ছোট গল্প - বদ || লেখক - অলভ্য ঘোষ || Written by Alabhya Ghosh || Short story - Bod
বদ
অলভ্য ঘোষ
আমি তখন স্কুলে পড়ি একটি ছেলে বখে গিয়েছিল।লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট খেত কেবল না গঞ্জিকা সেবন ও করতো।আমাকে অনেকে বারণ করতো ও খারাপ ছেলে তুই ভালো ছেলে ওর সাথে মিশিস কেনো।খারাপ হয়ে যাবি।আমার ভালো ভালো ছেলে গুলোর চাইতে খারাপ ছেলেটাকেই বেশি ভালো মনে হতো।কারণ তার ভালো সাজার কোন দায় ছিলনা।কে তাকে খারাপ বলবে তাতে তার কিছুই যেত আসতো না।আর আতু আতু পাতু পাতু ভালো ছেলে গুলোর ছিল সর্বদা লোকের কাছে ভালো হবার চেষ্টা।গজ-দম্ভ মিনারে বাস!আমার মনে হত একটা খারাপ ছেলে যদি একটা ভালো ছেলেকে খারাপ করেদিতে পারে তবে একটা ভালো ছেলে একটা খারাপ ছেলেকে কেন ভালো করতে পারবে না।যদি সে সত্যিই ভালো হয়।যদি ভালো ছেলেটা খারাপ ছেলেটার ভালো না করতে পারে তবে ভালো ছেলেটার ভালো গুণে খামতি আছে।অমন ভালো হওয়ার চাইতে না হওয়া ভালো। আমি ছেলেটার সাথে স্কুলে যেতাম।ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী ,নেতাজি সুভাষ-চন্দ্র বসু,মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরা, রবিনহুড প্রতিদিনই এক একটা গল্প শোনাতাম।
"উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে !"
ছেলেটা আমাকে একদিন একটা মাঠের মাঝে নিয়ে গিয়ে বলল;
-তুই তোর জ্ঞানের কথা রাখ।কত বড় হিম্মত আছে বিড়ি খেয়ে দেখা।
আমি বললাম;
- বিড়ি খেতে আবার হিম্মত লাগে নাকি।
ছেলেটা বলল;
-মুখে বললে হবে কেন খেয়ে দেখা।
ওর হাত থেকে একটা বিড়ি নিয়ে মুখে ধরলাম।দেশলাই কাঠি জ্বেলে ও আমার মুখাগ্নি করার সাথে সাথে ওর মুখটা যেন প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো আনন্দে। বিড়িটা ঠিকমতো জ্বলেনি তখনো ফিরিয়ে দিতেই সে ফুরফুর টান দিতে লাগলো আমার মুখের বিড়িটা আনন্দের চোটে।এ আনন্দ কিসের আনন্দ আমি আন্দাজ করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তার প্রকাশও পেলাম।ছেলেটা জনে জনে স্কুলে সকলকে বলে বেড়াতে লাগলো আমাকে সে বিড়ি খাওয়াতে পেরেছে।কেউ কেউ বিশ্বাস করলো ছিঃ ছিঃ করে বলল আমি উচ্ছন্নে গেলাম।কেউ কেউ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না।আমার মত ভালো ছেলে তেমন কোন কাজ কখনোই করতে পারে না।বরং ছেলেটার ওপর তাদের বিশ্বাস ছিল না।
আমি ছেলেটার সাথে পরের দিনও প্রস্তুত হলাম স্কুলে আসতে নতুন একটা গল্প শোনাতে।ছেলেটা তখন আমায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে ভাবটা এমন তার আর আমার মধ্যে এখন কোন ফারাক নেই।তবে কেন বাপু জ্ঞানের কথা অতো।
আমার খুব হাসি পেয়েছিল।আমি বিড়িটা মুখে ধরেছিলাম কিন্তু ধোঁয়াটা কখনোই মুখের ভিতর টানিনি।ছেলেটাকে বলেছিলাম শোন কে আমাকে ভাল-বলবে তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি নিজের কাছে নিজে কতটা ভাল।আমার পথ যদি তোর পথের থেকে উৎকৃষ্ট হয় তোকে আমার পথে আসতেই হবে। তোর পথ যদি আমার পথের থেকে ভালো হয় আমি তোকে কথা-দিলাম নির্দ্বিধায় তোর পথে হাঁটব।
ছেলেটাকে আমি সেদিন বুদ্ধদেবের গল্প বলেছিলাম পথ হাঁটতে হাঁটতে।
সময় টা বর্ষাকাল জঙ্গলের মধ্যে সিক্ত বুদ্ধদেব তখন ধ্যানে মগ্ন থাকেন সারাদিন।কর্দমাক্ত পথে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয় না জঙ্গল সন্নিকট নগর থেকে ভিক্ষানুসন্ধানে বেড়য় শিষ্যগণ।কোনদিন ভিক্ষা জোটে কোনদিন ভিক্ষা জোটে না।যেদিন জোটে সেদিন আহার্য গ্রহণ করে।যেদিন জোটে না খেতে পায় না।খাদ্যের চেয়েও অন্তরায় প্রকৃতি বর্ষা মুখর দিনে জঙ্গলে থাকা দুরূহ।একটা ছাউনি খুব প্রয়োজন।
বুদ্ধ শিষ্যদের বলেন;
- যাও দেখো নগরে একটি ছাউনি মেলে নাকি।
কিন্তু নগরে কিছু লোক তাদের ভিক্ষা দিতে সম্মত হলেও ছাউনি দিতে কেউয়ই চায় না।অবশেষে এক পতিতা তাদের ভিক্ষা ও ছাউনি উভয় দিতে সম্মত হয়।
শিষ্যরা ফিরে এসে গুরুকে জানাল;
- ছাউনি পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব। কিন্তু......
