উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -19




 অবশ্যই দেখুন, কিন্তু আমার অনুরোধ জুতো পরে ভেতরে প্রবেশ করবেন না । পতিতালয় হলেও আমাদের এই ভগ্ন কুটিরে দেবতা বিরাজ করেন । 


ভেরি সরি । ঠিক আছে আমি এখান থেকে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিচ্ছি ।


 সে আপনার ইচ্ছে স্যার । অফিসার টর্চের আলোতে ভেতরটা লক্ষ্য করতেই উনি বললেন , ভেতরে একজন শুয়ে আছে উনি কে আপনার ? 


আমার পঙ্গু স্বামী , তিনি রোগ শয্যায় আছেন । প্লিজ ওকে জাগাবেন না । বহু কষ্ট করে ওকে ঘুম পাড়িয়েছি । জাগিয়ে দিলে সারারাত ঘুমাতে পারব না । 


অফিসার বললেন , ওকে জাগাবার দরকার নেই । আপনি অতি ভদ্র , আপনার ব্যবহারে অত্যন্ত খুশী । কিছুক্ষণের জন্য আপনার ঘুম নষ্ট করলাম বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।


এখন আসি ওরা যাবার পর কপাটের খিল লাগিয়ে পাঞ্জাবীর কাছে এসে বলল , এবার উঠে পড়ুন দাদা । পুলিশ চলে গেছে । লোকটা তক্তাপোষের উপর বসে বলল , বহুত আচ্ছা কাম করেছিস বহেন । হামার নাম শিবাজী সিং আছে । এ এলাকার বহুত বড়া গুন্ডা আউর মাফিয়া আছি । লেকিন হামি সচকা পূজারী আছি । কোই আদমী বুরা কাম করলে বেইমানী করলে হামি তাকে বাঁচতে দেবে না । এক বড়া বেইমানি অফিসার কো জানসে মার দিয়া , ইসলিয়ে হামাকে জানসে মারনেকে অর্ডার দিয়া উঁচা মহলকা অফিসার। হামার মাথার দাম আছে পাঁচ লাখ রূপায়া । লেকিন তু এ লাইনমে ক্যায়সে আয়ে বহিন ! তু বহুত বড়া আদমীকে লেকড়ী আছিস । 


শ্যামলী বলল , আপনাকে সব কথা জানাচ্ছি । আপনি শুনুন । সংক্ষেপে প্রকাশ করল শ্যামলীদি । আমি পাশের ঘর হতে হাজির হয়েছি পুলিশরা প্রস্থান করতেই । প্রকাশ করার পর শ্যামলীদির চোখ দুটো জলে ভরে গেল । 


শিবাজী সিং শ্যামলীদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল , রোনা মত্‌ বহিন এবার বোল হামার দ্বারা কুছ কাম হোবে ? শ্যামলী বলল , হ্যাঁ দাদা , এই লোকটাকে খোঁজ করে বের করতে হবে । আমি আপনাকে ওর একখানি ফটো দিচ্ছি । আপনার কাজে লাগবে । শ্যামলী ডায়রী হতে ফটোটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল , এই কুলঙ্গার আমাদের ২ জনকে এই পতিতালয়ে বিক্রি করেছে । শিবাজী সিং দাঁতপাটিকে কড় কড় করে বলল , সোচ্ ম বহিন । তোরা হামার বহিন আছিস্ । হামি তোদেরকে কথা দিলাম , এই আদমী কো জলদী সে হাজির করবো তুমলোগকা পাশ । হামারা পত্তা লিখলো । কৌন কাম কে জরুরত হোবেত হামরা পাশ চলা জানা , কৌই ডর নেহি । হাম ঐ শালাকো ফটো লিয়ে যাচ্ছি । হাম চলতা বহিন , এ জায়গা মে রহনা ঠিক হোবে না । চলে বহিন তুমলোক শো যাও ।


 শিবাজী সিং বেরিয়ে গেলো । শ্যামলীদি ওর পিছন পানে তাকিয়ে দন্তে দত্ত চেপে আপন মনে বলতে শুরু করল , এবার পল্টু বাবু আর কতদিন লুকিয়ে থাকবে মশাই । তোমাকে একটি বার কাছে পাবার জন্য অনেক সাধনা করেছি , কিন্তু বারে বারে তুমি আমার নাগালের বাইরে চলে গেছো । যে কোন উপায়ে তোমায় দর্শন এবার পাবই ।


 তারপর শ্যামলীদি দাঁতগুলো বজ্রের মত কড়মড় করতে থাকল । শিবাজী সিং এর আশ্বাসে শ্যামলীদি পল্টু কে যেন নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলল । প্লটুর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত শ্যামলীদির জীবনে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ দারুন বেড়ে গেলো । শ্যামলীদিকে শোবার জন্য অনুরোধ করলাম দুজনে পুনরায় শুয়ে পড়লাম । রাত যে কত হবে ঠিক জানা নেই । শোবার একটু পরেই ধীরে ধীরে বেহুঁশ হয়ে পড়লাম । 


পরদিন ময়নার কথা মনে পড়তেই চোখ আমার ছল্ ছল্ করতে থাকলো । আমার জীবন তো মরুভূমি । তাই এই মরুভূমির মধ্যে ময়নাকে মরূদ্যান ভেবে নিয়েছি । ময়নার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার পর থেকে এক অনাস্বাদিত পূর্ণ পলকে আমার দেহমন ভরে উঠেছে ।


