ছোট গল্প - ভুতুড়ে ট্যাভার্ন || লেখক - বৈদূর্য্য সরকার || Written by Boidurjya Sarkar || Short story - Vuture tavarn
ভুতুড়ে ট্যাভার্ন
বৈদূর্য্য সরকার
'ঋতুপর্নের ফিল্মের ইন্টিরিয়ার কৈশোরে কল্পনা করে , মধ্যতিরিশে যাদের ঘরদোর জীবন হয়ে যায় স্বপন সাহা মার্কা... তারা সব এসে জোটে বন্দুক গলিতে ।'
শুনে রে রে করে ওঠে পিনাকি । সে এখনও বুঝতে চায় না, আমাদের মতো এখানকার সবার জীবনের চিত্রনাট্য লেখা শেষ হয়ে গেছে এবং তা চূড়ান্ত ফ্লপ । আমি হেসে বলি, আর তো ক’টা দিন... তারপর তাড়াতাড়ি বুঝে যাবি নিয়তির মানে কী ! আজ পিনাকির জন্মদিন । সব বড় বড় লোকের মতো সে গ্রীষ্মের জাতক । এক আধুনিক জ্যোতিষের কাছে শুনেছি, গরমকালে জন্মানো লোকেদের তাকদ অন্যদের থেকে বেশি হয় । সূর্যের তাপ ওরা ধারণ করতে পারে । সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে এটা ঠিক পিনাকির উত্তাপ উদ্দীপনা খানিক বেশি । বড় একটা আলসেমি তাকে মানায় না, বিস্তর দৌড়ঝাঁপের কাজ । সেজন্যে দরকার যথেষ্ট ফুয়েল ফর ইন্টারন্যাল সিস্টেম। আমি অবশ্য ইদানিং ওর সাথে পাল্লা দেওয়ার অবস্থায় থাকি না মধ্যতিরিশে এসে। তাছাড়া বসারও সুযোগ হয় না বিশেষ ।
দু'বছর অবশ্য লকডাউন আর করোনাতেই কেটে যাচ্ছে । নয়তো ট্যাভার্ণে দু’পাত্তরের ব্যবস্থা হতো ।
এখন সবার অবস্থা হয়েছে আত্মহত্যাপ্রবন । আগে এ কথা পদ্যেই ব্যবহার করেছি, এখন জীবনে উঠে এসেছে । মাসের পর মাস কাজ নেই, মাইনে অনিয়মিত । তার মধ্যে নানারকম রোগ ব্যাধি আর মিডিয়ার ভীতিসঞ্চার করা খবর । রোজই নতুন নতুন তরিকায় সেই এক ভয়ের খবর তুলে ধরা । এই করেই যে কত কোটি লোকের কাজ গেছে, আরও কত যাবে... তার ঠিক নেই ।
ভোম্বলদা আড্ডায় এসে মিডিয়ার লোকেদের একহাত নেয় । তার ট্যুরিজিমের অবস্থা সঙ্কটজনক, আর প্রাইভেট টিউশান তো উঠে যাওয়ার পরিস্থিতি । পরীক্ষার ঠিক নেই যেখানে, কে পয়সা দিয়ে পড়তে আসবে । শুনলাম, ছাত্রদের বাঁশ দেওয়ার ভরপুর ঐতিহ্য ভুলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বাড়িতে বই দেখে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে ।
এই দু'টো বছর যা চলছে মাথাখারাপ অবস্থা হয়েছে সবারই । তবে ভোম্বলদার একটা ব্যাপারে জ্ঞান বেশ টনটনে, ঘরে আসর বসানোর ব্যাপারে। বাইরে গিয়ে খরচ করা পোষায় না তার । জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি টানাটানির এই গল্প বাপমায়ের মুখে শুনতে শুনতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আজকাল আর আলাদা করে বিশেষ দুঃখবোধ হয় না । বাপমা তাদের পঞ্চাশ বছরের পুরনো ভ্যালুজ আর সর্বদা এই টানাটানির কীর্তন শুনিয়ে জীবনের