ছোট গল্প - রিকভারি স্টেজ || লেখক - ডা: অরুণিমা দাস || Written by Arunima Das || Short story - Recovery stage


 

রিকভারি স্টেজ

ডা: অরুণিমা দাস



ডা: রায় নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্ট প্রোফাইল গুলো চেক করছিলেন। পেশায় একজন বড়ো সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: সুশান্ত রায়। রোগীদের মানসিক স্বাস্থের প্রতি খুবই যত্নবান তিনি।খুব মন দিয়েই ফাইল গুলো দেখছিলেন।


হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলো,


মে আই কাম ইন ডক্টর।


ফাইল থেকে মুখ তুলে দেখলেন সিস্টার অহনা চেম্বারে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছেন। একগাল হেসে ডা: রায় বললেন ইয়েস,প্লীজ কাম ইন অহনা।


অহনা এগিয়ে গিয়ে একটা ফাইল তুলে দেয় ডা: রায়ের হাতে, আর বলে স্যার এটা মোনালিসার ফাইল, ও এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ আছে। মেডিসিন গুলোও সময় মত খাওয়াচ্ছি। স্যার ওকে কবে নিয়ে যেতে পারবো বাড়ী, সময় এলেই নিয়ে যেতে পারবেন,বললেন ডা: রায়। বলেই চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ফাইলটাতে। হেসে বললেন অহনা ইট ওয়াস নট পসিবল উইদাউট ইউ। অহনা বলল স্যার আমি তো শুধু কেয়ার নিয়েছি ওর, আর আপনি তো ওকে অ্যাসাইলামে আনা থেকে শুরু করে প্রপার মেডিসিন আর রেগুলার কাউন্সেলিং করে রিকভারি স্টেজে নিয়ে এসেছেন। ডা: রায় হেসে বললেন এটাই তো আমার কাজ সিস্টার। আর এই কাজের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজে পাই আমি। একগাল হেসে অহনা বলে জানিতো স্যার,আপনি রোগীদের কতো টা ভালোবাসেন। আপনি তাহলে ফাইলটা চেক করুন স্যার, আমি একটু পরে আসছি। মোনালিসার লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে, বললো অহনা।


ও শিওর, প্লীজ গো। অহনা বেরিয়ে গেলো।


মোনালিসার ফাইলটা দেখতে দেখতে ডা: রায় ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে লাগলেন অতীতের দিনে,মনে পড়ে গেলো বছর দুই আগেকার কথা। এক ঝড় বৃষ্টির দিন হসপিটাল থেকে রাউন্ড দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ গাড়ীর সামনে এসে পড়ে একটি মেয়ে। গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। অত রাতে কোনো উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন উনি। জ্ঞান ফিরলেও নিজের নাম বলতে পারেনি সেই মেয়েটি। কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি আর এলোমেলো চুলে তাকিয়েছিল সে। সেই রাতে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি ডা: রায়। পরদিন সকালে অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় গিয়ে ডা: রায় কিছু লোকজনকে মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন মেয়েটি মানসিক ভারাম্যহীন,নাম মোনালিসা,থাকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের এক ঝুপড়িতে। ওর বাড়ি কোথায় আর কেনোই বা ও এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকে এসব জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে ডা: রায় অনেক কিছু জানতে পারেন। একটি ছেলেকে ভালোবাসতো মোনালিসা, কিন্তু বাড়ির কেউ সেটা মেনে নেয়নি। পালাবার প্ল্যান করেছিল ছেলেটির সাথে। ধরা পড়ে যায় দাদার হাতে আর বেধড়ক মার খেয়ে ছেলেটির মৃত্যু হয় সেদিন। এই নৃশংস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে মোনালিসা পাগলের মত হয়ে যায়, নিজের চুল ছিঁড়তে থাকে। দাদারা ওকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে আটকে রাখে। চেঁচামেচি করলেই জুটতো মারধর আর অকথ্য গালাগাল। খেতেও দিতো না ঠিক করে। একদিন দাদারাই বোনের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসে। ওখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাবের ছেলেরা ওকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের কুঁড়েতে রেখে আসে। খাওয়াদাওয়া কিছু করেনা, সারাদিন রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। শুনতে শুনতে ডা: রায়ের মনটা ভার হয়ে ওঠে। উনি বলেন আজ থেকে ওর চিকিৎসার দায়িত্ত্ব আমার। ওকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখবো,দেখি কতটা সুস্থ করে তুলতে পারি ওকে। সবাই বললো, চেষ্টা করে দেখুন স্যার। সেইদিন থেকে মোনালিসা কে সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করেন ডা: রায়।


