ছোট গল্প - বোধনের রোদ্দুর || লেখক - রঞ্জিত মল্লিক || Short story - Bodhoner Roddur || Written by Ranjit Mallick


 


বোধনের রোদ্দুর

রঞ্জিত মল্লিক





                          "........শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে
                ..........জননী এসেছে দ্বারে......."

              পুজো আসতে আর বেশী দেরী নেই। শরৎ প্রকৃতির নয়নাভিরাম রঙীন জ্যামিতি প্রতিনিয়ত ইঙ্গিত দিচ্ছে মা দশভূজার মর্ত্যে আসার আগমন। ঢাকের মাতাল করা মোলায়েম মল্লারে ভেসে আসছে আগমনীর সুর।

             তাঁর টুকরো টুকরো অণু, পরমাণু  চোখে মুখে ছড়াতেই উৎসবের আনন্দে বুকের "ভিসুভিয়াস"টা দপদপ করে উঠছে সকলের। শিরায় শিরায় ফুটন্ত হিমোগ্লোবিনে আবেগের আঁচ ধরা পড়ছে।

             শতুর পাড়ার পুজো এবারে পঞ্চাশে পড়ল। পাড়ার সকলের ব্যস্ততা বেশ তুঙ্গে। প্রতিদিনই চলছে শলা পরামর্শ। পুজোকে সার্বিকভাবে সফল করে তুলতে সকলেই দল দলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। আট থেকে  আশি সকলের চোখে মুখে খুশীর ঝলসানো সোনামুগ রোদ্দুরটা হামাগুড়ি  দিচ্ছে।

             পঞ্চমীর সকাল থেকেই শুরু হল নিন্মচাপের দাপুটে ব্যাটিং। সকলের  মনখারাপ,  দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেকের চিন্তা পঞ্চাশ বছরের পূর্তির আনন্দটাই না মাটি হয়ে যায়।

                 শতু সারাদিন ঘরের মধ্যেই ছিল গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে। বৃষ্টির চোখ রাঙানি বাড়তেই একটু বিছানায় গাটা এলিয়ে দিল। মা ঘরে ঢুকতেই বলে  উঠল," কি রে, অবেলায় ঘুমোচ্ছিস?শরীর খারাপ?"
             "আসলে কদিন ধরেই মনটা ভাল নেই।"
              "একটু বাইরে ঘুরে আয়, দেখবি মনটা ঠিক চাঙ্গা হয়ে গেছে।"
             "মা, তুমি আবার জ্ঞান দিতে শুরু করলে। তুমি না...."

               মা আর কথা না বাড়িয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। 

              পুজো আসলেই শতুর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।  চারটে দিন নিজেকে  গৃহবন্দি রাখে। কারণ ও উৎসবের গন্ধ গায়ে মাখতে চায়না। পুরানো অতীত ওকে নাড়িয়ে দেয়। 

                       

                 সপ্তমীর দুপুরে  বাচ্চাটার চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল। নিম্নচাপ তখনও চলছে। যদিও প্রকোপ কমেছে। কুকুরের বাচ্চাটা অতিবৃষ্টিতে  ড্রেনের গভীর  জলে পড়ে সাঁতার কাটছে। আর বাঁচার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর  মা  গতকালই মারা গেছে। ভারী গাড়ির নীচে চাপা পড়ে। 

                 শতু ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে ঐ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ওকে ঘরে নিয়ে আসে। ওর শরীরের সমস্ত নোংরা ময়লা পরিষ্কার করে ওকে কিছু খেতে দেয়। খাবার পেয়ে বাচ্চাটার মেজাজ ফুরফরে হয়ে ওঠে। 

              বুকের উষ্ণতায় দুবার গলা ছেডে ডেকেও ওঠে। ডাক শুনে মিতাদেবী পাশের ঘর থেকে এসেই মেয়েকে কড়া ধমক," তোর কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে, এমন শুভ দিনে এই কুকুরটাকে কেউ ঘরে তোলে? ওর শরীরে কি রোগ আছে কে জানে?"
           "মা, তুমি এবার থামবে? অনেক্ষণ ধরে যা নয় তাই বলে যাচ্ছ।"
          "আমি কিছু বললেই দোষ, তাই না?"
           "মা, প্লিজ! একটু চুপ কর।"
           "আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত তাহলে কিছুতেই....."

             কথা শেষ হবার আগেই শতু মায়ের মুখের দিকে তাকায়,"মা, তুমি আজ একথা বলছ? তোমার ডেসানকে মনে পড়ে না? সেই ছোট্ট আদুরে ডেসান?"

