ছোট গল্প - পেন ও ফিরে পাওয়া বন্ধু || লেখক - দীপঙ্কর সাহা || Short story - pen o phire paouar golpo || Written by Dipankar saha


 

পেন ও ফিরে পাওয়া বন্ধু

দীপঙ্কর সাহা


-এক-


শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল বুলু (হেমন্ত দত্ত)। আমাদের পাশের পাশের বাড়ি থাকতো। এক সাথে স্কুলে যাওয়া ও স্কুল থেকে ফেরা, অবসর সময়ে এক সাথে খেলা ধুলো, সবকিছুতেই বুলু ছিল আমার একমাত্র সাথি। 


আমার শৈশব ও কৈশোরের সোনালী দিনগুলো কেটেছে যশোর শহরে, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যা এখনকার বাংলাদেশ। 


যতদূর মনে পড়ে, যখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি, তখন বুলুরা সপরিবারে পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে আসে এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁতে বসবাস করতে শুরু করে। 


তার অনেক পরে, ক্লাশ টেনের ফাইনাল পরীক্ষা (সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট) দিয়ে আমিও চলে আসি কলকাতায়। এত বছর পরেও বুলু কে আমি খুব মিস করতাম। 


ইচ্ছে থাকলেও বুলুর সাথে দেখা করার বা বনগাঁ যাবার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া ওদের বাড়ি চিনি না, বনগাঁ অনেক বড় জায়গা, কোথায় খুঁজবো বুলু কে বনগাঁ গিয়ে! 


এর বছর চারেক বাদে আচমকা এক সুযোগ এসে গেল বনগাঁ যাবার। বড়দা একদিন একবেলার জন্য কি একটা কাজে বনগাঁ গিয়ে ফিরলো না। মা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে, পরদিনই সকালে, আমাকে বনগাঁ গিয়ে খোঁজ খবর করতে পাঠিয়ে দিল। 


গেলাম। এই ভরসায় গেলাম যে, বুলুদের একটা দোকান ছিল বা আছে বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি কোথাও, এইটুকু শুধু জানতাম। 


তাছাড়া বুলুর এক কাকা ছিলেন বড়দার বন্ধু। হয়তো কোনও খবর পেলেও পেয়ে যেতে পারি, ওদের বাড়ি গেলে। 


বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি গিয়ে, বুলুর বাবার নাম করে দোকানের খোঁজ করতে পেয়েও গেলাম। দোকানে বুলুর বাবা ছিলেন, আর বুলুর ছোটভাই খোকা। 


খোকা আমাকে চিনতে না পারলেও, বুলুর বাবা এতো বছর পরেও আমাকে এক নজরে চিনতে পেরে মহা উৎসাহে হৈচৈ বাঁধিয়ে সমস্ত খোজ খবর নিতে শুরু করলেন বাড়ির সবার। 


বললাম সব, কিন্তু জানতে পারলাম বড়দা ওদের বাড়ি বা দোকানে আসে নি বা যোগাযোগও করে নি। কি করি, কথাবার্তার শেষে আমি চলে আসতে চাইলাম। 


-চলে যাবি মানে? দাড়া আমি ব্যাবস্থা করছি। 


নিজের চেনা এক রিকশা ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমি তো এটাই চাইছিলাম। বনগাঁ গিয়েও বুলুর সাথে দেখা না হলে, সারা জীবন আফসোস থেকে যেতো যে! 


-বাড়ি যা, সারাদিন থাকবি, খাবি। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি যাবি। তোর বন্ধু বুলু বাড়িতেই আছে। 


ছুটির দিন ছিল, বোধহয় রবিবার। বুলুর তো বাড়ি থাকারই কথা! বাড়ি ঢোকার মুখে বুলুর দাদা সুশান্তদার সাথে দেখা, মুখটা কাচুমাচু, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে অনেক দিন বসে আছে বলে বাড়িতে একচোট বকাবকি হয়েছে, আমাকে বললো, -তুই ভিতরে যা, বুলু আছে। 


বুলু তো আমায় জড়িয়ে ধরলো, দেখলাম আমার মতোই ওরও আমার প্রতি মনের টানটা এতদিন পরেও আছে! 


