ছোট গল্প - মরণকূপ || লেখক - ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী || Short story - Moronkup || Written by Isita Biswas Choudhary
মরণকূপ
ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী
রথীনবাবুর ট্রান্সফারেবল জব। ব্যাংকের চাকরি, তাই প্রতি চার বছর অন্তর নানা প্রত্যন্ত প্রান্তে এবং বেশ দুর্গম কিছু অঞ্চলে পোস্টিং হবার জন্য ফ্যামিলিকে সঙ্গে রাখতে পারেন না তিনি। কিছুদিন আগে প্রান্তিক অঞ্চলের একটি মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। তারপর চার বছর কেটে যাওয়ায় এবং একটি ব্রাঞ্চে তার প্রয়োজন পড়ায়, বীরভূমের 'সদরপুর' বলে একটি জায়গায় বদলি হন তিনি। অবশ্য আজকাল এসব নিয়ে আর কিছু ভাবেন না রথীনবাবু। যেকোনো জায়গার সাথে এডজাস্ট করে নিতে তার আজকাল আর সেরকম সমস্যা হয় না। আগে বেশ সমস্যা হতো। চিরকাল কলকাতায় থাকার দরুন নিতান্ত গ্রাম্য পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হতো তার। তবে আজকাল ভালই লাগে। এক জায়গায় বেশিদিন তার আবার মন বসেনা। বিভিন্ন স্থানে থাকার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর বলেই মনে হয় তার।এছাড়াও তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ভালোবাসেন। তাই যে অঞ্চলে পোস্টিং হয় শনি-রবিবার করে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে সেই অঞ্চলকে এক্সপ্লোর করতে। মাসে একবার বাড়ি যান। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে যাওয়ায় সাংসারিক দায়িত্ব সেভাবে থাকে আর নিতে হয় না তাকে। রিটায়রমেন্টের আর বেশি দিন বাকি নেই। জীবনটা এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাটাতে চান তিনি।
যথারীতি ব্যাংকের লোকেরা তাকে ফেয়ারওয়েল দিল। এতদিন থাকার দরুন মনটা একটু খারাপ লাগছিলো তবে নতুন জায়গায় যাবার কথা ভেবে তিনি মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। শনিবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নতুন ব্রাঞ্চ 'সদরপুর'। আসতে আসতে রাস্তায় দেখলেন লাল মাটির রাস্তা চারিপাশে বিভিন্ন রকম শাল-সেগুন এসবের জঙ্গল। ভীষণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চারিদিকে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ আসার পর তারা গ্রামে প্রবেশ করলেন। অদূরে ছোট ছোট টিলা এবং ছোট ছোট মাটির বাড়ি, কোনটাতে টালির চাল বা খড়ের ছাউনি । গাড়ি এসে ব্যাংকের সামনে দাঁড়ালো। ছোট্ট একতলা বাড়ি। একটি ছোট গ্রামীণ ব্যাংক, অফিস আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ায় সুনসান। আজ শনিবারও তাই সেরকম ভিড় নেই। রথীনবাবু ভিতর প্রবেশ করলেন। একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল "আসুন স্যার, আমার নাম সুমন, আমি ব্যাংকের কর্মী। আজ শনিবার অনেকেই বাড়ি চলে যায়, সোমবার সবাই ফিরে আসবে। আপনার জন্য বাড়ি ঠিক করাই আছে আগের ম্যানেজারবাবু যেখানে থাকতেন সেই বাড়িটি খালি আছে। চলুন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।"
সুমন রথীন বাবুকে নিয়ে এলেন তার কোয়াটারে। গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট একতলা একটি বাড়ি। সামনে পেছনে অনেকটা জায়গা। সুমন তাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এসে বলল, "আসুন বাবু আমার নাম রঘু, আমি আপনার দেখাশোনা করবো।" সারাদিন ক্লান্ত রথীনবাবু ফ্রেশ হয়ে একটু জিরিয়ে নিলেন। উঠে দেখলেন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রঘু রান্নাঘর থেকে এসে বলল, "বাবু চা করছি, রাতের খাবার করে রেখে গেলাম। কাল সকালে আবার আসবো।"
