ছোট গল্প - মাস্টার মশাই || লেখক - অমিতাভ ভট্টাচার্য্য || Written by Amitabh Bhattacharya || Short story - Master moshay


 

মাস্টার মশাই 

অমিতাভ ভট্টাচার্য্য


ওদের দুজনের বন্ধুত্ব সেই ছেলেবেলা থেকে। কখন যেন একসাথে খেলাধূলো করায় টান পড়ল। তারপর এক সময় দুজনের মধ্যে সলজ্জ দৃষ্টি বিনিময় শুরু হল। তখন ওরা দূজনেই ইস্কুল জীবনের শেষের দিকে। গরমের ছুটির এক নির্জন দুপুরে, হঠাৎ সমীরণ খুব উচাটন মন নিয়ে একটা বই শর্বরীকে ফেরৎ দেবার অছিলায় ওর একটা হাত ধরে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে কোনদিন ভূলে যাবে না তো?’ শর্বরী তাকে কথা দিয়েছিলো যে সে ওর জন্যে আজীবন অপেক্ষা করে থাকবে। কিন্তু সে কথা রাখেনি। বিএ পরীক্ষার আগেই বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়েতে বসে যায়। বাবা-মার চাপের কাছে ও যে কতো অসহায়, তা একটা কাগজে বিস্তারিত লিখে এক বান্ধবীর হাত দিয়ে বিয়ের দিন সকালে সমীরণের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। সমীরণের বড়দা বেশ কিছুদিন হল সংসারের হাল ধরেছে। মেজদা একটা ভাল সরকারী পদে চাকরি পাবার পর বড়দার সঙ্গে যোগ দেয়। আস্তে আস্তে সংসার বড় হতে থাকল। একদিন বড়দা অসুস্থ অবস্থায় অফিস থেকে তারাতারি বাড়ি ফিরে রাতের দিকে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তার ডাকা হল সঙ্গে সঙ্গে। ডাক্তার বড়দাকে পরীক্ষা করে বলল, ‘ম্যাসিভ স্ট্রোক’। বড়দা হাসপাতালে ভর্তি হল। এক সপ্তাহ পরে ছাড়া পেয়ে প্যারালাইজড অবস্থাতে আজও শয্যাশায়ী। বড়দার এই অবস্থায় মেজদা বাবাকে বলল, ‘আমরা চারজন এই সংসারে না থাকলে, আর্থিক চাপটা তোমার অর্ধেক হয়ে যাবে। সুবিধে হবে সংসার চালাতে। আমরা না হয় মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো তোমাদের।’ যেদিন মেজদা, মেজবৌদি আর তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল, বাবা সেদিন সমীরণের একটা হাত নিজের দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সমু, আমি আবারও  হেরে গেলাম রে।’ এই প্রথম সমীরণ তার বাবাকে কাঁদতে দেখল। বড়দা যেখানে কাজ করত তারা মানবিকতা দেখিয়েছিল। সমীরণ পড়াশুনো বন্ধ করে সেই চাকরিতে মন দিল। এর কিছুদিন পরে বাবা মারা গেলেন। মাঝে মাঝে শর্বরীর কথা সমীরণের মনে আসেনা তা নয়। যে অল্প সংখ্যক মানুষের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে, সমীরণের ধারণা শর্বরী তাদের মধ্যে একজন।  