বুলুও আমার মতোই পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই বি এস সি পড়ছে। কথা শুরু হলো, তো শেষ আর হয় না! ছোটবেলার নানান কথা, স্মৃতিচারণ এইসব হতে হতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। 


একসাথে বুলু কে আর আমাকে খেতে দিয়ে, বুলুর মা ও বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। 


খাওয়া হতেই বুলু বলে, - চল একটু ঘুরে আসি। আমি তো বুঝে গেছি, কেন বলছে। দেখলাম পাড়া ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দুরে গিয়ে, তারপর বুলু সিগারেট কিনলো! 


দেখে খুশি হলাম, আমার ব্র্যান্ডের সিগারেটই কিনলো বুলু, উইলস্ ফিল্টার। গল্প করতে করতে সিগারেট শেষ করে তারপর পাড়ায় ঢোকা হলো। 


গল্পে আর কথায় কথায় কখন বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই নেই। হঠাৎ উঠোনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আলো কমে এসেছে, শীতের বেলা! অগত্যা উঠতেই হলো। 


বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে মনটা খারাপ হয়ে গেল, মা তো বসে আছে বড়দার খবরের প্রতীক্ষায়, মা কে বাড়ি গিয়ে কি বলবো? 


বুলুর বাবা যা বলেছিলেন, তাই বললাম। উনি খোঁজ খবর নেবেন, বনগাঁয় এবং জানাবেন খবর পেলে। 


অবশ্য তার আর দরকার পড়েনি, বড়দার সেই রাতেই ফিরে এসেছিল। 


-দুই-


ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয় জিনিসের মধ্যে অন্যতম হলো পেন। তখন তো বল পয়েন্ট পেন ওঠে নি, চল ছিল ফাউন্টেন পেনের। আমার খুব প্রিয় একটা পেন ছিল কালো আর সোনালী রঙের। বিদেশি জিনিস, যতদুর মনে আছে জার্মানির তৈরি। 


আমি জানতাম বুলুর ওই রকম একটা পেনের খুব শখ। কিন্তু সেটা আমার এতো প্রিয় ছিল যে, কোনও সময় ওটা হাতছাড়া করতাম না। 


আসলে ছোটবেলায় ওই রকমই একটা কালো সোনালী প্রিয় পেন আমার হারিয়ে যায়, তাই এই পেনটার প্রতি আমার টান টা একটু বেশিই ছিল। 


তখন আমি থ্রি তে পড়ি। বড়দা, মেজদারা কলকাতায় পড়াশোনা করে। শীতের শেষে স্কুল ছুটি, যশোরে বাড়ি এসেছে। 


তখনো বড়দির বিয়ে হয়নি। বড়দা মেজদারা এসেছে মানে বাড়িতে আনন্দের হাঁট । হঠাৎ বড়দির চিকেন পক্স হয়ে পড়লো । মা বলতো মায়ের দয়া। 


তারপর একে একে অন্যদের হতে শুরু করলো। এক এক জনের হয়, আর তার জন্যে ঘর আলাদা করে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত দাদার ও হলো, সব কটা ঘর ওদের দখলে চলে গেল। 


আমি একা মার সাথে ঠাকুর ঘরে শুই আর মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াই, প্রাণপনে মনে মনে চাইছি আমার কেন হচ্ছে না !!!


রোজ সকালে মাকে ডেকে দেখাই - দ্যাখো তো মা আমার বোধহয় গুটি বেড়িয়েছে, মা না করলেই আরো মন খারাপ !! শেষ পর্যন্ত এক দিন মা বললো গুটি তো বেড়িয়েছে, ঠাকুমার ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। সেদিন কি আনন্দ !! 