রথীনবাবু বাইরে বেরিয়ে দেখলেন আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। বাইরে মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, দূরে গ্রামে মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে সন্ধ্যা দিচ্ছে। তিনি বাড়ির চারপাশটা ভালো করে ঘুরে দেখলেন। বাড়ির বেশ কিছুটা অংশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নানান রকম গাছে ভর্তি। পাঁচিলের পেছনে শাল, শিমুল,মহুয়া,পলাশের জঙ্গল শুরু হয়েছে। বাতাসের মর্মরধ্বনি কানে আসছে তার। জঙ্গলের মধ্যে দূরে কোথায় সমস্বরে শেয়াল ডেকে উঠল। রথীনবাবু হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের দিকে গেলেন। আশেপাশে বাড়িঘর সেরকম নেই বললেই চলে। তার বাড়িটি বেশ নিরিবিলিতে ফাঁকা জায়গায়। রথীনবাবুর একা থাকার অভ্যাস আছে, তার হয়তো খুব একটা সমস্যা হবে না। তাও বিদেশ বিভুঁই জায়গা, মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো তার। রঘুর ডাকে সম্বিৎ ফিরলে ঘরে ফিরে এলেন। রঘু বলল, "বাবু আপনার খাবার রেডি করে রেখে গেলাম। আমার বাড়ির সামনেই গ্রামে কাল ভোর হতেই চলে আসব। কালতো রবিবার, একটা ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াবো।" তিনি বাজার করার কিছু পয়সা দিয়ে বললেন,"ঠিক আছে কাল সকালে চলে এসো।" কি মনে হতে তিনি রঘুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,"আচ্ছা এই জঙ্গলে কোন বন্য পশু নেই তো? রাত্রে জানলা খোলা রেখে শোবো তাই বলছি।" কথাটা শুনে একটু চমকে উঠলো রঘু। ফিসফিস করে বলল, "ভর সন্ধ্যেবেলা ওই জঙ্গলের নাম নেবেন না বাবু , আপনি এখানে নতুন তাই বলছি আপনার বাড়ির পাঁচিলের পেছনে জঙ্গল শুরু হয়েছে সেটিকে 'নাড়াবোরা'র জঙ্গল বলে। আপনি দয়া করে ওদিকে বিশেষ যাবেন না। ওই জঙ্গল ভালো জায়গা নয়। জঙ্গলের মধ্যে একটা কুয়া আছে যেটি খুব সাঙ্ঘাতিক। অনেক মানুষের প্রাণ গেছে ওই মরণ কুয়োর ধারে গিয়ে। আগের ম্যানেজার বাবুর তো ওখানে গিয়েই মৃত্যু হয় আপনি জানেননা?" রথীন বাবু একটু বিস্মিত হলেন। একথা তো তাকে কেউ আগে জানায়নি! রঘু বলল, "এখানে অবশ্য ঠাকুরের মূর্তি আছে। ভয়ের কোন কারণ নেই। বলে দূরে দেয়ালে টাঙ্গানো ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে প্রণাম করলো সে। এমনিতে ভয়ের কোন কারণ নেই তবে সাবধানে থাকবেন।"
রঘু চলে গেলো। রাতে বাড়িতে ফোন করে গল্প করলেন অনেকক্ষণ। তারপর রাতের খাবার খেয়ে এসে শুলেন বিছানায়। চারদিকে মহুয়ার সুবাস নাকে আসছে। তবে ঘরের ভেতরে বেশ বদ্ধ গরম তাই জানলাগুলো খুলে দিলেন। আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলেন চুপ করে। নতুন জায়গা, ঘুম আসতে সময় লাগে তাই ফোন খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন।
চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু কানে আসছে না। এরকম একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে একা, ফাঁকা বাড়িতে থাকা সত্যিই বেশ দুরূহ ব্যাপার। তবে যারা একাকী থাকতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই জায়গা স্বর্গ বলেই মনে হয়। রঘুর কথাগুলো মনে পড়তে একটু চিন্তা হল। এমন একটা ঘটনা তাকে জানানো হলনা কেন? সে বিষয়ে তিনি বেশ ধন্দে রইলেন। হঠাৎ দূরে জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে একটা হালকা কমলা আলো আসছে। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার থাকায় আলো আরো বেশি দৃশ্যমান মনে হচ্ছে। এত রাতে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে কিসের আলো ? জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। সেরকম কিছু দেখতে পেলেননা। নিরাশ হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আগের ম্যানেজার অসীমবাবু কেন গেছিলেন জঙ্গলে? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালবেলা দরজায় করাঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙলো তার। রঘু একগাল হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে, বাজার করে এনেছে সে। তারপর বলল,"দাঁড়ান বাবু আপনার জন্য জলখাবার বানাই।'
রথীনবাবু বললেন ,"সেই ভালো আমি ফ্রেশ হয়ে একটু হেঁটে আসছি। তুমি জলখাবার রেডি কর।"
রথীনবাবু ভাবলেন আশপাশ অঞ্চলটা একটু ঘুরে আসি। সকালের মিঠে রোদ, মৃদু হাওয়া বইছে বাতাসে। অনেক দূরে পাহাড়ের রেখা চোখে পড়ছে, দূর থেকে মনে হয় নীল মেঘের সারি । লাল মোরামের রাস্তা ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। চারপাশে জঙ্গল কোথাও বেশি কোথাও-কোথাও হালকা হয়ে এসেছে। সকালে গ্রামের লোকজন গবাদিপশু নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন উনি। রথীনবাবুকে দেখে বললেন, "আপনি বুঝি পুরনো ম্যানেজারবাবুর জায়গায় এসেছেন?" রথীনবাবু একটু অবাক হলেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন ,"হ্যাঁ, আপনি কি করে জানলেন ?"
