উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -3


 

তিন


কয়েক সপ্তাহ আগে বিধান দত্তের সঙ্গে সুন্দরবন গিয়েছিল ঋজু। বিধানদা কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন। ফিচার লেখেন। বিখ্যাত লেখকের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে দেখানোর জন্য অনেকে যেমন এক-দেড়শো বছর আগেকার কোনও বিখ্যাত লেখকের মেয়ের দিকের অমুক ঘরের তমুক হিসেবে নিজের মিথ্যে মিথ্যে পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেন, কেউ কেউ আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে, নমস্য কোনও লেখকের চোদ্দোতম বা ষোড়শতম বংশধর হিসেবে নিজেকে দেখিয়ে একটা ভুয়ো বংশ তালিকা তৈরি করে ফেলেন। ঠিক তেমনি, উনি কোন ঘরানার লেখক, তা বোঝানোর জন্য, দু’-চার পুরুষ আগের তেমন কোনও বিখ্যাত কবি বা লেখক না পেয়ে, শুধুমাত্র পদবির মিল দেখেই উনি আকড়ে ধরেছেন স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। তাঁর নামে একটা আকাদেমিও ফেঁদে বসেছেন। সেই আকাদেমি থেকে প্রতি বছর এক ঝাঁক কবি-লেখক-সাংবাদিককে পুরস্কার দেওয়া হয়। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তেমন লোককেই বাছা হয়, যার যোগাযোগ খুব ভাল। তার যোগাযোগের সূত্র ধরেই যাতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওই অনুষ্ঠানের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ারা আসে। 
গত বছর যখন এই অনুষ্ঠান হয়, তার কিছু দিন আগে বিধানদা ঋজুকে বলেছিলেন, কয়েকটা পার্টি জোগাড় করে দাও না।
ঋজু অবাক। — পার্টি মানে?
উনি বলেছিলেন, তোমার তো বহু লোকের সঙ্গে জানাশোনা আছে। একটু বলেকয়ে দেখো না, কেউ যদি রাজি হয়।
তখনই ঋজু জেনেছিল, মাইকেল মধুসূদন আকাদেমি থেকে প্রতি বছর মহাধুমধাম করে কখনও গ্রেট ইস্টার্নে, কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ শতবাষির্কী ভবনে, আবার কখনও টাউন হলে যে অনুষ্ঠান হয়, সেখানে প্রচুর টাকা খরচ হয়। বিদেশ থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। কাউকে কাউকে তো যাতায়াতের বিমান ভাড়াও দিতে হয়। তার উপর আছে হল ভাড়া। অনুষ্ঠানের দিন অত লোকের জন্য খাবারের প্যাকেট। আমন্ত্রিতদের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেট। কিন্তু আকাদেমির তো অত টাকা নেই। তাই, উনি যাঁদের পুরস্কার দেবেন বলে ভাবেন, তাঁদের সঙ্গে আরও কিছু লোককে উনি পুরস্কার দেন। অবশ্যই একেবারে এলেবেলে লোককে নয়, যাঁর কিছু অবদান আছে, এবং আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট স্বচ্ছল, তেমন লোককে। তাঁদের সঙ্গে আগেই উনি কথা বলে নেন, আপনাকে আমরা পুরস্কার দিচ্ছি, কিন্তু এই অনুষ্ঠানের যে বিপুল খরচ, তার অন্তত কিছুটা আপনাকে ডোনেট করতে হবে। এই শর্তে নাকি বহু লোকই রাজি হয়ে যায়।
দু’-এক দিন পর পরই বিধানদা ফোন করেন, কাউকে পেলে? ঋজুর ভাল লাগে না। ভাবে, কাকে বলব! কী ভাবে বলব! এমন সময় মনে পড়ে গেল গৌর মিত্রের কথা।
ঋজু এক দিন কথায় কথায় ওর অফিসের দেবদূতদাকে বলেছিল, ওর বউয়ের অর্থপেডিক সমস্যার কথা। সেই কবে, বিয়েরও আগে, বড় নালা টপকাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল সে। গোড়ালি থেকে সরে গিয়েছিল হাড়। তিন-চার বার প্লাস্টার করা হয়েছে। বহু ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এখনও রাতের দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। পেন কিলার খেয়ে দিন কাটায়।
দেবদূত কোনও কথা বলেননি। খসখস করে দু’লাইন চিঠি লিখে দিয়েছিলেন এনআরএসের সুপারিনটেন্ডকে। বলেছিলেন, কালই চলে যাস। ও সব ব্যবস্থা করে দেবে।