ট্রেনটা আজ খুব দেরিতে যাচ্ছে। বাড়ি পৌঁছতে নির্ঘাৎ রাত হয়ে যাবে সমীরণের। কিছুদিন ধরে চোখ নিয়ে সমস‍্যায় পড়েছে। ওর বন্ধু দেবাশীষ ওকে পরামর্শ দিয়েছে চোখের ডাক্তারের কাছে যাবার জন‍্যে। কিন্তু সমীরণের সাহস হচ্ছে না। কত টাকা ডাক্তারের ফি তাই বা কে জানে। যদি চশমার কাঁচ পাল্টানোর কথা বলে, তার জন্য খরচ কত পড়বে সমীরণ জানেনা। জানবেই বা কি করে? অসুখ বিসুখ সর্দি কাশি মাঝে মধ‍্যে যে হয়না তা নয়। তবে তার জন্যে ডাক্তার বদ‍্যি দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ার চল অনেকদিন হল বাড়ি থেকে উঠে গেছে। মাস গেলে মাইনের টাকাটা বড় বৌদির হাতে দিয়ে দেয়। বড় বৌদি সেই টাকা থেকে ওকে ওর হাত খরচ আর ট্রেনের মান্থলীর খরচ বাবদ টাকা দেন। এছাড়া দুটো রুটি আর আলু ভাজা বা কোনো একটা তরকারী অফিসে যাবার সময় টিফিন বাক্সে ভরে ওর হাতে দেন। হাত খরচ বলতে তেমন কোনো খরচ ওর নেই।  টাকাটা সমীরণ জমিয়ে রাখে।   



ষ্টেশন থেকে বাড়ি যাবার জন্যে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। রাস্তাটা সন্ধ্যের পর অন্ধকার থাকে। ঐ রাস্তা দিয়ে যাবে কি যাবেনা এই নিয়ে যখন দোটানায়, তখন একজন যুবক সমীরণের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, 'মাস্টারমশাই কেমন আছেন?' সমীরণ খুব অবাক হল। পায়ে হাত দিয়ে আজকাল তাকে কেউ বড় একটা প্রণাম করে না। তিন ভাই দুই বোনের মধ‍্যে সে সবার ছোট। ছোটবেলা থেকে সে বড়দের প্রণাম করেই এসেছে। সমীরণ যুবকটিকে বলল, 'আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না তোমাকে।'


আমাকে চিনতে পারলেন না মাস্টারমশাই? আমি অরুণাভ; আপনার ছাত্র ছিলাম।


আমি তো কোনদিন স্কুলে পড়াইনি। তুমি বোধহয় আমাকে অন‍্য কারোর সাথে গুলিয়ে ফেলেছ।


আপনি আমাকে বাড়িতে পড়াতেন মাস্টারমশাই; মাধ‍্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন।



অরুণাভর চেহারাটা মনে পড়ল সমীরণের। অরুণাভ যখন মাধ‍্যমিক পরীক্ষা দেয় তখন ছিল ছিপছিপে চেহারার কিশোর। একেবারে চিনতে না পারার মতো পরিবর্তন ওর চেহারায় আসেনি বটে। তবে সমীরণের ওকে চিনতে একটু সময়ই লাগল। অরুণাভকে স্নেহ করত সমীরণ। সবাই অবশ‍্য এই স্নেহ করাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখত, "বড়লোক বাড়ির টিউশনি, মাস গেলে অনেক টাকা মাইনে। তার ওপরে ভারী টিফিন খেতে দেয়। ছাত্রকে স্নেহ না করে উপায় আছে?" 



সমীরণ হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, আরে অরু, কতো বড়ো হয়ে গেছিস! কি করছিস এখন?


বাবার ব‍্যবসা দেখছি মাস্টারমশাই।


লেখাপড়া আর করলি না?


বাবা একদিন বললেন, 'এতো বড় ব‍্যবসা, আমার অবর্তমানে সাতভূতে খাবে। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে কি লাভ হোলো?' আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। পাশ করে সোজা বাবার ব‍‍্যবসায় ঢুকে পড়লাম।


সাতভূতকে একেবারে অভুক্ত রেখে দিলি? 