"একটু আগে আপনাকে কোয়াটার থেকে বের হতে দেখলাম তো।'
তিনি বললেন, "ও আচ্ছা, আমি গত কালই এসেছি।"
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন," আমার নাম হরিহর দাস। আমি এই অঞ্চলের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আপনার সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। কালকে বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?"
রথীনবাবু বললেন," না সেরকম না। আমি তো বাইরে বাইরে সারাজীবন থেকে এসেছি তবে নতুন জায়গাতে ঘুম আসতে একটু সময় লাগে আর বাড়িটা একদম নিরিবিলিতে তাই একটু আর কি...."
" সেই। ভয় পাবেন না, আপনার বাড়িতে তো ভগবানের ছবি আছে, আর কোন কিছু মনে হলে ভগবান কে ডাকবেন।"
রথীনবাবু একটু বিস্মিত হলেন। তাকে বললেন,"কি ব্যাপার বলুন তো? ওই বাড়িতে কি কোন সমস্যা আছে ? রঘু আমাকে বলছিল ভেতরে জঙ্গলের ব্যাপারে কিছু কথা... যদিও আমি ওসব বিশ্বাস করিনি।"
হরিহরবাবু একটু থমকে বললেন ,"আপনি জানেন না, ও বাড়িতে কি হয়েছে? আপনার আগে যিনি ম্যানেজারবাবু ছিলেন অসীম বাবু, তিনি কিন্তু ও বাড়িতেই অপঘাতে মারা যান।"
"হ্যাঁ সে কথা আমি এখানে আসার পর জানতে পারি। তা বাড়িতে তো কেউ মারা যেতেই পারে সেখানে অসুবিধাটা কোথায় ?"
হরিহরবাবু আবার বললেন,"আপনি জানেন কিনা জানিনা তবে অসীমবাবুর মৃত্যুটা কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না। জঙ্গলের পেছনে একটি প্রাচীন কুয়ো আছে, সেটি অবশ্য বহুদিন অব্যবহৃত। আমাদের গ্রাম থেকে কেউ কোনদিনই জল নেয়না। স্থানীয় লোকদের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে, তারা বিশ্বাস করে ওই কূপের ভেতরে কোন অশরীরীর বাস এবং ওই জঙ্গলের মধ্যে মধ্যরাতে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। অসীমবাবুর মৃত্যু ওই কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার জন্যই হয়েছিল। রঘু সকালবেলায় কোথাও তাঁকে না পেয়ে গ্রামের লোকজন নিয়ে খুঁজে দেখে উনি কূপের ভেতরেই মরে পড়ে আছেন। পুলিশও সেরম কিছু করতে পারেনি। আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা কিছুই বোঝা যায়নি। তবে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস নিশি ডেকে নিয়ে গেছিল ওনাকে সেদিন রাত্রিবেলা। যাই হোক, রঘু সারাদিন তো বাড়িতেই থাকে। রাত্রেবেলা ফিরে আসে। রাত্রিবেলা একটু সাবধানে থাকবেন আর ভুলেও জঙ্গলের দিকে যাবেন না।" এরকম আরও নানান রকম কথাবার্তা বলে হরিহরবাবু বিদায় নিলেন।
রথীন বাবু হেটে বাড়ি ফিরে এলেন। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। অসীমবাবু কেন সেদিন মাঝরাতে সেখানে গিয়েছিলেন আর কি করেই বা কুয়োর ভেতর পড়ে মারা গেলেন সেটি বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার বটে। যাইহোক সেটা কোন কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে। তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রঘু সারাদিন থেকে তার ফাই ফরমাশ খেটে রাতে বাড়ি ফিরে গেল যথারীতি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলো, নিঝুম নিথর রাত্রি। অনেক কষ্টে এদিক ওদিক করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো তার। মনে হল জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই আওয়াজটা আসছে। কেউ যেন অদুরে করুন স্বরে বিলাপ করছে। আধো অন্ধকারে ঘড়ির দিকে চোখ পরতে দেখলেন প্রায় তিনটে বাজে। এত রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে কে বিলাপ করছে তার জানার কৌতুহল হল কিন্তু সকলের বারণ উপেক্ষা করে জঙ্গলে যাবার তার সাহস হলো না। নানা কথা ভাবতে ভাবতে, এপাশ-ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