বউকে নিয়ে পর দিনই ও গিয়েছিল হাসপাতালে। সুপারিনটেন্ড তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙে ব্যস্ত। কখন ফাঁকা হবে কেউ বলতে পারছে না। ঋজু তাই বেয়ারাকে দিয়ে দেবদূতের লেখা চিঠিটা সুপারিনটেন্ডের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ডেকে নিয়েছিলেন তিনি। ওখানকারই একজনকে সঙ্গে দিয়ে বলেছিলেন, আমি এখন একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। কিছু মনে করবেন না। ইনি হচ্ছেন গৌরবাবু। আপনাকে নিয়ে যাচ্ছেন। উনিই সব ব্যবস্থা করে দেবেন। দেবদূতবাবু ভাল আছেন তো?
করিডর দিয়ে যেতে যেতে গৌরবাবু নানান প্রশ্ন করছিলেন। কী নাম? কোথায় থাকেন? সুপারকে চিনলেন কী করে? কী করেন?
যে-ই শুনলেন, ঋজু আনন্দবাজারের লোক, অমনি তাঁর চেহারা পাল্টে গেল। কাঁচুমাচু হয়ে বলতে লাগলেন, আচ্ছা, আপনাদের রবিবারের পাতায় গল্প দিতে গেলে কী করতে হয়?
তার পর থেকে আর সঙ্গ ছাড়েননি উনি। ডাক্তার দেখানোর পর নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের। চা খাইয়েছিলেন। উনি নাকি বহু দিন ধরে গল্প লিখছেন। উপন্যাসও লিখেছেন। দশ-বারো বছর আগে তাঁর একটা বই বেরিয়েছিল। এ বছর বইমেলাতেও একটা বই বেরিয়েছে। লাস্ট বইটার একটা কপিও তিনি সে দিন ওদের উপহার দিয়েছিলেন। বইটার মলাটে লেখকের নাম দেখেই ঋজু জেনেছিল, লোকটার পদবি মিত্র। গৌর মিত্র। বাসে ফেরার সময় উল্টেপাল্টে দেখেওছিল বইটা। না। আহামরি নয়। তবে খুব একটা খারাপও নয়।
এ দিকে বিধানদা বারবার তাকে তাগাদা দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে এসেছে। হাতে আর সময় নেই। যে যা দেয়, দেখো না... ঋজু বুঝতে পারছে, যতক্ষণ না ও কাউকে জোগাড় করে দিচ্ছে, এই লোকটা ততক্ষণ ওকে জ্বালাবে। অথচ তাঁকে কিছু বলতেও পারছে না ও। তাই একদিন গৌরবাবুকে ফোন করে ওই বইটার ভূয়সী প্রশংসা করল সে—  খুব ভাল বই। এই বইটার একটা পুরস্কার পাওয়া উচিত।
গৌরবাবু তো খুশিতে ডগমগ। তিনি বলতে লাগলেন, আমি ভাই নিজেকে একদম নিংড়ে দিয়েছি। আমার লেখায় কোনও ফাঁকি পাবেন না। কিন্তু জানেনই তো, পুরস্কার-টুরস্কার সব লবির ব্যাপার। ও সব আমি করতেও পারি না। যোগাযোগও নেই। চাইও না।
কিন্তু ঋজু যে-ই মধুসূদন আকাদেমির কথা বলল এবং পুরস্কার পাওয়ার শর্তের কিছুটা আভাস দিল, গৌরবাবু যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। নিজে থেকেই বললেন, দেখুন না যদি হয়, যা লাগে দেব। জীবনে তো কিছুই পাইনি। শেষ বয়সে যদি কিছু পাই।
ও বিধানদার সঙ্গে গৌরবাবুর আলাপ করিয়ে দিল। অনেক দর কষাকষির পর দু’হাজার টাকায় রফা হয়ে গেল মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কারের।
না। আর কোনও পার্টি জোগাড় করে দিতে পারেনি ও। তবে তার পর থেকেই, বয়সের বিস্তর ফারাক থাকলেও বিধানদার সঙ্গে ওর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেই সখ্যতার সূত্র ধরেই ঋজুকে সুন্দরবন যাওয়ার কথা বলেছিলেন বিধানদা। যদিও এর আগে ঋজু এক বার সুন্দরবন গিয়েছিল। ওর বন্ধু হাননান আহসান একটা মেডিকেল টিম নিয়ে এক বার কুমিরমারি যাচ্ছিল। সুন্দরবনের নাম শুনেই আগ্রহ দেখিয়েছিল ঋজু। হাননান বলেছিল, তা হলে চলুন না আমাদের সঙ্গে।