দুজনেই হেসে উঠল এই কথায়।  



অরুণাভর বাবার খুব শখ ছিল ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবেন। নিজে বিশেষ লেখাপড়া করতে পারেননি। সাহস করে একমাত্র ছেলেকে ইংরেজি মাধ‍্যম স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করাতে পারেননি। সমীরণ যেদিন পড়ানোর খবর পেয়ে দেখা করতে গেল, সেইদিন অরুণাভর বাবা নিজের মনের কথাটা ওকে বলে ফেললেন, 'বাড়িতে তো ইংরেজিতে কথা বলা হয়না, তাই মাস্টার রাখা'। কথাটা শুনে অরুণাভ বলেছিল, 'আমি তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারিনা। আপনি বরং অন‍্য কোন টীচার দেখুন, যিনি পড়ানো আর ইংরেজিতে কথা বলা দুটোই একসাথে শেখাতে পারবেন।’ অরুণাভর বাবা সমীরণের এই কথা শুনে অপ্রতিভ হয়ে বললেন, 'না, না, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। আপনারা শিক্ষিত পরিবারের ছেলে, যা পড়াবেন তাতেই আমার ছেলের অনেক হবে।' 



অরুণাভ আর তার মাস্টারমশাই একই পাড়াতে থাকে। একই পাড়াতে থাকলেও দুজনের মধ‍্যে দেখা সাক্ষাৎ অরুণাভর মাধ‍্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার পর এই প্রথম। অরুণাভ ভালো ফল করেছিল মাধ‍্যমিকে। রেজাল্ট বেরোবার পর মিষ্টির বাক্স নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি গিয়েছিল খবরটা দিতে। দরজায় কড়া নাড়তে, একটি মিষ্টি দেখতে মেয়ে এসে দরজা খুলে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কয়েক মুহূর্ত। মেয়েটিকে আগে কখনো অরুণাভ দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সে মেয়েটিকে দেখে নার্ভাস হয়ে গেল। ওর বাবা ওকে কো-এডুকেসন স্কুলে ভর্তি করাননি। ওর বাবার ধারণা, কো-এডুকেসন স্কুলে গিয়ে মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে ছেলের লেখাপড়া একেবারে বারোটা বেজে যাবে। মেয়েদের সাথে মেলামেশা না করার ফলে, মেয়েটির সাথে কথা বলতে গিয়ে অরুণাভ তোতলাতে শুরু করলো। কোনরকমে মেয়েটিকে বলল, 'আমি মাধ‍্যমিকে নাইন্টি থ্রি পারসেন্ট পেয়েছি। মাস্টারমশাইয়ের জন‍্য মিষ্টি এনেছি।' কথাটা শেষ করে মেয়েটির হাতে মিষ্টির বাক্স তুলে দিয়ে দ্রুত পেছন ফিরে চলে যেতে যেতে শুনতে পেল মেয়েটি বলছে, 'কাকুকে কি বলব ?' অরুণাভ আদৌ এই কথার উত্তরে কিছু বলতে পেরেছিল কিনা, আজ আর ওর মনে নেই। সেদিন সোজা বাড়ি চলে এসেছিল। পড়াশুনোর ব‍্যস্ততায় তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। 



অনেকদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হলো মাস্টারমশাই। আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।


আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবি মানে? আমিতো নিজে হাঁটতে চলতে পারি।


না, না তা বললে হবেনা। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি ষ্টেশনে গাড়ি নিয়ে আসার জন‍্যে। 


আমার সাথে হেঁটে চল। কথা বলতে বলতে দিব‍্যি কখন পৌঁছে যাব বুঝতেই পারবি না। এতে শরীর মন দুটোই ভালো থাকবে। ড্রাইভারকে ফিরে যেতে বলে দে।