পরদিন সকালে ফ্রেশ হয়ে ব্রাঞ্চে পৌছলেন। সেখানে সকল কর্মচারীদের সাথে আলাপচারিতায় পর দৈনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তবে সারাদিন মনটা তার কেমন যেন খচখচ করছিল। বিকেলবেলা কি মনে করে সুমনকে ডেকে পাঠালেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, এই ব্যাংকের আগের ম্যানেজারবাবু অসীমবাবু, তাঁর নাকি আমার বাংলোতে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাটা আমাকে এখনো ব্যাংকের কোন লোক জানায়নি। আমি এখানে আসার পর স্থানীয় লোকদের কাছে কথা জানতে পারি কোন বিশেষ কারণ আছে কি?"
সুমন বেশ অবাক হয়ে গেল বলল,"আপনি কি কিছুই জানতেন না? যদিও আমাদের এ ব্যাপারে কথা বলতে নিষেধ আছে। তাও আপনি যে একেবারেই জানতেন না এটা আমি জানতাম না। হ্যাঁ ওনার অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল, বাড়ির পেছনে একটি কুয়োর মধ্যে সকালবেলা ওনার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সেটি নেহাতই দুর্ঘটনা বলে সবাই ধরে নিয়েছে কারণ আত্মহত্যা করার মত ব্যক্তি তিনি ছিলেননা। আর একটি পরিত্যক্ত কুয়োতে কেউ আত্মহত্যা করবেই বা কেন? সেটাও যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার। পুলিশ সেটাকে দুর্ঘটনা বলেই মনে করছে। কিন্তু অত রাতে উনি কেন ওই কুয়োর কাছে গেছিলেন সেটা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। তবে এখন সবকিছু আগের মতই চলছে। ব্যাংকের ভেতরে এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করতে কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেছেন কারণ গ্রাম্য জায়গায় এমনি লোকজন কুসংস্কারে জর্জরিত। এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হলে লোকে হয়ত ব্যাংকে আসতে চাইবে না, তাই আর কি।"
রথীনবাবু সব শুনে একটু আস্বস্ত হলেন। তিনি ভাবলেন হয়তো সত্যিই দূর্ঘটনাবশত ওনার মৃত্যু ঘটেছে। এরকম তো হতেই পারে। যেকোনো কারণে সেদিন অসাবধানতাবশত তিনি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছিলেন। যাই হোক তিনি নিজের কাজে মন দিলেন। অনেক অনেক কাজ পেন্ডিং রয়েছে আস্তে আস্তে তিনি সেখানে মন বসাতে শুরু করলেন।
কদিনপর থেকে কাজের চাপে এসব কথা তার আর মনে রইলনা। তবে রাত হলেই জঙ্গলের দিকে তাকালে তার যেন কেমন অস্বস্তি হয়। মনে হয় যেন ওই জঙ্গলের ভেতর কি রহস্য আছে তা তাকে উদ্ধার করতেই হবে, নাহলে যেন কোনোভাবে তার শান্তি হবে না। তবু সবার বারণ বলে নিজেকে আটকে রাখেন তিনি। আজকাল তিনি একটু বেশিই চুপচাপ থাকেন। কাজের পর ফিরে এসে চুপ করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কিসব যেন ভাবেন। শনিবার সন্ধ্যাবেলায় রঘু চা দিতে এসে তা লক্ষ্য করে সে বলে, "বাবু ওদিকে কি দেখছেন? আজকাল তেমন কথা বলেননা? একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন অনেকদিন তো যাননি। আর একটা কথা বলবো কিছু মনে করবেননা, এবাড়ীটা আপনি বদলে ফেলুন। ওরকম একটা ঘটনা ঘটলো সেদিন। এই জায়গাটা সুবিধার নয় রাত বাড়লে এমন সব কান্ড হয় আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না।"