               ডেসানের কথা উঠতেই মিতাদেবী কোথায় যেন তলিয়য়ে যান। বুকের ভিতরটা চিন চিন করে ওঠে ব্যথায়। বাচ্চাটার  দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ ভেজা চোখটা নতুন শাড়ির আঁচলে মোছেন।

                সন্ধ্যের পর থেকেই বৃষ্টির বন্দিশ কমতে থাকে।  আকাশ তবুও মেঘলা। মিতাদেবী রাতে রান্নাঘরে এসে দেখেন কুকুরের বাচ্চাটা গোটা রান্নাঘরটা নোংরা করে  রেখেছে। মেজাজ গেছে সপ্তমে। তবে সেটা সাময়িক। একটু পরেই ফুটন্ত মেজাজ নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ভিজে শীতল হতে শুরু করেছে। 

                 ..........  ......... ........  ..........

             " ........  জাগো দুর্গা.......
               .........  .........  তুমি জাগো......."

              আজ মহাষ্টমী। সকালে  ঢাকের  শব্দে ঘুম ভাঙে  শতুর। দেখে কুকুরের বাচ্চাটা ঘরে, বারান্দাতে ছোট একটা বল নিয়ে খেলছে।  নতুন জায়গাতে এসে আদর যত্ন পেয়ে  ওর মুখে খুশী ঝলসে  উঠছে। 

             অষ্টমীর অঞ্জলি শেষ হলে মিতাদেবী পুজোর পুষ্প শতু, কুকুরের বাচ্চাটার মাথায় একটু ঠেকিয়ে ওদের জন্যে মঙ্গল কামনা করেন। তারপর শতুর পড়ার ঘরে ঢুকে দেওয়ালে ডেসানের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন। 

                বাসি ফুলের মালাতে, ধুলোর চাদরে  ডেসান ফটোফ্রেমে  সদ্য ফোটা শিউলির মতন হাসছে। শতু ঘরে ঢুকেই ধুলো ঝেড়ে  ওর ছবিতে নতুন মালাটা চড়িয়ে দিল। আজ ডেসানের মৃত্যুবার্ষিকী। পুজোর আনন্দে সবাই ভুলে গেলেও মিতাদেবীর  মেয়ে   ঠিক মনে রেখেছে। 

              রান্নাঘর থেকে ডেসানের পছন্দের পদের গন্ধ ভেসে আসছে। আজ পুজোর দিন, মিতাদেবী ডেসানের কথা ভেবে হালকা কিছু বানিয়েছেন। যদিও প্রতি বছর ওর মৃত্যুদিনে ওর পছন্দের কিছু না কিছু বানানো হয়।

                ঝুপ করে সন্ধ্যে নামতেই চন্দননগরের আলোতে গোটা পাড়া ডুবে গেল। একটু পরেই সন্ধিপুজো বসবে। পাড়ার কচি কাঁচারা মণ্ডপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের হাতে ক্যাপ ফাটানো পিস্তল। ক্যাপের ফট্ ফট্ শব্দে চারিদিক মুখরিত। 

               "বাজলো তোমার.....
                ............ আলোর বেণু........"

             ১০৮টা প্রদীপ জ্বলে উঠতেই শতাব্দী পুচকেটাকে কোলে করে মণ্ডপে আসল। ওকে দেখেই সবাই স্তম্ভিত।  আজ বহু বছর পরে ও মা অপর্ণার মুখ দেখল। এমনিতেই ও পুজোর দিনে নিজেকে.....

              প্রদীপের আলোতে ঝলমল করছে পুচকে "ডেনে"র  এর মুখ। "ডেন" নামটা শতাব্দীর দেওয়া। "ডেসান" এর ক্ষুদ্র সংস্করণ। "ডেসান" এর নাম, শরীরের  ভিতরেই "ডেন" এর গন্ধ লুকিয়ে আছে।

               মিতাদেবী পুজো দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

                              *************

               শতুর বাবা তখন বদলির চাকরি নিয়ে চলে গেলেন বোলপুরে। শতু হোস্টেলে পড়াশোনা করছে। একমাত্র ছেলে অনুষ্টুপও বৌমাকে নিয়ে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালুরুতে আছে। প্রাইভেট কোম্পানী।  ছুটি কম।  মিতাদেবী একা থাকেন। অত বড় বাড়িতে ভয় করে। 

               শতাব্দী তখন বন্ধুর কাছে খোঁজ পেয়ে ছোট্ট ডেসানকে বাড়িতে আনল। মাকে একটু সঙ্গ দেবে বলে। এর  তিন মাস পরেই অনিকেতবাবু স্ট্রোকে মারা যান। শোকের ছায়া ঘিরে ধরল গোটা পরিবারকে। 

                বাবা মারা গেলে বাবার সরকারী  চাকরিটা অনুষ্টুপ পেল। স্বার্থপরের মতন ফ্ল্যাট নিয়ে কলকাতাতে চলে এল। মিতাদেবীর একাকীত্বের জীবনে তখন থেকেই ডেসানের রোল প্লে শুরু। 

