উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -26


 

আমি দৌড়ে এসে শ্যামলীদিকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। অসহ্য জ্বালা কোন প্রকারে দমন করতে পারলাম না। শ্যামলীদির চোখ দুটো জলে ভরে এলো। বহু কষ্টে অস্ফুট গলায় বলল, আর পারলাম না রে তোর বাবাকে বাঁচাতে। তোর কাছেও থাকার দিন ফুরিয়ে এলো। ভালোভাবে থাকিস। বাবাকে নিজের পরিচয় দে, বাকী জীবন আর ফুটপাতে কাটাতে দিস না। আসি রে।

 শ্যামলীদি চলে যেতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কাঁদতে থাকলাম। একি করলে ঠাকুর, তুমি কি সদা সর্বদাই নির্দয়? এই পতিতার কান্না তোমার হৃদয়ের রুদ্ধ দুয়ারে কি আঘাত করতে পারে না? অসহায় নারীর দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল এমনি করেই কি ব্যর্থ হবে? না, ঈশ্বরকে ডেকে কোন লাভ নেই।

 শ্যামলীদিকে আমার কাছ হতে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো, ওকে আর কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এবার আমাকেও মরতে হবে। হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তির শিকার হতে হবে ও লাঞ্ছনায় জীবন কাটাতে হবে।

 আমিও থানাতে যাবো, গিয়ে বলবো, আমিও তো এই দুঃকর্মে শ্যামলীদিকে পরিপূর্ণভাবে সহযোগিতা করেছি। সেজন্য আমি কি অপরাধী নই? শ্যামলীদির সঙ্গে একই কারাবাস গ্রহণ করব।

হঠাৎ কাসার বাসন পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম, তাকিয়ে দেখি বাবা এগিয়ে আসছেন দরজার দিকে। কয়েক মুহুর্ত বাবার কথা ভুলেছিলাম। এগিয়ে আসতে দেখে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জাপটে ধরলাম এ কারণে টিনের ছাউনি বলে সামনে একটা লোহার দণ্ডের কিছুটা অংশ বেরিয়ে আছে, ওতে ধাক্কা মারলে বাবার মাথায় ভীষণ আঘাত লাগবে। বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই বললেন, কে, মা তুমি? এমন করে জড়িয়ে ধরলে কেন ?

আমার মুখ বন্ধ। কোন কথা বলতে পারলাম না। থর থর করে ঠোঁট কাঁপতে থাকলো। কি করে কথা বলবো। আমার কণ্ঠস্বর যে অতি পরিচিত। চোখ দিয়ে টপ্‌ টপ্ করে জল ফেলা ও ঠোঁট কাঁপানো ছাড়া কোনো পথ পেলাম না।

বাবা দ্বিতীয়বার বলে উঠলেন, কি হলো মা, কথা বলছো না কেন? আবার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করলো। কোন প্রকারে ঘৃণায়, লজ্জায়, দুঃখে কথা বলতে পারলাম না। আমি বোবার মত অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলে বাবাকে বুঝিয়ে দিলাম। আমি একটি বোবা মেয়ে।

বাবা সহজে ধরে ফেললেন যে আমি বোবা। বললেন, তুমি বোবা, কথা বলতে পারো না? ওঃ ভগবান একি তোমার বিচার প্রভু, এ সংসারে কেউ বোবা, কেউ অন্ধ। এই সুন্দর ধরণীতলে তাদের জীবন বিড়ম্বনাময় হয়ে ওঠে এটা কি তুমি জানো দয়াল ? পৃথিবীর সৌন্দর্য্য সূর্যালোক, বৃক্ষের মর্মর ধ্বনি, নদীর কলতান, পাখীর কাকলি এইগুলো কি তাদের জন্য নয়? মা আমাকে একটু রাস্তায় বের করে দেবে? যদি বা একজনের কাছে আশ্রয় পেলাম তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো। আর কত কষ্ট দেবে ঠাকুর? তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো যাবার ক্ষমতা আমার নেই। জানি না কি এমন পাপ করেছিলাম যে এভাবে আমাকে তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে? মা আর দাঁড়িয়ে কেন, রাস্তায় নিয়ে চলো। বাবার কথায় বিচলিত হলেও তাকে রাস্তায় বার করে দেওয়া ছাড়া তখন আর কোন আমার গত্যন্তর ছিল না। -

বাবাকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে বিছানায় এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। এটাই আমার কাছে শেষ প্রাপ্য ছিল। একটু পর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বিছানা হতে উঠে ঘরের ভেতরে এসে কপালে করাঘাত করতে থাকলাম। এই পোড়া কপালীর বেঁচে থাকার কি সার্থকতা আছে। নিজের জীবনকে ধিক্কার দিতে থাকলাম! মৃত্যুই আমার শ্রেয়।

 হঠাৎ আমার হৃদয় অন্য রূপ ধারণ করল। না! আমি মরব না, আমি বাঁচব, বাঁচতেই হবে, দেখতে হবে আমার জীবনের চরম পরিণতিকে। যদি এর চেয়ে আরো

