ছোট গল্প - কালো রঙের চাঁদ || লেখক - তৈমুর খান || Short story - Kalo Ronger Chand || Written by Taimur khan


 

কালো রঙের চাঁদ 

তৈমুর খান 



     এক. 


নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠল। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল এতটুকু চিড় ধরেনি মনে। নানা কাজে ভুলে গেছি হয়তো। সাংসারিক জটিলতা আর টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হয়েছি। কিন্তু যখনই একা হয়ে গেছি, যখনই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি তখনই মনে পড়েছে ওকে। ওই আমার প্রথম নির্বাচিত নারী। যাকে আমি আমার জীবনের সঙ্গী করতে চেয়েছিলাম। 


       উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও যখন চাকুরি পাচ্ছি না, শুধু টিউশানই একমাত্র ভরসা, তখন কোন্ মেয়ের বাপ আমার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেবে? সুতরাং বিয়ে করার ভাবনা মাথাতেই আসেনি। কোনও রকম দিন কেটে যাচ্ছে। কোথাও ঝিলিক দিচ্ছে নারীমুখ ।জ্যোৎস্না রাত হাতছানিও দিচ্ছে না তা নয়। মধ্যরাতে ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে । স্বপ্নের ভেতর কখনও কখনও ছাত্রীরাও উঁকি মারছে। তা মারুক, কেউকেই বেশি প্রশ্রয় দিতে পারছি না। এমন সময়ই কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করি আর জুটে যায় একটা কলেজের আংশিক শিক্ষকের চাকুরি। একে কি চাকুরি বলে! নিজেরই সন্দেহ হয়। মাস গেলে দেড় হাজার টাকা। তা হোক, টিউশানের বাজার বাড়তে থাকে। আয়ও প্রায় পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। 


        দিব্যি একটা সংসার চলবে, তুই বিয়ে কর! চা খেতে খেতে এক হাতুড়ে ডাক্তার বন্ধু পরামর্শ দেয়। নিজেও ভাবতে থাকি বয়স প্রায় তিরিশে পা দিতে চলেছে। এ সময় তো বিয়ে করা জরুরি বইকি! ভাবতে ভাবতে বলি, কিন্তু কাকে বিয়ে করব? 


          বন্ধুটি দ্রুত উত্তর দেয়, আমারই মামা শ্বশুরের মেয়ে আছে, নোনাডাঙা বাড়ি। এবছরই বি এ পাস করেছে। আমাকে বর খুঁজতে বলেছে। আগামি রবিবারই চল্, দেখে আসি। 


         সম্মতি না দিয়ে পারিনি। একটা বয়সে বিয়ে করার ইচ্ছা সব নারী-পুরুষেরই থাকে। আমারও ছিল। একটা বি এ পাস মেয়ে, দেখতে ভালো হলে এবং আমাদের সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারে মানিয়ে নিলে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়? 


       কিন্তু সেই সপ্তাহে রবিবার দিনটি আসতে বড়োই দেরি করছে আমার মনে হল। প্রতিদিনই বারের হিসেব করি আর রাত দীর্ঘ হয়ে যায়। অবশেষে বহু নির্ঘুম রাত আর প্রতীক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত রবিবারটি এসে উপস্থিত হল। বুঝতে পারলাম, বাসনা তীব্র হলে সময় তখন দীর্ঘ মনে হয়। মুহূর্তগুলিও বছরে পরিণত হয়ে যেতে পারে। 


        সকাল সকাল স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম চুপচাপ। বন্ধুটিকে সঙ্গে নিতে হবে। ওরই পরামর্শ ছিল, কাউকে জানানোর দরকার নেই, আগে পছন্দ হোক, তারপর কথাবার্তা। বাড়ির লোকও জানবে না। 


         বাসে করে যাচ্ছি। সমস্ত রাস্তা কত রকম চিন্তা এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কী জিজ্ঞেস করব? হ্যাঁ, কোন্ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, ইসলাম সম্পর্কে কেমন ধারণা, সংসারে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে কিনা ইত্যাদি। কখনও আবার মনে আসছে, কী হবে ওসব জিজ্ঞেস করে? বরং মেয়েটি দেখতে কেমন হবে, কাজ করার ক্ষমতা আছে কিনা, সহিষ্ণু কিনা ইত্যাদি। বাস ছুটছে, যেন আমরা যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছি। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সেই রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি। কী আনন্দ! মনপ্রাণ যে নাচছে, কিন্তু কেউ দেখতে পাচ্ছে না। হাওয়া এসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। বারবার কল্পনায় দেখে নিচ্ছি মেয়েটির চোখ। কী উজ্জ্বল! কী স্নিগ্ধ! কী বিস্ময়! 

    
         


দুই. 