স্টেশন থেকে বেরিয়ে, রেললাইনকে বাঁ দিকে রেখে ডান দিকে পুকুরের পাশ দিয়ে সোজা গেলে শর্টকাট রাস্তায় গিয়ে পড়বে। ঐ রাস্তা ধরে এগো্তে থাকল ওরা দুজনে। গাড়ি ঘোড়া খুব কমই যায় ঐ রাস্তা দিয়ে। পুরো রাস্তাটাই নিরিবিলি আর  অন্ধকার। দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা বাড়ির জানলা দিয়ে যেটুকু আলো রাস্তায় এসে পড়ে তা সমীরণের দেখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। দু'পা এগোতেই সমীরণ হোঁচট খেল। পুরোনো চটিটা এই হোঁচট খাবার ফলে ছিঁড়ে গেল। সমীরণ ছেঁড়া চটিটা হাতে তুলে নিয়ে অরুণাভকে বলল, ‘গল্প করতে করতে এগোতে থাকলে রাস্তার দূরত্ব অনেক কমে যায়। আমি যখন একা যাই, নিজেই নিজেকে নানা রকম গল্প বলি।  অনেক রাস্তা পেরিয়ে এলাম বলে মনেই হয় না। সমাজ সেবা করতে গিয়ে সমাজের কাছে যে অপদস্ত হতে হবে, এমনটা  কেউ ভাবে না। কিন্তু আমাদের জীবনে ঘটেছিলো যখন আমরা বন্ধুরা মিলে সমাজ সেবা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম।  



তখন আমি কলেজে পড়ি। কেন জানিনা পাড়াতে সবাই আমাকে ভালোছেলে বলে ভাবতো। বাবা হেডমাস্টার মশাই ছিলেন বলে হয়ত হতে পারে। আমার বন্ধুরা অবশ্য সত্যিই ভালোছেলে ছিল। ভালোছেলেদের দলে থাকার দৌলতে আমার নামের ওপরে একটা ভালোছেলের ছাপ পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় পাড়ায় কোন সমস্যা হলে পাড়ার ছেলেদের ডাক পড়ত। এখনকার মত তখন পিচের রাস্তা ছিলোনা আমাদের পাড়াতে। ছিলো কাঁচা মাটির রাস্তা। রাস্তার দুপাশে কাঁচা নর্দমা। বর্ষায় নর্দমার জল উপছে রাস্তা ভেসে যেত। বৃষ্টি থেমে গেলে সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটা মুশকিল হত। কাদায় ভর্তি হয়ে থাকত গোটা রাস্তাটা। লোকে জুতো বা চটি খুলে হাতে নিয়ে ঐ রাস্তাটুকু পার হয়ে যেত। চটি ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিলোনা । 



বর্ষাকালে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করার সমস্যা হচ্ছে দেখে পাড়ার কয়েকজন বয়ঃজ্যেষ্ঠ আমাদের বললেন, রাস্তায় ইঁট পাতার বন্দোবস্ত কর। এভাবে যাতায়াত করা যায়না।


কিন্তু ইঁট কোথায় পাবো? 


কেন? পাড়াতে কত নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে, তারা দিতে পারবে না?


কিন্তু তারাই বা এতগুলো ইঁট দেবে কেন? রাস্তা তো সকলের।


না দিলে রাত্রি বেলা তোরা গিয়ে নিয়ে আসবি। ভালো কাজের জন্য নিলে তাকে চুরি করা বলে না।



বয়ঃজ্যেষ্ঠরা যে সব উপদেশ দেন, তা যে সব সময় গ্রহণযোগ্য হবে তার কোন মানে নেই। আমরা চাঁদা তুলে ইঁট কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। চাঁদা তুলতে বেরিয়েছি আমরা দুই বন্ধু। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী শ্রী রমেন্দ্র নাথ মুখার্জীর বাড়ি থেকে শুরু করলাম। দরজা খুলে বেরলেন মুখার্জী কাকীমা, অর্থাৎ রমেন কাকুর স্ত্রী। কাকীমা আমাদের ডেকে বললেন, ‘আয় আয়, তোদের কথাই ভাবছিলাম। এ পাড়ায় আর থাকা যাবেনা দেখছি। কিছু একটা ব্যবস্থা তোদের করা উচিৎ।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে কাকীমা?’ কাকীমা আমাদের বাড়ির 