কঠিন শাস্তি পেতে হয়, তা নেবার জন্য প্রস্তুত থাকবো। সে সময় মনে পড়লো শ্যামলীদির কথা, সে বলেছিলো এ জীবন নিয়ে যদি বাঁচতে হয়, এই অধঃপতিত জীবনের জ্বালা যন্ত্রণা যদি ভোগ করতে হয় তাহলে সুরাপান করতে হবে। এতে অনেক শান্তি পাওয়া যায়, দুঃখে সুখ পাওয়া যায়, দুর্বলে শক্তি পাওয়া যায়। হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমিও মদ খাবো, সব দুঃখ, যন্ত্রণাকে ভুলতে চাই। বিলম্ব না করে শ্যামলীদির পথ অনুসরণ করে আমার হৃদয় দৌর্বল্যকে সতেজ করে তুলবো সুরাপানে।

উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এলাম এক দোকানে, যেখানে মদ পাওয়া যায়। এক বয়কে বললাম। এক বোতল মদ মিনিটের মধ্যে শেষ করলাম। আরো চাই। পর পর দু'বোতল খাওয়ার পর আমি যেন চারিদিক অন্ধকার দেখলাম। সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে গেলো। আমি মদের নেশার ঘোরে আরেক বোতল চাইতে কে যেন শক্ত কঠিন হাতে আমাকে চেপে ধরলো। তার মুখের দিকে তাকিয়েও চিনতে পারলাম না। ধীরে ধীরে সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলাম। তারপর

তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো আমি আরামদায়ক খাটের উপর শুয়ে আছি। মাথার উপর বনবন করে একটা বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। ঐ সব দেখে আমার মনে একটা চমক সৃষ্টি হলো। দেখলাম বাড়ীর জানালার কাছে পিছন ফিরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

ধীরে ধীরে লোকটার কাছে গিয়ে বললাম, শুনছেন ? আমি কোথায় এসেছি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে কি আমায় আপনি - দিগন্ত পানে দৃষ্টি নিবন্ধ করে ভদ্রলোক আমার পানে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বিস্ময়ে ভরে উঠল। ভদ্রলোকের মুখখানি দেখে বললাম, দেবীবাবু আপনি!

কেন, আমাকে দেখে বিস্মত হয়েছেন নাকি? আমিই আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় দুলু ঘোষের দোকান হতে তুলে এনেছি। কিন্তু আমার অন্তরে এখন এক প্রশ্নের তুফান ছুটছে, কেন বোতলের পর বোতল মদ খাচ্ছিলেন। আপনাকে পৌঁছে দেবার জন্য বক্তীতে গিয়েছিলাম, ওখানে শ্যামলীকেও দেখতে পেলাম না। তবে কি

ওকে পুলিশে নিয়ে গেছে। পুলিশে নিয়ে গেছে। কেন ?

সে কথা বলার সময় নেই। আমাকে বস্তীতে ফিরে যেতে হবে, এখন আসি। কয়েক পা এগিয়ে এসে দরজার কাছে পৌঁছতেই চোখে পড়লো কাঠের বড় ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবিকে। ঐ ছবিখানি দেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে দেবীবাবুকে বললাম, এই ছবিখানি কার বলতে পারেন ?

দেবীবাবু মন্থর পদে কাছে এসে বললেন, এটা আমার অন্তরঙ্গ শুভাকাঙ্খী এক পরম বন্ধুর। একজন চরিত্রহীন লম্পটের হাতে অসহায়ভাবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

ঐ যুবকটিকে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ।

আমাকে সেই হত্যাকারীর কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?

কেন ?

প্রতিশোধ নেব।

সুমস্ত আপনার কে?

আমার দাদা।

কি বললেন, আপনার দাদা? দেবীবাবু একরকম চমকে উঠলেন। চমকে উঠলেন কেন? যে দাদাকে খুন করেছে তাকে আমি সহজে ছাড়বো না। কারণ দাদার মর্মান্তিক অকালমৃত্যু আমাদের সংসারকে ঝটিকা বিক্ষুব্ধ করে দিয়ে গেছে। ওর জন্য আমি ছিন্নমূল ব্রততীর মতো কলকাতার পতিতালয়ে অধঃপতিত জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছি, নারী জাতির মর্যাদা হারিয়েছি, জীবনের মূল্যবোধ আমার নষ্ট হয়ে গেছে। এমন কি বাবা অন্ধত্ব বরণ করে কলকাতার রাজপথে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন। আমাদের সুখের সংসারকে তছনছ করেছে? আমি দাদার হত্যাকারীর চরম প্রতিশোধ না নিয়ে আমি ছাড়বো না।

দেবীবাবু, অর্থের বিনিময়ে আপনার মেয়েকে সুস্থ করে তুলেছি সত্য, কিন্তু এর পরেও কি কিছু পাওনা থাকতে পারে না?

দেবীবাবু ঘাড় নাড়লেন। যদি পাওনা থাকে তাহলে ঐ হত্যাকারীকে চিনিয়ে দিন। প্লিজ দেবীবাবু, আমি আপনার পায়ে পড়ে বলছি। কিন্তু

কোন কিন্তু নয় দেবীবাবু। প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। নইলে শাড়ীতে ভেজানো একখানা ছুরি বের করে বললাম, এই ছুরি খানা ওর বুকে বসিয়ে দেব। আমাকে ওই পাষন্ডটার কাছে নিয়ে চলুন।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024