উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -6


 

রন্টুনা মায়ের মন্দিরে গিয়ে আমায় বলল, জানিস রমা অনেক দিন পর গ্রামে এজুম পূজো দেখতে। তোদের অবস্থা সুমন্তর কাছে শুনেছিলুম প্রথমত আমি বিশ্বাস। করতে পারিনি ওর কথা। কোন মানুষ যে এই অবস্থায় পড়ে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন। জামার কল্পনাতীত। তোর বাবার মতো ব্যক্তি এদেশে বিরল। শত কষ্ট স্বীকার করে। ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে প্রয়াসী হয়েছেন। বলতো রমা এইরূপ ত্যাগ স্বীকার। করে ক'জনই করতে পারেন। তোদের এইরূপ অবস্থা দেখে সংকল্প করেছি তোদের এই দুঃখের আমি অংশীদার হতে চাই। এই মায়ের মন্দিরে শপথ করছি তোকে আমি নিজের বোনের মতো দেখবো। রন্টুদার চোখের সামনে করুণ ছায়া নেমে এলো। পুনরায় আর্দ্র গলায় বলতে শুরু করলো, তোর দাদার সাথে মাত্র একটি বছর ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়েছিলুম, কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য সব কিছু হারিয়ে ফেললুম, অর্থাৎ নিজস্ব অর্থ না থাকলে এই বর্তমান যুগে কোন কাজেই সম্ভব নয়। মাসীমার অপার করুণায় ডাক্তারী পড়লুম। তাও কপালে সইলো না। এক বৎসর পরেই ডাক্তারী পড়ায় ইস্তফা দিতেও হলো। 


রন্টুদা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, সে অনেকবারে। তবে তোর মতো বোনকে লাভ করে আমি ধন্য হয়েছি। কারণ, দেখলাম রন্টুদার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হয়ে গেলো। বার কয়েক ঢোক গিলে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ওর ঐরূপ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কেমন যেন হয়ে গেলাম। মনটা বড় আকূল হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠলো, হঠাৎ রন্টুদার এ অবস্থা হবার কারণ কি! 


আমি জিজ্ঞাসা করার আগে বলল, আজ বহুদিন পর আমার হারানো বোনকে ফিরে পেলাম। 


ওকথা শুনে আরো কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি।


 বলল, জানিস রমা, দেখতে সে তোর মতই ছিলো। তোর চেহারার মধ্যে অনেকটা সাদৃশ্য ছিলো। ওকে বড় ভালোবাসতাম রে। কিন্তু হতভাগী যে অকালেই চলে যাবে ভাবতে পারিনি। তার অকাল বিয়োগ আমাকে পাগল করে তুলেছিলো ও বিধাতার এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহী হয়েছিলুম। 


স্থির হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। দাদা অনেক আগে আমাদের কাছ হতে সরে গিয়ে পাড়ারই এক ছেলের সাথে গল্পে মেতেছিলো। আমার তার দিকে মোটেই খেয়াল ছিল না। রন্টুদার মলিন মুখ দেখে বেদনায় আকূল হয়েছিলাম। রন্টুদা বলে চলেছে। তখন হতে কোন পল্লী অঞ্চলে যেতে চাই না। কারণ পল্লী অঞ্চলেই হারিয়েছিলুম বোনকে। এখানে না আছে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র না আছে কোন চিকিৎসার সুব্যবস্থা। এমনকি একটা ডাক্তার পর্যন্ত থাকে না। যদি সে ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে মনে হয় বোনকে হারাতাম না। তোর বাবা উপযুক্ত কাজ করেছেন। সুমন্ত ডাক্তারী পড়ার কারণ আমি সব শুনেছি। সুমন্ত ডাক্তারী পাশ করলে তোদের গ্রামে অনেক উপকার হবে। পল্লী গ্রামের চিকিৎসা অপ্রতুলতায় আমার বোনের জীবনদ্বীপ যে অকালে নির্বাপিত করে দিয়েছে। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমার, 


কি করে হারালো রন্টুদা? 


সে অনেক কথা রমা। শুনবি? 


শুনবো রন্টুদা। 


রন্টুদা মুখটাকে রুমাল দিয়ে মুছে বলতে শুরু করলো। গোল বেঁধে ছিলো ওখানে যদি মামার দেওয়া জিলিপিগুলো না খেতো তাহলে মনে হয় পুনরায় মুখটা মুছলো। দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। বেশ কিছু দিন আগে আমার মেজমামা আমাদের আনতে গিয়েছিলেন গ্রামের কীর্ত্তন উপলক্ষ্যে। আমার মামাবাড়ী পল্লী অঞ্চলে। যেখানে শুধু সবুজের সমারোহ। তাকাচ্ছে চারিদিকে আড়াল করে থাকে পুকুরকে। ভোরে কোকিলের কণ্ঠস্বর মনকে বড় মাতোয়ারা করে দেয়।


 সেই পল্লী গ্রামেই ছিলো আমার মামা বাড়ী। মা'র সাথে আমিও আমার বোন, হাজির হলুম মামা বাড়ীতে। বেশ ভালো লাগছিলো গ্রামখানিকে। বহুদিন পর মামাবাড়ীতে এলুম। ছোটবেলাতে কয়েকবারই এসে ছিলুম। তারপর বয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামাবাড়ীর আকর্ষণ অনেকটা হ্রাস পেয়েছিলো। কিন্তু মা'র কথা কাটতে পারলাম না। কীর্ত্তন মোটেই ভালো লাগতো না। মামাতো ভাই সুব্রতর সাথে নানান জায়গায় আড্ডা দিতাম। পর পর দুটো দিন নানা রঙে ঢঙে তামাসায় কেটে গেলো। ভাবতে পারিনি কিভাবে সময় কাটছিলো। তৃতীয় দিন আমাদের সকলের মধ্যে যে শোকের ছায়া নেমে আসবে কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। মামা বাড়ীতে যে বোনটার উজ্জ্বল শিখা নিভে যাবে তা বুঝতে পারিনি।