যথারীতি খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মেয়েটিকে আনা হল আমাদের সামনে। না, সাজপোশাকের কোনও বালাই নেই। যে শাড়িটি পরে সে এখানে ওখানে বের হয় কোনও অনুষ্ঠানে, সেই শাড়িটিই পরে এসে উপস্থিত হল। সকালের রোদ রং শাড়ি। অপূর্ব মানিয়েছে। সাদা সাদা বেলফুলের ছাপ সমস্ত শাড়ি জুড়ে। আরও পবিত্র ও স্নিগ্ধ করে তুলেছে ওকে। সামনে দাঁড়িয়েই সকলকে সালাম জানাল। যথারীতি সালামের উত্তরও দিলাম। তারপর বললাম, বসুন! 


     প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করল, আমাকে "তুমি" বলুন। 

   

      বেশ, তাই হবে। তারপর মুখ তুলে তাকাল। 

মুখটি খুব সুন্দর নয়, কিন্তু বড়ো সরল ও সতেজ মনে হল। নাকের নিচে ঠোঁটের বাঁ দিকে একটা কালো তিল, কালো রঙের চাঁদের মতো চনমন করছে দেখলাম। শ্যামবর্ণ ঠোঁটের লাল আভা অস্ফুট পদ্মের লাল পাপড়ির মতো। কপালের এক গোছা চুল যেন স্থির তরঙ্গের মতো। মুখটি গোল হতে হতে শেষ পর্যন্ত আর গোল হয়নি। আঁটসাঁট শরীরের সঙ্গে বেশ মানানসই। বন্ধুটি বলেছিল, ভালো ছেলে খুঁজছে, চাকুরি না হলেও হবে। ওর বাপের যা আছে তাতে বহু বড়োলোক জামাই ও পাবে। কিন্তু তা দেবে না। সৎ, শিক্ষিত ভালো ছেলে হলেই হবে। 


       আমি এই তথাকথিত ভালো ছেলের পর্যায়ে পড়ি কিনা সে কথাই ভাবছিলাম বারবার আর ভাবতে ভাবতেই প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু হয়েছিল। 

—তোমার নাম কী? 

—খালিদা রহমান। 

—পিতার নাম? 

—হাফিজুর রহমান। 

—কত দূর লেখাপড়া করেছ? 

—বি এ পাস। 

—কী কী বিষয় ছিল? 

—বাংলা, ইতিহাস, দর্শন। 

—কোন্ বিষয় পড়তে ভালো লাগে? 

—বাংলা। 

—আচ্ছা, একটা খুব অপ্রিয় কথা জানতে চাই, আমি তো চাকুরি করি না, টিউশান করি আর কলেজের আংশিক শিক্ষক, খুব সামান্য আয় করি। তুমি সব মানিয়ে নিতে পারবে তো? 


     এবার খালিদা মাথা নামিয়ে দেয়। এতক্ষণ যত দ্রুত উত্তর দিচ্ছিল এবার যেন থেমে যায়। আবার তাড়া দিয়ে বলি, বলো, কী হল? 


       মাথা ঝুঁকিয়ে সে নীরবে সম্মতি জানায়। 


  আমার পাশে থাকা বন্ধুটি বলতে থাকে, তা হলে যাও এবার। 

     

   ওকে থামিয়েই বলি, না থামো, এদিক ওদিক তাকিয়ে খুব নিচু গলায় খালিদার কাছে জানতে চাই, আমাকে তোমার পছন্দ তো? 


       এবার জোরে হেসে ওঠে খালিদা, চোখের ভেতর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালনা করে দেয় আর এক ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। এতগুলো প্রশ্ন-উত্তর চলেছে, তার ফাঁকে খুঁটে খুঁটে দেখেছি খালিদাকে। বাঁশঝাড়ে ঘেরা তাদের গ্রাম্য মাটির বাড়িতে এক মনোরম আনন্দ আমাকে সর্বদা আকৃষ্ট করেছে। চাষি পরিবার হলেও এদের রুচিবোধ আছে, শান্তি ও সৌন্দর্য আছে। খালিদার পিতা একটা জুনিয়র হাইস্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট মাস্টার মশাই। ছোটোখাটো চেহারার মানুষ। একদণ্ড এসেই দেখে চলে গেছেন। আমাদের মুরগি পোলাও ফলমূল খাবারেরও কত আয়োজন করেছেন। একে একে সব আসতে দেখে অবাক হয়ে গেছি। মনে হয়েছে, আহা এরা কী ভালো লোক! মানুষের কদরও বোঝেন! 


    সব বুঝেসুঝেই বন্ধুটিকে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। বারবার সে জিজ্ঞেস করেছে, রাজি তো? 


      আমিও বারবার বলেছি, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ! 


    তারপর সে সব দায়িত্ব নিয়ে একাই গেছে মেয়ের পিতা অর্থাৎ তার মামা শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলতে। আমাকে একটু দূরে সরে যেতে বলেছে। আমাদের তো বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে, যা বলার তা এখনই বলতে হবে।

       

তিন. 


—তুমি কত টাকা বেতন পাও? 

