ছোট গল্প - মৃত্যুই শেষ নয় || লেখক - তনিমা সাহা || Written by Tanima Saha || Short story - Mrityuy ses noi


 


মৃত্যুই শেষ নয়

তনিমা সাহা



সাবিত্রীর হাত-পা গুলো শুষ্কতার জন্য ফেটে গেছে। সেখান থেকে এখন রক্ত বেরোচ্ছে। সাবিত্রীর দুচোখ বেয়ে ঝরে পরছে গরম নোনা জল। তবে যতটা না শারীরিক কষ্টের জন্য সে কাঁদছে, তার চেয়েও বেশি কাঁদছে মনের যাতনার জন্য। আজ দুমাস হয়ে গেল মকবুল নেই। পুরোনো অভ্যেসে বালিশের তলায় হাত দিয়েই জোর চমকে উঠল সাবিত্রী।



ভালবাসার বিয়ে মকবুল আর সাবিত্রীর। গরীব বলেই হয়তো বিধর্মে বিয়ে করতে বেগ পেতে হয় নি তাদের বিশেষ। পয়সাওয়ালাদের তো দেখে কিছু একটা হলেই ইয়া বড়ো বড়ো করে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে! কিন্তু তাদের বেলায় পরম দয়াময়ের কৃপায় সেসব কিছুই হয় নি। রিক্সা চালাতো মকবুল আর সাবিত্রী তিনটে বাড়ির রান্নার কাজ করত। কোনোরকমে টেনেটুনে ঠিক চলে যেত ওদের সংসার। খুব সুন্দর হাতের কাজ জানতো মকবুল। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তার পড়াশোনা বা শিল্প ওইসব দিকে কিছু করা হয়ে ওঠেনি। তবে মকবুলের তাতে কোন আফসোস ছিল না। 


সে বলতো, 'জানো তো সাবিত্রী আল্লাহ্ কখনোই সবদিক থেকে আমাদের মারে না। বই পড়া হয়তো বা হয়নি কিন্তু শিল্পকে আমি ছাড়িনি।' 



বিবাহবার্ষিকীতে মকবুল বিভিন্ন সাজের জিনিস দিয়ে কখনও ফুলের মতো বা কখনো অন্য কিছুর আকার বানিয়ে উপহার দিত সাবিত্রীকে। সারাবছর সাবিত্রীর তাতে চলে যেত। মকবুল কী করে যেন আগে থেকেই সাবিত্রীর সব প্রয়োজনের কথা বুঝে যেত। সাতটা বছর ধরে যেন আলোর বন্যায় ভাসছিল তারা। প্রথম প্রথম তারা বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুতেই গর্ভধারণ করতে পারছিল না। ডাক্তারের কাছে যেতে তিনি কি যেন বড়োসরো একটা রোগের নাম বললো, আর তার নামের থেকেও বড়ো ছিল চিকিৎসায় খরচের অঙ্ক। স্পষ্টতঃই সাবিত্রী বুঝতে পেরেছিল যে তাদের কখনো বাচ্চা হবে না। খুব কেঁদেছিল তখন সে। 


মকবুল তাকে দুবাহুতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, 'আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। একদিকে ভালই হয়েছে! আমাদের এই টানাটানির সংসারে যদি সে আসতো তাহলে সত্যিই কি আমরা তার জন্য কিছু করতে পারতাম। তারচেয়ে একটা কাজ করলে হয়! আমরা যদি এক/দুজন পথশিশুর খাওয়াপরার দায়িত্ব নেই তাহলে কেমন হয়। হয়তো খুব বেশি কিছু করতে পারবো না। কিন্তু ওদের একবেলার খাবার, বছরে একবার জামা-কাপড় দিতে পারবো। তাতে তুমি একজনের নয় অনেকজন বাচ্চার মা হতে পারবে।' 



