Friday, December 2, 2022

ছোট গল্প - যোগাযোগ || লেখক - আভা সরকার মন্ডল || Written by Ava sarkar mondal || Short story - Jogajog


 



যোগাযোগ


আভা সরকার মন্ডল


 


ছোট বেলায় বাবা মারা গেছে ভুবনের চোদ্দো বছর বয়সে মাকেও হারিয়েছে ।


কাকুর কাছেই মানুষ হয়েছে ভুবন। কোনমতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে কাকুর ব্যবসার কাজে ঢুকে যায় সে।বলা ভালো --- এর বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না তার কাছে ।


 কাকুর ছেলে মেয়েরা অবশ্য যোগ্যতা অনুসারে প্রতিষ্ঠিত। তারা কেউ বাবার ব্যবসা দেখাশুনায় আগ্ৰহ দেখায় নি ।


অংকে ভুবন বরাবরই ভালো ছিল। তাই কাকুর কাপড়ের দোকানের হিসেবের বাক্সটা সেই সামলাতো ।সবই চলছিল ঠিকঠাক । কিন্তু নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলেই বাঁধে গোলোযোগ । পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করলে বাড়ি ছাড়তে হবে কাকুর এই হুংকারের সামনে বিবশ হয় সে বাড়ি ছাড়তে।


 


গড়িয়ে গেছে দশটি বছর মিনির সাথে সংসার পেতে, সে এখন ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের পিতা। একটি কাপড়ের দোকানে সে হিসাবপত্র দেখার কাজ করে, যেমন করত নিজের কাকুর দোকানে । ছুটির দিন এবং সকাল বিকাল সে বাড়িতে টিউশনও পড়ায় । তার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে স্কুল টিচার হবার। মনের সেই ইচ্ছেটাকে ছাত্র পড়িয়েই পুরণ করে সে। কাকু কে কখনও দোষারোপ করে না । তিনি পাশে না দাঁড়ালে, এই স্বপ্নটুকুও সে দেখতে পারত না , একথা কৃতজ্ঞচিত্তেই স্মরণ করে সবসময় ।


ভুবন মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর স্বপ্নে মশগুল এখন ।


একদিন এক অচেনা ছেলে তাকে একটি ফোন নম্বর দিয়ে বলে সে যেন ওই নম্বরে একটা ফোন করে, খুব জরুরি ।অবাক হলেও কাগজের টুকরো টি হাতে নেয় সে। এবং যথারীতি কাজের চাপে ভুলে যায় বুক পকেটে রাখা টুকরোটির কথা।


 


 ছুটির দিনে মিনি তাকে বলে


-- কাপড় ভিজানোর সময় কিছু দিন আগে এই কাগজটা পেয়েছিলাম দ্যাখো তো দরকারি কিনা ?


--- সেটা দেখে সে বলল,এই যাহ্ ! ভুলেই গেছিলাম ! দাও তো, ফোনটা এখনই সেরে নেই । কে যে ফোন করতে বলেছিল ।


----মিনি গম্ভীর হয়ে বলল,দ্যাখো তোমার পুরোনো কোনো প্রেমিকা কি না ।


---- ভুবন হেসে বলল তাড়াতাড়ি দাও ফোনটা, আমার আর তর সইছে না । পকেটে প্রেমিকার ফোন নাম্বার রেখে ভুলে গেছি ।


---মিনি হাসলো,সে জানে শুধু তার জন্যই ভুবন আজ বাড়ি ছাড়া। জাত-ধর্ম এক নয় বলে কাকু মেনে নেন নি তাদের বিয়ে।নিজের বাবা মা ও মানেন নি ,কাজেই মিনি নিজের ভাগ্য ছাড়া আর কাউকে দোষারোপ করে না।


 


ভুবন নাম্বারটি ডায়াল করে বলল


------ আমি ভুবন বলছি ।কেউ আমাকে এই নম্বরটি দিয়েছে ...... ভুবনের কথা শেষ না হতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো কেঁপে যাওয়া একটি গলার আওয়াজ


------ কেমন আছিস বাবা ? আমি কাকু বলছি।--


ভুবন থ হয়ে রইল কিছুক্ষন। দশ বছর পর সে শুনতে পাচ্ছে কাকুর গলা ।বিয়ের পরও তারা দুজনে একবার গেছিল দেখা করতে,বাইরের ঘরে বসে থেকে চলে এসেছে কাকু দেখা করেননি ।


-----আমাদের ভুলে গেছিস ? কাকুর গলাটা কেমন অসহায় শোনাল ।


ভুবন সম্বিৎ ফিরে বলল,


----ভালো আছি কাকু। তুমি কেমন আছো? কাকীমা, নূপুর,রনি ওরা কেমন আছে ?