প্রথম তিরিশ বছরের দফারফা করে ছেড়েছে । পরের তিরিশ বছরের দায়িত্ব নিয়েছে বৌ । সেই প্রাচীন কাহিনী আর সেসবের বাইরে না যাওয়া মন । দোষ দিয়েই বা কী লাভ ! অধিকাংশ মেয়েকেই দেখি – ডিজিট্যাল গ্যাজেটে অভ্যস্ত, ইউটিউব দেখে রান্না থেকে চুল বাঁধা শিখে ফেসবুক লাইভ, ফেমিনিজম চটকে তামাম ছেলেপুলের মাথা খারাপ করে... অথচ মনের মধ্যে দু’শো বছরের অন্ধকার । যদিও সেসব সরাসরি বলার উপায় নেই । বাপের পয়সায় ফুটানি করে সব হয়েছে বিপ্লবী । আর পরবর্তী জীবনে বর নামক একটি দুর্লভ গর্দভ তৈরি আছে যাবতীয় জিনিসের বোঝা বওয়ার জন্যে ।
এক সহকর্মী বলে- দ্যাখো ভাই, এসব বলে তো লাভ নেই... আমাদের কামের তাড়নাও তো আছে । মানি, তা অন্যান্য প্রবৃত্তিগুলোর থেকে অবশ্যই গুরুতর হয়ে ওঠে একটা বয়সের পর । এর টানেই জীবনের যাবতীয় আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা আশাকে জলাঞ্জলি দিতে হয় । ঢুকতে হয় দাম্পত্য নামক এমন একটা ব্যাপারে – যেটা দুনিয়ার কেউ খুব ভাল না বুঝলেও সবাইকেই পালন করে যেতে হয় নিয়মমাফিক । তাই পিনাকির যাবতীয় আত্মবিশ্বাসী কথার একটাই উত্তর দিই , বিয়ে থা হোক... তারপর দেখবো । তাতে পিনাকির মতো তর্করত্ন পর্যন্ত ব্যাকফুটে গিয়ে বলে, হ্যাঁ... তখন পরিস্থিতির বিচারে কথা তো বদলে যেতেও পারে ।
২
আমরা লক্ষ্য করছিলাম, চারদিক কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসছে । আশপাশের সব জায়গায় খাঁখাঁ শূন্যতা । থেকে গেছে আমাদের মতো কিছু ব্যর্থ লোকজন । সব বাড়িতেই সিনিয়ার লেভেলে মৃত্যুমিছিল । থাকার মধ্যে অশক্ত বৃদ্ধা আর আমরা । যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের বউ । তবে এটা বোঝা যাচ্ছিল, বাড়িতে ছেলেবেলায় দেখা স্থানাভাব ব্যাপারটার উল্টোদিকটাও খুব একটা স্বস্তির নয় ।
বন্দুক গলিতে যাওয়া আমাদের সাবেক দলেও ভাঁটার টান । একসময় ছ’আটজন মিলে যাওয়া হয়েছে । এপাড়া সেপাড়া, কাবাব পরোটা, খালাসিটোলা অশোকা সব ফুরিয়ে শেষে এই বন্দুক গলি । নাম বাহারি হলেও ক্রমশ ম্রিয়মাণ এসব অঞ্চল । সব বুড়োঝুরো লোকেরা আসে। যারা খুঁজেপেতে এখানে আসে, একটাই কারণ – শহরে সবথেকে সস্তা । একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম – আমাদের যতো বয়স বাড়ছে, কথাবার্তাও যেন ফুরিয়ে আসছে । ‘যা হওয়ার তাই হবে’, এর’ম একটা ভাব দিনকে দিন বাসা বাঁধছে ।