ভেতরে ডাকলেন। বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর কাকীমা বাইরের দরজাটা বন্ধ করে আমাদের বসতে বললেন। তারপর একটু গলা উঁচু করে বললেন, ‘ঝিণি সমীরণ আর দিলীপ এসেছে। ওদের জন্য দুকাপ চা করে নিয়ে আয়।’ কাকীমার মেয়ের নাম ঝিণি, দেখতে মন্দ নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষাটা এর মধ্যে ওর বার দুয়েক দেওয়া হয়ে গেছে। নিন্দুক প্রতিবেশীদের সংখ্যা তো কম নেই। তাঁদের অভিমত, “সুকুমার রায় এই সময় বেঁচে থাকলে নির্ঘাত ‘সৎপাত্রী’ নামে একটি কবিতা লিখে ফেলতেন।” কাকীমা নিজের গলার স্বর নীচু করে আমাকে বললেন, ‘নিমাইবাবুর ছেলে রতন, আর তার বন্ধু দিপু, এদের জ্বালায় তো পাড়া ছাড়া হতে হবে দেখছি।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কেন কাকীমা? কি করেছে ওরা?’ কাকীমা বললেন, ‘আগে পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে, গাছে উঠে অসভ্যতা করত। তোমার কাকু ওদের বাড়িতে গিয়ে একদিন জানিয়ে এসেছিলেন। তার ফলে বাড়িতে ওদের উপদ্রব বন্ধ হল ঠিকই। কিন্তু তার কিছুদিন পর থেকে ওরা বাইরে অসভ্যতা করতে শুরু করেছে।’ জানতে চাইলাম ‘বাইরে কি ধরনের অসভ্যতা করছে ওরা ?’ কাকীমা বললেন, ‘পরশু তোমার কাকু যখন অফিস থেকে ফিরছিলেন, ওরা তখন পেছন থেকে ধাক্কা দেয় তোমার কাকুকে। তুমিতো জান এই অঞ্চলের রাস্তায় প্রায়দিনই আলো জ্বলেনা। তোমার কাকু ওদের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান। হাত-পা ছড়ে যায়। আরেকটু হলে চশমাটা ভাঙছিল।’ কাকীমার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হল এর একটা বিহীত অবশ্যই করা দরকার। ‘ব্যাপারটা আমরা দেখছি’ বলে উঠে পড়লাম। 



রতন ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে একসাথে একই ইস্কুলে পড়ত। আমাদের বাড়িও  একেবারে পাশাপাশি। ক্লাস  নাইন থেকে টেন-এ ওঠার বার্ষিক পরীক্ষায় রতন পাশ করতে পারেনি। তার ওপরে রতনের করা অন্যায় তো একটা নয়। প্রায় দিনই মাস্টার মশাইরা ভুরি ভুরি অভিযোগ করতেন, রতন এই করেছে, রতন ঐ করেছে।  



হেডমাস্টার মশাই- এর অলিখিত নির্দেশে মাস্টার মশাইয়েরা ছাত্রদের আচার-আচরণ এবং পড়াশুনো দুটোর দিকেই বিশেষভাবে নজর রাখতেন। তিনি বলতেন, বিদ্যা মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। যার আচরণে বিনয়ী ভাব নেই, তার শিক্ষা আদৌ হয়ে ওঠেনি; যতই বড় বড় ডিগ্রী থাকুক না কেন।



