙ থেকে হলুদ আভা বের হচ্ছে। ছিপছিপে গড়ন নাক চোখ ঠোঁটের আকৃতি অপূর্ব। 

সকাল সকাল আহাদ নাস্তা কিনে আনার সময় কাঁচা বাজারও করে নিয়ে। একটুপরে কেরোসিনের চুলা বাসন কোসন বটিসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসে,  

পুরাতন সংসারি জোনাকি নতুন সংসারের আমেজে শুরু করে নতুন শহরে নব জীবনযাত্রা। 

এক সপ্তাহ পরে জোনাকির পুরাতন সংসারের জিনিসপত্র চলে আসবে। এইসময়ের মধ্যেই মতিন লিপিও চলে যাবে তাদের নতুন আবাসে। 

লিপি ওর তিনরুমের সংসারকে একরুমে গুটিয়ে বাঁধাছাঁদা করছে। 

মতিন টাকা পাইপাই করে বুঝে নিয়েছে আহাদ কাগজপত্র বুঝে নিয়েছে। 

একজন সংসার ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্যজন গুটিয়ে ফেলছে। এরমাঝেই একটু একটু কথায় কাছে আসে দুজন। 

চলুন ছাদে গিয়ে বসি। 

জোনাকির কথায় চমকে যায় লিপি। 

ছাদে যাবেন, ভাই জানে তো। 

আরে জানাজানি কি আছে। ছাদটা তো বাড়িরই অংশ। চলুন তো যাই আগে। আকাশ দেখি, খোলা বাতাস গায়ে মাখি। 

লিপি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জোনাকির উচ্ছ্বাস ভরা চোখের দিকে। 

ছাদে হাঁটছে জোনাকি আর লিপি। 

এই বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল বিহারি কলোনী হিসাবে।  বাড়িগুলো পৌঁনে দু'কাঠা জমির ওপর তৈরি। সরকারিভাবে একই নকশায় তৈরি, চুন শুরকির ঢালাই দেয়া লম্বা ঘরকে তিনটে রুমে বিভক্ত করা। একপাশে বাথরুম রান্নাঘর সামনে একটু খোলা জায়গা। 

এই রোডে এই বাড়িটাই একেবারে আলাদা এটা তিনতলার ফাউন্ডেশন দেয়া,  একতলা হবার পরই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। 

তখনই আঁটকে যায় বাড়ি তৈরির কাজ। 

দেশ স্বাধীন হবার পর মালিকানা বদলাতে থাকে।আহাদ তিনহাত বদলে চতুর্থ মালিক। 

নিচে চলুন তো সন্ধ্যা হয়ে এলো। 

একটু পরে যাই, এই তো সবে এলাম। 

না না চলুন তো। 


জোছনা রাতে, দুপুরের বৃষ্টিতে ছাদে আসেন তাই না। 

না কখ্খনো না কোনদিনও না। 

লিপির রুক্ষ কন্ঠস্বর ওর লাবন্যময় রুপের সাথে একেবারেই বেমানান। কোথায়  লুকিয়ে রাখে ওর এই কর্কশ স্বরের ডিপো,  কে জানে। 

জোনাকি লিপির কন্ঠস্বরকে একদম পাত্তা দেয় না, নিজের মত করেই চারপাশ দেখতে থাকে 

বড় রাস্তার উপর এই বাড়ি, রাস্তার ওপাশে মসজিদ স্কুল, হাতের নাগালে কাঁচা বাজার মার্কেট বড় ঔষধের দোকানসহ নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা, হাঁটা পথের দূরত্বে বাসস্ট্যান্ড। তাহলে মতিন সাহেবের মত ঘোরেল মানুষ তড়িঘড়ি এই বাড়িটা হাত ছাড়া করলেন কেন? তাও জলের দরে!  