বন্ধু তার বন্ধু আবার তার বন্ধু... এভাবে জড়ো হতো লোক । যেমন আমাদের পাড়ার বন্ধু পটলা, তার সংগঠনের বন্ধু বোধি, তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু ইসমাইল । পটলা ও বোধি আবার থার্ড স্ট্রিম পলিটিক্সে ভিড়েছিল । এখন অবশ্য সেসব ফরসা। পিনাকি আবার এখনকার শাসকের এককাট্টা সমর্থক, আমি বিরোধি । মুছে যাওয়া আগের শাসক দলের নেতার দৌহিত্র ইসমাইল । সে আবার ইংরিজিতে নভেল লেখে । শুনলে কেমন আশ্চর্য লাগে । তবে ছেলেটা একেবারে মাটির মানুষ । তবে ওইটাই যা বেশি শক্ত । সে শিলঙের স্কুলে পড়ত, সেখানে শ’খানেক অ্যাফেয়ার । এখানেও কয়েকটা কেঁচেগণ্ডূষ সম্পর্ক । সেসব নিয়ে আমাদের কারোর মাথাব্যাথা নেই অবশ্য । বরং তার পড়াশোনার রেঞ্জ দেখে হীনমন্যতায় ভুগতে হয় । তবে পানশালায় কোনও কথাই দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না ।
‘সমবেত হাসিঠাট্টায় দিন কাটে’ – এমনটা বলতে পারলে ভাল হতো । ইদানিং পিনাকির সাথে পটলা বা ইসমাইল ছাড়া বড় একটা কেউ আসে না । ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই । ব্যস্ততার ভাণ করতে হয় ।
পিনাকি রোজগার যাই করুক না কেন, পানশালায় সে কার্পণ্য করে না। তার চোখেমুখে তখন যাবতীয় দৈন্যকে কিনে নেওয়ার স্পর্ধা ফুটে ওঠে । খানিকটা অকাতরেই টাকাপয়সা ছড়ায় বেয়ারা দারোয়ানদের মধ্যে । ফলে খাতির পায় নিঃসন্দেহে । কিছু বলতে গেলে বলে, এতে তার মেজাজ শরিফ থাকে ।
মেজাজ নিয়েই তো হয়েছে ঝামেলা । বাল্যে সেসব নিয়ে বোধ থাকে না । কৈশোর থেকে আমরা বোধহয় নানারকমে হেজে গেছিলাম । বেশ মনে পড়ে, একটা সময় পর্যন্ত মুখে একটা অমলিন হাসি লেগে থাকতো - যা অকাতরে দেওয়া যায় । কিন্তু আজকাল খেয়াল করে দেখেছি, রেজাল্ট চাকরি মাইনে সংসার সব মিলিয়ে কপালে একটা স্থায়ী ভুরু কোঁচকানো ভাব চলে এসেছে । পিনাকির ক্ষেত্রে দেখেছি, অদ্ভুত একটা আক্রোশ জন্মেছে জগৎ সংসারের প্রতি। সেটা অবশ্য অকারণে নয়, যে কিশোরীকে সে টিনএজ থেকে স্বপ্নে দেখেছে... সেই মেয়েটি এখন জননী হলেও যোগাযোগ করে মাঝেমাঝে । তাতেই বাবুর ঘুম উড়ে যায় ।
আমাদের কৈশোরে ক্রিকেটে বেটিং জিনিসটা নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়েছিল । তারপর নানা কাণ্ডকারখানার পর এখন দেখি বেটিং সাইট খেলার উদ্যোক্তা হয়ে বসেছে । আমরাও ড্রিম ইলেভেন খেলি পাঁচ দশ টাকার । খেলা দেখলে মনে হয় – সব স্ক্রিপ্টেড । তবু দেখি, সন্ধেবেলায় বিনোদন তো বটে । শিল্প সাহিত্য খেলাধুলা সবই আসলে বিনোদন, অন্তত তাই ভাবলেই সুবিধা । অনেক লোকে হাহুতাশ করে – বই না পড়ে ঘরের বউরা মেগাসিরিয়াল বা চ্যাট করে কেন ! মনে হয়, তার আগে গৃহকর্মের ভেতরে বিনোদন ঢোকানো ছিল । কিন্তু বিনোদনের নিয়মে যেটা কম পরিশ্রমে বেশি মজা দেয়, সেটাতেই তো মানুষ মজবে ।