               টানা চার বছর  বিপদে আপদে আগলে রেখেছে উনাকে। ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল হল এই চারপেয়ে, অবলা,প্রভুভক্ত ডেসান। মিতাদেবীর পর শতু দিদিমণিই ওকে বেশী আদর করত, ভালবাসত।  

              বহুবার চুরির হাত থেকে মিতাদেবীকে বাঁচিয়েছে। উনার শরীর খারাপ হলেই ছুটে গিয়ে চিৎকার করে পাশের বাড়ি থেকে কখনো সবিতা আন্টি, কখনো জয়া বৌদিকে ডেকে এনেছে। 

               মিতাদেবীর এখনও বেশ  মনে আছে সেইদিনটাও ছিল অষ্টমীর সকাল। সবে পুজো বসেছে। মিতাদেবী অঞ্জলির জন্যে তৈরী হচ্ছেন। বাড়িতে একা। সবাই বেরিয়েছে।  হঠাৎ শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে উনি চোট পান। পরিস্থিতি বুঝে ডেসান  ছুটে গিয়ে সবিতা আন্টিকে ডাকতে যায়।
            
            সেই শেষবারের মত বাড়ি থেকে ওর বেরোনো।  আর ফেরেনি।  আসার পথে রাস্তা পেরোতে গিয়ে ফোর হুইলারের চাকায় পিষ্ট হয় ওর নিষ্পাপ শরীর। শতাব্দী যখন ফিরল তখন দেখে,  ডেসানের রক্তমাখা থেঁতলানো শরীর রাস্তার এক কোণে পড়ে রয়েছে। মৃত শরীরের উপর মাছি ভন ভন করছে। পথ চলতি মানুষ কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে দেখে  পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। 

                

               বহু বছর পার হয়েছে। ডেসান চলে গেছে না ফেরার দেশে। তবে পুজো আসলেই ওর টাটকা  স্মৃতি ঝলসে ওঠে। আজ বহু দিন পরে ওর মৃত্যুবার্ষিকী আর অষ্টমী একই দিনে পড়েছে। কোইন্সিডেন্স!

              সন্ধিপুজো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। শতাব্দীর আলতো ছোঁয়ায় মিতাদেবীর সম্বিৎ ফিরল।

"মা, আমি ডেনকে নিয়ে একটু উনিশ পল্লী আর বিদ্রোহী ক্লাবের ঠাকুরটা দেখে আসছি। সময় পেলে শক্তি নগর, পাঠক পাড়া, সীমান্ত পল্লীর ঠাকুরগুলো দেখে নেব। ফিরতে একটু দেরী হলেও হতে পারে। তুমি চিন্তা করো না।"
                "সাবধানে যাস মা, দেখিস যেন কোন বিপদ....."

             কথা শেষ হয়না। মিতাদেবী দেখেন শতাব্দীর কোলে পুচকে ডেন যেন ডেসানেরই হারিয়ে যাওয়া অতীত। 

              নিম্নচাপ কেটে গিয়ে তারায় ঝলমল করছে অষ্টমীর সন্ধ্যে। ডেনকে পেয়ে শতাব্দীর মনের উঠোনে আজ বোধনের রোদ্দুর। মিতাদেবীর চোখ থেকে নামছে পবিত্র আশ্বিনের শিশিরের নোনা চন্দন। ঠিক নিম্নচাপের মতই। তার ছিঁটে ফোঁটা মনে হল যেন ডেনের নরম, স্নিগ্ধ পশমেও পড়ল। 

             মিতাদেবী সকলের মঙ্গল কামনায় মা উমার কাছে প্রার্থনা করলেন। মায়ের মুখে কোজাগরী চাঁদের হাসি উথলে উঠছে।

            চারিদিকে আলোর বন্যায় মেখে আধুনিক গান আর মাঝে মাঝে বাজির শব্দ ভেসে আসছে। বৃষ্টি থেমে গিয়ে একটু গরমও ধরেছে। মিতাদেবী বেশ কিছুক্ষণ পরে গুটি গুটি পায়ে চ‍ৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটা চেনা কণ্ঠস্বরে পায়ের গতি শ্লথ করলেন।

                "মিতু, অ্যাই মিতু! চিনতে পারছিস?"
                 "কে? ও মা! নন্দা! কবে এসেছিস? কতদিন পরে......"
                 "নে ধর, আইসক্রিম। যা গরম!"
       
             দুই বন্ধুর হাসি, আড্ডাতে বোধনের রোদ্দুরে যখন জোয়ারের ভরা কোটাল, তখন শতাব্দী ডেনকে নিয়ে একটার পর একটা মণ্ডপ পেরিয়ে শক্তিনগরের দিকে পা বাড়াল। 

              "দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী........
              ......... মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে......."

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024