সূর্য ভোরের আলোর নধর দেহটা সারাদিনের রুপালী তাপে পুড়িয়ে লাল করে অভিজ্ঞতাটুকু পৃথিবীতে রেখে ডুবছে নিশ্চিত ফিরে আসার অঙ্গীকারে। 

সন্ধ্যার মোহন রঙরুপের সবটুকু বিভা লিপির মুখে অপরুপ ছায়া ফেলে।  এক নারীকে কি অনন্য অসাধারণ লাগছে। রুপসী লিপিকে কি যে অসামান্য সুন্দর লাগছে। 

লিপির চোখে চোখ পড়ে জোনাকির,  ওর চোখের নিচে এতো কালি কেন!  মনে হয় কতরাত ঘুমায়নি ও। 

সুগঠিত স্বাস্থ্যের অধিকারী স্বামী, গোল্লা গুল্লু দুই ছেলে, স্বামীর নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি নিরিবিলি সংসার, সবমিলিয়ে তো নির্ঝঞ্বাট জীবন। আর নিজের গা ভরা ঐশ্বর্যময় রুপ। তার আবার ঘুমের অসুবিধা কোথায়। 

ফুঁ দিয়ে মাইক পরীক্ষা করা হচ্ছে শুনেই লিপি বুঝে যায় মসজিদে এখনই মাগরেবের আজান হবে। 

চলুন এবার নিচে। 

জোনাকি ততোক্ষণে সন্ধ্যার অধরা  অপরুপ রূপে বিমুগ্ধ হয়ে গেছে। 

লিপি ওর হাত ধরে টান দেয়। 

চলুন তো এবার 

আজান শেষ হোক তারপর যাই

আমি কখনও আজানের সময় ছাদে থাকি না।চলুন

কন্ঠস্বর আগের চেয়েও তীক্ষ্ণ। জোনাকির নিরাসক্ত দৃষ্টিতে চোখ ছুঁয়ে দুপদাপ নেমে পড়ে লিপি। 

খোলা ছাদে হাঁটছে জোনাকি। সূর্য প্রতিদিনের মতোই  চেনা অথচ  অচেনা নতুন রুপে রক্তিম পথে ছুটছে। আজানের শব্দে জেগে যায় পুরো এলাকা। 

হঠাৎ জোনাকি ঘাড়ের কাছে দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু স্পর্শ। লিপি ফিরে এসেছে ভেবে পেছন ফিরতেই দমকা বাতাস ওর খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে উড়িয়ে দেয়,  এবার কোনকিছু না ভেবেই সিঁড়ি ভাঙতে থাকে জোনাকি। 

দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু স্পর্শে জোনাকির ঘুম ভেঙে যায়। সফল সঙ্গম শেষ নিসাড়ে ঘুমাচ্ছে আহাদ। জোনাকিরও তো এখন গভীর ঘুমে থাকার কথা তাহলে কি নতুন জায়গার কারণে ওর ঘুম ভেঙে গেল ভাবতেই পাশের ঘর থেকে চাপা কন্ঠস্বর ভেসে আসে রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে। 

মহিলার সাথে তো খুব খাতির পাতিয়ে ফেলেছো।  তা তোমার নাগরের কথাও কি বলেছো নাকি ওকে। 

কি বাজে বকছো এতো রাতে। 

আমি বাজে তাই না, বাজে বকছি আর তুমি কী? ঘরে ভাতার বাইরে লাঙ্গ ছিনাল মাগী। হায়রে মাগীর রুপ, জ্বইলা গেলাম রুপের আগুনে। 

চুপ কর তুমি চুপ কর,  পাশের ঘরে ওরা আছে। 

আছে তো কী হইছে আজ না জানলেও কাল তো জানবেই। আহাদ সাহেব তো বারবার জিজ্ঞেস করছিলো আমি কেন দামি জায়গা হাতছাড়া করলাম। 

মতিন সাহেব চুপ কর থাকে। নারী-পুরুষের দীর্ঘশ্বাসে রাতের প্রহর দীর্ঘ মনে হয় জোনাকির। 

ওঠে দাঁড়াতেই মতিন সাহেবের কন্ঠে নিরবে কাত হয়ে কান খাঁড়া করেশুয়ে পড়ে জোনাকি। 

কেমনে তারে বলি আমার ঘরের রুপে বাড়ি পুড়াইছে। দেহের রঙ্গে আমার কপাল পুড়ছে। বৌয়ের বিগারে নাগর উতলাইছে। খারাপ মাগী আমার ঘরে হান্দাইছে। 