প্রত্যেকদিন একই ছাত্র সম্পর্কে অভিযোগ শুনতে শুনতে হেডমাস্টার মশাই একদিন “গার্জেন্স মিটিং” ডেকে বসলেন। গার্জেন্স মিটিং -এ সেইসব ছাত্রের অভিভাবককেই ডাকা হত, যার সম্পর্কে মাস্টার মশাইদের অভিযোগের গুরুত্ব অনেক বেশী। সেই হিসেবে একমাত্র রতনের অভিভাবককেই ডাকা হয়েছিল। গার্জেন্স মিটিং-এর দিন হেডমাস্টার মশাই তাঁর অফিসে সহকারী প্রধান শিক্ষক, মৃণ্ময় স্যান্যাল মশাইকেও ডেকে নিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে রতনের অভিভাবক এসে পৌঁছলে, হেডমাস্টার মশাই ইস্কুলের দপ্তুরীকে দিয়ে ক্লাস থেকে রতনকে ডেকে পাঠালেন। একটু পরেই রতন এসে ঢুকল, ‘জেঠু আমায় ডেকেছো?’ বলে হেডমাস্টার মশাই- এর অফিস ঘরের দরজায় ঝোলানো ভারী পরদাটা পাকিয়ে হাতে ধরে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। হেডমাস্টার মশাই একবার তাঁর অফিস ঘরে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে দেখলেন। তারপর রতনের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। হেড মাস্টার মশাইয়ের সাথে কেউ এই ভাবে কথা বলছে, বিশেষ করে তাঁরই এক ছাত্র, তিনি এই দৃশ্য কল্পনা করতে পারছিলেন না। তিনি রতনের বাবার হাতে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের স্কুলের এ হেন হেডমাস্টার মশাই ছিলেন আমার বাবা। অধিকাংশ অভিভাবকরা  সেই সময় আমার বাবার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, মানুষ হিসেবে তিনি যাই হোন না কেন, হেডমাস্টার হিসেবে আরো সংবেদনশীল হওয়া উচিৎ ছিল। রতনের বাবারও সেই একই অভিমত। তিনি বলেছিলেন, পরীক্ষায় না হয় এক বছর ফেল করেছে। আরো এক বছর কি একই ক্লাসে রেখে দেওয়া যেত না? তাতে শিক্ষার ভিতটা পাকা হত। বাচ্ছারা তো দুষ্টুমী করবেই। তাই বলে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে? পরে অবশ্য বাবা বলেছিলেন,‘আদতে আমি হেরে গেছি। ওর মধ্যে পড়ার আগ্রহ গড়ে তুলতে পারিনি। ওকে শিক্ষা দিতে পারিনি। ওকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের হারটাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষক হিসেবে কাজটা ভালো করলাম না।’     



বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের কি করা উচিৎ ভাবতে ভাবতে হাঁটা শুরু করলাম। পথে এক বন্ধুর  সঙ্গে দেখা হল। তাকে সংক্ষেপে বললাম ঘটনাটা। এমন সময় দেখি রতন আসছে। আমার সেই বন্ধুটি ওকে ডাকল। রতন তাই শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘যা বলার এখানে এসে বলে যা।’ এরপর সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে গেল। আমার বন্ধু রতনের কাছে গিয়ে সপাটে এক চড় মারলো ওর গালে। রতন চড় খেয়ে গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আমাকে মারলি? দাঁড়া তোদের দেখাচ্ছি।’ এই কথা বলে সে চলে গেল। আমার বন্ধুটি হঠাৎ রেগে গিয়ে মারলো কেন আমি বোঝবার চেষ্টা করছি তখন। বন্ধু নিজেই ব্যাখ্যা করল, ‘অন্যায় করে আবার মেজাজ দেখাচ্ছে। এত সাহস ওর?’ আমি বললাম, ‘না মারলেই পারতিস।’ এমন সময় দেখলাম রতন, দিপু তাদের বাবা-মা ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমাদের কাছে এসে রতনের বাবা আমাকে বললেন, ‘রতনকে তোমরা মেরেছো কেন?’ আমি উত্তেজিত হয়েই ছিলাম। বললাম, ‘ছেলেকে নিজেরা শাসন না করতে পারলে, পাড়ার লোকে শাসন করবে এটাই তো স্বাভাবিক।’ আমার কথা শুনে রতনের বাবা আমার কাছে রতন কি করেছে তা জানতে চাইলেন। আমি ওনাকে মুখার্জী কাকীমার কাছ থেকে ওরা যা যা করেছে বলে শুনেছি তাই বললাম। রতনের বাবা আমাকে ওনার সাথে যেতে বললেন। সব কথা তিনি মুখার্জী কাকীমার মুখ থেকে শুনতে চান। আমি ওদের সাথে গেলাম মুখার্জী কাকীমার বাড়ি। কড়া নাড়লাম। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না ।  



