উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -4


 


সুরজিৎ বাবু অতি আনন্দিত হলেন। সুমন্ত গ্রামের গৌরব। সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেছে। প্রতিটি সাবজেক্টে ৯৩ পারসেন্ট নাম্বার আছে। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সমুন্তকে যাতে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।


  তিনি বললেন, সুমন্তর কাছে মত নিতে। কারণ সংসার যদি বিচ্ছিন্ন না হতো তাহলে গলা হাঁকিয়ে বলতে পারতেন। বাবা, সুরজিৎ বাবুকে বলেছিলেন, সুমন্তকে ডাক্তারী পড়াতে হলে যদি পথে বসতে হয় তাতেও তিনি রাজী আছেন। স্বপ্ন পূরণ করা তার কর্তব্য। তাই অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করেও পিছু হটবেন না। সুমন্তকে ডাক্তারী পড়াবেন এ তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।


 দাদাকে ডাকা হলো, দাদা বলতে সুমন্তদা একাই। দ্বিতীয় কোন ভাই ও বোন ছিল না আমার। দুই ভাই বোনকে জন্ম দিয়ে মা পৃথিবী হতে চিরবিদায় গ্রহণ করছিলেন অনেক আগে। মা বিদায় নিয়ে ভালই করেছিলেন। নতুবা পরিনতি ভয়াবহ হতো তা অজানা নয়। এখন ও পরের কথা। 


সুমন্তদা বাবার কাছে হাজির হতে বাবা খোলাখুলি আলোচনা করলেন। সে সময় সুরজিৎ বাবু উপস্থিত ছিলেন। দাদা কোন মতেই রাজী হতে চাইলেন না। বারবার এক কথা ও স্বপ্ন দেখে কি লাভ। একান্নবর্তী পরিবারে থাকলে তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করা যেত। এখন তাদের ছন্নছাড়া জীবন। অভাব অনটন ও দারিদ্রই তাদের জীবনের নিত্য সহচর। ডাক্তারী পড়তে হলে কত টাকা যে খরচ হবে তার হিসেব নেই। শেষ কালে কি পথে বসবে তারা?  


সুরজিৎ বাবু বুঝিয়ে বললেন। যদি বা বাবার কথা কাটতে পারতো বিশেষ করে সুরজিৎ বাবুর কথা কাটতে পারলেন না। তিনি বললেন, শুধু তোমার বাবার স্বপ্ন নয় সুমন্ত, প্রতিটি গ্রামবাসীর ইচ্ছা তুমি ডাক্তারী পাস করে গ্রামবাসীদের মৃত্যুর কবল হতে রক্ষে করবে। জানতো, কোন ডাক্তার এই পল্লী অঞ্চলে আসতে চায় না। কারণ ডাক্তারী পাশ করার সময় শহরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে পল্লী অঞ্চলে চেম্বার করতে তাদের অত্যন্ত অনীহা থাকে। আমরা তোমাকে কোলে - পিঠে মানুষ করেছি। যদি শহর হতে আসতে ইচ্ছে না করে জোরপূর্ব্বক গ্রামে আনার ক্ষমতা আমাদের আছে। তবে গ্রামে যদি আশানুরূপ রোজগার না হয় তাহলে শহরে সপ্তাহে চারদিন থাকলে, গ্রামে হয়তো তিন দিন এসে চেম্বারে বসলে গ্রামের অনেক উপকার হবে। 


তারপর কি জানো তোমার ঠাকুরদা স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রেমাংশুকে ডাক্তার করে গ্রামের অভাব পূরণ করবেন। কিন্তু ভাগ্যচক্রে এ রকম যে বিপর্যয় হবে কেও কি কোনদিন কল্পনা করেছিলো? 


সুমন্ত মাষ্টার মশায়ের সব কথা শুনে বললো, তা না হয় হলো, কিন্তু বাবার যে সম্পত্তি আছে ওতে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে পারবেন কি?