‘সব জায়গাতেই অপ্রাপ্তি থেকেই আমাদের যাবতীয় পণ্ডশ্রম’... বোঝার বয়স হয়ে গেলেও আমরা বন্দুক গলিতে এসে সে কথা ভুলে যাই । সেই থেকে যাবতীয় তর্কাতর্কি রাগ মনখারাপ । ফেরার পথে আগে সামনের একটা দোকানে বিফ কাবাব খাওয়ার অভ্যেস ছিল । এখন সবাই অম্বলজনিত কারণেই হয়তো খালি পেটেই থাকতে পছন্দ করে । তাতে খরচ কমল আবার বাড়ি ফিরে কুমড়োর ঘ্যাঁট সাগ্রহে খাওয়ার মতো একটা পরিস্থিতিও তৈরি হল । মনে হয়, আমাদের আগের প্রজন্মের বাইরে খাওয়া বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস ছিল না বলে টাকাপয়সা খানিকটা জমেছিল। সুবিধে ছিল, তাদের নাকের ডগায় এর’ম বিপুল বিজ্ঞাপন ও ইএমআইয়ের সুবিধের কথা ঝোলানো থাকতো না।
একদিন যেমন ইসমাইল বলল, ওর একটা এক লাখের চাকরি চাই । জানি, এসব কথা দু’পাত্তরের পরেই চলে । সেজন্যে পিনাকি বলে উঠল, ওর দরকার দু’লাখ । একলাখ তো ওড়াতেই চলে যাবে । মোদ্দা কথা হল, এর’ম অনেককিছুই আমরা প্রত্যেকে চাই । কেউ কেউ পায়, বাকিদের মার্কেটের নিয়মে স্বাভাবিকভাবে হয় না । কিন্তু যখন দেখা যায়, বিরাট চাকরি করা লোকেরা এমন কিছু নিউটন আইনস্টাইন নয়... সেখান থেকেই শুরু হয় যাবতীয় অশান্তি ।
৩
বাল্যের রেডিওতে ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’ শুনে আমি দিব্যি কাঁদতাম । স্পষ্ট মনে আছে । পরে ভেবে দেখেছি, স্মৃতি জিনিসটা বড় বেআক্কেলে । আর আমি যে যুগের লোকে যেখানে এই গানের পৌঁছনোর কথা নয় । তবু মিস্তিরিদের নিত্য ঠোকাঠুকির ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিংবা মহালয়ায় জেগে ওঠা রেডিও তখনও আমাদের অবলম্বন । সেই থেকে মনের মধ্যে একটা বদ্ধমূল হীনমন্যতা চেপে বসে আছে । মনে হয়, অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা তখন বড় হয়েছি । এর থেকে ভাল অবস্থায় অনেকে ছিল নিশ্চিত, কম্পিউটার না হলেও ছোটবড় নানারকমের ভিডিও গেম অনেকের হাতে । এয়ারগান নামের অতি উত্তেজক জিনিস দেখে থাকলেও কেনা যায় বলে জানতাম না । দৌড় ছিল চার’ছ টাকার ক্যাপ বন্দুক ।
পরে ভেবে দেখেছি, চারপাশের লোকজনের উপহার দেওয়ার প্রবণতা বড় একটা ছিল না । অন্তত আমার ক্ষেত্রে । আসলে এদিক থেকে যের’ম, উল্টোদিক থেকেও একই রিঅ্যাকশান । পুরোটাই একটা সিস্টেম । পুজোয় সংখ্যায় বেশ কিছু জামাকাপড় হলেও অধিকাংশ এলেবেলে ধরণের । ফলে কলেজে ভর্তির পর টিউশানি ইত্যাদি করে পুজোর খরচ তোলাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল । বাড়ির লোকের ধারণা ছিল, পুজোর দিনে ঘরে বসে থাকলে ছেলের মন খারাপ । তাকে সেজন্যে বাইরে যেতে উৎসাহিত করো । কিন্তু বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে যে টাকাপয়সা লাগে এবং সবার অবস্থা একরকম হয় না...। সেটা বাড়ির গোদাগুলোর না বোঝার মতো কি ছিল, কে জানে !