এগুলো তোমার ভুল ধারণা,  বুঝবে একদিন কত বড় ভুল করলে জীবনেও শুধরাতে পারবে না তা। 

ঔ মাগী আমি ভুল করছি আর তুই কি করছোস তর নাগরের সাথে, তোর ঘাড়ে নখের দাগ, তুই দেখাস নাই আমাকে। ভুল আমি করছি। 

মতিনের উত্তেজিত কন্ঠে নরম আওয়াজ ঢালে লিপি 

আমার যা মনে হয়েছে যা অনুভব করেছি সেটাই বলেছি। বলাটা কি ভুল। 

তোর নগরকে কি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিস নতুন বাসার। আমি না থাকলে দুইজনে শুবি। 

আমি তো জানি না কোথায় যাচ্ছি কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাদের। 

বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ে জোনাকি। কলজে কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ওর কানে ঝাপটা মারে। 

কার মন বেশি খারাপ? মতিন সাহেবের না লিপির। 

মতিন সাহেবের কথায় বাড়ি বিক্রি করার মূল রহস্য টের পায় জোনাকি। লিপিকে উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর ভেতরটা কতটা বহির্মুখী। 

উপরে স্বামী সন্তান অন্তপ্রাণ এক নারী। যতটুকু দেখেছে এই দুদিন। লিপির অন্তঃমুখী স্বভাবটা টেনেছে জোনাকিকে। অথচ ভেতরে ভেতরে কতটা বহির্মুখী একবারও বুঝতে পারেনি জোনাকি। 

মানুষ চেনা বড় কঠিন। 

কতটুকু চিনেছে লিপিকে কতটুকু চিনেছে মতিন সাহেবকে? প্রশ্নটা রাতের ঘুমকে গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেয়। 

দুপুরের রান্না শেষ করে ছেলেকে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে গল্প শোনাচ্ছে তখনই লিপি ঘরে ঢোকে। 

মেঝেতে পাতা বিছানায় দুজনে পা ছড়িয়ে বসে। জোনাকির চোখ জোড়া লিপির সুন্দর মুখের ভূগোল পরিক্রমা করতে থাকে বারবার। 

আপনারা তিনজনই থাকবেন বাসায়। 

মেয়ে, এই ছেলের ছোট। কাজকর্মের ঝামেলায় ওর অযত্ন হবে তাই মায়ের কাছে রেখে এসেছি,  তাকেও নিয়ে আসব, আর আছে শাশুড়ির আমলের একজন মহিলা। সংসারের কাজে সাহায্য করবে সেও থাকবে। স্বামীর ব্যাবসার লোকজনের আসাযাওয়া তো আছেই। আত্মীয় স্বজনরা কেউ না কেউ থাকেই। 

তাহলে সমস্যা হবে না,  আমার সাথে থাকার মত কেউ ছিল না। দুই ছেলে আর মতিন। আমার গায়ের রঙটা আরো সমস্যা। 

কন্ঠটা বুঁজে আসে লিপির। খপ করে ধরে ফেলে জোনাকি লিপির অস্পষ্ট কন্ঠস্বর।

কী ধরণের সমস্যা? 

লিপি এবার ওর ঠোঁট জোড়ায় টিপতালা মেরে দেয়।  আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জোনাকিকে দেখতে থাকে। 

জোনাকি লিপির মত টকটকে ফর্সা নয়, চেহারা সুরতও চৌকশ নয়। 

নিজের গায়ের রঙ নিয়ে আফসোস ছিল জোনাকির কিন্তু হীনমন্যতা নেই কোনকালেই। এই মূহুর্তে লিপির দৃষ্টির কাছে আফসোসটা প্রকট হয়ে ওঠে।  তিনটে ঠেলাগাড়িতে  দীর্ঘদিনপর সংসার তুলে বিদায় নিতে আসে লিপি। জোনাকিকে জড়িয়ে ধরে। এই কয়টা দিনেই কতটা কাছে এসেছে দুজন মনের অজান্তেই। আজ যাবারকালে বিষয়টা প্রকট হলো। 

চোখ মুছে দুজনই।

সাবধানে থাকবেন,  আর যখন তখন ছাদে যাবেন না। 

আরো কিছু বলার উপক্রম করতেই দেখে ঘাড়ের কাছে মতিন সাহেব দাঁড়িয়ে। জোনাকির পিঠে হাত রেখে এগুতে থাকে আস্তে হাতটা সরে যায় লিপির দেহের টানে। 

লিপির কি মায়া পড়ে গেছে জোনাকির জন্য? ওকে ছাদে যেতে বারণ করলো কেন লিপি? 