--- নূপুর তো বিয়ের পর বরের সঙ্গে কানাডা চলে গেছে । রনিও ওখানেই পড়াশুনা করছে।আমরা আছি বুড়োবুড়ি বাড়ি পাহারায় । তোর কাকীমার শরীর ভালো নেই । আমার ও হাই সুগার । বেঁচে আছি এইসব রোগ ব্যাধি নিয়েই ।


আমার দোকানের পুরোনো একটা ছেলে তোর ঠিকানা জানত।ওর মাধ্যমেই ফোন নম্বর টা পাঠিয়েছিলাম দিন দশেক আগে.... তিনদিন হল তোর কাকীমাকে আবার হসপিটালে ভর্তি করেছি। শরীর টা একটু খারাপ হয়েছে।


কাকু কে থামিয়ে দিয়ে ভুবন বলে ওঠে


--- কাকীমা কেমন আছে এখন?তোমরা করোনা ভ্যাকসিন নিয়েছো তো ?


---ধুররর ভ্যাকসিন নিয়ে কি হবে ? এসব ভ্যাকসিন,ট্যাকসিন এর কোনো মানে নেই। কাকীমা এখন ভালোই আছে ডাক্তার বলেছে দুদিন পরে ছেড়ে দেবে ।


 তুই বৌমাকে নিয়ে একবার আয়,দেখে যা আমাদের । কাকুর গলায় আকুতি !


মিনি দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। কথাবার্তা শুনেই সে সব বুঝতে পারছে ।


ভুবন জানে কাকু খুব জেদী মানুষ। নিজে যা ঠিক করবে তার বাইরে কারও কথা শুনবে না তবু সে বলল


--- ভ্যাকসিনটা নিয়ে নিও কাকু। চারদিকের অবস্থা ভালো নয়। দ্বিতীয় ঢেউটা খুব মারাত্মক আকার নিয়েছে।


প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কাকু বললেন


--- আমার উপর রাগ রাখিস না। একদিন আয় সবাই মিলে।এই বুড়ো বাপ টাকে ভুলে যাস না যেন । মাঝে মাঝে মনে করিস।


ভুবন কাকুর বাড়ি যাবে ,কথা দিয়ে ফোন রাখল ।


 


এতদিন পরে কাকুর ফোন পেয়ে সে আশ্চর্য হল তবুও মিনিকে বলল করোনা কমলে একদিন সবাই মিলে যাবে কাকুর ওখানে।মিনি কোনো কথা বলল না। সে খুশি হলো ? , না অখুশি ? ---বোঝা গেল না !


 


এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পর কাকুর নম্বর থেকে একটি ফোন পেল ভুবন। জনৈক সুজয় বাবু জানালেন


রাতে কাকীমা মারা গেছেন,সকালে কাকু। দুদিন আগে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার সময় কাকু নাকি তাঁকে ভুবনের ফোন নাম্বারটা দিয়েছিল ।কাকীমার করোনা পজিটিভ ধরা পরার আগেই কাকুর জ্বর,কাশি শুরু হয়েছিল। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে আসবেন এটাই কাকুর বিশ্বাস ছিল। তবু সুজয় বাবু কে বলেছিলেন তাঁদের অসুস্থ হওয়ার খবর যেন ভুবনকে না দেয়া হয়।কারণ তাঁর মনে হয়েছিল ভুবনের সাথে তিনি অন্যায় করেছেন। তাই করোনা কালীন এই ঘোর বিপদে তাকে ডাকাটা আরও একটা অন্যায় হবে। এই ছোঁয়াচে রোগের মারণ ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছিলেন। ভ্যাকসিন না নেয়াটাও যে চরম বোকামি হয়েছে তাও তিনি বুঝেছিলেন।ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।


তিনি যদি বেঁচে না ফেরেন, তবেই যেন ভুবনকে খবর দেয়া হয়--- সব কথার শেষে এই কথাটিও তিনি সুজয় বাবুকে বলে গেছিলেন।


 


 ভীষণ একটা কষ্ট ভুবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল । এতদিন একটা অভিমান বুকে বাসা বেঁধেছিল তার,সে জানত কাকু তাকে ভালোবাসে না। আজ তার সেই ভুল ভাঙল। শুধু তার বিপদ হবে বলে, এত বড় বিপদেও কাকু তাকে পাশে ডাকেননি। ভাই বোন বিদেশে আছে,অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়তো তাকেই করতে হবে।সে দ্রুত পায়ে কাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। ট্রেনে মাত্র তিনটি স্টেশন। ইচ্ছে থাকলেও বৌ বা মেয়েকে সে সঙ্গে নিল না,করোনার ভয়েই। তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল । চোখের জল মুছতে মুছতে সে ভাবতে লাগল--- এই দশ বছরে তাকে একবারও কেন মনে পড়ল না কাকুর ? মৃত্যুর আগেই কেন হল এই যোগাযোগ ? তবে কি সত্যি মানুষ নিজের মৃত্যু ঘনিয়ে আসাটা টের পায় ? ---


 


No comments: