উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -8
বাবা উদাস হয়ে জানালার পানে তাকিয়ে ছিলেন চক্ষুদ্বয়কে স্থির করে। আচার্য্য মশায়ের এতো ভাষণ দেওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম। গত কয়েক মাস আগে বাবা ওদের কোন এক মজলিসে বলেছিলেন, দাদা ডাক্তারী পাশ করলে যে সুদিন ফিরে আসবে তাতে তার খরচা তুলে নেবেন। আচার্য্য মশায় ঠাকুরদার আমল হতেই আমাদের প্রতি হিংসুটে ছিলেন। তিনি উপনিষদের কথা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন সত্য, কিন্তু এসময়ে আমাদের কোন ফল হলো না বরং শোকের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।
বাবা তার কথায় আরো দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কিভাবে দিনগুলো কাটাতেন তা ঈশ্বরই জানেন। তবুও নিজেকে শক্ত করে নানা ভাবে বাবাকে বুঝিয়ে কয়েক মাস অশেষ দুঃখ ভোগের পর মনে চাঞ্চল্য কাটিয়ে স্থৈর্য আনলাম সত্য, কিন্তু বাবা কোন প্রকারে দাদার কথা ভুলতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। তার এই শোকাহত জীবনের মুখচ্ছবি আমাকে আকুল করে তুলে ছিল। তাই ঐ জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঐ দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে আমাদের উভয়ের মৃত্যু কামনা করতাম। আবার কখনও কখনও ভাবতাম আমাদের জীবন রথ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
প্রতিদিনই একরকম উপবাসে দিন যেতো। সুতরাং দারিদ্রই ছিলো তখন দৈনন্দিন জীবনের সাথী। নৈরাশ্য, ব্যর্থতা ও অনটন নিয়ে তখন ঘর পেতে বসেছিলাম।
এভাবে কত দিন চলবে। দৈন্য পীড়িত, সংসারে আয়ের উৎস সন্ধানে ব্রতী হলাম। কিন্তু উৎসের সন্ধান সহজলভ্য হলো না। প্রাইভেট টিউশানির প্রতিযোগীতায় পরাজিত হলাম। একদিন ভাবলাম দূর সম্পর্কের পিসিমার বাড়ী হতে বেড়িয়ে আসি। আমাদের দুরাবস্থার কথা শুনিয়ে যদি কিছু সাহায্য পাই, তাহলে হয়তো কয়েকটা দিন চল যাবে। কিন্তু বাধা দিলেন রন্টুদা আমাদের বাড়ীতে এসে। আমি ভাবতেই পারিনি এই সময়ে রন্টুদা আমাদের বাড়ীতে আসবে।
নিজেদের অন্ন জোটানো বিশাল কষ্ট দায়ক; প্রথমেই বলেছি অধিকাংশ দিন আমাদের পিতা - পুত্রীকে অনাহারে থাকতে হতো। রন্টুদা এসে হাজির হয়ে মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে দিতেই আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। ভেতর থেকে যেন কান্নাকে ঠেলে নিয়ে এলো। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। রন্টুদা অনেক প্রবোধ দেবার পর কান্না থামল বটে, কিন্তু বার বার দাদার কথা মনে পড়তেই যেন পুনরায় কান্নাতে দেহ-
মনকে দুর্বল করে ফেলল। কোনো প্রকারে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর জলযোগের ব্যবস্থা করলাম।
রন্টুদা কিছুক্ষণ পর অতিনম্র গলায় বলল, সুমন্ত যখন কলকাতায় খুন হয় তখন। আমি কলকাতায় ছিলাম না। অনেক পরে আমি কলকাতায় এসেছি। এসে সুমন্তর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি আর থাকতে পারলাম না। তোদের অবস্থা আমি জানি, এই দুর্দিনে যদি তোদের পাশে এসে না দাঁড়াই তাহলে আমি চিরদিনের জন্য অকৃতজ্ঞ রয়ে যাবো।
সুমন্তর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি স্থির থাকতে পারিনি রমা। বার বার মন কাঁদতো তোদের কিভাবে দিন কাটছে, তোরা কেমন আছিস, কি করে তোদের সংসার চলছে, তোদের অগ্নিদগ্ধ জীবনে যদি একটুখানি সান্ত্বনা দিতে পারি তাহলে জানবো আমি তোর আপন দাদার কাজ করলাম। হ্যাঁরে, তোদের হাট - বাজার কোথায়। একটা থলে দে, কিছু আনাজপত্র নিয়ে আসি।
আমি কি করবো ভাবছি। আমার মুখপানে তাকিয়ে বললেন, আমি সব বুঝি, হলেটা দে, এবার বল বাজারটা কোথায়।
বললাম। আমাকে উনুন ধরাতে বলে রন্টুদা বাজারের অভিমুখে পা পাড়ালো। আমি উনুন ধরিয়ে বাবাকে একটা প্লেটে দুটো মিষ্টি দিয়ে বললাম, বাবা সকাল থেকে খালি পেটে আছো, দুটো মিষ্টি খাও। বাবা মিষ্টি দুটো হাতে নিয়ে নাড়া - চাড়া করতে দেখে ভাবলাম, কতদিন হল বাবা, মিষ্টি, সন্দেশ, চোখে দেখেনি তাই চোখ দুটো আমার জলে ভরে গেলো। বাবা কিছুক্ষণ পর মুখে মিষ্টি একটা প্রবেশ করাতেই কাশতে শুরু করলো। আমি জলের গ্লাসটা নিয়ে বাবাকে জলপান করালাম।
কোন প্রকারে দুটো মিষ্টি খেয়ে পুনরায় জানালার পাশে গিয়ে বসলো। পূর্বের মত উদাসীনভাব। তার অন্তরের জমাট বেদনা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাবার চোখ দিয়ে টপ্ টপ্ করে জল ঝরছে। প্রবোধ দিলেও বাবা শান্ত হয় না। এক সময় রন্টুদা থলি ভর্তি আনাজপত্র তরিতরকারী, চাল, ডাল ইত্যাদি এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো রাখ। তিন - চার দিনের আহার আছে। আজকে শুক্তো, ডাল ও আমের চাটনী করবি, সুন্দর ভাত খেয়ে নেব। মনে কোন দ্বিধা আনিস না রমা। বিধাতার অভিশাপে তোদের জীবন মরুময় হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি। তবে তোদেরকে আমি হারতে দেব ন। আমি একটা পথ বের করবই। আমি যখন এসে পড়েছি তখন তোদেরকে এইভাবে দিন কাটাতে দেব না। আজই উপার্জনের জন্য উৎস বের করবই।
রন্টুদার কথামত শুক্তো, ডাল, আমের চাটনি দিয়ে বাবা ও রন্টুদাকে খাবার পরিবেশন করলাম। হঠাৎ বাবা কেঁদে ফেললেন, রন্টুদা ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকলো, একটু পর বলল, আপনি কাঁদবেন না মেসোমশায়, আমি তো আছি। মনে করুন আমি সুমন্ত, দুঃখকে ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। আর ভুলতে হবেই। আমি জানি উপযুক্ত পুত্রকে হারিয়ে কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না। বারংবার তার মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। আপনি ভারসাম্য হারাবেন না। নইলে রমা বাঁচবে না। আপনার যন্ত্রণা দেখে ও কোন প্রকারে ভালো থাকবে না। মর্মে মর্মে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। আপনাকে দাঁড়াতেই হবে। কোন চিন্তা নেই আপনার, আমি সর্বদাই আপনার পাশে আছি। সর্বদাই আপনাদের সাহায্য করবো।
Comments