 শ্যামলীদিকে বললাম ময়নাকে দেখতে যাবার জন্য । তাকে পিড়াপিড়ী করাতে সে বলল , নিশ্চয় যাবো । কেন যাবো না ? ময়না তোর গর্ভজাত সন্তান না হলেও তুই মায়ের দায়ীত্ব স্কন্ধে নিয়েছিস । সে দায়িত্ব তোকে জীবন দিয়ে পালন করতে হবে মনে রাখিস । এটাই নারী জাতীর আদর্শ ।


 আমার কাছ হতে সরে পড়লো শ্যামলীদি । তার অভিমান ও ক্ষোভের কারণ কিছুটা অনুমান করলাম । সেও তো চেয়েছিল পাঁচজন নারীর মতো মা হতে , একটা ছোট্ট সংসারে সুখের নীড় বাঁধতে । কিন্তু বিধাতা তা হতে দেয়নি । ভদ্র মানুষের সমাজ হতে আমার মতো তাকেও আবর্জনার মতো দূরে সরে যেতে হয়েছে । আর কি অতীত সে ফিরে পাবে ? 


অকস্মাৎ দেবী বাবুর ডাকে আমার চিন্তার সূত্র কেটে গেল । বললাম , ভেতরে আসুন বাইরে কেন ? আমার অভ্যর্থনায় দেবী বাবুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । একটু বসুন , চা করি । 


দেবী বাবু কোন আপত্তি করলেন না । দেবী বাবুকে ঘরের চারিপাশ দেখতে দেখে বললাম , কি দেখছেন ? আপনার বাড়ির মতো আমাদের বাড়ীতে এতো আভিজাত্যের ছড়াছড়ি আছে কি , নেই । মনে রাখবেন এটা পতিতালয় । আপনাদের বাড়ীর মতো পবিত্র পরিবেশ খুঁজলে মিলবে না । কিন্তু আমাদের এই পাপ দেহের অভ্যন্তরে চিরন্তন নারীমন সুপ্ত হয়ে আছে । অনুকূল পরিবেশ পেলেই এই শাশ্বত নারীমনের জাগরণ ঘটবে । দেবী বাবু কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন , বাধা দিয়ে বললাম একটু বসুন , চা করে আনি তারপর আপনাকে কথা শোনাব । খানিক পরে প্রবেশ করে দেখলাম তিনি কিসের চিন্তায় মগ্ন হয়েছেন । মনে হল তার অতীতের ফেলে আসা দিনগুলির কথা চিন্তা করছেন । তিনি কত উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রহীন সমাজ বিরোধী ব্যক্তি ছিলেন । এই কলঙ্কিত জীবনের পাপ অজিতাকে মর্মে মর্মে দগ্ধ করেছে । একজন পতিতা তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য যেভাবে নারীত্বের গৌরব নিয়ে নিজের জীবনকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে তুলেছে তার নজির মেলে না ।


 ঈশ্বর কত রকমের মানুষ সৃষ্টি করেছেন । এই দেবীবাবুই একদিন কি ছিলেন । সেই অমানুষটার আজ কত পরিবর্তন ঘটেছে । কার জন্য এই পরিবর্তন ? নিশ্চয় এই পরিবর্তনের পিছনে কোন মহৎ প্রেরণা আছে। 


সহসা দেবীবাবুর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো । আমার পায়ের শব্দে তিনি চমকে উঠলেন । একি , কি ভাবছেন ? ভাবছেন আমি যাবো না , এই তো ? দেবীবাবুর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো । 


তিনি বললেন , না মানে ---


কোন ভয় নেই । নিন চা খান । ময়নাকে যখন মেয়ে বলে মেনে নিয়েছি ওকে না


সুস্থ করে ছাড়বো না । আপনি না এলেও যেতাম । শুধু আমি নই , শ্যামলীদিও আজ যাবে । দেবীবাবুর আনন্দ হল না তা নয় । 


কিন্তু ওর মুখ পানে তাকিয়ে থাকাতে তিনি মুখখানি নিচু করলেন । বুঝতে পারিনি । আমার চোখ দুটো কেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে চেয়েছিলো । আগে কতবার তো ওকে দেখেছি , কিন্তু কিসের লালসা জানিনা । কয়েকবার ঢোক গিললাম । কেন এমন হল । বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কোন উত্তর পেলাম না । বার বার মনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে মনের কপাটকে খুলতে পারলাম না । অবশ্য একথা আমি আজো বিস্মৃতি হয়নি যে আমি একজন বারবনিতা ।


 একজন ভদ্র এবং আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তির কাছে আশ্রয় পাওয়া আমার স্বপ্নের অগোচরে , লোভ আমার নেই , বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার ক্ষমতাও আমার নেই , কিন্তু এক মহান কর্তব্যের আহ্বানে ছুটে চলেছি । সেইজন্য দেবীবাবুর পরামর্শ মতো কাজ আমাকে করতেই হবে । আমার নারীমনে কখন যে প্রেমের জোয়ার এসোছিল বুঝতে পারিনি । ক্ষণিকের তরে ভুলে গেলাম পতিতার জঘন্য নোংরামী , নিশি - যাপনের দুর্নিবার মোহ । আমি তখন আমার হৃদয় - মন্দিরে প্রেমের দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি । তখন আমার দেহ মন্দির পবিত্র সৌরভে সুরভিত হয়ে গেছে , আমার অন্তরে বিকশিত হয়েছে সতীত্বের শ্বেত শতদল । একসময় সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দেবীবঝুর সাথে আমরা উভয়ে বেরিয়ে পড়লাম।


                                 ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024