রথীনবাবু হঠাৎ কিছুটা বিরক্তির সুরে রুক্ষ স্বরে বললেন, "আহ রঘু তোমার কাজ হয়ে গেলে তুমি এখন এস! আমি কোথাও যাবোনা।" রঘু মাথা নিচু করে চলে গেল। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। সেদিন ছিল শনিবার, অফিসের সবাই বাড়ি যাবে বলে আগেই বেরিয়ে গেছে। রথীনবাবু একাই বসে কাজ করছিলেন। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল তার। রোজ তিনি বাড়িতে হেঁটেই ফেরেন। এতে তার একটু হাঁটা হয়ে যায়। আজ অমাবস্যা, আকাশে চাঁদের দেখা নেই। সন্ধ্যেবেলায় নক্ষত্রের আলো এই জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের অন্ধকারকে দূর করতে অক্ষম । বাড়িতে ঢুকতেই রঘুর সাথে দেখা। সে বেরিয়ে যাচ্ছিল তাকে দেখে বলল, "বাবু আজ এত দেরি করে এলেন? আপনার জন্যে চা জলখাবার রেখেছি। আর রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। আমার আজকে একটু কাজ আছে তাই যেতে হচ্ছে। ছেলেটার শরীরটা ভালো নেই।" বলে সে বিদায় নিল। ঘরে ঢুকে রথীনবাবু ফ্রেশ হলেন। তারপর চা খেতে খেতে ফোন করলেন বাড়িতে। কথা বলার পর সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করলেন। আজসময় যেন কাটতে চায় না। হঠাৎ তার ভীষণ গরম অনুভূত হল। বাইরের পরিবেশটা আজ যেন অদ্ভুত। আকাশে জমাট মেঘ, সমগ্র পরিবেশকে আবদ্ধ করে রেখেছে। বারান্দায় এসে দেখলেন দূরে পাহাড়ের সীমারেখা বরাবর আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।আর মাঝে মাঝে কান বিদীর্ণ করা মেঘের আওয়াজ হচ্ছে। আজ যা গরম তাতে কালবৈশাখী ঝড় উঠবে বলে মনে হচ্ছে। গ্রামের দিকে কারেন্ট গেলে সহজে আসবে না। তাই তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন তিনি।
ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ প্রবল বাজ পড়ার শব্দে উঠে দেখলেন ভীষণ ঝড় উঠেছে। চারিদিকে আকাশ কালো করে এসেছে। তার পশ্চিম দিকের অর্থাৎ জঙ্গলের দিকে জানলাটা ঝড়ের দাপটে বারবার খোলা-বন্ধ হচ্ছে। রথীন বাবু উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিতে সেখানে গিয়ে দেখলেন জঙ্গলের মধ্যে সেই অপার্থিব কমলা আলো আজ যেন অনেকটা অঞ্চল বিস্তার করে রয়েছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে চোখে যেন এক ধাঁধা লেগে গেল রথীনবাবুর। ঝড়ের তান্ডব এবং আকাশে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ চমকানোর মধ্যেও তিনি দেখতে পেলেন জঙ্গলের সামনে অনতি দূরে একটি অদ্ভুত দর্শন ছায়ামূর্তি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখে তার নারীমূর্তি বলেই মনে হলো। চমকে উঠলেন তিনি সেই মূর্তি দেখে। ঘোলাটে তার দৃষ্টি, বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে সম্মোহনের ঘোর লেগে যায়। রথীনবাবু সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টির কাছে তার জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তাভাবনা সবকিছু বিসর্জন দিলেন। ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