এখন ভোম্বলদাকে দেখে মনে হয়, সবার আজকাল গরীব থেকে হঠাৎ বেমক্কা বড়লোক হওয়ার নেশা । তখন তার উল্টো মতটা চালু ছিল । যদিও জীবন সংগ্রামের নানা গালভরা নাম শুনে আজকাল সেগুলোকে প্রলাপ বলেই মনে হয় । ভোম্বলদা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন করে কিছু লোক জোগাড় করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে । মন্দ হয় না, নিজের ঘোরাটা উপরি । এমনিতে একা মানুষ, সময় কাটাতে কিছু একটা করতে হবে তো !
ভোম্বলদা আগের বামপন্থী সরকারের ছাত্র শাখার জেলাস্তর পর্যন্ত উঠেছিল । দু’চারটে বইপত্র পড়ে স্টিরিওটাইপ বিপ্লবী বক্তৃতা করতেও শিখেছিল । যদিও ক্যাবলা বলে তেমন কিছু বাগাতে পারেনি । ইসমাইলকে দেখার পর বুঝেছি, এই না বাগাতে পাড়া লোক দলটার সব স্তরেই ছিল । সেজন্যে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে । এখনকার সরকার এক অর্থে বেশ এফিসিয়েন্ট – ফেলো কড়ি মাখো তেল ।
আমার অবশ্য কোনও কিছুতেই আজকাল তেমন ইন্টারেস্ট নেই । দুর্গাপুজো থেকে ভোট... সব ইভেন্ট তুলে দিলেই বা ক্ষতি কী – এর’ম একটা ভাব। পিনাকি বলে, তুমি কি নিহিলিস্ট হয়ে গেলে নাকি ! আমি উত্তরে বলি, আমার আর কিছুই হওয়ার নেই । সব চুকেবুকে গেছে ।
এখন সব কিছুকেই মনে হয় – নিয়তি নির্দিষ্ট । কোথাও আলাদা কিছু হওয়ার জো নেই । বললে, অনেকেই রেগে ওঠে । তাহলে পক্ষে ভোট দিলেও যা বিপক্ষেও তাই ! আমার মনে হয়, একজনের সামান্য ভোটে কি সত্যিই কিছু বদলায় ? পিনাকি যুক্তি দেয়, তোমার মতো ভাবলে কোনও দেশে কোনও কালে কোনও পরিবর্তন আসতো না । ভাবি, সেও ঠিক । বন্দুক গলিতে এসব আলোচনা করে বাড়ি ফেরার পথে বিশেষ কিছু মনে থাকে না । ইসমাইল কীসব কঠিন থিয়োরি আলোচনা করে, নানারকম বইয়ের রেফারেন্স দেয়... ভাল বুঝতে পারি না । তার দল এই দশ পনেরো বছরে একেবারে এভারেস্টের চূড়া থেকে পাতালের গভীরে গিয়ে হারিয়ে গেছে, মনে থাকে না বোধহয় নেশার ঝোঁকে।
একদিন সে বলল, গ্রাফিক নভেল লিখবে তার জন্যে ছবি আঁকার লোকের ব্যাপারে নানা সমস্যা । তার সাথে বলল, কোন একটা বইয়ে কী পড়েছে যা পড়ার পর আর বিয়ে করা যায় না । দু’টো মিলেমিশে আমার মনে রয়ে গেল – বিয়ের কার্টুন আঁকার জন্যে লোক দরকার । মনেই শুধু থাকলো না, ফেসবুকে আপডেট দিয়ে ইসমাইলকে ট্যাগ করে টাকাপয়সার সুবন্দোবস্ত আছে... সেটা জানাতেও ভুললাম না । তারপর জানি না কী ঘটেছিল । আর আমাদের দেখা হয় না অনেকদিন ।
পিনাকির মুখে খবর পাই, সে বাড়িতে নানারকম এক্সপেরিমেন্টাল জিনিস রেঁধে খাওয়ায় । তার সাইক্লিক দাম্পত্য কলহের কাহিনী শুনি । বুঝতে পারি, নানা তত্ত্ব পড়া নভেল লেখা লোকের দাম্পত্য তো আর সাধারণ চারটে লোকের মতো হবে না । দাম্পত্য জিনিসটা এখন শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে বিপুল ঘুষ পাওয়া কিংবা কর্পোরেটে উন্নতি করা লোকেদের ক্ষেত্রেই সুখকর ।