মুখার্জী কাকীমা দরজা না খোলার ফলে রতন চোখে মুখে একরাশ রাগ আর আক্রোশ নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল, ‘এবার কিন্তু লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলব।’ আমরা চুপ করে ওর আস্ফালন আর ওর বাবার নিঃস্পৃহ হয়ে থাকা দেখছিলাম তখন । তবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলে কাকিমা বেরিয়ে এলেন।  



রতনের বাবা সরাসরি কাকীমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আমার ছেলেকে শাসন করার জন্য এদের বলেছেন?’ নিজের নিকটতম প্রতিবেশীর কাছ থেকে এমন প্রশ্নের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। এর ওপরে প্রতিবেশী ছেলেটির যা কর্মকান্ড, সে কথা তিনি পাড়াতে বলে বেড়িয়েছেন বলে স্বীকার করলে কী ঘটতে পারে এই ভেবে কাকীমার মুখের ওপরে কিসের যেন একটা ছায়া এসে পড়ল। অন্য কেউ দেখতে পেল কিনা জানিনা। তবে আমি লক্ষ্য করেছিলাম। কাকীমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘এই ধরনের কোন কথা কারোর সাথে আমার হয়নি।’ এবার রতন উত্তেজিত হয়ে আমাকে বলল, ‘সবার সামনে কান ধরে কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’   



অরুণাভ অনেকক্ষণ ধরে মাস্টার মশাইকে লক্ষ্য করছিল। এমনিতেই মাস্টার মশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে। তার ওপরে, মাস্টার মশাই ছেঁড়া জুতো হাতে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওর সাথে হাঁটছেন। অরুণাভর ভালো লাগছিল না। খুব রাগ হচ্ছিল মিউনিসিপ্যালিটির ওপরে। বছরের পর বছর রাস্তা সারাবে না, রাস্তায় লাইট লাগাবে না। কি করে টাকাগুলো দিয়ে? মাস্টার মশাইয়ের জন্য কিছু একটা তো করা উচিৎ। কিন্তু কিছু করতে গেলে যে উনি তা গ্রহণ করবেন না, অরুণাভ সেটা খুব ভাল করে জানে। বলবেন, ‘আমার তো এটার প্রয়োজন নেই’। অরুণাভ মনে মনে ভাবল, গুরুদক্ষিণার প্যাঁচে যদি মাস্টার মশাইকে বাগে আনা যায়। সমীরণ অরুণাভর গুরুদক্ষিণা দেবার প্রস্তাব শুনে বলল, ‘একান্তই যদি গুরুদক্ষিণা দিতে চাস, তাহলে একটা কাজ কর। অনেক বছর ধরে বকেয়া পড়ে আছে তোদের প্রপার্টি ট্যাক্স। টাকাগুলো পেমেন্ট করে দে তারাতারি। তোদের মত অনেকেই আমাদের পাড়ায় আছে, যাদের প্রপার্টি ট্যাক্স অনেক বছর ধরে বকেয়া পড়ে আছে। তারা আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট সক্ষম। নাম বললে চিনবি তাদের। দীর্ঘ দিন বকেয়া রেখেছে কাগজে কলমে দুঃস্থ প্রমাণ করার জন্য। এরজন্যে মিউনিসিপ্যালিটির লোককে তারা মিষ্টি খেতে অনেক টাকা দেয়। তবু সময় মত মিউনিসিপ্যালিটিকে ট্যাক্সের টাকা  দেয় না। মিউনিসিপ্যালিটির হাতে টাকা না থাকলে রাস্তাঘাট সারাবেই বা কি করে?  



কথায় কথায় ওরা নিজেদের পাড়ায় পৌঁছে যায়। সামনের বাঁ দিকের রাস্তা ধরে সমীরণকে চলে যেতে হবে। যাবার আগে সে তার ছাত্রকে গুরুদক্ষিণা দেবার কথাটা আরো একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, অন্যকে দায়ী করার আগে নিজের দায়িত্ব পালন করাটা খুব জরুরী।   






Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024