পরদিনই পুরো সংসার ট্রাকে তুলে নিয়ে আসে আহাদ সাথে শাশুড়ীর আমলের  মিনার মা। 

নতুন উদ্যমে সব গুছিয়ে নেয়। নতুন বাড়ি দেখতে আসে জোনাকির মা বাবা। ফিরে যাবার সময় কোলের মেয়েকে জোনাকির কোলে দিয়ে যায়। নতুন বাড়ি এখন ঝলমল করে ওঠে সংসার আনন্দের  আপন বিভায়। 

এতোকিছুর মধ্যে ছাদটা প্রিয় হয়ে গেছে জোনাকির কাছে। খুব ভোরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, ছাদের সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে বই পড়ে গান শোনে। বিকেলে ছেলেমেয়েসহ ছাদে পাটি বিছিয়ে গল্প করে। ওরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে। জোছনা রাতে একাকী ছাদে হাঁটে। 

লিপির সাবধান বাণী মনেও পড়ে না জোনাকির। 

একদিন ভর সন্ধ্যায় কি কারণে যেন মেয়ে কাঁদছে তার শব্দ ভেসে আসে ছাদে। দ্রুত নামতে থাকে জোনাকি, হঠাৎ পেছনে ধাক্কা এবং ঘাড়ের কাছে  আঁচড় অনুভব করে,  তাল সামলে নিতে পাশের দেয়াল ধরতে ধরতে মনে হলো কে যেন আঁচল টেনে ওকে পড়ে যাওয়া আঁটকে দিল। পেছন ফিরে দেখে বাতাসে আঁচল উড়ছে। মেয়ের কান্নার শব্দ জোরে হতে ভেতরে চলে আসে জোনাকি। 

লিপি আর মতিন সাহেব এসেছিল ছেলের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিতে, স্কুলের কাজ সেরে মতিন সাহেব কাঁচা বাজারে ঢোকে তার আগে লিপিকে রেখে যায় জোনাকির কাছে। 

লিপি আজ সুযোগ পেয়ে খুলে দেয় ওর মনের অবরুদ্ধ জানালা। কীভাবে মতিনের মিথ্যে সন্দেহ তেতো হয়ে গিয়েছে ওর মিষ্টি জীবন। সন্দেহ মতিনকে মানসিক রোগীতে রুপান্তরিত করেছে। যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতেও প্রতিদিন স্বামীর সুস্থতা কামনা করে। সমাজের ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারে না,  এমনিতেই ঘরে দিবানিশি লাঞ্জিত হচ্ছে ঘটনার সত্যতা বিচার না করেই সমাজ ওকে লাঞ্জিত করবে। বড়বোনকে কিছুটা বলেছিল,  বড়বোনও মতিনের সাথে তাল মিলিয়েছে। হাড়ির একটা ভাতে টিপ দিয়েই পুরো সামাজিক অবস্থা বুঝে নিয়েছে লিপি। সহ্য করার নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে অসহনীয় জীবনটায়। বাড়ি বিক্রি করেছে লিপির সব গহনা বিক্রি করেছে। লিপিকে সামান্য প্রসাধনী কিনে দেয় না কোন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যায় না। সারাক্ষণ লিপিকে চোখে হারায়, সন্দেহ আর ভালবাসা এক বাড়িতে থাকে না,  নাকি থাকে বুঝতে পারে না লিপি। বুঝতে পারে না ওর রূপের কারণে না মতিনের ভালবাসার আধিক্য ওর সহজ যাপন মরণসম বাঁচা  হয়ে গেল। 

হাজারো যন্ত্রণার কথা বলতে ফুঁপিয়ে  কেঁদে ফেলে লিপি। 

মতিন ভাই কি তেমন কাউকে পেয়েছে যাকে ঘিরে সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে?