মনে আছে, ঠাকুমার ঘরে ঢুকে, আনন্দের আতিশয্যে, প্রথম কথা বলেছিলাম, অসুখ সারলেই এই পেনটা বুলুকে দিয়ে দেবো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দিতে হয়নি। কারণ আমার অসুখ ছাড়ার আগেই ওরা যশোর ছেড়ে বনগাঁ চলে যায়। 

 

-তিন-


যশোরে আমাদের বাড়ি ছিল শহরের একদম জমজমাট অঞ্চলে, বাড়ির সামনে বড় রাস্তা, কিন্তু পিছন দিকে বাড়ির গা বেয়ে বয়ে চলেছে ভৈরব নদ। বাড়ির ঘাটে নদীর বুকে আড়াআড়ি ভাবে একজোড়া তক্তা পাতা। তাতে বসে শুধুমাত্র বাসন মাজা হয়। 


নদীতে নামা আমাদের বারণ ছিল। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসে যেতাম কখনো সখনো।


তখন আমার বয়স হবে ছয় কি সাত। স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে পড়ি, তবে পড়ার চেয়ে খেলার দিকে মন বেশী। গত বছর ইনফ্যান্ট ক্লাশ থেকে ওয়ানে ওঠার পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়ায় বাড়িতে একটু প্রশ্রয়ও পাচ্ছি। 


আগেই বলেছি পাশের পাশের বাড়িতে থাকে আমার প্রিয়তম বন্ধু বুলু। ছুটির দিনগুলোতে সারাদিনই হয় বুলুর বাড়িতে আমি, না হয় আমার বাড়িতে বুলু। একমাত্র বুলুর সাথেই আমার কখনও আড়ি হয়নি। 


গতবছর পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় কেউ একজন উপহার দিয়েছিলেন একটা সোনালী ফাউন্টেন পেন। বিদেশি জিনিস, তার চমকই আলাদা। 


পেনটি ছিল আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। সেটি দিয়ে যত না লিখতাম, তারচেয়েও বেশি সেটা হাতে নিয়ে খেলতাম। 


একদিন হয়েছে কি, আমি আর বুলু বাড়ির ঘাটে, কলাগাছের ঝাড়ের আড়ালে বসে মাছ ধরতে গেছি। বুলুর হাতে ছিপ, আমার হাতে যথারীতি সেই পেন। 


হঠাৎ ফাৎনায় টান পড়তেই বুলু এক ঝটকায় ছিপ টেনে তুলেছে, চমকে গিয়ে আমার হাত থেকে পেনটি একদম জলে। মূহুর্তে সেটি এক বুদবুদ তুলে জলে ডুবে গেল। 


আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখেই বোধহয় বুলু থাকতে পারেনি, এক ঝটকায় জামা খুলে আমার দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জলে ঝাপিয়ে পড়লো। 


জলে ডুবে দিয়ে বুলু আর তো ওঠেনা। সময় বয়ে যেতে থাকে, আমার উৎকন্ঠা বেড়ে চলে তার দ্বিগুণ বেগে। 


আমরা দুজনই সাঁতার জানিনা। তাহলে কি বুলু আর উঠবে না? আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি করবো বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ পরে সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা হাত ভেসে উঠলো জলের মধ্যে। 


হাতটা আমার নাগালের মধ্যেই ছিল, অনেক কষ্টে টেনে তুললাম আমার প্রিয়তম বন্ধুকে। 


বললো, -পেনটাতো পেয়েছিলাম, কিন্তু শ্যাওলায় পা জড়িয়ে ধরেছিল। শ্যাওলা থেকে পা ছাড়াতে গিয়ে পেনটা গেল পড়ে। পেন খুঁজতে গিয়ে শ্যাওলায় আবার জড়িয়ে গেলাম, এদিকে দম ফুরিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে শ্যাওলা ছাড়িয়ে উঠে আসতে পারলাম। 


আমি তো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। আশ্চার্য কান্ড, বুলু উল্লেখ করা সত্বেও, পেনটার কথা আমার মাথায়ই আসে নি। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024