ছোট গল্প - দীপাবলি || লেখক - চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জী || Written by Chandrani Gupta Banerjee || Short story - Dipabali


 


দীপাবলি

 চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জী


               (১)

মা বাবা বেশ দেখে শুনেই আমার বিয়েটা  দিয়েছিল। জানা শোনা পরিবার। পাত্রটি ও বেশ ভালো। শিক্ষিত। দেখতে মোটামুটি       ভালোই।পেশায় সরকারি ‌চাকুরে। অতএব  বাড়ির কারোর অপছন্দ  হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। আমার স্বর্গীয়া ঠাকুমা ও বড় দাদা দিদির ও পছন্দ ছিল সে। বয়সে সে আমার থেকে প্রায় বছর দশেকের বড়। সে সময় আমি ' নির্ভরতা ' খুঁজছিলাম। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছিলাম।। শূণ্যতা গ্রাস করেছিল আমার জীবন। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।বেশ‌ সাজানো গোছানো ছিল আমার পৃথিবীটা। স্কুল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পৌঁছুলাম। নতুন বন্ধু দের সাথে আলাপ পরিচয় হল। তাদের মধ্যেই    আমার জীবনে এক ঝলক  টাটকা  বাতাসের মতো এলো নয়ন। লম্বা, চওড়া , সুঠাম ,  সুদর্শন। প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। কিন্তু প্রকাশ করলাম না কিছুতেই।পাছে সে আমায় প্রত্যাখ্যান করে । হৃদয় ভাঙ্গার ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রইলাম। কিন্তু চোখ তো মিছে কথা বলে না। নয়ন আমার নয়নের কথা বুঝতে দেরি করল না। আমি মনপ্রাণ তাকে নিবেদন করলাম। ভালবাসলাম হদয় দিয়ে। ঈশ্বরের কাছে প্রত্যেক মেয়েই যা চায় তাই চাইলাম। নয়নের সাথে একটা সাজানো সংসার। স্বামী- সন্তান নিয়ে সাজানো একটা সংসার। স্বপ্ন দেখতে দেখতে কেটে গেল দু তিনটে বছর। স্বপ্নেরা সত্যিই ক্ষণস্থায়ী! আমার জীবন দিয়ে আমি বুঝেছি।কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। নয়নও কলকাতা ছেড়ে রওয়ানা দিল সূদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে । উচ্চ শিক্ষার জন্য।
নয়নের সাথে চিঠির মারফত যোগাযোগ ছিল। তখন তো আর অত ফোনের ঘটা ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই যোগাযোগ টা ফিকে হয়ে আসতে থাকে। নয়নের তরফ থেকে চিঠির আদান-প্রদান কমতে থাকে। জানি না কেন তা কমে গেল। বহু বার চেষ্টা করেছি তার সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু সব বিফলে গেল। সত্যি বলতে দ্বিধা নেই একটা সময় আমি ও হাল ছেড়ে দিলাম। জোর করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ আমার হতে থাকলো।দিনে দিনে ক্ষত স্থানটা শুকিয়ে গেল। কিন্তু হৃদয় ভাঙ্গার দাগটা সেখানে রয়েই গেল। পরে জেনেছি এক  নেপালী কণ্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।

              (২)

               
দেখতে শুনতে বেশ ভালোই আমি।তাই আমাকে আমার শশুর বাড়ী থেকে যারা দেখতে এসেছিল , তারা আমায় পছন্দ করে ফেলল। বিয়ে হয়ে গেল আমার ধুমধাম করে  সুপাত্রর সাথে। সুখের সংসার আমার। লক্ষ্মী উপচে পড়ছে।কোন কিছুর অভাব নেই। আমার বাপের বাড়ির লোকজন আমার স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এরকম স্বামী নাকি আমি ভাগ্য করে পেয়েছি। আমি ও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে সুখী হতে চাইলাম। ক্ষত স্থানের দাগটা একটু একটু করে বোধকরি মিলিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সুখবর টি এল। আমি 'মা' হতে চলেছি। বিধাতাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানালাম। বিধাতা মুচকি হাসলেন। স্বামী- শাশুড়ি নতুন অতিথির আগমনের জন্য তৈরি হতে লাগলেন। হঠাৎ করে একদিন রক্ত ক্ষরণ শুরু হল। এবার হৃদয়ে নয়। শরীরের অভ্যন্তরে। হারিয়ে ফেললাম অদেখা অতিথিকে।