মুখ ফসকে বলে ফেলে জোনাকি 

সে আরেক যন্ত্রণার ইতিহাস। সন্দেহের পোকা মাথায় ঢোকার পর থেকে নানাভাবে খুঁজতে থাকে আমাদের আশেপাশের পুরুষ মানুষের দৃষ্টি কেমন তারা কীভাবে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আরেক পন্থা অবলম্বন করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি বলে আশেপাশে লুকিয়ে থাকতো। বাড়ির চারপাশে নজর রাখতো আমি কী করি কোথাও যাই কিনা,  কেউ আসে কিনা?  একবার গোপনে ছাদে ওঠে দেখে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা স্টেশনারি দোকানে বসে আছে এক তরুণ। লাগলো তার পেছনে। খবর নিয়ে জানলো দোকান মালিকের পুত্র স্থানীয় এক কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে বাবার কাজে সাহায্য করতে আসে। কিছুদিন তাকে নিয়ে খুব যন্ত্রণা দিতে থাকে। অথচ তরুণকে কিছুই বলে না,  একসময় তরুণ দেশের বাইরে চলে গেলে মতিন আবার আরেকজনকে আবিষ্কার করে তাকে নিয়ে যন্ত্রণা দিতে থাকে। 

রাতে ঘুম ভেঙে যায় জোনাকির।  ছাদে কারো হাঁটাচলা শব্দ রড টানাটানির প্রকট শব্দ। আহাদ আর মিনার মাকে জাগিয়ে ছাদে যায় জোনাকি। 

পুরো ছাদ থৈ থৈ করছে জোছনা। একখণ্ড রডও কোথায়ও পড়ে নেই। নিচের কলাপসিবল গেটে তালা, লোকজন আসবে কীভাবে!

আহাদ সহজ সমীকরণ দেয়,  পাশের বাসার কোন পরীক্ষার্থী রাত জেগে পড়ছে মাঝে মাঝে চেয়ার টানছে, রাতের শব্দহীন সময়ে সামান্য শব্দটাই জোরে বাজছে জোনাকির কানে। হাই তুলতে তুলতে নিচে নেমে যায় আহাদ। ঘুম ভাঙা বিরক্তি নিয়ে আগেই নেমে গেছে মিনার মা। 

মাতাল জোছনায় হাঁটছে জোনাকি। কেউ যেন পিঠে দু'হাত দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। অনুভূতিটা প্রবল হতেই ব্লাউজের একটা অংশ ধরে টেনে ধরার অনুভব টাও টের পায়। 

থমকে দাঁড়ায় জোনাকি, ফেলতে যাওয়া পায়ের পাতাটা  যদি ফেলতো তাহলে সেটা ছাদের কংক্রিটে নয় শূন্যে ফেলতো ফলাফল হতে পায়ের টানে জোনাকির শরীরটা মাটিতে গিয়ে পড়তো। নিশ্চিত দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেল!  

একটু সুস্থির হয়ে খেয়াল করে কেমন করে এতোটা কিনারে চলে এলো,  নিজের উপর কি নিয়ন্ত্রণ নেই ওর!

ওর পেছনে কারা এই অশরীরী। একজন ধাক্কা দিতে চায় অন্যজন আঁটকে দিতে চায়। 

পড়িমরি করে নামতে থাকে জোনাকি হঠাৎ ঘাড়ের কাছে নখের আঁচড়ের স্পর্শ পায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে ওর কানের কাছে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়,  পেছন ফিরতেই মনে হয় একটা ছায়া আঁধারে মিশে গেল। এবার সমস্ত শরীর জুড়ে ভয়ের কাঁপুনি শিরদাঁড়া দিয়ে আতংকের ঢল নামে। 

দৌড়ে এসে ঘরের ছিটকিনি আঁটকে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে ভেতরে ভয় নিয়ে। 

ভোরের আলো ফুটতেই ভয় নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। জোনাকি মনের ভেতরের দ্বিধা নিয়ে তাকায় দিনের প্রথম আলোর দিকে।

ওর বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে কোনদিন কোন কথা গোপন করেনি আহাদের কাছ থেকে। এই প্রথম যতবার রাতের ঘটনা দিনে বলতে চেয়েছে ততোবারই লিপির দুঃসহ জীবন জটিল যাপনের চিত্র লিপির চোখের জলে ভেসে ওর কাছে এসেছে।

আহাদও যদি মতিনের মত ভুল বুঝে ওকে ওর সুস্থির যাপনকে অস্থির করে তোলে!