কেন্দ্রীয় সরকার কেন যে একটা কঠিন নিয়ম আনছে না, কে জানে ! 'এক লাখের নীচের লোকেদের সংসার করার অধিকার কেড়ে নেওয়াই সুবিধেজনক...' আড্ডায় এসব বললে ওরা বেশ মজা পায় । যদিও সবাই জানে, সামাজিক নিয়মগুলো বড় নাছোড়বান্দা । একদম সোজা নয় । যে ব্যর্থ, কম রোজগেরে – তাকে বাতিল করে দেওয়া নয়। বরং প্রতিমুহূর্তে দগ্ধে মারা হয় । চোখের সামনে নানা উদাহরণ দেখিয়ে প্রতিদিন জীবন সম্বন্ধে একটু একটু করে বীতশ্রদ্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া ।
‘আমি সর্বোতভাবে বুঝতে পেরে গেছি – সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি জীবনের যাবতীয় সুখ ব্লটিং পেপার হয়ে শুষে নিচ্ছে’ । ব্লটিং পেপার কখনও না দেখলেও উপমাটা লাগাই নিয়মমাফিক । পিনাকি খানিকটা রেগে বলে, সে তোমার ম্যানেজেরিয়াল স্কিলের অভাব... নয়তো তুমি যা বলছ সেতো চরম নারীবিদ্বেষী কথা । জানি সে লিব্যারাল, তার ব্যাপার আলাদা । বাড়িতে বৃদ্ধ বাপমা, শ্বশুরবাড়িতেও তাই...চাকরির হ্যাপা তার ওপর বউবাচ্চার দায়দায়িত্ব নিয়ে লোকজন কী করে নেচে বেড়ায়, আমি সে কথা বুঝে উঠতে পারিনি । ব্যক্তিগত বলে যেখানে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। সেটাও কি পুরুষ মানুষের একটা আক্ষেপ নয় ? শুনে অনেকে বলে, কী একেবারে কেজিবির চর হে তুমি ! যেন ব্যক্তিগত ব্যাপারটা ওদের ইন্সটিটিউশানাল নিয়মে চলবে ।
আমি শেষপর্যন্ত বুঝে গেছি, প্রতিটি চরিত্রের জন্যে দুটো করে লোক দরকার । একজন কাজকর্মের শেষে পানশালায় বসে হৃদয় জোড়াবে, আরেকজন ঘরসংসার ও সামাজিক ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবে । এই দু’জনের দেখা হয়ে গেলে কী হবে, কেউ বলতে পারে না । তখন হয়তো শুরু হবে নতুন কোনও কাহিনী ।
পিনাকি যেমন তার যাবতীয় চমকপ্রদ কথাবার্তা পজ করে ঢুকতে চলেছে জীবনের পরবর্তী দৃশ্যে - গার্হস্থ্য পর্যায়ে। ওর ব্যাচেলারস’ পার্টির পরে বন্দুক গলিতে আনাগোনার পাট চুকলো । শুনছি, এখানে সব ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি হবে ।
ব্যবস্থাটা বেশ অদ্ভুত ছিল – একতলায় দিশি, দোতলায় বিলিতি । আর তিনতলায় যা ইচ্ছে। বেয়ারাদের মুখে শুনেছি, মাঝরাতে একতলা থেকে মাতাল ভূত তিনতলায় উঠতে চায় । দোতলায় ততক্ষণে কারা সব মান্না দে’র গান ধরে । সেই প্রজন্মের শেষটা আমরা দেখেছিলাম । জীবনের প্রান্তে পৌঁছনো লোকেরা, যৌবনে শোনা গানগুলো বেসুরো গায় । গল্প বলে, কোথায় যেন নাচতে যেতো। এরা খানিকটা আয়নার মতো ছিল, যাদের কথা শুনে পিনাকি আমাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতো এবং সেসব ভারি দুঃখিত মুখে বলতো ।
যদিও সেসব কথা পিনাকিকে এখন মনে করিয়ে লাভ নেই, তার চোখে মায়া অঞ্জন লেগে আছে – স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
Comments