সাবিত্রী বলল, 'কিন্তু মকবুল তাহলে তো আমরা কখনও টাকা-পয়সা কিছুই জমাতে পারবো না। যখন আমাদের বয়েস হবে বা ভগবান না করুক যদি আমরা অসুস্থ হয়ে যাই তখন তো আমাদের কাছে চিকিৎসার জন্যও পয়সা থাকবে না। তখন আমাদের কী করে চলবে মকবুল।' 



হেসে মকবুল বলেছিল, 'ওসব চিন্তা আল্লাহর উপরই ছেড়ে দাও! যখন উঁনি আমাদের উপায় বলেছেন তখন দেখবে ওই উপায়কে পাওয়ার পথটাও উঁনিই বলে দেবেন।' 


মকবুল কখনওই সাবিত্রীকে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কিছু বলেনি। মকবুল বলতো সবই 'এক শক্তি'। আমরা আমাদের মনের মতো তাকে সাজিয়ে নেই। তাই তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম ভিন্ন ভিন্ন আকার। সাবিত্রী মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল মানুষটির মানসিকতায়। নিজেকে মনে মনে গরীব হওয়ায় ভাগ্যবতী ভাবলো সে। ভাগ্যিস! মকবুলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিল। আর্থিক ভাবে নির্ধন হলেও মানুষটি মনের দিক থেকে ছিল চরম ধনী। এরজন্য কতবার যে সাবিত্রী নিজের ঠাকুরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে তার হিসেব নেই। 


একদিন এমনই পথশিশুদের খাওয়ানোর সময় কোথা থেকে এক বেপরোয়া লড়ি এসে চোখের সামনে রাস্তায় পিষে দিল মকবুলকে। সাবিত্রীর গোটা জীবনটা যেন সেখানেই শেষ হয়ে গেল। কতবার ভেবেছিল নিজেকে শেষ করে মকবুলের কাছে চলে যাবে। কিন্তু তখনই পথশিশুগুলোর মুখ ভেসে উঠতো তার চোখের সামনে। আজকাল তো তার মনে হয় মকবুল যেন তার আশেপাশেই কোথাও আছে। মকবুলের মনটা খুব শৈল্পিক ছিল। যখন কথা বলতো তখন যেমন গুছিয়ে বলতো তেমনই সব জিনিসকে জায়গামতো গুছিয়ে রাখতো যাতে হাত দিলেই পাওয়া যায়। যেমন গরমের সময় পাঁচবাড়ির কাজ করতে করতে বেশি জলঘাঁটার জন্যে সাবিত্রীর সারা পায়ে হাজা হতো। তখন মকবুল একটা হাজার মলম নিয়ম করে সাবিত্রীর মাথার বালিশের নিচে রাখতো যাতে সাবিত্রী হাত দিলেই পেয়ে যায়। শীতকালে তার জায়গায় স্থান নিত বোরোলিন। বিয়ে হওয়া ইস্তক এই নিয়মই চলে আসছে।



আজ ফিরতে বড্ড রাত হয়ে গেছে সাবিত্রীর। যে পথশিশুগুলোকে সাবিত্রীরা দেখাশোনা করতো তারমধ্যে বুলবুলি হল সবচেয়ে ছোটো। বুলবুলিটা আজ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রান্নার কাজগুলো শেষ করেই বুলবুলিকে নিয়ে ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। সব সেরে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে তাই। রাত বেড়ে যাওয়ায় রাস্তায় মাতালদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে। জোরে পা চালিয়ে হাঁটছে সাবিত্রী। এই তো এই মোড়টা পেরোলেই ওর বাড়ির রাস্তাটা পড়বে। মোড়টা একটু অন্ধকার-অন্ধকার মতো! একটু ভয়ও করছে সাবিত্রীর। মোড়ের সামনে আসতেই হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে তিনটে লোক বেরিয়ে এল। আপাদমস্তক টলছে তাদের। গা থেকে ভুরভুরিয়ে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। সাবিত্রীর বমি পেয়ে গেল ওই দুর্গন্ধ শুঁকে। সেটা দেখে তিনজনের একজন খ্যানখ্যানে গলায় বলল, 'আরেব্বাস! ফুলটুসি…. এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো। শরীরটা তো খারাপ মনে হচ্ছে। একটু এগিয়ে দেবো নাকি বাড়ি পর্যন্ত‌।' 