জোনাকি তো ছোটবেলা থেকেই অন্যদের তুলনায় সাহসী। এতোদিনে তো বুঝতে পারছে দীর্ঘশ্বাস আঁচড়ের বিষয়টা শুধু ওর সাথেই হচ্ছে আর কারো সাথে নয়। ছেলেমেয়েদের একা একা ছাদে না দিলেই সমস্যাটা কাটান যাবে।

একরাতে আহাদ বাসায় নেই। ওর ব্যবসায়ের দুজন লোকও বাসায় নেই। ছেলেমেয়ে দুজন পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। মিনার মা নিচে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যাবেলায়ই।

মাথার কাছের জানালা খুলে ঘুমিয়েছে জোনাকি।

প্রবল আলোর স্রোতে ঘুম ভেঙে যায় ওর। এতো ভুলো মন ওর,  আলো জ্বেলে ঘুমিয়েছে!  ওঠে লাইট নিভিয়ে পাশ ফিরে শুতেই লাইট জ্বলে ওঠে। ওর সমস্ত শরীরের লোম কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিরাতে কলাপসিবল গেটে তালা দেয়া, ভেতরের কাঠের মূল দরজা হুড়কো টেনে বন্ধ করা, প্রত্যেক ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়া। ও নিজে করে। কখনো ভুল হয় না।আজও হয়নি। তাহলে? জোরে মিনার মাকে ডাকতে গিয়ে গলা জড়িয়ে আসে ভয়ে।

লাইট নিভে যায়।কেউ যেন পুরো ঘর জুড়ে হাঁটছে এলোপাথাড়ি। উপস্থিতি নিরব হলেও অনুভব সরব। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

ভয়ে কলজে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড তৃষায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিতেও সাহস হচ্ছে না।

অশরীরী হেঁটে চলছে অবিরাম। হুট করে খুলে যায় দরজা। হু হু করে দমকা বাতাস ঘরে ঢোকে। জোনাকি বুঝতে পারে বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বইছে। ভয়ংকর কড়কড় শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অঝোর বৃষ্টি আওয়াজ বুঝতে পারে। চাদর আর বালিশে সর্বাঙ্গ মুড়ে অধমরা হয়ে পড়ে থাকে। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসও অচেনা মনে হয়।

অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারে অশরীরী আর নেই। তবুও মুখের ওপর থেকে বালিশ সরিয়ে চাদরের তলা থেকে বের হবার সাহস শক্তি কোনটাই অবশিষ্ট নেই জোনাকির। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, সাথে থাকে ভোরের প্রতীক্ষা।

দিনের সূচনা হতেই দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ায়। গতরাতের ঝড়বৃষ্টির কোন লক্ষ্মণ দেখতে পায় না জোনাকি। তবে পেছনে কারো উপস্থিতি টের পায় ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখে মিনার মা দাঁড়িয়ে আছে।

আলতো স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস আর গভীর রাতে ছাদে রড টানাটানি নিয়ে কেটে গেছে এবাড়িতে কয়েক বছর।

সরকার বিহারি কলোনীর দায়িত্ব দেয় পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর। আহাদ দৌড়াতে থাকে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে দলিল নিজের নামে করার জন্য। মন্ত্রণালয়ে দৌড়াতে গিয়ে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার বলেছে শালা মতিন তুই বড় ধড়িবাজরে। ফাউ ফাউ কতগুলো টাকা নিয়ে গেলি আমার কাছ থেকে।

সরকারি মূল্য পরিশোধ করেই নিঝঞ্ঝাট মালিকানা বুঝে সুস্থির নিশ্বাস ফেলে আহাদ।

আহাদের সাথে জোনাকিও দৌড়াতে থাকে বাড়ির  আদি মালিকের খোঁজে। বিজলি মহল্লার সেখানেই পায় চুন্নু বকশীকে। বয়স আশির কোটা ছুঁই ছুঁই। সহজে মুখ খোলে না। সরু দৃষ্টিতে তাকাতো জোনাকির দিকে।পরে এনজিওর লোক ভেবে অনেক তথ্য দিয়েছে।