সে বার সুন্দরবনে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুই দেখা হয়নি তার। ট্রেনে করে ক্যানিং। তার পর মাতলা নদী পেরিয়ে ডকঘাট। সেখান থেকে ট্রেকারে করে সোনাখালি। সোনাখালি থেকে ভটভটি চেপে সোজা কুমিরমারি। খুব ভোরে রওনা হয়েও পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল ওদের। রোগী দেখতে দেখতে রাত। রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে পর দিন ভোর বেলাতেই কলকাতার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিল ওরা। তাই বিধানদা যখন বললেন, উদ্যোক্তারা সুন্দরবনটা ঘুরিয়ে দেখাবে বলেছে, তখন এক কথায় রাজি হয়ে গেল ও।
শ্যামবাজারের মেট্রো স্টেশনের কাছে অপেক্ষা করছিল উদ্যোক্তাদের পাঠানো সাদা আম্বাসাডর। ঋজু গিয়ে দেখে, শুধু বিধানদাই নয়, বিধানদার সঙ্গে তাঁর মেয়েও আচ্ছে। বছর তেইশ-চব্বিশ বয়স। গোলগাল চেহারা। ফর্সা। গড়পরতা বাঙালি মেয়েদের মতোই হাইট। ও যেতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
চুটিয়ে ঘুরেছিল ওরা। বিধানদা ওর দাদার মতো। তাই তাঁর মেয়ে শ্বেতাকে ও আর আপনি-আজ্ঞে করেনি। আলাপের সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে তুমি দিয়েই শুরু করেছিল কথাবার্তা। তখনও বাসন্তীর ওই ব্রিজটা হয়নি। গাড়ি নিয়ে ও পারে যাওয়া যেত না। তাই নৌকো করে ও পারে গিয়েই সারা দিনের জন্য ওরা একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে নিয়েছিল। যিনি ওদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তিনি আর বিধানদা বসেছিলেন সামনে। ঋজু আর শ্বেতা বসেছিল রিকশার পেছনে পা ঝুলিয়ে, পাশাপাশি। উল্টো দিকে মুখ করে।
সন্ধ্যা নামছিল। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছিল। ঋজু হঠাত্‌ শ্বেতাকে বলল, এখন যদি আচমকা একটা বাঘ সামনে এসে পড়ে, কী করবে?
একটু ঘাবড়ে গিয়ে সে বলল, এই, সন্ধেবেলায় একদম এই সব কথা বলবেন না।
— কেন?
— এটা সুন্দরবন না! জানেন না, এখানে ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির।
— জানি। সেই জন্যই তো বললাম।
ওরা যখন কথা বলছে, ও দিকে বিধানদা আর ওই সঙ্গী ভদ্রলোক একনাগাড়ে কী সব বকর বকর করে যাচ্ছেন। কিছু একটা আলোচনা করছেন ঠিকই, কিন্তু কী যে আলোচনা করছেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। দমকা বাতাস হঠাৎ হঠাৎই কানের কাছে ফরফর করে কানের লতি শীতল করে দিয়ে যাচ্ছে।
সুনসান সরু রাস্তা। বেশ অন্ধকার-অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশ। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ বাঘের গর্জন। ঋজুর পাশে বসেছিল শ্বেতা। সে ওকে জাপটে ধরল। ঋজু বলল, ভয় পেয়ে গেলে?
— সত্যি, আপনি না, উফ্, এই ভাবে কেউ ভয় দেখায়?
— আবার দেখাব?
— কেন?
— তা হলে আবার এই ভাবে আমাকে...
— ধ্যাত্‌, আপনি না...
বিধানদা আর ওই লোকটা তখন হো হো করে হাসছেন। কেন হাসছেন, ওরা বুঝতে পারল না। এর মধ্যেই এত ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নেমে এসেছে যে, নিজেদের হাত পা-ই দেখা যাচ্ছে না। সেখানে উল্টো দিকে মুখ করে বসা, বিধানদারা নিশ্চয়ই এক মুহূর্ত আগে ঘটে যাওয়া ওদের এই ব্যাপারটা দেখতে পাননি। কী ঘটেছে বুঝতেও পারেননি। নাক দিয়ে তার বাঘের গর্জন করাটা হয়তো শুনলেও, শুনে থাকতে পারেন!
অন্ধকারের মধ্যে চালক হয়তো খেয়াল করেনি। যেতে যেতে ভ্যানরিকশার চাকাটা হঠাৎ গর্তে পড়ে গেল। ভ্যানরিকশাটা ঝাঁকুনি দিয়ে লাফিয়ে উঠল। অতশত না ভেবে ঝপ করে পেছন থেকে শ্বেতার কাঁধটা চেপে ধরল ঋজু। যাতে পড়ে না যায়।
— এই ছাড়ুন। পিছনে বাবা আছে। খুব চাপা গলায় বলল শ্বেতা। ঋজু বলল, উনি এখন গল্পে মশগুল। আমরা যে এখানে আছি, উনি হয়তো ভুলেই গেছেন।
— যদি পেছনে তাকায়?
— তা হলেও দেখতে পাবে না। এত অন্ধকার...
— আপনি না...
— হ্যাঁ আমি। বলে, ওকে আরও কাছে টেনে নিল ঋজু।