প্রথম প্রথম একটা ঘরে বেঁধে রাখা হতো মোনালিসা কে। ইলেকট্রিক শক থেরাপি থেকে শুরু করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি সব কিছু চলতো। আর সাথে অ্যান্টি সাইকিয়াট্রিক মেডিসিন এবং সিস্টার অহনার রুটিন কেয়ার। এই সব কিছুর সম্মিলিত প্রয়াসে আজ মোনালিসার হাত পায়ের বাঁধন খুলে গেছে, মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে সক্ষম। সময় ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কঠিন বাস্তবের প্রেক্ষাপট তার মানসিক কাঠিন্য আরো সুদৃঢ় করে তুলেছে। আত্মনির্ভর হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় সে। আর যাইহোক,বাড়িতে কোনোভাবেই ফিরতে রাজি নয় মোনালিসা। বাড়ির লোকেদের নির্মম অত্যাচার কিছুতেই ভোলেনি সে। সিস্টার অহনা ঠিক করেছে মোনালিসা কে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে,অনাথ জীবনে বোনের অভাব দূর হবে। ডা: রায় ও পারমিশন দিয়েছেন। মোনালিসাও অহনাকে দিদির মতোই ভালোবাসে।

স্মৃতির পাতা থেকে চোখ তুলে মোনালিসার ফাইলে নতুন মেডিসিন গুলো লিখতে লাগলেন ডা: রায়। কল করে অহনাকে ডাকলেন তিনি। অহনা এলে বললেন জাস্ট দুটো মেডিসিন দেওয়া আছে, লো ডোজ, উদ্বেগ কমাবে আর মন শান্ত রাখবে। এগুলোই এখন থেকে খাবে মোনালিসা। আর ওষুধের থেকেও ওর দরকার এখন ভালোবাসা,সহমর্মিতা যেটা ওকে রিকভারি স্টেজ থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবে। অহনা বলল আমি সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো স্যার। ডা: রায় বললেন আমি জানি আপনিই পারবেন একমাত্র,তাই আপনাকে পারমিশন দিয়েছি। ফর্মালিটি গুলো পূরণ করে আপনি আগামী সপ্তাহেই আপনার নতুন বোনকে নিজের বাড়ী নিয়ে যেতে পারবেন। অহনা ধন্যবাদ জানিয়ে একছুটে মোনালিসার কেবিনে গিয়ে বললো আমার সাথে যাবি তো নাকি। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মোনালিসা বললো হ্যা দিদি, তোমার আর ডা: রায়ের হাতেই আমার পুনর্জন্ম হয়েছে, নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছি আমি। তোমাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সাথেই থাকবো আমি। কোথাও যাবো না তোমায় ছেড়ে।কেবিনে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না ডা: রায়। দিদি আর বোনের ভালোবাসার কথোপকথন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলেন ও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন এই বন্ধন যেনো অটুট থাকে চিরকাল আর মোনালিসার নতুন জীবন যেনো সবসময় খুশি আর আনন্দে ভরপুর থাকে। কোনো দুঃখ যেনো ওর মনকে ছুঁতে না পারে কোনোদিন। কেবিনের দরজা বন্ধ করে ডা: রায় হাঁটা দিলেন অন্য পেশেন্ট গুলো দেখবেন বলে। আরও কেউ হয়তো রিকভারি স্টেজ থেকে সুস্থ জীবনে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করছে যে দুটোর মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন গড়ে দিতেই তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকেন।



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024