সাবিত্রী গলায় জোর এনে বলল, 'পথ ছাড়ো! নইলে...ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।'



আরেরজন বলল, 'এই, এই ছেড়ে দে...ছেড়ে দে...নইলে এক্ষুনি 'হালুম' করে উঠবে রে', বলে তিনজনই বিচ্ছিরি ভাবে হাসতে লাগল। 



তৃতীয়জন ধমকের স্বরে বলল, 'আমরা যাকে ধরি তাকে যে অত সহজে ছাড়িনা ফুলটুসি! ভালয় ভালয় মেনে যাও। নইলে তোমারই কষ্ট বেশি হবে।'



কথাটা বলে আরেক চোট তারা হেসে উঠল। হাতের খালি মদের বোতলগুলো ফেলে দিয়ে এবার ওরা তিনজন সাবিত্রীর দিকে পায়ে পায়ে এগোল। 



সাবিত্রী আবার ধমকে উঠল, 'ভাল হবে না বলছি! পেছনে যা! যেতে দে আমায়।' 



প্রথমজন সাবিত্রীর শাড়িতে ধরে টান দিলে দ্বিতীয় জন সাবিত্রীর পড়নের ব্লাউজটাতে টান মারতে যেতেই হঠাৎই চোখমুখ বিকৃত করে কাটা কলাগাছের মতো ধপ্ করে রাস্তায় পড়ে গেল। লোকটি চিৎকার করে এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুড়তে লাগল। কিছুপরেই তার চোখ মুখ ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। প্রথম জন এই দৃশ্য দেখে মারাত্মক চমকে সাবিত্রীর শাড়ি ছেড়ে কেমন একটা স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। তৃতীয়জন এইসব দেখে ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগল, 'এই পল্টু, এই টনি..কি হল রে তোদের! কথা বলছিস না কেন?'


বলতে বলতে সে তার স্থবির হয়ে যাওয়া সাথীর কাঁধে হাত দিতেই সঙ্গে সঙ্গে স্থবির লোকটি ভষ্মে পরিনত হয়ে গেল। তৃতীয়জন এইবার প্রচণ্ড আক্রোশে সাবিত্রীর দিকে তেড়ে আসতেই কোথা থেকে এক ঘূর্ণি বাতাস এসে তৃতীয় লোকটিকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। সাবিত্রী এই সমস্তকিছু দেখে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। একটু পর হঠাৎই অন্ধকার মোড়টা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং রাস্তার ধুলোরাশি সরে গিয়ে সেখানে কিছু শব্দ ফুটে উঠল…



'ভয় পেয়ো না সাবিত্রী….আমি মকবুল। আমি থাকতে তোমার কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না। জীবিত থাকা অবস্থায় যেমন করে তোমায় আগলে রাখতাম মৃত্যুর পরেও তেমনি তোমায় আগলে রাখবো। তারপর যখন সময় হবে তখন দুজনের দেখা হবে মৃত্যুর ওপারে। মৃত্যুই শেষ নয় সবকিছুর.. সাবিত্রী আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্যে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তোমার পাশে থাকবো আমি…..এভাবেই।' 



এবার সাবিত্রীর কাছে সবকিছু স্পষ্ট হল। কিকরে বালিশের তলায় বোরোলিন আসলো বা কেনই তার চারপাশে মকবুলের উপস্থিতি মনে হত। সেসব কিছুর উত্তর তার ক্রন্দনরত ঠোঁটে হাসি হয়ে ফুটে উঠল।


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024