যখন হোগল নদী পার হবার জন্য ভ্যানরিকশা থেকে নেমে ওরা খেয়াঘাটের দিকে যাচ্ছে, ও দিক থেকে একটা লোক ঋজুর সামনে এসে দাঁড়াল, আপনি এখানে?
— ও পারে, ওই কুলতলিতে, নারায়ণতলা রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরের একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। তা, এই দ্বীপটাও একটু ঘুরে গেলাম।
— আমাকে চিনতে পেরেছেন?
— না, ঠিক, আসলে...
— আমি প্রভুদান হালদার। ব-দ্বীপ বার্তায় লিখি। বাংলা আকাদেমিতে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল...
— ও, আচ্ছা আচ্ছা। তাই বুঝি? আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন বিধান দত্ত...
— আপনি বিধান দত্ত? আরিব্বাশ। আপনি তো বিখ্যাত মানুষ। লাফিয়ে উঠল সে। মুখের মধ্যে ঝলমল করে উঠল এক ঝলক আলো। বিধানদার হাত দুটো ধরে সে বলতে লাগল, আমি ভাবতেই পারছি না, আপনার মতো একজন লোকের সঙ্গে এখানে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে। আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। আপনার নাম তো গত বছর নোবেল প্রাইজে উঠেছিল, তাই না?
বিধানদা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এক বার ঋজুর দিকে তাকাচ্ছেন আর এক বার লোকটার দিকে। তার পরেই লোকটাকে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল। একটু কথা বলতে পারলে আরও ভাল লাগত। কিন্তু আমাদের আবার তাড়া আছে। অনেকটা যেতে হবে তো... ও পারে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। আপনার সঙ্গে পরে আবার কথা হবে, কেমন?
লোকটার চোখমুখ পাল্টে গেছে। আনন্দে আপ্লুত। যে-কোনও দিন নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন, এমন একটা লোকের সঙ্গে যে এই জায়গায়, এই ভাবে তার দেখা হবে যাবে, তা বুঝি সে কল্পনাও করতে পারেনি। তাই, যাবার জন্য বিধানদা উসখুশ করলেও লোকটা কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে চাইছিল না। ঠিকানা নিল। ফোন নম্বর নিল। তার পর কোনও রকমে রেহাই দিল।