জোনাকিদের বাড়ির মূল মালিক  ছিল আরফান খান। সে ছিল এই রোডের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী। যেমন ছিল তার টাকার অহংকার তেমনি ছিল তার সৌখিনতা আর বদমেজাজ। তার ছিল অসম্ভব সুন্দরী তিন কন্যা। বড়মেয়ে লাভলী বেগমের সাথে গোলার টেকের বাঙালি তরুণ কামালের প্রেম হয়ে যায়। কথা জানাজানি হয়। পুরো দেশ জুড়ে তখন ঊনসত্তরের উত্তাল সময়।

আরফান খান পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হলেও বিহারের জামশেদপুরের পাঁচ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আসা খান বাঙালি সমাজকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। প্রথম জীবনে অভিজাত স্বচ্ছল অবস্থান থেকে পরবর্তী জীবনে রিফিউজি।  এদের কোন দেশ নেই। দেশপ্রেমও নেই। থাকে না মাটির প্রতি সংযোগ।

ঊনসত্তরের উত্তাল আন্দোলন এদের পুনরায় রিফিউজি জীবনে পর্যবসিত করতে পারে, সেই শংকাও ভেতরে তীব্রভাবে কাজ করে। অন্যদিকে কামাল একজন খাঁটি বাঙালি পরিবারের সংস্কৃতিমনা সন্তান।

আরফান খান কামালের সাথে একান্তে কথা বলতে চান। শুনে আনন্দে আত্মহারা লাভলী। তার অহংকারী পিতা তার প্রেম মেনে নিয়েছে এরচেয়ে পৃথিবীতে আনন্দের আর কী আছে। লাভলী নিজেই কাবাব বানাতে বসে যায় ওর বোনেরাও দুএক পদ তৈরি করে,  বিশেষ পদ তৈরি করে আরফান খান নিজে। 

পরদিন ভোরে আশেপাশে লোকজন দেখতে পায় তুরাগে জলে কামালের দেহের নিম্মাঙ্গ এবং জলের উপর পাড়ে শুয়ে আছে উর্ধাঙ্গ। 

পরদিন বিকেলেই আরফান খানের পরিবারে  আরেকটি জানাজার আয়োজন করতে হয়। 

লাভলী ঝুলছিল তাই কামালের দেয়া মহরমের মেলা থেকে কেনা ওড়না গলায় বাঁধে। 

চলে যাবার আগে জেনে গিয়েছিল আরফানের নিষ্ঠুর চাতুর্য। 

হেরে গেল আরফানের  ভয়ংকর মানসিকতার কাছে কামাল আর লাভলীর প্রেম। 

দেশ স্বাধীন হবার পর ওরা এদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়। 

চুন্নু বকশী এটুকুই জানে। 

সেদিনের সেই একতলা বাড়িটা ছ'তলা হয়েছ। 

একতলা  দোকান এবং দোতলা অফিস  কমার্শিয়াল হিসাবে ভাড়া তিনতলা চারতলা জুড়ে জোনাকির ভরভরন্ত সংসার। পাঁচতলা ছতলা দু ইউনিট করে চার ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া। 

এতো বছরে কত ভাড়াটিয়া এলো গেলো,  কেউ কখন লিপির আর জোনাকির সমস্যার কথা বলেনি। 

এখন ছাদ বাগানে জোছনা রাতে হাঁটাহাঁটি করে দোলনায় দোল খায় জোনাকি। রোজ বিকেলে বাগানের যত্নআত্তি নিজেই করে। 

দীর্ঘকাল দীর্ঘশ্বাস আর আঁচড়ের স্পর্শ পায় না। 

সেদিনের সেই দোকানটাও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়েছে। ক্যাশ কাউন্টারের আরামদায়ক চেয়ারে বসে পৌঢ় ভদ্রলোক। 

তার দিকে তাকিয়েই দীর্ঘকাল পরে লিপির জলভরা চোখ জোড়া মনে পড়ে।

বুক কাঁপিয়ে বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সোনাকির।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024