            (৩)

স্বামী আর ভালো করে কথা বলে না আমার সাথে। কেমন যেন গা-  ছাড়া ভাব। শশুর বাড়ীর সকলের ভালোবাসা আর বর্ষিত হচ্ছে না। ঘরের কোণে সময় কাটে আমার ।অবসর শুধু অবসর। রান্নাঘরে এখন আমার ঢোকা বারণ। আমি যে ব্রাত্য! সন্তান দিতে পারিনি। রক্তাক্ত আমার মন। আমার শরীর। নতুন করে জীবনটা আবার শুরু করতে চাইলাম। স্বামী কে বললাম। শুনেও শুনলেন না।  বাপের বাড়িতে বলায়  সবাই বললো, ' মানিয়ে গুছিয়ে নাও। লোকজন কি বলবে যদি বাপের বাড়ি চলে আস।' বুঝলাম যা করার নিজেকেই করতে হবে। নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়াতে হবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি টা তো ছিলই।গণিত আমার বিষয়। খবরের কাগজ দেখে দেখে বিভিন্ন জায়গায় দরখাস্ত পাঠাতে লাগলাম। জীবন দিয়ে বুঝলাম প্রত্যেকটা মানুষের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা কতটা প্রয়োজন।
কিন্তু যা আশা করছিলাম কিছুই কপালে জুটল না। নিদেনপক্ষে গুটি কয়েক গৃহশিক্ষকতা দিয়ে আমার একাকী পথ চলা  শুরু। শাশুড়ির চূড়ান্ত অসহযোগিতা ছিল। স্বামী অসম্ভব রকমের নিশ্চুপ ছিলেন। আমার অস্তিত্বটা তাকে কাঁটার মতো বিধছিল।আর আমার   অদর্শন দিচ্ছিল অপার শান্তি।‌ আমি ও কিছুটা শান্তির খোঁজে বাইরে পা বাড়ালাম। 
ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোর সান্নিধ্য আমায় বড়োই আনন্দ দিত। আমার অনাগত সন্তানকে তাদের মধ্যে দেখতে পেতাম।

              (৪)


কেটে গেছে বেশ কিছুটা সময়। সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে , পরীক্ষা দিয়ে একটা সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছি। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে। কিন্তু অব্যক্ত এক যন্ত্রণা আমায়   এখনো এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। এক না পাওয়ার বেদনা।এর ই মাঝে হারালাম মা আর বাবাকে । ঠাকুমা আগেই চলে গেছিলেন।
স্বামী আর আমি এক ছাদের নীচে শুধুমাত্র থাকি। কথাবার্তা নেই বললেই চলে। ‌ আমাদের পৃথিবীটা  রং চটা এক খোলশের মতো।  ইদানিং মুঠো ফোনে র সাথে তার সখ্যতা বেজায় বেড়েছে। সেই সূত্র ধরেই জানলাম  আমার জায়গায় নতুন  কেউ আসছে। সেই দিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। হুঁশ ছিল না কতক্ষণ হেঁটে চলেছি। আশে পাশে আনন্দে উচ্ছল এক প্রানবন্ত শহর। আমার বৃত্তে নিকষ, কালো  অন্ধকার। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানি। হাতের  ব্যাগটা ছিটকে কোথায় পড়ে গেল। ....... আবারও রক্ত ক্ষরণ..... ব্যথায় মুচড়ে গেল শরীরটা।

           ‌(৫)