 ঐদিন কীর্তনের শেষে আমরা সকলেই উঠানে বসে আছি। একটু পরে গ্রামের বুকে অন্ধকার নেমে এলো। মামা একসময় বড় প্যাকেটে কিছু গরম জিলাপী নিয়ে এলেন। সকলের হাতে কিছু কিছু দিলেন। বেশ হৈ হুল্লোড়ে সকলেই কিছু কিছু খেয়ে ফেললুম। ঘন্টাখানেক পর শুরু হলো এক করুণ দৃশ্য। সে দৃশ্য আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খাদ্যে বিষক্রিয়া শুরু হলো। বুঝতে পারলাম, এটা নিশ্চয়ই ফুড পয়েজিং এর কেস। যারা শক্তিশালী তারা সহ্য করতে পারল কিন্তু আমার বোন বীনা ও মামাতো বোন গোপা বিষক্রিয়ায় শিকার হয়ে উঠলো। আমি পাগলের মতো ডাক্তার ডাকার জন্য চিৎকার করতে থাকলাম। কি করবো অরণ্যের রোদন করে। ঐ এলাকায় কোন ডাক্তার নেই তো গ্রামের লোকেরা কি করবে। 


বীনার শেষ অবস্থা ঘনিয়ে এলো। গরুর গাড়ীতে করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবার ব্যবস্থা করলাম। গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে হাসপাতাল। গোপা ও বীনাকে হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই বীনার জীবন দ্বীপ নিভে গেলো। সে চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে পরম শান্তি লাভ করলো।


রন্টুদা চুপ করলো। ওর চোখ দিয়ে গরম জল নির্গত হলো। লোমশ বুকের মধ্যে। হাত রেখে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, ওর মৃত্যুতে বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিলুম। বিশেষ করে মা ওর শোক সহ্য করতে না পেরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সেই রোগ শয্যা হতে তিনি আজও পর্যন্ত উঠতে পারেননি। মনে হয় আর বাঁচবেন না। বীনার মতো উনারও আয়ু শেষ হয়ে এসেছে।


 রন্টুদার দীর্ঘশ্বাস পড়লো, সে অপলক নেত্রে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে হয় সেই শোকাবহ ঘটনা তার স্মৃতিপটে উদিত হওয়ায় সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। পর পর দুবার ডাক দেওয়ার পর আমার কথায় সাড়া দিলো। আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, অতীতকে মনে এনে নিজেকে দুর্বল কোরো না রন্টুদা। ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শুধু তোমার বোন বীনা কেন, ঐ বয়সর কত কত মেয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে বলে কি বিধাতার উপর দোষারূপ করবো? নিয়তিকে কেউ বাধা দিতে পারে না। জানবে আমার মধ্যে তোমার হারানো বোন ফিরে পেয়েছো। দাদা কতক্ষণ আগে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে তা লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম।


 দাদা বলল, তোদের এই স্নেহের বন্ধন আমার মনে এক অপার্থিব আনন্দের স্পর্শ এনে দিয়েছে। রন্টু আশাহত ছেলে। ও জীবনে অনেক কিছু করবে ভেবেছিলো কিন্তু এ সমাজের নিষ্ঠুরতার ওকে বলি হতে হয়েছে। সে অনেক কথা, ওর জীবনী নিয়ে একদিন বলবো তোকে। তবে মনে রাখিস ওকে ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করে যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিস।


 বললাম, রন্টুদা আমার আপন দাদা, তাই চিরদিনই ওকে মনে রাখবো।


 কি রে রন্টু, রমাকে পেয়ে তোর জীবনের ভগ্নি হারানোর শূন্যতার স্থান পূরণ করলি তো?


 রন্টু ঘাড়টা নাড়লো। মিনিট খানেক পরে নীরব থাকার পর আমরা সকলে বাড়ী যাবার জন্য পা বাড়ালাম। রন্টুদা বাক্যালাপ না করে আমাদের পিছনে হাঁটতে থাকলো। বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে রন্টুদার বোনের নিয়ে কথা বললে প্রথমতঃ তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।


 এমনি আনন্দের মাঝে শারদীয়া পূজো কেটে গিয়ে ওদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। ওদের বিদায় দিতে হবে শুনে মনটা বড় কেঁদে উঠলো। মনে হলো ওদের যেন হারিয়ে ফেলছি। মন চাইছিলো ওরা যেন আজীবন আমাদের কাছে থাকে। কিন্তু কর্তব্যের অনুরোধে তাদের ছাড়তে বাধ্য হলাম। ওদের কর্তব্যে বাধা দেওয়া আমার কাম্য নয়।


রন্টুদাকে প্রণাম করে বার বার আসতে বললাম। সে সম্মতি জানালো নিশ্চয়ই আসবে দাদা বিদায়ের আগে বলল টাকা পাঠাবার জন্য। বাবা কথা দিলেন যথা সময়ে ওর নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন ওরা বিদায় নিলো। আমি ও বাবা কিছু দূরে এগিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফিরে এলাম।


                               ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024