পর দিন কলকাতায় ফেরার সময় গাড়িতে আসতে আসতে ঋজুকে বিধানদা বললেন, কলকাতায় গিয়ে কিন্তু কালকের রাতের ব্যাপারটা আবার কাউকে বলে দিও না। যা সব লোকজন। এই নিয়ে আবার হাসাহাসি করবে। ও, ভাল কথা। সামনেই তো আমাদের অনুষ্ঠান। হাতে আর সময় নেই। ম্যামেনটো-ফ্যামেনটো সব হয়ে গেছে। না হলে কবিতার জন্য এ বারই তোমাকে একটা পুরস্কার দিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু কী করব! তুমি বরং একটা কাজ করো, অনুষ্ঠানের দিন পুরস্কার পর্ব মিটে যাওয়ার পরে তুমি তোমার পছন্দের লোকজন নিয়ে একটা কবিতা পাঠের আসর করে দাও। কী, কেমন হবে?

বিধানদা বলে দিয়েছেন। আর কোনও চিন্তা নেই। ঋজু উঠে পড়ে লেগেছে। একে ফোন করছে। তাকে ফোন করছে। কে কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, কার সঙ্গে কার গাঁটছড়া, কাকে নিলে আখেরে তার লাভ, এই সব সাত-পাঁচ ভেবে, হিসেব-নিকেশ করে সে তালিকা তৈরি করছে। কাকে নেওয়া যায়! কাকে নেওয়া যায়! কাকে নেওয়া যায়!
তালিকা তৈরি। কিন্তু আজ সকালে কণিকার অমন একটা ফোন পাওয়ার পর তাকে না রাখলে হয়! তাই, সেই তালিকার প্রথমেই লেখা হয়ে গেল কণিকার নাম। পরমার্থকে এক বার দেখিয়েও নিল সে, কোনও অসুবিধে নেই তো? এক ঘণ্টার ওপর সময়। সাতাশ জন কবি। তিন মিনিট করে এক-একজন পড়লেও, সবাই তো আর ঘড়ি দেখে পুরো তিন মিনিট করে পড়বে না। কেউ কেউ ছোট কবিতাও পড়বে। আবার দু’-একজন নাও আসতে পারে। হয়ে যাবে না?

ফোন করে কবিদের তালিকাটা শুনিয়েও দিল বিধানদাকে। তিনি কোনও উচ্চবাচ্চ্য করলেন না। শুধু বললেন, এত জন! অত সময় হবে! সবাইকে একদম ছোট্ট ছোট্ট কবিতা পড়তে বলবে, কেমন? না হলে কিন্তু সময়ে কুলোবে না। সাড়ে ন’টার মধ্যে হল ছেড়ে দিতে হবে। না হলে কিন্তু কশন মানি থেকে ওরা পাঁচশো টাকা কেটে নেবে।
ঋজু বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। সব হয়ে যাবে। বলেই, ফোন করল কণিকাকে। একটা বাচ্চা মেয়ের গলা, মা এখনও আসেননি।
— এখনও আসেননি! দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল ঋজু। আটটা বেজে গেছে। ঠিক আছে, পরে করব, বলেই, তালিকায় নাম লেখা কবিদের একটার পর একটা ফোন করতে লাগল সে। আর কথা হওয়ামাত্রই সেই নামের পাশে বসিয়ে দিতে লাগল একটা করে টিক চিহ্ন।
পরে, মেলাতে গিয়ে দেখে সবাইকেই ফোন করা হয়েছে। শুধু কণিকাকে ছাড়া। রাত তখন এগারোটা বেজে গেছে। ও মনে মনে ভাবল, এত রাতে ফোন করাটা কি ঠিক হবে! তার পরেই মনে পড়ল, ও তো বলেছিল, যখন খুশি ফোন করতে পারেন। একটা, দুটো, তিনটে। সেই তুলনায় তো এখন সবে সন্ধে।
ও ফোন করল। দেখল, এনগেজড। খানিকক্ষণ পর আবার করল। তখনও তাই। তার আধ ঘণ্টা পরেও, ওই একই। শুধু এনগেজড আর এনগেজড। আর একটা নম্বর ছিল। মোবাইলের। সেখানেও করল। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল রেকর্ডেট গলা, আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি এখন পরিষেবা সীমার বাইরে।
দু’মিনিট পর আবার করল। এ বার ভেসে এল— এই নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই। ঋজু অবাক। একটু আগেই বলল, পরিষেবা সীমার বাইরে, এখন আবার বলছে এই ফোনের কোনও অস্তিত্ব নেই! এই নম্বরটা তো ও-ই দিয়েছিল। তা হলে কি ও ভুল নম্বর দিল! কিন্তু খামোকা ভুল নম্বর দিতে যাবে কেন! তা হলে কি আমিই টুকতে ভুল করেছিলাম! আর এক বার দেখি তো, ফের ফোন করল ও। শুনতে পেল সেই একই কথা। তার পরেও বেশ কয়েক বার ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছে ও। এমনকী, অফিস থেকে যখন বেরোয়, সেই রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ, তখনও তার ফোন ব্যস্ত।



                                   ক্রমশ...





দ্বিতীয় পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন- 



চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024