আলোয় আলোকিত চারিদিক। কোথাও নেই কোন অন্ধকার।নেই কোন কালিমা। আমার বাড়িতে আজ চাঁদের হাট। ছাত্র ছাত্রীরা সবাই আমার বাড়িতে বাজি পোড়াবে। ওদের চাহিদা বড্ড কম। ওদের প্রত্যেক কে বাজি কিনে দিয়েছি। রং মশাল , তুবড়ি , চরকি আরও  কত কি! ট্রান্সফার নিয়ে শহর   ছেড়ে গ্রামের স্কুলে পড়াতে  এসেছি । এখানে এদের সাথে থেকে অদ্ভুত শান্তি পাই। এদের সারল্য আমায় মুগ্ধ করে। এদের যতখানি ভালোবেসেছি  এরা তার দ্বিগুন আমায়  ফিরিয়ে দিয়েছে। আমার জীবনের মলিনতা, ধূসরতা আজ অতীত। ওদের সাহচর্য আমার জীবনের রসদ। আমার সাথে  থাকে ' মুনলী' । নিজের কাজ গুলো যতটা পারি করি। কিন্তু মুনলী তা করতে দেয়না। জোর করে  আমার সাথে থাকতে চলে এল। ওর এই গ্রামেই বাড়ি। সতের- আঠারো বছর বয়সী মেয়ে। আমার কাছে লেখা পড়াও  শেখে । শেখার বড় ইচ্ছে মুনলীর। আমি ও তাকে প্রাণভরে শেখাই। মুনলী আর তার মাকে বললাম  গ্রামের সবার জন্য  রান্না করতে। আজ সবাই আমার এখানে খাবে। পেটপুরে। মানুষ গুলো বড্ড গরীব। তাদের উৎসব , আনন্দ নেই বললেই চলে। তাই এই ছোট্ট আয়োজন। বিকেল থেকেই গুটি গুটি পায়ে সব ' ছানারা ' এসে হাজির। আনন্দ করবে বলে। ইদ্রিসের বউ এর কোলে তাঁর ছমাসের মেয়ে টা । কেমন টুকুর টুকুর করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোলে নিতে বড্ড ইচ্ছে করছে। ইদ্রিসের বউটা ঠিক বুঝলো।
___ ' দিদি, তুমি কুলে লিবা?'
কোথা থেকে মুনলী  একখানা চেয়ার দৌঁড়ে নিয়ে এল।
___ ' দিদি, তুমি ইখানটায় বুসো।'
ক্রাচে ভর দিয়ে আমি চলি। কোলে নিতে পারব কি করে! একদম ছোট্ট বাচ্চা। তাই মুনলী আমায়  চেয়ারে বসিয়ে দিল। আমার কোল জুড়ে আছে তখন ' আসমা '। 
সেই রাতের দুর্ঘটনায় আমার বা পাটা কেটে বাদ দিতে হয়। বেশ কিছু দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার স্বামী খবর পেয়েও আসেননি। আর দাদা দিদিরা তখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। নিজেকে বোঝালাম- ' কেন স্বামী আসবেন। আমরা তো কেউ কাউকে সুখী করতে পারিনি। তার কিসের দায়?' আমার সহকর্মীরা না থাকলে এই জীবন যে কতটা সুন্দর তার জানতেই পারতাম না।  চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের অপত্য ভালোবাসা , মায়া, মমতা আমার না পাওয়ার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও নিরাময় করেছে। ঈশ্বর কে ধন্যবাদ জানালাম। আমি যে ভালোবাসার কাঙাল।

               (৬)