বাগান পেরিয়ে তিনি এসে উপস্থিত হলেন ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারে। পুরোনো পাঁচিলের একটি অংশ ভেঙে পড়েছে, তিনি সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে দুর্বার গতিতে হেঁটে চললেন সেই আলো লক্ষ্য করে। কিসের টানে তিনি ছুটে চললেন তা ভাবার মতন অবস্থায় তিনি ছিলেন না। তাঁর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি কিছু না ভেবে এগোতে থাকেন সেই মায়াবী আলোর টানে। কিছুদূর আসার পর তিনি দেখতে পেলেন একটি ভাঙা পরিত্যক্ত কূপ এবং তার মধ্যে থেকেই অদ্ভুত এক আলো ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র জঙ্গলের প্রান্তর জুড়ে। সেই অদ্ভুত দর্শন নারীমূর্তিকে অবশ্য তিনি আর খুঁজে পেলেন না। তার মনে হলো তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যে আমরা কোন ঘটনার কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করি কেন এরূপ ঘটনা ঘটছে তার ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করি, রথীনবাবু সেরকম মনে মনে ভাবলেন কেন আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? কিন্তু কোনো সদুত্তর তিনি পেলেননা। মনের কৌতূহল নিরসনের জন্য এবং কিছুটা সম্মোহনের কারণে তিনি এগিয়ে গেলেন সেই কূপের দিকে। তার পরিচিত সমস্ত মানুষ তাকে যে সেই কূপের কাছে যেতে নিষেধ করেছিল, কিছুদিন আগেই যেখানে তার পূর্বতন সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে সমস্ত কথা যেন তার মন থেকে উধাও হয়ে গেছে। সেই নিশির ডাক কে কোনভাবেই যেন তিনি অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। এগিয়ে এসে ওর মধ্যে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখলেন কূপের মধ্যে কোন জল নেই। তবে নিচে সুড়ঙ্গের মতন একটা অংশ বোঝা যাচ্ছে এবং সেখানে থেকেই আসছে সেই অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গলে। অনেকক্ষণ সেই মায়াবী আলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে রয়েছেন তিনি। হঠাৎ শুনতে পেলেন নারীকন্ঠে বিলাপের সুরে কেউ কাঁদছে। এত ঝড়ের আওয়াজ এর মধ্যেও সেই বিলাপ তার তার কানে এলো। ধীরে ধীরে সেই বিলাপ পরিবর্তিত হলো কর্ণকুহর ভেদী হাহাকারে। যেন নরকের অতল থেকে ভেসে আসছে সেই চিৎকার। তারপর বিস্ফারিত নেত্রে তিনি দেখলেন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসছে ভয়াল দর্শন সেই মূর্তি যার আবছায়া একটু আগে তিনি দেখেছিলেন। বন্য পশু যেভাবে সন্তর্পণে সবার অলক্ষ্যে নিজের শিকারকে ধরার চেষ্টা করে, ঠিক সেইভাবে এক নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে যার চক্ষু রক্তবর্ণ, লালায়িত ঠোঁট এবং জিহ্বা,গায়ের চামড়া অনেকটা সাপের শরীরের মত আঁশযুক্ত,হাতে বড় বড় নখ। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পর রথীনবাবু মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং জ্ঞান হারালেন। কতক্ষন সেভাবে পড়ে ছিলেন জানেননা।
বৃষ্টির ধারায় জ্ঞান ফিরে পেতে তিনি আধো -অন্ধকারে দেখলেন ভয়ালদর্শন নারীমূর্তি যে কোনোভাবেই মনুষ্য প্রজাতি সদস্য নয়, শ্বাপদ প্রাণীর মত চারপায়ে জঙ্গলে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। বিদ্যুতের ঝিলিকে তার স্বদন্ত চকচক করছে। রথীনবাবুর মনে পড়ে গেলো অসীমবাবুর মর্মান্তিক পরিণতির কথা। হয়তো এই মায়াবীনি তাকে ডেকে নিয়ে এসে নিজের সম্মোহনের মাধ্যমে তাকে কূপের মধ্যে ফেলে তার জীবনহানি ঘটিয়েছে। মুহূর্তে মনে আসে রঘুর কথা, সে বলেছিলো বাড়িতে ভগবানের মূর্তি থাকলে তিনি বিপদ মুক্ত হবেন। তিনি মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকেন এবং সেই প্রেতনীর অলক্ষ্যে অতিকষ্টে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করেন বাড়ি লক্ষ্য করে। তিনি শুনতে পেলেন সেই ভয়ঙ্কর পিশাচিনীর রক্ত জল করা খলখল অট্টহাসি। তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন নরকের শয়তানের দাস সেই পিশাচিনি, পলায়নরত শিকারকে নিজের কুক্ষিগত করতে তার করালদন্ত বিস্তার করে ধেয়ে আসছে। ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে প্রানপনে ছুটতে ছুটতে তিনি এসে পড়েন তার বাড়ির মধ্যে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একমনে ভগবানকে ডাকতে থাকেন। সারারাত সেই প্রেতনীর পৈশাচিক হাসি তিনি শুনতে পান। সেই ভয়ানক অমানুষিক আর্তনাদ উপেক্ষা করে কোনোক্রমে রাত্রিটা কাটান রথীনবাবু। ভোর হতেই রথিনবাবু গ্রামের দু একজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে যান হরিহর মাস্টারের বাড়ি। তিনি এত ভোরে রথীনবাবুকে দেখে অবাক। রথিনবাবু সবিস্তারে তার সাথে গতরাতে ঘটে যাওয়া অপার্থিব ঘটনাটি বর্ণনা করেন। সব শুনে আতঙ্কিত হরিহরবাবু বলেন ,"চলুন আপনাকে একজনের কাছে নিয়ে যাই, তিনি হয়ত আপনার মনের অন্ধকার কিছুটা দূর করতে পারবেন।"
তারপর তাকে গ্রামের আদিবাসিন্দা বৃদ্ধ ভোলানাথবাবুর কাছে নিয়ে আসেন হরিহরবাবু। রথীনবাবু গতরাতের সমস্ত ঘটনা জানাতে তিনি বললেন, "অনেক বছর আগে এই গ্রামে ওই জঙ্গলে বসবাসকারী এক মহিলাকে একবার গ্রামবাসীদের ওপর ডাকিনি বিদ্যা প্রয়োগ ও সম্মোহনের মাধম্যে গ্রামের মানুষের ক্ষতিসাধন করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়লে, ডাইনি সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মেরে ওই পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দেয়া হয়। তবে সে মারা যাবার আগে অভিশাপ দিয়ে যায়, যে তার বিচরণক্ষেত্রে আসবে তার মৃত্যু ঘটবে তারপর থেকে আমরা কেউ আর ঐ জঙ্গলে যাই না। ওই বাড়িতেও রাত্রি বাস করি না কারণ ওই পিশাচিনী একমাত্র মধ্যরাতে সক্রিয় রূপ ধারণ করতে পারে। অজান্তে অনেকের বেঘোরে প্রাণ গেছে ওই মরণকূপের মধ্যে। আগের ম্যানেজারবাবুকে বাড়িটি ভাড়া নেবার আগে গ্রামবাসীরা সতর্ক করেছিল ওখানে না থাকতে, কিন্তু কথা শোনেনি তার ফলস্বরূপ তাকে প্রাণ দিতে হয়। আপনাকেও হয়তো অনেকে সচেতন করে থাকবে তার পরেও আপনি সেই অভিশপ্ত স্থানে গেলেন।"
এতক্ষণে রথীনবাবু মুখ খুললেন,"তিনি বললেন কাল রাত্রে যা ঘটেছে তা সবটাই আমার অনিচ্ছাকৃত। আমি সব শুনেছিলাম, কখনোই ওই জঙ্গলে যেতাম না তবে ওই মায়াবী আলোর সম্মোহন এবং ওই পিশাচিনী নিশ্চয়ই কোন জাদু জানে যার মাধ্যমে সে আমাকে ওই মরণকূপের কাছে টেনে নিয়ে যায়। বহুকষ্টে এবং অতর্কিতে ওর নজর এড়িয়ে আমি সেখান থেকে ভগবানের দয়ায় পালিয়ে আসতে পারি। ও হয়তো আমায় মৃত ভেবে ভুল করেছিল। না হলে কালকে কি হতো আমি নিজেই জানিনা।"
"আপনি সত্ত্বর ঐ বাড়ি পরিত্যাগ করুন।"
ভোলানাথ বাবু তাকে সবিনয়ে অনুরোধ করলেন। রথীনবাবু সেদিনই রঘুকে সঙ্গে করে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ওই অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে অনেক দূরে তিনি অন্যত্র একটি বাড়িতে চলে গেলেন।
রোজ মধ্যরাত্রিতে 'নাড়াবোড়ার জঙ্গলে ' পরিত্যক্ত মরণকূপের মধ্যে দিয়ে নরকের পাতাল সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা সেই বীভৎস দেহের ডাইনির অতৃপ্ত প্রেতাত্মা ওৎ পেতে থাকে তার নতুন শিকারের অনন্ত অপেক্ষায়।
Comments