—দেড় হাজার। 

—দেড় হাজার টাকায় সংসার যাবে? 

—টিউশান করি, তাতেও হাজার পাঁচেক… 

—টিউশানের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? মেয়েকে ফেলে দেওয়া হবে! তোমার সঙ্গে… 

—আমি তো আসতেই চাইনি, আপনাদেরই জামাই বলেছিল, তাই… 

—থাক্ ওসব শুনব না, সরাসরি বলাই ভালো, তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। 


      তারপর জামাই অর্থাৎ আমার বন্ধুটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগলেন, সবই ভালো, একটা চাকুরি করা ছেলের খোঁজ এসেছে। এন ভি এফ পুলিশ। বাবার মৃত্যুর পর ডাইং হারনেসে চাকুরিটি পেয়েছে। পড়াশোনা একটু কম, ওই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তা হোক, চাকুরি করে তো! বিয়েটা ওখানেই দেবার ইচ্ছা আছে। কী গো, ভালো হবে না? 


     বন্ধুটি উদাসীন ভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। 


    লজ্জায় অপমানে আমার দুই কান রাঙা হয়ে উঠল। সেখানে আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। ঘটক বন্ধুটি অনেকক্ষণ পর ফিরে এল। শুকনো মুখে বলতে লাগল, মেয়েটির মা ও মেয়েটির খুব ইচ্ছা তোকে জামাই করার, কিন্তু ওর আব্বা চাইছে না। পাশের গাঁয়ের একটি লোক সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে ওই পুলিশ কর্মীর জন্য। 


      আমার আর কিছুই বলার নেই। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রির ওজন যে ভীষণ হাল্কা একজন অষ্টম শ্রেণি পাস পুলিশ কর্মীর তুলনায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতক্ষণ ধরে মাংস পোলাও যা খেয়েছি সবই বমি হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কোনও রকম ভাবে নিজেকে সামলে রাখছি। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। না, আর কোনওদিনও বিয়ে করতে চাইব না। বিয়ে করার জন্য আর কোনও মেয়েকে দেখতেও আসব না। তখনই হনহন করে ছুটছি। বন্ধুটি কী কথা বলছে পিছন থেকে বুঝতেও পারছি না, বোঝার প্রবৃত্তিও নেই। দুই কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। দুঃখী মায়ের মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাড়ি ফিরতে চাই, আমি দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাই। কিন্তু এ কী! বাঁশঝাড়ের অন্যপ্রান্তে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে খালিদা। সকরুণ চোখ দুটিতে মিনতি, ক্ষমা প্রার্থনা। চমকে উঠি। কেন ও এভাবে তাকাচ্ছে? হে আল্লাহ, যেখানে ওর আব্বা এত হিসেবি মানুষ, এত অহংকারের সঙ্গে আমার মুখের উপর কথাগুলি বলে আমাকে অপমান করলেন, সেখানে তারই কন্যা কেন এরকম ভাবে আমাকে হাতছানি দিচ্ছে? কোনও প্রশ্নেরই ঠিক উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমার অপমান, আমার পথহাঁটা যে অনেকটাই কমিয়ে দিতে পেরেছে সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। মনটা কীরকম উদাসীন হয়ে গেল। সারা রাস্তা চোখের সামনে ভাসতে লাগল সেই সকরুণ মুখটি। একটাও কথা বলতে পারিনি, নীরবে যেন বহুকথাই বলে দিয়েছি। 


   চার. 


আজ যে বাস থেকে নামছি সেই বাসেই উঠতে যাচ্ছে খালিদা। নাকের পাশের তিলটি তেমনই কালো রঙেই জ্বল্ জ্বল্ করছে চাঁদ হয়ে। নামতে নামতে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। সেই সকরুণ দৃষ্টি, সেই হাতছানি। কেমন আছ খালিদা? মুখে এনেও কথাটি বলতে পারলাম না। পেছনে জোর ধাক্কা, কী করছেন মশাই? রাস্তা ছাড়ুন! 


     মনে মনে বলতে লাগলাম, আমি তো রাস্তা কারও ঘিরে নেই, কেউ আমারই রাস্তা ঘিরে আছে! 


       বাস থেকে নেমে অনেকক্ষণ বাসের জানালায় চেয়ে থাকলাম বাসটা যতক্ষণ না ছাড়ল। খালিদাও জানালায় মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। তেমনই নির্বাক। তারই পাশের সিটে মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। মনে হল ওর স্বামী। আমি তো ওর কেউ নই, কেনই বা আমার সঙ্গে কথা বলবে? তাহলে এমন চোখে তাকায় কেন? কী যেন হারিয়ে গেল আমার! আর নিজের অজান্তেই খুঁজতে লাগলাম। চোখের পানিতে চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গেল। দূরে বা কাছে কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু একটা গোল শূন্য অস্বচ্ছ বল ওঠানামা করতে লাগল সামনের দিকে। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024