শহরের কোলাহল থেকে দূরে এই গ্রামের সাথে আমার যে আজ নাড়ীর টান। চেয়ারে বসে ছেলে মেয়েদের বাজি পোড়ানো দেখছি বিভোর হয়ে। হঠাৎ একটা গাড়ীর শব্দে চিন্তার তরঙ্গে বাঁধা পড়ল। দেখলাম গাড়ি থেকে নামছেন ডঃ চিরন্তন বসু। বাচ্চা গুলো তাকে দেখে আনন্দে তার কাছে ছুটে গেল। আপনজনকে পাওয়ার আনন্দ। যখনি ডঃ বসু আসেন , বাচ্চা গুলোর জন্য কিছু না কিছু আনবেনই। বড় ভালো মানুষ। বছর কয়েক আগে ঘটা সেই দুর্ঘটনার সময় উনিই আমার চিকিৎসা করেছিলেন এবং আমার বাঁ পাটা কেটে বাদ দেন।তখন থেকে আমাদের আলাপ পরিচয়।আপন ভোলা একটি মানুষ। শহরের একটি হাসপাতালে কর্মরত। আসমা কে তার মায়ের কোলে দিয়ে আমি ক্রাচে ভর দিয়ে ডঃ বসুর দিকে এগিয়ে গেলাম।
--- ' আসুন ডঃ বসু। আপনার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। দীপাবলী শুভ কামনা।'
ডঃ বসুর  মুখে উজ্জ্বল  হাসি। 
--- 'ভেতরে আসুন '
আমরা দুজন ঘরের ভেতরে এসে বসলাম। মুনলীকে বললাম দু কাপ চা পাঠিয়ে দিতে। 
--- ' রাতের খাবার কিন্তু খেয়ে যাবেন। '
--- ' আচ্ছা । কেমন আছেন আপনি ? এবার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। হসপিটালে কাজের বড্ড চাপ।‌ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। '
--- 'আমি ভালো আছি। আপনি ?'
---- ' চলে যাচ্ছে।‌ ভাবছি শহরে তো অনেক দিন কাজ করলাম। এবার ভাবছি গ্রামের এই লোকগুলোর জন্য কিছু করি। আপনাকে আমার পাশে চাই। '
বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। মুনলী এসে ততক্ষণে চা আর কিছু খাবার দিয়ে গেছে। 
--- ' কিছু বললেন না দীপা? এই চাওয়াটা কি আমায় দেওয়া যায় না? '
আমি চুপ করে রইলাম। 
--- ' আমি আমার সারাটা জীবন আপনাকে দিতে চাই। '
আমি ওনার চোখের দিকে এবার তাকালুম। সততার ছায়া তার চোখে। আমি জানি এ ভালবাসা বড্ড গভীর।  বড্ড সত্যি। কিন্তু আমি যে আর সাংসারিক জীবনের বাঁধনে
 জড়াতে চাই না। 
--- ' সারা জীবন আমি আপনার পাশেই থাকবো ডঃ বসু। একজন ভালো বন্ধু হয়ে। আমাদের বন্ধুত্ব চিরদিন অটুট থাকবে। তাকে শুধু শুধু জটিল করে কি লাভ বলুন। জীবন আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। এরাই আমার সংসার । আমার সন্তান। সেই সাংসারিক জীবনের স্বামী - স্ত্রী র বৃত্তে আর নয়। এরাই আমার পৃথিবী। আপনি আপনার জীবনে সুখী হোন। আপনি  আমার ভালো বন্ধু ছিলেন ও থাকবেন। আর সব সম্পর্কের পরিণতি হয় না। নাম পায় না। কিছু সম্পর্ক এমনিতেই সুখকর। '

আমরা দুজনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মুনলী বাড়ির চারিদিকে আজ প্রদীপ জ্বালিয়েছে। অন্ধকার নেই। প্রদীপের আলোয় সবকিছু প্রজ্বলিত। কিন্তু বারান্দার কয়েকটা প্রদীপ হাওয়ায় নিভে গেছিল। আমি আবার তাদের জ্বালিয়ে দিলাম। জ্বল জ্বল করে প্রদীপ গুলো জ্বলছে। অমাবস্যার সমস্ত অন্ধকার দূর করে আমার জীবন আজ আলোময়। আজ শুভ দীপাবলি। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। ও হ্যাঁ.... আমার   পুরো নামটাই যে বলা হলো না আপনাদের।  ঠাকুমা বড় আদর করে নাম রেখেছিল.... দীপাবলি ।।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024