সুরজিৎ বাবু বললেন, কোন ভয় নেই তোমার। তোমার বাবা যদি শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে না পারেন, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সেজন্য তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।  


সুমন্তদা আরো কিছু বলার জন্য সচেষ্ট হতে থাকে। কিন্তু বিরুদ্ধ অন্তরের কথাকে কোন প্রকারে বাঙ্ময় করতে পরলো না। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। 


  সুরজিৎ বাবু বললেন পুনরায়, সুমন্ত, তুমি আর বিলম্ব করো না। আগামীকাল আমার কাছে যাবে, নীহার বাবুর সাথে আলোচনা করে ওর সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দেব।


 সেদিন আর আলোচনা না করে সুরজিৎ বাবু আপনি বাড়ি পানে পা বাড়ালেন। দাদার ডাক্তারী পড়ার সব রকম আয়োজন হলো। বাবা গ্রামীণ মানুষ, দিনক্ষণকে ভীষণ মানেন। তাই পাড়ারই একজন এ্যাস্ট্রোলজারকে দিয়ে ভালো দিন দেখিয়ে পাড়ারই বিশিষ্ট ব্যক্তি নীহার বাবুর সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। ভর্তি হতে কোন বাধা হলো না।


 তিনি বলেছিলেন, সমুন্তর ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন। ডাক্তারী পাশ করার জন্য কোন বাধা বিঘ্ন নেই। সে সুন্দরভাবে ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে ফিরে আসবে। সেই এ্যাস্ট্রোলজারের কথা মনে ছিলো বলে বার বার তার চরণে প্রণাম জানিয়ে ইচ্ছে করছিল। এ জন্য যে, দাদা সুস্থ সকল শরীরে ডাক্তারী পাশ করে বাড়ীতে এসেছিলো বলে। একটু ধৈর্য্য ধরুন পরের পর সবই জানতে পারবেন। কারণ আমি মনযোগে লিখে চলেছি। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছি পরের পর ঘটনাকে কেন্দ্র করে।


 দাদা শুভ দিনে কলকাতায় ভর্তি হলো। বাবা ও সুরজিৎ বাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কারণ দাদার মোটেই ইচ্ছে ছিলো না ডাক্তারী পড়বার। তাকে জোর পূর্ব্বক ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তারী পেশায় যেন নামানো হলো। এ কথা শুনে মেজকাকা জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কেন যে আমাদের প্রতি এতো হিংসে হয়েছিলো তা বুঝতে পারিনি। বাবা জমিদার পরিবারের আভিজাত্যকে পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমের পথ বেছে নিলেন।

 

সেই সময় ভাবতে বড় আশ্চর্য লাগছিলো, যে মানুষটা চব্বিশ ঘন্টা জঙ্গলে পড়ে থাকতেন, বন্য জন্তুর পিছনে সর্বদাই ছোটাছুটি করতেন। সে মানুষটা যে এরূপ পাল্টে যাবে কোন দিন ভাবতে পারিনি। 


আমাকে পড়াশুনা ছাড়তে হলো। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর এগোতে পারলাম না। বাবার পরিশ্রমের পয়সাতে সুন্দরভাবে সংসার চালাতে চেষ্টা করলাম। একদিন কোথা হতে ছোট কাকা উদয় হলেন; প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে। তিনি যে এতো রোগা হয়ে যাবেন কল্পনা করিনি। কাকা ছিলেন সুপুরুষ, তেজদীপ্ত চেহারা ও দেহে আভিজাত্যের ছাপ। গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছোট কাকার চেহারা নিয়ে প্রশংসা করতেন। কিন্তু ছোটকাকার ঐ রূপ রোগা শরীর দেখে চোখ দুটো যেন গাম আঠা দিয়ে চিটিয়ে রেখেছিলেন। 


ছোটকাকা এসেই বললেন, কিরে রমা আমায় চিনতে পারছিস না? কি করে পারবি বল, আমি যে তোদের বংশের নাগাল হতে অনেক দূরে সরে গেছি। দুর্ভাবনায়, দারিদ্রতায় নিজেকে তিলে তিলে দগ্দ করছি। ভগবান যে আমাকে এতো কঠোর নির্যাতন দেবেন তা কোন দিনই মনে আনিনি। সবই ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছু নয়রে। 


ছোট কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন, জানি না জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করে কি পাপ করেছি। সেই পাপের যন্ত্রণা প্রতিটি শিরা , উপশিরায় প্রবেশ করে আমাকে মৃত্যুমুখী করে তুলেছে।


 আমি ছোট কাকার কথাগুলো শুনে শোকাহত যে হলাম না তা নয়। আমাকে মনমরা হতে দেখে তার দুঃখের কাহিনীকে অন্তরালে চাপা দিয়ে বললেন , তা হ্যাঁরে তোর বাবা কোথায়?


বললাম, বাবা উপার্জনে গেছেন। 


কি বলছিস তুই ? তবে কি মেজদা, বড়দাকেও ফাঁকি দিয়েছেন? 


আমি নীরব ছিলাম। মেজকাকাকে নিয়ে নানা কটু কথা বললেন তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য। যদি কোন দিন সবল হতে পারেন তাহলে একদিন বদলা নেবেন। এখন ছোট কাকা ভাগ্যের বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত পরে যেদিন ঈশ্বর ওর মুখপানে তাকাবেন সেদিন, এদিন তার থাকবে না। বাবা একটু পর বাড়িতে এলেন। কাকার দূরাবস্থার কথা শুনে প্রচুর দুঃখ পেলেন। কাকার আগমন বার্তা শুনলেন। বাবা যদি কিছু আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য না করেন তাহলে কাকা অসহায়ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।


 কাকার দুঃখে বাবা কাতর হয়ে পড়লেও সাহায্যের উদার হস্ত প্রসারিত করলেন। যেটুকু দিয়ে সাহায্য করলেন তা বহু কষ্টের উপার্জিত অর্থ। দাদার ডাক্তারী পড়ার ব্যবস্থা না করে বাবা আরো আর্থিক সাহায্য দিয়ে প্রকৃত ভ্রাতৃ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন।


 দাদার ডাক্তারী পড়া কথা শুনে ছোট কাকা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বিশেষ করে আনন্দিত হয়েছিলেন এ কারণে, ঠাকুর্দার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে বলে তিনি আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়তেই বললাম, ছোট কাকা একটু দাঁড়াও আমি আসছি। 


দ্রুত বেগে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বাক্স হতে এক জোড়া কানের দুল বের করে তার হাতে দিলাম। ছোট কাকার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হলে আমাকে শান্ত স্বরে

বললেন, আমার অবস্থা এখন চরম সীমানায় উপস্থিত হয়েছে। তবুও তোর কানের দুল দুটো নেবার কোন স্পৃহা আমার নেই। তুই রেখে দে রমা, একদিন দারুন কাজে লাগবে। আমি জানি এই দুটো নিলে আমার অভাব মিটবে না। কিন্তু তোরা যে শপথ নিয়ে যে পথের যাত্রী হয়েছিস আমারও কর্তব্য ছিলো তোদেরকে সাহায্য করা। দুল দুটো রেখে দে মা।


 আমি বললাম, আমরা ঠিকই এগিয়ে যাবো ছোট কাকা তোমাদের আশীর্বাদে এ দুটো নাও, এ সময় টাকার প্রয়োজন তোমার। খোকনকে বাঁচাতেই হবে । সেও তো আমার ভাই। তোমাকে নিতেই হবে এ দুল দুটো।


 বার বার অনুরোধে আমার কথা কাটতে পারলেন না। শুধু ঠোঁটে হাত দিয়ে আমাকে বললেন, তুই আমার মায়ের কাজ করলি রমা। তবে এই চন্দ্র সূর্য্যকে সাক্ষী রেখে শপথ করে বলছি, ঈশ্বর যদি কোন দিন আমার প্রতি সদয় হয়ে থাকেন, তাহলে আমার মায়ের ঋণ শোধ করবই। এই ঔ


 ছোট কাকা আর দাঁড়াননি ওখানে। ছল ছল চোখে স্থান ত্যাগ করলেন। তিনি স্থান ত্যাগ করতে আমারও চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো ও বার বার তার মলিন মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ওকে অনুসরণ করে দাদুর স্মৃতি মনে উদিত হয়ে আমাকে ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কি ছিলো আমাদের অবস্থা আর কি হয়েছে। এখন কোন অপরিচিত লোকদের যদি বলে থাকি, আমি জমিদারের নাতনী, কেউ বিশ্বাস করবে না! সকলে হেসে উড়িয়ে দেবেন। সেদিন কি আর ফিরে আসবে । জানি না এরপর ঈশ্বর আর কোন ভাগ্যবিপর্যয়ের জাল ফেলবেন। অতীত মনে পড়লে কিছুক্ষণ মনকে উতলা করে একটু পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তির আস্বাদ মিটিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে আমাদের অভাবের সংসার এগিয়ে চললো।



                                                ক্রমশ...


তৃতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-

Click here 🔴



পঞ্চম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--

Click here 🔴

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024