ছোট গল্প - জীবনাঞ্জলি || লেখক - চন্দন চক্রবর্তী || Short story - Jibonanjali || Written by Chandan Chakraborty


 

 


ভ্যাটের গাড়ির ছেলেটার মনটা ভালো । সামনের ফাঁকা জায়গায় করপোরেশন ভ্যাট ফেলা বন্ধের নোটিশ দিয়েছে । গতকাল গাড়ি আসে নি । আদরী উপবাসী থেকেছে । ছেলেটা এই পথেই যাচ্ছিল । আদরীর কষ্ট সে বুঝতে পেরেছে । গাড়িতে তুলে অনেকটা পথ এসে একটা নতুন জায়গায় নাবিয়ে দিয়ে গেল । 


সামনে একটা ভ্যাট ফেলার জায়গা আছে । গাড়ি এখন ওই রাস্তায় যাবে না । নো এন্ট্রি চলছে । কিন্তু ওরা যে ভাবে বলে গেল সব যে ঘুলিয়ে গেছে ! 


বেলা চড়ে মাথার ওপর রোদ । হাঁটতে হাঁটতে আদরী সামনে একটা পার্ক দেখতে পেল । পার্কের মাঝে বিরাট পূজার প্যান্ডেল । ঢাক বাজছে । অনেক লোকের সমাগম ।   


শরীর আর দিচ্ছে না । মাজা ভেঙে আসছে । লাঠিতে ভর দিয়ে সে আর কত দূর যেতে পারে ! গতকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি । মায়ের ওপর ভরসা রেখে সে সেখানে বসে পড়ল । 


সেই কবে বাপের ঘর তাকে ছাড়তে হল । তখন আদরী সবে বারোয় পড়েছে । সেই থেকে তার চলার শুরু । আজ আশি ছুঁই ছুঁই । তার জীবনে আর নিশ্চিত ঠিকানা হল কই ! 


আদরীর ছোট থেকেই মা নেই । বাপ লোকের জমিতে জন খাটতো । অভাব ছিল বারো মাস । তবু আধপেটা খেয়ে,বনে বাদাড়ে ঘুরে, এটা ওটা এনে,তাদের চলছিল । কিন্তু যেবার খরা হল । বাপটা শহরে এলো । এখানে এসে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হল । 

আদরী তখন নয় কি দশ । 


বাপটা এদিক ওদিক ঘুরে তেমন সুবিধা করতে পারতো না । আদরী বস্তির আর সব কচিকাঁচাদের সাথে ডাস্টবিন থেকে পচা গলা খাবার কুড়িয়ে আনতো । তবু যা হোক চলছিল ।  শেষে বাপটা হাঁপের রুগী হয়ে কাজে বেরনো বন্ধ করল । ঘরে বসে আর কদিন চলে । একদিন দালাল এসে আদরীকে কিনে নিয়ে গেল । 


দালালের গোপন আস্তানায় আদরীকে কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছর । বদ্ধ ঘরে তার দম আটকে আসতো । তিন বেলা যা খাওয়া দিত,ভালো করে পেট ভরতো না । তার মধ্যেই,সে ভালো করে ফোটার আগেই, রাতে তাকে দালালের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে । কোন কোন দিন,দিনের বেলাও বাদ যেতো না । আদরীর কান্না ঠেলে আসতো । এক একবার মনে হয়েছে পালিয়ে যাবে । কিন্তু তেমন কোন সুবিধা সেই ঘরে ছিল না । সে মৃত্যুর কথাও ভেবেছে । কিন্তু পেরে ওঠে নি । 



আদরীকে এবার আনা হল এক মাসির ডেরায় । মাসি তাকে ঘর দিল । তার নতুন নাম হল । যে মাটি না হলে উমার পূজো হয় না সেখানে সে কমল হয়ে ফুটল । 


কমল হয়েই সে রোজ রাতে সেজে রাস্তায় দাঁড়াতো । চল্লিশটা বছর সে সেখানে কাটিয়ে যখন বেরিয়ে এলো তখন শরীর জুড়ে তার জরা । খদ্দের আসা আগেই বন্ধ হয়েছে,তার দাম ফুরিয়েছে । 


শরীরে যখন প্রথম প্রেমের সাড়া পেল তখনও নিবেদন করার মত মানুষ পেল কোথায় ! কথাটা মাথায় এলেই নগেন ড্রাইভারের কথা মনে পড়ে । টানা তিন বছর নগেন রাতে একবার আসতোই । একবার তিনদিন তিনরাত তার ঘরে কাটিয়ে গেছে । আদরীর সেবার গায়ে ধুম জ্বর । নগেন তাকে ওষুধ এনে দিয়েছিল । বাইরে থেকে রান্না খাবার এনেছিল । জ্বরের মধ্যেও আদরী নগেনকে আসন পেতে শাল পাতায় খাবার বেড়ে যত্ন করে নিজ হাতে খাইয়েছিল । তারপর থেকে নগেন এলে আদরী সেদিন ঘরে অন্য খদ্দের ঢোকাত না । 


রাতে নগেন,সে,পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটিয়েছে । দুপুরে চান করে নগেনকে স্মরণ করে,সিঁদুর পরে আয়নায় নিজের মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতো । এই নিয়ে মাসির কাছে কথা শুনতে হয়েছে । সবার ওপরে যেটা,সে নগেনের সন্তানকে পেটে ধরেছে ।

তারজন্য তাকে যে অমানুষিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে,তা ভোলার নয় । তার শরীর নষ্ট হয়েছে,রোজগার নষ্ট হয়েছে,অনেক খদ্দের কমেছে । তবু সে মা ডাক শুনেছে । ছেলেকে সে ঠিক মত আদর যত্ন করতে পারে নি । খদ্দের ঘরে এলে ছেলেকে মাসির কাছে রেখে আসতে হত । সে মাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে চাইতো না । মা মা করে  চিৎকার করতো । মায়ের মনে উথাল পাথাল ঢেউ উঠতো । হায় ভগবান,আদারী তখন চোখ মুছে খদ্দের বুকে নিয়ে শুয়ে আছে ! তাই বুঝি ছেলেটা একটু বড় হতেই মায়ের ধার ঘেঁষতো না !


হঠাৎ সেই নগেনও কোথায় হারিয়ে গেল ! অনেকগুলো রাত বিনিদ্র থেকে সে খবর পেয়েছিল নগেন গাড়ি একসিডেন্টে মারা গেছে । রাতে শুয়ে সে চোখের জল ফেলেছে । 


তার জীবনে সেই শেষ বসন্ত এসেছিল ।

অনেকগুলো বছর গড়িয়ে শরীরের ঘ্রাণ হারিয়ে সে তখন সর্বশান্ত । ব্রার্ত্য হিসাবে তার নাম উঠল খাতায় । শেষে বীরেনবাবুর চেষ্টায় তার বাড়ি গিয়ে তার ঠাঁই মিলল । লোকটা তার ঘরে যৌবনকালে বার কয়েক অতিথি হয়েছিল । কদিন অন্তর ঘর পাল্টাতো ।  বীরেনবাবুকে তখন তার খারাপ মানুষ মনে হত । সেই লোকটাই তাকে বাড়িতে ঠাঁই দিল । সারাজীবন লোকটা বিয়ে না করে তাদের ওখানে যাতায়াত করে কাটিয়েছে । 


বাগান বাড়ির এক কোনে তার টিনের চালা । তার কাজ ছিল বিরাট বাড়িটা ধোয়া পোছা করা ।  

বছর দশেক কাটার পর শরিকী বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল । বীরেনবাবু ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেলেন । 


আদরীকে এবার পায়ের তলার মাটি হারিয়ে পথে নামতে হল । সারাদিন ভিক্ষা করে অনেকগুলো বছর চলার পর আর পারছিল না । অবশেষে ময়লা ফেলার স্থানে কোন ঠিকানা বানিয়ে তার চলতে লাগলো । মাঝে মাঝেই তাকে তার জন্য ঠিকানা পাল্টাতে হয়েছে । 


আজ যখন সে ঠিকানা হারালো শরীর একেবারেই পড়ে গেছে । আদরী ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল । হাতে পায়ে ঝি ঝি ধরেছে । মাথা ঝিমঝিম করছে । সে বেশ বুঝতে পারছে তার যাবার সময় হয়েছে ।


এ জীবনে তার কোন অনুযোগ নেই । বাপের ঘরের দেওয়া আদরী নাম তার শৈশবেই ঘুঁচেছে । পরবর্তীতে যে দোরের মাটি নিয়ে মায়ের পূজার শুরু,আদরী সেই মাটিতে কমল হয়ে ফুটেছে । তার দেহ মধুকরের পায়ে ক্ষত বিক্ষত হলেও তার মন আজো সদ্য প্রস্ফুটিত কমলের মত পবিত্র ।  


আদরী মন কমলকে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে চিরকালের মত চোখ বুজল ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024