বুদ্ধ বলেন;
-কিন্তু কি?
শিষ্যরা সংশয়ের সাথে বলেন;
-কিন্তু গুরুদেব তা বেশ্যালয়।
বুদ্ধ বললেন;
-আমরা সন্ন্যাসী ভিক্ষুক।আমাদের কাছে বেশ্যালয় আর দেবালয়ের মধ্যে কোন ফারাক নেই।চলো সেই উত্তম স্থানে আমাকে নিয়ে চলো।
শিষ্যরা বুদ্ধকে সেই বেশ্যালয়ে আতিথেয়তার জন্য নিয়ে গেলত বটে কিন্তু মনের মধ্যে সংশয়ে দোদুল্যমান রইলো এই ভেবে যে তাদের সন্ন্যাস ব্রত থেকে স্খলন ঘটতে আর বেশি দেরি নেই।এদিকে বুদ্ধকে অতিথি হিসেবে পেয়ে লাস্যময়ী বারবনিতা টি কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না।কিভাবে কতটা সেবা করলে প্রভু পরিতৃপ্ত হবেন।বুদ্ধের সিক্ত বস্ত্রের বদলে তিনি তাকে রেশমের কোমল গরম কাপড় পরিধান করতে দিলেন।সুগন্ধি খাদ্য পানীয় আহার করতে দিলেন; এমনকি তার মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্যও পরিবেশন করতে লাগলেন।আর এই প্রতিটি পদক্ষেপে শিষ্যরা আঁতকে উঠতে লাগলেন তবেকি তাদের গুরুদেব বশীভূত হয়েছেন এই সামান্য কয়েক কড়ির বেশ্যার!
বুদ্ধ শিষ্যদের ডেকে বলেন;
-শোন বাইরের কোন কিছুতেই মানুষের স্খলন ঘটে না।মানুষের স্খলন ঘটে ভেতরের দ্বিচারিতায়!
আমি থেমে বলেছিলাম;
- তারপর কি হয়েছিল জানিস?
ছেলেটা বোকার মত বলেছিল;
-কি?
আমি বলে ছিলাম;
-বুদ্ধদেব যখন সেই বেশ্যাখানা ছেড়ে চলে গেলেন।সেই বেশ্যাও তার পিছু নেয় সন্ন্যাস গ্রহণ করে।
ছেলেটা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।
-এসব ঢপের গল্প।শোন নগরের পথে ওই ভিখারি আর খানকি টা যদি এক সাথে বেড়য় লোকে ভিখারি কে ছেড়ে খানকির পেছনে ছুটবে কারণ সে বেশি আকর্ষণীয়।
কয়েক দিনের মধ্যেই আমি স্কুলে পেট ধরে বাবাগো মাগো করে উঠলাম।সর্বাগ্রে যে এগিয়ে এল সে ওই বিড়ি খাওয়া ছেলে টা।ওই টিচার্স রুমে গিয়ে শিক্ষকদের খবর দিল কেবল নয়।রিকশা ডেকে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো।শিক্ষক মহাশয় রা জরুরি অবস্থার জন্য স্কুলে সংরক্ষিত সাধারণ পেট ব্যথার ট্যাবলেট দিয়ে ছেলেটাকে আমার বাড়িতে পাঠাল খবর দিতে।
মায়ের কাছে কোন কিছু লুকানোর সাধ্য আমার নেই।তড়িঘড়ি আমার মা খবর পেয়ে ছুটে গেল স্কুলে এবং আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে প্রথম যে কথাটি বলেছিল সেটি হল;
- তোমার কিছুই হয় নি।
আমি মায়ের মুখের দিকে চেয়ে হেসেছিলাম।
মা কেবল বলেছিল;
- আর যেন এমন করোনা।
মা আমাকে জানতে চায়নি কেন আমি পেট ব্যাথার অভিনয় করেছিলাম।আমার স্কুল কখনো কামাই হতো না স্কুল থেকে পালিয়ে আসাত দূর।মা ভালকরেই জানতো এর পেছনে আমার কোন স্কুলের চাইতেও বড় কোন জীবন পাঠ লুকিয়ে রয়েছে।পাঠটি ছিল; আমি কি ঠিক না ভুল?Am I right or wrong?সমগ্র জীবনটা তো একটা পাঠশালা।
বহুদিন বাদে সেই ছেলেটি পথে আমায় ধরে বলল গল্প বলেবলে তুই আমার মাথাটা বিগরেদিলিরে।
আমি বললাম;
-যে মানুষ তার বদ বুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারে সেই বুদ্ধ।আর যে মানুষ তার বদ বুদ্ধির নিচে চাপা পড়ে থাকে তারা বুদ্ধু।
Comments